![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সিংহের থাবায় শৃগাল
যুদ্ধের প্রচ-তা ও লড়াইয়ের তীব্রতা গোটা রণাঙ্গন শামী সৈন্যদের জন্য সঙ্কীর্ণ করে দিয়েছিলো। যুদ্ধের হোতারা অন্যদেরকে সান্ত¡না দেয়ার ও নিজ নিজ বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার জন্য নিজেরাও রণাঙ্গনে প্রবেশ করতে বাধ্য হলেন। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের হারেছ ইবনে নাছ্র নামে একজন শত্রু ছিলো। যদিও তাঁরা দু’জনই ছিলেন একই মতাদর্শের অনুসারী, কিন্তু‘ পরষ্পরের অনিষ্টকামী ছিলেন। হারেছ তাঁর ক্বাছিদায় আম্রের নিন্দা করে বলেন, “কেন সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে না, শুধু অন্যদেরকে কেন ময়দানে পাঠাচ্ছে?”
তার এ ক্বাছিদাহ্ শাম বাহিনীর মাঝে প্রচারিত হলো। তখন ‘আম্র্ নিরূপায় হয়ে একবারের জন্য হলেও রণাঙ্গনে ইমামের মুখোমুখি হতে বাধ্য হন। কিন্তু এ কূটবুদ্ধি রাজনীতিক রণাঙ্গনেও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করলেন। ইমাম (আঃ) যখন তাঁর মুখোমুখি হলেন তখন আম্র্কে কোনো সুযোগই দিলেন না, বর্শার আঘাতে তাঁকে ধরাশায়ী করলেন। ‘আম্র্ যেহেতু ইমাম (আঃ)-এর পৌরুষের কথা জানতেন সেহেতু দ্রুত উলঙ্গ হয়ে গেলেন এবং ইমামকে তাঁকে ধাওয়া করা থেকে বিরত করে দিলেন। আরইমাম (আঃ) তৎক্ষণাৎ নিজের চোখ ফিরিয়ে নিলেন এবং তাঁকে ছেড়ে দিলেন।”১৩৮
মালেক আশ্তারের মুখোমুখি ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ
রণাঙ্গনে মালেক আশ্তারের প্রতাপ দেখে মু‘আবিয়ার চোখের ঘুম চলে গিয়েছিলো। এ কারণে তিনি মারওয়ান ইবনে হাকামকে একদল সৈন্য সঙ্গে নিয়ে মালেককে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু মারওয়ান এ দায়িত্ব গ্রহণ করলো না। সে বললো, “আপনার সবচেয়ে নিকটবর্তী ব্যক্তি হলো ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ Ñ যাকে আপনি মিসরের হুকুমাত প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কাজেই উত্তম হলো এ দায়িত্বটি তার ওপরেই ন্যস্ত করুন। আপনার গোপন কথা তো তার কাছেই বলেন, আমার কাছে নয়। আপনি তাকে বদান্যতায় ভরে দিয়েছেন আর আমাকে বঞ্চিতদের দলে ফেলে রেখেছেন।”
তখন অনন্যোপায় হয়ে মু‘আবিয়াহ্ একদল সৈন্য নিয়ে মালেক আশ্তারের সাথে মোকাবিলা করার জন্য ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন। কারণ, মালেক আশ্তারের যুদ্ধ পরিচালনা এবং অতুলনীয় সাহসিকতা শাম সেনাদের সারিগুলোকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছিলো।
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ র্মাওয়ানের বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, অগত্যা দায়িত্বকে গ্রহণ করলেন। কিন্তু মালেক আশ্তারের মুখোমুখি হওয়ার সময় ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো। তবে তিনি পলায়নের অপমান মেনে নিতেও প্রস্তুত হলেন না।
উভয় পক্ষে যুদ্ধের শ্লোক আবৃত্তি শেষ হলো এবং উভয়ই পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ‘আম্র্ আশ্তারের ওপর আক্রমণের সময় নিজেকে পিছিয়ে নিলেন এবং মালেকের বর্শা তাঁর মুখে আঁচড়ে দিয়ে গেলো। ‘আম্র্ প্রাণভয়ে মুখের ক্ষতকে অজুহাত করে এক হাতে ঘোড়ার লাগাম আর অন্য হাত দ্বারা মুখের ক্ষত চেপে ধরেন এবং দ্রুত বেগে শাম বাহিনীর কাছে ফিরে গেলেন। রণাঙ্গন থেকে তাঁর পলায়নের কারণে সৈন্যরা মু‘আবিয়ার কাছে প্রতিবাদ জানালো যে, এমন ভীরু ও কাপুরুষ লোককে তাদের সেনাপতি করা হলো কেন?১৩৯
দুনিয়াত্যাগী যুবক ও দুনিয়াপূজারী বৃদ্ধ
একদিন মালেক আশ্তার ইরাকী সেনাদের মাঝে চীৎকার করে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির বিনিময়ে তার জীবনকে বিক্রয় করতে প্রস্তুত!” আছাল্ ইবনে হিজ্ল্ নামক জনৈক যুবক এগিয়ে এলো। মু‘আবিয়াহ্ও হিজ্ল্ নামক একজন বয়স্ক লোককে উক্ত যুবকের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ময়দানে পাঠালেন।
দুই যোদ্ধা যখন নিজ নিজ বর্শাকে অপরের দিকে তাক করে ধরে রেখেছিলো, এমতাবস্থায় তারা তাদের মধ্যকার সম্পর্কের কথা বর্ণনা করতে লাগলো। হঠাৎ বুঝা গেলো যে, তারা পিতা-পুত্র। পিতা পুত্রকে বললো, “হে বাছা! দুনিয়ার দিকে চলে এসো।” পুত্র বললো, “বাবা, পরকালের দিকে চলে এসো। তোমার জন্য সমীচীন ছিলো যে, আমি যদি দুনিয়ার পথে পা বাড়াই এবং শামী বাহিনীতে যোগ দেই তাহলে তুমি আমাকে এ পথ থেকে বিরত রাখবে। আলী এবং সৎকর্মশীল মু’মিন ব্যক্তিদের সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?”
শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, উভয়ে নিজ নিজ^ স্থানে ফিরে যাবে।১৪০
বস্তুত যে যুদ্ধের মূল হচ্ছে স্বীয় চিন্তা-বিশ্বাসের হেফাযত সেখানে একমাত্র দ্বীনী সম্পর্ক ব্যতীত অন্য সব ধরনের সম্পর্কই দুর্বল ও প্রভাবহীন হয়ে যায়।
শামী সেনাদের নৈতিক দুর্বলতা
মু‘আবিয়ার বাহিনীর একজন সেনাপতি ছিলো আব্রাহা। মু‘আবিয়ার সৈন্যদের অধিক সংখ্যায় নিহত হতে দেখে সে বড়ই মনঃকষ্টে ভুগছিলো। সে নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করছিলো যে, শামী সেনারা মু‘আবিয়াহ্ নামক এক ব্যক্তির কামনার বলি হচ্ছে। এ কারণে সে শাম নিবাসী ইয়ামানী লোকদের মাঝে চিৎকার করে বললো, “ধিক্ তোমাদের! হে ইয়ামানের লোকেরা, তোমরা যারা নিজেদের বিনাশ চাও। এই দুই ব্যক্তি (আলী ও মু‘আবিয়াহ্)কে তাদের অবস্থায় ছেড়ে দাও যাতে তারা দু’জনে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অতঃপর যে জয়লাভ করবে আমরা তাকেই অনুসরণ করবো।”
আব্রাহার এ কথা ইমাম (আঃ)-এর কানে পৌঁছলে তিনি বললেন, “সে বড় ন্যায্য কথা বলেছে। আমি যেদিন শাম ভূখ-ে পা রেখেছি সেদিন থেকে এমন সুন্দর কথা আর শুনি নি।”
এ প্রস্তাবের কথা ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মু‘আবিয়াহ্ ভয়ে কেঁপে উঠলেন। তিনি নিজেকে সৈন্যদের শেষ প্রান্তে পৌছালেন এবং তাঁর চারপাশের লোকদেরকে বললেন, “আব্রাহার মতিভ্রম ঘটেছে।”
কিন্তু ইয়ামানের লোকেরা এক বাক্যে বলছিলো যে, আব্রাহা ধর্ম, বুদ্ধি ও সাহসের দিক থেকে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এমতাবস্থায় সৈন্যদের মনোবল রক্ষা করার জন্য ‘র্উওয়াহ্ দামেশ্কী রণাঙ্গনে প্রবেশ করলো এবং চীৎকার করে বললো, “মু‘আবিয়াহ্ যদি আলীর সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায় তাহলে, হে আলী! আমার সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।”
আলী (আঃ)-এর বন্ধুরা তাঁকে ‘র্উওয়াহ্র সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখতে চাইলো। কিন্তু ইমাম তা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি বললেন, “আমাদের চোখে মু‘আবিয়াহ্ আর ‘র্উওয়াহ্ এক সমান। একথা বলেই তিনি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং এক কোপে তাকে এমনভাবে দ্বিখ-িত করে দিলেন যে, একক খ- একেক পাশে গিয়ে পড়লো। উভয় বাহিনীর সৈন্যরাই ইমাম (আঃ)-এর আঘাত হানার প্রচ-তা দেখে কেঁপে উঠলো। এরপর ইমাম তার দু’খ- হয়ে যাওয়া লাশকে সম্বোধন করে বললেন ঃ “সেই আল্লাহ্র শপথ, যিনি নবীকে নবুওয়াত দিয়ে প্রেরণ করেছেন, আগুন দেখেছো এবং অনুতপ্ত হয়েছো।”
এমন সময় ‘র্উওয়ার চাচাতো ভাই প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রুখে দাঁড়ালো এবং ইমামের সাথে যুদ্ধ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু ইমাম (আঃ)-এর তলোয়ারের আঘাতে সে-ও ‘র্উওয়ার সাথে গিয়ে মিলিত হলো।১৪১
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
শামের জনগণের ক্রোধ রণাঙ্গনে ইমাম (আঃ)-এর অতুলনীয় সাহসিকতার কাছে পানি হয়ে গিয়েছিলো। মু‘আবিয়াহ্ একটি টিলার ওপর থেকে এ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলেন। মনের অজান্তে এক সময় তিনি শামের লোকদেরকে তিরষ্কার করে বললেন, “ধ্বংস হও তোমরা। তোমাদের মধ্যে কি কেউ নেই যে, আবুল হাসানকে [আলী (আঃ)কে] গুপ্ত আক্রমণের মাধমে কিম্বা যুদ্ধে দুই বাহিনীর মিশ্রিত অবস্থায় অথবা যুদ্ধ থেকে উত্থিত ধূলিমেঘের আড়ালে হত্যা করতে সক্ষম হবে?”
