![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিশতম অধ্যায়
সালিস-মীমাংসার প্রসঙ্গ এবং চাপসৃষ্টিকারী দল
মু‘আবিয়ার প্রতি ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের এ মর্মে প্রস্তাব যে, ‘ইমাম (আঃ)-এর সৈন্যদেরকে কোরআনের ফয়সালার প্রতি আহ্বান জানানো হোক, চাই তারা তা গ্রহণ করুক অথবা না-ই করুক’ Ñ পুরোপুরি ফলপ্রসূ হলো। কারণ, তা ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীকে অদ্ভুতভাবে দুই দলে বিভক্ত করে দিলো। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো সেই সব সরলমনা লোকদের দিকে যারা যুদ্ধে ক্লান্তÍ হয়ে মু‘আবিয়ার চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়ছিলো এবং ইমাম (আঃ)-এর অনুমতি ছাড়াই শ্লোগান দিচ্ছিলো যে, “আলী কোরআনের ফয়ছালা গ্রহণে সম্মতি দিয়েছেন।” অথচ হযরত আলী (আঃ) পুরোপুরি নীরব ছিলেন এবং ইসলামের ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তÍা করছিলেন।১৫৩
ইমাম (আঃ) বরাবরে মু‘আবিয়ার পত্র
এ সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মু‘আবিয়াহ্ ইমাম (আঃ)-এর কাছে এক পত্রে লিখলেন ঃ
“আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘায়িত হলো আর আমাদের প্রত্যেকেই প্রতিপক্ষের কাছ থেকে যা আদায় করতে চায় সে ব্যাপারে নিজেকে সঠিক বলে মনে করে, অথচ কোনো পক্ষই অন্যের আনুগত্য করতে রাযী নই। উভয় পক্ষের অনেক লোক নিহত হয়েছে। আশঙ্কা করছি যে, ভবিষ্যত অতীতের চেয়েও খারাপ হতে পারে। আমরাই এ যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিলোাম। কেবল আমি আর তুমি ছাড়া অন্য কেউ এ যুদ্ধের জন্য দায়ী নয়। এখন আমি এমন এক প্রস্তাব পেশ করছি যার মধ্যে নিহিত রয়েছে জীবন, উম্মাতের কল্যাণ, তাদের প্রাণরক্ষা, ধর্মীয় সম্প্রীতি আর বিদ্বেষের অবসান। সে প্রস্তাবটি হলো, আমার ও তোমার সহচরদের মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য হবে এমন দুই ব্যক্তি কোরআন মোতাবেক ফয়সালা করে দেবে। এটা আমার ও তোমার জন্য ভালো হবে আর তা ফিতনাহ্ দূর করে দেবে। এ বিষয়ে আল্লাহ্কে ভয় করো এবং কোরআনের নির্দেশের প্রতি সন্তুষ্ট থাকো যদি তার উপযুক্ত হয়ে থাকো।”১৫৪
বর্শার মাথায় কোরআন তোলা স্রেফ একটি মতপার্থাক্য সৃষ্টিকারী প্রচারণামূলক প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না এবং তা কখনোই কোরআনের ফয়ছালার পথ দেখিয়ে দেয় নি। কিন্তু মু‘আবিয়াহ্ তাঁর পত্রে এ ব্যাপারে অস্পষ্টতা দূর করে দেন এবং দুই পক্ষ থেকে দুই জন লোক মনোনীত করার প্রস্তাব করেন। আর পত্রের শেষে তিনি তাকওয়া ও কোরআনকে মেনে চলার প্রতি আহ্বান জানান।
মু‘আবিয়ার পত্রের জবাবে ইমাম (আঃ)
ইমাম (আঃ) মু‘আবিয়ার পত্রের নিম্নোক্ত জবাব দেন ঃ
“মানুষের অত্যাচার ও মিথ্যাচার তার দ্বীন ও দুনিয়াকে ধ্বংস করে দেয়, আর ছিদ্রান্বেষণকারীর নিকট তার বিচ্যুতিকে স্পষ্ট করে দেয়। তুমি ভালোমতোই জানো যে, অতীতকে পূরণ করতে তুমি অক্ষম। একদল অন্যায়ভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের মাধ্যমে খেলাফতের পিছনে ধাবিত হলো এবং আল্লাহ্র ষ্পষ্ট নির্দেশকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্রতী হলো। আর আল্লাহ্ তাদের মিথ্যাকে ষ্পষ্ট করে দিলেন। সেই দিনের ভয় করো যে দিন সেই ব্যক্তিই আনন্দিত হবে যার শেষ পরিণতি হবে প্রশংসনীয় আর যে ব্যক্তি তার নিজের লাগাম শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছে সে অনুতপ্ত হবে। দুনিয়া তাকে ধোঁকা দিয়েছে এবং সে তার প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
