নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দেশ , মানুষ

জীবনের সব কিছু আললাহর সন্তুষ্টির জন্য

আল মাহদী ফোর্স

কোরান ও নবী পরিবারের আঃ অনুসারী।

আল মাহদী ফোর্স › বিস্তারিত পোস্টঃ

সিফফিনের যুদ্ব,-৫ লেখকঃআয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানী,অনুবাদঃহুজ্জাতুল ইসলাম ডঃ আব্দুল কুদ্দুস বাদশা,হুজ্জাতুল ইসলাম মাইনুদ্দিন আহমেদ

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৪২

শাহাদাত গর্বের বিষয় ঃ একটি সংস্কৃতি

শাহাদাতকে গৌরবের বিষয় মনে করা এবং আল্লাহ্র সাথে মিলিত হতে আগ্রহী থাকা পরকালে ঈমানদার লোকদের জন্য এমন একটি সংস্কৃতি যা অন্যান্য জাতির মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় না। তাই মুসলমানরা পবিত্র উদ্দেশ্যসমূহের জন্য যুদ্ধ করে। শাহাদাতের প্রতি প্রেমই হলো বিদ্রোহ ও জিহাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ও চালিকাশক্তি। একজন শহীদ এ প্রত্যয় নিয়ে কয়দিনের নশ্বর জীবনকে চিরন্তÍন জীবনে পরিণত করে, আর এ পথে কোনো কিছুরই পরোয়া করে না।

ছিফ্ফীন যুদ্ধের এক দিনে শাম বাহিনীর বানূ আসাদ গোত্রীয় এক বীর যোদ্ধা রণাঙ্গনে প্রবেশ করে যুদ্ধের ডাক দেয়। ইরাকী সৈন্যরা এ বীরপুরুষকে দেখে পশ্চাদপসারণ করলো। কিন্তু হঠাৎ মুকাত্তা‘ ‘আমেরী নামে এক বৃদ্ধ এ আসাদী বীরের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হলেন। ইমাম (আঃ) ব্যাপারটি লক্ষ্য করে তাঁকে ময়দানে যেতে বাধা দিলেন। “কোনো যোদ্ধা আছে নাকি?” আসাদী বীরের এ রণহুঙ্কার তখন কর্ণকুহরকে প্রকম্পিত করছিলো। আর প্রত্যেক বারই উক্ত শাহাদাত-প্রেমিক বৃদ্ধ লোকটি এগিয়ে যাচ্ছিলেন আর ইমাম (আঃ) তাঁকে নিষেধ করছিলেন। অবশেষে বৃদ্ধ নিবেদন করলেন, “হে ইমাম! আমাকে যেতে দিন, আমি এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি যাতে শহীদ হয়ে বেহেশতে যেতে পারি অথবা তাকে হত্যা করে তার অনিষ্টতা থেকে আপনাকে মুক্ত করি।”

ইমাম (আঃ) এবার তাঁকে অনুমতি দিলেন এবং তাঁর জন্য দো‘আ করলেন।

এই বৃদ্ধের সাহসী ও প্রেমিকসুলভ আক্রমণ শামী বীর যোদ্ধার অন্তÍরে এমন আতঙ্কের জন্ম দিলো যে, সে পলায়ন করা ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পেলো না। পালাতে পালাতে সে মু‘আবিয়ার চৌকির কাছে পৌঁছে গেলো। বৃদ্ধ তাকে সেখান পর্যন্তÍ পিছু ধাওয়া করলেন। তবে তাকে নাগালে না পেয়ে ফিরে এলেন।

আলী (আঃ)-এর শাহাদাত এবং ইমাম হাসান (আঃ) ও মু‘আবিয়াহ্র মধ্যে সন্ধির পর লোকেরা মু‘আবিয়ার অনুকূলে বাই‘আত হলে মু‘আবিয়াহ্ মুকাত্তা‘ ‘আমেরীর সন্ধান করলেন এবং তাঁকে ডেকে পাঠালেন। মুকাত্তা‘ তখন অতিশয় বৃদ্ধ ; স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেছে। এ অবস্থায় তিনি মু‘আবিয়ার কাছে উপস্থিত হলেন।

মু‘আবিয়াহ্ ঃ হে ভাই! তুমি যদি এ অবস্থায় আমার কাছে না আসতে তাহলে আমার হাত থেকে নিস্তার পেতে না।

‘আমেরী ঃ তোমাকে আল্লাহ্র দোহাই দিচ্ছি, আমাকে হত্যা করো এবং এই লাঞ্ছনার জীবন থেকে আমাকে নি®কৃতি দাও। আর আমাকে আল্লাহ্র সাক্ষাত লাভের নিকটবর্তী করো।

মু‘আবিয়াহ্ ঃ আমি কখনোই তোমাকে হত্যা করবো না। তোমাকে আমার দরকার।

‘আমেরী ঃ তোমার দরকারটা কী?

