![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শিয়াদের দশম পথপ্রদর্শক “হযরত ইমাম আবুল হাসান আলী আন নাক্বী আল হাদী (আ.)” ২১২ হিজরীর ১৫ই জিলহজ্জ¦ মদীনার পার্শবর্তী এলাকার “সারিয়া” নামক স্থানে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর মহান পিতা হলেন হযরত ইমাম জাওয়াদ (আ.) এবং মাতা মহিয়ষী রমনী “সামানাহ” যিনি খোদাভীরু এবং আদর্শ কানিজ (দাসী) ছিলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধিসমূহ হল “নাক্বী” এবং “হাদী”। তাঁকে আবুল হাসানে ছালেছ ও বলা হয়। শিয়া রেওয়াতের পরিভাষায় ইমাম মুসা ইবনে জাফরকে (আ.) প্রথম আবুল হাসান এবং ইমাম আলী ইবনে মুসা আর রেযাকে (আ.) দ্বিতীয় আবুল হাসান বলা হয়ে থাকে। ইমাম হাদী (আ.) ২২০হিজরীতে তাঁর মহান পিতার শাহাদাতের পর ইমামতের মর্যাদায় অধিষ্টিত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৮ বৎসর। তাঁর ইমামত কাল ছিল ৩৩ বছর এবং তিনি ২৫৪হিঃ সনে সামেররাতে শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাত কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪১ বৎসর কয়েক মাস মাত্র।
ইমামের শারীরিক গঠন ঃ
যারা ইমামকে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তারা বর্ণনা করেছেন। এই মহামানবের গড়ন ছিল মাঝারী, চেহারা ছিল লালচে সাদা বর্ণের; আর ছিল আয়ত নয়ন, প্রশস্ত ভ্র“ এবং তাঁর চেহারা ছিল প্রফুল্ল ও মনোরম।
সমসাময়িক কালীন খলিফা ঃ ইমাম হাদী (আ.)-এর জীবদ্দশায় ৭জন আব্বাসীয় খলিফা হুকুমত করেছিল।
১। মামুন (১৯৩-২১৮হিঃ )
২। মো’তাসেম (২১৮-২২৭)
৩। ওয়াছেক (২২৭-২৩২)
৪। মুতাওয়াক্কিল (২৩২-২৪৮)
৫। মুনতাসির (ছয় মাস)
৬। মুসতাঈন (২৪৮-২৫২)
৭। মো’তায (২৫২-২৫৫)
মুতাওয়াক্কিলের হুকুমতকালে ঐ যালিমের নির্দেশে ইমামকে (আ.) মদীনা থেকে আব্বাসীয় হুকুমতের প্রাণকেন্দ্র সামেররাতে নিয়ে যাওয়া হয়। ইমাম (আ.) জীবনের শেষ পর্যন্ত সামেররাতেই অবস্থান করেন।
মহান ইমামের (আ.) সন্তানগণ ঃ
ইমাম হাদী (আ.) এর চার পুত্র ও এক কন্যাসন্তান ছিলেন। তাঁরা হলেন ঃ একাদশ ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.), হুসাইন, মুহাম্মদ, জাফর এবং আলীয়াহ।
খলিফাদের আচরণ ঃ
অত্যাচারী ও আত্মসাৎকারী খলিফাদের সাথে সম্মানিত নবী পরিবারের সংগ্রাম ও বিরোধিতা, ইসলাম ও শীয়াদের ইতিহাসের এক রক্তিম অধ্যায়, তবে মহা গৌরবময়। আমাদের মহান ইমামগণ (আ.) কখনোই অত্যাচারী যালিম শাসকদের সাথে আপোষ করতেন না। আর সর্বদা ন্যায়বিচারের স্বপক্ষে সুবিচার প্রতিষ্টার লক্ষ্যে অত্যাচারী শাসকদের বিরোধিতা করতেন। জবরদখলকারী খলিফারা জানত যে, শিয়াদের পবিত্র ইমামগণ (আ.) মানুষের হেদায়াত, সত্য প্রতিষ্টা, মজলুমের স্বপক্ষে অত্যাচার ও নিপিড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে কখনোই কুন্ঠাবোধ করবেন না। অত্যাচারী শাসকরা ইমামগণের (আ.) এ হেদায়েত পদ্ধতি, দিক-নির্দেশনা এবং ধারাবাহিক প্রতিবাদকে সর্বদাই নিজেদের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করত। আব্বাসীয় খলিফারা ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের মাধ্যমে অত্যাচারী উমাইয়াদের স্থান দখল করেছিল এবং ইসলামী খেলাফতের নামে জনগণের উপর রাজত্ব করেছিল। জবরদখলকারী পুর্বপুরুষগণের ন্যায় নবী পরিবারকে কলংকিত করতে এবং তাঁদের সম্মান গুড়িয়ে দিতে কোন প্রচেষ্টাকেই উপেক্ষা করত না। তারা যে কোন পন্থায় মুসলমানদের প্রকৃত পথপ্রদর্শকগণের (আ.) ভাবমুর্তী ক্ষুন্ন এবং কুৎসিতরূপে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়েছিল। পবিত্র আহলিবাইতগণের (আ.) ভাবমুর্তি ও জনপ্রিয়তাকে বিদীর্ণ করতে এবং বহুবিধ চক্রান্তের মাধ্যমে ঐ মহান ইমামগণকে (আ.) মানুষের নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শন থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এবং তাঁদের প্রতি উম্মতের যে গভীর আকর্ষণ, তা বাঞ্চাল করতে সকল প্রচেষ্টা কাজে লাগিয়েছিল। এই উদ্দেশ্য হাসিল করতে মামুনের যে, ষড়যন্ত্র এবং নিজেকে ন্যায্য ব্যক্তি হিসাবে উপস্থাপন করার যে জঘন্য বর্বরতা ও নেতৃত্বের মর্যাদাকে হস্তগত করতে এবং ইমামতের সূর্যকে অস্তমিত করতে তার যে অমানবিক প্রচেষ্টা, তা যারা ইমামগণের (আ.) এবং খলীফাদের ইতিহাস স¤পর্কে জ্ঞাত তাদের কাছে গোপন নেই। আমরা অষ্টম ও নবম পথপ্রদর্শকের জীবনী বিশ্লেষণ করতে তার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। মামুনের পর মো’তাসেম আব্বাসীও অনুরূপ ষড়যন্ত্রের নীল নকশা নবী ও ইমাম পরিবারের (আ.) উপর অব্যাহত রাখে। এ কারণেই ইমাম জাওয়াদকে (আ.) মদীনা থেকে বাগদাদে নিয়ে আসে, যাতে করে তাঁকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রেখে অবশেষে শহীদ করতে পারে। তাছাড়া আলাভীদেরকে কাল পোশাক (যা আব্বাসীয়দের রসম ছিল) না পরার দায়ে কারাবন্দী করত এবং তাদেরকে হত্যা করত কিংবা তারা কারাগারেই মারা †যত। মো’তাসেম ২২৭হিঃ সামেররাতে মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর তার পুত্র ওয়াছেক তার স্থলাভিষিক্ত হয় এবং সেও তার বাবা ও চাচার চিন্তা-চেতনার অনুসরণ করেছিল। ওয়াছেকও অন্যসকল খলিফাদের ন্যায় মদ্যপ ও বিলাসী ছিল। সে এ সকল অপকর্মে এত বেশী বাড়াবাড়ি করত যে, একপ্রকার নেশাদায়ক ট্যাবলেট ব্যবহার করত, যার মাধ্যমে উন্মাদনার মাত্রা আরও অধিক বৃদ্ধি পেত। সে ২৩২হিঃ সনে সামেররাতে মৃত্যুবরণ করে। আলাভীদের সাথে ওয়াছেকের ব্যবহার রূঢ় ছিল না। আর এ কারণেই তার সময়ে আলাভীরা সামেররাতে একত্রিত হতে পেরেছিলেন এবং কিছুটা সস্তিতে থাকতে পেরেছিলেন। কিন্তু মুতাওয়াক্কিলের সময়ে (তার অত্যাচারের ফলে) তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন। ওয়াসেকের পর তার ভাই মুতাওয়াক্কিল (যে আব্বাসীয়দের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম, পংকিল, পাপিষ্ট এবং অত্যাচারী ছিল) খেলাফত গ্রহন করে। অন্যসকল আব্বাসীয় খলিফাদের তুলনায়, ইমাম হাদী (আ.) এর জীবনের †বশীরভাগ সময় মুতাওয়াক্কিলের শাসনামলেই অতিবাহিত হয়েছিল, যা চৌদ্দ বছরেরও অধিক।
এ দীর্ঘ সময় ইমাম হাদী (আ.) এর অনুসারীদের জন্য জীবনের একঅতি কষ্টদায়ক অধ্যায় হিসাবে পরিগণিত হয়। কেননা, মুতাওয়াক্কিল আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে জঘন্যতম এবং নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক ছিল। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের প্রতি সে খুবই বিদ্বেষ পোষণ করত। তার হুকুমত কালে বহুসংখ্যক আলাভী মৃত্যুবরণ করেন অথবা বিষাক্রান্ত হন, নতুবা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। মুতাওয়াক্কিল মিথ্যা এবং মনগড়া স্বপ্ন বর্ণনা করে জনগণকে “মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস শাফেয়ী” (যে তার সময়ে মারা গিয়েছিল) তার অনুসরণ করতে অনুপ্রেরণা যোগাত। আর এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে ইমাম (আ.) গণের প্রতি ভক্তি প্রদর্শন থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালাত। ২৩৬ হিজরীতে শহীদের †নতা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক এবং পার্শবর্তী ভবনসমূহ ধ্বংস করার নির্দেশ দেয় এবং ঐ স্থানে চাষাবাদ করার আদেশ দেয় এমনকি জনগণকে ঐ পবিত্র স্থান যিয়ারত করতে কঠোরভাবে বাধা প্রদান করে।
