নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাটির দেশের কথা

জাকারিয়া জামান তানভীর

আত্মিক এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখি।

জাকারিয়া জামান তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

মে দিবস ’১৩: শ্রম, শ্রমিক ও আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপট

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:১৮





শ্রমের উন্মেষ ঘটেছে মানব জাতির আগমনের সাথেই। কাজ সমাধা করতে যেমনি শ্রম দিতে হয় ঠিক তেমনি শ্রমিকেরও প্রয়োজন হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শ্রমের বিভাজনও তৈরি হয়েছে। শ্রমিকেরা তাদের স্বীয় দক্ষতাবলে তাদের শ্রমকে বা সম্পর্কিত পেশাকে বিশেষায়িত করে তুলতে পেরেছেন। শ্রম বাজারে আমরা জুতা মেরামতকারীকে চামার, মৎসজিবীকে জেলে, ঝাড়ুদারকে মেথর বলে সম্মোধন করতে শিখেছি। অনেক সময় জাত পাতের বিভাজন পেশাজীবিদের শ্রমের উপর এসে ভর করে শ্রমিকের শ্রমকের উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নির্ণয় করতে শিখিয়েছে। আমাদের সমাজে এখনও সব শ্রেণীর পেশাজীবিরা সমান সম্মান আদায় করে নিতে পারেনি! অফিস আদালতের আধিকারিকরা যে সম্মান পান বা আমরা দেই তার ছিটেফোঁটাও আমরা মেথর, কুলি বা রিকশাওয়ালাকে দেয়ার প্রয়োজন মনে করি না! কারো প্রতি বিরাগভাজন হলে অনেক শিক্ষিত লোকজনও অবলিলায় “রিকশাওয়ালার বাচ্চা” বা “মেথরের বাচ্চা” বলে গালি দিয়ে বসেন। আমরা যারা ভদ্রলোক বা ভদ্র সমাজের প্রতিনিধি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিত সব পেশার মানুষদের এক পাল্লায় মাপার কথা কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যে অনেকটা ভিন্ন তার প্রমান হরহামেশাই পাওয়া যায়। আর এই ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা প্রশ্নের দাবি রাখে। এরূপ মনোভাব সমাজের সব পেশার মানুষদের এক সুতায় বাঁধতে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথা জাতীয় সমৃদ্ধি অনেকটা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে বলে মনে করি।



চাকরির সুবাদে দেশের সর্ব উত্তরের কয়েকটি জেলায় আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। ঐসব জেলায় বেশ কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থান আমার চোখে পড়েছে। নিতান্তই গরিব এইসব মানুষদের মাঝে যে হৃদ্যতা দেখেছি তাতে আমি বারবার অভিভূত হয়েছি। কিন্তু এইসব নরম হৃদয়ের মানুষরা যে কিভাবে তাদের নিজেদের কমিউনিটির মানুষদের দ্বারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছেন তা না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। নিগৃহের এই প্রচলিত ধারা আজকের এই আধুনিক সমাজেও সমানভাবে লক্ষণীয়! এইসব হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের সাথে উচ্চ বর্ণের পরিবারের শিশুরা একসাথে পাঠ নিতে অনিহা দেখায়। এমনকি শিশুরা তাদের সাথে বসতে পর্যন্ত চায় না। জাত পাতের বিভেদ এতটা স্পষ্ট যে ধর্মীয় আচার ব্যাবস্থা এক হওয়ার পরও তারা একে অন্যকে এড়িয়ে চলে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে শুধু পৈত্রিক পেশার কারনে তারা অন্যায় আচরনের শিকার হচ্ছে। চামাড়, নাপিত, জেলে বা মেথররা না পারছে পেশা বদল করতে না পারছে এসব থেকে রেহাই পেতে। সমস্যাটা যতটা তাদের তৈরি করা তার চেয়ে আরও বেশী দায়ী হচ্ছি আমরা। আমরাইত তাদের আপন করে নিতে পারিনি, তাদের শ্রমকে প্রকৃত স্বীকৃতি দিতে পারিনি। দেশের সব নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে এমন কথার বাস্তব প্রতিফলন করতে রাষ্ট্রও ব্যার্থ হয়েছে।



