![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যখন জানলাম যে ঐশী অাসলে ঐশী ঘোষ, অামার ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক চেতনা একটা বড়সড় ঝাঁকুনি খেল।
.
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই মেয়েটাকে চোখে পড়ে। হালকা-পাতলা গড়নের মাঝারি উচ্চতা। খাঁটি বাঙালি মেয়ের কোমল গায়ের রঙ তার। বন্ধুবান্ধবের সাথে দলবেঁধে যখন হাঁটত, অনেকদিন অামি খেয়াল করেছি। গর্বিত রাজহাঁসের অাত্মবিশ্বাসে হেঁটে চলত। তাঁর সহজ, সাবলিল শরিরী ভাষা তার একটা শোভন, পরিষ্কার ব্যক্তিত্ব তৈরি করত। অত্যন্ত সুন্দর চোখ ছিল তার। প্রথমে ধারণা করেছিলাম, চোখের কোয়ায় কাজল দেয়া থাকত। পরে বুঝতে পারি, সে কোনো কাজল ব্যবহার করে না। প্রাকৃতিক কাজলে, কোনো এক নীরিহ লাজুক বান্দার মন অধিকারের উদ্দেশ্যেই সম্ভবত, সৃষ্টিকর্তা তাকে সাজিয়েছিলেন।
.
ব্যাচে তখনকার নতুন বন্ধুদের কাছে অামি পরিচিতি পেয়েছিলাম ফেসবুকে তাদের ভাষায় ‘গুরুগম্ভীর’, ‘জ্ঞানগর্ভ’ বিভিন্ন স্ট্যাটাস দিয়ে। এমনিতেই ছেলে হিসেবে অামি খুব সংকুচিত, অসামাজিক। বিচ্ছিন্ন, বিচ্ছিরি কলেজ জীবন শেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দেই, অামি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম অনেক বন্ধু বানাবো, সবার সাথেই মেলামেশা করব, বয়ঃসন্ধির অাগে স্কুল জীবনে যেমনটা ছিলাম। বয়ঃসন্ধির পরিবর্তন অামাকে একা করে দিয়েছিল। অামি অামার বয়ঃসন্ধির সংকোচ অামার কলেজের সংকীর্ণ ক্যাম্পাসেই সাপের পুরোনো চামড়ার মতো রেখে অাসতে চেয়েছিলাম। এই উদ্দেশ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অালো-বাতাস, গাছ-গাছালি, কাঠবিড়ালি অার ফুলভর্তি বিশাল ক্যাম্পাসে নতুন বন্ধুদেরকে অাপন করতে চেয়েছিলাম। ফেসবুকের যুগে অামি খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুদের মাঝে পরিচিত হই। অামার ‘জ্ঞানগর্ভ’ ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো বন্ধুদের মধ্যে অামাকে খ্যাতি এনে দেয়। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ভিন্নধারার চিন্তাশীল এবং বইপড়ুয়া বন্ধুদের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে উঠি। অামার বিচ্ছিন্নতা অার একাকীত্ব থেকে তারা অামাকে অনেকটাই মুক্তি দিয়েছিল। তাদেরকে অামি ভালোবেসেছিলাম। তারাও হয়তো অামাকে।
.
বন্ধুদের সাথে নানা বিষয়ে মুক্ত অাড্ডা, রসালাপ হত। চিন্তার অাদান-প্রদান হত। অামি মেয়েদের সৌন্দর্যকে ভালোবাসতাম। বন্ধুদেরকে প্রায়ই মজার ছলে বলেছি, অামার একটা বিশেষ স্পর্শকাতর ইন্দ্রিয় অাছে যেখানে সবসময় সৌন্দর্য ধরা পড়ে। অাসলে, অামার সোপার্জিত জ্ঞান অামাকে অামার তখনকার উষ্ণ বয়সের কঠিন প্রেক্ষাপটেও মেয়েদের প্রতি কামবোধকে ছাড়িয়ে সৌন্দর্যবোধকে বিকশিত করতে সাহায্য করেছিল। অামি মেয়েদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে শিখেছি, তাদের কারো অাত্মার কান্তির পরিচয় পেলে বর্তে গেছি। যদিও সবকিছু তফাতে থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও অামার সংকোচ কাটেনি।
.
এর মধ্যে কখনই ঐশীর চোখকে অামি ভালোবেসেছিলাম। তাকে প্রায়ই দেখতাম। একদল বন্ধু-বান্ধবীর সাথে দল বেঁধে সে ক্লাসের অবসরে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। তাদের বন্ধুদের মধ্যে খুব অন্তরঙ্গতা ছিল। একসময় খবর পাই, তার বন্ধুদের একজনকে সে প্রেম প্রস্তাব দিয়েছে। বন্ধু প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল। অাশ্চর্য হয়ে খেয়াল করেছি, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বে কোনো ফাটল ধরেনি।
.
