নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবী আমার আবাস। মানুষ আমার পরিচয়।

আবীর চৌধুরী

ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার

আবীর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

অয়ন এখন মান-সঙ্কটে

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৩

আমি অয়ন। আমার সব হজম হয়, কিন্তু অপমান সহজে হজম হয় না।

শান্তিতে-স্বস্তিতে থাকার জন্য ৬/৭ বছর আগে নিজেদের কোলাহলপূর্ণ স্থায়ীনিবাস ছেড়ে এই এলাকায় এসেছিলাম। তবে, "জোর যার মুল্লুক তার", আর "শক্তের ভক্ত নরমের যম"- প্রবাদগুলি সব স্থানের জন্য প্রযোজ্য।

পুরানো সব তিক্ত অভিজ্ঞতা বললে উপন্যাস হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক কাহিনী বলি।

আমাদের বিল্ডিং-এ নতুন দারোয়ান হিসেবে সিদ্দিক নিয়োগ পায় কুরবানীর আগে/পরে। কুরবানীর পরের দিনই আমার বাবা-মা বোন দুটিকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে যায়। ৪/৫ দিন আমি বাসায় একা ছিলাম। ২ দিন রাতে দাওয়াতে বেরিয়েছি। আর কোন কাজে বের হইনি। খুব গুরুত্বপূর্ণ দরকার না হলে ঘন ঘন বাইরেও যাইনা। গেলেও খুব চেষ্টা করি গেইট বন্ধ করার আগে ফিরে আসতে।
এই ৫ দিনের যেই ২ বার বের হয়েছি, ২টাই কুরবানী উপলক্ষে দাওয়াত। গত ৭ বছরের মত এই ২ দিনেও পারতপক্ষে কারো সাথে কোন কথা না বলেই এলাকা থেকে বের হই। কুরবানীর ২ সপ্তাহ আগে থেকে আমাদের দরজার সামনের সিড়ির লাইট-টা নষ্ট, নতুন লাইট লাগানো হয়নি। তবে, কুরবানীর পরে আমাদের পাশের বাসার প্রতিবেশীরাও ছুটিতে; আমাদের ঘরেও শুধু আমি একা; আমিও বের হচ্ছি- তাই ২য় দিন আমি নতুন দারোয়ানের সাথে কথা বলতে বাধ্য হই।

বাইরে যাওয়ার সময় নিচে দারোয়ানকে বললাম- "তুমি নতুন দারোয়ান? নাম কি?"
সে হতভম্ব হয়ে বলল- "সিদ্দিক"।
আমি বললাম- "আমাদের ৪ তলার সিড়ির লাইট তো অনেক দিন ধরে নষ্ট। এখন মানুষজন নেই; সমস্যা হতে পারে; লাগিয়ে দিও।"
সিদ্দিক কিছু বলতে চাইছিল। কি বলবে বুঝছিল না। আমি তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেলাম। লাগানো-না লাগানো জমিদারের ব্যাপার।

সেদিন বন্ধুর বাসায় কুরবানীর দাওয়াত খেয়ে সাড়ে ১০টা বাজেই রিকশায় উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যেহেতু বাবা-মা ঢাকায়, দেরি হয়ে গেলে গেইট খুলে দেওয়ার আর কেউ নেই। তাই এই তাড়াহুড়া। ১১ টার আগে বাসায় পৌছে দেখলাম- মেইন কলাপসিপল গেইট-টা লাগানো, তালা ঝুলছে, কিন্তু লক লাগানো না। চারদিকে মানুষের নড়াচড়া নেই। আমি খুলে আবার গেইট লাগিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। তিনটা গেইট-ই বন্ধ, তালা লাগানো না, বাইরে থেকে বুঝা যাবে না। আমার কাছে চাবি থাকলে সবগুলি আমিই লাগিয়ে দিতাম। কিন্তু, নিজেকে বুঝ দিলাম, হয়তো জমিদারের বাসায় কেউ বাইরে গিয়েছে, বা যাবে। আর আমিও দারোয়ানকে গেইট খুলা রাখতে বলিনি। নিজে আর আগ বাড়িয়ে দারোয়ানকে কল দিলাম না, বা, খুঁজলাম না। অতিরিক্ত কেয়ার করার ফলাফল ২০১৩ সালে পেয়েছিলাম। দারোয়ানের প্রতি সহানুভূতিশীল মন্তব্য করার কারণে বিশ্রিভাবে সাকিবের কাছ থেকে অপমানিত হয়েছিলাম; সেটা অতীত।