আমাকে তুমি কোরআনের নির্র্দেশের প্রতি আহ্বান করেছো, অথচ তুমি তার অনুসারী নও। আমরা তোমাকে উত্তর প্রদান করি নি, তবে কোরআনের ফয়সালা মেনে নিয়েছি।”১৫৫
আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়স্ Ñ যে শুরু থেকেই মু‘আবিয়ার সাথে গোপন যোগাযোগ রেখে চলার দায়ে অভিযুক্ত ছিলো এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কখনো কখনো এ সম্পর্কে প্রমাণ চোখে পড়তো, এবার সে পীড়াপীড়ি শুরু করলো যে, সে মু‘আবিয়ার কাছে যাবে এবং এভাবে বর্শার মাথায় কোরআন তুলে ধরার পিছনে তার উদ্দেশ্য কী তা জিজ্ঞেস করবে।১৫৬
প্রথম দিন থেকেই ইমামের (আঃ) সাথে আশ্‘আছের আচরণে সততা ছিলো না। মু‘আবিয়ার ভাই ‘উত্বার সাথে বৈঠকের পর থেকে তার মাথায় সন্ধির চিন্তÍা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। লাইলাতুল হারীরে সে যুদ্ধ অব্যাহত রাখাকে উভয় পক্ষের ধ্বংসের কারণ বলে উল্লেখ করে এবং কোরআন তুলে ধরার ঘটনায় সে ইমাম (আঃ)কে শামী বাহিনীর আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য চাপ দেয় এবং সৈন্যরা ক্লান্তÍ বলে মত প্রকাশ করে। এবার সে মু‘আবিয়ার সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি চাইলো যাতে সন্ধির ব্যাপারে সর্বশেষ নির্দেশ লাভ করতে পারে।
এ আলোচনায় আমরা আরো দেখতে পাবো যে, প্রতিনিধি নির্বাচন প্রশ্নে সে ইমাম (আঃ)-এর ক্ষমতাকে খর্ব করে দেয় এবং তাঁর মনোনীত প্রতিনিধিকে কোনো না কোনো অজুহাত তুলে সরিয়ে দেয়। তদস্থলে তার পছন্দের প্রতিনিধিকে চাপিয়ে দেয়, যা ইরাকী বাহিনীর জন্য ক্ষতির কারণ হয়। সে মু‘আবিয়ার সাথে সাক্ষাতের পর নতুন কোনো বাণী নিয়ে আসে নি, বরং মু‘আবিয়ার পত্রের বিষয়বস্তুরই পুনরাবৃত্তি করে।
সশস্ত্র দলটির চাপ ইমাম (আঃ)কে কিতাবের ফয়ছালা মেনে নিতে বাধ্য করে। এ কারণে উভয় পক্ষের ক্বারীরা দুই বাহিনীর মাঝে সমবেত হলোন। তাঁরা কোরআনের দিকে তাকালেন এবং কোরআনের নির্দেশকে উজ্জীবিত করার সিদ্ধান্তÍ গ্রহণ করলেন, অতঃপর নিজ নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করলেন। এ সময় উভয় পক্ষ উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলো ঃ “আমরা কোরআনের নির্দেশ ও তার ফয়সালায় রাযী আছি।”১৫৭
মীমাংসাকারীদের নিয়োগ
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কোরআন নিজে কথা বলে না। যারা কোরআনে অভিজ্ঞ তাঁরাই কোরআনের কথাগুলো বলবেন, তার মধ্যে অনুধ্যান করে আল্লাহ্র নির্দেশকে উদঘাটন করবেন এবং কলহ-বিবাদের নিষ্পত্তি করবেন। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, শামীদের পক্ষ থেকে কয়েক ব্যক্তিকে ও ইরাকীদের পক্ষ থেকে কয়েক ব্যক্তিকে মনোনীত করা হবে। শামের লোকজন নিঃশর্তভাবে মু‘আবিয়ার অনুগত ছিলো; তিনি যাকেই নির্বাচন করবেন সকলে তাকেই মেনে নেবে। আর তারা সকলেই জানতো যে, তিনি এ ফিত্নার জনক ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ছাড়া অন্য কাউকে নির্বাচিত করবেন না। একটি প্রবাদ বাক্য অনুযায়ী, শামের জনগণ সৃষ্টির জন্য সর্বাপেক্ষা অনুগত আর স্রষ্টার জন্য সর্বাপেক্ষা অবাধ্য ছিলো।
