![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সঙ্গকলকঃ মোঃমাইনউদ্দিন আহমেদ,সামিউল হক,আশরাফুল আলম
------------------------------------------
হাদিসে গাদিরে খুম
বিশ্বনবী (সা.) বিদায় হজ্জ শেষে মদীনার দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে ‘গাদীরে খুম’ নামক একটি স্থানে পৌঁছানোর পর পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। মহানবী (সা.) তাঁর যাত্রা থামিয়ে দিলেন। অত:পর তাঁর আগে চলে যাওয়া এবং পেছনে আগত সকল মুসলমানদেরকে তাঁর কাছে সমবেত হবার আহ্বান করেন। সবাই মহানবী (সা.) এর কাছে সমবেত হবার পর তাদের উদ্দেশ্যে তিনি এক মহা মূল্যবান ও ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। এটাই সেই ঐতিহাসিক ‘গাদীরে খুমের’ ভাষণ হিসেবে পরিচিত। এই ভাষণের মাধ্যমেই তিনি হযরত ইমাম আলী (আ.) কে তাঁর পরবর্র্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন।
হযরত বুরআ’ (রা.) বলেন ঃ “বিদায় হজ্জের সময় আমি মহানবীর পবিত্র সান্নিধ্যে উপস্থিত ছিলাম। যখন আমরা ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছালাম, তখন মহানবী (সা.) আমাদেরকে ঐ স্থানটি পরিস্কার করার নির্দেশ দিলেন। এর পর তিনি হযরত ইমাম আলী (আ.) কে তাঁর ডান দিকে এনে তাঁর হাত দু’টো জন সমক্ষে উপর দিকে উঁচু করে ধরলেন। তারপর তিনি বললেন ঃ “আমি কি তোমাদের অভিভাবক (কর্তা) নই? সবাই উত্তর দিল, আমরা সবাই আপনারই অধীন। অতঃপর তিনি বললেন ঃ আমি যার অভিভাবক ও কর্তা, আলীও তার অভিভাবক ও কর্তা হবে। হে আল্লাহ্! আলীর বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব কর এবং আলীর শত্র“র সাথে শত্র“তা কর। এর পর দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তার হযরত আলী (আ.) কে সম্বোধন করে বললেন ঃ ‘তোমার এই অমূল্য পদ মর্যাদা আরও উন্নত হোক! কেননা তুমি আমার এবং সকল মু’মিনদের অভিভাবক হয়েছ।’ -আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান নিহায়াহ্, ৫ম খন্ড, ২০৮ নং পৃষ্ঠা, এবং ৭ম খন্ড, ৩৪৬ নং পৃষ্ঠা। যাখাইরূল উকবা, (তাবারী), ১৩৫৬ হিজরী মিশরীয় সংস্করণ, ৬৭ নং পৃষ্ঠা। ফুসুলুল্ মুহিম্মাহ্, (ইবনে সাব্বাগ) ২য় খন্ড, ২৩ নং পৃষ্ঠা। খাসাইসুন্ নাসাঈ, ১৩৫৯ হিজরীর নাজাফীয় সংস্করণ, ৩১ নং পৃষ্ঠা। জনাব আল্লামা বাহ্রানী (রহ.) তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থে সুন্নী সূত্রে বর্ণিত ৮৯ টি হাদীস এবং শীয়া সূত্রে বর্ণিত ৪৩টি হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
সাফিনাতুন্ নূহ্রে হাদীস
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন ঃ মহানবী (সা.) বলেছেন যে, ‘আমার আহলে বাইতের উদাহরণ হযরত নুুহ (আ.) এর নৌকার মত। যারা নৌকায় আরোহন করল, তারাই রক্ষা পেল। আর যারা তা করল না তারা সবাই ডুবে মরল’। (‘যাখাইরূল উকবা’ ২০ নং পৃষ্ঠা। ‘আস সাওয়াইকুল মুহরিকাহ (ইবনে হাজার)’ মিশরীয় সস্করণ, ৮৪ ও ১৫০ নং পৃষ্ঠা। ‘তারীখুল খুলাফাহ (জালালুদ্দিন আস্ সুয়ূুতী) ৩০৭ নং পৃষ্ঠা। ‘নুরূল আব্সার (শাবালঞ্জি)’ মিশরীয় সংস্করণ, ১১৪ নং পৃষ্ঠা)
জনাব আল্লামা বাহরানী, তার ‘গায়াতুল মারাম’ নামক গ্রন্থের ২৩৭ নং পৃষ্ঠায় সুন্নীদের ১১টি সূত্র থেকে এবং শীয়াদের ৭টি সূত্র থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
হাদীসে সাকালাইন