ওয়ালীদ ইবনে ‘উতবাহ্, মু‘আবিয়ার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। সে তাঁকে বললো, “আপনিই এ কাজে অন্যদের চেয়ে শ্রেয়তর।” মু‘আবিয়াহ্ বললেন, “আলী একবার আমাকে লড়াইয়ে আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু আমি কখনোই তার সাথে যুদ্ধে যাবো না। কারণ, সৈন্যরা হলো সেনাপতিকে রক্ষা করার জন্য।”
অবশেষে তিনি বুস্র্ ইবনে র্আতাহ্কে ইমাম (আঃ)-এর মোকাবিলায় যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করলেন এবং বললেন, “তার সাথে ধুলিমেঘের মধ্যে মোকাবিলায় নামবে।”
বুস্রের চাচাতো ভাই Ñ যে সবেমাত্র হেজায থেকে শামে প্রবেশ করেছিলো Ñ তাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু বুস্র্ যেহেতু মু‘আবিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছে সে কারণে রণাঙ্গনের দিকে রওয়ানা হলো। লৌহ বর্মে সারা শরীর আবৃত অবস্থায় রণাঙ্গনে এসে সে আলী (আঃ)কে যুদ্ধের জন্য আহ্বান করলো। কিন্তু ইমামের বর্শার আঘাতে সে-ও ধরাশায়ী হলো। তখন সে-ও ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের ন্যায় নিজেকে উলঙ্গ করে ফেললো এবং এভাবে তাকে ধাওয়া করা থেকে ইমামকে বিরত রাখলো।১৪২
সন্ধির জন্য মু‘আবিয়ার পীড়াপীড়ি
ছিফ্ফীনের সর্বাত্মক যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া এবং শামী সেনাদের হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া Ñ এ দুই কারণে মু‘আবিয়াহ্ যুদ্ধ পরিত্যাগ করে সন্ধি ও আপোস-আলোচনা এবং সে জন্য উভয় বাহিনীকে প্রথম অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য যে কোনো প্রকারে ইমাম (আঃ)কে সম্মত করানোর চিন্তা করতে থাকেন। এ জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পন্থা ছিলো তিনটি ঃ
(১) আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়সের সাথে আলোচনা
(২) ক্বায়স্ ইবনে সা‘ঈদের সাথে আলোচনা
(৩) ইমাম (আঃ)-এর কাছে পত্র লেখা।
কিন্তু ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের অটুট মনোবলের কারণে এসব নীলনকশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অবশেষে লাইলাতুল হারীর-এর ঘটনা সংঘটিত হলো এবং মু‘আবিয়ার সামরিক সংগঠন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু মু‘আবিয়ার প্রতারণা আর ইরাকীদের সরলতা এবং শামী সেনাদের পঞ্চম স্তম্ভ কর্তৃক ইমাম বাহিনীর অভ্যন্তরে তৎপরতা চালানোর ফলে পরিস্থিতি শাম বাহিনীর অনুকূলে ঘুরে দাঁড়ালো। নিম্নে আলোচনা বৈঠকগুলোর বিবরণ তুলে ধরা হলো ঃ
(১) মু‘আবিয়াহ্ তাঁর ভাই ‘উত্বাহ্ ইবনে আবি সুফিয়ানকে ডেকে পাঠালেন। ‘উত্বাহ্ একজন ভালো বাগ্মী পুরুষ ছিলো। মু‘আবিয়াহ্ তাকে ইমাম বাহিনীর প্রভাবশালী নেতা আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়সের সাথে সাক্ষাত করে তাঁকে উভয় পক্ষের অবশিষ্ট লোকদের ওপর দয়া করার অনুরোধ জানাবার দায়িত্ব দিলেন।
‘উত্বাহ্ রণাঙ্গনের সম্মুখভাগে পৌঁছলো এবং সেখান থেকেই নিজের পরিচয় দিয়ে মু‘আবিয়ার বার্তা পৌঁছে দেয়ার জন্য আশ্‘আছের সাথে সাক্ষাত করতে চাইলো। আশ্‘আছ্ তাকে চিনতে পারলো এবং বললো, “সে একজন অপচয়ী লোক, অতএব, তার সাথে দেখা করা চলে।”
সংক্ষেপে ‘উত্বাহ্র বক্তব্য ছিলো এই ঃ
“মু‘আবিয়াহ্ যদি আলী ছাড়া অন্য কারো সাথে সাক্ষাত করতে চাইতেন তাহলে তোমার সাথেই সাক্ষাত করতেন। কারণ, তুমি হলে ইরাকী জনগণের নেতা এবং ইয়ামানীদের মুরব্বি। তাছাড়া তুমি হযরত ওসমানের জামাতা এবং তাঁর শাসনামলের একজন কর্মকর্তা ছিলে। মালেক আর্শ্তা ও ‘আদী ইবনে হাতেমের চেয়ে তোমার হিসাবটা আলাদা। মালেক আশ্তার ওসমানের হত্যাকারী আর ‘আদী হলো এ কাজে মদদদাতাদের একজন। আমি তোমাকে বলছি না যে, আলীকে ত্যাগ করে মু‘আবিয়ার সহযোগিতায় এগিয়ে এসো। বরং বাদবাকিদের বাঁচাবার জন্য অনুরোধ করছি, যাতে তোমারও কল্যাণ, আমারও কল্যাণ।”
আশ্‘আছ্ তার উত্তরে যদিও ইমাম (আঃ)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রকাশ করলো এবং বললো যে ইরাক ও ইয়ামানের নেতা স্বয়ং আলী, কিন্তু তাঁর কথার শেষ ভাগে একজন কূটনীতিকের ন্যায় সন্ধির প্রস্তাবকে গ্রহণ করলো। সে বললো, তোমাদের বাদবাকীদের বাঁচাবার প্রয়োজন আমাদের চেয়ে বেশী নয়।
‘উত্বাহ্ যখন আশ্‘আছের এ কথা মু‘আবিয়াকে জানালেন তখন মু‘আবিয়াহ্ বললেন ঃ قَدْ جَنَحَ لِلسِّلْمِ “সন্ধির জন্য পাখা বিস্তার করে দিয়েছে।”
(২) মুহাজির ও আনছারদের মধ্য থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ছাহাবীগণ যখন ইমাম (আঃ)-এর চারপাশে সমবেত ছিলেন তখন আনছারদের মধ্যে থেকে কেবল দুই জন Ñ নো’মান ইবনে বাশীর ও ইবনে মুখাল্লাদ মু‘আবিয়ার সাথে সহযোগিতা করছিলেন। মু‘আবিয়াহ্ নো’মান ইবনে বাশীরকে ইমাম বাহিনীর সাহসী সেনাপতি ক্বায়স্ ইবনে সা‘দের সাথে সাক্ষাত করে সন্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ জানালেন। নো’মান ক্বায়সের সাথে সাক্ষাতকালে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির কথা উত্থাপন করে বললেন ঃ
أخَذَتِ الْحَرْبُ مِنّا وَ مِنْكُمْ مَا رَأَيتُمْ فَاتَّقُوا اللهَ فِي الْبَقِيَّة.