কিন্তু ইমাম (আঃ)-এর পালা এলে চাপ সৃষ্টিকারী মহল১৫৮ দু’টি বিষয়কে তাঁর ওপর চাপিয়ে দিলো ঃ
(১) মীমাংসা মেনে নিতে হবে,
(২) তাদের পসন্দের মীমাংসাকারীকে মেনে নিতে হবে, তাঁর পসন্দের নয়।
ইতিহাসের এ অধ্যায়টি শিক্ষণীয় বটে। এখানে তা তুলে ধরা হলো ঃ
চাপসৃষ্টিকারী দল ঃ আমরা আবু মূসা আশ্‘আরীকে মীমাংসাকারী হিসেবে মেনে নিয়েছি।
ইমাম (আঃ) ঃ আমি কখানোই এটা মেনে নেবো না এবং তাকে এ অধিকার প্রদান করবো না।
চাপসৃষ্টিকারী দল ঃ আমরাও তাকে ছাড়া অন্য কাউকে গ্রহণ করবে না। সে প্রথম দিন থেকেই আমাদেরকে এ যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বলেছিলো এবং এটাকে একটা ফিতনাহ্ বলে আখ্যায়িত করেছিলো।
ইমাম (আঃ) ঃ আবু মূসা আশ‘আরী হলো সেই ব্যক্তি যে আমার খেলাফতের শুরু থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং লোকজনকে আমার সাহায্য করা থেকে বিরত রাখে। এছাড়া সে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে যায় যতক্ষণ না তাকে আমি ক্ষমা করি। এরপর সে আমার কাছে প্রত্যাবর্তন করে। আমি ইবনে আব্বাসকে মীমাংসা করার জন্য নির্বাচন করলাম।
চাপসৃষ্টিকারী দল ঃ আমাদের জন্য আপনি ও ইবনে আব্বাসের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এমন কাউকে নির্বাচিত করুন যে আপনার ও মু‘আবিয়ার সম্পর্কে এক সমান হয়।
ইমাম (আঃ) ঃ তাহলে মালেক আশ্তারকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করলাম।
চাপসৃষ্টিকরী দল ঃ আশ্তার যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে। এখন আমরা তার হুকুমেই লাঞ্ছিত।
ইমাম (আঃ) ঃ আশ্তারের হুকুম কী?
চাপসৃষ্টিকারী দল ঃ সে লোকদেরকে পরস্পর হানাহানির মধ্যে ঠেলে দিতে চায় যাতে তার এবং আপনার স্বার্থ হাসিল হয়।
ইমাম (আঃ) ঃ মু‘আবিয়াহ্ যদি লোক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীন থাকে তাহলে একজন কুরাইশী ব্যক্তির (‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ) বিপরীতে আরেক জন কুরাইশী ব্যক্তিকে (ইবনে আব্বাস) নির্বাচন করা ছাড়া যথোপযুক্ত কাজ হবে না। তোমরাও তার বিপরীতে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসকে মনোনীত করো। কারণ, ইবনে ‘আছ্ এমন কোনো দলকে শৃঙ্খলিত করবে না যাদেরকে ইবনে আব্বাস মুক্ত করবে না, কিম্বা এমন কোনো দলকে মুক্ত করবে না যাদেরকে সে শৃঙ্খলিত করবে না। তেমনি এমন কোনো কাজকে সে মযবুত করবে না ইবনে আব্বাস যেটাকে দুর্বল করে দেবে না, কিম্বা এমন কোনো কাজকে দুর্বল করবে না যে, ইবনে আব্বাস সেটাকে মযবুত করবে না।
আশ্‘আছ্ ঃ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ও আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস মুদার গোত্রের। আর দু’জন মৃদার গোত্রের লোক এক সাথে মীমাংসায় বসা ঠিক নয়। যদি একজন (‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ) মুদারী হয় তাহলে অপর জন (আবু মূসা আশ্‘আরী) ইয়ামানী হতে হবে।
(কেউ একবার তাকে জিজ্ঞেস করলো না যে, তার এ আইন বা নীতির দলিল কী?!)
