নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবী আমার আবাস। মানুষ আমার পরিচয়।

আবীর চৌধুরী

ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার

আবীর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

চিত্তহীন মধ্যবিত্ত

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৭:৩৮

একটি পরিবার। মধ্যবিত্ত পরিবার; অবশ্য উচ্চবিত্তের সমান সামাজিক মর্যাদা এদের।

গৃহিণীর বয়স ৫০ এর ঘরে। উচ্চশিক্ষিত। জীবনের বেশির ভাগ সময় হাউজওয়াইফ ছিলেন। সংসার ও বাচ্চাদের দিকে দেখে পেশায় জড়াননি। তিন ধরণের পেশায় যেতে পারতেন। শিক্ষকতা, সাধারণ চাকরি (ব্যাংক/বীমা/এনজিও), ব্যবসা। ব্যবসার জন্য পুঁজি ছিল না স্বামীর কাছে। চাকরির জন্য উনার নিজের দেওয়ার মতো সময়, চাকরির উপযুক্ত পরিবেশ এবং ভালো চাকরির জন্য মামা ধরার মত আত্মমর্যাদাহীনতার অভাব ছিল। তাই সংসার জীবনের শুরুর দিকে ৩টা স্কুলে অল্প সময়ের জন্য চাকরি করেছিলেন। পেশাগত রেষারেষির কারণে শেষের ২টাতে টিকতে পারেননি। এখন অবশ্য অনেকটা বাধ্য হয়েই অর্থের জোগানের জন্য আবার পুরানো একটি স্কুলে যোগ দিয়েছেন। এবং পুরানো স্কুলের কতৃপক্ষ-ও তাকে সম্মানের সাথে বরণ করে নিয়েছে।

গৃহকর্তার বয়স ৬০ এর ঘরের শেষের দিকে। দেশের ও জেলার সিনিয়রমোস্ট লয়ারদের একজন। ৩৫ বছর আইনপেশায় থেকেও বাড়ি-গাড়ি ও সন্তানদের অভাবনীয় উন্নত জীবন দিতে না পারায় প্রমাণ করে দেয় এই আটপৌরে লোকটার সৎ ও সরল জীবনাদর্শকে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মুদির দোকানদার, স্বাধীন দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকার সহ-সম্পাদকসহ, এমনকি ২ বছরের মত পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর-ও ছিলেন। অর্থনৈতিক ও নৈতিকতা বিবেচনায় পেশা বদলে গিয়েছেন। আয়-উপার্জনের চেয়ে জমা-সঞ্চয় সবসময় কম ছিল। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের কঠিন সময়ে যৌথ পরিবারের বিশাল বোঝা মাথায় ছিল তার। ধীরে ধীরে আয় বাড়তে থাকে, যৌথ পরিবার-ও ভেঙ্গে একক পরিবার হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও আয় অনুপাতে সঞ্চয় বাড়েনি। "দিনে আনে, দিনে খায়" এর মত জীবনযাপন ছিল তার সংসারে। কখনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করেননি, প্রথাগত ট্র্যাকের বাইরে ভাবেননি, তাই সন্তানদেরও অসাধারণ কোন কিছু হয়নি। যে বয়সে তার সমবয়সী সবাই রিটায়ারমেন্টে গিয়ে আনন্দ-বিনোদন করছে, কিংবা বসে বসে আয়-সঞ্চয়ের মজা লুটছে, কিংবা পরিবার নাতিপুতিদের সাথে খুশির সময় কাটাচ্ছে, সেই বয়সেও এই ভদ্রলোক নিজেও যেমন সংগ্রাম করে আয় করে যাচ্ছেন, তেমনি তার স্ত্রী-সন্তানেরাও রোবটের মত চলতেই আছে।

