নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিনয়ী হতে চাই। বিনয়ই জ্ঞানীদের অস্ত্র।

আব্দুল হাই রাজিব

আব্দুল হাই রাজিব › বিস্তারিত পোস্টঃ

সবুজ

০৯ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:২৮

দু’হাতে ব্যাগ পত্তর নিয়া হাসপাতালের করিডোর ধরিয়া আগাইতে আগাইতে দু’আ করিতে লাগিলাম- “আমারে এই হাসপাতাল থ্যাইক্যা মরা বাহির কইরো”। কৃত দোয়া শুনিবার পর জননী যারপরনাই দুঃখিত বোধ করিয়া “কি বলিলি, কি বলিলি” করিয়া আফসোস করিতে লাগিলেন। নিজের কাপড়-চোপড়, শুশ্রুষাকারীর কাপড় চোপড়, হাড়ি-পাতিল, চিকিৎসার কাগজপত্রাদি বহন করিবার সময় এর চেয়ে ভালো কি দোয়া হইতে পারে তখন মাথায় ছিল না । ভর্তির সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করিয়া যখন হাসপাতালের বারান্দার কোণায় নামাজের জন্য দাড়াইছিলাম পাশে হ্যাংলা পাতলা শীর্ণ কায়ার অপুষ্ঠিতে ভুগতে থাকা মলিন যুবকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হইলো। ফুলহাতা শার্টের হাতাগুলো গুঁছিয়ে বাহুপর্যন্ত উঠাইয়া রাখার কারণে হাতে লাগানো পিতলের তাবিজখানা দেখার জন্য ঠাওর করিবার প্রয়োজন হয়না। নামাজে দাড়াইয়া সূরা পাঠ পূর্বে যুবকের বার বার নিয়ত করিবার জন্য হাত উঠানো নামাজের মধ্যে বিরক্তির কারণ হইয়া দাড়াইলো। নামাজ শেষ করিয়া যখন কিছু বলিতে উদ্ধত্য হইলাম পাশের অপর এক ভদ্রমহাশয় হাতটাকে কানের কাছে উঠাইয়া ঘুরাইতে লাগিলেন। যেমনটা আমরা স্ক্রু কে ঘুরাইতে থাকি। বুঝতে দেরী হইলেও অবশেষে উদ্ধার করিলাম সে মানসিক বিকারগ্রস্ত। ওয়ার্ডে থাকা অন্যান্য রোগীদের সাথে আলাপচারিতায় জানা হইলো রোগের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রান্ত হওয়ার পর Multi-Drug Resistant (MDR) রোগীদের উচ্চমাত্রার ওষুধ সেবনের ফলে রোগী কিছুদিনের জন্য মানসিক রোগীর ন্যায় আচরণ করিয়া থাকে। রোগীর মায়ের সাথে বাক্যালাপে জানা হইলো রোগীর নাম “সবুজ”। সেও এমডিআর ধাপে আছে। বৃহত্তর জেলা যখন ছিলো তখন সে আমাদের জেলারই বাসিন্দা ছিলো। ভেঙ্গে চার টুকরা হইবার পর সে এক টুকরার মধ্যে গিয়া থিতু হইলো । কবি আল মাহমুদের জেলা । আমার পড়াশোনা কবির এলাকায় হওয়ায় কথার মধ্যে সেই এলাকার টান থাকাতে সবুজ আমাকে ভাই ভাই বলিয়া সম্বোধন করিত। আমিও সবুজকে ছোটভাই বলিয়া সম্বোধন করিতাম। হাসপাতালের সুদীর্ঘ করিডোরে ওকে নিয়া পায়চারি করিতাম। মজা করিবার ছলে ওকে হাসাইতাম। আমি যা বলিতাম, ওকে তা পুনরাবৃত্তি করিতে বলিতাম।
আমি বলিতাম , আমার নাম সবুজ।
ও তখন বলিত- আমার নাম সবুজ।
আমি বলিতাম-ইসতিরিং বিসতিরিং।
ও তখন বলিত- ইস্তিরি বিড়িরি।
আমি বলিতাম- ব্রুনাই এর রাজধানী বন্দরসেরীবেগওয়ান।
ও তখন বলিত- বর্ণার রাজধানী মন্দিরবাগান

সবুজের ব্যর্থতা দেখিয়া হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিতাম, ভাইয়ের হাসি দেখিয়া সবুজও হো হো করিয়া হাসিতে শুরু করিত।

সবুজ যখন ছোট তখনই তাহার বাবা তাহাকে রাখিয়া পরপারে চলিয়া গিয়াছিলো। লেখাপড়া বলিতে গ্রামের স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্তই তাহার দৌড়। নুন আনতে পান্তা ফুরায় সংসারে লেখাপড়ার আশা করিয়া কোন প্রকার অলীক স্বপ্নের দিকে পা বাড়ানো হয়নাই সবুজের । বন্ধুরা যখন ক্রিকেট, ফুটবল আর জামানার হাওয়ায় গা ভাসাইয়া বেড়ায় সবুজ তখন জীবনের তাগিদে কাজে যোগ দেয়। হাসপাতালে ভর্তির পূর্বের মাসেও কর্মস্থলে ছিলো বলে জানায় সবুজের মা। কিছু টাকা ধারকর্জ করে ঢাকার পথে রওনা দিয়ে কোনমতে হাসপাতাল পৌছায়। হালে ঔষধ জোগাড় করাটাই মুশকিল সাথে পথ্য জোগাড় “গোদের উপর বিষফোঁড়ারই নামান্তর”। পথ্য ঠিকভাবে না হইলে MDR থেকে রোগীকে ফিরাইয়া আনতে ডাক্তারদের বেগ পোহাইতে হয়। চুপিসারে যখন সালুন পাঠাতাম স্বলাজ ভঙ্গিতে ও কৃতজ্ঞতা জানাইতো, দৃষ্টিকে লুকাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করিত। সেটা টের পাইবার পর চুপিসারে সালুন পাঠাইতাম। যেদিন হাসপাতাল হইতে ফেরত আসি সেদিন সবুজের চোখের দিকে তাকাইবার ইচ্ছা আমার ছিলো না। বহু কষ্টে সেদিন বিদায় লইয়াছিলাম। হাসপাতালে দ্বিতীয়বার যখন তাহার সাথে দেখা হইয়াছিলো হাউমাউ করিয়া বুকের উপর আসিয়া পরিলো। চোখের পানি মুছিতে মুছিতে স্বান্তনার বাণী শুনাইয়া পরিস্থিতি ঠান্ডা করিলাম। খেয়াল করিয়া দেখিলাম শরীর ক্রমেই অবনতির দিকে যাইতেছে। চোখ দুটি কোটরে পৌছিয়া গিয়াছিলো। বিছানায় থাকা শরীরটা যেনো মিশে গেছে প্রায়। সবুজের মা’কে জিজ্ঞাসা করিলে প্রত্যুত্তরে কিছু না বলিয়া অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগিলেন। মায়ের হাতে ফলমুল আর কিছু টাকা দিয়া বিদায় নিলাম।

সবুজের সাথে এটাই ছিলো আমার শেষ দেখা।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.