নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যের সন্ধানে ও শান্তির অন্বেষায় ...

জোবাইর

বিনয়ী মূর্খ অহংকারী বিদ্বান অপেক্ষা মহত্তর।

জোবাইর › বিস্তারিত পোস্টঃ

তালিবান, আল-কায়েদা ও নাইন-ইলেভেন

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৫২



সন্ত্রাস এখন কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা জাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের নেটওয়ার্কের কথা উঠলেই যেসব নাম আগে আসে সেগুলো হল তালেবান, আল-কায়েদা, ওসামা-বিন লাদেন, সেভেন ইলেভেন ও আই এস এস। আজ থেকে ১৮ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা হয়েছিল। টুইন টাওয়ারে দুটি উড়োজাহাজের আঘাত হানার দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখে বিশ্ববাসী চমকে গিয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রস্থল। সেখানে এমন ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এত বড় ঘটনার প্রেক্ষাপট ও প্রতিপক্ষ একদিনে সৃষ্টি হয় নি। দুনিয়া কাঁপানো এ ঘটনাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে আফগানিস্তানের ৬০ ও ৭০-এর দশকের বিশৃঙ্খল দিনগুলো থেকে শুরু করে বর্তমান আতঙ্ক আইএসএস পর্যন্ত ইতিহাস। এই লেখাটি আজকের তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে লেখা যাদের অনেকেই সেভেন ইলেভেনের সন্ত্রাসী ঘটনার পটভূমি কীভাবে তৈরি হয়েছিল জানে না।

স্বাধীনতাত্তোর আফগানিস্তানের দিনগুলো

১৯১৯ সালে আফগানিস্তান বৃটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতাত্তোর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ১৯৩৩ সালে জহির শাহকে রাজা নির্বাচিত করার পর প্রায় চল্লিশ বছর (১৯৩৩ - ১৯৭৩) দেশটিতে মোটামুটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। ১৯৫৩ সালে জেনারেল দাউদ খান প্রধানমন্ত্রী হয়ে সোভিয়েত সহযোগিতায় আফগানিস্তানে আর্থ-সামাজিক সংস্কার সাধন করেন। এসময় বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষা ও সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হত।


১৯৬৩ সালে দাউদ খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ১৯৬৪ সালের নতুন সংবিধানে রাজাকে কেবল নির্বাচিত আইনসভার সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে দেশটিতে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দাউদ খানের নেতৃত্বে এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং প্রজাতন্ত্র হিসেবে আফগানিস্তানের আবির্ভাব ঘটে (১৯৭৩ - ১৯৭৭)। ক্ষমতা দখল করে দাউদ খান আফগানিস্তানে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেন এবং বিরোধীতাকারীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রক্ষণশীল ইসলামী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা দাউদ খানের আর্থ-সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে স্বশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। সাম্যবাদ বিরোধী ইসলামপন্থিদের এই বিদ্রোহ কালের প্রবাহে দেশি ও বিদেশি শক্তির মদদে এবং বিশেষ করে স্নায়ু যুদ্ধের (Cold War) রাজনৈতিক মেরুকরণের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরো শক্তিশালী দুর্দষ রূপ ধারণ করে।

আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ (১৯৭৯ - ১৯৮৯)

