নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবী আমার আবাস। মানুষ আমার পরিচয়।

আবীর চৌধুরী

ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার

আবীর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালিয়ানাঃ আসল-নকল

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫

চকবাজারের স্টারনেটে বসে সেদিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিচ্ছি, অনেক দিন পরে গিয়েছি, তাই অনেকের সাথে অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে। ব্যস্ত, ভিড়ে ঠাসা এলাকাটাতে মানুষ আর গাড়ীর জ্যাম এখন আর কারো বিরক্তির উদ্রেক করে না; সবার চামড়া গণ্ডারের চামড়া হয়ে গিয়েছে।



হঠাৎ, চারদিক-কাঁপানো হিন্দি নাকি ইংলিশ (হয়তো বা কোন আধুনিক! বাংলা গান!) গানের কর্কশ আওয়াজ শুনে সবার নজর গেল একটি পিক-আপ ট্রাকের দিকে। ট্রাকটি ঠিক স্টারনেটের সামনে এসে দাঁড়ালো; এদিকে প্রচুর দোকানপাট- রেস্টুরেন্ট, ফটোকপি-প্রিন্টের দোকান, সাইবার ক্যাফে, কোচিং সেন্টার, আরো কত কি!



ট্রাকের সামনে-পাশে ব্যানার; একটি চিকেন-ফ্রাই-নির্ভর রেস্টুরেন্ট চালু হচ্ছে, তারই বিপণনের এই অভিনব আয়োজন। সবচেয়ে আকর্ষণীয় বা বিকর্ষণীয় যে ব্যাপারটা ছিল, তা হচ্ছে পিক-আপ ট্রাক ভর্তি বেশ-কিছু টিন-এজার যুবক-যুবতী গাদা-গাদি করে নাচানাচি করছে, কোল্ড-ড্রিংক্স খাচ্ছে আর গায়ে ঢালছে, সাথে মাঝে মাঝে "নতুন শুরু হতে যাওয়া রেস্টুরেন্টটার" লিফলেট বিলি করছে। কি অভূতপূর্ব বাঙ্গালিয়ানার বহিঃপ্রকাশ।



ট্রাকটা চলে গেল, অনেকের মধ্যে অনেকরকম অনুভূতি জাগিয়ে। কিছুক্ষণ পরে দোকানের সামনে কিছু কিশোর-যুবক-টাইপ ছেলে এল, সাইকেল চালিয়ে, হাতে-পায়ে-মাথায় স্পেশাল সাইক্লিস্টের পরিচায়কস্বরুপ গ্যাজেট। এখন শহুরে বড়লোকের দুলালেরা আনুষ্ঠানিক/ফেসবুকীয় গ্রুপ করে সাইকেল চালায়; বাইক বিক্রি করে সাইকেলের শো-অফ করে।



স্পেশাল ইভেন্ট আর ড্রেসের ছড়াছড়ি, তাই ব্যবসায়ীরাও এই সুযোগ লুফে নিয়েছে, তারা জনকল্যাণের নামে সাইকেলের দামকে গত ৫ বছরে মাটি থেকে আকাশে নিয়ে গিয়েছে, বিজ্ঞাপন আর মার্কেটিং-এর কল্যাণে সাইকেল-এর মত একটি মহাউপকারী যানবাহন এখন "স্মার্টফোনের" মত ফ্যাশন-আইটেমে পরিণত হয়েছে। এটা অবশ্য অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম। অনেক নতুন ডিজিটাল সেলিব্রিটি ঘোষণা দিয়ে ঢাকা থেকে অমুক-তমুক জায়গায় দীর্ঘপথ ব্যাপী সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা উপহার দিচ্ছে। তিন-চার বছর আগেও এই ট্রেন্ড/কালচার দেখা যেত না।



এই হুজুগেপনার মধ্যে দোষের কিছু নেই, দোষ মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে। আমাদের বাবা-দাদারা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ থেকে শুরু করে শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার জন্যেও সাইকেল ব্যবহার করতেন। তাদের জন্য সেটা ছিল জীবনের তাগিদ, শখ বা আদিখ্যেতার কিছু না।



