![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সিফফিন অভিমুখে ইমাম আলীর(আঃ) যাত্রা
কূফার নাখীলাহ্ সেনাশিবির অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী মুজাহিদের দ্বারা উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। সকলেই জীবন বাজি রেখে ইমামের পক্ষ থেকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলো। অবশেষে ইমাম (আঃ) ৩৬ হিজরীর ৫ই শাওয়াল বুধবার শিবিরে প্রবেশ করলেন এবং সৈন্যদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বললেন ঃ
“প্রশংসা আল্লাহ্র, প্রত্যেক বার যখন রাত্রি আগমন করে এবং চরাচর অন্ধকারে ডুবে যায়, প্রশংসা আল্লাহ্র, প্রতি মুহূর্তেই যখন কোনো তারকা উদিত হয় কিম্বা মিলিয়ে যায়, প্রশংসা আল্লাহ্র Ñ যার নে‘আমত সমূহের অন্তÍ নেই এবং যার অনুগ্রহসমূহের সমতুল্য ও প্রতিদান নেই।
“শোনো হে লোকসকল! আমার অগ্রসেনা দলকে আগেই রওয়ানা করিয়ে দিয়েছি১ এবং আমার পরবর্তী নির্দেশ তাদের কাছে না পৌঁছা পর্যন্তÍ তাদেরকে ফোরাতের তীরে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছি। এখন সময় এসেছে পানি অতিক্রম করার এবং তোমাদের থেকে একদল মুসলমানের অভিমুখে যাত্রা করার Ñ যারা দজলার আশেপাশে বসবাস করে; তাদেরকে তোমাদের সঙ্গে শত্রুর বিরুদ্ধে রওয়ানা করিয়ে দেবো যাতে তারা তোমাদের সাহায্য করতে পারে।২
“আমি ‘উক্বাহ্ বিন খালেদকে৩ কূফার গভর্নর নিযুক্ত করেছি। আমার নিজেকে ও তোমাদেরকে রেখে যাই নি, যাতে কেউ যাত্রা করা থেকে বিরত না থাকে। মালেক ইবনে হাবীব ইয়ারবু‘ঈকে নির্দেশ দিয়েছি যে, সে যেন পিছনে পড়া লোকদেরকে ছেড়ে না আসে; সবাইকে যেন তোমাদের সাথে যোগদান করায়।”৪
এ সময় মা‘ক্বাল ইবনে ক্বায়স্ রিয়াহী Ñ যে একজন তীক্ষè ও সাহসী ব্যক্তি ছিলো Ñ উঠে দাঁড়ালো এবং বললো, “আল্লাহ্র শপথ, সন্দেহভাজন ব্যতীত কেউ নির্দেশ ভঙ্গ করে না, আর মুনাফিক ব্যতীত কেউ বিলম্ব করে না। কতই না ভালো হতো যদি নির্দেশ অমান্যকারীদের গর্দান নিতে মালেক ইবনে হাবীবকে নির্দেশ দিতেন।”
উত্তরে ইমাম (আঃ) বললেন, “আমি তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেছি। আর আল্লাহ্ চান তো সে এ নির্দেশ অমান্য করবে না।”
অতঃপর আরেক দল বক্তব্য রাখার জন্য উদ্যত হলো। কিন্তু ইমাম (আঃ) অনুমতি দিলেন না এবং তাঁর ঘোড়া আনতে বললেন। তিনি যখন ঘোড়ার রেকাবে পা রাখলেন তখন বললেন “বিসমিল্লাহ্।” এরপর যখন জিনের ওপর বসলেন তখন বললেন ঃ
سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَ مَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنيِنَ وَ اِنَّا اِلَي رَبِّناَ مُنْقَلِبونَ.
“প্রশংসা আল্লাহ্র, যিনি আমাদের জন্য এ বাহনকে অনুগত করে দিয়েছেন, নচেৎ আমাদের সে ক্ষমতা ছিলো না। আমরা সবাই আল্লাহ্র কাছেই প্রত্যাবর্তন করবো।”৫
অতঃপর তিনি বললেন, “হে আমার রব! আমি সফরের কষ্ট থেকে, প্রত্যাবর্তনের দুঃখ থেকে, ইয়াক্বীনের পরবর্তীতে হয়রান ও দিশেহারা হওয়া থেকে এবং স্বীয় পরিবার ও মাল-সম্পদে কুদৃষ্টি থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি। হে আমার রব! সফরে তুমিই আমার সঙ্গী আর পরিবারে তুমিই আমার স্থলাভিষিক্ত। আর এ দু’টি (ক্ষমতা) শুধু তুমি ছাড়া কারো মধ্যে একত্রিত হয় না। কেননা, যে ব্যক্তি স্থলাভিষিক্ত হয় সে সঙ্গী হয় না, আর যে ব্যক্তি সঙ্গী হয় সে স্থলাভিষিক্ত হয় না।”
অতঃপর তিনি স্বীয় বাহনকে রওয়ানা করালেন। হুর ইবনে সাহ্ম রাব্‘ঈ তাঁর পেছন পেছন চলছিলেন এবং রণসঙ্গীত গাচ্ছিলেন।
এ সময় ইমাম (আঃ)-এর প্রহরীদের সর্দার মালেক ইবনে হাবীব তাঁর ঘোড়ার লাগামকে টেনে ধরলেন এবং ভগ্ন হৃদয়ে বললেন, “হে ইমাম! এটা কি ঠিক যে, আপনি মুসলমানদেরকে নিয়ে জিহাদে রওয়ানা হবেন এবং তাদের সাথে আল্লাহ্র রাহে জিহাদের পুরস্কার লাভে ধন্য হবেন, আর আমাকে নির্দেশ ভঙ্গকারীদেরকে জড়ো করার কাজে রেখে যাবেন?” ইমাম বললেন, “এ দলটি (যুদ্ধে গমনকারীরা) যে প্রতিদানই লাভ করবে তুমিও তাতে অংশীদার থাকবে। তুমি আমাদের সাথে থাকার চেয়ে এখানে বেশি কার্যকর।” তখন ইবনে হাবীব বললেন, سَمِعاً وَ طَاعَةً يا أَمِيِرَ الْمُؤْمِنيِنَ“হে আমীরুল মু‘মিনীন! আপনার কথা শুনলাম ও মেনে নিলাম।”৬
ইমাম (আঃ) স্বীয় সৈন্যদেরকে নিয়ে কূফাহ্ ত্যাগ করলেন। কূফাহ্ সেতু অতিক্রম করার পর তিনি তাঁর সৈন্যদের উদ্দেশে বললেন, “এখানে স্থানীয় অনুসরণকারীরা ও এখানে বসবাসকারীরা সকলে নামায সম্পূর্ণরূপে আদায় করবে। কিন্তু আমরা মুসাফির। আর আমাদের সাথের কোনো লোক (যারা মুসাফির) ফরয রোযা রাখবে না এবং তার নামায কছর করবে। অতঃপর তিনি দুই রাকা‘আত যোহরের নামায পড়লেন এবং তারপর স্বীয় যাত্রা অব্যাহত রাখলেন। এরপর সেনাবাহিনী যখন কূফাহ্ থেকে দুই র্ফাসাখ (১২ কিলোমিটার) দূরে অবস্থিত আবু মূসা নামক স্থানে পৌঁছলো তখন তিনি দুই রাআ‘আত আছরের নামায পড়লেন। নামায শেষ হলে তিনি তাঁর দো‘আর মধ্যে বললেন ঃ
“পরম প্রমুক্ত সেই আল্লাহ্ যিনি নে‘আমত ও অনুগ্রহের মালিক। পরম প্রমুক্ত সেই আল্লাহ্ যিনি ক্ষমতা ও দয়ার মালিক। তাঁর কাছে আমার প্রার্থনা যেন আমাকে তাঁর সন্তুষ্টিতেই সন্তুষ্ট রাখেন এবং স্বীয় আনুগত্যে আমাকে সফল করেন, আর তাঁর নির্দেশের প্রতি আমাকে মনোযোগী করেন। তিনিই তো দো‘আ শ্রবণকারী।”৭
অতঃপর তিনি পুনরায় যাত্রা করলেন এবং মাগরিবের নামায পড়ার জন্য ছারাশ্ নামক একটি স্থানে থামলেন যেখান থেকে ফোরাতের একটি প্রশস্ত শাখানদী প্রবাহিত হচ্ছিলো। মাগরিবের নামাযশেষে দো‘আর মধ্যে তিনি বললেন ঃ