পরিবারের তিন সন্তানের ছোট দুইজন মেয়ে। বড় মেয়ে (মেজ সন্তান) বেসরকারি মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার। ইন্টার্ন করছে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ও পারিবারিক-সাংসারিক জটিল পরিস্থিতি বিবেচনায়, নিজের পড়ালেখা বা ইচ্ছার ঘাটতি/ব্যতিক্রম থাকা সত্ত্বেও বিশাল অংকের অর্থের বিনিয়োগ করে, এবং অমানষিক খাটুনি করে, ৬ বছরের এই পড়াশোনার শেষে, আজ মেয়েটি ডাক্তার হওয়ার পথে। পরিবারের নানান সমস্যার পাশাপাশি বিশাল অর্থের বোঝা ও জটিল অর্থের বোঝা সবসময় তার জন্য অদৃশ্যমান পাহাড় হয়ে ছিল/আছে। সমবয়সী মেয়েরা প্রায় সবাই বিবাহিত, বা বিয়ে করছে। সেখানে, তার এখনো চলার পথ অনেক বাকি। আঞ্চলিক প্রথা অনুসারে বিশাল আয়োজন করে বিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য এই মুহুর্তে তার পরিবারের কিছুতেই নেই। যদিও বংশমর্যাদা রক্ষার্থে তা-ই করতে হবে। যেখানে অন্য বেসরকারি মেডিকেলের ইন্টার্ন ডাক্তারেরা তার চেয়ে বেশি বেতনে কম কাজ করছে, সেখানে সরকারি মেডিকেলের ইন্টার্ন ডাক্তারদের অর্ধেকের চেয়েও কম বেতনে প্রায় দ্বিগুণ খাটনি দিয়ে মধ্যবিত্ত হওয়ার প্রায়শ্চিত্ত করছে এই মেয়েটি।

ছোট মেয়ে সরকারি ভার্সিটিতে কমার্সের সাধারণ সাবজেক্টে অনার্স শুরু করেছে ১ বছরের কিছু কম সময় আগে। পরিবারের অন্য সবার মতই সেও অসাধারণ মেধাবী না; এবং চেষ্টা ও পরিশ্রমেও ঘাটতি ছিল। ফলস্বরূপ, স্বপ্নের কোন প্রতিষ্ঠানে চান্স পায়নি। সংসারের আর্থিক টানাপোড়েনের দুর্দিনে এসে তাই আজ মেয়েটি নিজের ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে নতুন এক বিষয় নিয়ে নতুন করে শুরু করেছে। সাথে সামান্য টিউশনি করে নিজের শখ-আহ্লাদ মেটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