১৯৭৮ সালে আফগান কমউিনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নূর মোহাম্মদ তারাকী ও বারবাক কামাল এক পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দাউদ খানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে নেন। তাঁরা সাম্যবাদ বিরোধী ইসলামপন্থিদের সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাশিয়ার সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত, ইসলামী নীতি, আফগান জাতীয়তাবাদ ও আর্থ-সামাজিক ন্যায় বিচারকে দেশ শাসনের নীতি হিসাবে ঘোষণা করেন। এসময় ক্ষমতাসীন “পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ আফগানিস্তান” (পিডিপিএ) দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে রীতিমত সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। কম্যুনিস্ট পার্টির আরেক নেতা হাফিজুল্লাহ আমিনের সাথে তারাকীর অন্তর্দ্ধন্ধের জেরে ১৯৭৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাফিজুল্লাহর সমর্থকদের হাতে তারাকী নিহত হলে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এই অবস্থায় একই সালের ২৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত বাহিনী সরাসরি আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করে এবং হাফিজুল্লাহ আমিনের সরকারকে উৎখাত করে বারবাক কামালকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসান। এর প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তানের রক্ষণশীল ইসলামী ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতারা তাদের সমর্থকদের নিয়ে এক হয়ে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। এই যোদ্ধারা 'মোজাহিদিন' নামে পরিচিত। এই যুদ্ধকে মোজাহিদিনরা 'অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ইসলামের' ও 'কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের' যুদ্ধ তথা 'জিহাদ' বলে অভিহিত করে। এই তথাকথিত জিহাদে শরীক হওয়ার জন্য স্থানীয় ও বাইরের অনেক মৌলবাদী মুসলমানেরাও উৎসাহী হয়ে উঠে। বিশ্বের মুসলিম মৌলবাদী দলগুলো, আরব বিশ্ব, পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোজাহিদিনদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে আসে। (প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানও প্রচার করেছিল এই যুদ্ধ হিন্দু ও কমিউনিস্টদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ, হিন্দুবাদী ভারতের সাথে ইসলামপন্থী পাকিস্তানের যুদ্ধ! তাই মোটাবুদ্ধির আরব বিশ্ব আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল।)

আল-কায়েদা ও ওসামা বিন লাদেনের উত্থান

মুসলিম দেশগুলোতে মুজাহিদিনরা সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও স্থানীয় কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধকে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ধর্মীয় যুদ্ধের (জিহাদ) একটা প্রোপাগান্ডা হিসাবে দাঁড় করতে সক্ষম হয়; তাই মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোও আফগানিস্তানের কট্টরপন্থীদের সাহায্য-সহযোগিতা দেওয়া শুরু করে। তাছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইসলামিক স্বেচ্ছাসেবীরা আফগান মুজাহিদিনদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য আফগানিস্তানে ঢুকতে শুরু করে। আর এই স্বেচ্ছাসেবীদের একজন ছিলেন সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন। তিনি নিজস্ব অর্থ, সম্পদ ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে মোজাহিদিনদের সক্রিয় সহযোগিতা করেন। ১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানের মুজাহিদিন ক্যাম্পে বহির্বিশ্বের মোজাহেদীনদের জন্য আল-কায়েদা সংগঠনটি গড়ে ওঠে। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। শুরুতে এই সংগঠনের উদ্দ্যেশ্য ছিল আফগানিস্থানে যুদ্ধরত বহির্বিশ্বের মোজাহেদীনদের সংগঠিত করে বিশ্বব্যাপী একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা।


পিডিপিএ সরকার সোভিয়েত সরকারের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা পেত, অন্যদিকে মুজাহিদিনরা যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদী আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে সাহায্য পেত। আফগানিস্তানের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সহায়তায় আমেরিকা ও আরব দেশগুলো অর্থ ও অত্যাধুনিক অস্ত্র আফগান মুজাহিদদের হাতে তুলে দিত। অর্থ ও সামরিক সাহায্য পেয়ে আফগান যোদ্ধারা সোভিয়েত আর্মিকে ঘাবড়ে দিতে সক্ষম হয়। ওই সময় যুদ্ধের কারণে তিন ভাগের এক ভাগ মানুষকে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে আশ্রয় নেয়।

সোভিয়েত আর্মীর প্রস্থান (১৯৮৯)