মু‘আবিয়াহ্ ঃ আমার ইচ্ছা তোমার সাথে আমি ভাই হবো।

‘আমেরী ঃ আমি অতীতে আল্লাহ্র জন্য তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। এখনও এ অবস্থায় বহাল আছি যতদিন না কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ আমাদেরকে সমবেত করেন এবং আমার ও তোমার সম্পর্কে বিচার করেন।

মু‘আবিয়াহ্ ঃ তোমার কন্যাকে আমার সাথে বিবাহ দাও।

‘আমেরী ঃ আমি এর চেয়ে সহজতর আবেদনও প্রত্যাখ্যান করেছি, এ আবেদন তো অনেক দূরের কথা।

মু‘আবিয়াহ্ ঃ আমার সম্পর্ককে জোড়া লাগিয়ে নাও।

‘আমেরী ঃ তোমার সাথে সম্পর্কে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।১১২
একটি সামরিক কৌশল

দশম দিনে কিম্বা তার পরে যখন ইরাক ও শামের অশ্বারোহী বাহিনীর মধ্যে প্রচ- যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন ইমাম (আঃ)-এর এক হাজার সৈন্য শামীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং সৈন্যদের মূল অংশের সাথে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় ইমাম (আঃ) ঊচ্চৈঃস্বরে বললেন, “কেউ কি নেই যে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন করবে এবং স্বীয় দুনিয়াকে পরকালের বিনিময়ে বিক্রি করে দেবে?”

তখন আবদুল আযীয নামক জনৈক ব্যক্তি ধূসর রঙের একটি ঘোড়ায় চড়ে এবং লৌহ বর্মে আবৃত হয়ে ইমাম (আঃ)-এর নিকট উপস্থিত হলো এবং বললো, “আপনি বলুন, যা কিছু নির্দেশ দেবেন পালন করবো।”

ইমাম (আঃ) তার জন্য দো‘আ করলেন এবং বললেন, “শামের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করো এবং নিজেকে অবরুদ্ধ সৈন্যদের নিকট পৌঁছাও। যখন তাদের নিকটে পৌঁছবে তখন বলবে যে, আমীরুল মু’মিনীন তোমাদেরকে সালাম দিয়েছেন। তিনি চান তোমরা ঐ দিক থেকে তাকবীর বলবে আর আমরাও এদিক থেকে তাকবীর বলবো। আর তোমরা এদিক থেকে আর আমরা ঐদিক থেকে আক্রমণ চালাবো যাতে অবরোধ ভেঙ্গে তোমাদেরকে মুক্ত করতে পারি।”

ইমাম (আঃ)-এর নির্দেশ পেয়ে লোকটি শামের বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালো এবং নিজেকে আটকে পড়া সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছালো এবং ইমাম (আঃ)-এর বার্তা তাদেরকে পৌঁছে দিল। তারা ইমাম (আঃ)-এর বার্তা শুনে আনন্দিত ছিলো। অতঃপর দুই দিক থেকে তাকবীর ধ্বনি ও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো এবং অবরোধের বেষ্টনী ভেঙ্গে গেলো। আর আটকে পড়া সৈন্যরা ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের কেন্দ্রে এসে যোগ দিলো। শামের বাহিনী আটশ’ জন নিহতের লাশ রেখে পশ্চাদপসরণ করলো এবং সাময়িকভাবে যুদ্ধের আগুন নিভে গেলো।১১৩
যুদ্ধের মাঝে জোর রাজনৈতিক তৎপরতা

সামরিক বিশেষজ্ঞগণ সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ইমাম (আঃ)কে বিজয়ী মনে করছিলেন। কারণ, তাঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন যে, প্রতি দিনই যুদ্ধের পরিস্থিতি ইমাম (আঃ)-এর অনুকূলে পরিবর্তিত হচ্ছে আর মু‘আবিয়ার বাহিনীকে ধ্বংস ও মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে। এ বিজয় কতগুলো কারণে নিশ্চিত হয়ে পড়েছিলো Ñ যার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো ঃ

(১) সর্বাধিনায়ক হযরত আলী (আঃ)-এর সুযোগ্য ও অভিজ্ঞ নেতৃত্ব। এ সঠিক সামরিক নেতৃত্বের কারণেই মু‘আবিয়ার বাহিনীর নিহতের সংখ্যা ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর নিহতের সংখ্যার দ্বিগুণে দাঁড়ায়। (ছিফ্ফীন যুদ্ধের ঘটনাবলী বর্ণনা করার পর উভয় পক্ষের নিহতদের পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হবে।)

(২) ইমাম (আঃ)-এর সাহস Ñ যা ছিলো বিশ্বের ইতিহাসে নযীর বিহীন। ইমাম (আঃ)-এর এক শত্রুর ভাষায়, আলী এমন কোনো বীরের মুখোমুখি হন নি যার রক্ত দ্বারা মাটিকে সিক্ত করেন নি। এ বীরত্বের কারণেই বিশাল এক সৈন্যদলের অনিষ্টতার হাত থেকে ইরাক বাহিনী রেহাই পায় এবং শত্রুর মনে প্রচ- আতঙ্ক প্রবেশ করে। ফলে তাদের বেশীর ভাগই দৃঢ়তা প্রদর্শনের পরিবর্তে পলায়নকে বেছে নেয়।

(৩) ইমাম আলী (আঃ)-এর সত্য ইমামত, খেলাফত, তাকওয়া ও মর্যাদার প্রতি তাঁর সৈন্যদের গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। যারা ঐশী মনোনয়নকে ইমামত বা নেতৃত্বের মাপকাঠি বলে মনে করতেন আর যারা আনছার ও মুহাজিরদের নির্বাচনকে খেলাফতের মাপকাঠি মনে করতেন, তাঁদের সকলেই মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের যুদ্ধে এবং অবাধ্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়পন্থীদের যুদ্ধে ইমাম (আঃ)-এর পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। অথচ মু‘আবিয়ার সৈন্যদের অবস্থা ছিলো অন্যরূপ। যদিও একদল লোক মযলুম খলীফার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মু‘আবিয়ার পিছনে কাতারবদ্ধ হয়েছিলো ও তলোয়ার ধরেছিলো, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই বস্তুগত উদ্দেশ্যে ও পার্থিব স্বার্থে তাঁর পাশে সমবেত হয়েছিলো। এছাড়া কিছু লোক ইমামের (আঃ) সাথে পুরাতন শত্রুতার কারণে এ পথে পা বাড়িয়েছিলো। আর এ সত্য কোনো ঐতিহাসিকের কাছেই গোপন নয়।