Last, but not the Least... পরিবারের বড় সন্তান। অনেক স্বপ্ন ছিল তাকে নিয়ে পিতামাতার, পরিবারের, বংশের। তার নিজের-ও অনেক স্বপ্ন ছিল। পাগলা ঘোড়ার মত বয়স ৩০ অতিক্রম করে চলে গিয়েছে কয়েক বছর হচ্ছে। শিক্ষাজীবনে সবসময় ভালো প্রতিষ্ঠানেই পড়ে আসছিল। পড়ালেখায় দুর্দান্ত না হলেও পড়ালেখা ও অন্যান্য এক্সট্রা-কারিকুলার একটিভিজ বিবেচনায় তাকে স্ট্যান্ডার্ড অলরাউন্ডার বলা "যেত"। দেশের ভালো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো সাবজেক্টে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অনার্সে সে চান্স পেয়ে পড়া শুরুও করেছিল। কিন্তু, সমস্যা ছিল একটাই। তার বাবার মতই। সুনির্দিষ্ট, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না থাকা; উচ্চাভিলাষী না হওয়া। জীবনটাকে সহজভাবে নেওয়া, আবেগ-অনুভূতিকে প্রাধান্য দেওয়া। কয়েকটা ঘটনা (দুর্ঘটনা)-র জেরে তাকে দুরবর্তী সরকারি ভার্সিটি ছেড়ে চলে আসতে হয়। গ্যাপ দিয়ে ভর্তি হয় একই শহরের উঠতি প্রাইভেট ভার্সিটির আনকোরা ডিপার্টমেন্টে; তারপরেও স্বস্তির ব্যাপার ছিল "ইঞ্জিনিয়ারিং"। পরিশ্রম ও মেধার জোরে সে পুরানো সময়ের ক্ষত কাটিয়ে ৪ বছর পরে ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়। ইতিমধ্যে সমাজ-সংসার ও পেশার বাজার তাকে নানারকমভাবে হতাশাগ্রস্থ ও দ্বিধাগ্রস্থ বানিয়ে ফেলেছে। ছোট একটা কোচিং-এ টিচিং দিয়ে আয় করা শুরু করে সে জীবনে প্রথম। অল্প সময় পরে ছেড়ে দেয়। American Dream তুমুলভাবে পেয়ে বসে তাকে। নিজের অর্থের ও মেধার (নাকি চেষ্টার?) সাধ্যের বাইরে থাকা সত্ত্বেও আমেরিকা যাওয়ার সাধ মেটাতে সে সময় ব্যয় করে অনেক। প্রচেষ্টা বিফল হয়। অন্যান্য উন্নত দেশের যাওয়ার চেষ্টা করেও নানাভাবে ব্যর্থ হয়। ঐ সময়ে সে গবেষণা করে বা দেশেই মাস্টার্স করে বাইরে যাওয়ার পথ আরো সুগম করতে পারতো। নিজের অজ্ঞতা ও সঠিক পরামর্শদাতার অভাব তাকে ভোগাতে থাকে। ছোটখাটো কিছু করে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা চালায়। দীর্ঘস্থায়ী সুফল আসেনি কখনো। আর্থিক প্রতিষ্ঠার অভাবে সামাজিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে থাকে সে। মাঝখানে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা বাদ দিয়ে একবার বিসিএস, আরেকবার সরকারি চাকরি, এবং আরো কয়েকবার বেসরকারি চাকরির চেষ্টা চালায় সে। কিন্তু, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্নরকম প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদের কারণে তার প্রচেষ্টাগুলি ব্যর্থ হতে থাকে; বিবিধমুখী জ্ঞান ও দক্ষতা তার মত সাধারণের সামনে অসাধারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপার্জন বা চাকরির বাজারে অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, নিম্নবিত্ত, অভিজ্ঞতাহীন, উচ্চবিত্ত ও ক্ষমতাবানদের নৈকট্যা আছে এমন মানুষদের দাপটে সে ক্রমশ ছিটকে পরে, ভেঙে পরে। ড্রাইভার, কুক, মেকানিক, বুয়া, দারোয়ান, রিকশাচালক, পান-সিগারেট বিক্রেতা শিশুর মাসিক আয় একজন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েট যুবকের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হতে পারে দেখে সে নিজেকে ও নিজের দেশকে ঘৃণা করতে শুরু করে। চাকরির