হযরত যাইদ বিন আরকাম (রা.) বলেন ঃ মহানবী (সা.) বলেছেন ঃ “মনে হচ্ছে আল্লাহ্ যেন আমাকে তাঁর দিকেই আহ্বান জানাচ্ছেন, অবশ্যই আমাকে তার প্রত্যুত্তর দিতে হবে। তবে আমি তোমাদের মাঝে অত্যন্ত ভারী (গুরুত্বপূর্ণ) দু’টো জিনিস রেখে যাচ্ছি ঃ তা হচ্ছে আল্লাহ্র এই ঐশী গ্রন্থ (কুরআন) এবং আমার পবিত্র আহলে বাইত। তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবে, সে ব্যাপারে সতর্ক থেকো। এ দু’টো (পবিত্র কুরআন ও আহলে বাইত) জিনিস ‘হাউজে কাউসারে’ (কেয়ামতের দিন) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনোই পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।” (আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্ ৫ম খন্ড, ২০৯ নং পৃষ্ঠা। যাখাইরূল উকবা, (তাবারী) ১৬ নং পৃষ্ঠা। ফুসুলুল্ মুহিম্মাহ্, ২২নং পৃষ্ঠা। খাসইসুন্ নাসাঈ, ৩০ নং পৃষ্ঠা। আস্ সাওয়াইকুল মুহরিকাহ্, ১৪৭ নং পৃষ্ঠা।)
গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থে' আল্লামা বাহরানী ৩৯টি সুন্নী সূত্রে এবং ৮২টি শীয়া সূত্রে উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ‘হাদীসে সাকালাইন্’ একটি বিখ্যাত ও সর্বজন স্বীকৃত এবং অকাট্য ভাবে প্রমাণিত সূত্রে বর্ণিত। উক্ত হাদীসটি অসংখ্য সূত্রে এবং বিভিন্ন ধরনের বর্ণনায় (একই অর্থে) বর্ণিত হয়েছে। উক্ত হাদীসের সত্যতার ব্যাপারে সুন্নী ও শীয়া উভয় স¤প্রদায়ই স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এ ব্যাপারে তারা উভয়ই সম্পূর্ণরূপে একমত।
আলোচ্য হাদীসটি এবং এ ধরনের হাদীস থেকে বেশ কিছু বিষয় আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়। তা হল ঃ
১। পবিত্র কুরআন যেভাবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে টিকে থাকবে, মহানবী (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইতও তাঁর পাশাপাশি মানব জাতির মাঝে কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন। অর্থাৎ এ বিশ্বের কোন যুগই ইমাম বা প্রকৃত নেতা বিহীন অবস্থায় থাকবে না।
২। বিশ্বনবী (সা.) মানব জাতির কাছে এই দু’টো অমূল্য আমানত গচ্ছিত রাখার মাধ্যমে তাদের সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও জ্ঞান মূলক প্রয়োজন মেটানো এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে গেছেন। মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণকে সকল
প্রকার জ্ঞানের অমূল্য রতœ ভান্ডার হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের যে কোন কথা ও কাজকেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
১। পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইতকে অবশ্যই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মহানবী (সা.) এর আহলে বাইতের পবিত্র জ্ঞান ধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের উপদেশ ও হেদায়েতের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার কোন মুসলমানেরই নেই।
মানুষ যদি পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) আনুগত্য করে এবং তাঁদের কথা মেনে চলে, তাহলে কখনোই তারা পথভ্রষ্ট হবে না। কেননা তারা সর্বদাই সত্যের সাথে অবস্থান করছেন।
মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সর্ব প্রকার ধর্মীয় ও অন্য সকল জ্ঞানই পবিত্র আহলে বাইতগণের কাছে রয়েছে। তাই যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, তারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না এবং তারা অবশ্যই জীবনের প্রকৃত সাফল্য লাভ করবে। অর্থাৎ পবিত্র আহলে বাইতগণ সর্ব প্রকার ত্র“টি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। এ থেকেই বোঝা যায় যে, পবিত্র আহলে বাইত বলতে মহানবী (সা.) এর পরিবারের সকল আত্মীয়বর্গ ও বংশধরকেই বোঝায় না। বরং পবিত্র আহলে বাইত বলতে নবী বংশের বিশেষ ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং সর্বপ্রকার পাপ ও ভুল থেকে তাঁদের অস্তিত্ব মুক্ত ও পবিত্র হওয়াই ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য। যাতে করে তাঁরা প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন। ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন ঃ হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এবং তাঁর বংশের অন্য এগারো জন সন্তান। তাঁরা প্রত্যেকেই একের পর এক ইমাম হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। একই ব্যাখ্যা মহানবী (সা.) এর অন্য একটি হাদীসে পাওয়া যায়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন ঃ “আমি মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, আপনার যে সব আত্মীয়কে ভালবাসা আমাদের জন্যে ওয়াজিব, তাঁরা কারা? মহানবী (সা.) বললেন ঃ ‘তাঁরা হলেন আলী, ফাতিমা, হাসান এবং হোসাইন। ” (ইয়া নাবীউল মুয়াদ্দাহ্, ৩১১ নং পৃষ্ঠা।)
হযরত যাবির (রা.) বলেন ঃ বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন ঃ “মহান আল্লাহ্ প্রত্যেক নবীর বংশকেই স্বীয় পবিত্র সত্বার মাঝে নিহিত রেখেছেন। কিন্তু আমার বংশকে আলীর মাঝেই সুপ্ত রেখেছেন।” (ইয়া নাবীউল মুয়াদ্দাহ্, ৩১৮ নং পৃষ্ঠা।)
হাদীসে হাক্ক
হযরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন “আমি আল্লাহ্র রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন ঃ ‘আলী পবিত্র কুরআন ও সত্যের সাথে রয়েছে। আর পবিত্র কুরআন ও সত্যও আলীর সাথে থাকবে এবং তাঁরা ‘হাউজে কাওসারে আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হবে না।” উক্ত হাদীসটি ‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থের ৫৩৯ নং পৃষ্ঠায় একই অর্থে সুন্নী সূত্রে ১৪টি এবং শীয়া সূত্রে ১০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হাদীসে মান্যিলাত্
হযরত সা’দ বিন ওয়াক্কাস (রা.) বলেন ঃ “আল্লাহ্র রাসূল (সা) হযরত আলী (আ.) কে বলেছেন ঃ ‘তুমি এতেই সন্তুষ্ট নও যে, তুমি (আলী) আমার কাছে মুসা (নবী) আর হারূনের মত? শুধু এই টুকুই পার্থক্য যে, আমার পর আর কোন নবী আসবে না।”
(বিদায়াহ্ ওয়ন্ িনিহায়াহ্, ৭ম খন্ড, ৩৩৯ নং পৃষ্ঠা। যাখাইরূল উকবা, (তাবারী), ৫৩ নং পৃষ্ঠা। ফুসুসুল মুহিম্মাত, ২১ নং পৃষ্ঠা। কিফায়াতুত তালিব (গাঞ্জী শাফেঈ ), ১১৪৮ - ১৫৪ পৃষ্ঠা। খাসাইসুন্ -নাসাঈ, ১৯- ২৫ নং পৃষ্ঠা। আস্ সাওয়ঈকুল মুহ্রিকাহ্, ১৭৭ নং পৃষ্ঠা।)
‘গায়াতুল মারাম’ গ্রন্থে'র ১০৯ নং পৃষ্ঠায় জনাব আল্লামা বাহরানী উক্ত হাদীসটি ১০০টি সুন্নী সূত্রে এবং ৭০টি শীয়া সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
আত্মীয়দের দাওয়াতের হাদীস
