![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই আমি-\nপৃথিবীর কোনো এক প্রান্ত থেকে\nআমার মনের কথাগুলো চিৎকার\nকরে ছড়িয়ে দেই অসীম আকাশে!\nজানি না এই নিছক কিছু তরঙ্গ\nকতটা পথ পাড়িয়ে হারিয়ে যাবে!\nঅথবা কোনো এক ভিনগ্রহী\nঅবাক হয়ে শুনবে আমার কথামালা\nজানি না কি অনুভূতি হবে তার!\nহয়তো গাঢ় নীল অশ্রু গড়িয়ে পড়বে\nকরুণামাখা কন্ঠে বলবে আনমনে,\n\'বড় দুঃখী এক মর্ত্যবাসী!\'
প্রারম্ভ
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে। চৈত্র মাসে আচমকা বৃষ্টি! এই রকম বৃষ্টি দেখলে আমার সব সময়ই খুব বিরক্ত লাগে। বৃষ্টি দেখে আমার কোনো রকম রোমান্টিকতা হয় না। কি জানি, আমি মনে হয় একদম পানসে ধরণের। কিছুতেই হয়তো রোমান্স দেখাতে পারি না। রিনি ঠিক উল্টো। বৃষ্টি দেখলেই তার মাথা খারাপের মত হয়ে যায়। এই বৃষ্টিতে ভেজো, এই খিচুড়ি রাঁধো। সাথে আমার উপর সে চড়াও, এক্ষুণি বাজারে যেতে হবে ইলিশ মাছ আনতে। আমি বিরক্ত হয়ে কোল্ড স্টোরেজের ইলিশ আনতে যাই। গত শীতে নিম্নচাপ না কি জানি একটা হল, সারাদিন ঝুম বৃষ্টি। এর ভিতরেও তার কি উচ্ছ্বাস! মহাউৎসাহে সে অসময়ের বৃষ্টিধারা উপভোগ করতে নামলো। ফলাফল যতটুকু ভয়াবহ হওয়ার কথা ছিল তার চেয়ে অনেক বেশীই হয়ে গেল। পরবর্তী তিনরাত শুধু ঢাকা মেডিক্যালের মশাদের কাছে আমার রক্তদান করে কেটে গেলো।
বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। অফিসে অলরেডি লেট হয়ে গেছে। বৃষ্টি এসে একদম সর্বনাশ করে দিল। বৃষ্টির জন্য তো বাস লেট করার কথা না। কি অদ্ভূত, তারপরেও লেট হচ্ছে। দুই-একজনকে দেখলাম রিকশা ঠিক করে চলে যাচ্ছে। আমিও একবার ট্রাই করলাম। রিকশাওয়ালা তাচ্ছিল্যের স্বরে যে ভাড়া বলল তা প্রায় গোটা একমাসের বাস ভাড়া। আমি বিরস মুখে আবার এক দোকানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইদানিং চোখের সমস্যাও শুরু হয়েছে। এই বয়সে আসার পর নাকি আর মায়োপিয়া হয় না। আমার চোখ সম্ভবত এখনো আমার বয়স ধরতে পারছে না। দূরের জিনিস আমি এমনিতেই ঝাপসা দেখি, বৃষ্টিতে তো প্রায় কিছুই দেখছি না। হঠাৎ মনে হল বাস আসছে, আমি বৃষ্টির ভিতরেই বাসের দিকে দৌড়ে ছুটলাম। যাহ! ভুল বাস দেখে দৌড়ে এসেছি। আমি ভয়ংকর হতাশ হয়ে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লাম। একদম ভিজে গেছে, আজকের দিনটাই মাটি। মাঝে মাঝেই এই রকম দিনের দেখা মেলে। সবকিছুতেই ঝামেলার এক শেষ। হর্নের শব্দ শুনে পেছনো তাকাতেই দেখি বাস এসে গেছে। কি ভয়ংকর তার গতি! আমি সেই গতিতে বাঁধা হলাম না। আমাকে তীব্রভাবে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে। যার জন্য এত অপেক্ষা, আমাকে ফেলেই সে চলে যাচ্ছে?
আর আমি? আমি কি তবে মারা যাচ্ছি?