(৪) ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদলে ইসলামী উম্মাহ্র বিখ্যাত ও শ্রদ্ধাভাজন বক্তিদের উপস্থিতি। যেসব ছাহাবী বদর, ওহুদ ও হুনাইনে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের সততা ও পবিত্রতার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সাক্ষ্য দেন। তাঁদের মধ্যে ‘আম্মার ইয়াসির, আবু আইয়্যুব আনছারী, ক্বায়স্ ইবনে সা’দ, হুজ্র্ ইবনে ‘আদী, আবদুল্লাহ্ ইবনে বাদীল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এ বিষয়টি মু‘আবিয়াহ্র বাহিনীর অনেক স্বার্থহীন সরলমনা সৈন্যের মধ্যে দ্বিধা ও সংশয়ের উদ্রেক করেছিলো।

এসব কারণে মু’আবিয়াহ্ ও তাঁর বিচ্ছিন্ন মগয ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ তাঁদের পরাজয় নিশ্চিত দেখতে পেলেন। এ অবস্থা প্রতিহত করার এবং ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের সামরিক বিজয়ের চাকার গতি রোধ করার উদ্দেশ্যে তাঁরা গোপন তৎপরতা চালাতে থাকেন। এসব তৎপরতার অন্যতম ছিলো ইমাম (আঃ)-এর সেনাপতিদের কাছে পত্র লেখা এবং তাঁদেরকে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের মাঝে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো।

১) ছিফ্ফীনের যুদ্ধে ইমাম (আঃ)-এর প্রতি সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিলো রাবি’আহ্ গোত্র। মুদার গোত্রের লোকদের মধ্যে দৃঢ়তা দেখা না গেলেও রাবি‘আহ্ গোত্রের লোকেরা পর্বতের ন্যায় অটল থাকে। ইমাম (আঃ)-এর চোখ যখন তাদের পতাকাসমূহের ওপর পড়লো তখন তিনি বললেন, “এ পতাকাগুলো কা’দের?” বলা হলো, “ রাবি‘আহ্ গোত্রের।” ইমাম বললেন ঃ

هِي رَاياتُ اللهِ عَصَمَ اللهُ أَهْلَهَا وَ صَبَّرَهُمْ وَ ثَبَّتَ أقْدَامَهُمْ.

“এগুলো আল্লাহ্র পতাকা। আল্লাহ্ এগুলোর মালিকদেরকে রক্ষা করুন এবং তাদেরকে অটলতা ও অবিচলতা দান করুন।”

ইমাম (আঃ)-এর কাছে খবর এলো যে, এ গোত্রের একজন সেনাপতি খালেদ ইবনে মু‘আম্মার মু‘আবিয়ার সাথে গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং তাদের মধ্যে এক বা একাধিক পত্রবিনিময় হয়েছে। ইমাম (আঃ) তক্ষুণি তাকে ও রাবি‘আহ্র নেতাদেরকে হাযির করালেন এবং তাদেরকে বললেন, “হে রাবি‘আহ্ গোত্রের লোকজন! তোমরা আমার সাহায্যকারী এবং আমার আহ্বানে সাড়া দানকারী। আমার কাছে খবর এসেছে যে, তোমাদের মধ্যে একজন মু‘আবিয়ার সাথে পত্র আদান-প্রদান করেছে।”

অতঃপর তিনি খালেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার সম্পর্কে আমার কাছে যে খবর এসেছে তা যদি সঠিক হয় তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করবো এবং নিরাপত্তা প্রদান করবো। তবে শর্ত হলো ইরাক, হেজায কিংবা এমন কোনো স্থানে Ñ যা মু’আবিয়ার শাসনাধীন নয়, চলে যাবে এবং সেখানে বসবাস করবে। আর যদি সে কথা মিথ্যা হয় তাহলে তোমার প্রশান্তিÍদায়ক কসমের দ্বারা আমাদের উত্তপ্ত অন্তরগুলোকে শীতল করো।”

সে ঐ মজলিসের মধ্যে কসম করলো যে, কখনো এরূপ ছিলো না। তার সহযোগীরা বললো, “এ অভিযোগ সত্য হলে আমরা তাকে হত্যা করবো।” তখন তাদের মধ্য থেকে যিয়াদ ইবনে হাফ্ছাহ্ নামক এক ব্যক্তি ইমাম (আঃ)কে বললো, “খালেদের কাছ থেকে কসম গ্রহণের মাধ্যমে নিশ্চিত হোন যে, সে আপনার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।”১১৪

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য নির্দেশ করে যে, সে মু‘আবিয়ার পঞ্চম বাহিনীর লোক হিসেবে ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর মধ্যে অবস্থান করছিলো। বিজয়ের সময়গুলোতে, এমনকি যখন স্বয়ং মু’আবিয়াকে নাগালে পাওয়া যায় ও তাঁকে তাঁর তাঁবুর মধ্যে আটক করা সম্ভব ছিলো তখন সে সৈন্যদেরকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিচ্ছিলো। পরে সে তার এ কাজের সপক্ষে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্তÍ তুলে ধরা হলো।

