![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইমামের (আঃ) সৈন্যদলে সালিসী অঙ্গীকারনামার প্রতিক্রিয়া
অঙ্গীকারা নামা প্রণীত হওয়ার পর সিদ্ধান্তÍ হলো যে, ইরাক ও শামের জনগণ আলোচনা বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে অবগত হবে। এ কারণে আশ্‘আছ্ সালিসী অঙ্গীকারনামাকে তাদের কাছে উপস্থাপন করলো। প্রথম দিকে কোনো বিরোধিতা পরিলক্ষিত হয় নি। তবে ‘আন্যাহ্ প্রমুখ কতিপয় ইরাকী গোত্র এর বিরোধিতা করে এবং প্রথম বারের মতো ‘আন্যাহ্ গোত্রের দুই যুবক মিদান ও জা‘দের কণ্ঠ থেকে لَا حُکْمَ إلّا ِلله (আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো বিচার-ফয়ছালার অধিকার নেই) Ñ এ শ্লোগান উচ্চারিত হলো। যুবকদ্বয় উন্মুক্ত তলোয়ার দ্বারা মু‘আবিয়ার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় এবং মু‘আবিয়ার তাঁবুর নিকটে নিহত হয়।
অঙ্গীকারনামাটি মুরাদ গোত্রের কাছে উপস্থাপন করা হলে অঙ্গীকারনামা মুরাদ গোত্রপতি ছালেহ্ ইবনে শাফীক্ব উক্ত যুবকদের শ্লোগানই উচ্চারণ করে বললো لاحُکْمَ الّا ِللهِ وَ لَوْ کَرِهَ الْمُشْرِکُونَ (আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো বিচার-ফয়সালার অধিকার নেই যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে।) অতঃপর সে এ কবিতাটি আবৃত্তি করলো ঃ
مَا ِلعَلِيٍّ فِي الْدّمَاء قَدْ حَکَمَ لَوْ قَاتَلَ الْأحْزَابَ يَوماً مَا ظَلَمَ
“কী হলো যে, আলী ঝরে যাওয়া রক্তের ব্যাপারে সালিস মেনে নিলেন/ অথচ যদি দলগুলোর সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন তবে তা অন্যায় হতো না।”
আশ্‘আছ্ তার কাজ চালিয়ে গেলো। সে যখন বানূ তামীমের পতাকার সামনে উপস্থিত হলো এবং তাদের কাছে সালিসের অঙ্গীকারনামা পেশ করলো তখন তারা لَا حُکْمَ إلّا للهِ وَ هُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِِِيِنَ “আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো বিচার-ফয়সালার অধিকার নেই, আর তিনিই সর্বোত্তম ফয়সালাকারী।” Ñ এ শ্লোগান উচ্চারণ করতে লাগলো।
আর র্উওয়াহ তামীমী বললো ঃ
أتُحَکِّمُونَ الْرّجَالَ فِي أَمْر ِالله؟ لاحُکْمَ الّا لله. أيْنَ قَتْلانا يَا أَشْعَثُ؟
“তোমরা কি আল্লাহ্র ব্যাপারে লোকদেরকে বিচারক মনোনীত করছে? আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো বিচার-ফয়সালার অধিকার নেই। আমাদের নিহত লোকদের বিষয় কী, হে আশ্‘আছ্?”১৬৬ (তারা কি সত্যের পথে নিহত হয়েছে নাকি মিথ্যার পথে?)
অতঃপর সে তার তলোয়ার দ্বারা আশ্‘আছের ঘোড়ার ওপর আক্রমণ করলো। তার আঘাত আশ্‘আছের ঘোড়ার গায়ে লাগলো এবং তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে ফেলে দিলো। অন্যরা এগিয়ে না এলে আশ্‘আছ্ উক্ত তামিমীর হাতেই নিহত হতো।
আশ্‘আছ্ ইরাকী বাহিনীর ভিতরে একবার টহল দিয়ে ইমাম (আঃ)-এর সামনে উপস্থিত হলো এবং এমন ভাব প্রকাশ করলো যেন ইমাম (আঃ)-এর বেশিরভাগ সমর্থকই সালিসী অঙ্গীকারে সন্তুষ্ট রয়েছে; কেবল একটি কিম্বা দু’টি দল ছাড়া আর কেউ বিরোধিতা করছে না।
কিন্তু কিছু সময় পার না হতেই সব দিক থেকে لا حُکْمَ الّا لله (আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো বিচার-ফয়ছালার অধিকার নেই) এবং الْحُکْمُ للهِ يَا عَلِيٌّ لَا لَکَ (বিচার-ফয়ছালার অধিকার আল্লাহ্র, হে আলী, তোমার নয়।) Ñ এ শ্লোগানদ্বয় উচ্চকিত হতে লাগলো। লোকেরা চিৎকার করে বলতে লাগলো ঃ “আমরা কখনোই আল্লাহ্র দ্বীনের ব্যাপারে মানুষকে ফয়ছালাকারী হতে (ও হুকুম পাল্টে দিতে) দেবো না। আল্লাহ্ নিদের্শ দিয়েছেন যে, মু‘আবিয়াহ্ ও তার সহচরদেরকে নিহত হতে হবে কিম্বা আমাদের শাসনাধীনে চলে আসতে হবে। সালিসের ঘটনাটি ছিলো আমাদের দ্বারা সংগঠিত একটি বিচ্যুতি। অতঃপর আমরা তা থেকে প্রত্যাবর্তন করেছি এবং তাওবাহ্ করেছি; তুমিও প্রত্যাবর্তন করো ও তাওবাহ্ করো, নতুবা আমরা তোমাকে পরিত্যাগ করবো।”১৬৭