মহানবী (সা.) তাঁর নিকট আত্মীয়দেরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন ঃ “এমন কোন ব্যক্তির কথা আমার জানা নেই, যে আমার চেয়ে উত্তম কিছু তার জাতির জন্যে উপহার স্বরূপ এনেছে। মহান আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর প্রতি আহ্বান জানানোর জন্যে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে আমাকে এ পথে সহযোগিতা করবে? আর সে হবে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা বা প্রতিনিধি। উপস্থিত সবাই নিরুত্তর রইল। অথচ আলী (আ.) যদিও উপস্থিত সবার মাঝে কনিষ্ঠ ছিলেন, তিনি বললেন ঃ ‘আমিই হব আপনার প্রতিনিধি এবং সহযোগী’। অতঃপর মহানবী (সা.) নিজের হাত
তাঁর ঘাড়ের উপর রেখে বললেন ঃ ‘আমার এ ভাইটি আমার উত্তরাধিকারী এবং আমার খলিফা। তোমরা সবাই অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করবে’। এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার পর উপস্থিত সবাই সেখান থেকে উঠে গেল এবং এ বিষয় নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে লাগল। তারা জনাব আবু তালিবকে বলল ঃ “মুহাম্মদ তোমাকে তোমার ছেলের আনুগত্য করার জন্যে নির্দেশ দিয়েছে।” (তারীখু আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১১৬ নং পৃষ্ঠা।)
এ জাতীয় হাদীসের সংখ্যা অনেক যেমনঃ হযরত হুযাইফা বলেন মহানবী (সা.) বলেছেনঃ “তোমরা যদি আমার পরে আলীকে খলিফা ও আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত কর, তাহলে তোমরা এক জন দিব্য দৃষ্টি সম্পন্ন পথ প্রদর্শক হিসেবেই পাবে, যে তোমাদেরকে সৎ পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করবে। আমার মনে হয় না যে, এমন কাজ তোমরা করবে।” (খলিফাতুল আউলিয়া, আবু নাঈম, ১ম খন্ড, ৬৪ নং পৃষ্ঠা। কিফায়াতুত তালিব, ৬৭ নং পৃষ্ঠা, ১৩৫৬ হিজরীর নাজাফিয় মুদ্রণ।)
হযরত ইবনু মারদুইয়াহ্ (রা.) বলেন ঃ মহানবী (সা.) বলেছেন যে, “যে ব্যক্তি আমার মতই জীবন যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে চায় এবং বেহেশতবাসী হতে চায়, সে যেন আমার পরে আলীর প্রেমিক ও আমার পবিত্র আহলে বাইতের অনুসারী হয়। কারণ, তারা আমারই রক্ত সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়বর্গ এবং আমারই কাদামাটি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আমার জ্ঞান ও বোধশক্তি তারাই লাভ করেছে। সুতরাং হতভাগ্য সেই, যে তাঁদের পদ মর্যাদাকে অস্বীকার করবে। অবশ্যই আমার সুপারিশ (শাফায়াত) থেকে তারা বঞ্চিত হবে”। (মুন্তাখাবু কানযেল উম্মাল, মুসনাদে আহমাদ, ৫ম খন্ড, ৯৪ নং পৃষ্ঠা)।
১। আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৫ম খন্ড, ২৭৭ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খন্ড, ১৩৩ নং পৃষ্ঠা। আল্ কামিল ফিত্ তারীখ (ইবনে আসির), ২য় খন্ড, ২১৭ নং পৃষ্ঠ। তারীখুর রাসুল ওয়াল মুলুক (তাবারী ), ২য খন্ড, ৪৩৬ নং পৃষ্ঠা।
---------------------------------------------
অবশ্য ঐসব হাদীসের যথেষ্ট অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। আর এই অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ঐগুলোর মূল অর্থকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
পূর্বোক্ত আলোচনার পক্ষে কিছু কথা