ব্রিটিশেরা আমাদের চা পানে অভ্যস্থ করেছিল। চা চাষ খুবই শ্রমসাধ্য কাজ যা এই তল্লাটের মানুষদের দ্বারা সম্ভব না বিধায় ব্রিটিশরা ভারতের অনেক জায়গা থেকে ভালো কাজ দেয়ার নাম করে দেশের সিলেট অঞ্চলের চা বাগানগুলিতে প্রতিস্থাপন করেছিল। সেই থেকে তারা খেটে যাচ্ছে। তাদের কথাবার্তা, সামাজিক রীতিনীতিতে এখনও তাদের পূর্বপুরুষদের ছাপ রয়ে গেছে। চা বাগানে বছরের সব সময় কাজ থাকে না আর কাজ থাকলেও যে পরিমান মজুরি তারা পায় তা দিয়ে সুস্থ জীবন যাপন করা ধারনার অতীত। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা অবিচারের আগুনকে চাপা দিতে তারা প্রায়ই দারস্থ হয় মাদকের। সমাজের অনেক কাছে থেকেও তারা যেন সমাজ থেকে অনেক দূরে। তাদের নতুন প্রজন্মও এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। চা শ্রমিকরা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এতটাই পিছিয়ে যে তাদের জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় আনা এখন প্রায় দুঃসাধ্য। হাজার কোটি টাকার চা শিল্পের মালিকেরা সি.আই.পি’র মর্যাদা পান আর শ্রমিকেরা উন্নয়নের ধারা থেকে পিছিয়ে রয়েছে কয়েক যুগ! বহুজাতিক কোম্পানির সুন্দর মোড়কে উপস্থাপন করা ভালো চায়ের দামের কতটুকু ভাগ্য বিড়ম্বিত চা শ্রমিকদের হাতে পৌছায় তা সহজেই অনুমেয়।



মিডিয়ার বদৌলতে দেশের প্রধান রপ্তানিখাত গার্মেন্টস শিল্পের অবস্থাত আমাদের সবার নখদর্পণে। এই শিল্পটি প্রধানত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। ঢাকা ও চট্টগ্রাম দেশের প্রধানতম শহর আর ঢাকার পাশেই নারায়ণগঞ্জ জেলার অবস্থান। সেলাই শ্রমিকদের অনেকেই দুর দুরান্তের গ্রাম থেকে শুধু একটু সাচ্ছন্দের আশায় গরিব আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে রেখে এসে এই বড় শহরগুলিতে ঠাই নিয়েছে। শ্রমিকদের যে বেতন দেয়া হয় তা খুবই অপর্যাপ্ত। থাকা খাওয়ার খরচের পর তাদের হাতে যে টাকা থাকে তা দিয়ে মাস শেষ হয়না, বাড়িতে টাকা পাঠানোর কথা তারা চিন্তাও করতে পারে না। আর এখন পর্যন্ত কত শত শ্রমিককে যে আগুনে প্রান দিতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই শিল্পের সাথে কম করে হলেও কোটি খানেক মানুষের ভাগ্য জড়িত আছে কিন্তু সব কিছু যেভাবে চলে তা দেখে অবাক হতে হয়। এইত গেল বছর তাজরিন গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে ১১৫ জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে! আগে ও পরে আরও অনেক কারখানায় আগুন লেগেছে, শ্রমিকদের প্রান যাচ্ছে কিন্তু কারো যেন টনক নড়ছে না! অগ্নি নির্বাপণের সাথে জড়িত প্রশাসকদের হিসাব মতে প্রায় ৮৫% কারখানা আগুনে ভস্মীভূত হওয়ার ঝুকিতে আছে! তারপরেও শ্রমিকের প্রান রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসছেনা, যা খুবই হতাশার। ভাঙ্গা বিল্ডিংয়ে কাজ করতে বাধ্য করায় ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহ দুর্ঘঠনায় এই পর্যন্ত ৫০০’র বেশী শ্রমিক নিহিত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩ হাজারেরও বেশী। এইসব খামখেয়ালিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে গরিব সেলাই শ্রমিকদের নিয়ে চিন্তা করার বা শ্রমের মূল্য দিতে জানা লোকের বেশ অভাব আছে। আগুনে পুড়ে, বিল্ডিংয়ের নিচে চাপা পড়ে বা পদদলিত হয়ে মৃত্যু বরণ করলে কেবল সামান্য ক্ষতিপূরণেই যেন সবকিছু ঠিক হয়ে গেল! যার যায় সেই বুঝে হারানোর বেদনা। মালিক আর সরকারপক্ষ এইসব হতদরিদ্র শ্রমিকের ব্যাথা বোঝার ক্ষমতা রাখে না। একেত কম মজুরি তার উপর কর্মক্ষেত্রে প্রান যাওয়ার ভয় এই দুয়ে মিলে এদের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। আমরা কবে যে এদের শ্রমের মূল্য দিতে শিখব?