যেদিন রাতে বাবা-মা ঢাকা থেকে ট্রেনে আসবে, সেদিন লাইট লাগানো হল। দরজা খুলে দেখছিলাম লাইট-টা বেশ উজ্জ্বল। তখন ছাদ থেকে বিড়ালের মত কালো ছোট মানুষ একটা নামছিল; দেখি এটা সিদ্দিক। আমি বললাম, "আজ রাতে মা-বাবা ঢাকা থেকে আসবে, ট্রেন দেরি হতে পারে, গেইট পারলে একটু দেরিতে বন্ধ করিও।" সিদ্দিক প্রথম আমার সাথে কথা বলল- "তুমি ফোন করবে আমাকে"। সিদ্দিক গেঁও চাঁটগাইয়্যা; এরকম আঞ্চলিক ভাষা আমার বাবা-মাকেও বলতে শুনিনি। আমি তার ভাষা, আর কথার ধরণ দেখে অবাক হলাম। যদিও অবাক হওয়ার বিষয় না; এই বিল্ডিং-এ গত ৭ বছরে জমিদারের সব জাতীয় চাকর আমাদের সাথে "জমিদারসুলভ" আচরণ করে এসেছে। সে আমাকে তার মোবাইল নাম্বার দিল। মোবাইল নম্বর সেইভ করে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "সাকিব অফিস থেকে এসেছে?" এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল, সিদ্দিককে বুঝিয়ে দেওয়া আমি সাকিবের সমবয়সী। কারণ, আমাকে দেখতে আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট ছেলের সমান লাগে। গর্দভ দারোয়ান সিদ্দিক উত্তর দিল- "হ, সাকিব বাসায় আছে।" আমি বুঝলাম, এই সিদ্দিক গেঁও খ্যাত। আপনি/তুমি/তুই সব তার কাছে এক। আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম।

এর ১ সপ্তাহ পরের কথা। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুশফিকের ছোট বোনের বিয়ের দিনক্ষণ চলে এল। ডাক্তার দম্পতির বিয়ে, ৪ টা প্রোগ্রামের এলাহী কারবার, দুই হলুদ, বিয়ে আর বৌভাত। আমার সব প্রোগ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বন্ধুরা জোর করায় সবগুলিতেই যেতে হয়।

২০১২ সাল থেকে বিভিন্ন বন্ধুর বিয়ে ছাড়া আর কারো বিয়েতে তেমন একটা যাইনি; ক্যারিয়ারের চাকা ভালভাবে সচল হয়নি বলে আত্মীয়-স্বজনের বিয়ে এড়িয়ে চলি, বন্ধুরা বুঝতে পারবে বলে তাদের দাওয়াতে যাই। বন্ধুদের বিয়েগুলির প্রোগ্রামগুলিতে রাতে থাকার ব্যবস্থার কারণে আমার সুবিধা হত, রাতে দেরি করে বাসায় ফিরতে হত না। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, দেরি হয়ে যাওয়ার কারণে বাসায় না এসে আমার দাদুর বাড়িতে চলে যেতাম। সেখানে বড় জেঠাত ভাই/ফুফাত ভাইদের সাথে থাকা যেত; এখন তাদের বৌ-বাচ্চা নিয়ে সংসার, সেই সুযোগ আর নাই। দেরি করে ফিরলে আওয়াজ হয়, বাবা/মাকে নেমে তালা খুলতে হয়, আর তাছাড়া রাস্তাঘাটের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও আছে।