এক
অনেককাল ঘুমানোর পর যখন ঘুম ভঙ্গে যায় হঠাৎ তখন যে রকম অনুভূতি হয় আমার ঠিক যেন সে রকম এক অনুভূতি হল। গতরাতে কখন ঘুমিয়েছিলাম ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে এরকম ফ্রেশ একটা ঘুমের পর কিন্তু দারুণ একটা আমেজ থাকে শরীরে। আমি রিনি বলে চিৎকার দিলাম। রিনির নাম আমি যত আওয়াজ করে ডাকি আমার কাছে ততই মধুর লাগে। কোনো সাড়াশব্দ নেই ওদিক থেকে। বিছানা ছেড়ে উঠতেই বুঝলাম কোথাও একটা সমস্যা আছে। একটু ভালো মত চারপাশে তাকাতেই দেখি অদ্ভূত এক ব্যপার। আমাদের সেই পুরোনো বাড়িটির ঘরে। একদম সব আগের মতই। পিতলের ফুলদানিতে ধূলোমাখা কাগজের ফুল, পুরোনো সেই তেপায়া টেবিলের উপড় রাখা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টেলিভিশন, ক্যাটক্যাটে রঙ্গের পর্দা! অনেক বছর হলো এই বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এই জায়গাটুকুও এখন আর আমাদের দখলে নেই। আমি যেন বিশ বছর আগের কোনো এক সময়ে এসে থমকে গেছি।
‘মাসুদ, তাহলে উঠেছিস’ কে যেন আমাকে বলল। আমি ঘোর লাগা চোখে চারিদিকে দেখছিলাম। কথা শুনেই তার দিকে তাকালাম। সাথে সাথেই ভয়াবহ রকমের চমকে উঠলাম। ঝকমকে এক গাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মামুন, আমার জমজ ভাই। কতকাল তার সাথে দেখা নেই। দেখা হবারও কথা নয়। বহু বছর আগের এক চৈত্রের বিকালেই তার সাথে আমার শেষ দেখা, পৃথিবীর সাথে তার শেষ সাক্ষাৎ। আমি কিছু বলার খুঁজে পাচ্ছি না। শুধু মনে হচ্ছে মাথার ভেতরে অসহ্য রকম এক যন্ত্রণা।
‘ভয় পেয়ে গেছিস মনে হচ্ছে খুব। তোর চোখে মুখে তো ভয়াবহ আতংকের ছাপ!’ মামুন হাসছে। কি অসাধারণ তার হাসি। আমার হাসিও কি এমন সুন্দর? আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না কি বলা যেতে পারে। আমি যেন আচমকা এসে পড়েছি কোনো নাটকের মধ্য দৃশ্যে। শুরুটা কিছু মনে আসছে না। আমি খুব দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। গতকাল রাতে কোথায় ছিলাম? মনে পড়ছে একটু একটু। রিনির সাথে কি নিয়ে একটা ঝগড়া হয়ে গেল। দু’জন দুপাশ হয়ে ঘুমাতে গেলাম। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো মনে আসছে। রিনির অভিমান সকালেও কমলো না। ও ডেকে না দেয়াতে ঘুম থেকে উঠতে একদম দেরী হয়ে গেলো। তারপর বৃষ্টি... বাস! কেমন ধোঁয়াশার এক অনুভূতি। বাসের সাথে আমার প্রচন্ড এক ধাক্কা লাগার কথা। এরকম হলে তো বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই নেই। একদম সাথে সাথে মৃত্যু। তাহলে আমি কি এখন মৃতদের জগতে?
আমি মামুনের দিকে তাকিয়ে আছি। এত বছর পর মামুনকে আমি চিনতে পারছি কারণ দুজনের চেহারা অবিকল এক। কিন্তু ওই তো ওর মুখের বামপাশে সেই লালচে তিল। কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মামুন মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছে। আমিই এবার বললাম, ‘আমি এখানে কিভাবে এলাম?’