ইমাম (আঃ) ঃ আমার ভয় হলো তোমাদের ঐ ইয়ামানী ঠকে যায় কিনা। কারণ ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ হলো এমন ব্যক্তি যে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে কোনো কিছু করা থেকেই পিছপা হয় না।
আশ্‘আছ্ ঃ আল্লাহ্র শপথ, যখন দুই মীমাংসাকারীর একজন ইয়ামানী হবে সেটা আমাদের জন্য উত্তম যদি সে আমাদের প্রত্যাশার বিপরীতে মীমাংসা করে তবুও। আর যখন উভয়ে মুদারী হবে সেটা আমাদের অপসন্দ, যদিও তারা আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী মীমাংসা করে দেয়।
ইমাম (আঃ) ঃ এখন যেহেতু তোমরা আবু মূসা আশ্‘আরীর জন্যেই পীড়াপীড়ি করছো তাহলে তোমরা যা চাও সেটাই করো।১৫৯
আবু মূসা আশ্‘আরী যখন কূফার গভর্নর ছিলেন তখন জনগণকে জঙ্গে জামালের ফিত্নাহ্ উৎপাটনে ইমাম (আঃ)-এর সাথে যোগ দেয়া থেকে বিরত রাখেন। তাঁর অজুহাত ছিলো, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর এ উক্তি ঃ “যখন উম্মাতের মধ্যে ফিত্নার উদ্রেক হয় তখন তা থেকে দূরে থাকো”। এখন সেই ব্যক্তিই সালিশির ক্ষেত্রে ইমাম (আঃ)-এর প্রতিনিধি হতে চলেছেন। সন্দেহ নেই যে, তাঁর সরলতা ছাড়াও যেহেতু তিনি ইমাম (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ছিলেন, সুতরাং কখানোই ইমামের পক্ষে রায় প্রদান করতেন না।
ইমাম (আঃ) চাপসৃষ্টিকারী দলকে ভ্রান্তÍ ও ক্ষতিকর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সব রকমের প্রচেষ্টা চালান। এ কারণে তিনি তাঁর সকল সেনাপতিকে একটি স্থানে সমবেত করলেন এবং সকলের উপস্থিতিতে নিম্নোক্ত বক্তব্য প্রদান করলেন ঃ
“জেনে রাখো, শামীরা তাদের সবচেয়ে আপন লোকটিকে মনোনীত করেছে। আর তোমরা যাদেরকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করতে তাদের আপন জনকে (আবু মূসা আশ্‘আরীকে) মনোনীত করেছো। তোমাদের যত কাজ আবদুল্লাহ্ ইবনে ক্বায়সের মতো লোকদের সাথে (আবু মূসা আশ্‘আরীর মূল নাম)। এ হলো সেই লোক যে গতকালও বলতো ঃ “যুদ্ধ হলো ফিত্নাহ্। তাই তোমরা তোমাদের ধনুকের জ্যা-গুলোকে কেটে ফেলো আর তলোয়ারগুলোকে কোষবদ্ধ করে রাখো।”
সে যদি সত্যবাদী হয় তাহলে সে নিজে কেন কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই রণাঙ্গনে অংশগ্রহণ করলো? আর যদি মিথ্যাবাদী হয় তাহলে তো সে অভিযুক্ত। ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের বক্ষকে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাসের মুষ্টিবদ্ধ হাতের ঘুষি দ্বারা ভেঙ্গে দাও। আর অবকাশ প্রদানকারীদেরকে ব্যবহার করে ইসলামের সীমান্তগুলোকে নিয়ন্ত¿ণ করো। তোমরা কি দেখতে পাচ্ছো না যে, তোমাদের শহরগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে আর তোমাদের ভূ-খ-সমূহ শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে?”১৬০
শুধু তাঁর সাথে বিক্ষিপ্ত কিছু সাক্ষাতের ঘটনা ছাড়া ইমাম (আঃ)-এর বক্তব্য তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে কোনোই প্রভাব ফেললো না। এ কারণে আহ্নাফ ইবনে ক্বায়স্ ইমাম (আঃ)কে বললেন, “আমি আবু মূসাকে পরীক্ষা করেছি; তার মধ্যে গভীরতা বলতে কিছু নেই। সে হলো এমন এক লোক যে ইসলামের শুরুতে তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কাজেই যদি চান তো আমাকেই মীমাংসাকারী হিসেবে মনোনীত করুন। আর যদি এটা সঠিক মনে না করেন তাহলে আমাকে দ্বিতীয় কিম্বা তৃতীয় মীমাংসাকারী হিসেবে মনোনীত করুন। তাহলে দেখতে পাবেন যে ‘আম্র্ ইবনুল ‘আছ্ যে গিঁটই দিক না কেন, আমি তা খুলে দেবো, আর যে গিঁটই সে খুলুক না কেন আমি তা কষে দেবো।”
ইমাম (আঃ) আহ্নাফের প্রতিনিধিত্বের প্রসঙ্গটি সৈন্যদের কাছে উপস্থাপন করলেন। কিন্তু তারা এতই পথভ্রষ্ট ও একগুঁয়ে হয়ে গিয়েছিলো যে, শুধু আবু মূসার প্রতিনিধিত্ব ছাড়া আর কাউকে মানতে রাযী ছিলো না। এ নির্বাচন এতই ক্ষতিকর ছিলো যে, জনৈক শামী কবি তাঁর কবিতায় এর পর্দা উন্মোচন করে বলেন ঃ
“ইরাকের জনগণের যদি সঠিক সিদ্ধান্তÍ থাকতো তাহলে তা তাদেরকে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করতো এবং তারা ইবনে আব্বাসকে নির্বাচিত করতো। কিন্তু তারা ইয়ামানের বৃদ্ধকেই মনোনীত করলো Ñ যে পাঁচ ও ছয়ের মধ্যেই আটকে থাকে। আলীর কাছে সেই ব্যক্তির উক্তি পৌঁছে দাও যে সত্য বলতে ভয় পায় না। আবু মূসা আশ্‘আরী কোনো আস্থাশীল ব্যক্তি নয়।”১৬১
আমাদের আলোচনায় পরবর্তীতে এ বিষয়টি আসবে যে, এই যেসব লোক মু‘আবিয়ার সাথে সন্ধির বিষয়টিকে ইমাম (আঃ)-এর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো এবং সালিস নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর হাতকে বেঁধে রেখেছিলো। তারাই সর্বপ্রথমে সালিসের বিষয়টিকে কবিরাহ্ গুনাহ্ বলে গণ্য করে এবং একটি চুক্তিপত্র লেখার পর ইমাম (আঃ)কে তা ভঙ্গ করতে বাধ্য করার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু এটা অসম্ভব যে, ইমাম (আঃ) চুক্তি ভঙ্গ করবেন এবং পুনরায় এসব ভ- ধার্মিকদের কথায় কর্ণপাত করবেন।
এখন দেখা যাক সালিশির রায় কীভাবে লেখা হয় এবং ইমাম কি তৃতীয় বারের জন্য চাপসৃষ্টিকারী দলের মতামতের চাপে পড়েন?