মুশফিকের বোনের বিয়ের ১ম প্রোগ্রাম; তুমুল বৃষ্টি। কোনমতে সিএনজি নিয়ে ১ টার মধ্যে বাসায় ফিরে এলাম। অন্যসময় এরকম মুহুর্তে বাসায় ফোন করি। আমার বাবার কাছে এই বাসায় আসার পর থেকেই গেইটের অতিরিক্ত চাবি আছে; বাবার আসতে দেরি হয়; তিনি নিজে রাতে এসে গেইটের লক খুলে আবার লাগিয়ে বাসায় আসতে অভ্যস্ত। কোন কারণে আমার আসতে দেরি হলে বাসা থেকে সেই চাবি নিয়ে বাবা/মা গেইট খুলে দিতে আসে। সেদিন বাসায় ফোন করতে গিয়েও করলাম না; কারণ মনে পরল বাবার কাছে মেইন কলাপসিপল গেইটের চাবি আছে। কিন্তু তার আগে যেই সাদা গেইট পেরিয়ে আসতে হবে, সেটার নতুন চাবি নেই। মাত্র ৪/৫ দিন আগে থেকেই রহস্যজনকভাবে এই গেইটে নতুন করে তালা লাগানো হচ্ছে। তাই, আমি বাধ্য হয়ে দারোয়ানকে কল দিলাম। সে এসে দরজা খুলতে খুলতে বলল- "রাত হয়ে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি আসতে পারলে ভাল হত।" আমি হেসে গ্রাম্য মানুষটার কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, "দাওয়াত তো, আর তার উপর বৃষ্টির কারণে গাড়ি পেতেও দেরি হয়ে যায়।" এই বলে চলে এলাম বাসায়।

মুশফিকের বোনের বিয়ের ২য় প্রোগ্রাম; ছেলের বাড়িতে হলুদ। শহরের হলুদ; দেরিতে আরম্ভ হল। সাড়ে ১০টা বাজে গাড়িবহর নিয়ে সুদূর ফয়েজ লেইকের পাশে বরের বাসায় পৌছলাম। বাসা থেকে নয়টায় বের হওয়ার সময় সিদ্দিক আমাকে দেখেছিল; দাওয়াত খেতে যাচ্ছি সেটাও আমার ড্রেস দেখে বুঝার কথা। ঠিক ১০টা ৪০ মিনিটে সিদ্দিক আচমকা আমার মোবাইলে কল দিল; তখন বরের বাড়িতে হলুদের মালামাল নিয়ে আমরা কনেপক্ষ ঢুকছি। আমি আশ্চর্য হয়ে ফোন রিসিভ করলাম। সে জিজ্ঞেস করল, "ভাইয়া আপনি কি এখন আসছেন? আমি গেইট বন্ধ করব।" আমি কোনমতে তার অবোধগম্য আঞ্চলিক ভাষা, আর বিয়েবাড়ির শব্দের মধ্যে শুনে-বুঝে তাকে বললাম- "আমি মাত্র এসেছি, আসতে দেরি হবে, তুমি গেইট লক করে শুয়ে পর।" আমার বন্ধুরা শুনে ভেবেছিল, বাবা-মা বা গার্লফ্রেন্ড/বৌ-জাতীয় কেউ ফোন করেছে; দারোয়ান বাসায় চলে আসতে বলছে শুনে তারা অনেক তামাশা করল। সেদিন তবে গেইট ২টা বাজেও খোলা। দারোয়ান বন্ধ থাকলেও এই বিল্ডিং-এর পুরানো কর্মচারী হোসেন সেদিন জেগে ছিল। সে চোরের মত এসে গেইট খুলে দিল। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম গেইট কেন এখনও খোলা। সে বলল- "গাড়ি বের হবে।"