“সেই আল্লাহ্র প্রশংসা যিনি রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করেন। আল্লাহ্র প্রশংসা যখন রাতের আঁধার ছড়িয়ে পড়ে। প্রশংসা আল্লাহ্র, যখন কোনো তারকা উদিত হয় কিম্বা অস্তমিত হয়।”৮
অতঃপর সে রাতে তিনি সেখানেই বিশ্রাম করলেন এবং ভোরে ফজরের নামায পড়ে পুনরায় রওয়ানা হলেন। ‘কুব্বায়ে কুব্বাইন’ নামক স্থানে পৌঁছলে নদীর ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা খেজুর গাছের ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়লো। তখন তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন ঃ وَ النَّخْلَ بِاسِقَاتِ لَهَا طَلْعٌ نَضِيدٌ “আকাশ থেকে যে পানি বর্ষিত করেছি তা দ্বারা লম্বা লম্বা খেজুর গাছ উৎপন্ন করেছি Ñ যার সুশৃঙ্খল ও পরস্পর বিজড়িত পুষ্পকলি রয়েছে।”৯
এরপর তিনি ঘোড়ার সাহায্যে নদী অতিক্রম করলেন এবং ইয়াহূদীদের একটি উপাসনালয়ের পাশে বিশ্রাম করলেন।১০
ইমামের (আঃ) কারবালা প্রান্তÍর অতিক্রম
ইমাম (আঃ) কূফাহ্ থেকে সিফফীনে যাওয়ার পথে কারবালা অতিক্রম করেন।
র্হাছামাহ্ ইবনে সেলিম বলেন, ইমাম (আঃ) কারবালা প্রান্তÍরে অবতরণ করলেন এবং আমাদের সাথে নামায আদায় করলেন। তিনি সেখানকার কিছু মাটি হাতে তুলে নিয়ে ঘ্রাণ নিলেন এবং বললেন, “ধন্য তুমি, হে কারবালার মাটি! তোমার থেকে এমন একদল মানুষ উত্থিত হবে যারা বিনা হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করবে।” অতঃপর তিনি হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে করে বললেন, “এখানে এবং ঐখানে।”
সা‘ঈদ ইবনে ওয়াহাব বলেন, আমি বললাম, “আপনার কথার তাৎপর্য কী?” তিনি বললেন, “অত্যন্তÍ মর্যাদাবান একটি পরিবার এ প্রান্তÍরে অবতরণ করবে। তাদের ওপর তোমাদের থেকে ভর্ৎসনা এবং তোমাদের ওপর তাদের থেকে ভর্ৎসনা।” আমি বললাম, “আপনার কথার তাৎপর্য কী?” তিনি বললেন, “তাদের ওপর তোমাদের থেকে ভর্ৎসনা অর্থাৎ তোমরা তাদেরকে হত্যা করবে এবং তোমাদের ওপর তাদের ভর্ৎসনা অর্থাৎ তাদেরকে হত্যা করার জন্য তোমাদেরকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে।”১১
হাসান বিন ক্বাছীর স্বীয় পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, ইমাম (আঃ) কারবালা প্রান্তÍরে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ذَاتُ كَرْبٍ وَ بَلاَءٍ Ñ দুঃখ ও বিপদের ভূমি। অতঃপর হাত দ্বারা নির্দিষ্ট একটি স্থানে ইঙ্গিত করলেন এবং বললেন, এটা হলো তাদের মালপত্র নামানোর জায়গা এবং তাদের জন্তুগুলোর ঘুমানোর জায়গা। অতঃপর আরেকটি স্থানে ইঙ্গিত করলেন এবং বললেন, এটা হলো তাদের নিহত হওয়ার জায়গা।
প্রথম রাবী (বর্ণনাকারী) র্হাছামাহ্ বলেন ঃ সিফফীনের যুদ্ধ শেষ হলো এবং আমি আমার বসবাসের এলাকায় ফিরে এলাম। কারবালা প্রান্তÍরে ইমাম (আঃ)-এর ঘটনার বিবরণ আমার স্ত্রীর নিকট বর্ণনা করলাম। আমার স্ত্রী ছিলেন ইমাম (আঃ)-এর ভক্ত। আমি তাঁকে বললাম, “ইমাম কীভাবে গায়েবের কথা অবগত হলেন?” আমার স্ত্রী বললেন, “আমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করো না, কেননা ইমাম সত্য বৈ বলেন না।”
এরপর অনেক দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো। ‘উবায়দুল্লাহ্ ইবনে যিয়াদ হুসাইন (আঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশাল সৈন্যদল প্রেরণ করে এবং আমি ঐ সৈন্যদলের মধ্যে ছিলাম। আমি যখন কারবালা প্রান্তÍরে পৌঁছলাম তখন ইমাম (আঃ)-এর সেই কথা আমার মনে পড়লো। আমি এ ঘটনার জন্য খুবই ব্যথিত হলাম। নিজের ঘোড়াকে হুসাইন (আঃ)-এর তাঁবুগুলোর দিকে ধাবিত করলাম এবং তাঁর সামনে উপস্থিত হলাম। তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললাম।
হুসাইন (আঃ) বললেন, “শেষ পর্যন্তÍ তুমি কি আমাদের সাথে রয়েছো, নাকি আমাদের বিরুদ্ধে?” বললাম, “কোনোটাই না। আমি নিজ পরিবারকে কূফায় রেখে এসেছি এবং ইবনে যিয়াদকে ভয় পাচ্ছি।”
তিনি বললেন, “যত শীঘ্র পারো এ প্রান্তÍর ত্যাগ করো। নচেৎ মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রাণ যে আল্লাহ্র হাতে তাঁর শপথ করে বলছি, যে কেউ আমাদের সাহায্যের আবেদন শুনবে কিন্তু আমাদেরকে সাহায্য না করবে আল্লাহ্ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষিপ্ত করবেন।”
কাজেই, তখনি আমি সে জায়গা থেকে সরে পড়লাম যাতে তাঁর শাহাদাতের দিবসকে না দেখি।১২
সাবাত্ব ও মাদায়েনে ইমাম (আঃ)
ইমাম (আঃ) সাবাত্বের উদ্দেশে কারবালা প্রান্তÍর ত্যাগ করলেন এবং বার্হ্র্সী উপশহরে এসে পৌঁছলেন। সেখানে পারস্য সম্রাট খসরুর কোনো চিহ্নই আর অবশিষ্ট ছিলো না। এ সময়ে হুর ইবনে সাহ্ম্১৩ নামক তাঁর একজন সঙ্গী আবু ইয়া‘ফুরের উপমামূলক কবিতা থেকে আবৃত্তি করলেন ঃ
حَرَّتِ الرِّياحُ عَلَي مَكَانِ دِيارِهِمْ فَكَأَنَّما كَانُوا عَلَي مِيعَادٍ
“প্রচ- ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেলো তাদের দেশের ওপর দিয়ে/ যেন তারা তাদের অঙ্গীকারের ওপর বহাল ছিলো।”
ইমাম (আঃ) বললেন, তুমি এই আয়াতটি তেলাওয়াত করলে না কেন?
كَمْ تَرَكُوْا مِنْ جَنَّاتٍ وَ عُيونٍ وَ زُروعٍ وَ مَقَامٍ كَرِيِمٍ وَ نِعْمَةٍ كَانُوا فِيهَا فَاكِِهيِنَ كَذَلِكَ وَ اَوْرَثْنَاهَا قَوْماً آخَرِينَ فَمَا بَكَتْ عَلَيهِمُ السَّمَاءُ وَ الْأرْضُ وَ مَا كَانُوا مُنْظِرِينَ.