আফগানরা জাতিগতভাবেই যোদ্ধার জাতি। শত বছরের আফগান ইতিহাসে দেখা যায় এখানকার মানুষ বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত হলেও তারা উপনেবেশিক শক্তিগুলোর বিরদ্ধে একতাবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করে তুলেছিলো। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ইতিহাস ও সংস্কৃতি এদের আগে থেকেই ছিল। সোভিয়েত রেড আর্মি দেশটির পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট ছোট বিদ্রোহী গোষ্ঠীর (আফগান মুজাহিদিন) প্রতিরোধের সন্মুখীন হয়েছিল! তাছাড়া তখন সারা বিশ্ব ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চলা “কোল্ড ওয়ার” বা স্নায়ু যুদ্ধের কারণে দ্বিধা বিভক্ত। তাই সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দেওয়ার জন্য আমেরিকা ও তার মিত্ররা মুজাহিদিনদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। সৌদি আরবের অর্থ, আমেরিকার অস্ত্র এবং পাকিস্তান থেকে ট্রনিং পেয়ে ১৯৮৬ সাল নাগাদ মোজাহিদিনরা স্থলে গেরিলা আক্রমণে কিছুটা সাফল্য ফেলেও সোভিয়েত বিমান হামলায় তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে বিমান হামালা ও স্থলে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুজাহিদিনদের এয়ার ডিফেন্সের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। পরবর্তীতে আমেরিকা “স্টিংগার” নামক অ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল তুলে দেয় আফগান মুজাহিদিনদের হাতে। এ মিসাইল তখনকার সময়ে সব চাইতে অত্যাধুনিক ছিল। এটি আফগান যুদ্ধে মুজাহিদিনদের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করেছিল।


এই মিসাইল আক্রমণের ফলে সোভিয়েত বিমানগুলো পর্যুদস্ত পড়ে। অবশেষে প্রায় ১৩,০০০ সৈন্য হারানোর পর সোভিয়েত বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের সংস্কারবাদী প্রধানমন্ত্রী মিখায়েল গরভাচেভের সিদ্ধান্তে ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় “জেনেভা অ্যাকর্ড” স্বাক্ষরের মাধ্যমে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে আসে। প্রায় ১০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে আমেরিকা, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সাহায্যে যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আফগান মুজাহিদদের জয় হয়।

ইতিহাসের পালাবদল


উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ১৫ বছর ব্যাপী (১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫) ভিয়েতনাম যুদ্ধে সোভিয়েত সাহায্যপুস্ট উত্তর ভিয়েতনামের সাম্যবাদী সরকারকে উৎখাত করার জন্য দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে অবশেষে যেভাবে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করে স্বদেশে ফিরে গিয়েছিল ঠিক একইভাবে দশ বছরের (১৯৭৯ - ১৯৮৯) আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিন সাহায্যপুস্ট মোজাহেদীনদের কাছে সোভিয়েত বাহিনী যুদ্ধে পরাজিত হয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ওসামা বিন লাদেনও নিজের দেশে ফিরে যায় ইসলামিক হিরো হিসেবে। ওই সময় সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগান মোজাহেদীনদের বিজয়কে বিশেষ করে মৌলবাদী মুসলিম দেশ, সরকার ও দলগুলো "কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলামের বিজয়" হিসাবে আখ্যায়িত করে। এতে আল-কায়েদার অতি উৎসাহী স্থানীয় ও বহিরাগত মোজাহিদেনদের অনেকেই আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তথাকথিত ইসলামের বিজয়কে এগিয়ে নেওয়ার উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

তালিবান কী ও কারা

তালিব আরবী শব্দ যার অর্থ 'জ্ঞান তলবকারী' কিংবা ছাত্র। তালিবুল ইলম অর্থ 'জ্ঞান তালাশকারী ছাত্র'। এ শব্দটি সামান্য পরিবর্তন হয়ে 'তালিবান' ফার্সী ভাষায় ব্যবহৃত হয়। ফার্সী ভাষায় এর অর্থ হল বহু ছাত্র। এটি পশতু ভাষায়ও একইভাবে ব্যবহৃত হয়। কুরআনিক মাদ্রাসায় তালিবান প্রাথমিক কোর্স মাত্র ২২ মাসের জন্য। তালিবান মাদ্রাসাসমূহ পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর তা কান্দাহার, হেলমন্দ, পাটিকা, খোস্ত প্রভৃতি অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এগুলোর জনপ্রিয়তা ব্যাপক হারে বৃদ্বি পায়। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে আরব এবং আমেরিকান অর্থের সাহায্যে অনেক ইসলামিক স্কুল (তালেবান মাদ্রাসা) চালু করা হয়েছিলো।