আবেদন ও পরীক্ষা দিতে দিতে সে যা খরচ করতে থাকে, তার অনার্স পড়ার খরচ-ও তার চেয়ে কম ছিল। তার ক্রমাগত চেষ্টার ফলস্বরূপ দেশের নামকরা প্রাইভেট ব্যাংকের তলানির পোস্টে মোটামুটি সন্তোষজনক বেতনে তার চাকরি হয়; উল্লেখ্য যে একজন সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার এর চেয়েও কম বেতন পায়, একজন বুয়া/দারোয়ান/ড্রাইভার এর চেয়েও বেশি আয় করে, একজন রিকশাওয়ালা দিনে অর্ধেক কাজ করেও এর দ্বিগুণ আয় করে, এবং একজন ৫ বছর কাজ করা গার্মেন্টস কর্মী ওভারটাইম করে এর সমপরিমাণ আয় করে। এই পেশায় সে বেশিদিন টিকতে পারেনি। একই শাখায় তার সাথেই নিয়োগপ্রাপ্ত হয় আরেক যুবক, যে কোন পরীক্ষা ও নিয়োগবিজ্ঞপ্তিতে ঢুকেনি; যার পিতা ব্যাংকের একজন অন্যতম স্বাধীন পরিচালক। চাকরির কিছুদিনের মাথায় বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হতে থাকে সে; বাধার সম্মুখীন হয় নিজের পেশাগত ও সামাজিক জীবনের উতকর্ষসাধনে। কখনো নিয়মমাফিক কিছু করার কারণে এবং কখনোবা অবান্তর/অযৌক্তিক নিয়মের নিন্দা-সমালোচনার কারণে অপমানিত হয় সে। ধীরে ধীরে দেশের চলমান কর্পোরেট সেক্টরকে ভালোভাবে চিনে ও বুঝে যায় সে। কাজের ফাঁকেই ঝোঁকের বশে ইউরোপের এক দেশে স্নাতকোত্তরের জন্য আবেদন করে বসে সে; এবং এই আবেদনের ব্যাপারে ভুলেও যায় সে। এক ঈদের পরে, তার সেই নিয়োগপরীক্ষাবহির্ভুত কলিগের বাসায় দাওয়াত (যেটা প্রায়সময় কোন না কোন উপলক্ষে হয়ে থাকতো) খাওয়ার পরের দিন সকালের কথা। ম্যানেজার তার রুমে তাকে ডেকে অন্য সবার সামনে তাকে যাচ্ছেতাই কথা শুনায়; এবং একই সাথে তার সাথে তুলনা করা হয় সেই কলিগকে। সেই কলিগের তুলনায় তার অর্জন শূন্য। এই তুলনার ভিত্তি কিছুতেই তার মাথায় ঢুকে না। অফিসে তাকে তার গণ্ডির ভেতরে দেওয়া সব কাজ সে সময়ের আগেই শেষ করতো। তারপরেও প্রাইভেট ব্যাংকের অক্সিজেন বলে খ্যাত "ডিপোজিট" না আনার কারণেই তার উপরে ম্যানেজারের যত ক্ষোভ ও দোষারোপ। পরদিন থেকে সে আর কাজে যায়নি, বেতন-ও নেয়নি সে মাসের। নতুন কিছু শুরু করার জোর চেষ্টা চালায় সে। এবং কয়দিনের মাথায় ইউরোপের সেই দেশের ভার্সিটি থেকে তার জন্য জবাব চলে আসে। চলে যায় সে বিদেশে। নতুন স্বপ্নের খোঁজে। যে বয়সে তার বন্ধুরা বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করানোর চিন্তা করছে, সে বয়সে সে পরিবারের টাকার উপর ভিত্তি করে কষ্টসাধ্য পড়ালেখার যুদ্ধে নেমে পরেছে। যে দেশে সদ্য পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির জন্য ৩ বছরের অভিজ্ঞতা খোঁজা হয়, আবার বয়সসীমাও রাখা হয় অদ্ভুতরকমের, বেতন হয় ৪ অংকের চেয়ে কিছুটা বেশি, কাজের সময়সীমা "মে দিবসের" তাৎপর্যকে ম্লান করে দেয়, কাজের খাটনি হয় একজন জাহাজ-ভাঙ্গা শ্রমিকের সমমানের, যে দেশে বিয়ের জন্য ছেলেকে কাবিনের বোঝা ও ডিভোর্সের চিন্তা মাথায় নিয়ে শরীর ও মনকে রক্তাক্ত করতে হয় প্রতিনিয়ত, সেই দেশ "ডেমোক্রাফিক ডিভিডেন্ট" এর সোনার ডিমপাড়া হাঁস নিয়ে, এবং "উন্নয়নের রোলমডেল" হয়ে কি বালটা ফেলাবে, সেটা আজ-ও এই যুবকের মনে প্রশ্ন হয়ে জ্বলেপুরে খায়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ৯:২৮

রাজীব নুর বলেছেন: দুঃখজনক।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.