“তারা ছেড়ে গিয়েছিলো কত বাগান ও ঝর্ণা এবং শস্যক্ষেত্র ও সুরম্য স্থান, আর কত সুখের উপকরণ যা তারা ভোগ করতো! এভাবেই হয়েছে এবং আমি তার উত্তরাধিকারী করেছি অন্য লোকদেরকে। অতঃপর তাদের জন্য আসমান ও যমীন ক্রন্দন করে নি এবং তারা কোনো অবকাশও পায় নি।” ১৪
অতঃপর ইমাম (আঃ) বললেন, “দ্বিতীয় দলটিও উত্তরাধিকারী ছিলো, কিন্তু তারাও চলে গেলো এবং অন্যরা তাদের উত্তরাধিকারী হলো। এ দলটিও যদি আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে তাহলে খোদায়ী নে’আমতসমূহ তাদের অকৃতজ্ঞতার কারণে তাদের নিকট থেকেও কেড়ে নেয়া হবে। নে‘আমতের অস্বীকার করা থেকে বিরত থাকো যাতে দুর্ভাগ্য তোমাদের ওপর নেমে না আসে।” অতঃপর তিনি সৈন্যদেরকে সেখানকার একটি উঁচু জায়গায় অবতরণের নির্দেশ দিলেন।
ইমাম (আঃ) যে এলাকায় অবতরণ করেছিলেন সেটা ছিলো মাদায়েনের নিকটবর্তী। ইমাম (আঃ) হারেছ আ‘ওয়ারকে নির্দেশ দিলেন যেন শহরে গিয়ে ঘোষণা করেন যে, যে ব্যক্তি যুদ্ধ করতে সক্ষম সে যেন আছরের নামাযের সময়ে আমীরুল মু’মিনীন (আঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়।
আছরের নামাযের সময় ঘনিয়ে এলো। সেখানকার সক্ষম লোকেরা ইমামের কাছে উপস্থিত হলো। ইমাম (আঃ) আল্লাহ্র প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বললেন ঃ
“আমি তোমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে পলায়ন করা, এলাকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং অত্যাচারী ও ধ্বংসপ্রাপ্ত লোকদের দেশে বসবাস করা দেখে বিস্মিত হচ্ছি। তোমরা না ভালো কাজের প্রতি নির্দেশ দিচ্ছো, আর না মন্দ থেকে বিরত রাখছো।”১৫
মাদায়েনের কৃষকরা বললো, “আমরা আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। আপনি যা পসন্দ করেন আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করুন।”
ইমাম (আঃ) ‘আদী ইবনে হাতেমকে সেখানে অবস্থান করার এবং তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সিফ্ফীনের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। ‘আদী তিন দিন অবস্থান করার পর তিনশ’ জন লোক সঙ্গে নিয়ে মাদায়েন ত্যাগ করেন, তবে স্বীয় পুত্র ইয়াযীদকে সেখানে অবস্থান করার এবং দ্বিতীয় আরেক দলকে সঙ্গে নিয়ে ইমাম (আঃ)-এর সাথে যোগ দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। পরে ইয়াযীদ বিন ‘আদী চারশ’ লোককে সঙ্গে নিয়ে ইমামের সাথে মিলিত হন।১৬
আম্বারের কৃষকদের পক্ষ থেকে ইমাম (আঃ)কে অভ্যর্থনা
ইমাম (আঃ) মাদায়েন ত্যাগ করে আম্বারের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। আম্বারের জনগণ ইমামের যাত্রা সম্পর্কে এবং আম্বারের ওপর দিয়ে তাঁর যাওয়ার সিদ্ধান্তেÍর ব্যাপারে সংবাদ পেলো এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ছুটে এলো। এ অভ্যর্থনাকালে তাদের ও ইমাম (আঃ)-এর মাঝে বিভিন্ন কথাবার্তা হয়।
তারা যখন ইমাম (আঃ)-এর সামনে এলো তখন নিজ নিজ ঘোড়া থেকে অবতরণ করে এবং তাঁর সামনে পরম ভক্তি, বিনয় ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনার্থে মাটিতে হামাগুড়ি দিতে লাগলো।
ইমাম (আঃ) বললেন, “তোমরা এটা কী করছো? আর এই চতুপদ জন্তুগুলোকে কীজন্য নিয়ে এসেছো?”
তারা বললো, “এটা হলো (পারসিক সম্রাটদের আমল থেকে চলে আসা) আমাদের সম্মানিত ও মুরুব্বীজনদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পদ্ধতি। আর এই জন্তুগুলো আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে উপহার। আমরা আপনার জন্য এবং আপনার সৈন্যদলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আর আপনাদের জন্তুগুলোর জন্য ঘাস যোগাড় করেছি।”
ইমাম (আঃ) বললেন, “তোমরা যেটাকে তোমাদের সম্মানিত ও মুরুব্বীজনদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের রীতি বলে মনে করছো, আল্লাহ্র শপথ, এ কাজ তাদের কোনো উপকারে আসবে না। তোমরা বরং এ কাজের মাধ্যমে নিজেকে কষ্ট ও পরিশ্রমের মধ্যে ফেলে দিচ্ছো। এ কাজ আর করবে না। তোমরা যে পশুগুলোকে সাথে করে নিয়ে এসেছো, তোমরা সন্তুষ্ট থাকলে সেগুলোকে গ্রহণ করতে পারি। তবে শর্ত হলো, তা খারাজ ও করের মধ্যে গণ্য হবে। আর আমাদের জন্য যে খাবারের ব্যবস্থা করেছো তা একটি শর্তে গ্রহণ করতে পারি, তা হলো তার মূল্য পরিশোধ করে দেবো।”
আম্বারের লোকজন বললো, “আপনি গ্রহণ করুন। আমরা মূল্য নিরূপণ করবো, অতঃপর তার মূল্য গ্রহণ করবো।”
ইমাম (আঃ) বললেন, “সে ক্ষেত্রে তোমরা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য ধার্য করবে।”
আম্বারের লোকজন বললো, “হে ইমাম! আরব জনগণের মধ্যে আমাদের অনেক পরিচিত ও বন্ধুজন রয়েছে। আপনি কি আমাদেরকে তাদের কিছু উপহার দেওয়া থেকে এবং তাদেরকে সে উপহার গ্রহণ করা থেকে বাধা দিচ্ছেন?”
