![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইমামের (আঃ) বাহিনীতে ‘আম্মারের অংশগ্রহণের প্রতিক্রিয়া
হযরত ‘আম্মারের ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর বিপ্লবী অবদান সম্পর্কে শামবাসীদের অজানা ছিলো না। তাঁর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কথাটি গোটা মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিলো। শুধু যে জিনিটি কিছুটা হলেও শামবাসীদের কাছে গোপন ছিলো তা হলো হযরত ‘আম্মারের ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীতে যোগদান। যখন ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীতে তাঁর সম্ভাব্য অংশগ্রহণের খবর শাম বাহিনীর মধ্যে গুঞ্জরণ তোলে তখন যারা মু‘আবিয়ার বিষাক্ত প্রচারণার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো তারা অনুসন্ধান করতে নেমে পড়ে। এদের মধ্যে একজন হলেন ইয়ামানের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যূল্ কালা’ Ñ যিনি হেম্ইয়ারী গোত্রসমূহকে মু‘আবিয়ার সপক্ষে সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। এখন তাঁর অন্তরে সত্যের আলো প্রক্ষিপ্ত হয়েছিলো এবং সে সত্যকে খুঁজে পেতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তিনি কূফায় বসবাসরত ও ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদলে অংশগ্রহণকারী হেম্ইয়ারী গোত্রের জনৈক নেতা আবু নূহের সাথে যোগযোগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ কারণে যূল্ কালা’ মু‘আবিয়াহ্র বাহিনীর অগ্রভাগে উপস্থিত হলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বললেন ঃ “আমি কালা‘ গোত্রের আবু নূহ্ হেম্ইয়ারীর সাথে কথা বলতে চাই।”
আবু নূহ্ এ চিৎকার শুনে সামনে এলেন এবং বললেন, “কে তুমি? পরিচয় দাও।”
যূল্ কালা’ ঃ আমি যূল্ কালা’। অনুরোধ করছি আমাদের নিকটে এসো।
আবু নূহ্ ঃ আমি আমার সঙ্গীদেরকে সাথে না নিয়ে একাকী তোমাদের কাছে আগমন করা থেকে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় চাই।
যূল্ কালা’ ঃ তুমি আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যূল্ কালা’র আশ্রয়ে রয়েছো। আমি একটি বিষয়ে তোমার সাথে আলাপ করতে চাই। এ কারণে তুমি একাকীই দলের মধ্যে থেকে বের হয়ে এসো। আমিও একাকী বের হচিছ। অতঃপর আমরা দু’জনে দু’বাহিনীর মধ্যবর্তী জায়গায় আলাপ করবো।
অতঃপর উভয়ে নিজ নিজ দল থেকে পৃথক হলেন এবং উভয় বাহিনীর মধ্যবর্তী জায়গায় পরস্পর আলোচনায় রত হলেন।
যূল্ কালা’ ঃ আমি এজন্য তোমাকে ডেকেছি যে, অতীতে (হযরত ওমরের শাসনামলে) ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের নিকট থেকে একটি হাদীছ শুনেছিলাম।
আবু নূহ্ ঃ হাদীছটি কী?
যূল্ কালা’ ঃ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ বলেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেছেন, শাম আর ইরাকের অধিবাসীরা পরস্পর মুখোমুখি হবে। তখন সত্য ও সঠিক নেতৃত্ব থাকবে একটি দলে। আর ‘আম্মার হবে সেই দলভুক্ত।
আবু নূহ্ ঃ আল্লাহ্র শপথ, ‘আম্মার আমাদের সাথেই রয়েছেন।
যূল্ কালা’ ঃ তিনি কি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ?
