নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবরার সাদী

আবরার সাদী › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেলুন বালিকা দুঃখ বিলাস

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৮

২রা ফাল্গুন ১৪২১।



ছোটবেলা থেকেই শায়ের খুবই আবেগপ্রবন একটা মানুষ। আজ থেকে ঠিক ২৩ বৎসর আগে প্রাইমারী স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে আগে কোন একদিন শায়ের তার মায়ের কাছে বায়না করেছিল একজোড়া ‘বেলী কেডস’ কিনে দেবার জন্য। মা তার সেই শখের ‘বেলী কেডস’ কিনে দেননি বলে শায়ের তাদের ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে সজোরে কেঁদেছিল অনেক্ষন। দিনের বাকি সময়টাও তার কেটেছিল ভীষন মন খারাপ নিয়ে। সেদিনের সেই না পাওয়ার দুঃখটা শায়েরের মনে একটা আবেগী দাগ কেটেছিল। শায়ের তখন থেকেই মনে মনে ভাবত সে যেদিন মায়ের মত বড় হয়ে যাবে, সেদিন সে কোন বাচ্চাদেরকে আর কাঁদতে দিবে না।



গত বছরের কোন একদিন সকাল বেলা অফিসে যাবার সময় শায়ের দেখতে পেল, বিল্ডিং এর নিচতলায় সিড়ির পাশে দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে কাঁদছে। শব্দহীন কান্নায় মেয়েটার ভেতরটা যেন গলে বেরিয়ে পড়ছে দু-চোঁখ বেয়ে। মেয়েটার বয়স নয় কি দশ হবে। এই বিল্ডিং এর ১৮ টা ফ্লাটের কোন একটা ফ্লাটের মেয়ে। শায়ের ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটায় কান্না অবজ্ঞা করে যেতে পারল না। মেয়েটার পাশে গিয়ে একটু কুজো হয়ে জিজ্ঞেস করল “কি হয়েছে ভাইয়া? এরকম করে কাঁদছো কেন?” শায়েরের কথা শুনে মেয়েটা কিছুটা লজ্জা, কিছুটা দুঃখ, কিছুটা অবাক, কিছুটা আহ্লাদ মেশানো ভংগী করে দাঁড়িয়ে থাকল।



শায়ের দেশ-বিদেশ ঘুরে এটা অন্তত শিখেছে যে, অপরিচিত কোন বাচ্চার গায়ে যেকোন কারণে হাত রাখলে সেটাকে ভদ্র সমাজে ‘চাইল্ড এবিউস’ হিসেবে মনে করা হয়। শায়ের খুব সচেতন ভাবে আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে মেয়েটার পাশে প্রায় হাটু গেড়ে বসে তাকে আবার জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে ভাইয়া। মেয়েটা তখন অনিচ্ছার স্বরে অনুযোগ করে বলল, তার বাবা তাঁর কোন কথা শুনেন না। আজকে তার জন্মদিন, গতকাল সে বাবাকে বলেছিল বাবা যেন তার জন্য ২৩ টি বেলুন আর ২৩ টি চকলেট নিয়ে আসে। আজকে সে তার ক্লাসের সব বন্ধুদেরকে বেলুন আর চকলেট দিবে। কিন্তু গতকাল সে অনেক রাতে ঘুমুতে যাবার আগেও বাবা তার জন্য বেলুন আর চকলেট নিয়ে বাসায় ফেরেননি। সকাল বেলা সে যখন বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বেলুন আর চকলেটের কথা বলল, তখন বাবা তাকে অনেক ধমক দিয়ে বলেছেন, তার পক্ষে এখন বাইরে গিয়ে এসব কিনে আনা সম্ভব না।