মামুন বলল, ‘এতক্ষণে মনে হয় বুঝে ফেলেছিস তুই কোথায়? অনেকটা সময় তো ভেবে ফেললি।’
মাথা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আমি মৃত্যুর পরের জগতকে বোঝার চেষ্টা করছি কিছুটা। কি গোছানো এক জগত। যে জগত একসময় আমার কাছে থেকে হারিয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে সেই জগত আমার সামনে হাজির হয়ে পড়েছে।
‘মাসুদ, তোর কি খিদা লাগছে?’ মামুন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো।
‘না তো, একদম না! মনে হচ্ছে কোথাও থেকে আমার ভিতরে খাবার চলে আসছে আপনা আপনি। খুব অদ্ভূত এক অনুভূতি। এইটাই কি তবে বেহেশত?’
মামুন আবার তার সেই হাসি দিচ্ছে। আমি এবার তার হাসিতে ভড়কে গেলাম। সে বলল, ‘চল, আশেপাশে থেকে ঘুরে আসা যাক।’
আমি বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় খেয়াল করলাম আমার শরীর জুড়ে রক্তে একাকার। কিন্তু রক্ত মিলিয়ে যাচ্ছে!
বাহিরের মন ভালো করার মত পরিবেশ। সেই সবুজে মাখা ছোট্ট শহর। কিন্তু চারপাশটা একদম ফাঁকা। শুধু আমি আর মামুন হাটছি পাশাপাশি। অনেকক্ষণ কথা নেই। আমরা শুধুই হাঁটছি। পরিচিত সেই গন্ধ, বহুকাল বারেবারে হেঁটে যাওয়া সেই পথ। আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি যে বাড়ির সামনে, সেটা আমার পূর্বপরিচিত। রূপকদের বাসা। ছোটবেলায় কতবার আসা হয়েছে এই বাসায়। এই বাসাকে প্রাসাদ বলা যেতে পারে। প্রকান্ড এক বাসা, সামনে কি বিশাল এক বাগান ছিল। এখন সেই প্রাসাদ ধ্বংসস্তূপ, সামনের বাগান হয়ে আছে জঙ্গল।
‘তুই ভিতরটা দেখে আয়। রূপক আছে ওখানে।‘ মামুন আমাকে তাগিদ দিচ্ছে।
আমার কেমন জানি ভিতরে যেতে ইচ্ছে করছে না। তারপরেও মনে হল যাওয়াটা খুব দরকার। মরচে ধরা লোহার গেট পাড় হতেই কি আমার মনে হল আমি যেন খুব পুরাতন এক সময়ে এসে পড়েছি। যেখানে সময় থেমে আগে বহুকাল আগে থেকে। বাসার ভেতরে ছমছমে ভাব। অন্ধকার ঘরের কোণে মোম্বাতি জ্বলিয়ে বসে আছে রূপক। কি অদ্ভূত চেহারা হয়েছে তার। মামুন যদি ওর কথা না বলে দিত তাহলে হয়তো চিনতামই না ওকে। কেমন জট বাঁধানো চুল, ভয়ংকর লাল চোখ, স্বাস্থ্যটাও স্বাভাবিকের চাইতে অনেক বেশী! আমাকে দেখেই ক্যানক্যানের স্বরে বলল,
‘কতকাল পরে দেখা তোর সাথে! তাই না মাসুদ?’
আমি কি বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এদের সাথে তো আমার দেখা হবার কথা না। মৃত মানুষের সাথে কারো কখনো দেখা হয় না। আমি আমতা আমতা করছি।
‘আসলেই, অনেক বছর পর দেখা। তুই কেমন আছিস?’
রূপক এবার হো হো করে হেসে উঠলো। তার বিশাল শরীর তার হাসির সাথে দুলছে। আমি কিছুটা ইতস্তত!