আবু নূহ্ ঃ হ্যাঁ, আল্লাহ্র শপথ, তিনি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের চেয়েও অধিক দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছে হলো, ইস্! তোমরা সবাই যদি একজন ব্যক্তি হতে আর আমি সকলকেই গলা কাটতাম আর সবার আগে তোমাকে দিয়েই শুরু করতাম, যদিও তুমি আমার চাচার পুত্র।
যূল্ কালা’ ঃ তুমি এরূপ প্রত্যাশা কেন করছো? আমি তো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করি নি। তোমাকে আমার নিকটাত্মীয়দের একজন বলে জানি। আমি তোমাকে হত্যা করতে চাই না।
আবু নূহ্ ঃ আল্লাহ্ ইসলামের বদৌলতে এক শ্রেণীর সম্পর্ককে ছিন্ন করে দিয়েছেন এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোকে সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছেন। তুমি এবং তোমার সঙ্গীরা নিজেদের আত্মিক সম্পর্ককে ছিন্ন করেছো। আমরা সত্যের ওপর রয়েছি আর তোমরা মিথ্যার ওপরে। কারণ, তোমরা কাফের নেতাদেরকে ও দলসমূহকে সাহায্য করছো।
যূল্ কালা’ ঃ তুমি কি প্রস্তুত আছো একসাথে আমরা শাম বাহিনী অভ্যন্তরে যাবো? আমি তোমাকে নিরাপত্তা দেবো। তোমাকে নিহত হতেও দেবো না, তোমার থেকে কিছু ছিনিয়ে নিতেও দেবো না। আর তোমাকে বাই‘আত হতেও হবে না। বরং আমার উদ্দেশ্য হলো ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছকে আলী (আঃ)-এর বাহিনীতে ‘আম্মার ইয়াসীরের উপস্থিতির কথাটি অবগত করতে হবে। হয়তো বা আল্লাহ্ দুই বাহিনীর মধ্যে সন্ধি ও শান্তি স্থাপন করে দেবেন।
আবু নূহ্ ঃ আমি তোমার এবং তোমার সঙ্গীদের চক্রান্তের ভয় করছি।
যূল্ কালা’ ঃ আমিই আমার নিজের কথার জন্য দায়বদ্ধ থাকবো।
আবু নূহ্ আকাশের পানে মুখ তুলে বললেন, “হে আল্লাহ্, তুমি জানো যে, যূল্ কালা’ আমাকে কেমন নিরাপত্তা দিয়েছে। তুমি আমার অন্তরের অবস্থা অবগত আছো। আমাকে তুমি রক্ষা করো।” একথা বলে আবু নূহ্ যূল্ কালা’র সাথে মু‘আবিয়াহ্র বাহিনী অভিমুখে হাঁটতে শুরু করলেন। উভয় যখন ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ও মু‘আবিয়াহ্র অবস্থানস্থলের নিকটবর্তী হলেন তখন দেখলেন যে, তাঁরা উভয়ই লোকজনকে যুদ্ধের জন্য উস্কানি দিচ্ছেন।
যূল্ কালা’ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্কে দেখে বললেন, “তুমি কি ‘আম্মার ইয়াসিরের ব্যাপারে একজন প্রজ্ঞাবান ও সত্যবাদী ব্যক্তির সাথে কথা বলতে চাও?”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ ঃ “লোকটি কে?”
যূল্ কালা’ আবু নূহের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, “সে হলো আমার চাচাতো ভাই এবং কূফার অধিবাসী।”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ আবু নূহের দিকে তাকালেন এবং বললেন, “আমি তোমার চেহারায় আবু তুরাব (আলী)-এর চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।”
আবু নূহ্ ঃ আমার চেহারায় মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের চিহ্ন রয়েছে আর তোমার চেহারায় রয়েছে আবু জেহেল আর ফিরাউনের চিহ্ন।
এ সময়ে মু‘আবিয়াহ্র বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি আবু আ‘ওয়ার উঠে দাঁড়ালো এবং তার তলোয়ার কোষমুক্ত করে বললো, “এই মিথ্যাবাদীকে Ñ যার চেহারায় আবু তুবাবের চিহ্ন রয়েছে Ñ এই মুহূর্তে হত্যা করবো। কারণ, সে এতোটা দুঃসাহস দেখাচ্ছে যে, আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে মন্দ বলছে।”
যূল্ কালা’ বললেন, “আল্লাহ্র শপথ, তার দিকে যদি হাত বাড়াও তাহলে তলোয়ার দিয়ে তোমার নাক গুঁড়িয়ে দেবো। এ হলো আমার চাচাতো ভাই; আমার দেয়া নিরাপত্তা নিয়েই সে এ আস্তানায় ঢুকেছে। আমি তাকে এ কারণে এনেছি যাতে ‘আম্মার ইয়াসিরের ব্যাপারে তোমরা অবগত হতে পারো যাকে নিয়ে তোমরা বিতর্কে লিপ্ত হয়েছো।”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ঃ তোমাকে আল্লাহ্র কসম দিয়ে বলছি সত্য বলবে। ‘আম্মার ইয়াসির কি তোমাদের মাঝে রয়েছে?
আবু নূহ্ ঃ আমি যতক্ষণ এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য কী জানতে না পারবো ততক্ষণ এর উত্তর দেবো না। তবে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর একদল ছাহাবী আমাদের মাঝে রয়েছেন যারা সকলেই তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ঃ আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে শুনেছি যে, ‘আম্মার ইয়াসিরকে অবাধ্য দল হত্যা করবে। ‘আম্মার সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না এবং জাহান্নামের আগুন তার ওপর হারাম।
আবু নূহ্ ঃ সেই আল্লাহ্র শপথ যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ নেই। তিনি আমাদের সাথেই রয়েছেন এবং তিনি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ঃ তিনি কি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চান?