ইমাম বললেন, “সকল আরবই তোমাদের বন্ধু। কিন্তু সবাই তোমাদের এই ভারী উপহারাদি গ্রহণ করার উপযুক্ত নয়। আর কেউ যদি তোমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয় তাহলে আমাকে জানাবে।”
আম্বারের লোকজন বললো, “হে ইমাম! আমাদের উপহার গ্রহণ করুন। আমরা চাই, আপনি আমাদের উপহার গ্রহণ করবেন।”
ইমাম বললেন, “আফসোস তোমাদের জন্যে। আমরা তোমাদের মুখাপেক্ষী নই।” এ কথা বলেই তিনি পথ চলা শুরু করলেন এবং যারা বছরের পর বছর অনারব সম্রাটদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়েছে ও সর্বদা তাদের কষ্টের উপার্জনে তাদের সে শাসকদের রুযী যুগিয়ে এসেছে, তাদেরকে আল্লাহ্র ন্যায়পরায়ণতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলেন।১৭
ইমাম (আঃ) চলার পথে যখন আল-জাযিরায় পৌঁছলেন তখন তাগ¦লিব্ ও নাম্র্ গোত্রের লোকজন তাঁকে অভ্যর্থনা জানালো।
ইমাম (আঃ) কেবল তাঁর একজন সেনাপতি ইয়াযীদ বিন্ ক্বায়স্কে তাদের খাবার গ্রহণ করার অনুমতি প্রদান করলেন। কারণ, তিনি ঐ গোত্রের লোক ছিলেন।
অতঃপর ইমাম (আঃ) রিক্কাহ্ ভূখ-ে পৌঁছলেন এবং ফোরাতের তীরে অবতরণ করলেন। সেখানে এক আস্তানায় জনৈক পাদ্রী বসবাস করতেন। তিনি ইমাম (আঃ)-এর আগমনের খবর জানতে পেরে তাঁর সাক্ষাতে উপস্থিত হলেন এবং বললেন, “বাপ-দাদাদের উত্তরাধিকার হিসেবে একটি ছহীফাহ্ আমার হাতে এসে পৌঁছেছে। ঈসা মসীহ (আঃ)-এর ছাহাবীগণ সেটা লিখেছেন। আমি সেটি এনেছি আপনাকে পাঠ করে শোনাবো বলে। অতঃপর তিনি তা থেকে পাঠ করতে লাগলেন ঃ
“পরম করুণাময় অনন্তÍ দাতা আল্লাহ্র নামে Ñ যে আল্লাহ্ অতীতে নির্ধারণ করে রেখেছেন যে, অজ্ঞ লোকজনের মধ্যে একজন পয়গাম্বর প্রেরণ করবেন। তিনি তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দান করবেন এবং আল্লাহ্র রাস্তায় হেদায়াত করবেন, আর বাজারসমূহে একত্ববাদের বার্তা প্রচার করবেন এবং খারাপকে খারাপ দ্বারা শাস্তি দেবেন না, বরং ক্ষমা করবেন। তাঁর অনুসারীরা আল্লাহ্র প্রশংসাকারী। তারা যেকোনো উঁচু স্থানেই থাকুক কিম্বা যেকোনো নিচু স্থানেই গমন করুক সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র প্রশংসা করবে। তাদের জিহ্বাসমূহ তাক্বীর ও তাহ্লীল পাঠে ব্যস্ত থাকে। আল্লাহ্ তাঁকে শত্রুদের ওপর বিজয়ী করবেন। অতঃপর যখন আল্লাহ্ তাঁকে তুলে নেবেন তখন তাঁর উম্মত দুই ভাগে বিভক্ত হবে, কিন্তু পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে এবং কিছুকাল এভাবে থাকবে। তারা পুনরায় দুই দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। তাঁর উম্মাতের মধ্য থেকে একজন পুরুষ এই ফোরাতের তীর দিয়ে অতিক্রম করে যাবে। এ হলো এমন পুরুষ যে ভালোসমূহের প্রতি নির্দেশ প্রদান করে এবং খারাপ সমূহ থেকে বাধা দেয়, সঠিক ও ন্যায্য বিচার করে এবং বিচারকার্যে উৎকোচ ও পারিশ্রমিক গ্রহণ করে না। দুনিয়া তার কাছে বাতাসে উড়ে যাওয়া ছাইয়ের চেয়েও মূল্যহীন, আর মৃত্যু তার কাছে পিপাসার্ত ব্যক্তির পানির পেয়ালা পান করার চেয়েও সুধাময়। সে নির্জনে আল্লাহ্কে ভয় করে আর লোকালয়ে তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ থাকে। সে আল্লাহ্র নির্দেশ বাস্তবায়নে ভর্ৎসনাকারীদের ভর্ৎসনা থেকে ভয় পায় না। এ এলাকার যে ব্যক্তি উক্ত পয়গাম্বরকে দেখবে এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনবে তার পুরস্কার হলো আমার সন্তুষ্টি ও বেহেশত লাভ। আর যে ব্যক্তি উক্ত ছালেহ্ বান্দাহ্কে দেখবে এবং তাকে সাহায্য করবে ও তাঁর পথে নিহত হবে সে শাহাদাত লাভ করবে.....।”
পাদ্রী ছহীফাহ্ পাঠ শেষ করে বললেন, “আমি এখন থেকেই আপনার সেবায় নিয়োজিত হলাম এবং আপনার থেকে বিচ্ছিন্ন হবো না, যাতে আপনার প্রতি যা পৌঁছে, আমার জন্যেও তা পৌঁছে।”
ইমাম (আঃ) এ অবস্থা দেখে ক্রন্দন করলেন এবং বললেন, “আল্লাহ্র প্রশংসা যিনি আমাকে ভুলে যাওয়াদের মধ্যে অন্তÍর্ভুক্ত করেন নি। প্রশংসা আল্লাহ্র যিনি নেককারদের কিতাবে আমাকে স্মরণ করেছেন।”
উক্ত পাদ্রী সে সময় থেকে সর্বদা ইমাম (আঃ)-এর সঙ্গে ছিলেন, অবশেষে সিফ্ফীন যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম (আঃ) তাঁর নামাযে জানাযা পড়েন ও তাঁকে দাফন করেন এবং বলেন ঃهَذَا مِنَّا اَهْلِ الْبَيتِ “এ ব্যক্তি আমাদের আহ্লে বাইত থেকে।” আর এরপর থেকে তিনি বারংবার তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।১৮
রিক্কাহ্ ভূখ-ে ইমাম (আঃ)
ইমাম (আঃ) মাদায়েন থেকে নিজে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে মা‘ক্বাল্ ইবনে ক্বায়স্-এর নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যর একটি দলকে রিক্কাহ্ অভিমুখে প্রেরণ করেন।১৯ তিনি তাঁকে যাত্রাপথে প্রথমে মুছেল্ ও তারপর নাসীবাঈন্ হয়ে যাবার এবং এরপর রিক্কায় অবতরণ করে সেখানে ইমাম (আঃ)-এর সাথে মিলিত হবার জন্য নির্দেশ দেন। ইমাম (আঃ) নিজে অন্য এক পথে রিক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন।
ধারণা করা হয়, মা‘ক্বাল্ ইবনে ক্বায়স্-এর দলটিকে ঐ পথ দিয়ে যেতে বলার পিছনে ইমাম(আঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিলো ঐ অঞ্চলে বিদ্যমান স্বীয় শাসনব্যবস্থাকে মযবুত করা। এ কারণে তিনি সেনাপতিকে কারো সাথে যুদ্ধ না করতে এবং চলার পথে সেখানকার জনগণের সাথে আশা ও শান্তিÍর কথা বলতে, আর সকালে ও বিকালে পথ চলতে এবং মধ্যাহ্ন ও রাতের প্রথম ভাগে বিশ্রাম গ্রহণ করতে২০ আর নিজেকে ও নিজের অধীন সৈন্যদল ও বাহনগুলোকে আরাম ও নিরাপত্তা প্রদান করতে নির্দেশ দেন।