চাপিয়ে দেয়া চতুর্থ বিষয়টি
ইমাম (আঃ)-এর মূর্খ বন্ধুরা এবার চতুর্থ বিষয়টি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হলো। আর তা হলো, ইমাম (আঃ)কে ঐ দিনই সালিসের অঙ্গীকারনামাকে উপেক্ষা করতে হবে এবং তার কার্যকারিতা বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু এবার ইমাম (আঃ) কঠিন দৃঢ়তা প্রদর্শন করলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলেন ঃ
وَيْحَکُمْ، أَبَعْدَ الْرّضَا وَ الْعَهْدِ نَرْجِعُ؟ ألَيْسَ اللهُ تَعَالَيٰ قَدْ قَالَ: ্রأوْفُوا بِالْعُقُودِগ্ধ وَ قَالَ: ্রوَ أَوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إذَا عَاهَدْتُمْ وَ لَا تَنْقُضُوا الْأيْمَانَ بَعْدَ تَوکِيدِهَا وَ قَدْ جَعَلْتُمُ اللهَ عَلَيْکُمْ کَفِيلاً إنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَগ্ধ.
“ধিক্ তোমাদের ওপর। এখন তোমরা একথা বলছো? যখন আমরা সম্মত হয়েছি এবং অঙ্গীকার করেছি তখন কি পুনরায় যুদ্ধে ফিরে যাবো? কেন, আল্লাহ্ কি বলেন নি “তোমরা অঙ্গীকারসমূহকে পূরণ করো।”১৬৮? আল্লাহ্ আরো বলেছেন, “তোমরা আল্লাহ্র (নামে কৃত) অঙ্গীকার পূরণ করো এবং কসমগুলোকে দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না যখন তোমরা আল্লাহ্কে নিজেদের কাজে যামিনদার করে নিয়েছো। অবশ্যই তোমরা যা করো আল্লাহ্ সে ব্যাপারে জ্ঞাত রয়েছেন।১৬৯”১৭০
কিন্তু ইমামের এসব কথা তাদের ওপর প্রভাব ফেললো না। তারা ইমামের অনুগত্য বর্জন করলো এবং সালিসের বিষয়টিকে পথভ্রষ্টতা হিসেবে গণ্য করলো। এরা ইতিহাসে “খারিজী” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং ইসলামের সবচেয়ে বিপজ্জনক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এরা ইতিহাসে কোনো শাসনের সাথেই আপোস করে নি। নিজেদের জন্য এরা স্বতন্ত্র পথ বেছে নেয়। আমরা পরে সবিস্তারে এ দলটির চিন্তÍাগত ভ্রষ্টতাগুলো সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো এবং প্রমাণ করবো যে, সালিসের বিষয়টি খোদায়ী দ্বীনের মধ্যে ব্যক্তিদের ফয়ছালা অর্থে ছিলো না। বরং এর উদ্দেশ্য ছিলো দু’টি দলের মধ্যে মতপার্থক্য নিরসনে কোরআনের ও নবীর সুন্নাতের ভিত্তিতে মীমাংসা এবং যথাস্থানে তা খুবই সঠিক ও মযবুত একটি বিষয়, যদিও ‘আম্র্ ইবনুল ‘আছ্ তা প্রতারণাপূর্ণ উদ্দেশ্যে কাজে লাগিয়েছিলেন।
ইমাম (আঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন ঃ
إنّا لَمْ نُحَكِّمِ الْرِّجالَ و إنَّما حَكَمْنَا الْقُرآنَ وَ هٰذا القُرآنُ إنَّما هُوَ خَطٌّ مَسطُورٌ بَيْنَ الْدَّفَّتَيْنِ لايَنطِقُ بِلِسانٍ وَ لابُدَّ مِنْ تَرجُمانٍ و إنَّما يَنْطِقُ عَنْهُ الْرِّجالُ. وَ لَمّا دَعانا الْقَوْمُ إليٰ أنْ نُحَكِّمَ بَيْنَنا الْقُرآنَ لَمْ نَكُنِ الْفَريِقُ الْمُتَوَلّي عَنْ كِتَابِ اللهِ وَ قَدْ قالَ سُبْحَانَهُ: ্রفَإنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إلَي اللهِ و الْرّسُولِগ্ধ فَرَدُّهُ إلَي اللهِ أنْ نَحْكُمَ بِكِتَابِهِ وَ رَدُّهُ إلَي الْرّسُولِ أنْ نَأخُذَ بِسُنَّتِهِ.