‘আমার ভালো থাকার ব্যবস্থা তো তুই অনেক আগে থেকেই করে রেখেছিস।’ রূপক তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়েই আমাকে বলল এই কথাগুলো।
অনেক আগের ঘটনা। বছর বিশেক হবে। বা তার বেশীই হতে পারে। এরকম সময় আগে রূপককে আমি খুন করি। এটাই মনে হয় আমার প্রথম খুন। তার আগের স্মৃতিগুলো আমার কাছে কেমন জানি ঝাপসা। রূপকের সাথে আমার আশ্চর্য রকমের বন্ধুত্ব ছিল। দুজন একসাথে স্কুলে যেতাম রোজ। পথে যেতে যেতে আমাদের মাঝে রাজ্যের কথা হত। কল্পনায় আমরা চলে যেতাম রুপকথার সীমানাহীন রাজ্যে। আমরা তখন মনে হয় ক্লাস সিক্সে পড়ি, দুজনেই একসাথে দিলু আপার প্রেমে পড়ে গেলাম। দিলু আপা তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। দুজনেই মাঝে মাঝে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতাম দিলু আপাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে দেবো। দেখা যাক, কাকে সে বেছে নেয়। এরই মাঝে দিলু আপার বিয়ে হয়ে গেলো। আমাদের মাঝে কিন্তু এটা নিয়ে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। তার বিয়েতে আমরা অনেক মজা করলাম, কি একটা ব্যাপার নিয়ে বরপক্ষের সাথে মারামারিও করে বসলাম।
আমার জীবনে আমি কখনো পরিবর্তন সহ্য করতে পারি না। একদমই পারি না। আমার ছকে বাঁধা জীবনে একটু নড়চড় হলেই আমার সামনে পৃথিবী ভেঙ্গে পড়ে ঝরঝর করে। আমার জীবনে পরিবর্তন আনলো রূপক। হঠাৎ করেই তার হাঁটাচলা বন্ধ হবার জোগাড়। সম্ভবত পোলিও হয়েছিল ওর। আমার সাথে তার স্কুলে যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেলো প্রায়। আমাদের রুপকথার রাজ্যে দাপড়ে বেড়ানো শেষ হয়ে গেল।
তার বাসাতেই স্যারেরা তাকে গিয়ে পড়াতে শুরু করলো। আমি রুপকের সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিলাম। তবে তার খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করিনি। ওর বাবা একটা হুইলচেয়ার কিনে দিয়েছিল। সেটা নিয়েই মাঝে মাঝে সে অনেক দূরের মাঠ পর্যন্ত একা একা চলে যেত। এক সকালে আমি এরকমই এক মাঠে তাকে খুন করে ফেলি। ঠান্ডা মাথায় খুন। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। এক হাত দূরের কিচ্ছু দেখা যায় না এমন অবস্থা। আমি ওর পিছনে পিছনে অনেক দূর গেলাম। কেউ ছিলো না চারপাশে। আমি ওর গলায় খুব ধারালো এক ছুড়ি চালিয়ে দিলাম। অনেকখানী রক্ত ছিটকে বেড়িয়ে গেলো। আমি শক্ত হাতে ওর মুখ চেপে রাখলাম... একটা শব্দও যেন ওর মুখ থেকে বের না হয়। রক্ত গড়িয়ে পড়া দেখার মধ্যেও যে এত উত্তেজনা এটা আমার জানা ছিল না। রূপকের লাশ মাঝ মাঠে ফেলেই আমি চলে আসি। আমার রক্তেভাজা শার্ট, ছুড়ি সবকিছু পুতে ফেলি আমাদের বাসার পেছনের জঙ্গলে। এইরকম কিছু একটা গল্পের বইতে পড়েছিলাম। পার্থক্য হলো গল্পের খুনি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়।
আমাকে সন্দেহ করার কোনো কারণ অবশ্য ছিলো না। ক্লাস সিক্সে পড়া কেউ একজনকে খুন করে ফেলবে সেটা ভাবার কোন কারণ নেই। তাছাড়া রূপকের বাবা-চাচার সাথে অনেকেরই সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ। এরকম কয়েকজনের নামে তারা মামলা করে দিলো। তিনজনের জেলও হয়ে গেলো বেশ কয়েক বছর করে। আমার পৃথিবী ধ্বংসের অপরাধে মৃত্যুদন্ড পেলো রূপক!
রূপক কিছুই বলছে না। আমিও বলার কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তার মৃত্যু পরবর্তী জীবনটা তো খুব বেশী কষ্টকর না। আমার কাছে তো তাই মনে হচ্ছে। নিজের ঘরে পরকাল যাপন খারাপ হবার কথা না। এখনো কি ও হাঁটতে পারে কি না জানা দরকার। কিন্তু এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা কি ঠিক হবে?