মুশফিকের বোনের ৩য় প্রোগ্রাম- বিয়ে। সেদিন সাড়ে এগারটার কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে গিয়েছিলাম। বিয়ের সাজগোজে আমাকে যেতেও দেখেছিল দারোয়ান। তাও গেইট বন্ধ করে দেয়। তাও আবার সাড়ে এগারটায় বরাবর। সাধারণত ওই সময়েই গেইট বন্ধ করা হয়। আমার দুই মিনিট আগেই নাকি আমার বাবা এসেছিল- পরে জেনেছিলাম। আমি এসে ভিতরের সাদা গেইটের তালা বন্ধ থাকাতে বাসায় ফোন না করে তাকে ফোন দিলাম। সে এসে গেইট খুলে আমি সিড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় তার ভাষায় আমতা আমতা করে বলল- "আরো তাড়াতাড়ি আসবে। এত দেরি হয় কেন?" আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। পেছনে ফিরে শক্ত কিন্তু ভদ্র ভাষায় নিচু স্বরে বললাম- "আমি তোমার বন্ধু, নাকি এই বাসার কাজের লোক? আমার সাথে এভাবে কথা বলবে না। কোন দারোয়ান বা গার্ড তো এভাবে আগে কথা বলেনি। তুমি কি আচরণ জানো না, নাকি কথা বলতে পারো না?" সে একটু ভয় পেয়ে চুপ মেরে থাকল। আমি চলে এলাম।

মুশফিকের বোনের বিয়ের ২য় প্রোগ্রাম; বৌভাত। ১২ বাজেও গ্যারেজের পরিবেশ রাত ৮টার মত। দেখে খুব আজব লাগলো। আমি এসে দেখি দারোয়ান সিদ্দিক ক্লান্ত আর ভীতভাবে গ্যারেজের মুখে চেয়ারে বসে আছে। বাইরে সাকিবের হাঁটাচলা, ড্রাইভারদের আনাগোনা, সাকিবের বন্ধুর উপস্থিতি বলে দেয়- কেউ বাইরে যাবে বা আসবে। মালিকের জন্য সকল নিয়ম রদ- এটাই সব জায়গার নিয়ম। আমি নিজে নিজে মুচকি হেসে বাসায় চলে আসলাম। ভাবতে লাগলাম, কিভাবে পৃথিবীর সব মানুষ বুঝে যায়, অন্যের উপর কখন-কিভাবে খবরদারি করতে হয়।

এরপর ১ সপ্তাহের মত আর কোন দাওয়াত নেই। রাত করে বাসায় ফেরার প্রশ্নই উঠে না। "ফার্মের মুরগী" বা "মাম-ড্যাডের সন্তান" তকমাগুলি লাগানো নিয়ে আমি চিন্তিত না। সরল মধ্যবিত্তের সন্তান হিসেবে পরিবারের সম্মানটাই আমার কাছে মুখ্য। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অনার্স পাস করেও আমি ইঞ্জিনিয়ারিং জব করি না। উন্নত কোন দেশে যেকোনভাবে মাইগ্রেট হওয়াটা আমার মূল লক্ষ্য। আপাতত, ফ্রি-ল্যান্সিং ও অনলাইন নিউজপোর্টালের কাজের কারণে ইন্টারনেটের পিক আওয়ারের সদ্ব্যবহার করতে আমার দিন হয়েছে রাত, রাত হয়েছে দিন। কে এতে কি মনে করছে, তাতে আমার বা আমার পরিবারের কিছু যায় আসে না। আমরা আমাদের খাই-পরি; বাইরের কারো কোন ক্ষতি করি না। টিউশনি বা ব্যক্তিগত কোন জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে বেরই হই না। এমনকি, প্রায় ১ বছর আগে জিমে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু বিরক্তির হাত থেকে বাঁচতে। সম্মান ও মর্যাদা আমার কাছে শরীরগঠনের চেয়ে অনেক বেশি কিছু।

মাঝখানে একদিন সকালে বাবাকে ডেকে বাড়িওয়ালা বলল, আমাদের বিদ্যুতের মিটার নাকি কে ভেঙ্গে ফেলেছে। বাবা স্বভাবতই বলল, নিচে দারোয়ান থাকা সত্ত্বেও বাইরের অনেক ধরণের মানুষের আনাগোনা আছে। কে কখন আসে, কি উদ্দেশ্যে আসে, বলা যায় না। তাছাড়া রাতে এখানে সিড়ির পাশের ঘরে দারোয়ান সিদ্দিক ছাড়া অন্যান্য মানুষ-ও থাকতে দেখেছেন তিনি; যারা অনেক রাত জেগে টিভি দেখে। তারা তো কোন আওয়াজই করে না। সেদিন বাসায় এসে বাবা আমাদের এই খবর দেওয়াতে বুঝলাম, বিদ্যুতের মিটার ভাঙ্গার কারণেই কয়দিন ধরে ভিতরের সাদা ছোট গেইটেও তালা লাগানো হচ্ছে।