রাবি‘আহ্ গোত্র ইমাম (আঃ)-এর বাম পার্শ্বের বাহিনীতে অন্তÍর্ভুক্ত ছিলো। তাদের সেনাপতি ছিলেন আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস। ইমাম (আঃ)-এর বাম পার্শ্বের বাহিনী মু‘আবিয়ার ডান পার্শ্বে বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিলো Ñ যার নেতৃত্বে ছিলো শামের সবচেয়ে প্রতাপশালী ব্যক্তিত্ব যূল্ কালা‘ হেম্ইয়ারী ও ‘উবায়দুল্লাহ্ ইবনে ওমর। হেম্ইয়ার গোত্র যূল্ কালা‘র নেতৃত্বে এবং ‘উবায়দুল্লাহ্্র নেতৃত্বে অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী ইমাম (আঃ)-এর বাম পার্শ্বের বাহিনীর ওপর প্রচ- আক্রমণ চালায়। কিন্তু এতে কোনো কাজ হলো না। দ্বিতীয় আক্রমণে ‘উবায়দুল্লাহ্ বিন ওমর সৈন্যদের অগ্রভাগে দাঁড়িয়ে শামের জগণের উদ্দেশে বললো, “ইরাকের জগণের এ দলটি ওসমানকে হত্যা করেছে। তোমরা যদি তাদেরকে পরাজিত করতে পারো তাহলে তোমরা তোমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছো এবং আলীকে ধ্বংস করেছো।”

কিন্তু এ আক্রমণের মুখেও রাবি‘আহ্র লোকরা বিশেষ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চালিয়ে গেলো এবং কেবল অক্ষম ব্যক্তিরা ছাড়া কেউই পিছু হটলো না।

ইমাম (আঃ)-এর বিচক্ষণ সেনারা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, খালেদ যখন একদল সৈন্যকে পশ্চাদপসরণ করতে দেখে তখন সে নিজেও পশ্চাদপসরণ করার এবং এ পন্থায় ইমাম (আঃ)-এর অটল সৈন্যদেরকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু যেহেতু সে অন্য সৈন্যদের দৃঢ়তা লক্ষ্য করলো তখন তড়িঘড়ি করে তাদের কাছে ফিরে গেলো এবং নিজের কাজের ব্যাখ্যা তুলে ধরলো; বললো, “পিছু হটে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো পলায়নরতদেরকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনা।”১১৫

ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন ঃ

ইসলামের ঐতিহাসিকগণ, যেমন ঃ কাল্বী ও ওয়াক্বেদী একমত পোষণ করেন যে, সে দ্বিতীয় আক্রমণকালে ইচ্ছাকৃতভাবে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দেয় যাতে ইমাম (আঃ)-এর বাম পার্শ্বের বাহিনীকে পরাজয়ের শিকার করতে পারে। কারণ মু‘আবিয়াহ্ তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে, ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের ওপর জয়লাভ করতে পারলে খালেদ যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিনের জন্য তাকে খোরাসানের গভর্নরের পদ দেয়া হবে।১১৬

ইবনে মুযাহিমও উল্লেখ করেছেন ঃ

মু‘আবিয়াহ্ খালেদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে, তিনি যদি এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন তাহলে তাকে খোরাসানের গভর্নরের পদ দেয়া হবে। খালেদ মু‘আবিয়ার প্রতারণার শিকার হলো, কিন্তু তার আশা পূরণ হলো না। কারণ, মু‘আবিয়াহ্ যখন শাসন ক্ষমতা লাভ করেন তখন তাকে খোরাসানের গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন বটে, কিন্তু খালেদ সেখানে পৌঁছার পূর্বেই মধ্যপথে নিহত হয়।১১৭

শামের বাহিনী ‘উবায়দুল্লাহ্ ইবনে ওমরকে নিয়ে গর্ব করতো। তারা তাকে ‘পূত-পবিত্রের ছেলে পূত-পবিত্র’ বলে আখ্যায়িত করতো।

অবশেষে শাম বাহিনীর হেম্ইয়ারী সৈন্যদের এবং ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর রাবি‘আহ্ সৈন্যদের মধ্যে প্রচ- যুদ্ধ বেধে গেলো এবং উভয় পক্ষের বহু সংখ্যক লোক নিহত হলো। এ যুদ্ধে ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি ছিলো এই যে, ইমাম (আঃ)-এর বাহিনী থেকে পাঁচশ’ জন আপাদমস্তক লৌহবর্মে সজ্জিত হয়ে রণাঙ্গনে পদার্পণ করলো। মু‘আবিয়ার বাহিনী থেকেও সমসংখ্যক সৈন্য অনুরূপভাবে সজ্জিত হয়ে তাদের মোকাবিলায় দাঁড়ালো। এ দুই দলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধের শেষে উভয় পক্ষের একজন সৈন্যও আর ফিরে আসে নি ; তারা সকলেই নিহত হয়।

দুই বাহিনী সরে আসার সময় কঙ্কালে পরিপূর্ণ একটি ঢিবি পাওয়া গেলো যা তাল্লূল জামাজিম বা কঙ্কালের ঢিবি নামে আখ্যা লাভ করে। এ যুদ্ধেই মু‘আবিয়ার সবচেয়ে বড় সমর্থক এবং হেম্ইয়ারীদের নিয়ে গঠিত তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর বিশেষ সংগঠক যূল্ কালা‘ খুন্দুক নামক এক ব্যক্তির হাতে নিহত হয়। ফলে হেমইয়ারীদের মধ্যে বিচলিত অবস্থা সৃষ্টি হয়।”১১৮