বিশ্বনবী (সা.)-এর জীবনের শেষ দিনগুলো যখন অসুস্থ অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন। তখন একদল সাহাবী রাসূল (সা.) এর কাছে উপস্থিত ছিলেন। হযরত রাসূল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেন ঃ “আমার জন্যে কাগজ ও কলম নিয়ে এসো কারণ, আমি এমন কিছু তোমাদের জন্য লিখে রেখে যেতে চাই, যা মেনে চললে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না”। উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে কিছু লোক বললো ঃ ‘এ লোক তো অসুস্থতার ফলে প্রলাপ (?) বকছে। কারণ, আল্লাহ্র কুরআনই তো আমাদের জন্যে যথেষ্ট’!! এ নিয়ে উপস্থিত সাহাবীদের মধ্যে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। রাসূল (সা.) এ অবস্থা দেখে বললেন ঃ তোমারা এখান থেকে উঠে পড়। আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও। আল্লাহ্র রাসূলের কাছে হৈ চৈ করা উচিত নয়’।
পূর্বোক্ত অধ্যায়ের বিষয় বস্তু এবং এ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনা প্রবাহ যদি আমরা আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, যারা রাসূল (সা.)-এর ঐ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সেদিন বাঁধা প্রদান করেছিল, তারাই রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচনের ঘটনা থেকে লাভবান হয়েছিল। বিশেষ করে তারা হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের অজ্ঞাতসারেই ‘খেলাফত নির্বাচনের’ পর্বটি সম্পন্ন করে। তারা হযরত আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের বিপরীতে ঐ কাজটি সম্পন্ন করেছিল। এরপর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে, উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনায় মহানবী (সা.) তাঁর পরবর্র্তী উত্তরাধিকারী বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে হযরত আলী (আ.)-এর নাম ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন।
মহানবী (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা প্রদান পূর্বক ঐ ধরনের কথা বলার মাধ্যমে কথা কাটা-কাটি বা বিতর্ক সৃষ্টিই ছিল মূল উদ্দেশ্য, যাতে করে এর ফলে মহানবী (সা.) তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত হতে বাধ্য হন। সুতরাং অসুস্থতা জনিত প্রলাপ বকার কারণে তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়নে বাধা দেয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না।
কারণ, প্রথমতঃ আল্লাহ্র রাসূল (সা.)এর পবিত্র মুখ থেকে অসুস্থকালীন সময়ে অসংলগ্ন একটি কথাও শোনা যায়নি। আর এ যাবৎ এ ধরনের কোন ঘটনাও (অসংলগ্ন কথাবার্তা) কেউই বর্ণনা করেনি। ইসলাম নির্ধারিত নীতিমালা অনুযায়ী কোন মুসলমানই মহানবী (সা.) এর প্রতি প্রলাপ বকার (?) মত অপবাদ আরোপ করতে পারে না। কারণ, আল্লাহ্র রাসূল (সা.) ছিলেন ঐশী ‘ইসমাত’ বা নিস্পাপ হওয়ার গুণে গুণাম্বিত।
দ্বিতীয়ত ঃ যদি তাদের কথা (প্রলাপ বকার মিথ্যা অভিযোগ সত্যই হত, তাহলে এর পরের কথাটি (কুরআনই আমাদের জন্যে যথেষ্ট) বলার কোন প্রয়েজন হত না। কারণঃ তাদের পরবর্র্তী কথার অর্থ হচ্ছে, কুরআনই তাদের জন্যে যথেষ্ট, এরপর রাসূল (সা.)-এর বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর সাহাবীরা ভাল করেই জানতেন যে, পবিত্র কুরআনই মহানবী (সা.)-এর অনুসরণকে সবার জন্যে ফরজ হিসেবে ঘোষণা করেছে। রাসূল (সা.)-এর বাণীকে আল্লাহ্র বাণীরই মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট দলিল অনুসারে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশের মোকাবিলায় মানুষের ইচ্ছার কোন স্বাধীনতা বা অধিকার নেই।