‘তুই আমাকে খুন করে একদিক দিয়ে ভালোই করেছিলি। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হত। বিশাল মাঠটার মধ্যে গিয়ে যখন মনে হত এখানে আমি আর কখনো ছুটে বেড়াতে পারবো না, তখন আসলে আর বেঁচে থেকে লাভ নেই।’ রূপক মিটিমিট হেসে কথাগুলো বলছে।
‘তোর দুনিয়াতে তুই ভালো আছিস তো?’ রূপকের জিজ্ঞাসা।
উত্তর দিতে ইচ্ছা হচ্ছে না এইসব প্রশ্নের। আমি শুধু তাকিয়ে আছি তার দিকে। তার গলার কাছে কি বীভৎস কাঁটা দাগ!
দুই
রূপকের বাসা থেকে বের হবার পরই প্রথমবারের মত ঘটনাটা ঘটলো। চারিদিকের ভয়ংকর ভাবে কেঁপে উঠলো। আকাশ-বাতাস কোনো কিছুই এই ভয়াবহ কাঁপনের বাহিরে নয়। আর কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে আমার নাম। খুব চিকন একটা চিৎকার! কান্না জড়ানো বহু পরিচিত এক স্বর। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় মাটিতে পড়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার সব কিছু যেন স্বাভাবিক। মামুন আমার কাছে চলে এসেছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। এরপর আবার আমাদের হাঁটা শুরু হল। আমি ঠিক জানি না এবার কোথায় যাচ্ছি। তবে এবার অনুমান করা যায়। আমার জগতকে তছনছ করার অভিযোগে কোনো আসামীর কাছেই হয়তো যাচ্ছি।
অনেকখানি পথ খুব অল্প সময়েই যেনো পার হয়ে গেলো। আমার সামনের দালানটা খুব বেমানান এক জায়গায়। এখানে তার থাকার কথা না। আমি এই দালান খুব ভালো মত চিনি। আমার অফিস। আমি অফিসে ঢুকলাম। লিফট অনেকদিন ধরে নষ্ট। কেন জানি ঠিক করানো হচ্ছে না। আমার খুব একটা সমস্যা হয় না। সিড়ি দিয়ে পাঁচতলায় উঠতে আমার তেমন একটা কষ্টকর না। তবে প্রতিদিনই সবাই অফিসে এসেই চিল্লাচিল্লি শুরু করে এই ব্যাপারে। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সবাই এই ব্যাপার ভুলে বসে। আমি এইসব ঘটনায় বেশ মজাই পাই।
আমার রুমের মধ্যে গিয়ে দেখি সফিকুল্লাহ বসে আছে। আগের মতই ইতস্তত ভঙ্গি। তার চেয়ারের চারভাগের একভাগ জায়গা নিয়ে সে বসে থাকে। মনে হয় বেশি জায়গা নিয়ে বসলেই পাপ হয়ে যাবে। আমাকে দেখেই সে দাঁড়িয়ে গেলো। খুব দ্রুত সালাম দিয়ে বলল,
‘স্যার, ভালো তো? আপনার দেখি শরীর-স্বাস্থ্য ভাইঙ্গা পড়ছে।’
‘হুম। সবাই তাই বলে।’
‘স্যার রাতুলের সাথে কি দেখা হয়? কেমন আছে জানেন কি? অবশ্য দেখা করার আপনার সময় কই? অনেক ব্যস্ত মানুষ।’ সফিকুল্লাহ নিজের মনেই সব কথা বলে যাচ্ছে যেনো।
রাতুল সফিকুল্লাহ ছেলে। একমাত্র ছেলে। অফিসের যেকোনো অনুষ্ঠানেই সে তার ছেলেকে নিয়ে হাজির। সবার সামনেই তার ছেলের মহা প্রশংসা শুরু। কথা বলা শিখে ফেলেছে এই ঘটনাতেই সে মহা মুগ্ধ। আমি হাসতাম তার ছেলেকে নিয়ে এই বাড়াবাড়িতে।