আবু নূহ্ ঃ হ্যা, সেই আল্লাহ্র শপথ, যিনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ নেই, তিনি জামাল যুদ্ধে আমাকে বলেন, আমরা উষ্ট্র বাহিনী (আছ্হাবে জামাল)-এর ওপর বিজয়ী হবো। আর গতকাল তিনি আমাকে বলেন, যুদ্ধে যদি শাম বাহিনী আমাদের ওপর আক্রমণ করে এবং আমাদেরকে হিজ্র্ ভূখ- পর্যন্ত পিছু হটিয়ে দেয় তাহলেও আমরা যুদ্ধ থেকে বিরত হবো না। কারণ, আমরা জানি যে, আমরা সত্যের ওপরে রয়েছি আর তারা মিথ্যার ওপরে। আর আমাদের নিহতরা বেহেশতবাসী হবে এবং তাদের নিহতরা দোযখে যাবে।
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ঃ এমন কিছু কি করতে পারো যাতে আমি ‘আম্মার ইয়াসিরের সাথে সাক্ষাত করতে পারি?
আবু নূহ্ ঃ জানি না, কিন্তু চেষ্টা করবো যাতে এ সাক্ষাত সংঘটিত হয়।
আবু নূহ্ এরপর তাদের থেকে পৃথক হয়ে ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদলে প্রত্যাবর্তন করলেন যেখানে হযরত ‘আম্মার ইয়াসির ছিলেন সেখানে গেলেন। তাঁর কাছে গিয়ে ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। তিনি আরো বললেন, “বার জন লোকের একটি দল Ñ যাদের মধ্যে ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্-ও থাকবে, আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায়।”
হযরত ‘আম্মার ইয়াসির সাক্ষাতের ব্যাপারে তাঁর সম্মতির কথা জানালেন। অতঃপর ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর মধ্য থেকে একদল অশ্বারোহী সৈন্য এগিয়ে চললো এবং সেনা অবস্থানের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছার পর হযরত ‘আম্মারের দল থেকে ‘আওফ্ ইবনে বাশীর নামক একজন সৈন্য শাম বাহিনীর অবস্থান-সীমানায় প্রবেশ করলো এবং উচ্চৈঃস্বরে বললো ঃ “আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ কোথায়?” তারা বললো ঃ “এখানেই রয়েছেন।” ‘আওফ্ ‘আম্মার ইয়াসিরের অবস্থানস্থল দেখিয়ে দিলো। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ প্রস্তাব দিলেন যে, হযরত ‘আম্মার যেন শাম বাহিনীর অভিমুখে চলে আসেন। ‘আওফ্ উত্তর দিলেন, “তোমাদের ছলনা-প্রতারণা থেকে কোনো নিরাপত্তা নেই।”
অবশেষে স্থির হলো, দু’জনই স্ব স্ব পক্ষের একদল লোক সাথে নিয়ে উভয়ের পসন্দমতো দু’বাহিনীর মধ্যবর্তী একটি স্থানে বৈঠকে বসবেন।
উভয় পক্ষ স্থিরিকৃত স্থানের দিকে এগিয়ে চললো, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও সতর্ক থাকতে ভোলে নি। অবতরণ করার সময় তাদের হাতগুলো তলোয়ার ধরে রেখেছিলো। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ‘আম্মার ইয়াসিরের সাথে বৈঠকের সময় উচ্চৈঃস্বরে কালেমায়ে তাইয়্যেবাহ্ ও কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে পড়তে আলোচনা শুরু করলেন যাতে এর মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কথা প্রকাশ করতে সক্ষম হন। কিন্তু হযরত ‘আম্মার তাঁর এ প্রতারণার ফাঁদে পা দিলেন না। তিনি ধমক দিয়ে বলে উঠলেন ঃ “থামো। তুমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা বর্জন করেছো। এখন আবার কীভাবে তা দ্বারা শ্লোগান দিচ্ছো?”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ বললো ঃ “হে ‘আম্মার! আমরা এসব বিষয়ে কথা বলতে বসি নি। আমি তোমাকে এ বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পেয়েছি। তাই বলতে চাই যে, কেন আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে? অথচ আমাদের আল্লাহ্, কিবলাহ্ ও কিতাব সবই তো অভিন্ন।”