২) ‘উবায়দুল্লাহ্্ ইবনে ওমর যুদ্ধের তীব্রতম মুহূর্তে মতপার্থক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে একজনকে হযরত ইমাম হাসান (আঃ)-এর নিকট পাঠায় এবং তাঁর সাথে সাক্ষাতের আবেদন জানায়। ইমাম-পুত্র পিতার অনুমতি নিয়ে ‘উবায়দুল্লাহ্্কে সাক্ষাত দান করেন। এ সাক্ষাতে ‘উবায়দুল্লাহ্ ইমাম হাসান (আঃ)কে বললো, “আপনার পিতা অতীতে কুরাইশের প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছেন এবং বর্তমানেও ঝরাচ্ছেন। এমতাবস্থায় আপনি কি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে প্রস্তুত আছেন? তাহলে আপনাকেই মুসলমানদের খলীফাহ্ বলে পরিচয় করিয়ে দেই?”

তখন ইমাম-পুত্র রাগের সাথে তার বুকে প্রত্যাখ্যানের চপেটাঘাত করলেন। অতঃপর ইমামতের ইল্হামী জ্ঞানের ভিত্তিতে তিনি ‘উবায়দুল্লাহ্্কে তার শোচনীয় পরিণাম সম্পর্কে খবর দিলেন। বললেন, “আজ অথবা আগামীকাল তোমাকে নিহত দেখতে পাবো। জেনে রেখো যে, শয়তান তোমার নোংরা কাজকে তোমার চোখে সুন্দর প্রতিভাত করেছে।”

রাবী বলেন, সে ঐদিন অথবা তার পরদিন সবুজ পোশাক পরিহিত চার হাজার সৈন্যের একটি দল নিয়ে ময়দানে আসে এবং ঐদিনই হামদান গোত্রের হানী ইবনে খাত্তাব নামক এক ব্যক্তির হাতে নিহত হয়।১১৯

৩) মু‘আবিয়াহ্ তাঁর আপন ভাই ‘উত্বাহ্ ইবনে আবু সুফিয়ানকে ডেকে পাঠালেন Ñ যে ছিলো শুদ্ধভাষী ও সুবক্তা। তিনি তাকে বললেন, আশ্‘আছ ইবনে ক্বায়সের সাথে দেখা করো এবং তাকে সন্ধি ও আপোসের দিকে আহ্বান জানাও। ‘উত্বাহ্ ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের কাছে এলো এবং উচ্চৈঃস্বরে ইবনে ক্বায়স্কে ডাকলো। আশ্‘আছকে খবর দেয়া হলো যে, মু‘আবিয়াহ্র বাহিনীর জনৈক সৈন্য তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে। আশ্‘আছ্ বললো, তার নাম কী শোনো। যখন তাকে বলা হলো যে, সে হলো ‘উত্বাহ্ ইবনে আবু সুফিয়ান, তখন আশ্‘আছ্ বললো, “সে একজন আরামপ্রিয় যুবক। তার সাথে দেখা করা উচিৎ।”

সাক্ষাতের সময় ‘উত্বাহ্ আশ্‘আছ্কে বললো ঃ “মু‘আবিয়াহ্র যদি আলী ছাড়া অন্য কারো সাথে সাক্ষাত করার প্রশ্ন উঠতো তাহলে তোমার সাথেই সাক্ষাত করতেন। কেননা তুমি ইরাকী জনগণের এবং ইয়ামানীদের শীর্ষ নেতা আর হয়রত ওসমানের জামাতা ও তাঁর গভর্নর ছিলে। তুমি নিজেকে আলীর অন্যান্য সেনাপতির সাথে তুলনা করো না। কেননা, মালেক আশ্তার হলো সেই ব্যক্তি যে ওসমানকে হত্যা করেছে আর ‘আদী ইবনে হাতেম জনগণকে ওসমান-হত্যায় উস্কানি দিয়েছে। আর সা‘ঈদ ইবনে ক্বায়স্ হলো সেই ব্যক্তি আলী যার দিয়াতের (রক্তমূল্যের) দায়ভার নিজ স্কন্ধে তুলে নিয়েছেন। আর যুহাইর এবং শারীহ্ প্রবৃত্তির দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তুমি কৃতজ্ঞতার বশে ইরাকী জনগণের প্রতিরক্ষায় এসেছো এবং বিদ্বেষের বশে শামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছো। আল্লাহ্র শপথ, তুমি জানো যে, আমাদের ও তোমাদের অবস্থা আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমি বলছি না যে, আলীকে ত্যাগ করো এবং মু‘আবিয়াকে সাহায্য করো। আমি তোমাকে এমনভাবে থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি যাতে তোমার এবং আমাদের মঙ্গল রয়েছে।”

ইতিহাস বলে যে, আশ্‘আছ্ মু‘আবিয়ার সাথে গোপন যোগাযোগ রেখেছিলো এবং তাঁর অনুকূলে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গুণছিলো।