“আমরা লোকদেরকে আল্লাহ্র দ্বীনের ফয়সালাকারী নির্ধারণ করি নি, বরং কোরআনকেই ফয়সালাকারী নির্ধারণ করেছি। আর এ কোরআন হলো একটি লিপি যা দু’টি মলাটের মাঝে অবস্থান করে। সে নিজে কথা বলে না; তার জন্য একজন বর্ণনাকারী প্রয়োজন। শামীরা যখন আমাদের কাছে দাবি করলো, আল্লাহ্ কোরআনে এরশাদ করেছেন যে, কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে বিবাদ দেখা দিলে সেটাকে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ওপর ন্যস্ত করো Ñ এখানে আল্লাহ্র শরণাপন্ন হওয়া মানে কোরআনের শরণাপন্ন হওয়া আর তাঁর রাসূলের শরণাপন্ন হওয়া মানে তাঁর সুন্নাতের শরণাপন্ন হওয়া।”১৭১
ইমাম (আঃ)-এর এ ভাষণের মধ্যে এমন একটি বাক্য রয়েছে যা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন,
فَإذا حُكِمَ بالْصِّدْقِ فِي كِتابِ اللهِ فَنَحْنُ أحْسَنُ النَّاسِ بِهِ وَ إنْ حُكِمَ بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ فَنَحْنُ أُولاهُمْ بِهِ.
“সত্যিকার অর্থে যদি আল্লাহ্র কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করা হয় তাহলে আমরাই তার জন্য যোগ্যতম লোক, আর যদি নবীর সুন্নাত অনুযায়ী ফয়সালা করা হয় তাহলে আমরাই তার জন্য অগ্রগণ্য।”
হ্যা, যে ছিফ্ফীন যুদ্ধে ইমাম (আঃ)-এর মূল্যবান সময়ের মাসের পর মাস ব্যয় হয়েছিলো এবং ইরাকী বাহিনীর ২৫ হাজার সৈন্য শহীদ হয়েছিলো আর শামী বাহিনীর ৪৫ হাজার, বর্ণনান্তÍরে, ৯০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছিলো, অবশেষে এমনই এক দিনে সে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। অতঃপর দুই বাহিনী পরষ্পর থেকে দূরে সরে যায় এবং নিজ নিজ দেশের দিকে রওয়ানা হয়।১৭২
বন্দীদের মুক্তকরণ
অঙ্গীকারনামা প্রণয়ন, স্বাক্ষর ও প্রচারের কাজ শেষ হলে আমীরুল মু’মিনীন (আঃ) শত্রুদের সকল বন্দীকে একতরফাভাবে মুক্ত করে দিলেন। অথচ শামী বন্দীদের মুক্ত করার পূর্বে ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্ ইমাম (আঃ)-এর বাহিনীর বন্দী হওয়া সৈন্যদেরকে হত্যা করার জন্য মু‘আবিয়াকে পীড়াপীড়ি করছিলেন। কিন্তু মু‘আবিয়াহ্ যখন ইমাম (আঃ)-এর এ মহৎ কাজ দেখালেন তখন শিউরে উঠলেন এবং ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছ্কে বললেন, “আমরা যদি বন্দীদেরকে হত্যা করতাম তাহলে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সর্বমহলে অপদস্থ হতাম।”
যুদ্ধের সময় বন্দী শত্রুদের সাথে ইমাম (আঃ)-এর আচরণের পন্থা অন্য রকম ছিলো। কোনো লোক বন্দী হলে তিনি তাকে মুক্ত করে দিতেন. যদি না সে কাউকে হত্যা করে থাকে। কাউকে হত্যা করে থাকলে সে ক্ষেত্রে ক্বিছাছের বিধান অনুযায়ী তাকে হত্যা করা হতো। অবশ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কোনো বন্দী পুনরায় বন্দী হলে তাকে কোনো বিচার ছাড়াই হত্যা করা হতো। কারণ, মুক্তি পাওয়ার সে যে শক্র সৈন্যদের কাছে প্রত্যাবর্তন করেছিলো তা তার অশুভ উদ্দেশ্যেরই প্রমাণ বহন করে।১৭৩
ইমাম (আঃ) সালিসী পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি রাখেন
ইমাম (আঃ) ছিফ্ফীন থেকে কূফার দিক রওয়ানা হওয়ার পর সালিসীর ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে অমনোযোগী ছিলেন না। তিনি অনবরত ইবনে আব্বাসকে (যিনি চারশ’ জনের প্রধান হিসেবে ঐ এলাকায় প্রেরিত হয়েছিলেন) প্রয়োজনীয় দিকনিদের্শনা প্রদান করতেন। মুআবিয়াহ্ও সালিসদের কর্মকা- সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না। তিনিও চারশ জন লোককে ঐ এলাকায় প্রেরণ করেছিলেন।