এখানে ফ্রি পড়াশুনা করা যেত। এই সব মাদ্রাসা স্কুলে যারা পড়তো তাদের বলা হতো “তালেব” অথবা “তালেবান”! তাদের শিক্ষক ছিল পাকিস্তানী ও স্থানীয় মোল্লারা যেমন: মোল্লা মহাম্মদ ওমর! যে কিনা পরবর্তীতে তালেবান নেতা হয়! এই সময়টায় এখানকার ছাত্রদের শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষায় উজ্জীবিত করে ও যুদ্ধের ট্রেনিং দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো।

তালেবানি রাষ্ট্রের উত্থান (১৯৯৬)

সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের বিভিন্ন গোত্র, এলাকা ও ভাষাভিত্তিক যেসব সশস্ত্র দল যুদ্ধ করেছিল তারা সোভিয়েত প্রস্থানের পর প্রত্যেকে নিজেদের এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠলো। কেন্দ্রে নজিবুল্লাহ সরকার নামেমাত্র ক্ষমতায় থাকলেও কাবুলের বাইরে এই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমনকি নজিবুল্লাহ নিজেই জীবন বাঁচানোর জন্য কাবুলে অবস্থিত জাতিসংঘের অফিসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সারা দেশব্যাপী লুঠতরাজ, ধর্ষণ, বলাৎকার, চাঁদাবাজী ও ব্যাপক অরাজকতার কারণে গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি হলো। তালেবানগণ সর্বপ্রথম বিচ্ছিন্নভাবে এসব অন্যায়ের বিরুদ্বে আন্দোলন গড়ে তুলে। বিশেষ করে বিভিন্ন জায়গায় নারী ধর্ষণ, আফিম ব্যবসা, চাঁদাবাজী এবং লুন্ঠনবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে। এতে তালেবানরা স্থানীয় লোকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাছাড়া দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে ক্ষত-বিক্ষত আফগানিস্তানের যুদ্ধক্লান্ত জনগণ মোজাহিনদের ক্ষমতা দখলের আভ্যন্তরীন লড়াইয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দেশের শাসনক্ষমতা তালেবানদের হাতে ন্যস্ত করার পক্ষে সমর্থন দিতে শুরু করে। বিশেষ করে পশতুভাষী পাঠানরা ছিল তালেবানদের সবচেয়ে বড় সমর্থক। এইভাবে কান্দাহারের এক মাদ্রাসার শিক্ষক, প্রাক্তন মুজাহেদিন ও সোভিয়েত বিরোধী যুদ্ধে এক চোখ হারানো মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালেবানীদের উত্থান ঘটে। পাকিস্তান এসময় তালেবানদের সমর্থন করে বিভিন্ন সাহায্য-সহযোহিতা দিতে শুরু করে। তালেবানরা মোল্লা ওমারকে তাদের প্রধান নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে এবং তাদের প্রধান সেনাপতি হন নূর হাকমন। তাদের আরেকজন নেতা হলেন মোহাম্মদ রাব্বী।