উন্নত বিশ্বে শ্রমিকের পরিচয় না বরং তার দেয়া শ্রমকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। দিন শেষে শ্রমিককে মানুষ হিসাবেই দেখা হয়। পশ্চিমা দেশগুলির অর্থনীতি উন্নত হওয়ার দরুন তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে অনেকগুন বেশী কিন্তু তারপরেও শ্রম বিক্রি করা মানুষগুলি একে অপরকে কখনও নিচু করে দেখে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা হল অনেক আগ থেকেই আমরা সব পেশাকে সমান গুরুত্ব দেইনি বা দিতে শিখিনি। পারিবার এবং সেই সাথে সামাজিক শিক্ষার অপ্রতুলতা এখানে সমানভাবে দায়ি বলে মনে করি। আমরা যদি গৃহপরিচারিকার সাথে ভালো ব্যাবহার করতে শিক্ষা দেয়া হত, হতদরিদ্রের সাথে যদি সদয় ব্যাবহার করতে বলা হত তাইলে পরিস্থিতি অন্যরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। পারিবারিক গণ্ডি ছাড়িয়ে আমরা যখন বাইরের জগতে পা বাড়াতাম তখন সব শ্রেণী পেশার মানুষদের এক রকম দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থাকত। কিন্তু এরূপ চিন্তা চেতনা সব পরিবারেই অনুপস্থিত আছে বলে প্রতীয়মান হয়। তাইত বাইরে বেরুলে ঐক্যের বদলে বিভেদ চোখে পড়ে বেশী, সাম্যের বদলে শোষণ অনুভুত হয় বেশী। শ্রমের মূল্য দেয়া ব্যাতিত কোন সভ্যতা বা জাতির অগ্রগতি হয়নি। উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে আজকে আমাদের যে পরিচিতি অতি শিগ্রয়ই তার উন্নয়ন সম্ভব সেক্ষেত্রে আমাদেরকে শ্রম ও শ্রমিকদের যথাযোগ্য সম্মান দিতে শিখতে হবে। সবকিছু রোবট দিয়ে তৈরি বা সাজানো সম্ভব নয় তাই মানুষের হাতকে স্বীকৃতি দিতে হবে নইলে উন্নয়ন সেটা পারিবারিক হউক বা রাষ্ট্রীয় অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী বলে মনে করি। মহান মে দিবসকে সামনে রেখে আমারা প্রতিজ্ঞা করি শ্রমিকের শ্রমকে যথাযথ সম্মান দেয়ার, তাদের কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ রাখার। ধন্যবাদ।



(রি-পোস্ট)



সুনামগঞ্জ, এপ্রিল ৩০, ২০১৩

[email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.