ইমাম (আঃ)-এর সহচরদের সাথে মু‘আবিয়ার অনুসারীদের পার্থক্য ছিলো এই যে, শামীরা চোখ-কান বন্ধ করে তাদের শাসকের আনুগত্য করতো, আর যখনই মু‘আবিয়ার নিকট থেকে কোনো পত্র আসতো তখন তারা কখনোই প্রশ্ন করতো না যে, পত্রে তিনি কী লিখেছেন। অথচ যখনই আলী (আঃ)-এর নিকট থেকে ইবনে আব্বাসের কাছে কোনো পত্র আসতো তখনি সকলে গলা বাড়িয়ে জানার চেষ্টা করতো যে, ইমাম (আঃ) তাঁকে কী নিদের্শ দিয়েছিন। এ কারণে ইবনে আব্বাস তাদেরকে ভর্ৎসনা করেন এবং বলেন, “যখনই ইমামের নিকট থেকে কোনো বার্তা আসে তখনই তোমরা জিজ্ঞেস কর, কী নির্দেশ এসেছে? আমি তা গোপন করলে তোমরা বলো, গোপন করছো কেন? আর যদি তা প্রকাশ করি তাহলে আমাদের গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যাবে; আমাদের কোনো গোপন কথাই আর গোপন থাকবে না।১৭৪
একুশতম অধ্যায়
ইমাম (আঃ)-এর ছিফ্ফীন থেকে কূফাহ্ অভিমুখে যাত্রা
সালিস-মীমাংসার বিষয়টি এমন একটি বিষয় ছিলো যা ইমাম (আঃ) জোর-জবরদস্তির মুখে এবং অন্য সকল পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মেনে নিতে বাধ্য হন। কারণ, তিনি এ ব্যাপারে আপোসহীন থাকলে তাঁর দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধীরা মু‘আবিয়ার সৈন্যদের সাথে একজোট হয়ে ইমাম (আঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতো Ñ যার পরিণাম তাঁর ও তাঁর বিশ্বস্ত সহচরদের ধ্বংস ছাড়া আর কিছু হতো না। এ কারণে সালিসের কাজ অনুমোদিত হওয়ার পর ইমাম (আঃ) প্রতিনিধি প্রেরণের পর সালিসের ওপর পর্যবেক্ষণ দল প্রেরণ করেন এবং সমস্যাবলী সমাধান ও নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে কূফায় প্রত্যাবর্তন করেন। রওয়ানা হওয়ার সময় তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) থেকে বর্ণিত এ দো‘আটি পাঠ করছিলেন ঃ
‘‘হে আল্লাহ্! সফরের কষ্ট এবং প্রত্যাবর্তনের দুঃখ আর পরিবার ও ধনসম্পদের ওপর বিপদাপদ থেকে তোমার আশ্রয় চাই।”
ইমাম (আঃ) এ দো‘আটি পড়লেন এবং ফোরাতের উপকূল ধরে কূফার উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। তিনি যখন ছান্দুদা’ শহরে পৌঁছলেন তখন বানূ সা‘ঈদ গোত্র তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে ছুটে এলো। তারা ইমাম (আঃ)-এর মেহমানদারী করতে চাইলো। কিন্তু ইমাম (আঃ) তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না।১৭৫
অতঃপর ইমাম (আঃ) যখন কূফার খেজুর বাগানসমূহের কাছে পৌঁছলেন তখন জনৈক বৃদ্ধের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটলো যিনি একটি বাড়ীর ছায়ায় বসে ছিলেন; তাঁর চেহারায় ছিলো রোগক্লিষ্টতার ছাপ। তাঁদের দু’জনের মধ্যে কিছু কথা হলো যা নিম্নরূপ ঃ
ইমাম (আঃ) ঃ তোমার চেহারা শুকিয়ে গেছে কেন? অসুস্থ নাকি?
বৃদ্ধ ঃ জ্বী।
ইমাম (আঃ) ঃ অসুস্থতায় খুশি হও নি, তাই না?
বৃদ্ধ ঃ না, অসুস্থ হতে চাই নি।
ইমাম (আঃ) ঃ এ ধরনের অসুস্থতা কি আল্লাহ্র দরবারে কল্যাণকর কাজ বলে গণ্য হয় না?
বৃদ্ধ ঃ অবশ্যই।
ইমাম (আঃ) ঃ সুসংবাদ দাও যে, আল্লাহ্র রহমত তোমাকে আবৃত করেছে এবং তোমার পাপসমূহ মার্জনা হয়ে গেছে। কী নাম তোমার?
বৃদ্ধ ঃ আমি সালামান ইবনে ত্বাই গোত্রের সালীমের পুত্র ছালেহ্, যারা সালীম বিন মানছূর গোত্রের মিত্র।
ইমাম (আঃ) সবিস্ময়ে বললেন, তোমার নাম, আর তোমার পিতা ও মিত্রদের নাম কতই না সুন্দর! তোমরা কি আমাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলে?