সালিসী চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হলো
ছিফ্ফীনের ভূখ-ে সংঘটিত সালিশির ঘটনা ইসলামের ইতিহাসের একটি অভূতপূর্ব ঘটনা বলে পরিগণিত হয়। ইমাম আলী (আঃ) Ñ যিনি বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাঁর অজ্ঞ ও মূর্খ সহচররা যদি তাঁকে সমর্থন করা থেকে বিরত না থাকতো, কিম্বা ন্যূনতম পক্ষে তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি না করতো তাহলে তিনি সহজেই ফিত্নার মূলোৎপাটন করে ফেলতেন এবং নিকৃষ্ট উমাইয়্যাহ্ বংশের শাসন Ñ যা পরবর্তী কালে আশি বছর বা তার চেয়েও কিছু বেশিকাল স্থায়ী হয়েছিলো, তার অবসান ঘটাতেন এবং ইসলামের ইতিহাসের রূপ ও মুসলিম সভ্যতাকে পাল্টে দিতেন। তিনি ‘আম্র্ ইবনুল ‘আছের ধোঁকাবাজির কারণে Ñ যা তাঁর সৈন্যদলের একটি বৃহত্তর অংশকে প্রতারিত করে Ñ যুদ্ধ থেকে বিরত হন এবং বিজয় লাভে ব্যর্থ হন।
এই মূর্খ বন্ধুরা Ñ যাদের ক্ষতি জ্ঞানী শত্রুদের কৃত ক্ষতির চেয়েও বেশি, চারটি বিষয় ইমাম (আঃ)-এর ওপর চাপিয়ে দেয় যার ধোঁয়া প্রথমে তাদের চোখকেই আচছন্ন করে, অতঃপর অন্যান্য মুসলমানদের চোখে যায়। এ চারটি বিষয় হলো ঃ
১) যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া এবং কোরআন ও রাসূলের সুন্নাতের মীমাংসা গ্রহণ করা।
২) ইমাম (আঃ)-এর পক্ষ থেকে আবু মূসা আশ্‘আরীকে প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেয়া।
৩) মীমাংসা চুক্তিনামায় আলী (আঃ)-এর নাম থেকে “আমীরুল মু’মিনীন” বাদ দেয়া।
৪) মীমাংসা চুক্তি স্বাক্ষর করার পর তা ভঙ্গ করার জন্য পীড়াপীড়ি করা।
পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিষয় দু’টি চাপিয়ে দেয়া পন্থা সর্ম্পকে অবগত হয়েছি। এবার আমরা তৃতীয় ও চতুর্থ বিষয় দু’টি চাপিয়ে দেয়ার পন্থা সম্পর্কে এবং সন্ধির লিপি সম্পর্কে অবগত হবো।
কোরআন মজীদকে বর্শার মাথায় তুলে ধরার রাজনীতির পরে ঠা-া লাড়াইয়ের ধূলিমেঘ কেটে গেলো এবং বাকবিত-া থেমে গেলো। নির্ধারিত হলো যে, উভয় দলের নেতৃবৃন্দ মীমাংসার চুক্তিপত্র প্রস্তুত করবেন। একদিকে ইমাম (আঃ) ও তাঁর সহচরবৃন্দ আর অপরদিকে মু‘আবিয়াহ্ ও তাঁর বিচ্ছিন্ন মস্তিষ্ক ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ আর তাঁদের কতিপয় প্রহরী। চুক্তিপত্র লেখার জন্য দু’টি হলুদ কাগজ আনা হলো যার শুরু এবং সমাপ্তি ভাগে ইমাম (আঃ)-এর “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” লেখা সীল এবং মু‘আবিয়ারও “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” লেখা সীল ছিলো। সব কিছুই প্রস্তুত। ইমাম (আঃ) চুক্তির কথাগুলো উচ্চারণ করার এবং তাঁর সচিব ইবনে রাফে‘ সেগুলো লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
ইমাম (আঃ) তাঁর কথা শুরু করলেন এভাবে ঃ
بِسْمِ اللهِ الْرَّحْمنِ الْرّحِيم هَذا مَا تَقاضَيٰ عَلَيْهِ عَلِيٌّ أمِيِرُ الْمُؤمِنِيِنَ وَ مُعاوِيَةُ بْنُ أبِي سُفْيَانَ وَ شِيعَتُهُمَا فيِما تَراضَيَا بِهِ مِنَ الْحُکْمِ بِکِتَابِ اللهِ وَ سُنّةِ نَبِيِّهِ (ص).