মোল্লা উমর তালিবান নেতা হিসাবে ঘোষণা করলেন যে, তিনি একটা খাঁটি ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করতে চান। চলমান গৃহযুদ্ধের সুযোগে মোল্লা ওমর আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ঘোষণা দিয়ে বিপুল সংখ্যক অনুসারী (বিশেষ করে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় রিফিউজি ক্যাম্পের মা্দ্রাসার ছাত্ররা) তৈরি করেন। আগে থেকেই রিফিউজি ক্যাম্পের সামরিক ট্রেনিং ও সীমান্তের অপর পাড়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকায় খুব দ্রুতই মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে গঠিত তালেবান অদম্য হয়ে উঠে। ১৯৯৪ সালের মাঝেই মোল্লা ওমর ও তার অনুসারীরা আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণে নেয় অন্য কোন গোষ্ঠীর কাছে থেকে কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই। সেখানে তাঁর ভাষায় ইসলামী সরিয়া আইন চালু করে। সাধারণ মানুষও চাইছিলো গৃহযুদ্ধের অবসান হোক। দীর্ঘদিনের যুদ্ধ ও সংঘাতময় পরিস্থতি থেকে উত্তরনের বিকল্প হিসাবে সাধারণ মানুষেরাও তালেবানদের সমর্থন দেয়। এই সুযোগে তালেবানরা একের পর এক প্রদেশ দখল করতে থাকে। তারা প্রথমে গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার বাহিনীকে পরাস্ত করে তাদের দখলকৃত এলাকাসমূহ অধিকারভূক্ত করে নেয়। অতঃপর তারা ধীরে ধীরে কাবুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সেসময়ের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী আহমদ শাহ মাসুদ বাহিনীর কাছ থেকে তারা ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানে তাদের আধিপাত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। তালেবানগণ ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রায় সমগ্র আফগানিস্তান দখল করে নেয়। তালেবানরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডাঃ নজিবুল্লাহ ও তাঁর ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে রাজপথে ঝুলিয়ে রাখে। নজিবুল্লাহ সরকারের সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য (Northern Alliance) কাবুলের উত্তরে পার্বত্য এলাকায় অবস্থান নিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে। তখন ওসামা বিন লাদেন আবার আফগানিস্তানে ফিরে আসে। বিন লাদেন ও মোল্লা ওমর নিজেদের মাঝে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলে। ধারনা করা হয় অর্থের মাধ্যমেই সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন তালেবানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

তালেবানদের শরীয়া আইন ও কার্যক্রম (১৯৯৬ - ২০০১)

তালেবানরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে একটি নৃশংস ও বর্বর শাসনব্যবস্থা চালু করে। সরকার পরিচালনার জন্য মজলিশে শুরা প্রতিষ্ঠা করে মোল্লা ওমরকে আমীরুল মুমিনীন হিসেবে নির্বাচিত করে। প্রত্যেক এলাকায় ইসলামী আইনকানুন বাস্তবায়নের জন্য তালিবানী আদর্শে দীক্ষীত মোল্লাদের শরীয়া পুলিশ হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। রেডিও কাবুলের নাম পরিবর্তন করে 'রেডিও সরিয়া' রাখে। সব রকম টেলিভিশন, খেলাধুলা, গান, বাজনা, স্যাটেলাইট টেলিভিশন নিষিদ্ধ করা হয়। কেউ এর ব্যতিক্রম করলে নির্দয় ভাবে শাস্তি দেয়া হত। নারীদের বাড়ির বাইরে কাজ করা বন্ধ করা, বোরখা পরে বাহিরে যেতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন নিয়ম চালু করে। শরীয়া আইনে বিচার করে উন্মুক্ত ময়দানে জনসন্মুখে মাথায় গুলি করে অপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হত।


তালেবানদের কার্যক্রমের কিছু নমুনা :
• শরীয়া আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি হাত কেটে দেওয়া, ব্যভিচারের শাস্তি মাটিতে অর্ধেক শরীর পুতে পাথর মেরে হত্যা করা এবং হত্যার অপরাধে শিরচ্ছেদ।
• ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলম
• সকল পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক
• নারী শিক্ষাকে নিষিদ্ব ঘোষণা ও নারীদের কর্মক্ষেত্র থেকে ছাটাই
• নারীদের পর্দার ব্যাপারে অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ
• টিয়া পাখি পালন করা নিষিদ্ব
• ঘুরি উড়ানো নিষিদ্ব
• টেলিভিশন, গান-বাজনা, নৃত্য নিষিদ্ব