বৃদ্ধ ঃ না। অংশগ্রহণ করি নি। তবে আগ্রহী ছিলাম। আর আপনি যেমনটা দেখছেন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শারীরিক অক্ষমতার কারণে আমি যুদ্ধে যেতে পারি নি।
ইমাম (আঃ) ঃ আল্লাহ্র বাণী শ্রবণ করো যিনি এরশাদ করেন ঃ
لَيسَ عَلَي الضُّعَفَاءِ وَ لاَ عَلَي الْمَرْضيٰ وَ لاَ عَلَي الَّذينَ لاَ يَجِدُونَ ماَ يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلهِ وَ رَسُولِهِ مَا عَلَي الْمُحْسِنيِنَ مِنْ سَبِيلٍٍ وَ اللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ.
“দুর্বল, রুগ্ন, ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ লোকদের জন্য কোনো অপরাধ নেই যখন তারা মনের দিক থেকে আল্লাহ্ ও রাসূলের সাথে হবে। নেককারদের ওপর অভিযোগের কোনো পথ নেই। আর আল্লাহ্ হচ্ছেন ক্ষমাকারী দয়ালু।”১৭৬
ইমাম (আঃ) ঃ লোকেরা শামীদের সাথে আমাদের এ কাজ সম্পর্কে কী বলাবলি করছে?
বৃদ্ধ ঃ আপনার অনিষ্টকামীরা এ কাজে খুশি হয়েছে। কিন্তু আপনার প্রকৃত অনুসারীরা ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত।
ইমাম (আঃ) ঃ সঠিক বলেছো। আল্লাহ্ তোমার অসুস্থতাকে তোমার পাপ মার্জনার কারণ করুন। কেননা, অসুস্থতার মধ্যে কোনো পুরস্কার নেই, কিন্তু তা পাপ মার্জনার কারণ হয়। পুরস্কার কথা ও কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এতদসত্ত্বেও সৎ নিয়তের ব্যাপারে অবহেলা কাম্য নয়। কারণ, আল্লাহ্ অনেককেই তাদের সু-নিয়্যতের জন্য বেহেশত দান করবেন।
ইমাম (আঃ) এ কথাগুলো বললেন এবং তাঁর পথে চলতে শুরু করলেন।১৭৭
কিছুদূর পথ চলার পর আবদুল্লাহ্ ইবনে ওয়াদী‘আহ্ আনছারীর সাথে ইমামের সাক্ষাত ঘটলো। তিনি তার কাছ থেকে মু‘আবিয়ার সাথে চাপিয়ে দেয়া মীমাংসা সম্পর্কে জনগণের মতামত কী জানতে আগ্রহী হলেন। আবদুল্লাহ্ ও তাঁর মধ্যে নিম্নোক্ত কথোপকথন হলো ঃ
ইমাম (আঃ) ঃ জনগণ আমাদের কাজের ব্যাপারে কী বলাবলি করে?
আনছারী ঃ জনগণের মতামত দুই ধরনের। কিছু লোক এটাকে পছন্দ করেছে, আর কিছু লোক খুশি হতে পারে নি। অর্থাৎ কোরআনের ভাষায় বলতে হয় وَ لاَ يَزالُونَ مُخْتَلِفِينَ (সর্বদা তারা মতপার্থক্যে লিপ্ত।)
ইমাম (আঃ) ঃ জ্ঞানী লোকেরা কী বলেন !
আনছারী ঃ তাঁরা বলেন যে, আলীর চারপাশে একদল লোক ছিলো, কিন্তু তিনি তাদেরকে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছেন; তাঁর একটি সুরক্ষিত দুর্গ ছিলো, কিন্তু সেটাকে ধ্বংস করেছেন। আলী যাদেরকে বিক্ষিপ্ত করেছেন তাদেরকে পুনরায় একত্রিত করতে আর যে অট্টালিকা ধ্বংস করেছেন সেটাকে পুনঃনির্মাণ করতে কি তিনি সক্ষম হবেন ? তিনি যদি তাঁর অনুগত দলটি নিয়েই যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, চাই বিজয় লাভ করুন আর চাই ধ্বংসপ্রাপ্ত হোন, তাহলে সেটাই বুদ্ধিমত্তা ও সঠিক রাজনীতির কাজ হতো।
ইমাম (আঃ) ঃ আমি ধ্বংস করেছি নাকি তারা (খারেজীরা)? আমি ঐ সমষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করে দিয়েছি, নাকি তারা মতপার্থক্য করেছে এবং দলাদলি ও বিভক্তি সৃষ্টি করেছে? আর এই যে বলছে, সঠিক পদক্ষেপ ছিলো আমার অনুগত দলটিকে নিয়ে অবাধ্য দলটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো Ñ সে ব্যাপারে আমি অমনোযোগী ছিলাম না। আমি নিজের প্রাণকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলাম এবং প্রশস্ত বুকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হাযির ছিলাম। কিন্তু হাসান ও হুসাইনের দিকে তাকালাম, দেখলাম যে, শাহাদাতের পথে তারা আমার চেয়ে অগ্রগামী। এতে আমি ভয় পেলাম যে, তাদের দু’জনের মৃত্যুর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ কারণে আমি এ কাজটি পসন্দ করি নি। আল্লাহ্র শপথ, এবার যদি আমি শামীদের মুখোমুখি হই তাহলে এ পথটাই বেছে নেবো এবং ঐ দু’জন (হাসান ও হুসাইন) কখনো আমার সঙ্গে থাকবে না। ১৭৮