মুতাওয়াক্কিল ভয় পেত যে, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক তার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী ঘাঁটি হিসাবে গড়ে উঠবে। আর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাৎ ও আন্দোলন অত্যাচারী আব্বাসীয় খলিফাদের বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে সংগ্রাম ও অভ্যুত্থানের চেতনাকে জাগরিত করবে। কিন্তু শিয়া ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ভক্তরা কোন পরিস্থিতিতেই ঐ পবিত্র রওজা যিয়ারত করা থেকে বিরত থাকেন নি। এমনকি বর্ণিত আছে যে, মুতাওয়াক্কিল ১৭বার ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক ধ্বংস করে এবং যিয়ারতকারীদেরকে বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখায়। রওজার পাশে দুটি সামরিক ঘাটি স্থাপন করে। এত সব অত্যাচারের পরও তারা জনগণকে শহীদদের নেতার মাজার যিয়ারত থেকে বিরত রাখতে পারেনি। যিয়ারতকারীরা বিভিন্ন প্রকার ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে হলেও তাদের নেতার পবিত্র রওজা যিয়ারত করতে যেতেন। অত্যাচারী মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যুর পর, শীয়ারা আলাভীদের সাহায্যে স্বাধীনতার প্রতীক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র রওজা শরীফকে পুনঃনির্মান করেন। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা শরীফ ধ্বংশ করার ফলে মুসলমানরা এতই রাগান্বিত হয়েছিল যে, বাগদাদের জনগণ মুতাওয়াক্কিলের বিরুদ্ধে দেয়ালে এবং মসজিদের গায়ে সংগ্রামী কবিতা লিখে রাখত এবং এভাবে তাকে ব্যঙ্গ করত। নিম্নলিখিত কবিতাটি ঐ অত্যাচারীকে ব্যঙ্গ করে যে সকল কবিতা রচনা করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি ঃ “আল্লাহর কসম বনি উমাইয়্যা নবী (সা.) কন্যার সন্তানকে হত্যা করেছে। বর্তমানে যারা তার বংশধর (আব্বাসীয়রা আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান এবংবনি হাশিমের অন্তর্ভুক্ত) তারা বনি উমাইয়্যাদের মত অত্যাচারে লিপ্ত হয়েছে; ইহা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক, আমার জীবনের কসম তা ধ্বংশ করা হয়েছে।”
“মনে হয় যেন আব্বাসীয়রা দুঃখিত যে, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হত্যাকান্ডে জড়িত থাকতে পারেনি। এবং বর্তমানে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক ধ্বংস করে উমাইয়্যাদের পদানুসরণ করছে।” হ্যাঁ, যেহেতু জনগণের কোন বাক-স্বাধীনতা ছিলনা, আর মসজিদ মিম্বর এবং বক্তৃতা ও প্রচারের মঞ্চ শাসক শ্রেনীর আয়ত্বে ছিল (যা জনগণের সাধ্যের বাইরে ছিল), তাই তারা এভাবেই তাদের ক্রোধ ও বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাত। স্বীকৃত কবি এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও তাদের শিল্গ নৈপুণ্যতা এবং সাহিত্য প্রতিভা কাজে লাগিয়ে আব্বাসীয়দের অত্যাচারের চিত্র ফুটিয়ে তুলতেন এবং এভাবে জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার করে তুলতেন। অপরদিকে মুতাওয়াক্কিল সকল প্রকার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ধ্বনি বন্ধ করতে, কোন প্রকার অত্যাচার ও নিপীড়ন চালাতেই কুন্ঠাবোধ করেনি। পন্ডিত, সাহিত্যিক এবং অন্য সকল †শ্রণীর জনগণ, যারা তার অপকর্মের সাথে আপোস ও সহযোগিতা করতে রাজি হতেন না তাদেরকে কঠোর ভাবে দমন করত এবং নির্মমভাবে হত্যা করত।
প্রখ্যাত শিয়া সাহিত্যিক ও কবি “ইবনে সিক্কিত” যাকে আরবী ব্যাকরণের ইমাম বলা হত, তিনি মুতাওয়াক্কিলের সন্তানদের গৃহ শিক্ষক ছিলেন। একদা মুতাওয়াক্কিল তার দুই সন্তান মো’তায এবং মুসতাইনের দিকে ইশারা করে ইবনে সিক্কিতের কাছে প্রশ্ন করলÑএ দু’জন তোমার নিকট অধিক প্রিয় না ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)? ইবনে সিক্কিত তৎক্ষণাত জবাব দিল ঃ কাম্বার (আলী (আ.) এর গোলাম) তুমি ও তোমার দুই সন্তানের চেয়ে শ্রেয়তর। মুতাওয়াক্কিল আঘাত প্রাপ্ত ভল্লুকের ন্যায় উন্মাদ হয়ে, ইবনে সিক্কিতের জিহ্বা তার পিছন দিয়ে বের করে কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়। আর এভাবেই এ মহান বীর, সম্মানের প্রতীক এবং আদর্শ ব্যক্তিত্ব ৫৮ বছর বয়সে শাহাদাৎ লাভ করেন। মহান আল্লাহর, পবিত্র ব্যক্তিবর্গ এবং স্বাধীনচেতাদের দরুদ ও সালাম তার উপর বর্ষিত হোক। মুতাওয়াক্কিল ও অন্যসকল অত্যাচারী খলিফাদের ন্যায় মুসলমানদের বাইতুলমাল লুন্ঠনে খুব বেশী তৎপর ছিল এবং ভোগ বিলাসের ক্ষেত্রে মুক্তহস্ত ছিল। যেমনটি তার জীবনীতে পাওয়া যায় যে, সে বিভিন্ন ধরনের অট্টালিকা গড়ে তুলেছিল। শুধুমাত্র তার রাজপ্রাসাদ তৈরিতে ১৭ লক্ষ দিনার স্বর্ণমুদ্রা, খরচ করেছিল। যা এখনো সামেররাতে অবশিষ্ট আছে।
সর্বাধিক মর্মস্পর্শ্বী ঘটনা হল যে, অত্যাচারী শাসকদের এরূপ অপচয়, অপব্যয় এবং ভোগবিলাসের পাশাপাশি আলাভীরা ও রাসূল পরিবারের সদস্যরা অতি কষ্টে জীবন নির্বাহ করতেন। এমনকি আলাভী পরিবারের সম্মানিত রমনীদের এক সেট ভাল কাপড়ও ছিল না, যা দ্বারা তারা নামায আদায় করবেন। শুধুমাত্র এক সেট জরাজীর্ন কাপড় ছিল যা তারা নামাজের জন্যে পালাক্রমে ব্যবহার করতেন। এবং চর্কা ঘুরিয়ে সুতা বানিয়ে (তা বিক্রয় করে) জীবন নির্বাহ করতেন। মুতাওয়াক্কিলের মৃত্যু পর্যন্ত তারা অতিকষ্টে এবং অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করেন।
আলী (আ.)-এর প্রতি বিদ্বেষ এবং শত্র“তাই ছিল তার এহেন অবিশ্বাস্য হীনমন্যতা ও নীচতার মূল কারণ। মুতাওয়াক্কিল নাসেবী(আলী আঃ বিদ্বেষী) এবং আহলুল বাইতের দুশমনদের সাথে ঘনিষ্ট স¤পর্ক স্থাপন করত।
এমনকি তার অপবিত্র এবং পংকিল আত্মার তুষ্টির জন্যে তার ভাঁড়কে তার উপস্থিতিতেই ঘৃণ্য এবং লজ্জাজনক কার্যের মাধ্যমে আমিরুল মুমিনিন আলীকে (আ.) উপহাস করার নির্দেশ দিয়েছিল। মুতাওয়াক্কিল তার ভাঁড়ের অশ্লীল ও কুৎসিৎ ভাবÑভঙ্গি দেখে শরাব পান করত এবং মাতাল হয়ে অট্ট হাসি হাসত। এরূপ অপকর্ম মুতাওয়াক্কিলের পক্ষে কোন আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল না, বরং বিস্ময়কর ও দুঃখজনক হল তাদের পরিস্থিতি, যারা এহেন নোংরা ও নিকৃষ্ট বানরদেরকে ইসলামের খলিফা এবং মুসলমানদের নেতা বলে মনে করে এবং সঠিক ইসলাম ও রাসূল (সা.)ও তাঁর পবিত্র আহলুল বাইতকে পরিত্যাগ করে এরূপ জালিম ও নিকৃষ্ট ব্যক্তিদের অনুসরণ করে! হায়! আফসোস মানুষ কতটা গোমরাহ হতে পারে। সর্বোপরি, মুতাওয়াক্কিল এত †বশী অত্যাচারী ছিল যে, এমনকি কখনো কখনো নিজেই তা স্বীকার করত। একদিন তার উজির তাকে চিন্তিত দেখে তোষামদি করে বলল ঃ আপনি কোন চিন্তা করছেন? আল্লাহর কসম পৃথিবীর বুকে কেউই আপনার ন্যায় সুখী ও সুন্দর জীবন-যাপন করে না। মুতাওয়াক্কিল উত্তর দিল ঃ আমার চেয়ে ঢের সুখী ও সুšদর জীবন ঐ ব্যক্তির যার একটা ভাল বাসগৃহ, যোগ্যা স্ত্রী এবং জীবনযাত্রার সকল উপকরণ প্রস্তুত আছে। কেননা আমাকে অত্যাচারী হিসাবে সকলেই চিনে!
রাসূল (সা.)-এর আহলি বাইতের প্রতি মুতাওয়াক্কিল এতই কঠোরতা অবলম্বন করেছিল যে, শুধুমাত্র ইমামগণের (আ.) অনুসরণ এবং তাঁদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করার কারণে জনগণের উপর নির্যাতন করত। উক্ত কারণেই পবিত্র আহলি বাইতের (আ.) সদস্যরা তাঁদের দ্বীনী কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে কঠিন সমস্যার সন্মুখীন হতেন। মুতাওয়াক্কিল ওমর ইবনে ফারাহ রাজিকে মক্কা ও মদীনার গভর্ণর নিযুক্ত করেছিল। আর সে জনগণকে আবুতালীবের বংশধরের প্রতি সদাচরন করতে বাধা দিত। কেউ তাঁদের সাথে সদ্ব্যবহার করলে সে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিত। জনগণও জীবনের ভয়ে নবী পরিবারের সদস্যদেরকে সাহায্য ও সমর্থন করা থেকে বিরত থাকত। যার ফলে রাসূল (সা.)-এর আহলি বাইতের জীবন ব্যবস্থা অতি কষ্টদায়ক হয়ে পড়েছিল।
সামেরায় ইমাম দাওয়াত ঃ
সমাজে ইমামগণের (আ.) অনিবার্য প্রভাব এবং তাঁদের প্রতি জনসাধারনের আকর্ষণের কারণেই অত্যাচারী খলিফারা ভয় পেত এবং ইমামগণকে (আ.) স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা প্রদান করত। মুতাওয়াক্কিলের ক্ষেত্রে এ ভীতি ছাড়াও নবী পরিবারের প্রতি যে বিশেষ শত্র“তা ও হিংসা ছিল, তাও তার কঠোর হওয়ার এক মুখ্য কারণ। আর একারণেই ইমাম হাদীকে (আ.) মদীনা থেকে সামেররাতে নিয়ে আসে। যেন ইমামকে (আ.) নিকট থেকে স্বীয় নিয়ন্ত্রনে রাখতে পারে। সে ২৪৩ হিজরিতে ইমাম হাদীকে (আ.) সম্মানের সাথে মদীনা থেকে সামেররাতে নির্বাসন দিয়েছিল এবং ইমামকে সামরিক ঘাটির পাশে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। তাঁকে জীবনের শেষ লগ্ন (অর্থাৎ ২৫৪হিঃ) পর্যন্ত সেখানেই থাকতে বাধ্য করেছিল। সে ইমামকে (আ.) কঠোর নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখত এবং তার পরবর্তী খলিফারাও মহান ইমামকে (আ.) তাঁর শাহাদাত পর্যন্ত বিশেষ নিয়ন্ত্রনে রেখেছিল।
ইমাম হাদী (আ.) এর নির্বাসনের ঘটনাটি এরূপ ঃ মুতাওয়াক্কিলের খেলাফত কালে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি মদীনায় সামরিক পদাধিকারী ও নামাজের দায়িত্বশীল ছিল। সে ইমাম হাদী (আ.)-এর প্রতি অত্যাচার করত এবং মুতাওয়াক্কিলের কাছে ইমামের (আ.) কুৎসা রটাত। ইমাম হাদী (আ.) ঘটনাটি জানতে পেরে এক পত্রে আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদের মিথ্যাচার ও দুশমনি স¤পর্কে মুতাওয়াক্কিলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। সে চিঠির উত্তরে ইমামকে (আ.) সম্মানের সাথে সামেররাতে নিয়ে আসার দাওয়াত পাঠিয়েছিল। চিঠির উত্তরটি নিন্মরূপ ঃ