“যুদ্ধ আমাদের ও তোমাদের মধ্য থেকে যাদেরকে নিয়ে গেছে তা তো দেখতেই পাচ্ছো; বাদবাকিদের বেলায় আল্লাহ্কে ভয় করো (এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য একটা উপায় খুঁজে বের করো)।”
নো‘মানের কথার জবাবে ক্বায়স্ মু‘আবিয়াহ্ ও আলী (আঃ) উভয়ের সমর্থকদের সম্বোধন করে বললেন ঃ “রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর যুগে আমরা মুখম-ল ও গলা বাড়িয়ে দিয়ে শত্রুদের তলোয়ার ও বর্শার উত্তর দিতাম এবং এভাবে সত্য জয়লাভ করে। কিন্তু কাফেররা এ ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিলো। হে নো‘মান! এ মুহূর্তে মু‘আবিয়ার সহযোগী বলতে মুষ্টিমেয় বেদুঈন, মুক্তিপ্রাপ্ত আর প্রতারিত ইয়ামানবাসী ছাড়া আর কেউ নেই। অথচ আলীর দিকে তাকিয়ে দেখো, মুহাজির, আনছার, তাবে‘ঈন প্রমুখ যাদের ওপর আল্লাহ্ সন্তুষ্ট রয়েছেন, তারা তাঁর চারপাশ ঘিরে রয়েছেন। কিন্তু মু‘আবিয়ার পাশে কেবল তুমি আর তোমার বন্ধু (ইবনে মুখাল্লাদ) ছাড়া আর কেউ নেই। আর তোমাদের কেউই বদরীও নও,ওহুদীও; আর না তোমাদের মধ্যে কেউ ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলো, না কোনো আয়াত তোমাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। যদি এ (যুদ্ধের) ব্যাপারে তোমরা আমাদের বিপক্ষে চলো তাহলে সেটা নতুন কিছু নয়, কারণ তোমাদের পিতারাও পূর্বে এমন কাজ করেছে।”১৪৩
(৩) এসব বৈঠকের পিছনে উদ্দেশ্য ছিলো সন্ধি ও আপোসের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। কিন্তু মু‘আবিয়ার উদ্দেশ্যে পূরণ হয় নি। এ কারণে তিনি বাধ্য হয়ে হযরত আলী (আঃ)কে পত্র লিখলেন। কিন্তু পত্রে তিনি এমন একটি আবেদন রাখলেন যে আবেদন তিনি তাঁর অবাধ্যতার প্রথম দিনেই রেখেছিলেন। অর্থাৎ কোনোরূপ বাই‘আত কিম্বা আনুগত্যের শর্ত ছাড়াই শামের হুকুমাত তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে। তিনি আরো লিখলেন, “আমরা সকলেই ‘আব্দ্ মানাফের বংশধর; আমাদের কেউই একে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নয়, যদি না কেউ কোনো সম্মানিতকে লাঞ্ছিত আর স্বাধীনকে গোলামে পরিণত না করে।
ইমাম (আঃ) স্বীয় সচিব ইবনে আবি রাফে‘কে ডাকলেন এবং তিনি যেভাবে বলেন সেভাবে তাঁর পত্রের উত্তর লিখতে তাঁকে নির্দেশ দিলেন। ইমামের পত্রের বক্তব্য নাহ্জুল্ বালাগ¦াহ্র ১৭ নং পত্রে লিপিবদ্ধ রয়েছে।১৪৪
ঊনবিংশ অধ্যায়
ছিফ্ফীন যুদ্ধের ও ইসলামের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন
ইমাম (আঃ) ৩৮ হিজরীর ১০ই রবিউল আউয়াল মঙ্গলবার প্রত্যুষে অন্ধকার থাকতেই স্বীয় সঙ্গীদের সাথে ফজরের নামায আদায় করলেন। তিনি শাম বাহিনীর ক্লান্তিÍ ও অক্ষমতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন এবং জানলেন যে, শত্রুরা সর্বশেষ পরিখা অবধি পশ্চাদপসারণ করেছে। এ অবস্থায় একটি দুর্দান্তÍ আক্রমণ চালিয়ে মু‘আবিয়ার আস্তানা গুঁড়িয়ে দেয়া যায়। এ কারণে তিনি সৈন্যদেরকে সজ্জিত করার জন্য মালেক আর্শ্তাকে নির্দেশ দিলেন। মালেক আপদমস্তক লৌহ বর্মে আবৃত হয়ে সৈন্যদের মাঝে এলেন এবং স্বীয় বর্শার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন ঃسَوُّوا صُفُوَفَكُمْ رَحِمَكُمُ اللهُ “তোমাদের সারিগুলো সুশৃঙ্খল করো। আল্লাহ্ তোমাদের দয়া করুন।”
একটু পরেই আক্রমণ শুরু হলো এবং শুরু থেকেই শত্রুদের পলায়নের মাধ্যমে তাদের পরাজয়ের আরামত প্রকাশ হয়ে পড়েছিলো।
এ সময় শাম বাহিনী থেকে একজন বের হয়ে এলো এবং ইমাম (আঃ)-এর সাথে সশীরে সাক্ষাত করার অনুরোধ জানালো। ইমাম (আঃ) দুই বাহিনীর মাঝখানে তার সাথে আলোচনা শুরু করলেন। সে প্রস্তাব দিলো যে, উভয় পক্ষ তাদের যুদ্ধপূর্বকালীন সময়ের স্ব স্ব স্থানে পশ্চাদপসরণ করবে, আর ইমাম শামকে মু‘আবিয়ার হাতে সোপর্দ করবেন।
ইমাম (আঃ) তার প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বললে, “আমি এ প্রসঙ্গে অনেক চিন্তÍা করে দেখেছি। কিন্তু এর জন্য দু’টির বেশি পথ খুঁজে পাই নি ঃ হয় অবাধ্যদের সাথে যুদ্ধ, না হয় আল্লাহ্র প্রতি এবং তাঁর নবীর ওপর যা কিছু নাযিল হয়েছে তার প্রতি কুফরী করা। আর আল্লাহ্ কখনো সন্তুষ্ট নন যে, তাঁর কর্তৃত্বসীমায় কোনো অবাধ্যতা ও পাপ সংঘটিত হোক আর লোকেরা এর বিপরীতে নীরব থাকুক এবং সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা থেকে বিরত থাকুক। এ কারণে অবাধ্য দলের বিরুদ্ধে য্দ্ধু করাকেই শিকলে বন্দী হওয়ার দশা থেকে শ্রেয়তর মনে করি।”
লোকটি যখন ইমাম (আঃ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারে হতাশ হয়ে পড়লো তখনاِنّا لِلهِ وَ اِنَّا اِلَيهِ رَاجِعُونَ (অবশ্যই আমরা আল্লাহ্র কাছ থেকে এসেছি এবং তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তন করবো।) এ আয়াতটি পড়তে পড়তে শাম বাহিনীর দিকে ফিরে গেলো।১৪৫