হযরত ‘আম্মার সংক্ষিপ্ত কথাবার্তার পরে বললেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, আমি অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদের ও সত্য থেকে পথভ্রষ্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। ইতিমধ্যে অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করেছি, আর এখন তোমরা হলে সত্য থেকে পথভ্রষ্ট দল। তবে জানি না, যারা দ্বীন থেকে খারিজ হবে সে দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুযোগ আমার হবে কিনা।” এরপর ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন ঃ “হে নিষ্ফলা-বন্ধ্যা! তুমি জানো যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আলী সম্পর্কে বলেছেন,
مَنْ کُنْتُ مَولاهُ فَعَلِيٌّ مَولاهُ الّلهُمَّ والِ مَنْ والاهُ وَ عَادِ مَنْ عَاداهُ
“আমি যাদের মাওলা এ আলী তাদের মাওলা। হে আল্লাহ্! যে আলীকে ভালবাসে তুমি তাকে ভালবাসো আর যে আলীর সাথে শত্রুতা করে তুমি তার সাথে শত্রুতা করো।”
উভয় পক্ষের এ বৈঠক হযরত ওসমানের হত্যা সম্পর্কে কিছু কথাবার্তার পরে শেষ হলো এবং উভয় দল পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে স্ব স্ব অবস্থানস্থলে প্রত্যাবর্তন করলো।১৩০
এই সাক্ষাত থেকে বুঝা যায় যে, ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ জানতে চাচ্ছিলেন না যে, হযরত ‘আম্মার হযরত আলী (আঃ)-এর বাহিনীতে যোগদান করেছেন কিনা। কেননা, তিনি আলী (আঃ)-এর সৈন্যদলের নেতাদেরকে ভালোভাবেই চিনতেন। এ কারণেই তিনি হযরত ‘আম্মারের যুক্তির বিপরীতে হযরত ওসমানের হত্যার প্রসঙ্গ টেনে এনে বিতর্ক ও বাকবিত-ায় লিপ্ত হন যাতে তাঁর কাছ থেকে এ স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেন যে, ওসমান হত্যাকা-ে তিনিও জড়িত ছিলেন, আর এ পন্থায় শাম বাহিনীকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে পারেন। অবশ্য মু‘আবিয়াহ্ ও ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের ভাগ্য ভালো ছিলো যে, যূল্ কালা‘ হযরত ‘আম্মারের আগে নিহত হন। কেননা, তিনি হযরত ‘আম্মার ইয়াসিরের পরে বেঁচে থাকলে ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ আর তাঁর ভিত্তিহীন কথাবার্তা দ্বারা তাঁকে ধোঁকা দিতে পারতেন না। ফলে যূল্ কালা’ নিজেই তখন শামী সৈন্যদের মধ্যে মু‘আবিয়াহ্ ও ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের জন্য একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতেন। এ কারণে যূল্ কালা‘ নিহত হওয়ার এবং ‘আম্মার ইয়াসির শহীদ হওয়ার পর ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ মু‘আবিয়াকে বলেন, “আমি জানি না এ দু’জনের কার মৃত্যুর জন্য বেশি খুশি হবো। যূল্ কালা‘ নিহত হওয়ার জন্য, নাকি ‘আম্মার ইয়াসির নিহত হওয়ার জন্য? আল্লাহ্র শপথ, ‘আম্মার ইয়াসির নিহত হওয়ার পর যূল্ কালা‘ বেঁচে থাকলে গোটা শাম বাহিনীকে আলীর কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতো।”১৩১
ছিফ্ফীন যুদ্ধে ইমাম আলী (আঃ)-এর বীরত্ব
ইমাম আলী (আঃ) সর্বাধিনায়ক হিসাবে মু‘আবিয়াহ্ কিম্বা ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের ন্যায় ছিলেন না যে, একটি নিরাপদ স্থানে ঘাঁটি করে তাঁবুর ভেতরে আশ্রয় নেবেন এবং নিজের সুরক্ষার জন্য অগণিত সৈন্যকে প্রহরায় নিযুক্ত করবেন, আর বিপদ অনুভব করলে পলায়নের পথে পা বাড়াবেন। বরং তিনি তাঁর সেনা অধিনায়কের দায়িত্বকে রণাঙ্গনের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থানরত সৈন্যদের মাঝে ঘুরে ঘুরে পালন করেন এবং কঠিন মুহূর্তেও সৈন্যদের অগ্রভাবে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যান। আর ভারী আক্রমণের সময় বিজয়ের চাবিকাঠি ছিলো তাঁর পবিত্র ও বলিষ্ঠ হাতে।