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম।
নিশ্চয় আমীর আপনার মর্যাদাকে উপলদ্ধি করেন। তিনি আপনার সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে চান এবং আপনার অধিকার ন্যায্য বলে মনে করেন। আমীর, আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদকে আপনার মর্যাদার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন, আপনার প্রতি বেয়াদবী এবং দোষারোপ করার জন্য পদচ্যুত করলেন। আমীর জানেন যে আপনি এসকল অভিযোগ থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত এবং আপনি আপনার কথা ও কর্মে সত্যবাদী। আর আপনার ব্যাপারে যে সকল মিথ্যারোপ করা হয়েছে, আপনি সে সকল বিষয়ে নিজেকে লিপ্ত করেননি। তিনি তার স্থানে মুহাম্মদ ইবনে ফযলকে নিয়োগ দিয়েছেন এবং তাকে আপনার প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং আপনার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ মেনে চলার আদেশ দিয়েছেন। তবে আমীর আপনার প্রতি অনুরক্ত এবং আপনার সাথে নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে চান। অতএব যদি আপনিও তার সাথে সাক্ষাৎ ও তার সাথে অবস্থান করতে চান, তাহলে আপনি, আপনার পরিবার এবং যাদেরকে পছন্দ করেন তাদেরকে নিয়ে সুবিধামত সময়ে আমাদের কাছে চলে আসুন।
সফরকালে পথিমধ্যে বিরতির স্থান এবং পথ নির্বাচন আপনার ইচ্ছার উপর ন্যাস্ত করা হল। হারেছকে কিছু সৈন্য সহ পাঠানো হয়েছে আপনি চাইলে তাদেরকে সাথে রাখতে পারেন এবং তাকে আপনার নির্দেশ মেনে চলার আদেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমীরের সাথে মোলাকাত করার জন্যে আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা করুন। তার নিকট তার ভ্রাতা, সন্তান এমনকি তার পরিবারের কেউই আপনার চেয়ে অধিক প্রিয় নয়। ওয়াস সালাম।
নিঃসন্দেহে ইমাম হাদী (আ.) মুতাওয়াক্কিলের দুরভীসন্ধি স¤পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। কিন্তু সামেররাতে যাওয়া ছাড়া ইমামের (আ.) আর কেন উপায় ছিল না, কেননা তার দাওয়াত গ্রহন না করা মিথ্যাচারিদের জন্যে একটি দলিল হত। আর এভাবে মুতাওয়াক্কিল বেশী উত্তেজিত হত এবং সে এটাকে একটি বৃহৎ অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করত। ইমাম হাদী (আ.) যে উপায়ান্তর না দেখে, বাধ্য হয়ে সামেররাতে এসেছিলেন তার স্পষ্ট দলিল হল এই যে, পরবর্তীতে তিনি নিজেই বলেন ঃ “আমাকে জোরপুর্বক মদীনা থেকে সামেররাতে আনা হয়েছে।”
যাহোক ইমাম হাদী (আ.) চিঠি পেয়ে সামেররার উদ্দেশ্যে রওনা করেন এবং ইয়াহিয়া ইবনে হারছামাও তাঁর সাথে ছিল। ইমাম সামেররাতে পৌছালে মুতাওয়াক্কিল সেদিন তাঁকে শহরে প্রবেশ করার অনুমতি না দিয়ে ‘খানুস সায়ালিক’ নামক এক অনুপযুক্ত স্থানে (যেখানে ভিক্ষুকরা থাকত) থাকার নির্দেশ দিয়েছিল। সে দিনটি ইমাম (আ.) সেখানেই অবস্থান করেছিলেন। পরদিন মুতাওয়াক্কিল একটি পৃথক গৃহ ইমামের জন্য বরাদ্দ করল এবং ইমামকে (আ.) সেখানে স্থানান্তরিত করল। সে বাহ্যিকভাবে ইমামকে (আ.) শ্রদ্ধা করলেও গোপনে ইমামের (আ.) বদনাম করত এবং সে তাঁর ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সে ক্ষমতা তার ছিল না।
সালেহ ইবনে সাঈদ বলেন ঃ ইমাম হাদী (আ.) যেদিন ‘খানুস সায়ালিকে’ প্রবেশ করেন, আমি তাঁর খেদমতে পৌছে নিবেদন করলাম ঃ আমার জীবন আপনার জন্য উৎসর্গ হোক, এই অত্যাচারী (মুতাওয়াক্কিল) সকল ক্ষেত্রে আপনার নুর নিভিয়ে দিতে চায় এবং আপনার মর্যাদাকে অগ্রাহ্য করতে চায়। আর সে কারণেই আপনাকে এই নিন্মমানের সরাইখানায় (যেখানে ফকিররা থাকে) উঠিয়েছে। ইমাম হাদী (আ.) একদিকে ইশারা করে বলেন ঃ ওহে সাঈদ ঐখানটাতে দেখ। আমি চেয়ে দেখলাম একটি সুসজ্জিত বাগান যা ছিল বিভিন্ন প্রকার ফলে পরিপুর্ণ, প্রবাহিত ঝর্ণা ধারা, বেহেশতি হুর ও গেলমান, এদৃশ্য দেখে আমি আশ্চর্য বোধ করলাম এবং দিশেহারা হয়ে গেলাম।
ইমাম হাদী (আ.) বললেন ঃ আমরা যেখানেই থাকি এগুলো আমাদের খেদমতে নিয়োজিত থাকে। হে ইবনে সাঈদ আমরা খানুস সায়ালিকে থাকি না। ইমাম হাদী (আ.) সামেররাতে অবস্থান কালে অত্যন্ত কষ্ট ভোগ করেছিলেন। বিশেষ করে মুতাওয়াক্কিলের পক্ষ থেকে সার্বক্ষনিক হুমকি ও সমূহ বিপদের আশংকায় ছিলেন। নিন্মে বর্ণিত ঘটনাবলী সামেররাতে থাকাকালীন সময়ে ইমামের (আ.) দূর্বিসহ অবস্থার এবং অত্যাচারী শাসকদের অত্যাচারের মোকাবেলায় তাঁর ধৈর্য ও অবিচলতার প্রমাণ বহন করে। সাকার ইবনে আবি দুলফ বলেন ঃ ইমাম হাদীকে (আ.) সামেররাতে আনা হলে আমি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে জানতে গোলাম। মুতাওয়াক্কিলের প্রহরী যাররাফী আমাকে দেখে বলল এদিকে এস, তার কাছে গেলে জিজ্ঞাসা করল ঃ কী জন্যে এসেছ? বললাম ঃ কল্যাণ কাজে এসেছি। বলল ঃ বস। কিন্তু ভয় লাগছিল এবং মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম ইমামের (আ.) সাথে দেখা করতে এ†স হয়ত ভুল করেছি, জানিনা আমার অদৃষ্টে কী আছে! যাররাফী লোকজনকে সরিয়ে দিয়ে বলল ঃ কী দরকার এবং কিসের জন্যে এসেছ? বললাম ঃ শুভ কাজের জন্যে এসেছি। বলল ঃ মনে হয়, তোমার মাওলার খবর নিতে এসেছ। বললাম ঃ আমার মাওলা কে? খলিফা আমার মাওলা! বলল ঃ থাম, তোমার মাওলা সঠিক পথে আছে, ভয় করনা, কেননা আমিও তোমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং তাঁকে (ইমাম হাদীকে আ.) ইমাম হিসাবে মানি। আমি আল্লাহর শোকর করলাম এবং সে বলল ঃ তুমি কি তাঁর কাছে যেতে চাও?
বললাম ঃ হ্যাঁ। বলল ঃ কিছু সময় অপেক্ষা কর, সংবাদ বাহক চলে যাক তার পর। সংবাদ বাহক চলে গেলে যাররাফী তার গোলামকে বলল ঃ এই লোকটাকে যেখানে ঐ আলাভী (অর্থাৎ ইমাম হাদী আ.) বন্দী আছে নিয়ে যাও। ইমামের খেদমতে পৌছে দেখলাম তিনি একটি পাটির উপর বসে আছেন এবং তাঁর সামনে একটি কবর খোড়া আছে। সালাম করলাম, ইমাম (আ.) জবাব দিয়ে বসতে বললেন। বসলাম, ইমাম হাদী (আ.) জিজ্ঞাসা করলেন কেন এসেছে?
নিবেদন করলাম ঃ আপনার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এসেছি। আর ঐ কবরের দিকে চেয়ে কেদে ফেললাম। ইমাম (আ.) বললেন ঃ কেদনা, কেননা সে বর্তমানে আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।
আমি আল্লাহর প্রশংসা করলাম। অতঃপর একটি হাদীসের অর্থ জিজ্ঞাসা করলাম। ইমাম (আ.) জবাব দিলেন এবং বললেন আমাকে একা থাকতে দাও। কেননা এখানে থাকলে হয়ত তোমার ক্ষতি হতে পারে।
আহলে সুন্নতের বিশিষ্ট আলেম ইবনে জাওযী বলেন ঃ একবার কিছু দুষ্ট †লাক মুতাওয়াক্কিলের কাছে ইমাম হাদী (আ.) সম্পর্কে মিথ্যা রটনা করল যে, তাঁর ঘরে অস্ত্রসস্ত্র কিছু লেখাজোকা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আছে, যা শিয়ারা কোম থেকে পাঠিয়েছে; আর তিনি হুকুমতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে প্রস্তুত।
মুতাওয়াক্কিল একদল গোয়েন্দা পাঠাল, তারা রাত্রে ইমামের (আ.) ঘরে প্রবেশ করে সর্বত্র খোজাখুঁজি করে কোথাও কিছু পেল না, বরং দেখল ইমাম হাদী (আ.) মেঝেতে বসে ইবাদতে মশগুল আছেন এবং কোরআন তেলাওয়াত করছেন। ইমামকে (আ.) ঐ অবস্থায় মুতাওয়াক্কিলের কাছে নিয়ে গেল। আর তাকে বলল ঃ ইমামের (আ.) ঘরে কিছুই পাইনি এবং তাঁকে দেখলাম কেবলামুখী হয়ে কোরান তেলাওয়াত করতে। মুতাওয়াক্কিল ইমামকে (আ.) দেখে তাঁর মর্যাদা ও বিরাট ভাবমূর্তী লক্ষ্য করে নিজের অজান্তেই তাঁকে সম্মান জানাল এবং ইমামকে (আ.) নিজের পাশে বসাল। আর তার হাতে যে শরাবের পেয়ালা ছিল, তা ইমামের (আ.) দিকে বাড়িয়ে দিল। ইমাম হাদী (আ.) বললেন ঃ আমার রক্ত-মাংস এই সকল অপবিত্র দ্রব্য দ্বারা কখনোই মিশ্রিত হয়নি। কাজেই আমাকে অব্যাহতি দাও। মুতাওয়াক্কিল আর পিড়াপিড়ি না করে বলল ঃ একটা কবিতা বলুন। ইমাম হাদী (আ.) বললেন ঃ আমার তেমন কোন কবিতা মুখস্থ নেই। বলল ঃ অবশ্যই বলতে হবে। ইমম হাদী (আ.) এই কবিতাটি পাঠ করলেন ঃ
“পার্বত্য এলাকার পাহাড় চুড়ায় রাত্রি প্রভাত করল এবং শক্তিশালী ব্যক্তিরা তাদেরকে পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখর তাদেরকে (মৃত্যুর হাত থেকে) রক্ষা করতে পারল না।”
“সম্মানের পর নিরাপদ স্থান থেকে নিচে নামিয়ে তাদেরকে গর্তের মধ্যে (কবরের মধ্যে) স্থান দিল। আর তা কতইনা অপছন্দনীয় আশ্রয় স্থল।”
“যখন সমাধিস্থ করা হল, আহব্বানকারী চিৎকার করে বলল ঃ কোথায় আছে সেই দামী জাঁকাল বাজুবন্ধ, মুকুট (তাজ) এবং জাকজমকপূর্ণ পরিচ্ছদ?”
“কোথায় আছে সেই সকল লাজুক এবং বিলাসপূর্ণ চেহারা, যাদের সম্মানে পর্দা টাঙ্গানো হত। (যাদের প্রাসাদ, ঝালোর এবং দারওয়ান ছিল)?”
