নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তৎকানিক মস্তিস্কুৎপন্ন আবর্জনা.।।

অরণ্য আরণ্যক

অতি সাধারন, শিখতে চাই, যে কনো কিছু আমি ভাবি, জ্ঞানই পূর্ণতা। অপূর্ণ জ্ঞানই ভ্রান্তির শুরু আর ভ্রান্তির শেষ।।

অরণ্য আরণ্যক › বিস্তারিত পোস্টঃ

"কাদের মোল্লার মামলা: প্রসিকিউশনকে যা করতে হবে"

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ১:২৮

কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড হলো এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রাণের দাবি। আপিল আইনের সীমাবদ্ধতার কারণে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের পক্ষে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নিশ্চিত করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়েছে। তাই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনের অধীনে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের পক্ষে আপিল করার বিধানটি সংশোধন করার। বর্তমান মামলাটির আপিলে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের দাবি করবেন বলেও বিজ্ঞ প্রসিকিউশন ইচ্ছা পোষণ করেছেন। ন্যায়বিচারের দাবি অথবা আপিলের বিধানের সংশোধনী যা-ই হোক, এই মুহূর্তে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন এবং সরকার চিন্তাভাবনা করছে, তার উদ্দেশ্য হলো কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিত করা। আজকের সারা দেশে সর্বসাধারণের দাবিও কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড। আমিও এই দাবির সঙ্গে সহমত পোষণ করি। তবে জনগণের দাবির সঙ্গে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনকেও আইনি লড়াইয়ে জিততে হবে। এই সাধারণ ব্যাপারটি যদি আমরা উপেক্ষা করি, তাহলে জনগণের আন্দোলনটি ভিন্নতর পরিণতির দিকে এগোবে।



কাদের মোল্লার মামলাটিতে যদি বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কোনো কৌশলগত দুর্বলতা, অদক্ষতা বা ব্যর্থতা থেকে থাকে, সেটি আপিলের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিবর্তিত রায় নাও দিতে পারে। বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কৌশলগত অদক্ষতার মূল কারণটি হলো, কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধু একজন ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে (Individual Criminal Responsibility)। এটি আনা হয়েছে ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী (সংক্ষিপ্ত রায়ের ৯০, ১০৫ ও ১০৬ অনুচ্ছেদসমূহ দ্রষ্টব্য)।

আমার মতে, কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা নিরূপণের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে তা হলো, কাদের মোল্লার নেতা হিসেবে অপরাধের দায়বদ্ধতা (Superior Responsibility)। কাদের মোল্লা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ্ হল ইউনিটের ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ তত্কালীন সভাপতি (সংক্ষিপ্ত রায়ের অনুচ্ছেদ ১২ দ্রষ্টব্য)। সুতরাং কাদের মোল্লা ছিল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ একটি ইউনিটের নেতা, যার অধীনে বা নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ নীতি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতো। কাদের মোল্লার ইউনিটের অধীন ব্যক্তিরা কাদের মোল্লার নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিল, কেননা একটি সংগঠিত সংঘের সদস্য বা অধীন ব্যক্তিরা তাদের নেতার নির্দেশ, উপদেশ বা অবস্থানকে সমর্থন করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।



‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ যদি ১৯৭১ সালে আলবদর বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় (সংক্ষিপ্ত রায়ের অনুচ্ছেদ ৮ দ্রষ্টব্য), তাহলে এই সিদ্ধান্ত-নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্বে কাদের মোল্লা অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এটি আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না যে কাদের মোল্লা তার ইউনিটের সভাপতি হিসেবে ইউনিটের অধীনস্থ ব্যক্তিদের সংগঠিত করেছে আলবদর পরিকল্পনা এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে। অতএব, ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধু একজন ব্যক্তি হিসেবেই নয়, বরং একটি সংগঠিত বা অর্গানাইজড ইউনিটের নেতা হিসেবেও (Superior Responsibility) আনা উচিত ছিল। সংঘটিত অপরাধসমূহের দায়বদ্ধতা যদি একজন ব্যক্তি হিসেবে কাদের মোল্লার কম হয়েও থাকে, একজন ইউনিট-প্রধান হিসেবে তার অপরাধের দায়বদ্ধতা ছিল অনেক বেশি। তবে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন কাদের মোল্লার অপরাধের দায়বদ্ধতা শুধু ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(১) ধারা অনুযায়ী এনেছে। বিজ্ঞ প্রসিকিউশন ৪(২) ধারা অনুযায়ী কাদের মোল্লার ওপর অপরাধের দায়বদ্ধতা অর্পণে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, অপরাধের দায়বদ্ধতা ১৯৭৩ সালের আইনের ৪(১) এবং ৪(২) ধারা অনুযায়ী যুগপত্ আনা সম্ভব; এ ক্ষেত্রে আইনি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অতএব, বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের কৌশলগত দুর্বলতা আপিলের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সাজা নাও নিশ্চিত করতে পারে।



এটা ঠিক যে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’-এর স্বার্থে যেকোনো রায় দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। তবে এই ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ বলতে কী বোঝাবে, সেই ব্যাপারে কোনো সংজ্ঞায়ন বা নির্দেশনা আইনের কোথাও দেওয়া হয়নি। ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ সঠিক ন্যায়বিচার নাও হতে পারে [নাজিরউদ্দিন বনাম হামিদা বানু (১৯৯৩) ৪৫ ডিএলআর (এডি) ৩৮, ৪৪]।