উভয় পক্ষের মধ্যে বিরতিহীন য্দ্ধু শুরু হলো। এ যুদ্ধে সম্ভাব্য সব রকমের হাতিয়ার ব্যবহার করা হচ্ছিলো। তীর, তলোয়ার, পাথর, বর্শা, বিরাটাকারের লোহার গুর্য ইত্যাদি উভয় পক্ষ থেকে পরস্পরের ওপর নেমে আসছিলো। বুধবার সকাল পর্যন্তÍ যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। ঐ রাতে মু‘আবিয়ার বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিহত হয় এবং আরো বিপুল সংখ্যক আহত হয়, আর আহতরা তীব্র আর্তনাদ করতে থাকে। এ কারণে ঐ বুধবারের রাতকে “লাইলাতুল হারীর” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আশ্তার সৈন্যদের মাঝে ঘোরাফেরা করছিলেন এবং বলছিলেন, “হে লোকজন, বিজয় পর্যন্তÍ আর মাত্র একটি ধনুকের চেয়ে বেশি ব্যবধান নেই।” তিনি চিৎকার করে বলছিলেন ঃ
أَلا مَنْ يَشْرِي نَفْسَهُ للهِ وَ يُقَاتِلُ مَعَ الْأشْتَرِ حَتّيٰ يَظْهَرَ أوْ يَلْحَقَ بِاللهِ؟
“কেউ আছে কি যে স্বীয় জীবনকে আল্লাহ্র কাছে বিক্রয় করবে আর এ পথে আশ্তারের সহযোদ্ধা হয়ে য্দ্ধু করবে যাতে বিজয়ী হতে পারে কিম্বা আল্লাহ্র সান্নিধ্য চলে যেতে পারে?”১৪৬
ইমাম (আঃ) এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে নিজের প্রভাবশালী সৈন্যদর ও সেনাপতিবৃন্দের সামনে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন ঃ
“হে লোকসকল! তোমরা দেখতে পাচ্ছো যে, তোমাদের এবং শত্রুদের অবস্থা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। শত্রুদের শুধু শেষ নিঃশ্বাসটি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কোনো কাজের শুরুটা তার শেষটা দিয়ে পরিমাপ করা হয়। সকাল হলেই আমি তাদরেকে আল্লাহ্র আদালতে তুলবো এবং তাদের ঘৃণ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবো।”১৪৭
মু‘আবিয়াহ্ ইমাম (আঃ)-এর বক্তব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত হলেন। সুতরাং ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্কে লক্ষ্য করে বললেন, “এ হলো সেই রাত যা পোহানোর সাথে সাথে আলী যুদ্ধের পরিণতি নির্ধারণ করে দেবে। এখন কী করা যায়?”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ বললেন, “না তোমার সৈন্যরা তাঁর সৈন্যের মতো, আর না তুমি তাঁর মতো। তিনি যুদ্ধ করছেন দ্বীন ও ঈমানের জন্য, অথচ তোমার উদ্দেশ্য ভিন্ন কিছু। তুমি জীবন চাও আর তিনি চান শাহাদাত। ইরাকী বাহিনী তাদের ওপরে তোমার বিজয়ে নিজেদের জন্য ভয় পায়, অথচ শামী বাহিনী তাদের ওপর আলীর বিজয়ে ভয় পায় না।”
মু‘আবিয়াহ্ ঃ তাহলে কী করতে হবে?
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ ঃ এমন কিছু প্রস্তাব করতে হবে যদি তা গ্রহণ করে তাহলে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হবে, আর যদি গ্রহণ না করে তবুও তাদের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হবে। তাদেরকে আল্লাহ্র কিতাবের প্রতি আমন্ত্রণ জানাও যাতে তোমার ও তাদের মধ্যে ফয়ছালা করে দেয়। তাহলে তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হবে। এ বিষয়টি অনেক দিন ধরে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় তা প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলোম।”
মু‘আবিয়াহ্ তাঁর সহকারীর এ পাকাপোক্ত পরিকল্পনার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন এবং বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন।
১৩ই রবিউল আউয়াল মতান্তরে ১৩ই সফর বৃহস্পতিবার সকাল বেলা, ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদল একটি নযীর বিহীন চক্রান্তের মুখোমুখি হলো। শামের স্বৈরাচারীদের জন্য ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ যে সেরা উপহার দিলেন তা উমাইয়্যাহ্ বংশের পুনর্জীবন লাভ এবং সামাজিক দৃশ্যপটে তাদের পুনরায় প্রত্যাবর্তনের কারণ হলো।
‘আম্রের নির্দেশে শামের বাহিনীর সৈন্যরা বর্শার মাথায় কোরআন বাঁধলো এবং এভাবে তাদের সারিগুলোকে শোভাম-িত করে দাঁড়ালো। এছাড়া দামেশ্কের বৃহত্তম কোরআন ১০ জনের সহযোগিতায় বর্শার মাথায় বহন করা হচ্ছিলো। অতঃপর সবাই এক কণ্ঠে শ্লোগান তুললো ঃ “তোমাদের ও আমাদের মাঝে ফয়সালাকারী আল্লাহ্র কিতাব।”
ইরাকী সৈন্যদের কানে শ্লোগান পৌঁছলো এবং তাদের দৃষ্টি বর্শার মাথায় পড়লো। শামের সৈন্যদের নিকট থেকে কেবল দয়া কামনার শ্লোগান আর চিৎকার ছাড়া অন্য কিছুই শোনা যাচ্ছিলো না। সকলেই বলছিলো ঃ
“হে আরবের জনগণ! তোমাদের স্ত্রী ও কন্যাদের জন্য আল্লাহ্কে স্মরণে রাখো।”
“আল্লাহ্কে স্মরণে রাখো তোমাদের দ্বীনের জন্য।”
“শামের জনগণ না থাকলে কে শামের সীমানাগুলোকে রক্ষা করবে? আর ইরাকী জনগণ না থাকলে কে ইরাকের সীমানাগুলোকে রক্ষা করবে?”