এখানে আমরা ইমাম (আঃ)-এর সে সব বীরত্বের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরবো। এগুলোর বিস্তরিত বিবরণ ইবনে মুযাহিম রচিত “ওয়াক্ব‘এ-এ ছিফ্ফীন” গ্রন্থে এবং “তারীখে ত্বাবারী”তে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
(১) মুহুর্মুহু তীরবর্ষণের মাঝে ইমাম (আঃ)
সেনাপতি আবদুল্লাহ্ ইবনে বাদীলের নিহত হওয়ার ফলে ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর ডান পার্শ্বের সেনাব্যূহ বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। মু‘আবিয়াহ্ হাবীব ইবনে মুসলিমাহ্কে ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর ডান পার্শ্বের অবশিষ্ট সৈন্যদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার দায়িত্ব দিলেন। অপর দিকে ইমাম (আঃ) সাহ্ল্ ইবনে হুনাইনকে ডান পার্শ্বের বাহিনীকে পুনর্বিন্যস্ত করার দায়িত্ব দিলেন। কিন্ত তাঁর এ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হলো না। ছত্রভঙ্গ উদভ্রান্ত সৈন্যরা পিছু হটে এলো এবং মধ্যভাগে Ñ যেখানে স্বয়ং আলী (আঃ) সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেখানে এসে যোগ দিলো। ইতিহাস এখানে রাবি‘আহ্ গোত্রের প্রতিরোধ আর মুদার গোত্রের লাঞ্ছনা ও পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেছে। এ পরিস্থিতিতে ইমাম (আঃ) এগিয়ে গেলেন এবং সশরীরে যুদ্ধে নেমে পড়লেন।
ছিফ্ফীন যুদ্ধের Ÿর্ণনাকারী যায়েদ ইবনে ওয়াহাব বলেন, ইমাম (আঃ)-এর সন্তানগণ আশঙ্কা করছিলেন যে, তিনি শত্রুর তীরে বিদ্ধ হয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হন কিনা। এ কারণে, তাঁরা ইমাম (আঃ)-এর ইচ্ছার বিপরীতে প্রতিরক্ষার ঢাল স্বরূপ তাঁর চারপাশে ঘিরে থাকেন। কিন্তু ইমাম (আঃ) তাঁদেরকে উপেক্ষা করে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং শত্রুদেরকে পিছু হটিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ ইমাম তাঁর সম্মুখভাগে দেখলেন যে, তাঁর গোলাম কীসান ও আবু সুফিয়ানের গোলাম আহ্মারের মাঝে লড়াই চলছে এবং শেষাবধি কীসান নিহত হলো। আবু সুফিয়ানের গোলাম স্বীয় বিজয়ে অহঙ্কারীর বেশে উলঙ্গ তরবারী নিয়ে ইমাম (আঃ)-এর দিকে এগিয়ে এলো। কিন্তু তিনি লড়াইয়ের প্রথম মুহূর্তেই তাকে গলা ধরে নিজের দিকে টেনে আনলেন এবং ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এমনভাবে সজোরে মাটিতে আছাড় দিলেন যে, তার ঘাড় ও কাঁধদ্বয় ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে গেলো। অতঃপর তাকে ছেড়ে দিলেন। এ সময় ইমাম আলী (আঃ)-এর পুত্র ইমাম হুসাইন (আঃ) ও মুহাম্মাদ হানাফীয়াহ্ তাঁদের তলোয়ার দ্বারা আহ্মারকে শেষ করে দিয়ে ইমামের কাছে ফিরে এলেন।
ইমাম মৃদু হেসে তাঁর পুত্র হাসান (আঃ)কে বললেন, “কেনো তোমার ভাইদের মতো তাকে হত্যা করতে গেলে না?” ইমাম হাসান (আঃ) উত্তর দিলেন ঃ كَفَيانِي يا أميِرَ الْمُؤمنِيِنَ“তাঁরা দু’জনই যথেষ্ট ছিলো, হে আমীরুল মু’মিনীন।”
যায়েদ ইবনে ওযাহাব বলেন, ইমাম (আঃ) যতই শাম বাহিনীর নিকটবর্তী হচ্ছিলেন ততই তাঁর গতি বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ইমাম হাসান (আঃ) ভয় পাচ্ছিলেন যে, মু‘আবিয়াহ্র বাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলতে পারে, ফলে তাঁর জীবন বিপদাপন্ন হয়ে পড়বে। এ কারণে তিনি ইমামকে বললেন, “কিছুটা বিলম্ব করলে ভালো হতো যাতে রাবি‘আহ্ গোত্র থেকে আপনার ত্যাগী ও দৃঢ়পদ সৈন্যরা এসে আপনার সাথে যোগ দিতে পারে।”
ইমাম (আঃ) পুত্রের কথার জবাবে বললেন ঃ
إِنَّ لِأَبِيكَ يَوْماً لا يَعْدُوهُ وَ لاَ يُبْطِِئُ بهِ عَنْهُ السَّعْيُ وَ لاَ يُعَجِّلُ بِهِ إِلَيهِ الْمَشْيُ. إِنَّ اَباكَ وَ اللهِ لا يُبَالِي وَقَعَ عَلَي الْمَوْتِ أوْ وُقِعَ الْمَْوْتُ عَلَيهِ.