আনছারীর সাথে ইমাম (আঃ)-এর খোলামেলা কথাবার্তা থেকে দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় ঃ
১) ইমাম (আঃ) যে পরিবেশে জীবনযাপন করেছিলেন সে পরিবেশটি ছিলো স্বাধীনতার। সেখানে লোকেরা তদানীন্তন সরকার ও শাসন সম্পর্কে স্বাধীনভাবে নিজ মতামত ও চিন্তা-ভাবনা প্রকাশ করতে পারতো। আর নিজস্ব অভিমত প্রকাশকারীরা স্বপক্ষীয় হোক আর বিপক্ষীয় হোক, ইমাম (আঃ)-এর চোখে তারা সমান ছিলো। আর বিরোধীরা যতক্ষণ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে না তুলতো এবং সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত না হতো ততক্ষণ পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতো।
২) রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বংশ Ñ যাকে কোরআন মজীদ ‘কাওছার’ শিরোনামে আখ্যায়িত করেছে, তা রক্ষা করা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব সমূহের অন্যতম। মু‘আবিয়াহ্ এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরিণতি হতো স্বয়ং ইমাম (আঃ) এবং হাসান ও হুসাইনের শাহাদাত বরণ এবং এর ফলশ্রুতিতে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বংশ নিধন ও ইমামতের বাতি নিভে যাওয়া। ইমাম মাহ্দীর (আল্লাহ্ তাঁর আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত করুন) আবির্ভাব অবধি মা‘ছূমগণের বংশকে টিকিয়ে রাখার খোদায়ী ইচ্ছার দাবি ছিলো এই যে, ইমাম (আঃ) মীমাংসার বিষয়টিকে মেনে নেবেন। এ কথাটি যদিও সালিস-মীমাংসা মেনে নেয়ার একমাত্র দলিল ছিলো না, কিন্তু তা সেই সব কারণের মধ্যে একটি যা ইমামকে এ কাজে বাধ্য করেছিলো।
খুব্বাব্ বিন্ র্উরাতের কবরের পাশে ইমাম (আঃ)
ইমাম (আঃ) যাত্রাপথে এগিয়ে চলেন এবং এক সময় বানী ‘আউফের বাড়ীঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি রাস্তার ডানপাশে একটি উঁচু জায়গায় ৭/৮টি কবর দেখতে পান। ইমাম (আঃ) এ সব কবরে যারা সমাধিস্থ তাদের নাম জিজ্ঞেস করলেন।
কুদ্দামাহ্ বিন্ ‘আয্লান আয্দী উত্তর দিলেন ঃ খুব্বাব বিন্ র্উরাত্ আপনার ছিফ্ফীন যাত্রার পর পরই মারা যায় এবং অছিয়ত করে যেন তাকে একটি উঁচু স্থানে দাফন করা হয়। তাকে ঐখানে দাফন করার কারণে অন্যরাও তাদের মুর্দাগুলোকে তার কবরের পাশে দাফন করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
ইমাম (আঃ) খুব্বাবের জন্য মাগফেরাত কামনার পর তাঁর সম্পর্কে বললেন, “সে অন্তর থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং আগ্রহ ও উদ্দীপনা সহকারে হিজরত করে, সারা জীবন জিহাদ করে ও পরিশেষে অক্ষম হয়ে পড়ে। আল্লাহ্ সৎলোকদের পুরস্কারকে বিনষ্ট করেন না।”
অতঃপর তিনি সেখানকার মৃতদের উদ্দেশে বলেন ঃ
“হে ভয়ানক এবং পানি ও গাছপালা বিহীন শুষ্ক ভূখ-ের বাশিন্দা মু’মিন ও মুসলমান নর-নারীগণ, তোমাদের জন্য দো‘আ করছি। তোমরা আমাদের অগ্রে গমন করেছো আর আমরা তোমাদের পেছনেই রয়েছি। অল্প কিছু পরে আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হবো। হে আল্লাহ! আমাদেরকে ও তাদেরকে ক্ষমা করো এবং আমাদেরকে ও তাদেরকে মার্জনা করো।”