“তাদের পরিবর্তে কবর জবাব দিল ঃ সেই সকল চেহারার উপর এখন কীট-পতঙ্গরা বিচরন করছে।”
ইমাম হাদী (আ.)-এর প্রাণ কাড়া বাণী মুতাওয়াক্কিলের উপর এতই প্রভাব ফেলেছিল যে সে কেদে ফেলেছিল এবং তার শ্মশ্র“ বেয়ে অশ্র“ ঝরছিল। উপস্থিত সকলেও কাঁদছিল। অতঃপর মুতাওয়াক্কিল শরাবের বিছানা গুটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিল এবং ইমাম হাদীকে (আ.) চার হাজার দেরহাম উপহার দিল।
ইমামের গৃহে অপর এক হামলা ঃ
মুতাওয়াক্কিল এক কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর ইমাম হাদী (আ.)-এর কাছে চিকিৎসার পরামর্শ চায়, সে ইমামের (আ.) পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে ওথে এবং পাঁচশত দেরহাম ইমামকে (আ.) হাদিয়া সরূপ পাঠিয়েছিল। তার মাতা ও মানত মোতাবেক দশহাজার দিনারের একটি পুটলি ইমাম হাদী (আ.)-এর খেদমতে পাঠিয়েছিল। এ ঘটনার কিছুদিন পর বাতহায়ী নামে এক দুষ্ট লোক মুতাওয়াক্কিলের কাছে মিথ্যা প্রচার করে যে, ইমাম হাদী (আ.) যুদ্ধের জন্য টাকা-পয়সা, অস্ত্র-সস্ত্র এবং সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করেছেন। মুতাওয়াক্কিল সাঈদ হাজাবকে নির্দেশ দিল কিছু সৈন্য এবং শক্তিশালী যোদ্ধাদেরকে নিয়ে আতর্কিত ইমামের বাসায় হামলা কর, আর যা কিছু পাবে তা বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এস।
সাঈদ বলে ঃ যখন সকলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, এক দল যুদ্ধবাজ নিয়ে ছাদের উপর দিয়ে হযরতের বাসার দিকে গেলাম। অতঃপর চেরাগ ও মশাল নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে দু’টি পুটলি, যার একটি স্বর্ণ মুদ্রায় পূর্ণ ছিল এবং তাতে মোহর মারা ছিল, অপরটিতে সামান্য কিছু মুদ্রা ছিল। আর পুরাতন গেলাফে ঝোলান একটি তলোয়ার ব্যতীত কিছুই পেলাম না। ইমামকে (আ.) †দখলাম একটি পাটিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন, তাঁর গায়ে একটি পশমী জুব্বা ও মাথায় একটি টুপি ছিল। তিনি আমাদের প্রতি কোন ভ্রক্ষেপই করলেন না। দু’পুটলি মুদ্রা ও তলোয়ারটি মুতাওয়াক্কিলের কাছে নিয়ে গেলাম এবং বললাম স¤পদ ও টাকা পয়সা বলতে যা পেয়েছি তা হল এই। মুতাওয়াক্কিল যে পুটলিটির মধ্যে তার মায়ের সিল ছিল তা দেখে বিষয়টি তার কাছে জানতে চাইল। তার মা বলল তুই যখন অসুস্থ ছিলি আমি মানত করেছিলাম যদি আল্লাহ তোকে সুস্থ করেন তাহলে আবুল হাসানকে (ইমাম হাদী আ.) দশ হাজার স্বর্ণ মুদ্রা দিব। তোর সুস্থ হওয়ার পর আমি সে মানত পূর্ণ করি। মুতাওয়াক্কিল আরও পাঁচশত দিনার দিয়ে সাঈদ হাজাবকে বলল ঃ দু’টি পুটলি এবং তলোয়ার সহ এ পাঁচশত দিনার ইমামকে (আ.) ফিরিয়ে দিয়ে এস এবং আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিও।
সাঈদ বলে ঃ ঐ গুলিকে ফিরিয়ে দিয়ে নিবেদন করলাম যে, আমির ক্ষমা চেয়েছে। আর আমাকেও ক্ষমা করবেন কেননা আমি কর্মচারী, আমিরের হুকুম অমান্য করার সাধ্য আমার নেই। ইমাম (আ.) বললেন ঃ অচিরেই অত্যাচারীগণ উপলদ্ধি করতে পারবে যে কোথায় প্রত্যাবর্তণ করতে হইবে। অবশেষে মুতাওয়াক্কিলের লাঞ্ছনাকর হুকুমতের অবসান ঘটল। তার পুত্র মুনতাসিরের উষ্কানিতে একদল তুর্কী সেনা তাকে ও তার উজির ফাতহ ইবনে খাকানকে যখন তারা আমোদ প্রমোদে মত্ত ছিল হত্যা করেছিল। আর এভাবে পৃথিবী তার পংকিলতাপূর্ণ অস্তিত্ব থেকে পবিত্র হল। মুনতাসির তার পরের দিন খেলাফত গ্রহন করে এবং তার বাবার কয়েকটি প্রাসাদ ধ্বংশ করার আদেশ দেয়। সে আলাভীদের কোন ক্ষতি করত না এবং তাদের প্রতি সহানুভুতি ও সহমর্মিতা প্রদর্শন করত। সে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক যিয়ারত করার অনুমতি দিয়েছিল এবং তাদের প্রতি সদয় অচরণ করেছিল। বাগে ফাদাক ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সন্তানদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল এবং তাদের ওয়াকফ করা সম্পত্তি সমূহকে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ প্রদান করেছিল। মুনতাসিরের খেলাফত কাল মাত্র ছয় মাস স্থায়ী হয়েছিল এবং সে ২৪৮ হিজরীতে মারা গিয়েছিল। মুনতাসিরের পর তার চাচাত ভাই মুসতাঈন খেলাফত গ্রহণ করে এবং পূর্ববর্তী অত্যাচারী খলিফাদের নীতি গ্রহন করে। তার হুকুমত কালে আলাভীদের একটি দল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং সকলেই মৃত্যুবরণ করেছিল। মুসতাঈন তার তুর্কী সৈন্যদের আন্দোলন দমন করতে অক্ষমতা প্রকাশ করে আর এ সুযোগে বিদ্রোহীরা মো’তাযকে বন্দিশালা থেকে মুক্ত করে তার হাতে বয়াত করে। এভাবে মো’তাযের ক্ষমতা ও প্রভাব তুঙ্গে ওঠে এবং মুসতাঈন তার সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হয়। মো’তায বাহ্যিক ভাবে সন্ধি মেনে নিয়ে মুসতাঈনকে সামেররাতে ডেকে পাঠায় এবং তাকে পথিমধ্যে হত্যা করার নির্দেশ †দয়।
মুসতাঈন তার আত্মীয় স্বজন এবং কিছু তুর্কী সেনাদের আমোদ প্রমোদের জন্য বাইতুলমাল খুলে রেখেছিল। অপরদিকে আমাদের মাসুম ইমামগণের (আ.) সাথে অতিশয় অন্যায় আচরন করত। কিছু বর্ণনা অনুযায়ী মুসতাঈন ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর অভিশাপে ধ্বংশ হয়।
মুসতাঈনের পর মুতাওয়াক্কিলের পুত্র মো’তায খেলাফত গ্রহন করে। আলাভীদের সাথে তার আচরণ অতিশয় মন্দ ছিল। তার হুকুমতকালে বহুসংখ্যক আলাভীকে হত্যা করা হয়েছিল কিংবা বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। আর ইমাম হাদীও (আ.) তার সময়ই শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
মো’তায অবশেষে তুর্কী সর্দার ও অন্যান্যদের বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিল এবং বিদ্রোহীরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে মারধর করার পর ভূগর্ভস্থ ঠান্ডা ঘরে আটকে রেখেছিল এবং সেখানেই সে নিহত হয়েছিল।
ইমামের বন্দীদশা এবং শাহাদাত ঃ
যে কোন চিন্তাবিদই ইমাম হাদী (আ.)-এর জীবনীতে দৃষ্টিপাত করলে উপলদ্ধি করতে পারবেন যে, ঐ মহান ব্যক্তিত্ব তাঁর সমস্ত জীবনে কঠোর সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন ছিলেন। তবে শুধুমাত্র ইমাম হাদী (আ.)-এর সময়ই এ অবস্থা সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং বনী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসকদের গোটা শাসনামলে (সাময়িক বিরতি ছাড়া) পরিস্থিতি একইরূপ ছিল। জবর দখলকারী খলিফারা সমাজ ও সমাজের কল্যাণের প্রতি ভ্র“ক্ষেপ করতনা এবং জনগণকে তাদের ভোগ বিলাসের পণ্য হিসাবে মনে করত। অত্যাচারী খলিফাদের শাসন ব্যবস্থা এতই কঠোর ও ভিতিপ্রদ ছিল যে, জনগণ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এবং পবিত্র ইমামগণের (আ.) নেতৃত্ব থেকে লাভবান হওয়ার ও সঠিক ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্টা করার শক্তি ও সাহস পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিল। আর একারণেই উম্মতের সাথে ইমামগণের (আ.) সম্পর্ক খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। যেমনটি পুর্বেই বলা হয়েছে যে, সমসাময়িক কালের শাসকবর্গ ইমাম হাদীকে (আ.) জোর পুর্বক মদীনা থেকে সামেররাতে নিয়ে এসেছিল এবং মহান ইমামকে (আ.) সম্পূর্ণরূপে তাদের নিয়ন্ত্রনে রেখেছিল। এতদসত্বেও ইমাম হাদী (আ.) সকল কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেছিলেন এবং কখনোই অত্যাচারীদের সাথে ন্যূনতম সমঝোতা করেননি। এটা সুশপষ্ট যে, ইমামের ঐশী ব্যক্তিত্ব, সামাজিক অবস্থান এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধাচারণ ও অন্যায়ের পথে সহযোগিতা না করা, অত্যাচারী শাসকদের জন্য অপ্রীতিকর ও ভীতিপ্রদ ছিল। আব্বাসীয়রা সর্বদা এবিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল। অবশেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে †পঁŠছল। আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করার অর্থাৎ মহান ইমামকে (আ.) শহীদ করার সিদ্ধান্ত নিল। আর এভাবে ইমাম হাদী (আ.)ও তাঁর পবিত্র পূর্বপুরুষগণের ন্যায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেননি। মো’তাসেমের খেলাফতকালে তাঁকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে , ২৫৪ হিজরীর ৩রা রজব মাসে শাহাদাত বরণ করেন। মহান ইমামকে তাঁর নিজ গৃহে সমাহিত করা হয়। মো’তায ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সর্বদা নিজেদেরকে ইমামের (আ.) বন্ধুরূপে উপাস্থাপন করার ভান করত। ইমামের (আ.) দাফন-কাফন ও জানাজার নামাজে অংশগ্রহন করেছিল, নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা চালিয়েছিল। আর এভাবে জনগণকে ধোকা দিয়ে নিজের অপকর্ম ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শীয়া মতানুসারে ইমামের জানাজার নামাজ ইমামই পড়বেন, আর সে কারণেই ইমামের (আ.) পবিত্র জানাজাকে বাইরে নেওয়ার পূর্বেই ইমাম হাসান আসকারী (আ.) তাঁর শহীদ পিতার জানাজার নামাজ পড়েন। অতঃপর জানাজা বাইরে আনা হলে মো’তায তার ভাই আহমাদকে, আবী আহমদ সড়কে ইমামের জানাজার নামাজ পড়ার জন্য পাঠায়। মহান ইমামের (আ.) জানাজায় অজস্র মানুষ অংশ নিয়েছিল এবং ইমামের শোকে অঝরে কেদেছিল। নামাজের অনুষ্টান শেষে ইমামের (আ.) জানাজাকে বাসায় আনা হয় এবং সেখানেই সমাহিত করা হয়। “তাঁর ও তাঁর পবিত্র পূর্বপুরুষগণের প্রতি আল্লাহর দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক” ।
ইমামের কিছু মুজিযাহ ঃ
পুর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে যেমনটি ইঙ্গিত করা হয়েছে; মাসুম ইমামগণ (আ.) ইসমাত ও ইমামতের মত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হওয়ার কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও অদৃশ্য লোকের সাথে এক বিশেষ সম্পর্কের অধিকারী ছিলেন। পয়গম্বরগণের (আ.) ন্যায় ইমামগণও (আ.) মুজিযাহ ও কিরামত প্রদর্শন করে থাকেন। দৃষ্টান্ত¯ স্বরূপ মহান ইমামগণের (আ.) জ্ঞান ও খোদায়ী শক্তি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে (আল্লাহর ইচ্ছায়) প্রকাশ লাভ করত। আর তা তাঁদের অনুসারীদের প্রশিক্ষন ও নিশ্চয়তার জন্য এবং ইমামগণের (আ.) সত্যতার দলিল হিসাবে ব্যবহƒত হত। মহান ইমাম হযরত হাদী (আ.) থেকেও অসংখ্য মুজিযাহ ও কিরামত পরিলক্ষিত হয়, যা ইতিহাস ও হাদীস গ্রন্থ সমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আর তা বর্ণনা করতে গেলে একটি পৃথক বইয়ের প্রয়োজন। সংক্ষিপ্ততা বজায় রেখে আমরা এখানে তার কিছু নমুনা পেশ করেই তুষ্ট থাকব।