সেনাপতি পুরো পথটাকে ইমাম (আঃ)-এর নির্দেশ মাফিক অতিক্রম করেন। তিনি যখন রিক্কায় প্রবেশ করেন তার আগেই ইমাম (আঃ) সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন।২১
রিক্কাহ্ থেকে মু’আবিয়ার কাছে পত্র প্রেরণ
ইমাম (আঃ)-এর সঙ্গীরা কল্যাণকর মনে করলেন যে, ইমাম (আঃ) মু‘আবিয়ার কাছে একটি পত্র লিখে পাঠান এবং পুনরায় তার কাছে চরমপত্র ঘোষণা করুন। ইমাম (আঃ) তাঁদের প্রস্তাবকে গ্রহণ করলেন।২২ কারণ তিনি মু‘আবিয়ার অবাধ্যতাকে কোনোরূপ রক্তপাত ব্যতিরেকে দমন করতে আগ্রহী ছিলেন, যদিও তিনি জানতেন যে, উপদেশ ও নছিহত ক্ষমতালিপ্সুদের কোনো সুফল দেয় না। ইমাম (আঃ)-এর পত্র মু‘আবিয়ার কাছে পৌঁছলে উত্তরে তিনি ইমামকে যুদ্ধের হুমকি দিলেন।২৩ এ কারণে ইমাম (আঃ) স্বীয় সিদ্ধান্তেÍ আরো দৃঢ় হলেন এবং রিক্কাহ্ থেকে সিফ্ফীন অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ জারী করলেন।
সাঁকো নির্মাণ করে ফোরাত অতিক্রম
ইমাম (আঃ)-এর জন্য একটি সমস্যা ছিলো প্রশস্ত ফোরাত নদী পার হওয়া। কোনো সাঁকো নির্মাণ ছাড়া কিংবা নৌকার সাথে নৌকা জুড়ে ছাড়া তা অতিক্রম করা সম্ভব ছিলো না। ইমাম (আঃ) রিক্কার জনগণকে তাঁর ও তাঁর সৈন্যদলের ফোরাত অতিক্রম করার জন্য বন্দোবস্ত করতে বললেন। কিন্তু এ সীমান্তÍ শহরের জনগণ ইরাকের জনগণের বিপরীতে আলী (আঃ)-এর প্রতি নির্দয় ছিলো। তারা সাঁকো তৈরী করতে বিরত থাকে। ইমাম (আঃ) ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের অস্বীকৃতির বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। তিনি সিদ্ধান্তÍ নিলেন স্বীয় সৈন্যদলকে নিয়ে মাম্বেজ্ নামক একটি দূরবর্তী স্থানে যে সাঁকো নির্মিত ছিলো তার ওপর দিয়ে পার হবেন।
এ সময় মালেক আর্শ্তা গর্জে উঠলেন এবং তারা যে দুর্গের মধ্যে আস্তানা করে ছিলো সেটাকে ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দিলেন। রিক্কার বাসিন্দারা তখন পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো ঃ “মালেক হলো সেই ব্যক্তি যে, যা বলে তা-ই করে।” এ কারণে তারা তৎক্ষণাৎ সাঁকো নির্মাণে তাদের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করলো এবং ইমাম (আঃ) ও তাঁর পদাতিক বাহিনী তাঁদের মালামালসহ উক্ত সাঁকো দিয়ে পার হলেন। সবশেষে যে ব্যক্তি ঐ এলাকা ত্যাগ করেন তিনি ছিলেন মালেক আর্শ্তা।২৪
শামে ইমাম (আঃ)
ইমাম (আঃ) ফোরাত অতিক্রম করে ইরাককে পিছনে ফেলে শামের মাটিতে পা রাখলেন। মু‘আবিয়ার যে কোনো অতর্কিত আক্রমণ কিম্বা কূটকৌশলের ফাঁদ থেকে রক্ষার জন্য তিনি যেভাবে কূফায় প্রবেশ করেছিলেন সে পদ্ধতিতেই যিয়াদ ইবনে নাছ্র ও শারীহ্ ইবনে হানী নামক দুইজন বলিষ্ঠ সেনাপতিকে অগ্রসেনা হিসেবে মু‘আবিয়ার বাহিনীর দিকে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা দুজন ‘সুর্রু রূম’ নামক স্থানে আবুল আ‘ওয়ারের নেতৃত্বে মু‘আবিয়ার অগ্রসেনাদলের সাথে মুখোমুখি হন এবং শত্রুবাহিনীর সেনাপতিকে শান্তিÍপূর্ণভাবে ইমাম (আঃ)-এর অনুগত করার চেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁদের চেষ্টা সফল হয় নি। তাঁরা দ্রুতগামী পত্রবাহক হারেছ ইবনে জাম্হান জুফী-র মাধ্যমে ইমাম (আঃ)-এর কাছে একটি পত্র লিখে পাঠান। পত্রে বৃত্তান্তÍ জানানোর পর তাঁরা ইমাম (আঃ)-এর পরবর্তী নির্দেশ জানতে চাইলেন।২৫
ইমাম (আঃ) পত্র পাঠ করার পর তক্ষুনি মালেককে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁকে বললেন, “যিয়াদ ও শারীহ্ এইসব লিখে জানিয়েছে। তুমি যত শীঘ্র সম্ভব নিজেকে তাদের কাছে পৌঁছাও এবং উভয় দলের পৃষ্ঠপোষকতা নিজের হাতে তুলে নাও। কিন্তু যতক্ষণ শত্রুর সাক্ষাত না পাও এবং তাদের কথা না শোনো ততক্ষণ যুদ্ধ শুরু করবে না, যদি না তারা যুদ্ধ শুরু করে দেয়। শত্রুর প্রতি তোমার রাগ ও ক্রোধ যেন তোমাকে আগেভাগে যুদ্ধে ব্যস্ত না করে। বরং বার বার তাদের কথা শুনবে এবং সকল যুক্তি-প্রমাণ তাদের সামনে স্পষ্ট করবে।” অতঃপর তিনি নির্দেশ দিলেন, “যিয়াদকে রণাঙ্গনের ডান দিকের এবং শারীহ্কে বাম দিকের সেনাপতি নিয়োগ করবে। আর তুমি নিজে সৈন্যদের মাঝখানে অবস্থান করবে। শত্রুর এতো কাছে যেয়ো না যে, তারা ভাববে যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে উদ্যত হয়েছো, আবার এতো দূরে থেকো না যে, তারা ধারণা করবে তোমরা শত্রু থেকে ভয় পাও। এই কৌশলে তুমি সেখানে পরিচালনা করতে থাকো যতক্ষণ না আমি এসে পৌঁছি।”২৬
অতঃপর ইমাম (আঃ) দুই সেনাপতির পত্রের উত্তরে মালেকের প্রশংসায় লিখে পাঠালেন ঃ
اَمَّا بَعْدُ؛ فَإِنِّي قَدْ اَمَّرْتُ عَلَيكُمَا مَالِكاً فَاسْمَعَا لَهُ و أطِيعا اَمْرَهُ فَاِنَّهُ مِمَّنْ لاَ يخَافُ رَهْقُهُ وَ لاَ سِِقَاطُهُ وَلاَ بُطْؤُهُ عَنْ مَا الْإسرَاعُ اِلَيهِ اَحْزَمُ وَ لاَ إِسْرَاعُهُ اِلَي مَا الْبُطْءُ عَنْهُ اَمْثَلُ وَ قَدْ اَمَرْتُهُ بِِمِِثْل الَّذِِي اَمَرْتُكُمَا الّا يَبْدَأُ الْقَوْمَ بِقِتَالٍ حَتّيٰ يَلْقَاهُمْ فَيَدْعُوهُمْ وَ يُعَذِّرُ إِلَيهِمْ اِنْ شَاءَ اللهُ.