“তোমার পিতার জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন রয়েছে যা অতিক্রম করবে না। বিলম্ব করলে যেমন তা পিছিয়ে যাবে না তদ্রƒপ (শত্রুর দিকে) অগ্রসর হওয়ার কারণে তা এগিয়ে আসবে না। আর তোমার পিতা এ চিন্তা করে না যে, সে মৃত্যুর সন্ধানে যাবে, নাকি মৃত্যু তার সন্ধানে আসবে।”১৩২
আবু ইসহাক বলেন ঃ ইমাম (আঃ) ছিফ্ফীনের এক দিনে যখন ছোট একটি বর্শা হাতে নিয়ে সা‘ঈদ বিন্ ক্বায়স্ নামক তাঁর এক সেনাপতির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সা‘ঈদ তাঁকে বললোঃ “আপনি কি এমন আশঙ্কা করছেন না যে, শত্রুদের এত নিকটবর্তী অবস্থায় হঠাৎ তাদের হাতে নিহত হতে পারেন?”
জবাবে ইমাম (আঃ) বললেন ঃ
إنّهُ لَيْسَ مِنْ أَحَدٍ الّا عَلَيْهِ مِنَ اللهِ حَفَظَةٌ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَنْ يَتَرَدّيٰ فِي قَليِبٍ أَوْ يَخِرَّ عَلَيْهِ حَائِطٌ أو تُصِيبَهُ آفَةٌ. فَإذَا جَاءَ الْقَدَرُ خَلَوا بَيْنَهُ وَ بَُيْنَهُ.
“এমন কেউ নেই যার ওপরে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রহরীরা থাকে না যাতে তাকে কুয়ার মধ্যে পড়া থেকে কিম্বা দেয়ালের ফাঁকে চাপা পড়া থেকে অথবা অন্য বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে। সুতরাং যখন আল্লাহ্র নির্ধারিত সময় উপনীত হয় তখন তারা তাকে ছেড়ে চলে যায় এবং সে নিয়তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।”১৩৩
(২) মু‘আবিয়ার গোলাম হারীছ্কে হত্যা
শাম বাহিনীর মধ্যে একজন বড় বীর ছিলো মু‘আবিয়ার গোলাম হারীছ্। সে কখনো কখনো মু‘আবিয়ার পোশাক গায়ে দিয়ে যুদ্ধ করতো। আর যারা জানতো না তারা মনে করতো যে, স্বয়ং মু‘আবিয়াহ্ যুদ্ধ করছেন।
একদিন মু‘আবিয়াহ্ তাকে ডেকে পাঠালেন এবং বললেন, আলীর সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকো, এছাড়া আর যাকে চাও তোমার বর্শার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারো। সে ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের কাছে গেলো এবং মু‘আবিয়ার কথাকে তাঁর কাছে বর্ণনা করলো। ‘আম্র্ (যে উদ্দেশ্যেই হোক) মু‘আবিয়ার মতামতকে ভুল বলে অভিহিত করলেন এবং বললেন, “তুমি যদি কুরাইশী হতে তাহলে মু‘আবিয়াহ্ চাইতেন তুমি আলীকে হত্যা করো। কিন্তু এ গৌরব কোনো অ-কুরাইশী ব্যক্তির হোক তা তিনি চান না। সুতরাং যদি সুযোগ পাও তাহলে আলীর ওপরও আক্রমণ করবে।”