(১) বাল্যকালে ইমামত ও নেতৃত্বের অধিকারী হওয়া ঃ যেমনটি পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে, ইমাম হাদী (আ.) তাঁর মহান পিতার শাহাদাতের পর আট বৎসর বয়সে ইমামতের মহান মসনদে অধিষ্টিত হন। আর এটাই তাঁর মুজিযাহ ও কিরামতের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। কেননা এধরনের মর্যাদা অর্জন করা এবং এই গুরুভার পালন, যা একমাত্র খোদায়ী দান, তা শুধুমাত্র এক বালকের পক্ষেই নয় বরং এক পরিপুর্ণ বিজ্ঞ মানুষের পক্ষেও অসম্ভব। যেহেতু শিয়া ওলামা ও মুহাদ্দিসগণ প্রত্যেক ইমামের (আ.) শাহাদাতের পর বিভিন্ন বিষয় স¤পর্কে জানতে পরবর্তী ইমামের (আ.) শরণাপন্ন হতেন এবং এমনকি কখনো কখনো তাঁকে পরীক্ষাও করতেন। আর আলাভী ও ইমামের (আ.) আত্মীয়দের মধ্যে বিজ্ঞরা, যারা বয়সে ছিলেন প্রবীণ, তারাও ইমামের (আ.) বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন। একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমোদন এবং ইমামতের অধিকারী হওয়া ব্যতীত একটি বালকের পক্ষে এই মর্যাদার মসনদে অধিষ্টিত হওয়া এবং সকল প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া ও সকল সমস্যার পরিপূর্ণ নেতৃত্ব দান অসম্ভব। নিঃসন্দেহে একজন সাধারণ লোকও একটি সাধারণ বালককে একজন সচেতন ইমাম বা নেতা থেকে পৃথক করতে পারেন। ইমাম জাওয়াদ (আ.)-এর ক্ষেত্রেও এরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করতে গিয়ে জানতে পেরেছি যে, ইমামতও নবুয়্যতের ন্যায় আল্লাহ প্রদত্ত বিষয় এবং বয়সের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
(২) আব্বাসীয় খলিফা ওয়াছেকের মৃত্যুর খবর প্রদান ঃ খাইরান ইসবাতী বলেন ঃ ইরাক থেকে মদীনায় গেলাম এবং ইমাম হাদী (আ.)-এর খেদমতে পৌছে ধন্য হলাম। মহান ইমাম (আ.) আমাকে প্রশ্ন করলেন ঃ ওয়াছেকের অবস্থা কেমন? নিবেদন করলাম ঃ আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ হোক, ভালই আছে। আর আমি অন্যদের চেয়ে বেশী খবর রাখি কারণ আমি সবেমাত্র ওখান থেকে এসেছি। বললেন ঃ লোকজন বলছে, সে মারা গেছে। যখন একথা বললেন, বুঝতে পারলাম লোকজন বলতে ইমাম (আ.) নিজেকেই বুঝিয়েছেন। অতঃপর বললেন মুতাওয়াক্কিল কি করছিল? ঊললাম ঃ মানবেতর অবস্থায় জেলে ছিল। বললেন ঃ সে খলিফা হবে। অতঃপর বললেন ঃ ইবনে যিয়াত কি করছিল? বললাম ঃ জনগণ তার সাথে আছে এবং হুকুম তারই হুকুম। বললেন ঃ নেতৃত্ব তার জন্য দুর্ভাগ্য জনক। অতঃপর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন ঃ আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোন উপায় নেই, হে খাইরান! জেনে রাখ ওয়াছেক মারা গেছে ও তার স্থানে মুতাওয়াক্কিল বসেছে এবং ইবনে যিয়াদকে হত্যাকরা হয়েছে। বললাম ঃ আপনার জন্য জীবন উৎসর্গ হোক, কবে ও কখন এঘটনা ঘটেছে? বললেন ঃ তোমার রওনা হওয়ার ছ’দিন পর। কয়েকদিন না যেতেই মুতাওয়াক্কিলের পাইক আসল এবং ইমাম হাদী (আ.) যা বলেছিলেন তাই বর্ণনা করল।
(৩) তুর্কী ভাষায় কথা বলা ঃ আবু হাশিম জা’ফরী বলেন ঃ যখন ওয়াছেকের সেনাপতি ‘বাগা’, বেদুইনদেরকে ধরার জন্য মদীনা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আমি মদীনাতে ছিলাম। ইমাম হাদী (আ.) বললেন ঃ চল এ তুর্কীর যুদ্ধ উপকরণ দেখে আসি। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আর সৈন্যরা আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল। তুর্কী সেনাপতি আসল, ইমাম তার সাথে তুর্কী ভাষায় কিছু কথা বললেন। সে ঘোড়া থেকে নেমে এসে ইমামের (আ.) পবিত্র পা চুম্বন করল। আবু হাশিম বলেন ঃ ঐ তুর্কীকে কসম দিয়ে বললাম ইমাম (আ.) তোমাকে কি বলেছেন। তুর্কী প্রশ্ন করল ঃ এই ব্যক্তি কি পয়গম্বর? বললাম ঃ না। বলল ঃ তিনি আমাকে যে নাম ধরে ডেকেছেন বাল্যকালে তুরষ্কে আমাকে এ নামে সকলেই জানত। আর এ পর্যন্ত আরবের কেউই আমার এ নামটি জানত না।
(৪) হিংস্র প্রাণীদের বিনয় (কাকুতি-মিনতি) ঃ আহলে সুন্নতের আলেম শেখ সুলাইমান কানদুযী, তার ইয়া নাবী আল মুয়াদ্দাহ নামক গ্রন্থে লিখেছেন ঃ মাসউদী বর্ণনা করেছেন, একদা মুতাওয়াক্কিল তার প্রাসাদ অংগনে তিনটি হিংস্র পশু আনে অতঃপর ইমাম হাদীকে (আ.) দাওয়াত করে। যখনই ইমাম (আ.) প্রাসাদ অংগনে প্রবেশ করলেন, মুতাওয়াক্কিল প্রাসাদের দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল হিংস্র পশুগুলো ইমামের চারি পাশে পাইচারী করতে লাগল এবং ইমামের প্রতি বিনয় প্রকাশ করল। আর ইমাম (আ.) জামার আস্তিন দিয়ে তাদের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। অতঃপর ইমাম উপরে মুতাওয়াক্কিলের কাছে গিয়ে কিছু সময় তার সাথে কথা বলে নীচে নেমে এলেন। যতক্ষণ না ইমাম (আ.) প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন হিংস্র পশুরা পুনরায় তাঁর প্রতি বিনয় প্রকাশ করতে লাগল। পরবর্তীতে মুতাওয়াক্কিল ইমামের (আ.) জন্য এক বিশাল উপঢেŠকন প্রেরণ করেছিল। দরবারীরা মুতাওয়াক্কিলকে বলল ঃ তোমার চাচাত ভাই (ইমাম হাদী (আ.)), (পশুদের সাথে) কেমন আচরন করল তাতো দেখলে, এবার তুমি ঐ রকম কর। বলল ঃ তোমরা আমাকে মারতে চাও! আর বলল এ ঘটনা কাউকে বলনা।
(৫) ইমামের মহত্ব ও ব্যক্তিত্ব ঃ আশতার আলাভী বলেন ঃ আমি ও আমার পিতা মুতাওয়াকি‹লের বাসায় ছিলাম, আমি তখন ছোট্ট। আলে আবু তালিব, আলে আব্বাস এবং আলে জাফরের কিছু লোকজনও সেখানে ছিল। এমনি সময় ইমাম হাদী (আ.) সেখানে প্রবেশ করলেন এবং সকলেই তার সম্মানে উঠে দাঁড়াল। হযরত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। উপস্থিত কেউ কেউ একে অপরকে বলতে লাগল ঃ কেন এই যুবকের জন্য উঠে দাঁড়াব, সে না আমাদের চেয়ে অধিক আভিজাত্যের অধিকারী, না আমাদের চেয়ে বয়সে বড়। খোদার শপথ এবার আর তাঁর জন্য উঠে দাঁড়াব না। আবু হাশিম জা’ফরী সেখানে উপস্থিত ছিল এবং বলল ঃ খোদার কসম যখন তাঁকে দেখবে, তখন তাঁর সম্মানে অবনত মস্তকে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। কিছুক্ষণ না যেতেই ইমাম হাদী (আ.) মুতাওয়াক্কিলের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে উপস্থিত সকলেই উঠে দাঁড়াল। আবু হাশিম বলল ঃ তোমরা যে বলেছিলে উঠে দাঁড়াবে না? বললঃ আল্লাহর কসম, আমরা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে পারিনি এবং নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম।
(৬) অন্তকরণের সংবাদ এবং গৃহীত দোয়া ঃ ইসপাহানে আব্দুর রহমান নামে এক শিয়া ব্যক্তি বাস করতেন। তার কাছে জিজ্ঞাসা করা হল কেন এই শিয়া মাযহাব গ্রহন করেছ এবং কেন ইমাম হাদী (আ.)-এর ইমামতে বিশ্বাস কর? বলল ঃ তার মুজিযাহর কারণেই। ঘটনাটি এরূপ ঃ
আমি একজন ফকির ও অসহায় ব্যক্তি ছিলাম। যেহেতু সাহস ও বাচন ক্ষমতা ছিল, ইস্পাহানের লোকেরা আমাকে এক দলের সাথে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য মুতাওয়াক্কিলের কাছে পাঠায়। একদা মুতাওয়াক্কিলের ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম, এমন সময় মুতাওয়াক্কিল আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে রেযাকে [ইমাম হাদী (আ.)] ডেকে পাঠায়। আমি উপস্থিত একজনকে প্রশ্ন করলাম যাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে তিনি কে? বলল ঃ তিনি হলেন আলাভী এবং রাফেজিরা তাঁকে ইমাম বলে জানে। আরও বলল ঃ খলিফা হয়ত তাকে হত্যা করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছে। বললাম ঃ এই আলাভীকে না দেখা পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়বনা। হঠাৎ দেখতে পেলাম এক নুরানী ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে মুতাওয়াক্কিলের বাড়ির দিকে আসছেন, উপস্থিত জনতা তাঁর সম্মানে রাস্তার দু পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখছে। ঐ মহান ব্যক্তির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া মাত্রই আমার অন্তরে তাঁর মহব্বত সৃষ্টি হল। তাঁর জন্যে †দায়া করতে থাকলাম যেন আল্লাহপাক তাঁকে মুতাওয়াক্কিলের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা করেন। হযরত জনগণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর তাঁর দৃষ্টি ঘোড়ার কেশরের দিকে নিবদ্ধ ছিল এবং ডানে বায়ে কোন ভ্র“ক্ষেপই তাঁর ছিল না। আমি অনবরত তাঁর জন্য দোয়া করছিলাম, যেই আমার কাছে পৌছলেন আমার দিকে পুর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেনঃ আল্লাহ তোমার দোয়া কবুল করেছেন, তিনি তোমাকে দীর্ঘায়ু দান করেছেন এবং তোমার ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি বৃদ্ধি করেছেন। এটা দেখে আমি কাঁপতে শুরু করলাম এবং বন্ধুদের মধ্যে পড়ে গেলাম। তারা জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে? বললাম সুসংবাদ আছে এবং চুপ রইলাম। ইস্পাহানে ফিরে আসার পর আল্লাহ আমাকে প্রচুর স¤পদ দান করেছেন। বর্তমানে শুধু আমার ঘরে যা স¤পদ আছে তার মুল্যই হাজার হাজার দেরহাম। তাছাড়া বাইরে তো আছেই। বর্তমানে আমি দশটি সন্তানের পিতা এবং আমার বয়স সত্তরেরও অধিক। আমি সেই ব্যক্তির ইমামতে বিশ্বাস করি যিনি আমার অন্তরের খবর রাখেন এবং যার দোয়া আমার জন্য কবুল হয়েছে।
(৭) প্রতিবেশির সমস্যা সমাধান ঃ সামেররাতে ইউনুস নাক্কাশ নামে এক ব্যক্তি ইমামের (আ.) প্রতিবেশি ছিলেন। সে সর্বদা ইমামের নিকট আসত এবং তাঁর খেদমত করত। একদা কাঁপতে কাঁপতে ইমামের কাছে এসে বলল ঃ মাওলা আমি ওসিয়াত করছি সে আপনি আমার পরিবারের দেখাশুনা করবেন। ইমাম (আ.) বললেন ঃ কি হয়েছে? নিবেদন করলাম ঃ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েছি! তিনি মুচকি হেসে বললেন ঃ কেন? বললাম ঃ মুসা ইবনে বাগা (আব্বাসীয়দের শক্তিশালী সেনাপতী) একটি মুল্যবান পাথর নকশা করার জন্য আমাকে দিয়েছিল। নকশা করতে গিয়ে পাথরটি ভেঙ্গে দু’টুকরা হয়ে গেছে, কালই তাকে বুঝিয়ে দেওয়ারদিন। সে হয় আমাকে হত্যা করবে, নতুবা হাজার দোররা মারবে। ইমাম (আ.) বললেন ঃ নিশ্চিন্তে বাসায় চলে যাও, কাল পর্যন্ত কল্যাণ ছাড়া কিছুই দেখবে না। পরদিন ইউনুস আবারও কাঁপতে কাঁপতে ইমামের (আ.) কাছে এসে বলল ঃ মুসা পাথর নিতে এ†সছে। ইমাম (আ.) বললেন ঃ তার কাছে যাও সুসংবাদ আছে। বললাম ঃ মাওলা তাকে কি বলব? ইমাম হেসে বললেন ঃ তার কাছে যাও, যা বলে তাই শোন; কল্যাণ ছাড়া কিছুই দেখবে না। সে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর হাঁসতে হাঁসতে ফিরে এসে বলল ঃ হে মাওলা যখন তার কছে গেলাম, বলল আমার ছোট্ট দুই মেয়ে এই পাথর নিয়ে ঝগড়া করছে, সম্ভব হলে পাথরটিকে দু’টুকরা বানাও। এর বিনিময়ে তোমাকে পুরস্কৃত করব। ইমাম (আ.) আল্লাহর প্রশংসা করলেন, অতঃপর ইউনুসকে বললেন ঃ তাকে কি জবাব দিয়েছ? বলেছি সময় দাও দেখি কিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। ইমাম (আ.) বললেন ঃ উত্তম জবাব দিয়েছ।