“আর কারা রোম, তুর্কী ও অন্যান্য কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য অবশিষ্ট থাকবে?”১৪৮
কোরআনের সমাহারে এ প্রাণসঞ্চারী দৃশ্য আর মমতাবিজড়িত ক্রন্দন ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের চিন্তÍা-চেতনাকে হরণ করলো এবং তাদেরকে অভিভূত ও আতঙ্কিত করে তুললো। কিছুক্ষণ পূর্ব পর্যন্তÍও যে যোদ্ধারা বীরত্বের গৌরবগাথা রচনা করছিলো এবং বিজয়ের দ্বারপ্রান্তেÍ পৌঁছে গিয়েছিলো হঠাৎ তারা সম্মোহিত হয়ে স্ব স্ব স্থানে পেরেকের মতো গেঁথে রইলো।
তবে ‘আদী ইবনে হাতেম, মালেক আশ্তার ও ‘আম্র্ ইবনুল হামেক্ব প্রমুখ বীরপুরুষগণ চক্রান্তেÍর বিষয়ে অবগত র্ছিলেন এবং জানতেন যে, শত্রুদের যেহেতু মোকাবিলা করার সামর্থ্য নেই এবং যেহেতু তারা পতন ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তেÍ উপনীত হয়েছে। সুতরাং চক্রান্তেÍর পথ দিয়েই এখন তারা বাঁচার চেষ্টা করছে। অন্যথায় তারা কখনোই কোরআনকে মান্য করে নি, ভবিষ্যতে ও করবে না। এ কারণে, ‘আদী ইবনে হাতেম ইমাম (আঃ)কে বললেন ঃ “বাতিলপন্থী সৈন্যরা কখনোই হকপন্থীদের মোকাবিলা করার সামর্থ্য রাখে না। উভয় পক্ষে বহু লোক নিহত ও আহত হয়েছে। আর যারা আমাদের সাথে অবশিষ্ট রয়েছে তারা তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী। শামবাসীদের ন্যাকা কান্নায় কান দেবেন না। আমরা আপনার অনুগত আছি।”
আশ্তার বললেন, “মু‘আবিয়ার স্থলাভিষিক্ত নেই, কিন্তু আপনার স্থলাভিষিক্ত রয়েছে। তার সৈন্য আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের ধৈর্যক্ষমতা আপনার সৈন্যদের মতো নয়। লোহাকে লোহা দিয়ে পিটান এবং আল্লাহ্র সাহায্য গ্রহণ করুন।”
তৃতীয় একজন বললেন, “হে ইমাম! আমরা বিদ্বেষের কারণে আপনার সমর্থনে এগিয়ে আসি নি, বরং আল্লাহ্র জন্য আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। এখন সত্য তার শেষ প্রান্তÍবিন্দুতে পৌঁছে গেছে। আপনার উপস্থিতিতে আমাদের কোনো মতামতের অবকাশ নেই।”১৪৯
কিন্তু আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়স্ Ñ যে ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদলে যোগদান করেছিলো এবং প্রথম দিন থেকেই রহস্যপূর্ণ আচরণ করছিলো আর মু‘আবিয়ার সাথে তার যোগাযোগের কথা কম-বেশি প্রকাশ পেয়েছিলো, সে ইমাম (আঃ)কে বললো, “লোকদের আহ্বানে সাড়া দিন। আপনি তাদের আবেদনে সাড়া দেয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য। জনগণ বাচঁতে চায়; তারা যুদ্ধ পসন্দ করে না।”
ইমাম (আঃ) যেহেতু তার কলুষিত সংকল্পের কথা অবগত ছিলেন এ কারণে বললেন ঃ “এ ব্যাপারে ভাবতে হবে।”১৫০
মু‘আবিয়াহ্ ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদের আবেগকে তাড়িত করার উদ্দেশ্যে ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের পুত্র আবদুল্লাহ্কে Ñ যে তৎকালীন সমাজে একজন তথাকথিত দরবেশ প্রকৃতির ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলো Ñ উভয় বাহিনীর মাঝে দাঁড়িয়ে তাদেরকে আল্লাহ্র কিতাবের ফয়ছালা মেনে নেয়ার আহ্বান জানাতে নির্দেশ দিলেন। সে-ও দুই বাহিনীর মাঝে দাঁড়িয়ে গেলো এবং বললো, “হে লোকসকল! আমাদের যুদ্ধ যদি দ্বীনের জন্য হয়ে থাকে তাহলে উভয় বাহিনীই প্রতিপক্ষের জন্য চরম হুজ্জাত (যুক্তি-প্রমাণ) উপস্থাপন করেছে। আর যদি দুনিয়ার জন্য হয়ে থাকে তাহলে উভয় বাহিনীই সীমালঙ্ঘন করেছে। আমরা তোমাদেরকে আল্লাহ্র কিতাবের ফয়সালা মেনে নেয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। তোমরাও যদি আমাদেরকে এ আহ্বানে জানাতে তাহলে আমরা তা মেনে নিতাম। সুতরাং এ সুযোগকে কাজে লাগাও।”
এসব শ্লোগান বিক্ষিপ্ত শত্রুপক্ষ এবং ইরাকের সরলমনা লোকদেরকে প্রতারিত করলো। লোকেরা ইমাম (আঃ)-এর ওপর এ আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো।
ইমাম (আঃ) এ স্পর্শকাতর মুহূর্তে প্রতারিত জনগণের চিন্তা-চেতনাকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে বললেন ঃ
“আল্লাহ্র বান্দাহ্গণ! আমি অন্য যে কারো চেয়ে কোরআনের নিদের্শের প্রতি সাড়া দেয়ার ব্যাপারে অধিকতর উপযুক্ত। কিন্তু মুআবিয়াহ্, ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ, ইবনে আবি মু‘ঈত, হাবীব ইবনে মুসলিমাহ্ ও ইবনে আবি সারাহ্ দ্বীন ও কোরআনের লোক নয়। আমি তাদেরকে তোমাদের চেয়ে বেশি চিনি। আমি তাদের সাথে শৈশব থেকে অদ্যবাধি ওঠা-বসা করছি। তারা সর্বাবস্থায় নিকৃষ্টতম শিশু ও নিকৃষ্টতম পুরুষ ছিলো। আল্লাহ্র শপথ, তারা এ কারণে কোরআনকে উঁচু করে নি যে, তারা কোরআনকে স্বীকার করে এবং তার ভিত্তিতে ফয়সালা করতে চায়। বরং এটা তাদের প্রতারণা বৈ নয়। আল্লাহ্র বান্দাহ্গণ। তোমাদের মাথাগুলো ও বাহুগুলোকে ক্ষণিকের জন্য আমাকে ধার দাও। সত্য তো চূড়ান্তÍ ফলাফলে পেঁৗঁছে গেছে। আর অত্যাচারীদের মূলোৎপাটন হতে তেমন কিছু বাকি নেই।”