তালেবানদের সাথে বহিঃবিশ্বের সম্পর্ক মোটেই ভালো ছিল না। পার্শ্ববর্তী দেশ ইরান শিয়া প্রধান দেশ। তাই তারা গোঁড়া সুন্নীদের এই আবির্ভাবকে সুনজরে দেখতে পারে নাই। আধুনিক ও গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশগুলো আফগানিস্তানে ইসলামের নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতার কারণে তালেবানদের সাথে সম্পর্ক রাখে নাই। শুধুমাত্র পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবানদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বিশ্বের উদারপন্থি গণতন্ত্রমনা মুসলমানেরাও তালেবানদের শরীয়া আইনকে ভালো চোখে দেখেনি।

এবার তালেবান ও আল-কায়েদার লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব

যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়ে গিয়েছিলো তাই আফগানিস্তানের প্রতি আমেরিকার আর তেমন আগ্রহ ছিল না এবং আফগানিস্তানকে আর কোন আর্থিক দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করল না। এতে তালেবানদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঠানাপোড়ন সৃ্ষ্টি হয়। জাতিসংঘ তালেবান সরকারকে বিরোধীদের সাথে শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এ ব্যাপারে রোমে অবস্থানরত সাবেক আফগান বাদশাহ জহির শাহ এক নতুন প্রস্তাব দিলে তালেবানরা তা প্রত্যাখান করে। তখন জাতিসংঘ আফগানিস্তানের ব্যাপারে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়ে। সেইসাথে আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেন ঘোষণা করেন আমেরিকানরা মুসলমনের শত্রু তাদেরকে হত্যা করতে হবে। তখন কেনিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে আমেরিকান দূতাবাসে বিন লাদেনের আল কায়দা হামলা চালায়। আমেরিকা তখন তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে চাপ দিতে থাকে–বিন লাদেন তালেবান সহায়তায় সন্ত্রাসী হামলা করছে আমেরিকানদের বিরদ্ধে। কিন্তু মোল্লা ওমর সেটা অস্বীকার করে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো ঐতিহাসিক দুটি বৌদ্ধমূর্তি তালেবানরা গুড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার পর পুরো পৃথিবী জুড়ে তালেবান বিরোধী একটা মনোভাব গড়ে উঠে! এভাবে তালেবানরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। এই সময় সৌদি আরবও তালেবনাদের আর্থিক সাহায্য দেয়া বন্ধ করে দেয়। বাকী থাকে কেবল পাকিস্তান।

যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা (৯/১১)


২০০১, সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখে আল-কায়েদার আত্মঘাতী জঙ্গীরা যাত্রীবাহী কয়েকটি বিমান হাইজ্যাক করে, তার মধ্যে যাত্রীসহ দুটো বিমান নিয়ে জঙ্গীরা আমেরিকান টুইন টাওয়ারে এসে হামলে পড়ে। এতে দুটো বিশাল ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং ভবন দুটো ভেঙ্গে পড়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হয় এবং কয়েক হাজার আহত হয়।




আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও তালেবানের পতন (২০০১)