আশ্‘আছ্ তার উত্তরের শুরুতে ইমাম (আঃ)-এর প্রশংসা করলো এবং ‘উত্বাহ্র বক্তব্যগুলোকে একটি একটি করে প্রত্যাখ্যান করলো। কিন্তু শেষ ভাগে আকারে-ইঙ্গিতে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য তার সম্মতির কথা জানিয়ে দিলো, বললো “বেঁচে থাকার প্রয়োজন আমাদের চেয়ে তোমাদের বেশি নয়। আমি এ বিষয়ে ভেবে দেখবো এবং আল্লাহ্র ইচ্ছায় স্বীয় মতামত প্রকাশ করবো।”১২০

৪) মু‘আবিয়াহ্ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্কে বললেন, “আলীর পরে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হলো ইবনে আব্বাস। সে যদি কোনো কথা বলে আলী তার বিরোধিতা করবে না। যুদ্ধ আমাদের ধ্বংস ডেকে আনার আগে অবিলম্বেই কোনো উপায় খুঁজে বের করো। শামের জনগণ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্তÍ কখনোই আমরা ইরাকে পৌঁছতে পারবো না।”

‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ বললেন, “ইবনে আব্বাস প্রতারণার শিকার হয় না। তাকে যদি ধোঁকা দেয়া যায় তাহলে আলীকেও ধোঁকা দেয়া যাবে।”

মু‘আবিয়ার পীড়াপীড়ির কারণে শেষ পর্যন্তÍ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ইবনে আব্বাসকে একটি পত্র লিখতে বাধ্য হলেন। পত্রের উপসংহারে একটি কবিতাও জুড়ে দিলেন। ‘আম্র্ যখন তাঁর এ পত্র ও কবিতা মু‘আবিয়াকে দেখালেন তখন মু‘আবিয়াহ্ বললেন ঃ لاَ اَرَي كِتَابَكَ عَلَي رقَّةِ شِعْرِِكَ “আমি তোমার পত্রটিকে তোমার কবিতার মানের বলে মনে করি না।”

‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ উক্ত পত্র ও কবিতার মধ্যে আব্বাস এবং তাঁর বংশের প্রশংসা করেন এবং মালেকের নিন্দা করেন। পরিশেষে তিনি প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন যে, যুদ্ধ শেষ হলে ইবনে আব্বাস শূরার সদস্যপদ লাভ করবেন যাদের মাধ্যমে আমীর নির্বাচিত হবেন।

এ পত্র যখন ইবনে আব্বাসের হাতে পৌঁছলো, তখন তিনি তা ইমাম (আঃ)কে দেখালেন। ইমাম (আঃ) বললেন, “আল্লাহ্ ইবনে ‘আছ্কে হত্যা করুন। কী প্রতারণাপূর্ণ পত্র! যত শীঘ্র সম্ভব তার উত্তর লিখে পাঠাও। আর কবিতাংশটির উত্তরের জন্য, তোমার ভাই তো জাঁদরেল কবি ; তার কাছ থেকে উত্তর লিখে নাও।”

ইবনে আব্বাস পত্রের উত্তরে লিখলেন ঃ “আমি আরবদের মধ্যে তোমার চেয়ে নির্লজ্জ লোক দেখি নি। তুমি স্বল্প মূল্যে তোমার দ্বীনকে বিক্রি করেছো, দুনিয়াকে বড় বড় গুনাহ্গারদের ন্যায় গণ্য করছো, আবার লোক দেখানো পরহেযগারিরও ভান করছো। যদি আল্লাহ্কে খুশি করতে চাও তাহলে সর্বপ্রথম মিসরের রাজত্বকে মস্তিষ্ক থেকে বের করে ফেলো এবং নিজের ঘরে ফিরে যাও..। আলী আর মু‘আবিয়াহ্ এক সমান নয়, ঠিক যেভাবে ইরাক ও শামের জনগণও এক সমান নয়। আমি আল্লাহ্কে চেয়েছি আর তুমি চেয়েছা মিসরের রাজত্ব।”

অতঃপর, তিনি তাঁর ভাই ফযল ইবনে আব্বাস ‘আম্রের কবিতার ছন্দে ও মাত্রায় যে কবিতা রচনা করেছিলেন তা পত্রের সাথে জুড়ে দিলেন এবং পত্রটি আলী (আঃ)কে দেখালেন। আলী (আঃ) বললেন, “ও যদি বুদ্ধিমান হয় তাহলে তোমার পত্রের আর উত্তর দেবে না।”

এ পত্র যখন ‘আম্রের হাতে পৌঁছলো তখন তিনি তা মুআবিয়াকে দেখালেন এবং বললেন, “তুমিই আমাকে পত্র লিখতে অনুরোধ করেছিলে। কিন্তু না তোমার লাভ হলো, না আমার।” মু‘আবিয়াহ্ বললেন, “ইবনে আব্বাস আর আলীর অন্তÍর অভিন্ন; উভয়ই আবদুল মুত্তালিবের সন্তÍান।”১২১

৫) মু‘আবিয়াহ্ যখন অনুভব করলেন যে, ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অবরোধের গ-ি সঙ্কীর্ণতর হয়ে আসছে এবং শামীদের ঘাঁটির পতন হওয়ার উপক্রম হয়েছে, তখন তিনি সিদ্ধান্তÍ নিলেন যে, সরাসরি ইবনে আব্বাসের কাছে পত্র লিখবেন এবং তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেবেন যে, এ যুদ্ধ হলো বনি হাশেম ও বনি উমাইয়্যাহ্র মধ্যকার শত্রুতার প্রকাশ। আর এর পরিণতি সম্পর্কেও তাঁকে ভয় দেখাবেন। তিনি এ পত্রে ইবনে আব্বাসকে প্রলুব্ধ করলেন এবং বললেন, “জনগণ যদি আপনার অনুকূলে বাই‘আত হয় তাহলে আমরা আপনার অনুকূলে বাই‘আত হবো।”