“পর সমাচার, আমি তোমাদের উভয়ের ওপরে মালেককে সেনাসর্বাধিনায়ক নিয়োগ করেছি। তার কথা মেনে চলো এবং তার নির্দেশের আনুগত্য করো। কেননা, সে এমন কোনো ব্যক্তি নয় যে, তার কোনো বুদ্ধির ভুল এবং বিচ্যুতির আশঙ্কা করা যায়। আর সে এমন কেউ নয় যে, দ্রুততার জায়গায় বিলম্ব করবে কিম্বা ধৈর্যের জায়গায় তড়িঘড়ি করবে। আমি তোমাদেরকে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তাকেও সেই নির্দেশ দিয়েছি। তা হলো, কখনোই শত্রুর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ো না যতক্ষণ না তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের প্রতি আহ্বান জানাবে এবং তাদের ওপর যুক্তি-প্রমাণ পুরাপুরিভাবে স্পষ্ট করবে, ইনশাআল্লাহ্।”২৭
মালেক দ্রুতবেগে নিজেকে সে স্থানে পৌঁছালেন যেখানে দুই পক্ষের সৈন্যরা মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। তিনি প্রথমে সৈন্যদেরকে সুশৃঙ্খল করলেন। অতঃপর শুধু সৈন্যদের আত্মরক্ষা ছাড়া কোনো দিকেই মন দিলেন না। যখনই শামের সেনাপতি আবুল আ‘ওয়ার-এর পক্ষ থেকে কোনো আক্রমণ পরিচালিত হতো তখন তা প্রতিহত করা হতো। আশ্চর্যের বিষয় যে, মালেক এমনকি শত্রুর সেনাপতির মাধ্যমেও মু‘আবিয়াকে বার্তা পাঠান যে, যদি যুদ্ধই চান তাহলে যেন সশরীরে ময়দানে হাযির হোন যাতে পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয় এবং অন্যদের রক্তপাতের কারণ না ঘটে। কিন্তু মু‘আবিয়াহ্ কখনোই এতে সাড়া দেন নি। এভাবে কিছুদিন চলার পর কোনো এক মধ্যরাতে মু‘আবিয়ার সৈন্যরা দ্রুত পশ্চাদপসরণ করে ও ফোরাতের এক বিস্তীর্ণ তীরভূমিতে অবতরণ করে এবং ইমাম (আঃ)-এর অগ্রবর্তী সেনাদের জন্য পানি বন্ধ করে দেয়।২৮
মু‘আবিয়ার সিফ্ফীন যাত্রা
মু‘আবিয়ার কাছে খবর পৌঁছলো যে, আলী (আঃ) রিক্কায় ফোরাতের ওপর সাঁকো তৈরী করে নিজে এবং তাঁর সৈন্যদল তার ওপর দিয়ে পার হয়ে এসেছেন। মু‘আবিয়াহ্ যেহেতু পূর্ব থেকেই শামের জনগণকে নিজের পক্ষে নিয়ে রেখেছিলেন কাজেই মিম্বারে উঠে শামের জনগণের কাছে ইমাম (আঃ)-এর কূফাহ্ ও বছ্রার লোকজনদের সাথে নিয়ে যুদ্ধ করতে রওয়ানা হওয়ার কথা জানালেন। আর তাদেরকে নিজের ও সন্তÍান-সন্তÍতিদের জান-মাল রক্ষায় আগের চেয়ে বেশি উৎসাহ ও উস্কানি দিলেন। মু‘আবিয়ার ভাষণের পর তাঁকে সমর্থনের জন্য পূর্ব থেকে প্রস্তুত করে রাখা লোকেরা তাঁকে সমর্থন করলো।
অবশেষে মু‘আবিয়াহ্ যুদ্ধে সক্ষম সকল লোকজনকে সাথে নিয়ে সিফ্ফীনের পথে রওয়ানা হলেন২৯ এবং আবুল আ‘ওয়ারের নেতৃত্বাধীন তাঁর অগ্রবর্তী সেনাদলের পেছন ভাগে এসে অবতরণ করলেন। সেখানেই তিনি তাঁবু গাড়লেন এবং এক বর্ণনামতে, তিনি ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদেরকে ফোরাত থেকে পানি নিতে বাধা দেয়ার জন্য চল্লিশ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেন ।৩০
ইমাম (আঃ)-এর ছিফ্ফীনে প্রবেশ
কিছু সময় যেতে না যেতে ইমাম (আঃ)ও বিশাল বাহিনী নিয়ে ছিফ্ফীনে প্রবেশ করেন এবং মালেক আশ্তারের নেতৃত্বাধীন তাঁর সৈন্যদলের সাথে যোগ দেন। ইমাম (আঃ) এমন সময় ছিফ্ফীনে পা রাখলেন যখন শত্রুরা তাঁর সৈন্যদের ও ফোরাতের পানির মাঝে বিশাল বাহিনী মোতায়েন করে রেখেছিলো এবং ইমামের বাহিনীর জন্য ফোরাতের পানির নাগাল পাওয়া অসম্ভব করে তুলেছিলো।
আবদুল্লাহ্ ইবনে ‘আওফ্ বলেন, ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের পানির সংগ্রহ ফুরিয়ে আসছিলো। অপর দিকে মু‘আবিয়ার অগ্রবর্তী বাহিনীর সেনাপতি আবুল আ‘ওয়ার পদাতিক ও অশ্বরোহী বাহিনী দ্বারা পানির পথ বন্ধ করে রেখেছিলো। আর তাদের সামনে তীরন্দায বাহিনী এবং তাদের পাশে বর্শাধারী ও বর্ম পরিহিত বাহিনীকে মোতায়েন করে রেখেছিলো। অবশেষে ইমাম (আঃ)-এর বাহিনী পিপাসাক্লিষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাঁর কাছে এ অভিযোগ পৌঁছে যায়।৩১
ইমাম (আঃ)-এর সহিষ্ণুতা
এরূপ পরিস্থিতিতে যে কোনো সাধারণ সেনাপতি ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে এবং আক্রমণ করার নির্দেশ প্রদান করে থাকে। কিন্তুপ্রথম দিন থেকেই ইমাম (আঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিলো সম্ভব হলে কোনো রক্তপাত ছাড়াই সমস্যাটির নিষ্পত্তি করা। তিনি ছা‘ছা‘ ইবনে ছূহান৩২ নামক তাঁর এক বিশ্বাসভাজন সহযোগীকে ডাকলেন এবং তাঁকে দূত হিসেবে এ বার্তা নিয়ে মু‘আবিয়ার কাছে পাঠালেন ঃ
“আমরা এ এলাকায় এসেছি ; সকল যুক্তি-প্রমাণের কথা শেষ না করে যুদ্ধ শুরু করার আমাদের ইচ্ছা নেই। তুমি তোমার সর্বশক্তি নিয়ে শাম থেকে এসেছো। আর আমরা তোমার সাথে যুদ্ধ করার আগেই তুমি লড়াই শুরু করে দিয়েছো। আমাদের কথা হলো, তুমি যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নাও এবং আমাদের যুক্তি-প্রমাণগুলো শোনো। এটা কোন্ ধরনের কাপুরুষোচিত কৌশল যে, তুমি আমাদের জন্য পানি বন্ধ করে দিয়েছো? প্রতিবন্ধকতাগুলোকে দূরে সরিয়ে দাও যাতে আমাদের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে পারো। আর যদি চাও অবস্থা এভাবেই চলতে থাকুক এবং লোকজন পানি নিয়ে পরস্পর যুদ্ধ করুক এবং শেষ পর্যন্তÍ বিজয়ী দলই পানি ব্যবহার করুক, তাহলে আমাদের কোনো কথা নেই।”
ছা‘ছা‘ ইমাম (আঃ)-এর দূত হিসেবে সৈন্যদের মধ্যভাগে অবস্থিত মু‘আবিয়ার তাঁবুতে প্রবেশ করলেন এবং ইমাম (আঃ)-এর বার্তা তাঁকে পৌঁছে দিলেন। ওয়ালীদ ইবনে ‘উক্বাহ্র ন্যায় পাষাণ হৃদয় লোকগুলো ফোরাতের পানি অবরোধ করে রাখার পক্ষে ছিলো, যাতে ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যরা পিপাসায় মারা যায়। কিন্তু রাজনীতিতে পোড় খাওয়া ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ বানূ উমাইয়্যাহ্র মতের বিপরীতে মু‘আবিয়াকে বললেন, “সৈন্যদের জন্য পানি ছেড়ে দিন এবং যুদ্ধের অন্যান্য বিষয় নিয়ে চিন্তÍা করুন।”
অন্য এক বর্ণনামতে, ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ বলেন, “আলীর অধীনে যখন এমন সৈন্যরা রয়েছে যারা ফোরাতের পানির দিকে তাকিয়ে রয়েছে তখন এটা কখনো হতে পারে না যে, আপনি পরিতৃপ্ত থাকবেন আর আলী পিপাসার্ত থাকবেন। শেষ পর্যন্তÍ হয় তারা তা দখল করে নেবে, না হয় এ পথে মৃত্যুবরণ করবে। আপনি জানেন যে, আলী হলেন আক্রমণকরী সাহসী পুরুষ। আর ইরাক ও হেজাযের লোকজন তাঁর সাথে রয়েছে। আলী হলেন সেই পুরুষ যিনি ফাতেমাহ্র গৃহে আক্রান্ত হওয়ার দিন বলেছিলেন, যদি চল্লিশ জন পুরুষ আমার সাথে থাকতো তাহলে আক্রমণকারীদের থেকে আমি প্রতিশোধ গ্রহণ করতাম।”