“পরম দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ্র নামে। এটা হলো আমীরুল মু’মিনীন আলী আর মু‘আবিয়াহ্ ইবনে আবু সুফিয়ানের এবং এতদুভয়ের অনুসারীদের মধ্যকার চুক্তিনামা যা আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর নবীর (সাঃ) সুন্নাতের নির্দেশ মেনে নেয়ার মর্মে উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে লিখিত।”
এ সময়ে মু‘আবিয়াহ্ লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন এবং বললেন ঃ “কতই না নিকৃষ্ট সে ব্যক্তি যে কাউকে আমীরুল মু’মিনীন বলে গ্রহণ করে, অতঃপর তার সাথে যুদ্ধ করে!”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ তৎক্ষণাৎ ইমাম (আঃ)-এর লেখককে বললেন, “আলী ও তাঁর পিতার নাম লেখো। তিনি তোমাদের আমীর, আমাদের নন।”
এ সময় ইমাম (আঃ)-এর একজন সাহসী সেনাপতি তাঁকে বললেন, “আপনার নামের পাশ থেকে “আমীরুল মু’মিনীন উপাধি” মুছে ফেললে ভয় হয় হয়তো পুনরায় তা আর আপনার কাছে ফিরে আসবে না। অতএব, এ কাজ করবেন না, যদি তাতে রক্তপাতও ঘটে যায়।”
বাকবিত-া দীর্ঘায়িত হলো। দিনের একটা অংশ এ বিষয়ের ওপর তর্কবিতর্কে কেটে গেলো। ইমাম (আঃ) স্বীয় নামের পাশ থেকে “আমীরুল মু’মিনীন” উপাধি মুছে ফেলতে রাযী হলেন না। রহস্যজনক ব্যক্তি আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়স্ Ñ যে প্রথম দিন থেকেই আলী (আঃ)-এর সাথে বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে তাঁর বিরুদ্ধে কাজ করছিলো, সে পীড়াপীড়ি করলো যে, এ উপাধি লেখা যাবে না।
এ টানাহেঁচড়ার মধ্যে ইমাম (আঃ) হুদায়বিয়ার সন্ধির তিক্ত স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি বললেন ঃ
“হুদায়বিয়ার ভূখ-ে আমি ছিলাম রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর লেখক। একদিকে ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আর অপর দিকে সুহাইল ইবনে ‘আম্র্ মুশরিকদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছিলো। আমি সন্ধিপত্রকে এভাবে প্রস্তুত করলাম ঃ
هَذَا مَا تَصَالَحَ عَلَيهِ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ (ص) وَ سُهَيلُ بْنُ عَمْرو.
“এ হলো মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ও সুহাইল ইবনে ‘আম্রের মধ্যকার সন্ধিপত্র।”
“কিন্তু মুুশরিকদের প্রতিনিধি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)কে বললো ঃ “আমি কখনোই যে পত্রে তুমি নিজেকে আল্লাহ্র নবী বলে আখ্যায়িত করবে তাতে স্বাক্ষর করবো না। আমি যদি মানতাম যে, তুমি আল্লাহ্র নবী তাহলে কক্ষনোই তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতাম না। তুমি যদি আল্লাহ্র নবী হয়ে থাকো আর তোমাকে আল্লাহ্র ঘর তাওয়াফ করা থেকে বিরত রাখবো তাহলে আমি তো বড় যালেম হয়ে যাবো। বরং লিখো, “মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্্” Ñ যাতে আমি তা মেনে নেই।”
“এ সময়ে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাকে বললেন, “হে আলী, আমি আল্লাহ্র রাসূল যেমনভাবে আমি আবদুল্লাহ্র পুত্র। কখনোই আমার নামের পাশ থেকে রাসূলুল্লাহ্ উপাধি মুছে ফেলার কারণে আমার রিসালাত চলে যাবে না। লিখো ঃ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্।”
“হ্যা, সেদিন মুশরিকদের চাপ আমার ওপর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিলো যাতে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নামের পাশ থেকে “রাসূলুল্লাহ্” উপাধি তুলে দেই। সেদিন যেহেতু রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) মুশরিকদের জন্য সন্ধিপত্র লিখেছিলেন সেহেতু আজ আমি তাদের সন্তÍানদের জন্য লিখছি। আমার ও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পথ ও পন্থা এক ও অভিন্ন।”
‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ আলী (আঃ)কে বললেন, “সুবহানাল্লাহ, আমাদেরকে কাফেরদের সাথে তুলনা করছো অথচ আমরা মু’মিন!”