এ পত্র যখন ইবনে আব্বাসের হাতে পৌঁছলো তিনি এমনভাবে যুক্তিপূর্ণ এবং দাঁতভাঙ্গা উত্তর লিখে মু‘আবিয়াকে পাঠিয়ে দিলেন যে, মু‘আবিয়াহ্ তাঁকে পত্র লেখার জন্য অনুতপ্ত হলেন এবং বললেন, “এটা হলো স্বয়ং আমার কাজের ফল। আগামী এক বছরের মধ্যে তার কাছে আর কোনো পত্র লিখবো না।”১২২
‘আম্মার ইয়াসির ও অবাধ্য দল

ইয়াসির পরিবারটি ইসলামের একটি মূল পরিবার। ইসলামের সূচনাকালেই তাঁদের সকলে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর দাওয়াতে সাড়া দেন এবং এ পথে নানা অত্যাচার সহ্য করেন। অবশেষে ইয়াসির এবং তাঁর স্ত্রী সুমাইয়্যাহ্ তাওহীদী দ্বীনের পথে আবু জেহেল ও তার দলবলের নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারান। এ দম্পতির যুবক পুত্র ‘আম্মার মক্কার যুবকদের সুপারিশে এবং মৌখিকভাবে এ নতুন ধর্মের প্রতি বিরাগ প্রদর্শনের মাধ্যমে রক্ষা পান। মহান আল্লাহ্ ‘আম্মারের এ কাজকে নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে নির্দোষ বলে ঘোষণা করেন ঃ

الّا مَنْ أُكْرِهَ وَ قَلْبُهُ مُطْمَئِنٌّ بِالْاِيمَانِ.

“শুধু সে ব্যতীত যে (কুফরী কথা বলতে) বাধ্য হয় অথচ তার অন্তÍর ঈমান দ্বারা প্রশান্তÍ।”১২৩

‘আম্মারের কাহিনী এবং তাঁর ঈমান গোপন করার কথা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কানে পৌঁছলে তিনি বলেন, “না, কখনোই নয়। ‘আম্মারের আপাদমস্তক ঈমানে পরিপূর্ণ। তাওহীদ তার রক্ত ও মাংসের সাথে মিশে রয়েছে।”

ইতোমধ্যে ‘আম্মার এসে পৌঁছলেন ; তাঁর চোখ অশ্রুসজল। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর অশ্রু মুছে দিয়ে মনে করিয়ে দিলেন যে, যদি পুনর্বার এরূপ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়েন তাহলে যেন (ইসলামের সাথে) প্রকাশ্যে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।১২৪

এ আত্মত্যাগী সাহাবী সম্পর্কে শুধু এই একটি আয়াতই নাযিল হয় নি, বরং মুফাসসিরগণ আরো দু’টি আয়াতকেও তাঁর সম্পর্কে নাযিল হয়েছিলো বলে উল্লেখ করেছেন।১২৫

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর হিজরতের পর ‘আম্মার তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হন এবং তাঁর সাথে প্রত্যেকটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) অংশগ্রহণ করেন নি এমন কতক যুদ্ধেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। যদিও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ওফাতের পর ক্ষমতাসীন খেলাফত তাঁর পসন্দের ছিলো না তথাপি যতদূর পর্যন্ত শাসকমহলের সাথে সহযোগিতা করা ইসলামের স্বার্থে ছিলো ততদূর সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানে তিনি কুণ্ঠিত হন নি।

রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মদীনায় প্রবেশের পর সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন তা হলো মসজিদ নির্মাণ। হযরত ‘আম্মার এ কাজে সর্বাধিক পরিশ্রম করেন এবং একাই কয়েক জনের কাজ আঞ্জাম দেন। ইসলামের প্রতি তাঁর সততা ও প্রতিশ্রুতিশীলতার সুযোগ নিয়ে অন্যরা তাঁকে দিয়ে তাঁর ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নিতেন। একদিন হযরত ‘আম্মার তাদের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে এই বলে অভিযোগ করেন যে, এরা আমাকে মেরে ফেললো। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তখন তাঁর ঐতিহাসিক উক্তিটি করলেন যা উপস্থিত সকলের অন্তরে গেঁথে গেলো। তিনি বললেন ঃ

إنَّکَ لَنْ تَموتَ حَتّي تَقْتُلَکَ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُِ الْنّاکِبَةُِ عَنِ الْحَقِّ، يَکونُ آخِرُ زادِکَ مِنَ الْدُّنيَا شَربَةُ لَبَنٍ.