এখনকার তরুণ প্রজন্মের দুনিয়া-বদলানোর যে "লোক-দেখানো" আবেগ কাজ করে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র বিশুদ্ধতা নেই, কারণ তারা নিজেদেরকেই বদলাতে পারেনি। এই কর্পোরেট-সাইকেল যুগ আসার আগে আমি ও আমার মত গুটিকয়েক পাগল মানুষ চেঁচিয়ে বলত- "সাইকেল চালান, সাইকেল যানজটের সমাধান, পরিবেশ দূষণের সমাধান, জ্বালানি-খরচ ও মূল্যস্ফীতির সমাধান, সামাজিক ভেদাভেদ দূরীকরণের উপায়, নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ সবার জন্য স্বাস্থ্যকর!" তখন সবাই এগুলোকে ছাইপাশ বলে উড়িয়ে দিত।



যাক সেসব পুরোনো কথা, আসল কথায় আসি। ছেলেগুলো স্টারনেটে এসেছে প্রিন্ট করতে, "চট্টগ্রাম সাইক্লিং এসোসিয়েশন" লেখা তিনটি সাদামাটা পোস্টার। আমি ওদের সাথে এসব নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তারপর বললাম ওদের সংগঠনের নামে ত্রুটি আছে। প্রথম ত্রুটি শব্দ বাছাই-এর, সাইক্লিং এর স্থলে সাইক্লিস্ট হবে। দ্বিতীয়টা গুরুচণ্ডালি, ভাষার অপমিশ্রণ, সব যখন ইংরেজী শব্দে লেখা হচ্ছে, তখন চট্টগ্রাম-এর জায়গায় চিটাগাং লিখতে দোষ কি? ওরা আমতা-আমতা করে বলল, "ভাইয়া, কাল একুশে ফেব্রুয়ারী তো, তাই... মানুষ দেখলে কি বলবে?"

আহ্লাদিপনা দেখে ভিতরে গা-টা জ্বলে গেল, কিন্তু প্রকাশ করলাম না। ওদেরকে বললাম, যদি কোন শব্দের সহজ ও প্রচলিত পারিভাষিক শব্দ পাওয়া না যায় (যেমন, প্রিন্ট, সাইক্লিস্ট, স্মার্টফোন, চিকেন-ফ্রাই, ইত্যাদি) তবে ঐসব শব্দের ব্যবহারে কোন সমস্যা নেই।



এসব ছেলে-ছোকরার কথা কি বলব, বড়-বড় মানুষদের মধ্যেও ভাষার ব্যবহার ও ভাষাদিবস পালন নিয়ে অদ্ভুত ও মিশ্র বৈপরীত্য দেখা যায়। বিশেষ দিবসে বিশেষ রিংটোন, রিংব্যাক-টোন, ইত্যাদি তো মোবাইল-অপারেটরদের পাবলিসিটি-স্টান্ট; কিন্তু ব্যক্তি-মানুষেরাও ফেসবুক প্রোফাইলে বিশেষ দিবসে নিজেদেরকে বিশেষায়িত করতে পিছিয়ে থাকেন না। ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে বাংলাকে জড়িয়ে ধরা হয়, অন্য সব প্রয়োজনীয় বা অপ্রয়োজনীয় ভাষাকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়। জনসমাগমে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বলে ফেললে (সঙ্গত কারণে, ফ্যাশন দেখাতে নয়) কারো চোখ উপরে উঠে, কারো জিভ বের হয়ে আসে।



পরিশেষে, গত রাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি ও গাজী টিভিতে দেখা একুশের স্পেশাল টক-শো দুটোর কথা না বললে আমার লেখাটাই অপূর্ণ রয়ে যাবে। গাজী টিভির টক-শো-টা ভালই ছিল, সমস্যা ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি'র "আজকের বাংলাদেশ"-এ। সঞ্চালক সহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সবারই বাংলা ভাষা নিয়ে যে উপলব্ধি- তাতে প্রচুর ঘাটতি ছিল।