(৮) আবুহাশিমের প্রতি দয়া ঃ আবু হাশিম জাফরী বলেনঃ এক সময় খুবই অভাবÑঅনটনে পড়েছিলাম। এমতাবস্থায় ইমামের (আ.) খেদমতে পৌছলে তিনি আমাকে বসতে বললেন। অতঃপর বললেন ঃ হে আবু হাশিম আল্লাহতায়ালা তোমাকে যে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন, তুমি কি তার একটিরও শুকরিয়া জ্ঞাপন করে শেষ করতে পারবে? আমি চুপ করে রইলাম এবং বুঝতে পারছিলাম না কি বলব! ইমাম (আ.) নিজেই জবাব দিলেনঃ আল্লাহ তোমাকে ঈমান দিয়েছেন এবং তার মাধ্যমে তোমার শরীরকে দোযখ থেকে রক্ষা করেছেন। তিনি তোমাকে সুস্বাস্থ্য দান করেছেন এবং তাঁর আনুগত্যের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন। তিনি তোমাকে পরিতৃপ্ত (অল্পে তুষ্টি) করেছেন এবং তার মাধ্যমে তোমার মান সম্মান রক্ষা করেছেন। ইমাম আরো বললেন ঃ হে আবু হাশিম আমি এভাবে শুরু করলাম, কেননা অনুভব করছিলাম তুমি এমন কারো ব্যাপারে অভিযোগ করতে চাও, যিনি তোমাকে অঢেল নেয়ামত দান করেছেন। আমি তোমাকে একশত দিনার প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছি, তুমি তা গ্রহন কর।
ইমাম হাদী (আ.)-এর বাণীতে ইমাম পরিচিতি ঃ
আমাদের বার ইমামের প্রত্যেকেই (তাদের পবিত্র নুরের উপর সর্বদা আল্লাহর দরুদ বর্ষিত হোক) কেবলমাত্র উম্মতের নেতা বা ইসলামের আহকাম ও কোরআন বর্ণনা কারীই ছিলেন না। বরং শিয়াদের সামাজিক জীবনে মাসুম ইমামগণ (আ.) হলেন পৃথিবীর বুকে আল্লাহর নুর। সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য সুষ্পষ্ট ও পরিপুর্ণ হুজ্জাত বা দলিল। বিশ্বজগৎ ও সকল অস্তিত্বের কেন্দ্র বিন্দু। সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কল্যাণকামী মাধ্যমস্বরূপ। পরিপূর্ণতার উজ্জল দৃষ্টান্ত এবং মানবীয় শ্রেষ্টত্বের ক্ষেত্রে তাঁরা ছিলেন সবার শীর্ষে। সকল কল্যাণ ও মঙ্গলের সমষ্টি। আল্লাহর জ্ঞান ও শক্তির বহিঃপ্রকাশ। ফানাফিল্লাহর পরিপুর্ণ নিদর্শন, সকল প্রকার দোষত্র“টি থেকে মুক্ত, মাসুম। আলমে মালাকুত, ধরিত্রী, অদৃশ্যলোক এবং ফিরিশতাগণের সাথে সম্পর্কিত।
দুনিয়া ও আখিরাতের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত। খোদায়ী রহস্যাবলীর ধনভান্ডার এবং আম্বিয়াগণের সকল পরিপুর্ণতার উত্তরাধিকারী। হ্যাঁ, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের পবিত্র অস্তিত্বই হল, অস্তিত্ব নামক দিক দর্শনের †কন্দ্র বিন্দু। তাঁদের সম্মানিত বেলায়েতের আধিপত্য আম্বিয়া ও রাসূলগণের (আ.) বেলায়াতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর সে মহান কতৃত্বকে তাঁরা ব্যতীত অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে তা রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতকে প্রদান করেছেন। কোন লোভীই তাতে লোভাতুর হাত বাড়াতে পারে না...। মাসুম ইমামগণের (আ.) মর্যাদা স¤পর্কে যা কিছু গণনা করা হয়েছে তাদের প্রকৃত ফযিলত এর চেয়ে ঢের বেশী। আর তা কোরআনের অকাট্য ভাষ্য এবং রাসূল ও ইমাম গণের (আ.) নির্ভরযোগ্য বক্তব্য থেকে প্রমাণ যোগ্য। শিয়া মনীষীগণের বিভিন্ন গ্রন্থে তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে এ ক্ষুদ্র পরিসরে তার বিশদ বিবরণ ও যুক্তি প্রদর্শন সম্ভব নয়। আমাদের সম্মানিত মাওলা এবং ইমামত নামক আকাশের দশম সুর্য, ইমাম আবুল হাসান হাদী (আ.) আমাদের শিয়াদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে পুরস্কৃত করেছেন। “তিনি যিয়ারতে জামে” নামক এক যিয়ারতে তাঁর গভীর ও অসাধারণ বাণীর মাধ্যমে একক বক্তা হিসাবে খোদায়ী শিক্ষা-দীক্ষার ময়দানে এক ত্বড়িৎ গতি প্রদান করেন। আর তার জ্ঞান সমুদ্রের মুক্তাবৃষ্টি ও অলংকার পূর্ণ বাণী সমূহকে প্রিয়তম ইমামদের প্রকৃত প্রেমিকদের জ্ঞানভান্ডারে উৎসর্গ করেছেন। আমাদের বোধগম্যতার নিকটবর্তী, ইমামের প্রকৃত মর্যাদার প্রকাশক নয়। তিনি এর মাধ্যমে আল্লাহর ফুলবাগের কিছু অংশের সজীবতাকে বর্ণনা করেছেন। আমাদের জীবন তাঁর পদধুলিতে উৎসর্গ হোক, কেননা তিনি আমাদের মত মর্তবাসীদেরকে তাঁর রশ্মি বিকিরণকারী বাণীর মাধ্যমে খোদার মহিমা ও মহত্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমরা যারা ঐ মহামানবদের স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট পেয়ালা থেকে পান পিপাসূ, তাদেরকে আল্লাহর বেহেশতী হাউজে কাওছারের ফোয়ারার দিকে পরিচালিত করেছেন। যেভাবেই হোক, ইমাম হাদী (আ.) তাঁর এক অনুসারীর অনুরোধে মাসুম ইমামগণের (আ.) যিয়ারতের জন্য কিছু দোয়া শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঐমহান ইমামের জীবনী বর্ণনা করব আর পাঠক বৃন্দকে ঐ মহান যিয়ারত থেকে বঞ্চিত করব (যা প্রকৃত পক্ষে ইমাম পরিচিতির এক শিক্ষনীয় সূচীপত্র) তা ঠিক হতে পারে না। খ্যাতনামা অনেক আলেম এই যিয়ারতটিকে একটি উত্তম ও পূর্ণাজ্ঞ যিয়ারত বলে মনে করেছেন। মহামনীষীগণ যেমন ঃ মরহুম শেখ সাদুক (রহঃ) যিনি ৩৮১ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন এই যিয়ারতকে তাঁর “মান লা ইয়াহযারুহুল ফকীহ” এবং “উয়ুনু আখবারুর রিযা” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া শেখ তুসী (রহঃ) যিনি ৪৬০ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন, তার “তাহযীবুল আহকাম” নামক গ্রন্থে এ যিয়ারতটির উল্লেখ করেছেন। সাবলীল ভাষা, সমুন্নত বিষয়বস্তু, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান যা এই যিয়ারতের মধ্যে তরঙ্গায়িত হয়েছে,ইত্যাদি সকল কিছুই এ যিয়ারতের মৌলিকত্বের পরিচায়ক এবং খোদায়ী সমুন্নত শিক্ষারই প্রবক্তা। এখন পুনরায় আমাদের মহান ইমাম হযরত হাদী (আ.)-এর জ্যোতির্ময় রূহের প্রতি দরুদ পাঠ করে এমহান বাণী (যিয়ারতটি ) বর্ণনা করব। প্রত্যাশা এটাই যে পবিত্র ইমামগণের (আ.) অনুসারীরা এই প্রজ্জ্বলিত রত্ন ও শিয়াদের ধনভান্ডারকে যেন উপেক্ষা না করেন। এ মহান ইমামগণের (আ.) যিয়ারতের ক্ষেত্রে যেন এ জ্যোতির্ময় বাণীগুলোর মাধ্যমে যিয়ারত করেন, হোক তা তাদের মাযারে গিয়ে, কিংবা দূর থেকে।
যিয়ারতে জামে’ কাবীরাহ ঃ
মুসা ইবনে আব্দুল্লাহ নাখায়ী বলেন, ইমাম হাদীকে (আ.) নিবেদন করলাম ঃ হে রাসূলে খোদার সন্তান আমাকে একটি প্রাঞ্জল ও পূর্ণাঙ্গ দোয়া শিক্ষা দিন, যাতে আমি যখনই কোন ইমামের (আ.) রওজা যিয়ারতে যাব, তা পাঠ করতে পারব।
ইমাম (আ.) বললেন ঃ যখন ইমামগণের (আ.) রওজায় পৌছবে দাঁড়িয়ে কালিমা শাহাদৎ পাঠ করবে,অবশ্যই গোসল করে আসবে। হারামে (রওজা) প্রবেশ করে যখনই কবর দেখতে পাবে দাঁড়িয়ে পড়বে। তার পর ধীরে ধীরে শান্ত হƒদয়ে কিছুটা সামনে অগ্রসর হবে। অতঃপর কবরের নিকটে যাবে।
অতপর বলবে ঃ “আপনাদের প্রতি সালাম হে (মহান) নবীর (সা.) আহলিবাইত। হে রিসালতের স্থান আপনাদের প্রতি সালাম। ফিরিশতাগণের গমনাগমনের স্থান, আপনাদের প্রতি সালাম। ওহী অবতীর্ণ হওয়ার স্থান আপনাদের প্রতি সালাম। রহমতের খনি এবং কোষাধ্যক্ষগণ (ভান্ডারগণ) আপনাদের প্রতি সালাম। হে সহিষ্ণুতা ও নম্রতার চরম বিন্দু আপনাদের প্রতি সালাম। হে কিরামতের মূলসমূহ এবং উম্মতসমূহের নেতাগণ আপনাদের প্রতি সালাম। নেয়ামতসমূহের মালিকগণ আপনাদের প্রতি সালাম। সৎকর্মশীলদের মূল এবং কল্যাণকারীদের স্তম্ভ, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর বান্দাগণের অভিভাবক আপনাদের প্রতি সালাম। শহর সমূহের ভরকেন্দ্র ও ঈমানের দ্বারসমূহ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহ রহমানুর রহিমের বিশ্বস্তগণ ও পয়গম্বরগণের নির্যাস আপনাদের প্রতি সালাম। রাসূলগণের মনোনীত, আপনাদের প্রতি সালাম। বিশ্ব প্রতিপালকের মনোনীত রাসূলগণের বংশধর, আপনাদের প্রতি সালাম। আপনাদের প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত।”
হে হিদায়াতের ইমামগণ (আ.), আপনাদের প্রতি সালাম। হে অন্ধকারের প্রদীপসমূহ আপনাদের প্রতি সালাম। আত্মসংযমের ঝান্ডাসমূহ, আপনাদের প্রতি সালাম। বুদ্ধিবৃাত্তি ও বিবেকের অধিপতি, আপনাদের প্রতি সালাম। জনগণের আশ্রয়স্থল, আপনাদের প্রতি সালাম। পয়গম্বরগণের উত্তরাধিকারী, আপনাদের প্রতি সালাম। উৎকৃষ্ট নিদর্শন, আপনাদের প্রতি সালাম। উত্তম নিমন্ত্রনকারী, আপনাদের প্রতি সালাম। সমগ্রবিশ্ববাসীর (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উভয় জগতের) জন্যে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলিল বা হুজ্জাতসমূহ আপনাদের প্রতি সালাম। আপানাদের প্রতি বর্ষিত হোক আল্লাহর রহমত ও বরকত।”
“হে আল্লাহর জ্ঞানের স্থানসমূহ, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর বরকতের স্থানসমূহ আপনাদের প্রতি সালাম, আল্লাহর হিকমতের স্থান, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর হিকমতের খনি আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর রহস্যের রক্ষাকারী আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর কিতাবের (কোরআনের) বাহকগণ, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর রাসূলের উত্তরাধিকারীগণ এবং রাসূল (সা.)-এর সন্তানগণ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর রহমত ও বরকত আপনাদের উপর বর্ষিত হোক।
“হে আল্লাহর দিকে আহবানকারীগণ, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতি দিক নির্দেশকগণ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর নির্দেশের প্রতি দৃঢ়প্রত্যয়ীগণ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর সাথে বন্ধুত্বে পরিপূর্ণগণ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর একত্বের প্রতি নির্মল বিশ্বাস স্থাপণকারীগণ, আপনাদের প্রতি সালাম। হে আল্লাহর আদেশ নিষেধের প্রকাশকারীগণ আপনাদের প্রতি সালাম। হে আল্লাহর বান্দাগণ আপনারা কোন বিষয়ে তাঁর অগ্রে চলেন না এবং তাঁর আদেশ †মাতাবেক আমল করেন, আপনাদের প্রতি সালাম। আপনাদের উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত।”
