![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক পিচ্চিকে আমি নিয়মিত পড়াতে যাই। ছাত্রের মা অনেক বড়লোক মানুষ। বাবাও ভাল চাকরি করেন। ছাত্র তাঁদের একমাত্র ছেলে। ছাত্র আমার দূরসম্পর্কের কাজিন। প্রচন্ড আদর আর স্বাধীনতা দিয়ে তাকে বড় করা হচ্ছে। চাচা-চাচী উভয়ই ভারতীয় চ্যানেলগুলোর নিয়মিত দর্শক। তাঁরা টিভি দেখে আর আড্ডা মেরেই তাঁদের অবসর সময় কাটান। ছোটভাই সিক্সে পড়ে। তার লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ অনেক কম। বেশীরভাগ সময়ই দুষ্টামি করে, টিভি দেখে, খেলাধুলা করে সময় কাটায়। তার পড়াশোনার ব্যাপারেও তার বাবা-মা উদাসীন। অনেকগুলো টিউশান দিয়ে ছেলের পড়াশোনার দায়দায়িত্ব শিক্ষকদের উপর ছেড়ে দিয়ে তাঁরা ভারমুক্ত হয়েছেন।
টিউশনির প্রথম দিকে গিয়েই দেখলাম ছাত্র সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকনির্ভর। নিজে থেকে কোন নতুন অংক সমাধান করার মত তেমন কোনো উদ্যম বা আগ্রহ নাই তার মধ্যে। শিক্ষক তো আছেই তার সবরকম সমস্যার সমাধানকারী হিসেবে। নিজের মাথা খাটানোর কোন প্রয়োজনই নাই। বাজে শিক্ষাব্যবস্থা সবসময় কল্পনা করার, নতুন কিছু চিন্তা করার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। আর সার্বক্ষণিক টিভি দেখে দেখে সে কল্পনা করার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই জিনিসটা পড়াশোনায় খুব বেশী দরকার।
আমি তার অমনোযোগীতার কারণ হিসেবে নিরানন্দ পাঠ্যবইয়ের কথা বিবেচনায় নিলাম। তাকে বইপাঠে আগ্রহী করতে বাঙলা পাঠ্যবইয়ের গল্প আর কবিতাগুলো আগ্রহ করে পড়ার উপর জোর দিলাম। ইংরেজিতেও সে ভয়াবহ খারাপ। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমি একটা সমাধানই খুঁজে পেলাম।
এখানে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান লাইব্রেরীর বাস নিয়মিত আসে। আমি নিজে সেখানকার সদস্য, তাকেও সদস্য হতে উৎসাহিত করলাম। তার বাবাকেও আনন্দ ও আগ্রহের সাথে লেখাপড়ার জন্য এর গুরুত্ব বোঝালাম। তিনিও রাজি হলেন। পরে নিয়মিতভাবে ছাত্র তার লাইব্রেরীতে সদস্য হওয়ার ডেট পেছাতে লাগল। পরে জানলাম, এসব ‘অপ্রয়োজনীয়’ বই পড়ার জন্য যৎসামান্য চাঁদাটাও ছাত্রের বাবা দিতে রাজী নন। কিন্তু তিনি তাঁর সন্তানের ভালো ফলের প্রত্যাশী। সারাদিন পাঠ্যবই মুখস্ত করে অনেক ছেলেমেয়ে প্রতিবছর ভালো রেজাল্ট করে। অনেকেই ভালো চাকরী পায়। আমার মনে হয়, তিনিও এইজাতীয় চিন্তা থেকেই ছেলেকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বই পড়া থেকে বিরত রাখলেন। লেখাপড়া যেহেতু চাকরী পাওয়ার জন্য, তাই ‘দরকারী’ বইগুলোই বেশী বেশী পড়ার দরকার। আমিও হয়তো তাঁকে এর গুরুত্ব ভালোভাবে বোঝাতে পারিনি। এইরকম ভ্রষ্টচিন্তাশীল ‘শিক্ষিত’ গার্জেন বাঙলাদেশে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ। বাঙলাদেশের শিক্ষার অতীত-বর্তমান উনাদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছে। যদি ভবিষ্যতেও এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তাহলে বাঙলাদেশ হাজার হাজার চাকুরে ঠিকই তৈরি করবে, কিন্তু অশিক্ষিত চাকুরের অশিক্ষার মূল্যও দুর্নীতিবাজদের স্বর্গভূমি বাঙলাদেশকেই পরিশোধ করতে হবে। তারা শিক্ষাগ্রহণ করে চাকরির জন্য। আর চাকরি করে অর্থের জন্য। পুনরাবৃত্তি, চাকরি করে অর্থের (বৈধ/অবৈধ) জন্য। জাগতিক লাভ ছাড়া এক কদমও চলে না। দেশের জন্য তাদের চাইতে বড় শত্রু আর কে হতে পারে?
©somewhere in net ltd.