এই ঘটনার কিছুদিন পরে সেই অদ্ভূত অাঘাতটা অাসে অামার জীবনে। তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত পরিবেশে অামরা কয়েকজন বন্ধুরা মিলে অামাদের বুদ্ধিকে তার সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। এই কঠিন কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছি অামি নিজেই। অামি, অামার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের ছোট্ট দলটা তখন অামাদের রক্ত থেকে সাম্প্রদায়িকতার বীজ, যা অামরা অামাদের পূর্বপুরুষ থেকে এবং পরিবেশ থেকে পেয়েছি, অপসারণ করতে চেয়েছিলাম। জনগণের অর্থে শিক্ষালাভ করে জনগণের কাছে, দেশের কাছে নিজেদের দায়বদ্ধতা অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক ইতিহাস থেকে, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে নিজেদের শক্তিশালী করতে শুরু করেছিলাম। মানুষকে, মানুষের সৌন্দর্যকে, মনুষ্যত্বকে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। ঠিক ঐরকম একটা মুহুর্তে, সম্ভাব্য নতুন পৃথিবীর কল্পনাবিলাসী এক ছোট্ট তরুণদলের স্বঘোষিত নেতার মনের ভেতরে স্ববিরোধী, অন্ধকারযুগীয় এক অস্বস্তি দুঃখের মত ছড়িয়ে পড়ল। অামার সামনে হঠাৎ ঐশী ঘোষ হাজির হলো। ঐশী কিভাবে ‘ঘোষ’ হয়, এটা বিচার করার সময় হয়নি অামার। এই বিভ্রম সৃষ্টির জন্য তার পিতা-মাতাকেও দোষারোপ করার সময় পাইনি অামি।
.
অামি ভেতর থেকে দূর্বল হয়ে পড়ি। এই দূর্বলতা ঐশীর প্রতি আর নিজের উপর অাস্থার দিক থেকে যুগপৎ কাজ করেছিল। অামি ঐশীকে তার সেই বন্ধুর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়াটার নতুন অর্থ ধরে নিই। প্রাথমিক অাঘাত সামলে ওঠার পর তার প্রতি সহানুভূতিতে মন অাচ্ছন্ন হয় অামার।
.
ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি, অামাদের সংখ্যালঘু বন্ধুরা তাদের এবং অামাদের এই মাতৃভূমিতে কেমন একটু বিচ্ছিন্ন, দূর্বল, অাত্মবিশ্বাসহীন চলাফেরা করে। হয়তো তাদের মনে হয়, তারা খুব বেশি নিরাপদ নয়, এই বাঙালির দেশে। তাদের শরীরি ভাষায় হীনমন্যতা লক্ষ্য করেছি অামি। এই একটা মেয়ে দেখলাম, যাকে কখনো দূর্বল সংখ্যালঘু বলে এক মুহুর্ত বিভ্রমের সুযোগ ছিলনা অামার।
.
তার এই নতুন পরিচয় প্রকাশে হঠাৎ এত ব্যথাবোধ হল কেন অামার? অামার অজান্তেই কি কোনো একটা গোপন স্রোত বইছিল অামার অস্তিত্বে? সেখানে কি সেই রাজহাঁস গর্বভরে মৃদু মুদু পানি কেটে চলছিল এতদিন? তার ভিন্ন সাম্প্রদায়িক পরিচয় প্রকাশ না হলে কি সেই রাজহাঁস অামার অস্তিত্বের মধ্যে অজান্তেই ফসিল হয়ে যেত? তাকে কি কখনো তাহলে সচেতনভাবে ভালবাসতে পারতাম না?
তখন সময়টা ছিল বসন্তের। অাজ মনে হয়, সেদিন বয়ঃসন্ধির প্রথম প্রহরের মত বসন্ত অামার রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়েছিল। অামি তাকে ভালোবেসেছিলাম। সৌন্দর্যের অাকর্ষণ অার ভালোবাসার টানের পার্থক্য অামি সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম। ভালোবাসা খুব বাঁধনে জড়াতে চায়।
.
তারপর? তারপর অামার জীবনের কঠিন করুণ ব্যর্থতার গল্প। এই লজ্জার পরিচ্ছেদ অামি ভুলে যেতে চাই।
.
একদিন, অনেকদিন পর, বন্ধুদের সামনে শপথ করে বলেছিলাম, বিয়ে করলে কোন এক সনাতনী কন্যাকেই বিয়ে করব। এটাতে হয়তো কিছু পাপমোচন হবে। বন্ধুরা শুধু হেসেছিল।
©somewhere in net ltd.