ঘটনাক্রমে সেদিনই ইমাম (আঃ) স্বীয় অশ্বারোহী বাহিনীর অগ্রভাগে থেকে রণাঙ্গনে এলেন। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের কথায় প্রভাবিত হারীছ এ সুযোগে আলী (আঃ)কে লড়াইয়ের জন্য আহ্বান জানালো। ইমাম (আঃ) কিছু যুদ্ধের শ্লোক আবৃত্তি করতে করতে এগিয়ে গেলেন এবং লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। প্রথম মুহূর্তেই তিনি প্রচ- এক আঘাতে তাকে দু’খ- করে দিলেন। এ খবর যখন মু‘আবিয়ার কাছে পৌঁছলো তখন তিনি অতি মাত্রায় বিষণœ হলেন এবং ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছকে দায়ী করে তাকে প্রতারক আখ্যা দিলেন। একটি কবিতার মাধ্যমে তিনি তাঁর এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন যার প্রথম অংশ নিম্নরূপ ঃ
حَـرِيثٌ اَلَمْ تَعْلَمْ وَ جَهْلُكَ ضَائِرٌ بِـاَنَّ عَلِيــاً لِلْفـَوارِسِ قَـاهِـرٌ
و َاِنَّ عَلِيـاً لـَمْ يُبـَارِزُهُ فـَارِسٌ مِنَ النَّاسِ الّا اقْصَـدَتْهُ الْأَظَافـِرُ
“হে হারীছ! যালেম ব্যক্তি তোমাকে বোকা বানিয়েছে; তুমি কি জানতে না/ যে, আলী সকল বীরদের ওপর বিজয়ী বীর/ কোনো বীরই আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে নি/ আলী যাকে তার পাঞ্জা দ্বারা ধরাশায়ী করে নি।”
হারীছের হত্যা মু‘আবিয়ার বাহিনীর মধ্যে এক আতঙ্ক ও ক্রোধের জন্ম দিলো। তাই ইমাম (আঃ)-এর কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ‘আম্র্ ইবনে হাছীন্ নামে আরেক জন বীর রণাঙ্গনে প্রবেশ করলো। কিন্তু ইমাম (আঃ)-এর কাছে পৌঁছার আগেই সা‘ঈদ ইবনে ক্বায়স্ নামক তাঁর এক সেনাপতির হাতে সে নিহত হয়।১৩৪
(৩) মু‘আবিয়াকে লড়াইয়ের জন্য ইমামের (আঃ) আহবান
একদিন ইমাম (আঃ) রণাঙ্গনে এলেন এবং দুই বাহিনীর মাঝখানে দাঁড়ালেন। তিনি শেষ বারের মতো মু‘আবিয়ার সামনে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে চাইলেন।
ইমাম (আঃ) ঃ মু‘আবিয়াহ্, মু‘আবিয়াহ্, মু‘আবিয়াহ্!
মু‘আবিয়াহ্ তাঁর বিশেষ কর্মচারীদেরকে বললেন, “যাও এবং তার উদ্দেশ্য কী আমাকে জানাও।”
কর্মচারীরা ঃ হে আবু তালেবের পুত্র! আপনি কী চান?
ইমাম (আঃ) ঃ তার সাথে আমি একটি কথা বলতে চাই।
মু‘আবিয়াকে তাঁর কর্মচারীরা বললো ঃ “আলী স্বয়ং আপনার সাথে কথা বলতে চান।” তখন মু‘আবিয়াহ্ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছকে সঙ্গে নিয়ে রণাঙ্গনে এলেন এবং ইমাম (আঃ)-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ইমাম (আঃ) ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের প্রতি ভ্রƒক্ষেপ না করেই মু‘আবিয়াকে বললেন, “আফসোস তোমার জন্যে; আমাদের জনগণ একে অপরকে হত্যা করবে কেন? কতই না ভালো হয়, এসো, ময়দানে আমরা পরস্পরে যুদ্ধে নামি। অতঃপর যে জয়লাভ করবে সে শাসনকর্তৃত্ব লাভ করবে।”
মু‘আবিয়াহ্ ঃ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ! এ প্রসঙ্গে তোমার মতামত কী?
