নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিরোনামহীন চলচ্চিত্র ও অন্তরালে আমি

মোঃ ইশতিয়াকুর রহমান ভুইয়া

কাউন্সিল সহকারী, চলচ্চিত্র গবেষক, তথ্যচিত্র নির্মাতা

মোঃ ইশতিয়াকুর রহমান ভুইয়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০ বছর (১৯৬১–২০১৩)

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ২:৫১

চলচ্চিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী আকর্ষণীয় গণ মাধ্যম। পৃথিবীর বহু দেশের বহু বিজ্ঞানীর বহু বছরের সাধনায় চলচ্চিত্র আবিস্কারের পূর্ণতা পায় ১৮৯৫ খ্রিঃ। সেই থেকে চলচ্চিত্র বিনোদন মাধ্যম, ব্যবসা মাধ্যম, শিল্প মাধ্যম, প্রচার ও প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে আসছে। চলচ্চিত্র প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ায় নির্মিত হয়ে প্রযুক্তিগতভাবে প্রদর্শিত হয়ে থাকে দর্শকের মাঝে। দর্শকরাই হলো একটি চলচ্চিত্রের নিয়ন্ত্রক। দর্শক যদি চলচ্চিত্র গ্রহণ করে তবেই এর সার্থকতা। আর যদি দর্শক প্রত্যাখান করে তবেই এর ব্যর্থতা। চলচ্চিত্রের বিনোদনরূপ বনাম শিল্পরূপ এ দ্বন্ধ চলে আসছে আদিকাল থেকেই। শিল্প মন্ডিত চলচ্চিত্রের রস আস্বাদনের জন্য অনুরাগী দর্শকরা গঠন করেছে চলচ্চিত্র সংসদ। চলচ্চিত্র সংসদের ধারণাটি উন্নত রুচি ও মনীষার সংগে জড়িত। চলচ্চিত্রের আবিস্কার হয়েছে পাশ্চাত্যে। আর সংসদেরও জন্ম হয়েছে পাশ্চাত্যে। চলচ্চিত্র সংসদ গঠনের পেছনে মূল চেতনাটি কাজ করেছে শিল্পমন্ডিত চলচ্চিত্রের জন্য সচেতন দর্শকদের ভালবাসা। চলচ্চিত্রের জন্য চাই দর্শক। আর সেই দর্শকরা চলচ্চিত্র দেখে চোখ দিয়ে। আর অনুধাবন ও উপভোগ করে জ্ঞান ও অনুভূতি দিয়ে।
১৮৯৫ খ্রিঃ জন্মলগ্ন থেকেই চলচ্চিত্র বিবেচিত হয়েছে জনরুচির লঘু আকর্ষণ হিসেবে। দর্শকদের কাছে এর আবেদন ছিল শুধুমাত্র প্রমোদ উপকরণ হিসেবে অনেকটা সার্কাস, ক্রীড়া কৌতুক, নাচ গানের মতোই। এর জন্ম বৈজ্ঞানিকের ল্যাবরেটরীতে হলেও এর বিস্তার ঘটেছে পণ্য হিসেবে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। সাধারণ দর্শকরা চলচ্চিত্র দেখে বিনোদিত হয় আর প্রযোজক ও নির্মাতারা ব্যবসায়িক স্বার্থে বিনোদনের নানা উপাদান দিয়ে তৈরী করে চলচ্চিত্র নামক পণ্যটি।
অন্যদিকে শিক্ষিত ও সচেতন দর্শকরা চলচ্চিত্রের মাঝে খোঁজে শিল্পরূপ। তারা জানতে চায় এর ইতিহাস, নির্মাণ কৌশল ও অন্যান্য অবদান। ফলে অনিবার্যভাবেই চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক এবং নান্দনিক রূপ নিয়ে একটি বিরোধের সৃষ্টি হয়। আর এ প্রেক্ষাপটেই শিল্প মন্ডিত চলচ্চিত্রের পক্ষে সচেতন দর্শক সৃষ্টির লক্ষ্যে গড়ে উঠে চলচ্চিত্র সংসদ।। চলচ্চিত্রের আদি পর্বেই এর নান্দনিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রচার প্রভাবমূলক ভূমিকা অনুভুত হয়েছিল চিন্তাবিদদের কাছে। চলচ্চিত্র সংসদ গঠনের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করেছে সেইসব চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, লেখক, চলচ্চিত্রকারদের তত্ত্বও সৃষ্টিকর্ম।
‘সভা সমিতি ও ক্লাব-সোসাইটি এসোসিয়েশন হল এ যুগের মানুষের সামাজিক জীবনের অঙ্গ। শুধু অন্যতম নয় অপরিহার্য সহচর। আদিম মানব সমাজেও ক্লাব-সোসাইটি এসোসিয়েশন ছিল। কোথাও বয়স ভেদে, কোথাও স্ত্রী-পুরষ ভেদে এমনকি কোথাও কোথাও ষ্ট্যাটাস বা মর্যাদা ভেদেও সেগুলো গড়ে উঠত এবং তার একটা সুনির্দিষ্ট সামাজিক কর্তব্য ছিল।
সভ্য সমাজের সভার বৈশিষ্ট্য হলো তার গোষ্ঠীগত এবং শ্রেণীগত স্বাতন্ত্র্য, এই জাতীয় সভা সমিতির উৎপত্তি হয়েছে আধুনিক যুগে এবং ক্রমেই এর প্রভাব এতই বেড়েছে এবং বাড়ছে যে তার ঘাত প্রতিঘাতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের ধারা পর্যন্ত বদলে যাচ্ছিল।
ঠিক তেমনিভাবে চলচ্চিত্র দর্শকরাও পারষ্পরিক স্বার্থে শিল্প মন্ডিত চলচ্চিত্র অবলোকন, অনুধাবন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, আলোচনা, সমালোচনা উপভোগ করার জন্য গঠন করেছে চলচ্চিত্র সমিতি বা সংসদ। নানা দিক বিবেচনা করে চলচ্চিত্র সংসদের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে নিম্নোক্তভাবে
‘A film society is a membership club where people can watch screening of films which would otherwise not be shown in mainstream cinema.’