১ সপ্তাহ পরেই ছিল কলেজের বন্ধু ডাক্তার নুসরাতের বিয়ের দাওয়াত; দূর্গাপূজার মৌসুম। ফেসবুকের ইভেন্টের কল্যাণে এই বিয়ের কথা বেশ আগে থেকেই জানতাম। মুশফিকের বোনের বিয়ের অভিজ্ঞতা থেকে ঠিক করেছিলাম এই বিয়ের কোন অনুষ্ঠানে যাব না। একে তো মেয়েবন্ধুর প্রোগ্রাম- রাতে থাকার কোন জায়গা পাবো না, দ্বিতীয়ত ফেসবুকের দাওয়াতের সব বিয়েতে যাওয়া মানায় না। কিন্তু, হলুদের আগে নুসরাত ফোন করে অনুরোধ করাতে না যাওয়ার প্ল্যান-টা বাদ দিতে হল।

নুসরাতের গায়ে হলুদের দিন থেকে দূর্গাপূজা শুরু। শহরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে গভীর রাতেও জনগণের প্রচুর আনাগোনা। ১২টার দিকে ফিরেছিলাম সম্ভবত। আমাদের বিল্ডিং-এর বাকি ৩ ভাড়াটিয়া হিন্দু হওয়াতে কিংবা পূজার ছুটিতে বাড়িওয়ালার ছেলে ঘরের বাইরে থাকাতেই সম্ভবত গেইটগুলি খোলা ছিল। আশেপাশে কাউকে দেখিনি। সেদিনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছিল। সোজা বাসায় চলে গিয়েছিলাম।