হে (সত্যের পথে) দাওয়াতকারী ইমামগণ (আ.) আপনাদের প্রতি সালাম। হে দিক নির্দেশকারী নেতাগণ, আপনাদের প্রতি সালাম। সর্দার ও অভিভাবকগণ আপনাদের প্রতি সালাম। (অন্যয়ের) প্রতিরোধকারীগণ এবং (মজলুমের) সাহায্যকারীগণ আপনাদের প্রতি সালাম। “জ্ঞানীগণ” ও “উলিল আমরগণ” আল্লাহর চিরন্তন নিদর্শন আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর নির্বাচিতগণ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর দল (হিযবুল্লাহ) আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর জ্ঞানের স্থান, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহরহুজ্জাত বা দলিল, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর পথ, আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর নূর আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আপনাদের প্রতি সালাম। আল্লাহর বরকত ও রহমত আপনাদের উপর বর্ষিত হোক।”
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয় এবং তাঁর কোন শরিক নেই। যেমনটি আল্লাহ ও তাঁর ফিরিশতাগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন; আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, যিনি হলেন সম্মানিত এবং মহিমান্বিত। সাক্ষ্য দিচ্ছি যে রাসূল (সা.) তাঁর মনোনিত বান্দা এবং মনঃপুত রাসূল। হেদায়াতের জন্যে ও সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী হতে, তাঁকে সঠিক দ্বীন দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যদিও মুশরিকরা তা পছন্দ করে না।”
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনারা হলেন হেদায়েত ও পথপ্রাপ্তদের ইমাম (আ.)। মাসুম ও পবিত্র, মহানুভব, নৈকট্য প্রাপ্ত, পরহেজগার, সত্যবাদী, নির্বাচিত এবং তাঁর অজ্ঞাবহ ও তাঁর নির্দেশের প্রতি দৃঢ় ও অবিচল, হে তাঁর ইচ্ছায় কর্মরতগণ! তাঁর মহত্বে উপনীতগণ! মহান আল্লাহ আপনাদেরকে তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে নির্বাচন করেছেন। তাঁর গোপন তথ্যের সংরক্ষক হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাঁর ক্ষমতার সাহায্যে বাছাই করেছেন। হেদায়াতের মাধ্যমে মহিয়ান করেছেন। যুক্তিভিত্তিক দলিলের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করেছেন। তাঁর নুরের জন্যে উপযুক্ত মনে করেছেন। তাঁর রূহের মাধ্যমে আপনাদেরকে অনুমোদন দিয়েছেন। সৃষ্টির জন্যে আপনাদেরকে খলিফা মনোনীত করেছেন। আপনারা তাঁর সৃষ্টির জন্যে, হুজ্জাতস্বরূপ। তাঁর দ্বীনের সহায়ক। তাঁর গোপন তথ্যের রক্ষী। তাঁর জ্ঞানের কোষাধ্যক্ষ। তাঁর হেকমতের আমানতদার। তাঁর ওহীর ব্যাখ্যাকারী। তাওহীদের স্তম্ভসমূহ। তাঁর সৃষ্টির জন্য সাক্ষীস্বরূপ। তাঁর বান্দাগণের জন্য উড্ডীয়মান ঝাঁন্ডা স্বরূপ। তাঁর শহর সমূহের সুউচ্চ নিদর্শন। সিরাতুল মুসতাকিমের দিকে দিকনির্দেশনাকারী। আল্লাহ তা’লা আপনাদেরকে বিচ্যুতি হতে রক্ষা করেছেন। এবং সকল প্রকার ফেৎনা ফাসাদ †থকে মুক্তি ও নিরাপত্তা দান করেছেন; আপনাদেরকে কলুষমুক্ত করেছেন। সকল অপবিত্রতা আপনাদের থেকে দূর করেছেন এবং আপনাদেরকে পুত-পবিত্র করেছেন।”
“অতঃপর আপনারা তাঁর মহত্বকে মহানরূপে চিনেছেন। তাঁর মর্যাদাকে সমুন্নত করে তুলে ধরেছেন। তাঁর সম্মানের প্রশংসা করেছেন। তাঁর যিকর (স্মরণ) অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর সাথে যে, অংগীকার করেছিলেন তাকে দৃঢ়তর করেছেন। তাঁর ইবাদাতের অংগীকারকে বাস্তবরূপ দান করেছেন। গোপনে অথবা প্রকাশ্যে খালেস নিয়তে তাঁরই জন্য কর্ম সম্পাদন করেছেন। হেকমতের সাথে সদুপদেশ দিয়ে জনগণকে তাঁর পথে দাওয়াত করেছেন। আপনাদের জীবনকে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করেছেন। আর তার পাশাপাশি যা কিছু (যত সমস্যা) আপনাদের উপর তার পক্ষ থেকে আপতিত হয়েছে তাতে ধৈর্য ধারণ করেছেন। নামাজ কায়েম করেছেন। যাকাত প্রদান করেছেন। সৎকর্মে আদেশ, অন্যায় কর্মে নিষেধ ও বাঁধা প্রদান করেছেন। আল্লাহর পথে যথোপযুক্ত জিহাদ করেছেন। তাঁর পথে আহবান করেছেন এবং ওয়াজিব সমূহকে বর্ণনা করেছেন। তাঁর হুকুম প্রতিষ্টা করেছেন। তাঁর হুকুম আহকামের প্রচার ও প্রসার করেছেন। আল্লাহর পথকে চিহ্নিত করেছেন। সে ক্ষেত্রেও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন। তাঁর ফয়সালাকেই মেনে নিয়েছেন। তাঁর পূর্ববর্তী পয়গমবরগণকে (আ.) সত্যায়িত করেছেন।” “অতঃপর যারা আপনাদেরকে পরিহার করেছে তারা দ্বীন †থকে বহিঃস্কৃত হয়েছে। আপনাদের সাথে যাদের সার্বক্ষনিক সম্পর্ক তারা দ্বীনদার হয়েছে। আপনাদের অধিকার অবমাননাকারীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। সত্য ও ন্যায় আপনাদের সাথে, আপনাদের মধ্যে এবং আপনাদের দিকেই সত্যের প্রত্যাবর্তন। আপনারা তার (ন্যায়ের) যোগ্য এবং তার খনি। নবুয়্যতের মি’রাসী সম্পদ আপনাদের নিকট। সমগ্র সৃষ্টি আপনাদের দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে। তাদের হিসাব আপনাদের মাধ্যমেই। সত্যের চুড়ান্ত আদেশ (ফাসলুল খিতাব) আপনাদের নিকট। আল্লাহর নিদর্শন সমূহ আপনাদের নিকট। আল্লাহর ইচ্ছাসমূহ আপনাদের মধ্যে। তাঁর নূর ও নিদর্শন আপনাদের নিকট। তাঁর আদেশ আপনাদের জন্যে। যে আপনাদের সাথে শত্র“তা পোষণ করল সে আল্লাহর সাথে শত্র“তা পোষণ করল। আর যে আপনাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করল সে আল্লাহর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করল। যে আপনাদেরকে ভালবাসবে সে খোদাকে ভালবাসল, আর যে আপনাদের সাথে দুশমনি করবে সে খোদার সাথে দুশমনি করল। যে বা যারা আপনাদেরকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করল সে বা তারা আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করল।”
“আপনারাই হলেন সুদৃঢ় রাস্তা, নশ্বর জগতের সাক্ষী এবং অবিনশ্বর ও চিরন্তন পারলেŠকিক জীবনে শাফায়াতকারী; অবিরাম এবং সংযুক্ত রহমত; আল্লাহর উত্তম নিদর্শন, যাদেরকে উত্তমরূপে ও সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়; সংরক্ষিত আমানত; জনগণের পরীক্ষার দরজা। যারা আপনাদের দিকে আসবে, তারা মুক্তি পাবে; আর যারা পরিত্যাগ করবে তারা ধ্বংস হবে। আপনারা আল্লাহর পথে আহবান করেন। তাঁর পথে যুক্তি প্রদর্শন করেন এবং তার প্রতি প্রকৃত ঈমান আনয়ন করেছেন। তাঁর নিকট আত§সমর্পণ করেছেন। তাঁর নির্দেশানুযায়ী কর্মসম্পাদন করেন। তাঁর পথে দিক নির্দেশনা দান করেন, এবং তাঁর বাণী অনুসারে হুকুম করেন। সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে আপনাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে। সেই ব্যক্তি ধ্বংস প্রাপ্ত, যে আপনাদের সাথে শত্র“তা করেছে। সেই ব্যক্তি নিরাশ, যে আপনাদেরকে অস্বীকার করেছে। সেই ব্যক্তি বিচ্যুত ও পথভ্রষ্ট যে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সেই ব্যক্তি সফলকাম যে আপনাদেরকে দৃঢ় ভাবে ধারণ করেছে। সেই ব্যক্তি নিরাপদ যে, আপনাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। সুস্থ ও নিরাপদ সে, যে আপনাদেরকে স্বীকার করেছে। আপনাদেরকে যে আঁকড়ে ধরেছে সেই হেদায়েত প্রাপ্ত হয়েছে। তার স্থান বেহেশতে, যে আপনাদেরকে অনুসরণ করেছে। তার স্থান জাহান্নামে যে আপনাদের বিরোধিতা করেছে। সে কাফের, যে, আপনাদেরকে অস্বীকার করেছে এবং সে মুশরিক যে আপনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। আর যে, আপনাদেরকে প্রত্যাখ্যান করবে এবং বরণ করবে না তার স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে।”
“সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এই মর্যাদা আপনাদের ছিল এবং চিরদিন তা থাকবে। সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনাদের রূহ, নুর এবং স্বভাব-প্রকৃতি একই। আপনারা পুত-পবিত্র। আপনারা সকলেই সম্মানের এবং প্রত্যেকেই একে অপর থেকে। আল্লাহ আপনাদেরকে নুর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাঁর আরশের চারপার্শ্বে পরিবেষ্টন করিয়েছেন। আমাদের প্রতি কল্যাণ সাধন করেছেন। অতঃপর আপনাদেরকে এমন গৃহসমূহ দান করেছেন যা আল্লাহর ইচ্ছায় উন্নত হয়েছে, এবং ঐ গৃহগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। তিনি আমাদের জন্যে আপনাদের প্রতি দরুদ ও ভালবাসাকে নির্ধারন করেছেন। আর তার মধ্যেই আমাদের সৃষ্টির পবিত্রতা, জীবনের পবিত্রতা, বিশুদ্ধতা এবং গোনাহসমূহের ক্ষতিপুরণ নিহিত করেছেন।
অতঃপর আমরা তাঁর (আল্লাহর) সমীপে আপনাদের ফযিলতকে স্বীকার করেছি এবং আপনাদের স্বীকৃতিতেই (তাঁর নিকট) পরিচিত হয়েছি। সুতরাং আল্লাহতা’লা আপনাদেরকে সম্মানিতদের জন্যে নির্ধারিত সম্মানিত স্থানে, নৈকট্যপ্রাপ্তদের জন্যে নির্ধারিত উৎকৃষ্ট স্থানে এবং রাসূলগণের জন্যে নির্ধারিত সুউচ্চু স্থানে পৌছে দিন, যেখানে কেউই পৌছতে পারে না। কোন অগ্রাধিকার পিয়াসুই তার অগ্রে যেতে পারে না। কোন অগ্রগামীই তার অগ্রে চলতে পারে না। কোন লালসাকারীই তার প্রতি লালসা করতে পারে না; এমনকি কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতাও না, কোন পয়গম্বরও না; কোন সিদ্দিক এবং শহীদও না; না কোন আলেম, না কোন জাহেল; না কোন সম্মানিত, না কোন নিকৃষ্ট; না কোন মুমিন, না কোন কাফের ও ফাসেক; না কোন মিথ্যা প্রতিহিংসাপরায়ণ, না কোন উদ্ধত শয়তান; না এর মধ্যবর্তী কোন সৃষ্টি। কেউই আপনাদের মর্যাদাকে উপলদ্ধি করতে পারবে না। শুধুমাত্র আল্লাহতা’লা যাদেরকে আপনাদের মহিমা সম্পর্কে অবহিত করবে তারা ব্যতীত। অবহিত করবে, আপনাদের সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে; আপনাদের মহত ও বুযুর্গী সম্পর্কে; আপনাদের পরিপূর্ণ নুর সম্পর্কে; আপনাদের প্রকৃত মর্যাদা ও স্থান সম্পর্কে; আপনাদের প্রতিষ্টিত পদমর্যাদা সম্পর্কে; তাঁর নিকট আপনাদের মর্যাদা সম্পর্কে; তাঁর নিকট আপনাদের সমুন্নত স্থান সম্পর্কে; তাঁর নিকট আপনাদের বিশেষত্বসমূহ সম্পর্কে এবং তাঁর সাথে আপনাদের নৈকট্য সম্পর্কে।”