“তুমি মৃত্যুবরণ করবে না যতক্ষণ না সত্য থেকে বিচ্যুত একদল অবাধ্য লোক তোমাকে হত্যা করে। আর দুনিয়া থেকে তোমার সর্বশেষ পাথেয় হবে এক ঢোক দুধ।”১২৬

এ কথাটি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাহাবীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং মুখে মুখে প্রচার হতে লাগলো। সেদিন থেকেই হযরত ‘আম্মার মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়ালেন। বিশেষ করে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর প্রশংসা ও স্তুতি করতেন।

ছিফ্ফীন যুদ্ধে হযরত ‘আম্মারের অংশগ্রহণের খবর মু‘আবিয়ার প্রতারণার শিকার হওয়া সৈন্যদের অন্তরকে প্রকম্পিত করলো। অনেকে বাধ্য হয়ে এ ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে দিলো।
হযরত ‘আম্মারের ভাষণ

হযরত ‘আম্মার যখন রণাঙ্গনে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন তখন ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের মাঝে দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিলেন। এতে তিনি বললেন, “আল্লাহ্র বান্দাহ্গণ! সেই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো যারা এমন একজন ব্যক্তির রক্তের প্রতিশোধ চায় যিনি নিজের ওপর যুলুম করেছেন এবং আল্লাহ্র কিতাবের বিরুদ্ধে হুকুম করেছেন। আর তাঁকে সৎকর্মশীল, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী ও সঙ্গত কাজের নির্দেশকারী লোকেরাই হত্যা করেছেন। কিন্তু যারা তাঁর হত্যার ফলে বিপদের সম্মুখীন হয়েছে তারা প্রতিবাদী হয়ে বললো, কেন তাঁকে হত্যা করা হলো? উত্তরে আমরা বললাম, তিনি তাঁর অপকর্মের জন্য নিহত হয়েছেন। তারা বললো, তিনি কোনো রীতিবিরুদ্ধ কাজই করেন নি! হ্যাঁ, তাদের দৃষ্টিতে ওসমান কোনো রীতিবিরুদ্ধ কাজ করেন নি। তিনি দীনারসমূহ তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন, আর তারা ভোগ করেছে ও ঘুরে বেড়িয়েছে। তারা তাঁর রক্তের প্রতিশোধ চায় না। বরং তারা দুনিয়ার যে স্বাদ আস্বাদন করেছে সেটাই ভালবাসে। তারা জানে যে, তারা যদি আমাদের হাতে পড়ে তাহলে ঐসব ভোগ-বিলাস থেকে বঞ্চিত হবে। উমাইয়্যাহ্ খান্দান ইসলাম গ্রহণে অগ্রগামী ছিলো না যে, এদিক থেকে তারা শাসনকর্তৃত্ব লাভের যোগ্য হবে। তারা জনগণকে প্রতারণার শিকারে পরিণত করেছে এবং ‘‘আমাদের নেতা মযলুমভাবে নিহত হয়েছেন’’Ñএ শ্লোগান তুলেছে যাতে জনগণের ওপর অন্যায়ভাবে হুকুমাত ও কর্তৃত্ব করতে পারে। এটা হলো একটি প্রতারণা যা দ্বারা তারা যা চেয়েছে তাতে উপনীত হয়েছে। তারা যদি এরূপ প্রতারণা না করতো তাহলে দু’জন লোকও তাদের হাতে বাই‘আত হতো না এবং তাদেরকে সহযোগিতা করতো না।”১২৭

হযরত ‘আম্মার এ ভাষণ প্রদান করলেন এবং রণাঙ্গনের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তঁর সঙ্গীরাও তাঁর সাথে বেরিয়ে পড়লেন। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের তাঁবু দৃষ্টিগোচরে এলে তিনি উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বললেন, “তুমি মিসরের হুকুমাতের বিনিময়ে নিজের দ্বীনকে বিক্রয় করে দিয়েছো। ধিক্ তোমার ওপর। ইসলামের ওপর আঘাত হানার ঘটনা এটাই তোমার প্রথম নয়।”

অতঃপর ‘উবায়দুল্লাহ্ বিন ওমরের অবস্থানস্থলের ওপর দৃষ্টি পড়লে তিনি বললেন, “আল্লাহ্ তোমাকে ধ্বংস করুন। তুমি তোমার দ্বীনকে দুনিয়ার লোভে আল্লাহ্ ও ইসলামের শত্রুদের নিকট বিক্রয় করে দিয়েছো।” উত্তরে সে বললো, “না। আমি মযলুম শহীদের রক্তের ক্বিছাছ করতে চাই।” হযরত ‘আম্মার বললেন, “মিথ্যা বলছো। আল্লাহ্র শপথ, আমি জানি যে, তুমি কখনোই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি চাও না। তুমি আজ যদি নিহত না হও আগামীকাল মরবে। একবার চিন্তা করে দেখো যে, আল্লাহ্ যদি তাঁর বান্দাহ্দেরকে তাদের নিয়্যত অনুযায়ী শাস্তি বা পুরস্কার প্রদান করেন তাহলে তোমার নিয়্যতটা কী?”১২৮

অতঃপর আলী (আঃ)-এর সৈন্যদের দ্বারা পরিবৃত অবস্থায় তিনি বললেন, “হে আল্লাহ্! তুমি জানো যে, আমি যদি জানতে পারি যে, এই দরিয়ার মধ্যে নিজেকে নিক্ষেপ করলেই তুমি সন্তুষ্ট হবে তাহলে আমি নিজেকে তাতে নিক্ষেপ করবো। আমি যদি জানতে পারি যে, তলোয়ারের ডগার ওপর পেট রেখে এমনভাবে ঝুঁকে পড়লে তুমি সন্তুষ্ট হবে যাতে তা অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায় তাহলে নিশ্চয়ই আমি সেরূপ করবো। হে আল্লাহ্ ! আমি জানি এবং আমাকে অবগত করেছো যে, আজকে যে কাজটি সব কিছুর চাইতে বেশী তোমাকে সন্তুষ্ট করবে তা এই দলটির বিরুদ্ধে জিহাদ ছাড়া অন্য কিছু নয়। আর যদি জানতাম যে, অন্য কিছু, তাহলে আমি তা-ই করতাম।”১২৯

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.