আমার ডেস্কের পাশেই সে বসতো। কথা বলাটা মনে হয় তার সবচেয়ে বেশী পছন্দের কাজ ছিল। চাকরিতে জয়েন করার তিন-চার দিনের মধ্যেই তার লাইফহিস্ট্রি আমার জানা হয়ে গেলো। খুব ভয়াবহ সময়ের মধ্যে দিয়ে নাকি সে যাচ্ছিলো। তুখোড় প্রেম করে দুজন বিয়ে করেছে। মেয়ে হিন্দু ছিল। মসুলমান ছেলে বিয়ে করায় বাসা থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে একেবারে বের করে দিয়েছে। সফিকুল্লাহর অবস্থা আরো ভয়াবহ। এতিমখানায় মানুষ হওয়া ছেলে। আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না। বেচারা অনেক কষ্টে অনার্স পাশ করছে অন্যের বাসায় থেকে থেকে। এই ধরণের পরাশ্রয়ী মানুষ সাহসী কোনো কাজ করতে জানে না। সফিকুল্লাহ পেরেছিল। হুট করে বিয়ে করে ফেলে। তারপরে তাদের ভয়াবহ জীবন-যাপন। সফিকুল্লাহ তখন থাকতো এক মসজিদে। চাকরি বলতে কিছুই নেই। বউ নিয়ে তো আর মসজিদে উঠতে পারে না সে। তাদের শুরু হয় যাযাবর দিনযাপন। সিনেমার গল্পে হয়তো নায়ক এই অবস্থায় থাকলে দুই-একদিনের মধ্যেই চাকরি জোগাড় করে ফেলে। কিন্তু সফিকুল্লাহ চাকরি পেল দুই বছর পর। এর মাঝে তাকে বহু রকম কাজ করে বেড়াতে হয়েছে। চাকরি পাওয়াটা তার জন্য মহা আনন্দের এক ব্যাপার ছিল।
কথায় বেশী কাজে কম লোক অনেক পাওয়া যায়। কিন্তু সফুকুল্লাহ ছিল দুটোতেই বেশী। সে যত বেশী কথা বলতো তার চেয়ে আরো বেশী কাজ করতো। এমডি স্যার তার উপরে বেজায় ধরণের খুশি হল। তাকে প্রমোশন দেয়ার জন্য তোরজোড় শুরু হল। হয়তো তার প্রমোশনের জন্য আমারো প্রমোশন দেয়া হল বেশ অনিচ্ছায়। আবার আমার রুটিন জীবনে বাঁধা আসলো। আমার নিখুঁত পৃথিবীতে পরিবর্তনের কোনো স্থান নেই।
আমার ডেস্কের ঠিক সামনেই বিশাল এক জানালা। ডেস্কে আসলেই অনেকখানি আকাশ আমার সামনে হাজির হয়ে যায়। আমি অবাক হয়ে আকাশ দেখতাম। কি বিশাল এক শূণ্যের সমুদ্র। আমার ভিতরে কাব্যিক ভাব ছিলো না তেমন। কিন্তু সীমাহীন আকাশ আমাকে অল্পক্ষণের জন্য হলেও অন্য ভূবনে নিয়ে যেত। সেই আকশ সফিকুল্লাহর দখলে চলে গেলো। আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল অন্য রুমে। আমি তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে দিলাম।
অফিসের নিচতলায় বিশাল এক স্টোররুম আছে। একসময় আমাদের অফিসের কাজে বেশ লাগতো স্টোররুম। গাদা গাদা স্যাম্পল জমে থাকতো। এখন সেই কাজের জন্য আলাদা এক অফিস নেয়া হয়েছে। এখানে আর এইসব কাজ চলে না। একটা গার্ড রাখা আছে স্টোররুমের জন্য। সেই ব্যাক্তি সারাদিনই ঝিমানোর উপরে থাকে। কাজ তেমন না থাকলেও সফিকুল্লাহকে মাঝে মাঝে সেখানে যেতে হয়।
এক বর্ষার সন্ধ্যায় আমি সেখানে সফিকুল্লাহকে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেললাম সেই স্টোর রুমে। বেচারা অনেক কাকুতি মিনতি করছিল বাঁচার জন্য। আমার বিশাল শরীরের কাছে তার ছোটখাটো শরীর পাত্তা পাবে কেন? গলায় দড়ি প্যাঁচানোর পর অসহায় ভাবে অনেকবার রাতুল রাতুল বলে চিৎকার দিচ্ছিলো। সে চিৎকার জমা পড়ে ছিল অন্ধকার স্টোররুমের দেয়ালে। ছেলের জন্য অনেক মায়া ছিলো। তার মায়ার বাঁধন আমি ছিন্ন করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলাম। এটা অনেক বেশী অগোছালো খুন ছিল। আমি হয়তো ধরা পড়েই যেতাম। পড়লাম না এমডি স্যারের জন্য। তিনি পুলিশ কেসের ব্যাপারটা খুব ভালো মত সামলে নিলেন। পুলিশের ওসি যেনো খুব অনিচ্ছারা সাথে ঘুষ নিয়ে অপমৃত্যুর কেস বানিয়ে ফেললেন ব্যাপারটা। সফিকুল্লাহর বউ বেচারী পড়লো মহাবিপদে। তার দুই কূলে আর কেউ থেকেও নেই। এমডি স্যার তাকে তেমন একটা টাকা-পয়সার ব্যাবস্থাও করে দিলেন না। তার কাছে তখন সফিকুল্লাহর নাম মানেই সাক্ষাৎ বিপদ! অফিসের লোকজন অবশ্য নিজেদের মত করে অনেক সাহায্য করল। আমিও রাতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিলাম।