নুসরাতের বিয়ের দিন পূজার শেষদিন; বৃহস্পতিবার। বন্ধুর বিয়ে; তাই জমকালো কালো স্যুট-শার্ট-প্যান্ট-জুতা পরে বিয়েতে গেলাম। যাওয়ার সময় দারোয়ান সিদ্দিক কোন কাজে হয়তো বাড়িওয়ালার বাসায় দোতলায় আসছিল; আমিও সেসময় নামছিলাম; সে আমাকে স্পষ্ট দেখল; গলা-চোখ ঘুরিয়ে আমার পোশাক-আশাক এমনভাবে দেখছিল যেন কোন ভিখারী হঠাৎ ধনীর বেশ ধরেছে। সেদিন রাতে বারোটার আগেই ফিরে এলাম। আমি আশাও করছিলাম না যে গেইটের লক খোলা থাকবে। কিন্তু যেহেতু সিদ্দিক আমাকে দাওয়াতের পোশাক পরে বের হতে দেখেছে, আর যেহেতু ভিতরের গেইটের চাবি বাসায় থাকার কথা না, সে কারণে আমি সিদ্দিককে ফোন করলাম। আমি ফোন করার সাথে সাথে ভিতরে গ্যারেজে দারোয়ানের খাটের জায়গা থেকে রিংটোন শোনা গেল। রিংটোন বড় হওয়াতে আমি কেটে দিলাম; ভাবলাম ও হয়তো জেগে যাবে, আর না দিলেই ভাল হবে। কিন্তু দুই মিনিট পরেও কেউ না আসাতে আমি আবার কল করতে গিয়ে দেখলাম, দারোয়ানের মোবাইল অফ।
৫/৬ দিন আগে আমার বাবা রাতে বাজার নিয়ে যখন এসেছিল, তখনও সে একই কাজ করেছিল। এর আগের সব দারোয়ানই কম-বেশি বাজার তুলে দেওয়া, বা ডাস্টবিনের ময়লা ফেলে দেওয়ার মত কাজ কালেভদ্রে করত; বকশিশের বিনিময়ে অবশ্যই; যদিও কতৃপক্ষের নাখোশ হওয়ার কারণে পরে সব দারোয়ানই এসব কাজ এড়িয়ে চলত। ভাড়াটিয়ারাও বলতে গেলে এই বিল্ডিং-এ এক প্রকার নীরব-অধনস্ত কীটপতঙ্গরূপো জীব।
দারোয়ানকে মোবাইলে না পেয়ে আমি বাসায় ফোন করলাম। মা বলল, একটু আগেই নাকি বাবা ঘরে ঢুকেছে, দারোয়ানের সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ার তো কোন মানেই হয় না। আমি মা-কে আস্তে ধীরে নামতে বললাম। আমি মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে মেইন গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে ফেসবুক আপডেট দেখছিলাম। ২/৩ মিনিট পরে খেয়াল করলাম, অন্ধকার গ্যারেজে কালো-ছোট মতন একটা কেউ দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। আমি তাকানোর পরে সেই ছায়া কাছে আসতে শুরু করল। গেইটের বাইরে আমি, ভেতরে সিদ্দিক- প্রায় ১ মিনিটের মত চুপচাপ দুইজন দুজনের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর আমি রাগত স্বরে বললাম- "কি আমাকে চিনতে পার নাই? আমাকে আগে কোনদিন দেখ নাই? আমি তো কোট-প্যান্ট-জুতা পরা চোর। চুরি করতে আসছি, ডাকাতি করতে আসছি।"
উত্তরে একেবারে সতেজ-ঘুমহীনভাবে অভিভাবকসুলভভঙ্গিতে দারোয়ান আমাকে যা বলল, তা এরকম- "তোমার প্রতিদিন এত দেরি হয় কেন? এত দেরিতে রাতে কি কর? একটু আগে তো তোমার বাবা এসেছে, তার সাথেই ঢুকতে পারো নাই?" আমি ব্যাটার কথার ধরণ দেখে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। মোটামুটি বড় স্বরেই বলতে আরম্ভ করলাম- "তোর সাহস তো কম না! তুই আমাকে এসব বলার কে? আর তুই কি আমাকে প্রতিদিন এত রাতে আসতে দেখসস? তোদের জন্য সামাজিকতা রক্ষাও করতে পারব না? তুই ফোন নন্ধ করছস ভালো কথা, এসে আবার চোর ধরার মত করে কি দেখতসস? এখন থেকে স্যার-স্যার করে কথা বলবি। বেয়াদ্দব কোথাকার!"
এসব বলতে বলতে সে কলাপসিবল গেইট খুলে দিল। মাঝখানে কথা বলতে চাইছিল। আমার কথার তোড়ে ভয়ে কিছু বলল না। দেখলাম ভেতরে সাদা গেইটে সেদিন তালা নাই। অর্থাৎ, সেদিন সিদ্দিকের কোন দরকারই ছিল না। মা এসে ঠিকই তালা খুলে দিতে পারতো।

পরের দিন নুসরাতের ওয়ালিমাতে আর গেলাম না। বারবার এরকম অশিক্ষিত-গেঁও-ঢিলা কিন্তু বেয়াদব লোকের সামনে পরতে ভাল লাগছিল না। আর তাছাড়া, বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ আর ভদ্রতার মুখোশ পরে থাকব? হঠাৎ লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ার একটা ভয় নিজের মধ্যে সবসময় কাজ করে। নিজের স্থায়ী নিবাসের এলাকায় জন্ম থেকে যৌবনের শুরু পর্যন্ত সম্মান ও দাপটের সাথে কাটিয়ে এসেছি। অথচ, যৌবনের মাঝামাঝি এসে এই এলাকায় ভিজে বেড়ালের মত চাকর-বাকরের হাতে অপদস্ত হতে হবে ভেবেই শিওরে উঠছিলাম। আমার বাবা-মা এসব তেমন আমলে নেন না। তারা নিজেরাও চুপসে থাকেন, জীবনের কোন পর্যায়ে কোনরকম ক্ষমতার প্রয়োগ-ই করেনা তারা।