অতঃপর তিনি বললেন ঃ
“প্রশংসা সেই আল্লাহ্র যিনি যমীনকে স্থানীয় মৃত ও জীবিতদের সমাবেশস্থল নির্ধারণ করেছেন। প্রশংসা সেই আল্লাহ্র, যিনি সকলকে তা দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদেরকে সেখানেই প্রত্যাবর্তন করাবেন, আর তার ওপরেই পুনরুত্থান ঘটাবেন। ধন্য তারা যারা পুনরুত্থানকে স্মরণে রাখে এবং হিসাবের দিবসের জন্য কাজ করে, আর সামান্যতে তুষ্ট থাকে।”১৭৯
অতঃপর ইমাম (আঃ) স্বীয় পথে চলতে থাকলেন এবং হামদান গোত্রসমূহের ঘরবাড়ীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করলেন। সেখানে তিনি ক্রন্দনরত কিছু নারীর আওয়ায শুনলেন যারা ছিফ্ফীনে নিহত তাদের স্বজনদের জন্য কান্নাকাটি করছিলো।
ইমাম (আঃ) শুরাহ্বিলকে ডাকলেন এবং তাকে বললেন, “তোমাদের নারীদেরকে ধৈর্য ধারণ করার এবং চিৎকার না করার জন্য অনুরোধ করো।”
তিনি ইমাম (আঃ)-এর কথার উত্তরে বললেন, “ব্যাপারটা যদি দু’একটি বাড়ীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে এ অনুরোধ কাজে আসতো। কিন্তু শুধু এই গোত্র থেকেই ১৮০ জন নিহত হয়েছে এবং এমন কোনো বাড়ী নেই যেখানে কান্নার আওয়ায নেই। তবে আমরা পুরুষরা কখনো ক্রন্দন করছি না বরং তাদের শাহাদাতে আমরা আনন্দিত।”
ইমাম (আঃ) তাদের মৃতদের জন্য দো‘আ করলেন। অতঃপর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ইমামকে বিদায় জানবার জন্য যখন শুরাহ্বিল এগিয়ে গেলেন তখন ইমাম (আঃ) তাঁকে বললেন ঃ
إرْجِعْ فَاِنَّ مَشْيَ مِثْلِكَ فِتْنَةٌ لِلْوَالِي وَ مَذَلَّةٌ للْمُؤْمِنيِنَ.
“ফিরে যাও। কারণ এ ধরনের পিছনে হাঁটা শাসকের মধ্যে অহঙ্কারের আর মু’মিনদের মধ্যে হীনমন্যতার জন্ম দেয়।”১৮০
তিনি যখন কূফায় পৌঁছলেন তখন চারশ’ লোককে সালিসদ্বয়ের ওপর পর্যবেক্ষক হিসেবে নির্বাচিত করলেন। আর সারীহ্কে সেনাপতি ও ইবনে আব্বাসকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে মনোনীত করলেন। অতঃপর তাঁর ওপরে চাপিয়ে দেয়া প্রতিনিধি আবু মূসা আশ্‘আরী-কে পাঠিয়ে দেয়ার সময় হয়ে এলো।১৮১
আবু মূসা আশ্‘আরীর সাথে ইমাম (আঃ)-এর কথোপকথন
শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে আবু মূসার সরলতা ও অবিচক্ষণতার ব্যাপারে একমত ছিলো। লোকেরা তাকে ‘ভোঁতা ও হাতল বিহীন ছুরি আর অপাত্র বলে আখ্যায়িত করতো। কিন্তু আলী (আঃ) কিইবা করতে পারতেন? তাঁর সরলমনা ও অবিচক্ষণ সহচররা Ñ যাদের অধিকাংশই ছিলো আবু মূসার একই সারির লোক, তারা দু’টি বিষয় ইমামের ওপর চাপিয়ে দেয়, মূল সালিসের বিষয়টি এবং সালিশকর্তা ব্যক্তিটিকেও।
ইমাম (আঃ) আবু মূসাকে দুমাতুল জান্দালে প্রেরণ করার সময় তাকে এবং স্বীয় সচিব ‘উবায়দুল্লাহ্ ইবনে আবু রাফে‘কে বলেন ঃ أُحْكُمْ بِكِتَابِ اللهِ وَ لاَ تَجَاوَزْهُ “আল্লাহ্র কিতাবের ভিত্তিতে ফয়ছালা করবে এবং তার চেয়ে আগে পা বাড়াবে না।”
আবু মূসা যখন রওয়ানা হলো তখন ইমাম বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি যে, এ কাজে সে ধোঁকা খাবে।”
‘উবায়দুল্লাহ্্ বললেন ঃ “যদি এরূপ ঘটে আর সে ধোঁকা খায় তাহলে তাকে পাঠাচ্ছেন কেন?”
ইমাম (আঃ) বললেন ঃ
لَوْ عَمِلَ اللهُ فِي خَلْقِهِ بِعِلْمِهِ مَا احْتَجَّ عَلَيهِمْ بِالرُّسُلِ.