‘পোলাডার জন্য মন কান্দে স্যার। নিজে এতিম তো তাই এতিমের কষ্ট বুঝি। আপনি যে আমারে মারছেন এইডা নিয়ে তেমন একটা দুঃখ নাই। মরণ তো সবারই আসবো। কিন্তু পোলাডা আমার এতিম হয়ে গেলো এই যা কষ্ট।...’ সফিকুল্লাহ নিজের মত করে বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছে এইসব কথা।
আমার কানে আর এখন এসব কথা আসছে না। আমি গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার ধারে। ভয়ানক মেঘলা আকাশ। দানব আকৃতির মেঘে পরিপূর্ণ আকাশ। আমার দিকে তার যেনো আর্তনাদের স্বরে গর্জন। আমার আকাশ তবে কি অনেক আগেই হারিয়ে গেছে?
তিন
মামুন আর আমি বসে আছি এখন নদীর ধারে। বাতাস বয়ে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। আসমান থেকেও তর্জন-গর্জন চলছে সমান তালে। তবুও আমরা দুইজন মৃত মানুষ খুব শান্ত, একদম পাথরের মত বসে আছি। দুরন্ত নদীর স্রোতে আমাদের স্থির দৃষ্টি। মামুনই নিরবতা ভেঙ্গে ফেললো
‘তুই আমাকে কেন খুন করলি এটা আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে...’ এখনো ওর দৃষ্টি উচ্ছল স্রোতের দিকে।
মামুনকে মেরে ফেলার ব্যাপাটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমরা অবিকল একরকম ছিলাম দেখতে। যে কেউ দেখলেই ধাঁধায় পড়ে যেত। কে মাসুদ, কে মামুন এইটা বের করতে তাদের কিছু সময় লাগতো। মামুনের গালের লালচে তিল সবার চোখে পড়তো না। মামুন এইব্যাপারে খুব মজা পেত। একদিন মামুন তার তিলের অংশটুকু কেটে ফেলে দিল। আমাকে এসে খুশি খুশি কন্ঠে বলল, ‘এবার আর আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।’
আমি যেন সেই সময় নিজের সত্তা হারিয়ে ফেলছিলাম। আমার মনে হতে থাকলো আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। মামুনের পাল্টে যাওয়া মানে আমার পাল্টে যাওয়া। মামুনের থাকা মানে আমি অস্তিত্ব ছাড়া এই পৃথিবীতে। আমি মামুনকেও হত্যা করে ফেললাম তাই। এই নদীর উপর তখন এক বিশাল সাঁকো ছিল। মানুষজন তেমন একটা পারাপার হত না এই সাঁকোয়। প্রতি বর্ষায় এই সাঁকোর বেহাল দশা হয়ে পড়তো। মাঝ নদীতেই হয়তো ভেঙ্গে পড়ে থাকতো। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের খেলার উপকরণ ছাড়া তার আর কোন ব্যবহার থাকতো না। আমরা ওদিকটায় যেতাম না। মায়ের কঠিন নিষেধ, আমরা দুজনের কেউই সাঁতার জানি না। তারপরেও সেই বিকালে আমরা দুজন সাঁকো ধরে হাঁটছি। মামুন সামনে, আমি পিছনে। কি অদ্ভূত মিল দুজনের। এক সাথেই প্রতিটা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি। মাঝ নদীতে যাওয়ার পরেই আমি ওকে পিছন থেকে ফেলে দিলাম। এই সময়ে এর আশেপাশে কেই তেমন থাকে না। মামুন অনেকবার চিৎকার করলো। ডুবে যেতে যেতে আমার দিকে করুণ মুখে সে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমি সেই হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ইশ, একদম একি রকম দুজনের হাত!