অর্থাৎ চলচ্চিত্র সমিতি বা সংসদ হচ্ছে সদস্যদের সংগঠন সেখানে যেসব চলচ্চিত্র দেখা যায় সেগুলো মূলধারার দেখা যায় না।
বৃটেনসহ বিভিন্ন দেশে ফিল্ম সোসাইটি শব্দটি বেশী ব্যবহৃত হয়। অনেক দেশে আবার ফিল্ম ক্লাব, (জার্মান, ফ্রান্স,) সিনে ক্লাব (স্পেন), ফিল্ম লিগা (ইটালী) নামে পরিচিত। আমাদের বাংলাদেশেও ফিল্ম সোসাইটি বা সিনে ক্লাব দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’ (১৯৬৩), ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’ (১৯৬৯)। আমাদের এখানে যে নামেই ফিল্ম সোসাইটি বা ফিল্ম ক্লাব যাই থাকুক না কেন বাংলা ভাষায় তা চলচ্চিত্র সংসদ হিসেবে পরিচিত।
কার্যক্রমের দিক দিয়ে ফিল্ম সোসাইটি বা সিনে ক্লাবের সঙ্গে অন্যান্য সমিতি/সংগঠনের পার্থক্য রয়েছে। চলচ্চিত্র সংসদ হচ্ছে চলচ্চিত্রে উৎসাহী বিদ্বৎ সমাজের সংগঠন। এর লক্ষ্য ও আদর্শ হচ্ছে সৎ, শিল্প মন্ডিত ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র অবলোকনের মাধ্যমে এর রস আস্বাদন করা । যেমন নান্দনিক চলচ্চিত্রের নিয়মিত প্রদর্শণী, আলোচনা, সমালোচনার ব্যবস্থা করা। চলচ্চিত্র নিয়ে সেমিনার, সভায় আলোচনা করা, চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখালেখি করা, বুলেটিন ও সংকলন প্রকাশ করা।
চলচ্চিত্র সংসদ গঠনের আদি তালিকায় ফ্রান্স ও বৃটেনের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। ‘ফিল্ম ক্লাব’ শব্দটি প্রথম পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এপ্রিল মাসে চলচ্চিত্রের সূতিকাগার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিতে। ওই সময় এডমন্ড বেনই লেভী নামে এক ব্যক্তি প্যারিসে ৫ নং মনমারিত্রি এলাকায় ফিল্ম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এ ক্লাবের উদ্দেশ্য ছিল সদস্যদের চলচ্চিত্র সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল, নির্দশন সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। ক্লাবে চলচ্চিত্র দেখার যন্ত্রপাতি সজ্জিত একটি প্রেক্ষন কক্ষও ছিল।
এ ঘটনার প্রায় ১২/১৩ বছর পর ১৯২০ সালে লুই ডি লো নামে এক ব্যক্তি প্যারিসে ‘সিনে ক্লাব’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ গঠন করেন।
এদিকে ১৯২১ সাল থেকে প্যারিসে বসবাস করছিলেন ইটালীর প্রখ্যাত চলচ্চিত্রবিদ রিক্কিওতো কানুডো। তিনিও ওখানে আরেকটি ফিল্ম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন ।
১৯২০ দশকেই প্রখ্যাত নারীবাদী চলচ্চিত্রকার সমালোচক লুই দ্যুলাক ও ফ্রান্সে আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ‘সিনিয়া’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র সাময়িকী প্রকাশ করেন ।
১৯২৪ সালে ফ্রান্সে স্থাপিত হয় আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ ‘সিনে ক্লাব ডু ফ্রান্স’ নামে। পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে ফ্রান্সে ২০টির মতো চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে উঠে। ১৯৩৫ সালে হেনরি ল্যাংলোওয়া ও জর্জেস ফ্রানজু প্যারিতে ‘সার্কেল ডু সিনেমা’ নামে একটি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সাল থেকে এটি ‘সিনেমাথেক’ নামে পৃথিবীর আদি ফিল্ম আর্কাইভ হিসেবে পরিচিতি পায় ।
১৯২০ ও ৩০ দশকে যখন ফ্রান্সে একের পর এক চলচ্চিত্র সংসদ তৈরী হচ্ছিল তখন ওখানে চলচ্চিত্র নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এসব পরীক্ষা নিরীক্ষা আঁভা গার্দ, কাব্যিক পরাবাস্তবতাবাদ আন্দোলন নামে পরিচিত। ফ্রান্সের পর চলচ্চিত্র সংসদ প্রতিষ্ঠায় আরেকটি অগ্রগামী দেশ হচ্ছে বৃটেন। ১৯২৫ সালের ২৫ অক্টোবর বৃটেনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘লন্ডন ফিল্ম সোসাইটি’। এ সংসদ গঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন এনথনি এসকুইসন্স, সিডনী বুম স্টেইন, আইভর মনটিগো, এইচ, জি ওয়েলস, জর্জ বানর্ডস এর মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ। রাশিয়ার আইজেন ষ্টাইনের ব্যাটেলশিপ পতেমকিন (১৯২৫) এই সোসাইটির সদস্যদের দারুনভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রায় একই সময়ে জার্মানী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা ও অন্যান্য দেশেও চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে উঠে। ১৯৩০ সালে কানাডায় ‘সেন্ট্রাল কাউন্সিল অব ফিল্ম সোসাইটিজ’ এবং ‘কানাডিয়ান ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৩৫ সালে ২৬টি চলচ্চিত্র সংসদের সমন্বয়ে গঠিত হয় বৃটিশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ। একই বছর স্কটল্যান্ডে গঠিত হয় সেন্ট্রাল ফিল্ম কাউন্সিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন বিকাশের সাথে সাথে শিল্প মন্ডিত ও নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের আন্দোলনও এগিয়ে চলে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত নির্বাক যুগের ধ্রুপদী চলচ্চিত্র (১৯০৬-১৯২৭), ফ্রান্স ও স্পেনে পরাবাস্তবাদ (১৯২৪-১৯৩০) এবং ফরাসী কাব্যিক বাস্তবতাবাদ (১৯৩০), জার্মাণ অভিব্যক্তিবাদ (১৯১৯-১৯২৬), ইটালীর নব্য বাস্তবতাবাদ (১৯৪২-১৯৫১), ফরাসী নবতরঙ্গ (১৯৫৯-১৯৬৪) ইত্যাদি। এসব আন্দোলন প্রসূত চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু, নির্মাণ শৈলী, আঙ্গিক, শিল্পবোধ, চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবনা ও রসবোধের সৃষ্টি করে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র, গ্রিফিথের বার্থ অব এ নেশন (১৯১৫), জার্মাণীর রবার্ট ভাইনের কেবিনেট অব কেলেগ্যারী (১৯১৯), লুই বুনুয়েল ও সালভাদার দালীর ‘এন আন্ডালুসিয়ান ডগ’ (১৯২৮) ও ‘গোল্ডেন এইজ’ (১৯২৯), জককতোর ‘ব্লাড অব দি পয়েট’ (১৯৩১), সোভিয়েট রাশিয়ার আইজেন ষ্টাইনের ‘ব্যাটেলশিপ পতেমকিন’ (১৯২৫), ‘অক্টোবর’ (১৯২৭), আলেকজান্ডার নেভেস্কি (১৯২৭), ইতালির দিসিকার ‘বাই সাইকেল থিফ’ (১৯৪৮), সত্যজিত রায়ের পথের পাচালী (১৯৫৫), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লাহার্টির প্রামাণ্যচিত্র ‘নানুক অব দি নর্থ’ (১৯২৬), ফ্রান্সের গদার, ত্রুফো ও অন্যান্যের নবতরঙ্গের ছবি ইত্যাদি।