“আল্লাহ্ যদি স্বীয় ‘ইল্ম্ অনুযায়ী তাঁর বান্দাহ্দের সাথে আচরণ করতেন তাহলে তাদের জন্য নবী প্রেরণ করতেন না আর তাঁদের দ্বারা তাদের জন্য দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করতেন না।”১৮২
ইমামের সেনাপতি ও আবু মূসার মধ্যে কথোপকথন
ইমাম কর্তৃক দুমাতুল জান্দালে প্রেরিত চারশ’ জন লোকের অধিনায়ক শারীহ্ ইবনে হানী আবু মূসার হাত দু’টি ধরলেন এবং বললেন, “তুমি এক বিরাট দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছো, যে কাজের ফাঁক পূরণ হওয়ার নয়। জেনে রেখো, মু‘আবিয়াহ্ যদি ইরাকের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে তাহলে আর ইরাকই থাকবে না। কিন্তু আলী (আঃ) যদি শামের ওপর কর্তৃত্ব লাভ করেন তাহলে শামীদের জন্য কোনো অসুবিধা ঘটবে না। তুমি ইমামের শাসনের শুরুতে অবহেলা প্রদর্শন করেছো। আবারো যদি সেরূপ কাজ করো তাহলে অনুমান নিশ্চিত বিশ্বাস আর আশা নিরাশায় পরিণত হয়ে যাবে।”
আবু মূসা উত্তরে বললেন ঃ “যারা আমাকে দোষারোপ করে তাদের জন্য আমাকে সালিস নিযুক্ত করা এবং এ দায়িত্ব প্রদান করা সমীচীন নয় যে, আমি তাদের থেকে মিথ্যাকে প্রতিহত করবো আর সত্যকে দাঁড় করাবো।”১৮৩
ইমাম (আঃ)-এর সেনাবাহিনীর বিখ্যাত কবি এবং আবু মূসার দীর্ঘদিনের বন্ধু নাজ্জাশী কবিতার ভাষায় তাঁকে সত্য ও ন্যায় মেনে চলার জন্য অনুরোধ করলেন। যখন এ কবিতাগুলো আবু মূসাকে আবৃত্তি করে শোনানো হলো তখন তিনি বললেন, “আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি যেন দিগন্ত আলোকিত হয়ে যায় এবং আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অনুযায়ী কর্তব্য পালন করি।”১৮৪
আহ্নাফের সাথে আবু মূসার কথপোকথন
আবু মূসাকে বিদায় দানকারী সর্বশেষ ব্যক্তিটি ছিলেন আহ্নাফ। তিনি আবু মূসার হাত দু’টি ধরে বললেন, “তোমার কাজের গুরুত্ব উপলব্ধি করো এবং জেনে রাখো যে, কাজের এখানেই শেষ নয়। যদি ইরাককে হারাও তাহলে আর ইরাক নেই। আল্লাহ্র বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকো, তাহলে আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখেরাতকে তোমার জন্য একত্রিত করবেন। আগামীকাল যদি ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের মুখোমুখি হও তাহলে তুমি প্রথমে সালাম দিতে যেয়ো না, যদিও আগে সালাম দেওয়া সুন্নাত। কিন্তু সে এর উপযুক্ত নয়। আর তার হাতে তুমি হাত মেলাবে না। কারণ, তোমার হাত হলো উম্মাতের আমানত। আর তোমাকে যেন সভার সম্মুখভাগে না বসায়। কেননা এটা ধোঁকা ও প্রতারণার কাজ। তাছাড়া সভাকক্ষে তোমার সাথে একা একা কথা বলার সুযোগ দেবে না। কারণ, হয়তো সেখানে একদলকে গোপনে সাক্ষীস্বরূপ লুকিয়ে রাখবে যাতে তারা তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়।”
অতঃপর ইমামের প্রতি আবু মূসার আন্তরিকতা পরীক্ষা করার জন্য আহ্নাফ তাঁকে প্রস্তাব দিলেন ঃ “যদি ইমামের ব্যাপারে ‘আম্র্ ইবনুল্ ‘আছের সাথে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে না পারো তাহলে তাকে প্রস্তাব দেবে যে, ইরাকীরা শামে বসবাসরত কুরাইশীদের মধ্য থেকে একজনকে খলীফাহ্ হিসেবে নির্বাচন করতে পারে। আর যদি এ প্রস্তাবকে না মানে তাহলে অন্য একটি প্রস্তাব করবে যে, শামীরা ইরাকে বসবাসরত কুরাইশীদের মধ্য থেকে একজনকে খলীফাহ্ হিসেবে নির্বাচন করতে পারে।”১৮৫
বলা বাহুল্য যে, এ বক্তব্যের অর্থ হলো ইমাম (আঃ)কে খেলাফত থেকে অপসারণ এবং অন্য কাউকে খলীফাহ্ নির্বাচন করা। কিন্তু আবু মূসা এ কথা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলেন না।
আহ্নাফ দ্রুত ইমাম (আঃ)-এর কাছে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং ঘটনাটি তাঁকে অবহিত করলেন, আর বললেন, “আমরা এমন এক ব্যক্তিকে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে প্রেরণ করছি যে, আপনার অপসারণ ও বরখাস্তের কোনো পরোয়া করে না।”
ইমাম (আঃ) বললেন ঃ إنَّ اللهَ غَالِبٌ عَلَي أمْرِهِ “অবশ্যই আল্লাহ্ তাঁর কাজে বিজয়ী।”
তখন আহনাফ বললেন, “এ কাজ আমাদের জন্য কষ্টের কারণ।”১৮৬
©somewhere in net ltd.