এদিকে মু‘আবিয়াহ্ আলী (আঃ)-এর সৈন্যদের ওপর পানি বন্ধ করে দেয়াকে যখন তাঁর প্রথম বিজয় বলে মনে করছিলোন তখন ‘আবেদ হাম্দানী নামক ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের জনৈক বন্ধু Ñ যিনি বাগ্মিতায়ও পারদর্শী ছিলেন Ñ মু‘আবিয়াকে বললেন, “সুব্হানাল্লাহ্! আপনি ইরাকী বাহিনীর আগে এখানে পৌঁছে গেছেন বলে তাদের ওপর পানি বন্ধ করে দেবেন Ñ এটা হতে পারে না। আল্লাহ্র শপথ, তারা যদি আপনাদের আগে এখানে পৌঁছে যেতো তাহলে আপনাদের ওপর পানি বন্ধ করে দিতো না। খুব বড় যে কাজটি করতে পারেন তা হলো সাময়িকভাবে তাদের জন্য ফোরাতের পানি বন্ধ করে রাখবেন, কিন্তু অন্য কোনো সুযোগের জন্য প্রস্তুত হোন। তারাও আপনাদের এভাবে শাস্তি দেবে। এটা কি জানেন না যে, তাদের মধ্যে ক্রীতদাস, ক্রীতদাসী, শ্রমিক ও নিরপরাধ অক্ষম লোকেরা রয়েছে? আল্লাহ্র শপথ, আপনাদের এ কাজটি প্রথম অন্যায় ও অবিচার। হে মু‘আবিয়াহ্! আপনি এ নোংরা কাজের দ্বারা ভীতু ও দ্বিধাগ্রস্ত লোকদের চোখ খুলে দিয়েছেন। আর যে ব্যক্তি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার চিন্তÍায় ছিলো না তাকে উস্কে দিয়েছেন।”৩৩
অন্যান্য অনেক সময়ের বিপরীতে মুা‘আবিয়াহ্ প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখে ধৈর্য ধরার পরিবর্তে ‘আবেদ হাম্দানীর ওপরে গর্জে উঠলেন এবং ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ও তাঁর সাথে যে বন্ধুত্ব ছিলো সে কারণে তাঁর ওপর ক্রুদ্ধ হলেন। কিন্তু সৌভাগ্য এই ধার্মিকেরই কপালে জুটে গলো; তিনি মু‘আবিয়ার সৈন্যদের পরিণাম অমানিশার অন্ধকারের মতো লক্ষ্য করে রাতারাতি ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদলে এসে যোগ দিলেন।
আক্রমণ ও অবরোধ ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ জারী
পানির অভাব ও পিপাসা ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালো। তাই ইমাম (আঃ) দুঃশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়লেন। তিনি যখন তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যকার মায্হেজ্ গোত্রের পতাকার নিকটবর্তী হলেন তখন একজন সৈন্যকে ক্বাছিদাহ্র মধ্যে এরূপ বলতে শুনলেন ঃ
أَيَمنَعُنَا الْقَوْمُ مَاءَ الْفُرَاتِ وَ فِينَا الرِّمَاحُ وَ فِينَا الْحُجْفُ
“শামের লোকেরা কি আমাদের ওপর পানি বন্ধ করে দেয়/ যখন আমরা বর্শা ও লৌহবর্মে সজ্জিত?”৩৪
অতঃপর ইমাম (আঃ) কিন্দাহ্ গোত্রের পতাকার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং দেখলেন উক্ত গোত্রের সেনাপতি আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়সের তাঁবুর পাশে জনৈক সৈন্য কবিতা আবৃত্তি করছে। কবিতাটির প্রথম দু’টি পঙ্ক্তি এই ঃ
لَئِنْ لَمْ يُجِلُّ الْأشْعَثُ الْيوْمَ كَرْبَةً مِنَ الْمَوْتِ فِيهَا لِلْنُّفُوسِ تَعَنُّتٌ
فَنَشْرَبُ مِنْ مـَاءِ الْفُرَاتِ بِسَيفِهِ فهَـبْنَا أُنَاساً قَبْلُ كَانُوا فَمَوِّتُوا
“আজ যদি আশ্‘আছ্ নির্যাতন ও নিপীড়নে নিমজ্জিত মানুষদের মৃত্যুর দুঃখকে দূর করে না দেয় তাহলে আমরা তার তলোয়ার দ্বারা ফোরাতের পানি পান করবো। কতো না ভালো হয়, হে আশ্‘আছ্ যদি এ ধরনের লোকদেরকে আমাদেরকে দাও যারা আগে ছিলো এবং এখন মৃত্যুবরণ করছে।”৩৫
সৈন্যটি স্বীয় শিবিরের নিকটে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে এ কবিতা আবৃত্তি করছিলো। ইমাম (আঃ) সৈনটির কবিতা আবৃত্তি শোনার পর নিজের তাঁবুতে ফিরে এলেন। হঠাৎ আশ্‘আছ্ এসে পৌঁছলো এবং বললো, “এটা কি সঠিক কাজ যে, শামের লোকেরা আমাদের জন্য ফোরাতের পানি বন্ধ করে রাখবে অথচ আপনি আমাদের মাঝে রয়েছেন আর আমাদের তলোয়াগুলো আমাদেরই হাতে? আপনি অনুমতি দিন। আল্লাহ্র শপথ, হয় ফোরাতের অবরোধ ভেঙ্গে ফেলবো, না হয় এ পথে মৃত্যুবরণ করবো। আপনি মালেক আশ্তারকে নির্দেশ প্রদান করুন আপনি যেখানেই বলবেন স্বীয় সৈন্যদেরকে নিয়ে সেখানেই যেন দাঁড়িয়ে থাকে।”
ইমাম (আঃ) বললেন, “তোমাদের স্বাধীনতা তোমাদের হাতে।” অতঃপর তিনি মালেক আশ্তার স্বীয় সৈন্যদেরকে নিয়ে যেখানে অবস্থান গ্রহণ করবেন তা নির্ধারণ করে দিলেন। তারপর স্বীয় বিশাল সৈন্যদলের মাঝে ছোট একটি ভাষণ দিলেন। এ ভাষণটি এতই অগ্নিঝরা ও অনুপ্রেরণাদায়ক ছিলো যে, ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যরা বিদ্যুৎ বেগে আক্রমণ চালিয়ে মু‘আবিয়ার সৈন্যদেরকে হটিয়ে দিতে এবং ফোরাতের কূল দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ভাষণটি ছিলো এই ঃ
قَدِ اسْتَطْعَمُوكُمُ الْقِتَالَ فَأَقِِرُّوا عَلَي مَذَلََّةٍٍ وَ تَأْخيِرِ مَحَلَّةٍ اَوْ رَوُّوا السُّيُوفَ مِنَ الدِّمَاءِ تَرْوَوْا مِنَ الْمَاءِ فَاْلْمُوْتُ فِي حَياتِكُُمْ مَقهُورِينَ وَ الْحَياةُ فِي مَوْتِكُمْ قَاهِرِينَ. ألاَ وَ إِنَّ مُعَاوِيةَ قَادَ لُمْةً مِنَ الْغُواةِ وَ عَمَّسَ عَلَيهِمُ الْخَبَرَ حَتّيٰ جَعَلُوا نُحُورَهُمْ اَغْراضَ الْمَنِيّةِ.
“মু‘আবিয়ার বাহিনী এ কাজের মাধ্যমে তোমাদেরকে যুদ্ধের দিকে আহ্বান করেছে। এখন তোমরা দুই রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে আছো ঃ হয় অপমানের গ্লানি নিয়ে স্ব-স্থানে বসে থাকবে, না হয় তলোয়ারগুলোকে রক্ত দ্বারা পরিতৃপ্ত করবে যাতে তোমরাও পানি দ্বারা পরিতৃপ্ত হতে পারো। তোমাদের জীবনে পরাজয়ই মৃত্যু, আর মৃত্যুতে জীবন হলো তোমাদের জন্য বিজয়। জেনে রাখো যে, মু‘আবিয়াহ্ একদল বেখবর পথভ্রষ্ট লোকদেরকে সাথে করে এনেছে। তাদের কাছে সে সত্যকে পর্দার আড়াল করে রেখেছে যাতে অজ্ঞদল তাদের গর্দানগুলোকে তীর ও বর্শার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে।”৩৬
আশ্‘আছ্ ঐ রাতেই স্বীয় অধীন সৈন্যদেরকে ডেকে বললো, “যে কেউ পানি চায় কিম্বা মৃত্যু, তার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুত সময় হলো ভোরবেলা।”৩৭
একদিকে পিপাসার চাপ অপর দিকে ইমাম (আঃ)-এর শাণিত ভাষণ এবং সৈন্যদের অনুপ্রেরণামূলক কবিতা ইত্যাদির কারণে তখনই ১২ হাজার সৈন্য ফোরাতকূল মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হলো। আশ্‘আছ্ তাঁর বৃহত্তর সৈন্যদল নিয়ে আর আর্শ্তা তাঁর শক্তিশালী অশ্ববাহিনী নিয়ে শত্রু সেনাদের মোকাবেলায় দাঁড়িয়ে গেলেন এবং এক নিমিষেই বিদ্যুৎবেগে আক্রমণ চালিয়ে তাদের চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী শত্রুর প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করে ফোরাতকূলে এতদূর পর্যন্তÍ পৌঁছে গেলেন যে, ঘোড়াগুলোর পা ফোরাতের পানিতে ভিজে যেতে থাকে। এ আক্রমণে আশ্তারের হাতে সাত জন আর আশ্‘আছের হাতে পাঁচ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়।
যুদ্ধের ফলাফল ইমাম (আঃ)-এর অনুকূলে এসে যায় এবং বিশাল ফোরাত নদী ইমাম (আঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তখন ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ মুআবিয়াকে বললেন, “এখন যদি আলী অনুরূপ বদলা গ্রহণ করেন এবং ফোরাতের পানি আপনার জন্য বন্ধ করে দেন তাহলে কী করবেন?”