এর পরদিন থেকে আমাদের বাসায় কাজের বুয়া আসছিল না। এই কাজের বুয়া জমিদারের বাসার কাজের লোক। পর পর দুই দিন বুয়া না আসাতে ৩য় দিন আমার মা বুয়া এসেছে কিনা খুঁজতে নিচে নামল। গ্যারেজে আর গেইটের পাশে কাউকে না দেখে মা বাইরের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেন। মসজিদের সামনে লাইটপোস্টের নিচে দারোয়ান সিদ্দিক এলাকার সিকিউরিটি গার্ডের সাথে কথা বলছিল। আমার মা গিয়ে প্রথমে বুয়ার কথা জিজ্ঞেস করল।

মা তারপর সেদিন আমার সাথে ওর কথোপকথন নিয়ে কিছু উপদেশ-আদেশমূলক কথা বলতে লাগলেন। মাঝখানে মাঝখানে সিদ্দিক ভাঙ্গা ভাঙ্গাভাবে যা বলল, তার সারমর্ম এরূপ- "ও সবসময় এরকম দেরি করে আসে। ওর চলাফেরার লক্ষণ-ও ভালো না। টাঙ্কির পানি শেষ হয়ে গেলে লাইনে পানি না থাকলে ও ফোন করে; সাকিব ভাই বলছে এভাবে ওর কথা শুনে পানির পাম্প না ছাড়তে। আর, ও-ই তো মিটার টা ভেঙ্গে ফেলেছে। কেন, সেদিন খালাম্মা (জমিদার) আঙ্কেলকে (আমার বাবা) বলে নাই?"

শেষের কথাটা শুনে শুধু আমার মা না, আমাকে চেনা-জানা, বন্ধু-দুশমন, যেকেউ-ই ভয়াবহ বিস্মিত হয়ে যাওয়ার কথা। একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমি জানি, বৈদ্যুতিক মিটার নষ্ট হয়ে গেলে ভুতুড়ে বিল আসবে; অতিরিক্ত বিলের বোঝা আমাদেরই বইতে হবে। আর, নতুন মিটারের টাকাও আমাদের দিতে হবে। কেন আমি জেনেশুনে অযথা নিজেদের খরচ বাড়াব? আর মিটার ভেঙ্গে আমি কার ক্ষতি করব? কোন উদ্দেশ্য কারণ ছাড়া কেন আমি এটি করব?

আমার মা সিদ্দিককে জিজ্ঞেস করল, "তুমি দেখস ওকে মিটার ভাঙ্গতে?" সিদ্দিক বলল ও দেখেনি, ওকে বলা হয়েছে। যে আমার ওপর এই অযৌক্তিক দোষের বোঝা দিয়ে অপমানিত করল, তার কি উদ্দেশ্য? সে কি প্রমাণ করতে চায় আমি সন্ত্রাসী, চোর, মাদকাসক্ত, নাকি অন্যকিছু? আমার মা সিদ্দিককে যা পারে বুঝিয়ে ঘরে চলে এল। সেদিন রাতে বাবার সাথে এসব নিয়ে অনেক আলোচনা হল। কিছুতেই এই উপসংহারে আসা গেল না যে কে এবং কেন আমার উপর এই অদ্ভুত দোষ চাপাচ্ছে। কখনো মনে হল এটি ভাড়া বাড়ানোর পায়তারা, কখনো মনে হল এটি ভাড়াটিয়া উচ্ছেদের জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি, কখনো মনে হল এটি বাড়িওয়ালার ছেলের অকারণ প্রতিহিংসার ফল, কখনো মনে হল এটি বাহ্যিক দিক থেকে ঢিলা মনে হওয়া দারোয়ান সিদ্দিকের ফন্দি-ফিকির।

আমার খুব অপমান বোধ হতে লাগল। এসব অপমান অন্তর পুড়িয়ে ফেলে। বাইরের মানুষদের এসবের কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। আমার মা-বাবা কেউই এসব নিয়ে বাড়িওয়ালা বা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে রাজি হল না। আবারও, নীরবে সহ্য করা, অপমান মেনে নেওয়াটাকেই "ভদ্রতা"-র বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উপস্থাপন করল আমার বাবা-মা। আগেও করে এসেছে, হয়তো আমরণ করে যাবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.