পাশ্চাত্যের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এবং বিভিন্ন চলচ্চিত্র আন্দোলনের প্রতি ভারতীয় শিল্প প্রত্যাশী দর্শকদেরও আকৃষ্ট করেছিল। এই বোধ থেকেই ভারতীয় উপ মহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র সংসদ স্থাপিত হয় মুম্বাই শহরে ১৯৩৭ সালে। এই চলচ্চিত্র সংসদের নাম ছিল ‘দি এ্যামেচার সিনে সোসাইটি’। এই সোসাইটি গঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন সমালোচক রুদি লাদেন, প্রামাণ্য চিত্র নির্মাতা ড. পতি, দেরেক জেফরিস ও ইলাস্ট্রেটেড উইকাল অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক স্ট্রেনলি জেপসন ও অন্যান্য ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে গঠিত হয় আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ ‘বোম্বাই চলচ্চিত্র সোসাইটি’। এর উদ্যোক্তা ছিলেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ক্লেমেন্ট ব্যাপটিস্ট, কে,এল, খাদপুর এবং ধারা ভাষ্যকার সাম্যুয়েল বারকলি অন্যান্য। দু’টো সংগঠনের নেতৃত্বের দূর্বলতার কারণে চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রম আন্দোলন রূপ নিতে পারেনি। ১৯৪৭ উত্তর উপ মহাদেশ বিভক্তির পর ওই বছরের ৫ অক্টোবর কলকাতায় গঠিত হয় ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। এই সোসাইটি গঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন সত্যজিত রায়, চিন্দানন্দ দাশগুপ্ত, নিমাই ঘোষ ও অন্যান্য। পরবর্তীতে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন হরিসাধন দাশগুপ্ত, সুব্রত মিত্র, সুধী প্রদান, অজয়কর ও জ্যোর্তিময় রায়। ১৯৪৯ সালে এপ্রিলের মধ্যে সোসাইটির সদস্য সংখ্যা দাড়ায় ৭৫ এ। কয়েক বছরের মধ্যেই সোসাইটির কার্যক্রম ও সাংগঠনিক তৎপরতা বেড়ে যায়। এ সংগে জড়িত হয় সংস্কৃতি ও অন্যান্য অংগনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। এদের মধ্যে ছিলেন প্রশান্ত মহলাবীশ, হীরন কুমার স্যানাল, দীলিপ কুমার ঘোষ, চারু প্রকাশ ঘোষ, ঋত্বিক ঘটক, মৃনাল সেন, মৃগাঙ্গ শেখর রায় ও অন্যান্য।
ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির ধারাবাহিকতায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে গঠিত হয় আরও অনেক চলচ্চিত্র সংসদ। যেমন পাটনা ফিল্ম সোসাইটি (১৯৫১), দিল্লী ফিল্ম সোসাইটি (১৯৫৬), মাদ্রাজ ফিল্ম সোসাইটি (১৯৫৭)। ১৯৫৯ সালে কোলকাতায় গঠিত হয় সর্বভারতীয় চলচ্চিত্র সংসদ ‘ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব ইন্ডিয়া’। সত্যজিত রায় হন এ সংগঠনের প্রথম সভাপতি। পরবর্তীতে ভারতের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ ফেডারেশনের সঙ্গে জড়িত হন। এদের মধ্যে ছিলেন সহ সভাপতি হিসেবে তৎকালীন তথ্য বেতার মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও ।
১৯৫৫ সালে সত্যজিত রায়ের ‘পথের পাঁচালী মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথে এর নান্দনিক গুনে বিশ্ব চলচ্চিত্রের অংশ হয়ে দাঁড়ায় এবং চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের কাছে এই ছবি টেক্সট হিসেবে বিবেচিত হয়। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির কার্যক্রম এবং সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালীর প্রভাব পড়ে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্প এবং এখানকার বুদ্ধিজীবী মহলেও।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিহাসকে নানা বিবেচনার প্রেক্ষিতে চারটি পর্বে ভাগ করা যায়। যথাঃ
(১) চলচ্চিত্র সংসদের সূচনা (১৯৬১-১৯৭১)
(২) চলচ্চিত্র সংসদের বিকাশ (১৯৭২-১৯৭৯)
(৩) চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন ও অস্তিত্বের লড়াই (১৯৮০-১৯৯৯)
(৪) চলচ্চিত্র সংসদ এবং স্যাটেলাইট টিভি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব (২০০০-২০১১)

চলচ্চিত্র সংসদের সূচনা (১৯৬১–১৯৭১)
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজ সচেতন বাঙালীরা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য সংগ্রাম করেছে, রাজনৈতিক মৌলিক অধিকারের জন্য আন্দোলন করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। ঢাকায় চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠার পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই চলচ্চিত্রের সামাজিক গুরুত্ব অনুধাবন করে নির্মল চলচ্চিত্রের প্রচার, প্রসার ও অনুধাবনের জন্য শিক্ষিত ও সচেতন দর্শকরা সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে ঢাকায় চলচ্চিত্র সংসদ গঠনের কয়েকটি উদ্যোগের কথা জানা যায় ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসের সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ ও অন্যান্য সূত্রে। ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ক্লাব গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে পাকিস্তান চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি। এ উদ্দেশ্যে তারা অর্থ সাহায্যের জন্য আবেদনও জানায়। এ ক্লাব গঠনের জন্য বিশিষ্ট প্রযোজক ও পরিবেশক এবং ভাষা সংগ্রামী মোশাররফ হোসেন চৌধুরীকে আহবায়ক নির্বাচন করা হয়। ১৯৬০ সালের শেষ দিকে তৎকালীন গভর্ণর আযম খান কর্তৃক ঢাকায় এই ফিল্ম ক্লাব উদ্ধোধনের কথাও ‘চিত্রালী’তে প্রকাশিতও হয়েছিল।