তৃতীয়ত ঃ প্রথম খলিফার মৃত্যুর সময় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। তখন প্রথম খলিফা তার পরবর্র্তী খলিফা হিসেবে দ্বিতীয় খলিফার নামে খেলাফতের ওসিয়ত (উইল) লিখে যান। তৃতীয় খলিফা ওসমান যখন প্রথম খলিফার নির্দেশে উক্ত ‘ওসিয়ত’ (উইল) লিখেছিলেন, তখন প্রথম খলিফা সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু, এবার দ্বিতীয় খলিফা প্রথম খলিফার ব্যাপারে মোটেই প্রতিবাদ করেন নি, যে প্রতিবাদটি তিনি আল্লাহ্র রাসূল (সা.) এর ব্যাপারে করেছিলেন।
এ ছাড়া হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে দ্বিতীয় খলিফার যে স্বীকারোক্তি উল্লিখিত হয়েছে, তাতে তিনি বলেছেন ঃ “আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) আলীর খেলাফতের বিষয়টি লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে তা আমি হতে দেইনি”। তিনি আরও বলেন যে ‘আলীই ছিল খেলাফতের অধিকারী । কিন্তু সে যদি খেলাফতের আসনে বসত তাহলে জনগণকে সত্য পথে চলার জন্যে উদ্বুদ্ধ
--------------------------------------------
২। আল্ কামিল ফিত্ তারীখ (ইবনে আসির), ২য় খন্ড, ২৯২ নং পৃষ্ঠা। শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খন্ড, ৪৫ নং পৃষ্ঠা।
৩। শারহু ইবনি আবিল হাদিদ, ১ম খন্ড, ১৩৪ নং পৃষ্ঠা।
৪। তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৩৭ নং পৃষ্ঠা।
----------------------------------
করত। কিন্তু কুরাইশরা তার আনুগত্য করত না। তাই আমি তাকে খেলাফতের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছি’!!!
ইসলামের নীতি অনুযায়ী সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্যে সত্যবাদীদেরকে পরিত্যাগ না করে বরং সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে সত্য গ্রহণে বাধ্য করা উচিত। যখন প্রথম খলিফার কাছে সংবাদ পৌঁছলো যে মুসলমানদের একটি গোত্র যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে, তৎক্ষণাত তিনি তাদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন এবং বললেন ঃ “আল্লাহ্র রাসূল (সা.) কে মাথার রুমাল বাধার যে দড়ি দেয়া হত, তা যদি আমাকে না দেয়া হয়, তাহলেও তাদের সাথে আমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হব।” অবশ্য এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোন মূল্যের বিনিময়েই হউক না কেন, সত্যকে পুনরুজীবিত করতে হবে। অথচ, সত্য ভিত্তিক খেলাফতের বিষয়টি মাথার রুমাল বাঁধার দড়ির চেয়ে অবশ্যই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ছিল।
ইসলামে ইমামত
নবী পরিচিতি অধ্যায়ে ইতিপূর্বে আলোচিত হয়েছে যে, গণভাবে পথ নির্দেশনার (হেদায়াত) অপরিহার্য ও ধ্র“ব আইন অনুসারে সৃষ্টি জগতের প্রতিটি সৃষ্টিই প্রাকৃতিক ভাবে স্বীয় শ্রেষ্ঠত্ব, পূর্ণত্ব ও মহত্ব প্রাপ্তির পথে পরিচালিত ও সদা ধাবমান। মানুষও জগতের অন্যান্য সৃষ্টির মতই একটি সৃষ্টি। তাই মানুষও উক্ত আইনের ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং মানুষও তার বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী ও সামাজিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে তার নিজ জীবনে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, যার মাধ্যমে সে ইহকালে ও পরকালে দু’ জীবনেই সাফল্য ও সৌভাগ্য লাভ করতে পারে। এক কথায় এমন এক শ্রেণীর বিশ্বাস ও বাস্তব দায়িত্বের ভিত্তিতে মানব জীবন পরিচালিত হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে মানুষ, জীবনের সাফল্য ও মানবীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। মানব জীবন পরিচালনার ঐ কর্মসূচী ও জীবন দর্শনের নামই দ্বীন। এই দ্বীন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত নয় বরং তা ঐশীবাণী (ওহী) ও নবুয়তের মাধ্যমে প্রাপ্ত, যা মানব জাতির কিছু সংখ্যক বিশিষ্ট ও পবিত্র আত্মসম্পন্ন ব্যক্তিদের (নবীগণ) মাধ্যমে অর্জিত হয়।