এখানে আরও একটি প্রশ্ন রয়েছে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিল বিভাগ কি আইনের সঙ্গে অসংগতিমূলক কোনো রায় দিতে পারে? ইতিপূর্বে আপিল বিভাগের রায়ে প্রতীয়মান হয় যে সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের অধীনে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের ক্ষমতা ব্যবহার কখনো আইনের প্রকাশ্য বা লিখিত বিধানের সঙ্গে অসংগতিমূলক হলে চলবে না [এইচ এম এরশাদ বনাম রাষ্ট্র (২০০১) ৬ বি.এল.সি. (এ.ডি.) ৩০]। আবার একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ মামলারত যেকোনো একটি পক্ষের জন্য প্রযোজ্য হয় না। ‘সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার’ করতে গিয়ে আদালত দুই পক্ষের অধিকারের একটি ভারসাম্য রক্ষা করবেন, এটাই স্বাভাবিক।



প্রসিকিউশনকে অধিকতর সজাগ করতেই এই যুক্তির অবতারণা।

আইন পরিবর্তন করে যদি বিজ্ঞ প্রসিকিউশন এবং আসামি পক্ষের আপিল করার অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা আনা হয়, সেটা নিঃসন্দেহে মামলারত দুই পক্ষকে আইনের সমান সুযোগ লাভে সক্ষম করবে। ফলে, সাজা বাড়ানোর দাবিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশনও আপিল দায়ের করার সুযোগ পাবে। সরকার বর্তমানে এ ধরনের একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে ট্রাইব্যুনালের কোনো রায়ে দণ্ডের বা সাজার পরিমাণ কম মনে হলে প্রসিকিউশন যেন সাজা বৃদ্ধি করার জন্য আপিল করতে পারে। তবে, যেহেতু ট্রাইব্যুনাল ইতিমধ্যে কাদের মোল্লার রায় ঘোষণা করেছে, সে ক্ষেত্রে নতুন আইনটিকে কাদের মোল্লার রায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করতে হলে, আইনটির ভূতাপেক্ষ (Retrospective) প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া যদি কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের কোনো কৌশলগত বা অদক্ষতা থেকেই যায়, সে ক্ষেত্রে নতুন আইনের অধীনে কাদের মোল্লার মামলার বিজ্ঞ প্রসিকিউশন আপিল করার সুযোগ পেলেও তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি অনিশ্চিত থেকেই যাবে।



এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন কী করে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একটি মৃত্যুদণ্ডের রায় নিশ্চিত করতে যথা ভূমিকা রাখতে পারে? এ মুহূর্তে প্রসিকিউশনের উচিত, শুধু আপিলের রায় অথবা আইনের সংশোধনের অপেক্ষায় না থেকে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে নতুন চার্জ এনে আরও এক বা একাধিক মামলা দায়ের করা। কাদের মোল্লা ১৯৭১ সালে ‘কসাই মোল্লা’ নামে পরিচিত ছিল। তার কৃত অপরাধের সংখ্যা অগণিত। বর্তমান মামলাটিতে বিজ্ঞ প্রসিকিউশন কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে শুধু ছয়টি চার্জ এনেছে। এত কর্ম চার্জ আনার পেছনে সম্ভাব্য কারণগুলো ছিল—তদন্তের অপ্রতুলতা; ভয়ভীতির কারণে ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী অথবা সাক্ষীদের অসহযোগিতা; তদন্ত এবং প্রসিকিউশন টিমের মধ্যে সমন্বয়হীনতা; আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সম্পর্কে প্রসিকিউশন টিমের জ্ঞানের অগভীরতা ইত্যাদি।



এ মুহূর্তে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে একটি গণজোয়ার চলছে। রাজনৈতিক মণ্ডলেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। এমন একটি অনুকূল পরিবেশে ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী বা সাক্ষীরা নির্ভয়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে বলেই প্রতীয়মান হয়। সুতরাং কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের এখনই উপযুক্ত সময়। তদন্ত এবং বিজ্ঞ প্রসিকিউশনের এ মুহূর্তে উচিত অনতিবিলম্বে সঠিক কৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত তদন্ত ও বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে এক বা একাধিক ফরমাল চার্জ দাখিল করা। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তদন্ত টিম এবং প্রসিকিউশনকে তাদের ফৌজদারি এবং প্রথাগত অনুশীলনীয় সংস্কৃতির পরিসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আন্তর্জাতিক আইন এবং সংশ্লিষ্ট মামলার রায়ের আলোকে আমাদের ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোকে পরিচালনা করতে হবে।



যুগে যুগে সত্যের জয় অনিবার্য। সত্য তার আপন রূপে প্রতিভাত হতে বাধ্য; কিন্তু কখনো কখনো সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হয়। কাদের মোল্লা তার কৃত অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আজ কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত আইনি লড়াইয়ের। আমরা আশা রাখি, তদন্ত এবং বিজ্ঞ প্রসিকিউশন টিম আজকে জাতীয় সামগ্রিক দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমাদের সবার হয়ে এই আইনি লড়াইটি লড়বে। আমাদের আবেগ, অশ্রু, হাহাকার, ক্ষোভ আর বিদ্রোহের প্রতিফলন যেন দেখি তাদের পেশাগত অঙ্গীকার এবং কর্মকাণ্ডে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.