ইমাম (আঃ) বললেন, “কোনদিন তুমি কাফেদের সমর্থক এবং মুসলমানদের শক্র ছিলে না? তুমি তোমার মায়ের মতো যে তোমাকে জন্ম দিয়েছে।”
একথা শুনে ‘আম্র্ বৈঠক থেকে উঠে দাঁড়ালো এবং বললো, “আল্লাহ্র শপথ, এরপর কখনো তোমার সাথে আর কোনো বৈঠকে বসবো না।”
ইমাম (আঃ)-এর বন্ধু-সাজা ছদ্মবেশী শত্রুদের পক্ষ থেকে তাঁর নামের পাশ থেকে “আমীরুল মু‘মিনীন” উপাধি মুছে ফেলার জন্য চাপ প্রয়োগ ইমামের অসহায়ত্বে নতুন মাত্রা যোগ করলো।১৬২ কিন্তু এর বিপরীতে ইমাম (আঃ)-এর কিছু সত্যিকার বন্ধু খোলা তরবারী সহকারে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো এবং বললো, “আপনি নির্দেশ দিন, আমরা পালন করবো।”
ওসমান ইবনে হুনাইফ তাদেরকে এই বলে উপদেশ দিলেন, “আমি হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় উপস্থিত ছিলোাম। আর এ সময়ও আমরা ঠিক রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পথেই রয়েছি।”১৬৩
ইমাম (আঃ) বললেন, “রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) হুদায়বিয়ায় আজকের এ ঘটনা সম্পর্কে আমাকে আগাম সংবাদ প্রদান করেন। তিনি বলেছিলেন ঃ إنَّ لَکَ مِِثْلَهَا سَتُعْطِيها وَ أنْتَ مُضْطَهِدٌ “এ রকম দিন তোমার জন্যও আসবে এবং তুমিও এরূপ কাজ করতে বাধ্য হবে।”
সন্ধিপত্র
ইমাম (আঃ) কর্তৃক নমনীয়তা প্রদর্শন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে দুই পক্ষের মতপার্থক্যের অবসান হলো। তিনি “আমীরুল মুমিনীন” উপাধি ছাড়াই তাঁর নাম লেখার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করলেন। ফলে সন্ধিপত্র লেখার কাজ এগিয়ে চললো। সন্ধির গুরুত্বপূর্ণ শর্তগুলো ছিলো নিম্নরূপ ঃ
১) উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে যে, কোরআনের ফয়ছালাকে অবনত মস্তকে মেনে নেবে এবং তার নির্দেশের বাইরে চলবে না। একমাত্র কোরআন ছাড়া আর কিছুই তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে না। শুরু থেকে শেষ অবধি মতপার্থক্যসমূহের নিষ্পত্তির জন্য কোরআনকেই ফয়ছালাকারী হিসেবে গ্রহণ করবে।
২) আলী ও তাঁর অনুসারীরা আবদুল্লাহ্ ইবনে ক্বায়স্ (আবু মূসা আশ্অ‘ারী)কে তাদের সালিস ও মীমাংসাকারী মনোনীত করেছেন আর মু‘আবিয়াহ্ ও তাঁর অনুসারীরা ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছকে একই পদে মনোনীত করেছেন।
৩) দু’জনের প্রত্যেকের কাছ থেকেই, মহান আল্লাহ্ স্বীয় বান্দাহ্দের কাছ থেকে যে মহান প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন সেই অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছে, যাতে তাঁরা আল্লাহ্র কিতাবকেই তাঁদের পথপদর্শক হিসেবে গ্রহণ করেন, আর যে ক্ষেত্রে তার ফয়সালা লাভ করবেন সে ক্ষেত্রে এর বাইরে এগিয়ে যাবেন না। আর যেক্ষেত্রে এতে ফয়সালা লাভ করবেন না সে ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সুন্নত ও সীরাতের সন্ধানে যাবেন। তাঁরা মতপার্থক্যে লিপ্ত হবেন না এবং স্বীয় কামনা-বাসনার অনুসরণ করবেন না, আর সংশয়মূলক কাজে আগ্রসর হবেন না।
৪) আবদুল্লাহ্ ইবনে ক্বায়স্ এবং ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ দুজনই স্ব স্ব নেতার কাছ থেকে খোদায়ী অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, কিতাব ও সন্নাহ্র ভিত্তিতে তাঁদের কৃত ফয়ছালাকে মেনে নেবেন এবং তা ভঙ্গ করবেন না। আর তাঁদের দু’জনেরই শাসনে যতক্ষণ পর্যন্তÍ ন্যায় ও সত্যকে অতিক্রম না করবেন তাঁদের জান, মাল ও সম্ভ্রম সম্মানার্হ থাকবে।