আল্লাহ্র নবীরাই ‘ওহী’ বা ঐশীবাণীর মাধ্যমে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে মানব জাতির কাছে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সমূহ পৌঁছে দেন। যাতে করে ঐ সব দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মানব জীবন সাফল্য মন্ডিত হয়। এটা খুবই স্পষ্ট যে, উক্ত যুক্তির ভিত্তিতে এ ধরনের একটি জীবন বিধানের প্রয়োজনীয়তা মানব জাতির জন্যে প্রমাণিত হয়। একই ভাবে এর পাশাপাশি মানব জাতির ঐ মূল্যবান জীবন বিধান সম্পূর্ণ অবিকৃত রূপে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও প্রমাণিত হয়। মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহের মাধ্যমে সেই ঐশী জীবন বিধান মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে যেমন বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন, তেমনি ঐ জীবন বিধান সংরক্ষণের
---------------
১। আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৬ম খন্ড, ৩১১ নং পৃষ্ঠা।
-------------------------
জন্যেও বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রয়োজন। যাতে করে ঐ জীবন বিধান চিরদিন অবিকৃত রূপে সংরক্ষিত থাকে এবং প্রয়োজনে তা মানুষের কাছে উপস্থাপন ও শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। অর্থাৎ সর্বদাই একের পর এক এমন কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকা প্রয়োজন, যারা আল্লাহ্র প্রদত্ত ঐ দ্বীনকে সর্বদাই অবিকৃত রূপে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে তা প্রচার করবেন।
যে বিশিষ্ট ব্যক্তি ঐ ঐশী দ্বীনকে অবিকৃত ভাবে সংরক্ষণের জন্যে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নিয়োজিত, তাঁকেই ‘ইমাম’ নামে অভিহিত করা হয়। একই ভাবে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ‘ওহী’ বা ঐশী বাণী ও বিধান গ্রহণের যোগ্যতা সম্পন্ন আত্মার অধিকারী ব্যক্তিকে ‘নবী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। নবুয়তও ইমামতের সমাহার একই ব্যক্তির মধ্যেও পাওয়া যেতে পারে, আবার পৃথক পৃথকও হতে পারে।
পূর্বোক্ত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে নবী রাসূলগণের জন্যে ‘ইমামত’ বা নিষ্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্বি^ত হওয়ার অপরিহার্যতা যেমন প্রমাণিত হয়, তেমনি ইমামের জন্যে ‘ইসমাত’ বা নিস্পাপ হওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার অপরিহার্যতাও প্রমাণিত হয়। কেননা, দ্বীনকে কেয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে সম্পূর্ণ অবিকৃত ও প্রচারের যোগ্যতা সম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ করা আল্লাহ্র দায়িত্ব। আর এ উদ্দেশ্য ঐশী ‘ইসমাত’ (নিস্পাপ হওয়ার গুণ) ও ঐশী নিরাপত্তা বিধান ছাড়া বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
............চলবে।
©somewhere in net ltd.