তাদের জ্ঞাতার্থে আমি বলতে চাই, প্রত্যেক ভাষারই মান ভাষার দরকার আছে, আঞ্চলিক ভাষাও থাকবে তার নিজ স্থলে। সমস্যা হল ঢাকার মত কস্মোপলিটান শহরের মিশ্র-অদ্ভুতুড়ে ভাষার ব্যবহার নিয়ে। ইংরেজী-কুট্টি-জামালপুর-ময়মন্সিং-কুমিল্লা-নোয়াখালী-ফেনী, এই সব অঞ্চলের ভাষাকে জগাখিচুড়ী করে ঢাকাতে একটা অজাতের ভাষা তৈরী হয়েছে, যাকে কিছু জাতবিহীন মানুষ অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়ে ফেলছে। মানুষের ভেদাভেদ যেমন সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য, ভাষাতেও সেরকম থাকা বিচিত্র কিছু নয়।



কিন্তু, একান্ত বন্ধুদের আড্ডায় যেটা "আকর্ষণীয় ললনা", ধোলাইখালে সেই একই শব্দ দিয়ে "লোহালক্কড়" বুঝায়; সিলেটে যে শব্দটা শুনলে ভদ্রঘরের মেয়েরা অপমানিত হবে, চট্টগ্রামে সেটা হয়তো একটি সুস্বাদু ডাল দিয়ে তৈরী খাবার; সুন্দর জিনিস কখন জটিল আর জটিল জিনিস কখন সুন্দর হয়ে যায়- সেটাও বুঝতে হবে।



গাজী টিভিতে আসা প্রবীণ এক সাহিত্যিক, নাম সম্ভবত সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বলেছিলেন- "Language makes Culture; without Culture man is Vulture!"

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:৩৯

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: ভাই বাংরেজী শব্দের সাথে পরিচয় না থাকলে তথাকথিত আধুনিক ছেলেমেয়ের কাছ থেকে জেনে নিন।।

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৬

আবীর চৌধুরী বলেছেন: ২০০৭ থেকে ফেসবুক ব্যবহার করি, তার-ও আগে থেকে মিগ, হাই-ফাইভ, ইত্যাদি ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। বাংলা-ভাষাভাষীদের সাথে বাংলায় কথা বলতে ইংরেজী হরফে বাংলা কথা লিখতেই হত। কারণ, বিজয় ব্যবহার করা সহজ ছিল না, এবং তখন-ও অভ্র-র মত "ফোনেটিক" বাংলা সফটওয়্যার আসেনি। সামু ব্লগ ও প্রথম-আলো ব্লগেও আমি ভালভাবে লিখতে শুরু করি অভ্র-র কল্যাণে।
এখনকার কথা সম্পূর্ণ আলাদা।
আমি বাংলিশ লেখার বিপক্ষে না, আমি বলেছি ৭০% মানুষ যারা ফেসবুক বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ব্যবহার করে তারা বাংলিশ লিখতে গিয়ে ভুলভাল, হাস্যকর ও বিদ্রুপাত্মক ভাষার জন্ম দেয়। প্রচলিত ফেসবুকীয় ভাষায় এদের "মুরাদ-টাকলা" বলে; ফেসবুকে বা গুগলে এটা লিখে সার্চ দেন।
আমি এখন বাংলিশ-এ-ই এই কমেন্ট লিখছি, কিন্তু অভ্র সেই কোডকে রূপান্তরিত করে এখানে বাংলা দেখাচ্ছে।
আধুনিকতার মাপকাঠি একেকজনের কাছে একেকরকম। যদিও আমি নিজেকে ঠিক ইন্টারনেট যুগের তরুণ বলে মনে করি, তবুও আমি আমার চেয়ে জ্যোষ্ঠদের একচেটিয়াভাবে অনাধুনিক বা কনিষ্ঠদের একচেটিয়াভাবে আধুনিক মানতে নারাজ।

তারপরেও অসংখ্য নব্য-আধুনিক, বাংলা ও নিজেকে অপমানকারী ইন্টারনেট-ব্যবহারকারী দেখবেন; যারা অন্য কারো ভাগনে জন্ম নেওয়ার পর লিখবে- I have no vagina :(

বিচিত্র!

২| ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:৪২

সচেতনহ্যাপী বলেছেন: আমিও ঠিক এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।। আর আশ-পাশের দিকে তো অহরহই দেখতে পাবেন বাংলা ও ভিন্ন ভাষার চর্চা,যারা বাংলাই শুদ্ধ করে লিখতে পারে না। একপাতা লিখতে দিলে কম হলেও দশটা বানান ভুল পাবেন।।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.