৫) সালিসদ্বয় তাঁদের কাজ শেষ করার পূর্বে কোনো একজন মীমাংসাকারী মারা গেলে তাঁকে নিয়োগের শর্তাবলীর অনুরূপ শর্তাবলীতে ঐ দলের নেতা তদস্থলে একজন ন্যায়পরায়ণ সালিস নিয়োগ করবেন। তদ্রƒপভাবে দুই নেতার কোনো একজন মীমাংসা সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে মারা গেলে সে দলের অনুসারীরা তদস্থলে অন্য কাউকে নির্বাচিত করতে পারবে।
৬) উভয় সালিসের নিকট থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে যে, তাঁরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে কোনো কার্পণ্য করবেন না, আর অনুচিত কোনো ফয়সালাও করবেন না। আর যদি স্বীয় অঙ্গীকার রক্ষা না করেন তাহলে উম্মাত তাঁদের বিচারকার্যে অসন্তেÍাষ প্রকাশ করতে পারবে এবং তাঁদের বিচার মানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে না। এ চুক্তিপত্র মেনে চলা আমীরদ্বয়, বিচারকদ্বয় ও উম্মাতের জন্য আবশ্যক এবং ওয়াজিব বলে গণ্য হবে। আর এরপর থেকে চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সময় পর্যন্তÍ জনগণের জান-মাল ও সম্ভ্রম নিরাপদ থাকবে, অস্ত্র মাটিতে রেখে দিতে হবে এবং রাস্তাসমূহ নির্বিঘœ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে এ ঘটনায় যারা উপস্থিত রয়েছে এবং যারা উপস্থিত নেই তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
৭) উভয় সালিসের কর্তব্য হলো, তাঁরা ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী একটি স্থানে সমবেত হবেন। সেখানে তাঁদের পসন্দের কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ উপস্থিত থাকবে না। তাঁরা রমযান মাসের শেষ অবধি সালিস-নিষ্পত্তি করার সময় পাবেন। আর যদি চান তাহলে এর পূর্বেও ফয়ছালা করতে পারবেন এবং চাইলে হজ্বের মওসূম পর্যন্তÍ ফয়ছালাকে বিলম্বিত করতে পারবেন।
৮) সালিসদ্বয় যদি আল্লাহ্র কিতাব ও নবীর সুন্নাত অনুযায়ী বিচার না করেন তাহলে মুসলমানরা তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবে; উভয় পক্ষের মধ্যে কোনো অঙ্গীকার থাকবে না। মুসলিম উম্মাহ্র কর্তব্য হলো এ চুক্তিপত্র মেনে চলা। আর যে কেউ শক্তি প্রয়োগ করবে কিম্বা তা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্তÍ নেবে উম্মাহ্ তার বিরুদ্ধে এক ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাড়াবে।১৬৪
ত্বাবারীর বর্ণনা অনুযায়ী, অতঃপর উভয় পক্ষ থেকে দশ জন স্বাক্ষর করেন। ইমামের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, আশ্‘আছ্ ইবনে ক্বায়স্, মালেক আর্শ্তা, সা‘ঈদ ইবনে ক্বায়স্ হামদানী, খুব্বাব ইবনে উররাত্, সাহ্ল ইবনে হুনাইফ, ‘আম্র্ ইবনুল হামেক্ব খুযা‘ঈ এবং ইমাম (আঃ)-এর সন্তান হাসান ও হুসাইনের নাম পাওয়া যায়।১৬৫
উভয় বিচারক সিদ্ধান্তÍ নিলেন যে, তাঁরা শাম ও হেজাযের সীমান্তÍবর্তী এলাকা আয্রাহ্ ভূখ-ে মিলিত হবেন এবং সেখানে বসে মীমাংসাকার্য পরিচালনা করবেন। আর প্রত্যেক পক্ষ থেকে ৪০০ জন করে লোক সালিসী কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরিত হলো।
©somewhere in net ltd.