এদিকে কয়েকজন চিত্র পরিচালক সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও লেখক “ঢাকা ফিল্ম সোসাইটি” নামে আরেকটি চলচ্চিত্র সংসদ গঠন করেন। এর প্রাথমিক সদস্য ছিলেন ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান, এস,এম পারভেজ, কাইয়ূম চৌধুরী ও সৈয়দ শামসুল হক (আহবায়ক)। সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’র ১৯৬১ সালের ৯ জুন সংখ্যায় এই চলচ্চিত্র সংসদ গঠন সংক্রান্ত সংবাদও এ বিষয়ে সম্পাদকীয় ছাপা হয়। ঢাকা ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি ছিলেন এহতেশাম হায়দার চৌধুরী। তিনি প্রযোজক সমিতি কর্তৃক চলচ্চিত্র ব্যবসা সংরক্ষণ সংক্রান্ত দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। ‘ঢাকা ফিল্ম সোসাইটি’র আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন হয় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাস্থ তৎকালীন জার্মাণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল কবীর।
অন্য দিকে পাকিস্তান প্রযোজক সমিতির ব্যবস্থাপনায় ঢাকায় ফিল্ম ক্লাব গঠনের উদ্দেশ্যে খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী ও চিত্র পরিচালক কলিম শরাফী কে অনারারী সেক্রেটারী মনোনীত করে একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয় বলে সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’র ১৯৬২ সালের ৬ এপ্রিল সূত্রে জানা যায়। ক্লাবের সেক্রেটারী কলিম শরাফী এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানান যে এতে ছবি নিয়ে আলোচনা হবে, বই থাকবে, চলচ্চিত্র সম্পাদনার কাজ হবে, ক্যামেরা আনা হবে। ১৯৬২ সালের ১৩ জুলাই এই ফিল্ম ক্লাবের আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধন হয়। উদ্ধোধন করন প্রাদেশিক আইন ও তথ্যমন্ত্রী এটিএম গোলাম মোস্তফা।
চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির ফিল্ম ক্লাব এবং ‘ঢাকা ফিল্ম সোসাইটি’ নামে দু’টি চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হলেও এদের কার্যক্রমে বিশেষ কোন গতির সঞ্চার হয়নি। ১৯৬৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’তে এ সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্যে ফিল্ম সোসাইটির কার্যক্রমের গতিশীলতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয়। ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে ‘ঢাকা ফিল্ম সোসাইটি’র একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় মতিঝিলস্থ গ্রামাফোন রেকর্ড কোম্পানীর অফিসে। এতে সভাপতিত্ব করেন এফডিসির এমডি খায়রুল কবীর। ১৯৬৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘চিত্রালী’ সুত্রে জানা যায় যে, ‘ঢাকা ফিল্ম সোসাইটি’র কার্যক্রম পুনঃর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে পরবর্তীতে দু’টি চলচ্চিত্র সংগঠনেরই কার্যক্রমের আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।
১৯৬৩ সালে মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র মাহবুব জামিল ও অন্যান্যের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘স্টুডেন্টস ফিল্ম ক্লাব’। এ ক্লাবের সভানেত্রী হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ডঃ ফাতেমা সাদেক।
১৯৬৩ সালের ২৫ অক্টোবর এ দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। এদিন ঢাকায় স্থাপিত হয় ‘পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটি’ (পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ)। এ সংসদ পরবর্তী প্রায় ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এর সক্রিয় কার্যক্রমের মাধ্যমে যেমন নির্মল চলচ্চিত্র আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছে, তেমন দিয়েছে সংসদ পরিচালনায় নেতৃত্ব, নির্দেশনা ও প্রেরণা। এই সংসদের প্রাণ পুরুষ হিসেবে কাজ করেছেন মুহম্মদ খসরু। যাকে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অগ্রগামী স্থপতি বলা যেতে পারে। একজন সক্রিয় সংসদ কর্মী হিসেবে তিনি চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ও চর্চা নিয়ে বহু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লিখেছেন, সম্পাদনা করেন ‘ধ্রুপদী’ নামে মননশীল সংকলন। ‘পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদ’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ’ নামে পরিচিতি পায়। এ সংসদ গঠনের প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে বাহাউদ্দিন চৌধুরী, আনওয়ারুল হক খান ও ওয়াহিদুল হক এর নাম জানা যায়। পরবর্তীকালে এদের সংগে যোগ দেন তরুণ মুহম্মদ খসরু। ওয়াহিদুল হক সুত্রে জানা যায় যে, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষ উদযাপিত হয় দেশজোড়া মহা উৎসবের মতো। শতবার্ষিকীর সুফল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘ছায়ানট’ বাংলার ঋতু উৎসব ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করে। এ ‘ছায়ানটের’ অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও সনজিদা খাতুন।
১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আনোয়ারুল হক খান। প্রাথমিক পর্বে সংসদে যোগ দেন আবদুস সবুর, মনিরুল আলম প্রমুখ।
১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনে কোন সভাপতি ছিল না। ১৯৬৭ সালে এ সংগঠনে এসে যোগদেন কামরুল হাসান (সহসভাপতি), আলমগীর কবির (সাধারণ সম্পাদক), লায়লা সামাদ (সদস্য) প্রমুখ। ১৯৬৯ সালে এ সংসদের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মুহম্মদ খসরু। চলচ্চিত্র সংসদের প্রথম সভাপতি হিসেবে যোগদেন শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদীন। আর সাধারণ সম্পাদক হন মাহবুব জামিল। ১৯৭২ সালে সংসদের সভাপতি হন অধ্যাপক কবির চৌধুরী।পাকিস্তান পরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের অন্যান্য কীতির্র মধ্যে রয়েছে অতি উন্নতমানের ‘ধ্রুপদী’ সংকলন প্রকাশ, স্বাধীনতার পর চলচ্চিত্র সমীক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা, ফেডারেশন গঠনে নেতৃত্ব দান, চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের দাবী, ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার দাবী ইত্যাদি। এই সংসদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় মুহম্মদ খসরু রচিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন’ (২০০৪) ও মুহম্মদ খসরু সম্পাদিত ‘তিমির হননের নান্দী পাঠ’(২০০৩) গ্রন্থ থেকে।