এ সময় নিষ্ঠাবান লোকেরা যখন ইমাম (আঃ)-এর মতামতকেই সমর্থন জানাচ্ছিল তখন হঠাৎ ইরাকী যোদ্ধাদের মধ্য থেকে বিশ হাজার লোকের একটি দল Ñ যারা আপাদমস্তক লৌহবর্ম পরিহিত ছিলো এবং তাদের কপালে সিজদার দাগ পড়ে গিয়েছিলো, আর তাদের হাতে ছিলো তলোয়ারে Ñ চৌকির দিকে এগিয়ে এলো।১৫১ এ দলের নেতৃত্বে ছিলো মুসা‘র্আ ইবনে ফাদাকী, যায়েদ ইবনে হাছীন ও ইরাকের কতিপয় কারী Ñ যারা পরবর্তীতে খারেজী সম্প্রদায়ের নেতা হয়। তারা ইমাম (আঃ)-এর অবস্থানস্থলের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো এবং তাঁকে “হে আমীরুল মু‘মিনীন!”-এর পরিবর্ততে “হে আলী!” বলে সম্বোধন করলো এবং চরম অভদ্রতার সাথে বললো ঃ “জনগণের আহ্বানে সাড়া দাও, নতুবা আমরা ওসমান ইবনে ‘আফফানকে যেভাবে হত্যা করেছি তোমাকেও সেভাবেই হত্যা করবো। আল্লাহ্র শপথ, তুমি যদি তাদের আহ্বানে সাড়া না দাও তাহলে তোমাকে হত্যা করবো।”
গতকাল যে সেনাধিনায়ক পূর্ণ আনুগত্য লাভ করেছিলেন এ মুহূর্তে তাঁর অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়ালো যে, তাঁকে আত্মসমর্পণ করার ও সন্ধি মেনে নেয়ার নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছিলো।
ইমাম (আঃ) তাদের উত্তরে বললেন,
“আমি সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে আল্লাহ্র কিতাবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি এবং আমি সর্বপ্রথম ব্যক্তি যে কিতাবের প্রতি আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আর তোমাদেরকে আল্লাহ্র কিতাব ভিন্ন অন্য কিছুর প্রতি ডাকা আমার জন্য জায়েয নয়। আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। কারণ, তারা কোরআনের নিদের্শের প্রতি কর্ণপাত করে না। তারা আল্লাহ্র নাফরমানি করেছে এবং তাঁর অঙ্গীকারকে ভঙ্গ করেছে ও তাঁর কিতাবকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছে। আমি তোমাদের নিকট ঘোষণা করছি যে, তারা তোমাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে। তারা কোরআনের ভিত্তিতে চলতে ইচ্ছুক নয়।”
ইমাম (আঃ)-এর যুক্তি-প্রমাণ ভিত্তিক বক্তব্য তাদের ওপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হলো না। আর সময়ের প্রবাহে স্পষ্ট হলো যে, তারা একদল উগ্র এবং সত্য অনুধাবানে অক্ষম লোক Ñ যারা শামী বাহিনীর অন্তঃসারশূন্য শ্লোগান দ্বারা প্রভাবিত হয় পড়েছিলো। ইমাম (আঃ) তাদেরকে যতই উপদেশ দিচ্ছেলেন ততই তাদের গোঁয়ার্তুমি বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তারা দাবি তুললো যে, ইমাম যেন মালেক আশ্তারকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।
যুদ্ধাবস্থায় একটি সৈন্যবাহিনীর জন্য মতপার্থক্য ও দলাদলির চাইতে ক্ষতিকর আর কিছুই নেই। তার চেয়েও জঘন্য হলো একদল সরল ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতাবিহীন লোকের পক্ষ থেকে তাদের বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ সেনাপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ইমাম (আঃ) নিজেকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তেÍ দেখতে পাচ্ছিলেন এবং শত্রুদের এ সন্ধিপ্রস্তাবের স্বরূপ সস্পর্কে অবগত ছিলেন। কিন্তÍ তিনি কি-ই বা করতে পারতেন, যখন বিভেদ সৈন্যদলের ঐক্যকে সমূলে বিনষ্ট করে দিচ্ছিলো!
ইমাম (আঃ) বিশ হাজার ধর্মের ভান করা সশস্ত্র লোক Ñ যাদের কপালে অধিক সিজদাহ্র কারণে কড়া পড়ে গিয়েছিলো, তাদের বিপরীতে দৃঢ়তা প্রদর্শন করাকে কল্যাণকর মনে করলেন না। তিনি ইয়াযীদ ইবনে হানী নামক তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ জনকে কাছে ডাকলেন এবং তাঁকে বললেন ঃ “মালেক আর্শ্তা যে স্থানে যুদ্ধে ব্যস্ত রয়েছে সেখানে চলে যাও এবং তাকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বলো। আর যত দ্রুত সম্ভব আমার কাছে চলে আসতে বলো।”
ইয়াযীদ ইবনে হানী রণাঙ্গনের অগ্রভাগে পৌছলেন এবং মালেক আর্শ্তাকে বললেন ঃ “ইমাম যুুদ্ধ বন্ধ করার এবং অবিলম্বে তাঁর নিকট উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।”
আর্শ্তা বললেন ঃ “ইমামকে আমার সালাম পৌঁছে দাও এবং বলো যে, এখন আমাকে রণাঙ্গন থেকে ডেকে পাঠানোর সময় নয়। আশা করি অতি সত্বরই বিজয়ের সমীরণ ইসলামের পাতাকাকে দোলা দেবে।”
বার্তাবাহক প্রত্যাবর্তন করলেন এবং বললেন, আশ্তার রণাঙ্গন ত্যাগ করাকে কল্যাণকর মনে করছেন না এবং বলছেন যে, আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি।”
বিদ্রোহীরা ইমাম (আঃ)কে বললো ঃ “আশ্তার তোমার নির্দেশেই প্রত্যাবর্তনে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তুমি তাকে রণাঙ্গনে প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে বার্তা পাঠিয়েছো।”
আলী (আঃ) পরম দৃঢ়তার সাথে বললেন, “আমি কখনোই আমার কর্মচারীর সাথে গোপনে কথা বলি নি; যা কিছু বলেছি সেটা তোমরাও শুনেছো। তাহলে আমি যা প্রকাশ্যে বলেছি তার বিপরীতে কীভাবে তোমরা আমাকে অভিযুক্ত করছো?”