শায়ের তখন চটপট বলে ফেলল, “আরে এটা কোন ব্যাপার! তুমি যদি কান্না থামিয়ে বলে দিতে পার আমার চুল আঁচড়ানোটা ঠিক হয়েছে কি না, তাহলে আমি এক্ষুনি গিয়ে তোমার জন্য বেলুন আর চকলেট নিয়ে আসবো।“ উজ্জ্বল নীল এর মধ্যে গোলাপী লেইসের কাজ করা জামা পরা পরীর মত বাচ্চা মেয়েটা যেন এবার আরো অনেক বেশি অবাক হল। এবার যে কিছুটা লজ্জা এবং কিছুটা আনন্দের মিশেল একটা চেহারা নিয়ে, শুধু মাথা নাড়ল। যার মানেটা শায়ের ঠিক বুঝতে পারল না। শায়ের খুকিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটা তখন শায়েরের মাথার দু-পাশের চুলে আলতো হাত বুলিয়ে বলল, “চুলে জেল দিলে আরও বেশি সুন্দর লাগত।“ এবং সাথে সাথে মেয়েটা আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “আমি জানি তুমি চকলেট আর বেলুন নিয়ে আর কখনই ফিরে আসবে না। চকলেটের দরকর নেই। যদি পার শুধু ২৩ টা বেলুন কিনে দাও আমাকে।“ এটুকু বলেই মেয়েটা বুক ফাটিয়ে কেঁদে যাচ্ছিল।



কথাগুলো শুনে শুনে শায়ের এক ঝটকায় উঠে দাড়াল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে তার বসকে ফোন করে জানাল, আজকে অফিসে আসতে তার কিছুটা দেরি হবে। ফোন রেখে শায়ের মেয়েটার দিকে আর ফিরে তাকায়নি। মেইন গেট ধরে সোজা বেরিয়ে গেল। বেলুন কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে? রাস্তা দিয়ে হেটে হেটে সে হাতির ঝিল পর্যন্ত চলে আসলো। পুরোটা হাতির ঝিল চক্কর দিয়েও এই সকাল বেলা সে কোন বেলুন বিক্রেতাকে খুঁজে পেল না। ভাবল শাহবাগ মোড় অথবা শিশুপার্কের পাশে অবশ্যই পাওয়া যাবে। একটা অটোরিক্সা নিয়ে তাড়াতাড়ি করে শাহবাগ চলে গেল...



সকালে অফিস শুরুর সময়, ঢাকা শহরে যেই পরিমাণ ট্রাফিক জ্যাম হয়, তা সবাইকেই যেকোন পরিস্থিতিতে মেনে নিতেই হয়। সেদিন বেলুন কিনে বাসায় ফিরে আসতে শায়েরে সাড়ে ১২টা বেঁজে গেল। অটোরিক্সা ছেড়ে গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখল মেয়েটা সিড়ির পাশে এখন আর দাঁড়িয়ে নেই; এতক্ষন অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকার কথাও না। দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করাতে সে মেয়েটা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারল না। সকাল বেলা আবেগে আপ্লুত হয়ে সে মেয়েটার নামটাও জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে ভুলে গিয়েছিল। উপায়ান্তর না দেখে, শায়ের বিল্ডিং এর প্রতিটা ফ্লাটে গিয়ে লোকজনকে ‘সকাল বেলা দেখা’ মেয়েটার বর্ণনা দিয়েও তাকে আর কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারল না। অনেক ফ্লাটের লোকজন বেলুন হাতে শায়েরকে দেখে কেউবা অবাক, কেউবা আবার বিরক্ত হয়েছেন। এক ফ্লাটের মুরুব্বী তো শায়েরকে বলেই বসলেন, “দেখো বাবা, এই জন্যই আমরা কোন ব্যচেলরকে ফ্লাট ভাড়া দিতে চাই না। কত রকমের কত ধাঁন্দা-ফিকির যে থাকে তোমাদের!!” শায়ের কোন প্রতিবাদ করেনি, কথাগুলো শুনে নিরবে চলে এসেছিল। তার মাথার ভিতরে শুধুই খুঁজে না পাওয়া সেই বালিকাটির কথা ঘুরছে। আর বালিকাটির সকাল বেলার সেই কথাটার মানে খোঁজার চেষ্টা করছে, “তুমি বেলুন আর চকলেট নিয়ে, আর কখনই ফিরে আসবে না।“



শায়ের নিজের ফ্লাটে ঢুকল। নিজের বেডের পাশে বেলুন গুলো বেঁধে রেখে শুয়ে পড়ল বিছানায়...



আজ ঠিক ২৩ টি সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। ২৩ বেলুনের কোনটি ফেটে গেছে, কোনটা বা চুপসে গেছে। সেই খূকিটার কোন খোঁজ আজ পর্যন্ত পায়নি শায়ের। কিন্তু শায়েরের মাথার ভেতরে সেই ‘বেলুন বালিকা দুঃখ বিলাসের সূর’ আজও একই তালে বেঁজে যাচ্ছে...

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.