মু‘আবিয়াহ্ যেহেতু ইমাম (আঃ)-এর মহানুভবতা ও আত্মিক ও ইসলামী নৈতিকতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কাজেই বললেন, “আমার মনে হয় সে আমাদের ওপর পানি বন্ধ করবে না। কেননা, সে এসেছে অন্য উদ্দেশ্যে।”৩৮
এখন দেখা যাক, মু‘আবিয়ার কাপুরুষোচিত আচরণের বিপরীতে ইমাম (আঃ) কী প্রতিক্রিয়া দেখালেন।
ক্ষমতা সত্ত্বেও মূলনীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিশীলতা
ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যরা বিশেষ এক সামরিক কৌশল প্রয়োগ করে ফোরাতকূল দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ফলে ফোরাতের পানি ব্যবহার করা তাদের জন্য সম্ভবপর হয়ে ওঠে এবং একচ্ছত্রভাবে তাদের অধীনে চলে আসে। পক্ষান্তÍরে মু‘আবিয়ার সৈন্যদল ফোরাতকূল থেকে বিতাড়িত হয় এবং একটি গাছপালাহীন শুষ্ক মালভূমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শাম বাহিনীর জন্য এ পরিস্থিতিতে জীবন চালিয়ে যাওয়া সম্ভবপর ছিলো না। শীঘ্রই তাদের পানির সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছিলো। বাধ্য হয়ে তাদের জন্য নিম্নোক্ত তিনটি পরিকল্পনার যে কোনো একটিকে বেছে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছিলো ঃ
(১) আক্রমণ করে পুনরায় ফোরাতকূল দখলে নেয়া। কিন্তু তাদের সে শক্তি ও সাহস ছিলো না।
(২) পিপাসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া এবং ছিফ্ফীনকে তাদের গোরস্তানে পরিণত করা।
(৩) পালিয়ে যাওয়া এবং শাম ও তার আশপাশে আশ্রয় নেয়া।
কিন্তু এতসব সত্ত্বেও ফোরাত দখলের ঘটনা শাম বাহিনীর সেনাপতিদের মধ্যে বিশেষ করে মু‘আবিয়ার মধ্যে তেমন ভীতির সঞ্চার করে নি। কারণ, তারা ইমাম (আঃ)-এর যে সদাচার, মহানুভবতা, সাহস ও প্রতিশ্রুতিপরায়ণতার পরিচয় জানতো তাতে তারা আত্মবিশ্বাসী ছিলো যে, ইমাম কখনো তাঁর ইসলামী আদর্শ ও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দেবেন না। নৈতিক মৌলনীতিসমূহের প্রতি এবং উৎকৃষ্টতম মনুষ্যত্বের মূল্যবোধসমূহের প্রতি অবিচল থাকা প্রত্যেক সুশীল ও সভ্রান্তÍ মানুষের ঊর্ধ্বলোকীয় মানসিকতা থেকে উৎস লাভ করে থাকে। এসব মৌলনীতি সর্ব অবস্থা ও পরিস্থিতিতেই কাক্সিক্ষত। শান্তিÍ বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তা পরিবর্তন হয় না। বরং জীবনের ব্যাপ্তিতে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সাথেই তা সম্পর্কিত।
মহানবী (সাঃ) কর্তৃক ইসলামী বাহিনীকে প্রেরণের সময় তাঁর বাণীসমূহের প্রতি, তদ্রƒপ ছিফ্ফীনে ইমাম আলী (আঃ)-এর বাণীসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রতীয়মান হবে যে, উভয় বাণীর সারসত্য বা বাস্তবতা একটাই। আর তা হলো, কখনোই মানবিক মূল্যবোধকে উদ্দেশ্যের পিছনে উৎসর্গ না করা। বরং কঠিনতম সঙ্কটকালেও নীতি-নৈতিকতার প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল থাকতে হবে; অবহেলা করলে চলবে না।
মু‘আবিয়ার সেনাপতিরা যেকেনো ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের ফোরাত-কূল দখল করে নেয়ার পরও উদ্বিগ্ন ছিলো না তার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় দুই পোড় খাওয়া বৃদ্ধ রাজনীতিকের (মু‘আবিয়াহ্ ও ‘আম্র্ ইবনে ‘আছের) মধ্যকার কথোপকথন থেকে।
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ মু‘আবিয়ার এ সম্পূর্ণ মানবতা বিরোধী কাজের বিপক্ষে ছিলেন। কিন্তু মু‘আবিয়াহ্ তাঁর “বিচ্ছিন্ন মগয”-এর (অর্থাৎ ‘আম্র্ ইব্নুল্ ‘আছের) মতামতের বিপরীত কাজ করেন। অবশেষে পরিস্থিতি ঘুরে যায় এবং ফোরাতের কূল ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের দখলে আসে। আর মু‘আবিয়ার সৈন্যরা বহু ক্রোশ দূরে হটে যায়।
এ সময় রাজনীতির দুই মোড়ল পরস্পর কথপোকথনে ব্যস্ত হলেন যার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ ঃ
‘আম্র্ ঃ আপনি যেভাবে ইরাকীদের জন্য পানি বন্ধ করে দিয়েছিলেন এখন সেভাবেই তারা যদি আপনার জন্য পানি বন্ধ করে দেয় তাহলে কী করবেন? তখন কি পানি মুক্ত করার জন্য তারা যেভাবে লড়াই করেছে আপনিও সেভাবে লড়াই করবেন?
মু‘আবিয়াহ্ ঃ অতীতের কথা ছেড়ে দাও। আলীর ব্যাপারে তুমি কী ভাবছো?
‘আম্র্ ঃ আমার মনে হয আপনি তাঁর সাথে যে আচরণ করেছেন তিনি আপনার সাথে তদ্রƒপ আচরণ করবেন না। কারণ, তিনি কখনোই ফোরাতকূল জয় করতে আসেন নি।৩৯
মু‘আবিয়াহ্ এমন একটা কথা বললেন যা রাজনীতির মোড়লকে অসন্তুষ্ট করলো এবং তিনি তাঁর উত্তরে কিছু কবিতা আবৃত্তি করলেন, আর মনে করিয়ে দিলেন যে, আকাশে কালো মেঘ। অতএব, তাঁর পরিণতিও ত্বাল্হাহ্ ও যুবাইরের মতো হতে পারে।৪০
কিন্তু ‘আম্রের অনুমান পুরোপুরি সঠিক ছিলো। ইমাম (আঃ) ফোরাতকূল দখল করার পর শত্রুকে ফোরাতের পানি ব্যবহার করার পথ উন্মুক্ত করে দিলেন।৪১ আর এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করে দিলেন যে, পরম শত্রুর সাথে যুদ্ধের সময়ও তিনি নৈতিক মূলনীতিসমূহের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল। তিনি কখনো মু‘আবিয়ার ন্যায় উদ্দেশ্যকে মাধ্যমের যথার্থতা প্রমাণকারীরূপে গ্রহণ করার নীতিতে তথা যেকোনো উপায়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর নীতিতে বিশ্বাসী নন।
চলবে....
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:২০
ধঅনের শীষ বলেছেন: পরে পড়ম