‘আম্র্ ঃ আলী ন্যায্য কথা বলেছেন। তুমি যদি তা এড়িয়ে যাও তাহলে এমন এক কলঙ্ক তোমার গায়ে এবং তোমার খান্দানের গায়ে লাগবে যাতে আরবরা যতদিন বেঁচে থাকবে এ কলঙ্ক মুছবে না।
মু‘আবিয়াহ্ ঃ আম্র্, আমার মতো লোক তোমার প্রতারণার শিকার হয় না। এমন কোনো বীর নেই যে, আলীর সাথে লড়াইতে অবতীর্ণ হয়েছে আর তার রক্ত দ্বারা মাটি রঞ্জিত হয় নি। এ কথা বলার পর তাঁরা দু’জনে নিজেদের বাহিনীর কাছে ফিরে গেলেন।
ইমাম (অঃ)ও মুচকি হাসলেন এবং নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করলেন।
মু‘আবিয়াহ্ আম্রের দিকে তাকলেন এবং বললেন, “তুমি কতই না নির্বোধ!” তিনি আরো বললেন, “আমার ধারণা, তোমার ঐ প্রস্তাবটি প্রকৃত ছিলো না, বরং তুমি রসিকতা করেছো।”১৩৫
শহীদ-পুত্রের সাহসিকতা
ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের মধ্যে হাশেম র্মেক্বাল্ ছিলেন একজন সাহসী ও দুর্ধর্ষ সেনাপতি। ইসলামের বিজয় ইতিহাসে তাঁর উজ্জ্বল ভূমিকা কারো অজানা ছিলো না। মনে করা হচ্ছিলো যে, তাঁর শাহাদাতের কারণে ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা সৃষ্টি হবে। কিন্তু তাঁর পুত্রের অগ্নিঝরা বক্তৃতা গোটা পরিস্থিতিকে বদলে দিলো এবং তাঁর পথের পথিকদেরকে এ পথে অগ্রসর হতে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুললো। তিনি পিতার পতাকাটি হাতে তুলে নিলেন এবং সত্যের জন্য আত্মোৎসর্গকারী সৈন্যদের উদ্দেশে বক্তৃতায় বললেন ঃ
“হাশেম ছিলেন আল্লাহ্র বান্দাহ্দের মধ্যে একজন Ñ যার রুযী ছিলো সীমাবদ্ধ এবং যার কাজসমুহ খোদায়ী নথিতে লিপিবদ্ধ ছিলো। তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে আসে এবং আল্লাহ্ Ñ যার সাথে কোনো বিরোধিতা চলে না Ñ তিনি তাঁকে নিজের কাছে ডেকে নিয়েছেন। আর তিনিও আল্লাহ্র সাক্ষাতে ছুটে গেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর চাচাতো ভাইয়ের পথে জিহাদ করেছেন Ñ এমন ব্যক্তির পথে যিনি ছিলেন সর্বপ্রথম ঈমান আনয়নকারী এবং যিনি আল্লাহ্র দ্বীন সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী আর আল্লাহ্র শত্রুদের কঠোর বিরোধী Ñ যে শত্রুরা আল্লাহ্র হারামকে হালালে পরিণত করে এবং জনগণের মধ্যে স্বেচ্ছাচার ও অত্যাচারের মাধ্যমে শাসন করে, শয়তান তাদের ওপরে চেপে বসেছে আর তাদের মন্দ কর্মগুলোকে তাদের চোখে সুন্দর প্রতিপন্ন করে দিয়েছে। এখন তোমাদের দায়িত্ব হলো যারা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পথের বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং আল্লাহ্র বিধানগুলোকে অমান্য করেছে আর তাঁর বন্ধুদের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। এ জগতে তোমাদের পবিত্র জীবনকে আল্লাহ্র আনুগত্যের পথে উৎসর্গ করো যাতে পরকালে উৎকৃষ্টতম মর্যাদায় আসীন হতে পারো।”
এরপর তিনি বললেন ঃ
فَلَوْ لَمْ يَكُنْ ثَوابٌ وَ لاَ عِقَابٌ وَ لاَ جَنَّةٌ وَ لاَ نَارٌ لَكَانَ الْقِتالُ مَعَ عَلِيٍّ اَفْضَلَ مِنَ القِتَالِ مَعَ مُعَاوِيةَ ابْنِ آكِلَةِ الْاَكْبَادِ. وَ كَيفَ اَنتُمْ تَرْجُونَ مَا تَرْجُونَ.
“যদি ধরে নেয়া হয় যে, পুরস্কার, শাস্তি, বেহেশত, দোযখ কিছুই সত্য নয়, তারপরও আলীর সাথী হয়ে যুদ্ধ করা কলিজাখোরের পুত্র মু‘আবিয়ার সাথী হয়ে যুদ্ধ করার চেয়ে উত্তম। আর কেনোই বা তা হবে না যখন তোমরা আশা করে থাকো যা আশা করা হয়?”১৩৬
তখনো শহীদ সেনাপতি তনয়ের বক্তৃতার রেশ কাটে নি এমন সময় ইমামের (আঃ) অন্যতম নিষ্ঠাবান অনুসারী আবুত তুফাইল ছাহ্হাবী হাশেমের শোকে একটি শোকগাথা রচনা করলেন। শোক গাথাটির প্রথম দ্বিপদীটি এরূপ ঃ
يا هَاشِمَ الْخَيرِ جَزَيتَ الْجَنَّةَ قَاتَلْتَ فِي اللهِ عَدُوَّ السُّنَّةِ
“হে হাশেম, মোবারকবাদ, পুরস্কার হোক জান্নাত তোমার/ আল্লাহ্র রাহে যুদ্ধ করেছা তুমি সুন্নাতের শত্রুর সাথে।”১৩৭
©somewhere in net ltd.