১৯৬৯ সালে আলমগীর কবির ও লায়লা সামাদের উদ্যোগে গঠিত হয় ‘ঢাকা সিনে ক্লাব’। আলমগীর কবির ১৯৬৯ সালেই প্রতিষ্ঠা করেন চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ফিল্ম ইন্সটিটিউট এবং একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক গ্রন্থ ‘দি সিনেমা ইন পাকিস্তান’। এই তিনটি ঘটনাই দেশের চলচ্চিত্রের বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা, চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এবং সুষ্ঠু চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে।
১৯৬৮-৬৯ সালে দেশের রাজনীতির পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। গণ আন্দোলন, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমশই তীব্র হতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানী শাসকচক্র নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে দমন, পীড়ন ও নৃশংসতার আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ ঘোষিত হয় স্বাধীনতা, দেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং ঐ বছরই ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ থাকে। ১৯৭২ সালে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নতুন করে শুরু হয়।
চলচ্চিত্র সংসদের বিকাশ (১৯৭২–৭৯)
১৯৭০ দশক স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার দশক। ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। হাজার বছরের ইতিহাসের এ ঘটনা বাঙালীর রাজনৈতিক সত্ত্বা, আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানসিক বিকাশের নতুন দিগন্ত খুলে দেয় আলোচ্য সময়ে। চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী আলমগীর কবির ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ভিত্তিক তিনটিটি চলচ্চিত্রের ধারা ভাষ্য রচনা ও ধারা বিবরণী পাঠ করেন এবং একটি প্রামাণ্য চিত্র ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ নির্মাণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ধীরে বহে মেঘনা(১৯৭২), সুর্যকন্যা(১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭) পরিচালনা করেন। এছাড়া চলচ্চিত্র সংসদকর্মী কবীর আনোয়ার পরিচালনা করেন সুপ্রভাত (১৯৭৬) ও স্লোগান (১৯৭৩)। শেখ নিয়ামত আলী ও মশিউদ্দিন শাকের সরকারী অনুদানে নির্মাণ করেন ‘সুর্য দীঘল বাড়ি’ (১৯৭৯), বাদল রহমান সরকারী অনুদানে রঙিন শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’র কাজ শুরু করেন। পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোক্তা সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক খান ১৯৭১ সালে মুজিব নগর সরকারের তথ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নুতন প্রেক্ষাপটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে অন্যান্য সমিতি ও সংগঠনের মতো চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার ক্ষেত্রেও জোয়ার আসে। অবাধ মুক্ত পরিবেশে অনেক নতুন চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয়। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সিলেট, রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালী পর্যন্ত চলচ্চিত্র সংসদের শাখা বিস্তার লাভ করে এবং এ সংখ্যা ৭০ দশকের শেষে ১০০ তে উন্নীত হয়। এ সময়ের মধ্যে গঠিত হয় উত্তরণ ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭২), অনুষ্টুপ ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৩), সিনে আর্ট সার্কেল (১৯৭৩), সিনেপল ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৪), চট্টগ্রাম ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৩), নিউ ওয়েব ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৩), ক্ল্যাপস্টিক ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৩), সিনে সেন্ট্রাল বাংলাদেশ (১৯৭৪), ঢাকা সিনে সার্কেল (১৯৭৪), মন্তাজ সিনে ক্লাব (১৯৭২), সিনেমেট ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৫), ক্যাটওয়া ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৫), চিত্রন ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৫), ইমেজ ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৫), অর্গান্টা ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৬), চিপাচস (১৯৭৬), রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৭), শতাব্দী ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৭), শুভেচ্ছা ফিল্ম সোসাইটি (১৯৭৭), সাইট এন্ড সাউন্ড (১৯৭৭), ক্যাটস (?), চলচ্চিত্রম (১৯৮২) প্রভৃতি। এছাড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ এর চট্টগ্রাম, খুলনা ও নারায়নগঞ্জে এবং শিশুদের শাখাও ছিল।
এ সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অনেক বিদেশী রাষ্ট্র ঢাকায় দুতাবাস খোলে। বিশেষ করে রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন। যেমন বুলগেরিয়া, পোলান্ড, রুমানিয়া, হাংগেরী প্রভৃতি দেশের নান্দনিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রসমূহ দেখার সুযোগ হয়। চলচ্চিত্র সংসদের সদস্যরা এসব দেশের চলচ্চিত্রের মধ্যে যুদ্ধ, মানবিকতা ও শিল্প সুষমার নিদর্শণ খুঁজে পায়।অন্যদিকে আগে থেকেই ঢাকায় অবস্থিত রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মাণী ও ভারতীয় দূতাবাসগুলো সে দেশের বিভিন্ন নান্দনিক চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ করে দেয়। বিদেশী দূতাবাসগুলো তাদের অডিটোরিয়ামে ছবি দেখার যন্ত্রপাতি ও অডিটোরিয়াম ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সুযোগ করে দেয়।