বিদ্রোহীরা বললো ঃ “যত শীঘ্র সম্ভব মালেক আর্শ্তাকে ময়দান থেকে ফিরে আসতে বলো। অন্যথায় তোমাকেও ওসমানের মতো হত্যা করবো, কিম্বা জীবিত মু‘আবিয়ার হাতে সোপর্দ করবো।”
ইমাম (আঃ) ইয়াযীদ ইবনে হানীর দিকে তাকালেন এবং বললেন, “তুমি যা দেখলে তা মালেককে গিয়ে বলো।”
মালেক ইমামের (আঃ) বার্তা সম্পর্কে অবহিত হলেন এবং বার্তাবাহককে বললেন, “এ ফিত্নাহ্ বর্শার মাথায় কোরআন উত্তোলন করা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আর এ চক্রান্ত ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের।” অতঃপর তিনি গভীর দুঃখের সাথে বললেন, “তুমি কি বিজয় দেখতে পাচ্ছো না এবং আল্লাহ্র নির্দেশকে অবলোকন করছো না? এমতাবস্থায় রনাঙ্গন ত্যাগ করা কি উচিৎ হবে?”
বার্তাবাহক বললেন ঃ “এটাও কি উচিৎ হবে যে, আপনি এখানে থাকবেন আর আমীরুল মু’মিনীন নিহত হবেন কিম্বা শত্রুর হাতে সোপর্দ হবেন?”
এ কথা শুনে মালেক কেঁপে উঠলেন। তৎক্ষণাৎ যুদ্ধ থেকে বিরত হলেন এবং ইমাম (আঃ)-এর সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তাঁর দৃষ্টি যখন লাঞ্ছনাকামী বিদ্রোহীদের ওপর পড়লো তখন তিনি বললেন, “তোমরা এখন শত্রুদের ওপর প্রাধান্য অর্জন করেছো এবং বিজয়ের দ্বারপ্রান্তেÍ উপনীত হয়েছো। কাজেই তোমরা প্রতারণার ফাঁদে পা দিও না। আল্লাহ্র শপথ, তারা আল্লাহ্র নির্দেশকে পরিহার করেছে এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সুন্নাতকে বর্জন করেছে। কখনোই তাদের আবেদন সাড়া দিও না। আমাকে সামান্য সময় দাও যাতে সবকিছু সাঙ্গ করে আসতে পারি।”
বিদ্রোহীরা ঃ তোমার সাথে একমত হওয়া মানে তোমার ভ্রান্তিÍতে অংশীদার হওয়া।
মালেক ঃ আফসোস যে, তোমাদের মধ্যকার মহান লোকেরা নিহত হয়েছেন আর তোমাদের নিকৃষ্ট জনেরা অবশিষ্ট রয়ে গেছে। আমাকে বলো দেখি, কোন্ কালে তোমরা সত্যের ওপরে ছিলে? যখন তোমরা যুদ্ধ করছিলে তখন সত্যের ওপর ছিলে এবং এখন যেহেতু যুদ্ধ ত্যাগ করেছো কাজেই বাতিলের ওপরে রয়েছো? নাকি যখন যুদ্ধ করছিলে তখন বাতিলের ওপরে ছিলে আর এখন সত্যের ওপরে আছো? তোমাদের ধারণা যদি এমনই হয়ে থাকে তাহলে তোমাদের সকল নিহতগণ Ñ যাদের ঈমান, তাকওয়া, ও নিষ্ঠার কথা তোমরা স্বীকার করে থাকো, তাদের জাহান্নামে থাকা অবধারিত।”
বিদ্রোহীরা ঃ আমরা আল্লাহ্র রাস্তায় যুদ্ধ করেছি এবং আল্লাহ্র জন্য যুদ্ধ থেকে বিরত হয়েছি। আমরা তোমাকে অনুসরণ করি না। আমাদের থেকে দূরে সরে যাও।
মালেক ঃ তোমরা প্রতারণার ফাঁদে পড়েছো এবং এর মাধ্যমে যুদ্ধ ত্যাগ করার প্রতি আহুত হয়েছো। হে কপালে কড়া পড়া সৈন্যরা! আমি তোমাদের নামাযকে দুনিয়া ত্যাগ ও শাহাদাতের প্রতি আসক্তির প্রতীক মনে করতাম। এখন প্রমাণিত হলো যে, তোমদের উদ্দেশ্য হলো মৃত্যু থেকে পলায়ন এবং দুনিয়ার প্রতি ঝোঁক। ধিক্, তোমাদের ওপর, হে মলখেকো পশুদের দল। তোমরা কখনোই সম্মানের পাত্র হবে না। দূর হয়ে যাও যেমনভাবে অত্যাচারীরা দূর হয়ে গেছে।”
এ সময় বিদ্রোহীরা একদিক থেকে আর মালেক আশ্তার অপর দিক থেকে পরপরকে গালিগালাজ করতে ও ধিক্কার জানাতে থাকে এবং একে অপরের ঘোড়াসমূহের মুখে চাবুকাঘাত করতে থাকে। ইমাম (আঃ)-এর সামনে এ অবাঞ্ছিত দৃশ্য এতটাই বেদনাদায়ক ছিলো যে, তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন, “তোমরা একে অপর থেকে দূরে সরে যাও।”
এমতাবস্থায় সুযোগসন্ধানী বিদ্রোহীরা ইমামকে তাদের মত মেনে নিতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে ইমাম (আঃ)-এর সামনেই কোরআনের ফয়সালায় তাঁর সম্মত হওয়ার জোর আওয়ায উঠালো। ইমাম (্আঃ) নিশ্চুপ থাকলেন; কোনো কথা বলছিলেন না। শুধু গভীর চিন্তÍায় নিমগ্ন হলেন।১৫২
©somewhere in net ltd.