আমি মামুনকে ঘটনাগুলো বলছি। মামুন শুনে যাচ্ছে। পাশেই সেই সাঁকো। অবিকল সেদিনের মত দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ হয়ে। আমি কথা বলছি সেদিকেই তাকিয়ে।
‘তুই যে খুব ভয়াবহ অসুস্থ তা কি তুই জানিস?’ মামুন বলছে কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করছে। এতগুলো মানুষ আমার হাত দিয়ে চলে যাচ্ছে, এখানে তো আমার কোনোই দোষ নেই। আমার জগতে তো তাদের কারো প্রবেশাধিকার নেই। তবে কেন তারা বারবার ধংস করতে নামে? আমি উদাস হয়ে বলে যাচ্ছি-
‘জানিস, আমার জগত অনেকদিন ধরে নিখুঁত ছিল। রিনি আমার সব ভেঙ্গেচুরে দিল। ওর অদ্ভূত মায়াকারা চোখ। তার উপরে কি গাঢ ভ্রু। আমি ওর চোখেই বাস করেছি অনেকগুলো বছর। হঠাৎ ওর ভ্রু সরু করে ফেললো। রিনি আমার জগতে প্রলয় ডেকে আনছে আবার। ওর চোখের মাঝে আর আমার আবাস নেই।’
আবার এই দুনিয়া কেঁপে উঠছে। সামনের জলরাশি ফুঁসে উঠছে বারবার। ইস্রাফিল যেন ফুঁ দিয়ে বসেছে শিঙ্গায়। ভয়ঙ্কর শব্দে চারিদিক অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তার ভিতর থেকে ভেসে আসছে আমার নাম। মামুন আমার দিকে চিৎকার করে বলছে, ‘তুই আবার ফিরে যাচ্ছিস... আর ফিরে আসিস না এখানে মাসুদ... আর ফিরে আসিস না’
ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে চারপাশ। আমি নিজেও ছিনভিন্ন হচ্ছি। আমি আবার ফিরে যাচ্ছি!
পরিসমাপ্তি
আমার মুখের কাছে ঝুকে আছে রিনি। শঙ্কা আর আশার এক মিলিত চাহনি। হাসি ফুটে উঠছে ওর মুখে। আমিও অবাক হয়ে চেয়ে আছি ওর দিকে। আবার সেই চোখের টলমল দৃষ্টি, গাঢ় ভ্রুর খেলা। আমার জগতটা আবার নিখুঁত হয়ে উঠছে। আরো কিছুদিন আমার পৃথিবীতে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার পালা!
২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৪৬
অদিব বলেছেন: হুম...
২| ২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৫১
নিয়ামুল ইসলাম বলেছেন:
২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:০৬
অদিব বলেছেন: :-< :-< :-<
৩| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩৮
স্বপ্নবাজ অভি বলেছেন: ভালো লেগেছে !~ তবে আমি কিন্তু চৈত্র মাসেই বৃষ্টি চাই!
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:০৪
বোধহীন স্বপ্ন বলেছেন: অদ্ভূত!!