১৯৭৩ সালে চলচ্চিত্র সংসদ চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ হয় এবং এ বছর আটটি চলচ্চিত্র সংসদ মিলে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ফেডারেশন’। আলমগীর কবির হন এ সংগঠনের প্রথম সভাপতি। তাঁর সংগে ছিলেন মাহবুব জামিল, সৈয়দ সালাহ উদ্দিন জাকী, বাদল রহমান, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ। চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশন এর সদস্য সংসদগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার প্রাপ্তি, কর্মসূচী পালন ও অন্যান্য বিষয়ে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস চালায়। এ সময় চলচ্চিত্র সংসদগুলো দেশে ফিল্ম আর্কাইভ স্থাপন, ফিল্ম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রবর্তন, অনুদান তহবিল চালুসহ রুচিশীল শিল্প শোভন চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ তৈরীর জন্য সরকারের কাছে দাবী জানায়।
১৯৭০ দশকেই দুই চলচ্চিত্র সংসদকর্মী সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী ও বাদল রহমান ভারতের পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে চলচ্চিত্র বিষয়ক অধ্যয়ন শেষে দেশে ফিরে আসেন। তারা তাদের অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। ১৯৭৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে একটি চলচ্চিত্র সমীক্ষণ কোর্স অনুষ্ঠিত হয়। পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর এ কোর্স পরিচালনা করেন। এতে বিভিন্ন চলচ্চিত্র সংসদের সদস্য ও অন্যান্যরা অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই ছিল চলচ্চিত্র সমীক্ষণ সংক্রান্ত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। অধ্যাপক সতীশ বাহাদুরের পরিচালনায় কোর্সে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলচ্চিত্রের ইতিহাস, আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক গুরুত্বসহ এর নন্দনতত্ব সম্পর্কে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এ সময় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগে অধ্যাপক সতীশ বাহাদুর বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের রূপরেখা তৈরী করে দেন, যা পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালে সরকারীভাবে কিছুটা অদল-বদল করে বাস্তবায়িত হয় ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এন্ড আর্কাইভ’ নামে। চলচ্চিত্র সংসদের কর্মীদের দাবীর প্রেক্ষিতে এ আর্কাইভ প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রসমূহ সংগ্রহ হয়। পরবর্তীতে ফিল্ম আর্কাইভ চলচ্চিত্র সংসদের কার্যক্রম বিকাশে নানাভাবে সহায়তা করে।
১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর পরিবার ও জাতীয় ৪ নেতাসহ নিহত হয়। এ প্রেক্ষাপটে দেশে সামরিক শাসন জারী হয়। তখন সরকারের গোয়েন্দা দফতর চলচ্চিত্র সংসদ এবং এর কার্যক্রমের উপর নজরদারী শুরু করে। এর ফলে সংসদের কার্যক্রমের উদ্যোমে সাময়িকভাবে ভাটা পড়ে। এ দশকেই চলচ্চিত্র সংসদকর্মীদের কয়েকটি দাবীও পূরণ হতে দেখা যায়। উপ প্রধান, সামরিক আইন প্রশাসক ও তথ্য উপদেষ্টা জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৬ সালে চালু হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, অনুদান তহবিল এবং শিশু চলচ্চিত্রের উপর থেকে প্রমোদকর মওকুফসহ চলচ্চিত্রকে একটি শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালে ২৪ অক্টোবর সাপ্তাহিক চিত্রালীর পাঠক পাঠিকারা গঠন করে ‘চিত্রালী পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ’ (চিপাচস)। চলচ্চিত্রের মূল ধারার অনুসারী এ পত্রিকাটির প্রচার ও জনপ্রিয়তা ছিল সারা দেশ জুড়ে। এর ফলে ‘চিপাচস’ আলাদাভাবে গুরুত্ব পায় তরুণ শিক্ষার্থী ও চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে। ‘চিপাচস’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই এর শাখা ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের মহকুমাগুলোতে। এসবের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০টি। অন্যদিকে অন্যান্য সংসদগুলো চলচ্চিত্র প্রদর্শণী, সভা, সেমিনার, সম্বর্ধনা প্রদান, পুরস্কার চালু, সমীক্ষা কোর্স, লেকচার ওয়ার্কশপ চালু, চলচ্চিত্র বিষয়ক সংকলন প্রকাশ করে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে গতির সঞ্চার করে।
চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন, অস্তিত্বের লড়াই (১৯৮০–১৯৯৯)
১৯৮০ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক ইতিহাসে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক ঘটনার ক্ষেত্রে ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়া হত্যাকান্ড, এরশাদের ক্ষমতা দখল, ৯০ দশকে এরশাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুথ্থান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার চালুও গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু এবং চলচ্চিত্র সংসদ নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের দাবীতে সংসদ কর্মীদের প্রবল আন্দোলন, নকল ও অশ্লীল চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে সংসদ কর্মীদের প্রতিবাদ ও মিছিল বের হয়।তাছাড়া চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ফোরাম গঠন (১৯৮৬), স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ধারার প্রবর্তন এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন ও সরকারী চলচ্চিত্র অনুদান ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। ১৯৮৩ সালে চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশন দু’টি আবার একত্রিত হয়।