প্রত্যাশিতভাবেই এ হামলার প্রতিশোধ নিতে দৃঢ়সংকল্প নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কারণ, এর সঙ্গে মার্কিন নাগরিকদের জীবনের মূল্য ও দেশের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত ছিল। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। এসব প্রশ্নের ফয়সালা করতে যুদ্ধকেই একমাত্র পথ বলে মনে করলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। টুইন টাওয়ার ধ্বংস হওয়ার বছরেই শুরু হয় মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের আফগানিস্তান আক্রমণ। লক্ষ্য ছিল আল-কায়েদা ও এর নেতা ওসামা বিন লাদেন এবং তাঁকে সমর্থন দেওয়া তালেবান সরকার। এই সন্ত্রাসী হামলার পরপরই প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তালেবানদের আলটিমেটাম দেয়, ওসামা বিন লাদেন এবং আল কায়েদার সদস্যদের আমেরিকার হাতে তুলে দিতে হবে। কিন্তু তালেবান নেতা মোল্লা ওমর অস্বীকার করেন। মোল্লা ওমর লাদেনের পক্ষ নিয়ে ঘোষণা করেন, “অর্ধেক আফগানিস্তান এমনিতেই রাশিয়ান আর্মি দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে; বাকীটা যদি আমেরিকার জন্য হয় তো হোক। আমি মাথা নত করবো না এবং বিন লাদেন আমার অতিথি। আমরা অতিথির অসম্মান করতে পারি না”! এই ঘোষণার পর আমেরিকা শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখ আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে। এভাবেই এক সময় যেই আমেরিকা ধর্মকে পুঁজি করে, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সোভিয়েত আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তালেবানদের সাহায্য করেছিলো; সেই আমেরিকাই আবার এই তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে এবং পাকিস্তানও আমেরিকার চোখ রাঙানিতে রাতারাতি বোল পাল্টে তালেবানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকার সাথে জোটভুক্ত আরো কয়েকটি দেশ এবং স্থানীয় উত্তরাঞ্চলীয় জোট বাহিনীর যৌথ আক্রমণে ২০০১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের অবসান ঘটে। আক্রমণে বেশিরভাগ তালেবানী নিহত হলেও মোল্লা ওমর ও বিন লাদেন গোপনে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সেনাবাহিনীর সহায়তায় ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় হামিদ কারজাই সরকার।

ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু

২০১১ সালের মে ২ তারিখে দিবাগত রাতে পাকিস্তানের আ্যবোটাবাদ শহরে মার্কিন কমান্ডোদের হামলায় (অপারেশন জেরোনিমো) ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। গোপনসূত্রে খবর পেয়ে মার্কিন কমান্ডোরা ২টি হেলিকপ্টারযোগে লাদেনের বাসভবনে হামলা চালায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির মাত্র ১০০০ ফুট দূরে লাদেনের এই গোপন আস্তানাটি ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয়। এখানে লাদেন তার কনিষ্ঠা স্ত্রী এবং পুত্র সহ বাস করতেন।


লাদেনের মরদেহ মার্কিন কমান্ডোরা হেলিকপ্টারযোগে প্রথমে আফগানিস্থানে এবং পরে মার্কিন রণতরীতে নিয়ে যায়। লাদেনের দেহ ডিএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে শনাক্ত করা হয়। শনাক্তকরণের শেষে ইসলামী প্রথানুসারে মরদেহ আরব সাগরে দাফন করা হয়।

আল-কায়েদা ও তালেবানদের বর্তমান অবস্থা

আফগানিস্তানের পর ২০০৩ সালে ইরাকে আক্রমণ চালিয়ে বসে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযোগ তোলা হয়, ইরাকের তৎকালীন একনায়ক সাদ্দাম হোসেইন মজুত করছেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র। যদিও সাদ্দাম সরকার উৎখাতের এত বছর পরও সেই অস্ত্রের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাঝখান দিয়ে উদ্ভব ঘটে খেলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস)। ২০১৫ সালে সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বলেছিলেন, ইরাকে যুদ্ধ না হলে আইএসের জন্ম হতো না। আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের পর বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে এই আইএস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালানো সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করে আলোচনায় চলে আসে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি। এরই মধ্যে ইরাক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে গেছে মার্কিন সেনা। সঙ্গে গেছে দেশটির তেলসম্পদের বখরাও। আর রেখে গেছে চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নৈরাজ্য।


সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া প্রথম যুদ্ধক্ষেত্র অবশ্য ছাড়তে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। উল্টো আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাসমাবেশ আরও বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কারণ, দুধকলা দিয়ে বড় করা তালেবান যে শায়েস্তা হয়নি! উল্টো দুধের সঙ্গে আফিম মিশিয়ে ফের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে তারা। আফগানিস্তানে প্রায় দেড় যুগ ধরে তালেবানের সঙ্গে লড়ে কার্যত কোনো ফল নিয়ে আসতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। তার সহযোগী পশ্চিমা মিত্ররা এ যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে অনেক আগেই পাততাড়ি গুটিয়েছে। প্রথমে চেষ্টা ছিল তালেবানকে ঝাড়ে–বংশে নির্বংশ করার। কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি। তালেবান যেন অফুরান বেনো জল। এই শেষ তো আবার উত্থান। আফগান সরকারে কর্মকর্তারা নানা জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। কাজেই সরকারে নানাজনের নানা মত। সে অনুযায়ী আফগান বাহিনীর মধ্যে একক শক্তির অভাব দেখা দেয়। হালের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যা–ও বা আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেন, তা–ও গেল ভেস্তে! সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই আলোচনা এখন মৃত। তালেবানের সাম্প্রতিক হামলায় মত বদলেছেন। তালেবানও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তালেবান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ এক বিবৃতিতে বলেন, এটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের পরিপক্বতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। এ জন্য আমেরিকাকে চরম মূল্য দিতে হবে বলেও হুঁশিয়ার করেছে তালেবান।

সন্ত্রাসের থাবায় গণতন্ত্র ও মানবতা বিপন্ন

নাইন-ইলেভেনের পর সন্ত্রাসবাদ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে অনেক রাষ্ট্রেই কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মস্কোয় চলছে পুতিনের শাসন, বেইজিংয়ে সি চিন পিংয়ের। সেখানে তাঁদের কথাই শেষ কথা। একই মডেলে দেশ চালাতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। সবখানে রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তিই প্রধান হয়ে উঠছেন। ডালপালা মেলছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ইতিহাসের অধ্যাপক জেরেমি সুরি বলেছেন, নাইন-ইলেভেন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা খর্ব হয়েছে। বেড়েছে প্রযুক্তিগত নজরদারি। এই ঐতিহাসিকের মতে, মার্কিনরা এখন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই লড়ছেন! বাগদাদ, কাবুল, মুসল থেকে সন্ত্রাসী যুদ্ধ এখন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয়েছে। এ কারণে নাইন-ইলেভেন-পরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধে মার্কিন সেনা নিহত হওয়ার সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা! সেইসাথে ইরাক, সিরিয়া,আফগানিস্থান থেকে হাজার হাজার অভিবাসী পশ্চিমা বিশ্বে আমদানী করেছে হিজাব, বোরকা ও মৌলবাদী ধ্যান-ধারণা। এতে ইউরোপ-আমেরিকায় ঘৃণা-জনিত অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে।


নাইন-ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা ও নজরদারি সংস্থায়। এত কিছুর ভিড়ে খানিকটা নিষ্ক্রিয় হলেও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়নি আল-কায়েদা বা আইএস। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, নামে-বেনামে ফের ফণা তুলতে পারে এসব সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক। আফগানিস্থান থেকে মার্কিন সৈন্য সম্পূর্ণরূপে প্রতয়াহার করে নিলে তেলিবানরা আবারও আফগানিস্থানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার মত মতও শক্তি ও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, সন্ত্রাসবাদের সমূল উৎপাটনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা স্বার্থ। এসব ভুলে এক মঞ্চে দাঁড়াতে না পারলে হয়তো কোনো দিনই সন্ত্রাসের বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই মিলবে না।

--------------------------
সূত্র: দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা ও ইন্টারনেট

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৯

রাজীব নুর বলেছেন: ধর্মের নামে যারা রক্তপাত করে তারা অমানুষ।

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৪৪

জোবাইর বলেছেন: এটাইতো অনেকে বুঝতে চায় না।

২| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৫৩

পাঠকের প্রতিক্রিয়া ! বলেছেন: পরিশ্রমী পোস্টে প্লাস

সংঘাত নয় শান্তি চাই

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৪৪

জোবাইর বলেছেন: সংঘাত নয় শান্তি চাই।
ধন্যবাদ।

৩| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৪:২৮

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: During 9/11 cia was the biggest theif

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.