১৯৭০ দশকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ গঠন ও কার্যক্রমের যে জোয়ার এসেছিল ১৯৮০ সালে তা হঠাৎ স্তিমিত হয়ে পড়ে সরকার কর্তৃক চলচ্চিত্র সংসদ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন পাশের পর। এ আইন চলচ্চিত্র সংসদ কার্যক্রমের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে প্রচন্ডভাবে বাধাগ্রস্থ করে এবং এর বিরুদ্ধে চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়।
এ আইন পাশ হওয়ার পর চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সংসদ কর্মীরা আইনটি প্রত্যাহার করার জন্য জোর দাবী জানান। আগষ্ট মাসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ এর সভাপতি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উত্থাপিত ফিল্ম ক্লাবসমূহ রেজিষ্ট্রিকরণ ও নিয়ন্ত্রণ বিল ১৯৮০ নামে যে বিলটি পাশ করা হয়ছে তা কার্যকর হলে দেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন যে, চলচ্চিত্র যে কেবল মাত্র হালকা মনোরঞ্জনের বিষয় নয় এবং চলচ্চিত্র চর্চা মানে যে শুধুমাত্র কুৎসিত নিম্ন রুচির কিছু গল্পের প্রতিফলন ঘটানো নয় এ বোধ থেকেই বিগত দুই দশক ধরে এদেশে চলচ্চিত্র সংসদ বিভিন্ন গঠনমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এদেশের চলচ্চিত্র সংসদকে সরকারের অবশ্যই উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত।
এই আইন চালুর ফলে অনেক সক্রিয় চলচ্চিত্র সংসদ বন্ধ হয়ে যায় এবং নতুন চলচ্চিত্র সংসদ গঠনের সংখ্যা হ্রাস পায়। চলচ্চিত্র সংসদ এবং ফেডারেশনের ৩১ বছরের দাবীর প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ডিসেম্বরে আগের চলচ্চিত্র সংসদ নিবন্ধন সংক্রান্ত আইন রহিতপূর্বক সংশোধনসহ তা পুনঃপ্রবর্তণ করে। নুতন আইনে নিয়ন্ত্রণ শব্দটি না থাকলেও চলচ্চিত্র সংসদের নিবন্ধনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিবন্ধনের জন্য আগের চেয়ে আরও বাড়তি ফি দিয়ে নির্ধারিত ফরমে ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। পুরানো আইনে কোন চলচ্চিত্র দেখানো যাবে না। আগে ফিল্ম সেন্সর বোর্ড থেকে তা সেন্সর করিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। নুতন আইনে তা বাদ দিয়ে প্রদর্শণীর তিন দিন আগে প্রদর্শর্ণীর স্থান, তারিখ ও সময় উল্লেক করে কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অনঅনুমোদিত চলচ্চিত্র প্রদর্শণের শাস্তির বিধান বাতিল করে চলচ্চিত্র সংসদের নিবন্ধন বাতিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ইতিহাসে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ শটফিল্ম ফোরাম গঠনের মধ্য দিয়ে। এ ফোরাম গঠনের মূল কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে কাজ করেছে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’ (১৯৮৪), তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত হুলিয়া (১৯৮৫) স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দু’টি। তাদের সংগে যুক্ত ছিলেন অন্যান্য চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীও। যেমন, এনায়েত করিম বাবুল (চাক্কী), আবু সাইয়ীদ (আবর্তন), মানজারে হাসীন মুরাদ, জুনায়েদ, হালিম প্রমুখ। এ ফোরাম প্রচলিত বিনোদন ধর্মী অবাস্তব মূল ধারার চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের প্রবর্তণ করে। মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন এবং সমাজমুখী বিষয়বস্তু, ১৬ মিঃমিঃ ও ভিডিওতে ছবি নির্মাণ, সিনেমা হলের বাইরে ছবির মুক্তি ও প্রদর্শণী, স্বল্প বাজেটে স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা সাফল্য অর্জন করে। ১৯৮৮ সাল থেকে এ ফোরামের উদ্যোগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর আন্তর্জাতিক স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব। এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের পেছনে প্রেরণ দিয়েছিলেন আরেক প্রবীণ চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী পরিচালক, শিক্ষক, সমালোচক আলমগীর কবির।
আলোচ্য সময়ের মধ্যে চলচ্চিত্র সংসদ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইনকে চলচ্চিত্র সংসদ কর্মীরা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এবং তারা এটিকে কালো আইন বলে আখ্যায়িত করে। এই আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও তরুণ এবং উদ্যোমী চলচ্চিত্র প্রেমীরা সংসদ আন্দোলনের গতিকে সচল রাখে। তারা সরকারী নানা ধরণের নিয়ন্ত্রণ সত্ত্বেও নিজদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চলচ্চিত্র প্রদর্শণী, আলোচনা, সভা, সেমিনারের আয়োজন, অশ্লীল ও নকল ছবির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল চালিয়ে যেতে থাকে।
অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি নতুন চলচ্চিত্র সংসদও গড়ে উঠে। এসবের মধ্যে নাম করা যায় মোরশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে গড়ে উঠা চলচ্চিত্রম ফিল্ম সোসাইটি (১৯৮১), সাব্বির চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত জহির রায়হান ফিল্ম সোসাইটি (১৯৮৬), তানভীর মোকাম্মেল ও মানজারে হাসান মুরাদের ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ, অনুপম হায়াৎ এর বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাব (১৯৮৮), শামছুল আলম লিটনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ (১৯৯১), শৈবাল চৌধুরীর চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র (১৯৯১), আব্দুস সামাদের সের্গেই বান্দারচুক ফিল্ম ক্লাব (১৯৯৫), আজিজ মেহেরের নেতৃত্বে ঢাকা ফিল্ম ক্লাব ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শণ ও অধ্যয়ণের মাধ্যমে সৎ দর্শক সৃষ্টি করা হলেও একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে চলচ্চিত্রম ফিল্ম সোসাইটি। এই সোসাইটি দেশে প্রথম বারের মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনা করে। সোসাইটির তরুণ সাধারণ সম্পাদক মোরশেদুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আগামী (১৯৮৪) নির্মাণ করেন। এই চিত্রটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের মুখবন্ধ হিসেবে বিবেচিত। আগামী ১৯৮৫ সালে নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে। অবশ্য বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সংসদ প্রথম বারের মতো চলচ্চিত্র প্রযোজনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ‘হুলিয়া’র মাধ্যমে। কিন্তু ছবির পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল এর সাথে মতবিরোধের কারণে চলচ্চিত্র সংসদের উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়। এ সময়ের মধ্যে চিত্রালী পাঠক পাঠিকা চলচ্চিত্র সংসদ (চিপাচস) ১৯৮৪ সালে সুরুজ মিয়া নামক একটি চলচ্চিত্র সিনেমা হল থেকে নামিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে রাজপথে পিকেটিং ও মিছিল করে নতুন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশনও এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। আলোচ্য সময়ের মধ্যে ৯০দশকে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের নেটওয়ার্কের বিস্তার, ভিডিও, ভিসিডি ও অন্যান্য প্রযুক্তি চালুর ফলে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন নতুন সংকটের সম্মুখীন হয়।
চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন, স্যাটেলাইট টিভি ও ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব (২০০০–২০১০):
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং এর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। বিজ্ঞানের কল্যাণে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে যে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল শতবর্ষ পরে তার বিষয়বস্তু, নির্মাণশৈলী ও উপকরণগত রূপ বদলে গেছে। চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও প্রদর্শণ ক্ষেত্রে ঘটেছে বিপ্লব। এর প্রভাব পড়েছে চলচ্চিত্র সংসদ চর্চা তথা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। স্যাটেলাইট, টিভি, ভিসিআর, ভিডিও, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ওয়েব সাইট, ডিভিডি, মোবাইল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শণ খুব সহজ হয়ে গেছে। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যে কোন দেশের যে কোন নান্দনিক ধ্রুপদী চলচ্চিত্র দেখা যায়। অন্যদিকে বেড়েছে মানুষের কর্ম ব্যস্ততা, এর ফলে ১৯৬০, ১৯৭০ ও ১৯৮০ দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে জোয়ার এসেছিল একুশ শতকের প্রারম্ভে তাতে ক্রমেই ভাটার টান পড়েছে।
১৯৯০ দশকে বাংলাদেশে যে স্যাটেলাইট টিভি ও ডিভিডির যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০০ সাল থেকে ক্রমেই তার বিস্তার ঘটে চলছে আগ্রাসী ভুমিকায়। বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট চ্যানেল রয়েছে ১০/১২টির মতো এবং রয়েছে বিদেশী ৭০/৮০টি চ্যানেল। এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে মোবাইলে দেখা যায় চলচ্চিত্র। রাস্তার পাশের ফুটপাতে বা মুদি দোকানেও পাওয়া যায় চলচ্চিত্রের ডিভিডি। এর ফলে চলচ্চিত্র সংসদ গুলোর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে, কার্যক্রম হয়ে পড়ছে নিস্ক্রিয়। কিন্তু কিছু কিছু সিরিয়াস চলচ্চিত্র প্রেমীদের সংসদ কার্যক্রম থেমে নেই। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ, জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ, চলচ্চিত্রম, চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র চলচ্চিত্র প্রদর্শণী, আলোচনা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ, প্রকাশনা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি দু’বছর অন্তর অন্তর ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৯২ সাল থেকে আয়োজন করে চলেছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের ধ্রুপদী’র সর্বশেষ সংখ্যাও বেরিয়েছে ২০০৬ সালে। মোরশেদুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে ‘চিলড্রেন ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ’। এই সংসদের উদ্যোগে ২০০৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব, সেমিনার ও চলচ্চিত্র নির্মাণ কোর্স পরিচালনা করে আসছে। অন্যদিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র সংসদ গড়ে উঠেছে। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলচ্চিত্র সংসদের মাধ্যমে চলচ্চিত্র চর্চা বাড়ছে। আলোচ্য সময়ে চলচ্চিত্র সংসদ ফেডারেশন -একাংশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র সম্মেলন এবং বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এছাড়াও গত ১৬ মার্চ, ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের ৫০বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ভবিষ্যতে চলচ্চিত্র সংসদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, অতীতে কী হওয়া উচিত ছিল এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে সংগঠনটি।২৮ ডিসেম্বর,২০১৩ তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে থাকছে বছরব্যাপী আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠান।
চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী এবং যারা চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত তাদের জন্য সুখবর যে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র সংসদ (নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণ) আইনটি বাতিল করে নতুন আইন জারী করেছে। নতুন আইনে পুরানো কিছু বাধ্যবাধকতা বাদ দেয়া হয়েছে। ফলে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একটি বিজয় অর্জিত হয়েছে। (চলবে).......

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.