“আমার পিতা-মাতা, পরিবার, ধনসম্পদ এবং আত্মীয় স্বজন আপনাদের জন্য উৎসর্গ হোক। আল্লাহ এবং আপনারা সাক্ষী যে আমি ঈমান এ†নছি আপনাদের প্রতি এবং যার প্রতি আপনারা ঈমান রাখেন তার উপরও। আপনাদের দুশমনদেরকে প্রত্যাখ্যান করি এবং যা কিছুকে আপনারা অবিশ্বাস করেন তাকেও। আপনাদের মর্যাদাকে উপলদ্ধি করি এবং যারা আপনাদের সাথে বিরোধিতা করে তাদের বিপথগামীতাকেও। একমাত্র আপনাদের কারণেই আপনাদের প্রতি ভালবাসা পোষণ কারীদেরকে ভালবাসি। আর আপনাদের কারণেই আপনাদের শত্র“দের প্রতি শত্র“তা পোষণ করি। যারা আপনাদের সাথে সন্ধি ও আপোস করে আমরাও তাদের সাথে সন্ধি ও আপোস করি। যারা আপনাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, আমরাও তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হই। সুস্থিত করব তা, যা কিছু আপনারা সুস্থিত করেছেন। রহিত করব তা, যা কিছু আপনরা রহিত করেছেন। আমরা আপনাদেরই অনুগত। আমরা আপনাদের সত্যতার পরিচয়দানকারী। আমরা আপনাদের বদান্যতাকে স্বীকার করি। আমরা আপনাদের জ্ঞান †থকেই জ্ঞান অর্জনকারী। আপনাদের নিরাপত্তার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহন করেছি। আপনাদের স্বীকৃতিদানকারী। আপনাদের প্রত্যাবর্তণে বিশ্বাসী। আপনাদের প্রত্যাবর্তণকে স্বীকার করি। আমরা আপনাদেও নির্দেশের প্রতীক্ষায় থাকি, আপনাদের হুকুমতের প্রতীক্ষায় প্রস্তুত আছি; আপনাদের বাণী গ্রহণকারী; আপনাদের নির্দেশের প্রতি আমলকারী; আপনাদের কবরের কাছে আশ্রয় প্রার্থী। মহান ও সম্মানিত এবং পরাক্রমশালী আল্লাহর সমীপে আপনাদেরকে শাফায়াতকারী বলে জানি। আর আপনাদের উছিলায় তাঁর নৈকট্য প্রার্থণা করি। আপনাদেরকে আমার সকল চাওয়া পাওয়ার, আশা আকাংখা এবং সকল অবস্থায় ও সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দান করেছি। আপনাদের যা কিছু গোপন এবং প্রকাশিত রয়েছে তার প্রতি, উপস্থিত ও অনুপস্থিতি সকল কিছুর প্রতি এবং প্রথম ও শেষের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি। এ সকল বিষয়ে কার্যকে আপনাদের উপর অর্পণ করেছি এবং তাতে আপনাদের কাছে আত্নসমর্পণ করেছি। আমার অন্তর আপনাদেরকে গ্রহন করেছে এবং আমি আত্মসমর্পন করেছি। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা আপনাদের অনুগামী। আপনাদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমি প্রস্তুত, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতা’লা তাঁর দ্বীনকে আপনাদের জন্যে জীবিত করবেন এবং তাঁর হুকুমতকে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দিবেন। আপনাদেরকে ন্যায় প্রতিষ্টার জন্যে প্রকাশ করবেন এবং তাঁর রাজত্বে আপনাদেরকে ক্ষমতা প্রদান করবেন।”
“অতঃপর আপনাদের সাথে এবং আপনাদের সাথেই আমরা, অন্যদের সাথে নই। আপনাদের প্রতি ঈমান এনেছি। আপনাদের সর্বশেষের [ইমাম মাহদী (আ.)] বিলায়াতকে গ্রহন করেছি। যেমন গ্রহন করেছি আপনাদের সর্বপ্রথমের [ইমাম আলী (আ.)] বিলায়াতকে। মহিমান্মিত ও পরাক্রমশালী আল্লাহর কাছে আপনাদের শত্র“দের থেকে এবং “তাগুত” শয়তান ও তাদের অত্যাচারী দল, যারা আপনাদের অধিকারকে অস্বীকার করে, যারা আপনাদের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে গেছে, আপনাদের উত্তরাধিকার আত্মসাৎকারী, আপনাদের প্রতি সন্দেহ পোষণকারী এবং যারা আপনাদের থেকে বিচ্যুত তাদের প্রতি অসন্তুষ্টি ও নিদারুন বিরক্তি প্রকাশ করছি। আপনারা ব্যতীত অন্য সকল বিশ্বাস থেকে বিচ্ছেদ কামনা করছি। আপনারা ব্যতীত সকল বশ্যতা থেকেই বিচ্ছেদ কামনা করছি। আর যে নেতারা জাহান্নামের আগুনের দিকে দাওয়াত করে তাদের থেকেও বিচ্ছেদ কামনা করছি। অতএব আল্লাহতা’লা আমাকে সর্বদা (যতদিন জীবিত আছি) আপনাদের ভালবাসার আশ্রয়ে এবং আপনাদের দ্বীনের উপর প্রতিষ্টিত রাখুন। আপনাদের আনুগত্যের পথে সফল করুন। আপনাদের শাফায়াতকে আমার নসিব করুন। আমাকে আপনাদের উত্তম বন্ধুদের মধ্যে পরিগণিত করুন যারা আপনাদের সকল নির্দেশের অনুসরণ করে। আমাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন, যারা আপনাদের পদাংক অনুসরণ করে চলে, আপনাদের পথে চলে; আপনাদের হেদায়াতের মাধ্যমে হেদায়াত প্রাপ্ত হয়। আপনাদের দলে অন্তর্ভূক্ত হয়। আপনাদের প্রত্যাবর্তনে (রাজয়াতে) পুনরুত্থিত হবে। আর আপনাদের হুকুমতে ক্ষমতাশালী হবে। আপনাদের শান্তিকালীন সময়ে, যারা সম্মান প্রাপ্ত হবে। আপনাদের যুগে শক্তি ও মর্যাদা প্রাপ্ত হবে। অচিরেই তাদের চক্ষুসমূহ আপনাদের দর্শনে প্রজ্জ্বলিত হবে।”
“আমার পিতা-মাতা, আমি আমার পরিবার এবং ধনসম্পদ আপনাদের জন্য উৎসর্গ হোক। যে আল্লাহকে চায়, তাকে আপনাদের মাধ্যমে শুরু করতে হবে। যে তাঁর একত্বে বিশ্বাসী, তাকে আপনাদের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। যে তাঁকে পেতে চাইবে তাকে প্রথমেই আপনাদের মুখাপেক্ষি হতে হবে। হে আমার মাওলাগণ আপনাদের প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। আপনাদের প্রকৃত অবস্থাকে প্রশংসা করে এবং আপনাদের মর্যাদাকে বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। এবং আমি তা উপলদ্ধি করতেও অক্ষম। আপনারা ভাল ব্যক্তিদের জন্যে নুর, নেককার বান্দাদের পথ প্রদর্শক এবং শক্তিমান আল্লাহর হুজ্জাত। আল্লাহতা’লা আপনাদের কারণেই শুরু করেছেন এবং আপনাদের কারণেই শেষ করবেন। তিনি আপনাদের কারণেই বৃষ্টি বর্ষন করেন। আপনাদের করণেই আসমানকে জমিনে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেন আল্লাহর ইচ্ছায়। আপনাদের কারণে দুঃখ দুরীভুত করেন। দুরাবস্থার সমাধান করেন। আপনাদের নিকট রয়েছে তা, যা কিছু রাসূলগণের (আ.) প্রতি ফিরিশতা মারফত নাযিল হয়েছে। আপনাদের নানার প্রতি (আলী (আ.) এর যিয়ারতের ক্ষেত্রে বলবে ঃ আপনার ভাইয়ের প্রতি) রূহুল আমীন (জীব্রাইল) প্রেরিত হত। আল্লাহতা’লা আপনাদেরকে যা দান করেছেন বিশ্বের কাউকেই তা দান করেননি। সকল সম্ভ্রান্তই আপনাদের সন্মুখে অবনত হয়েছে। সকল দাম্ভিকই আপনাদের কাছে মাথা নত করে, আপনাদের আনুগত্য করেছে। সকল শক্তিমানই আপনাদের শ্রেষ্টত্বের নিকট নতজানু হয়েছে। সকল কিছুই আপনাদের কাছে হীন হয়ে গেছে। পৃথিবী আপনাদের নুরে নুরানী হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্তগণ আপনাদের বেলায়াতের মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। আপনাদের উছিলায় বেহেশতের দিকে ধাবিত হয়। যে আপনাদের বেলায়াতকে প্রত্যাখ্যান করবে সে আল্লাহর রোষানলে পতিত হবে।”
“আমার পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন, জীবন, ধনসম্পদ আপনাদের প্রতি উৎসর্গ হোক। আপনাদের স্মরণ, স্মরণকারীদের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে, আপনাদের নাম নামসমূহের মধ্যে একাকার হয়ে গিয়েছে। আপনাদের শরীর শরীরসমূহের মধ্যে, আপনাদের রূহ সকল রূহের মধ্যে, আপনাদের সত্তা সকল সত্তার মধ্যে, আপনাদের নিদর্শন সকল নিদর্শনের মধ্যে এবং আপনাদের কবর সকল কবরের সাথে একাকার হয়ে গেছে। অতএব আপনাদের নামসমূহ কতইনা মধুর। কতইনা মহৎ আপনাদের নফ্স। কত বেশী আপনাদের মর্যাদা। কতইনা সুউচ্চ আপনাদের পদমর্যাদা। কতইনা নির্ভরযোগ্য আপনাদের প্রতিশ্র“তি। কতইনা সত্য আপনাদের প্রতিজ্ঞা। আপনাদের বাণী নূর সমতুল্য। আপনাদের নির্দেশ হেদায়াত স্বরূপ। আপনাদের আদেশ তাকওয়া স্বরূপ। আপনাদের কর্ম কল্যাণকর। আপনাদের রীতি মঙ্গলজনক। আপনাদের স্বভাব মহানুভব। আপনাদের মর্যাদা সত্য, সঠিক এবং প্রশান্তি দায়ক।
আপনাদের বক্তব্য সুদৃঢ় এবং চুড়ান্ত। আপনাদের মতামত প্রজ্ঞা, সহনশীল ও চিন্তাশীলতায় নিহিত। যদি কল্যাণের স্মরণ করা হয় তাহলে তার শুরু, তার মূল, শাখা, খনি, যথাযথস্থান এবং শেষ সীমা আপনারাই।”
“আমার পিতা-মাতা এবং আমার জীবন আপনাদের জন্য উৎসর্গ হোক। কিরূপে (মহান আল্লাহ) সম্পর্কে আপনাদের মাধ্যমে কৃত যথাযোগ্য প্রশংসাকে বর্ণনা করব এবং আপনাদের অপূর্ব বদান্যতাকে অনুধাবন করব। আপনাদের উছিলায় আল্লাহতা’লা আমাদেরকে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আপনাদের মাধ্যমে আমাদেরকে সংকট ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা করেছেন। আমাদেরকে অধপতন এবং জাহান্নামের আগুনে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। আমার পিতামাতা এবং আমার জীবন আপনাদের জন্য উৎসর্গ হোক। আপনাদের সাথে বন্ধুত্ব এবং আপনাদের বেলায়াতের মাধ্যমে জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহকে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আপনাদের প্রতি ভালবাসা ও বেলায়েতের মাধ্যমেই কালিমা (ঈমান) পরিপূর্ণ হয়েছে এবং নেয়ামত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভেদসমূহ ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে। আপনাদের ভালবাসা ও বেলায়াতের মাধ্যমেই অপরিহার্য ইবাদতসমূহ গৃহীত হবে। আপনাদের জন্যেই সম্মানিত ও মহিমান্বিত আল্লাহর নিকট রয়েছে ভালবাসা, সুউচ্চ মর্যাদা, প্রশংসিত স্থান (মাকামে মাহমুদ) এবং নির্ধারিত পদ ও মর্যাদা। রয়েছে মহা সম্মান, বৃহৎ মর্যাদা এবং গ্রহনযোগ্য শাফায়াত। হে আল্লাহ যা কিছু অবতীর্ণ করেছেন, তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছি। এবং আপনার রাসূলের (সা.) অনুসরণ করেছি। সুতরাং আমাদেরকে রেসালতের সাক্ষীদের অন্তর্ভূক্ত করুন। হে পারওয়ারদেগার আমাদের অন্তঃকরণসমূহকে হেদায়াত করার পর বিচ্যুত করবেন না। আপনার পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি রহমত প্রেরণ করুন। আপনিতো অনন্ত দাতা। আমাদের পবিত্র প্রতিপালক। নিশ্চয় আপনার প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়িত হবে।”
“হে আল্লাহর ওলীগণ, নিশ্চয় আমার ও আমার সম্মানিত ও মহিমান্বিত আল্লাহর মধ্যে গোনাহসমূহ (প্রতিবন্ধক হিসাবে) রয়েছে। আপনাদের সন্তুষ্টি ব্যতীত তা মোচন সম্ভব নয়। অতঃপর তিনি আপনাদেরকে তাঁর গোপন রহস্যের রক্ষী নির্ধারণ করেছেন, নিযুক্ত করেছেন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে এবং সৃষ্টির সকল বিষয়ের হিফাজতকারী হিসেবে। তিনি আপনাদের আনুগত্যকে (আল্লাহতা’লা) নিজের আনুগত্যের শামিল করেছেন। তাঁর নিকট আমাদের জন্য ক্ষমা
প্রার্থণা করুন এবং আমাদেরকে শাফায়াত করুন। কেননা আমি আপনাদের অনুগত। যে আপনাদের আনুগত্য করবে প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর আনুগত্য করল। যে আপনাদের অবাধ্য হবে প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহর অবাধ্য হল। যে আপনাদেরকে ভালবাসবে প্রকৃত পক্ষে সে খোদাকে ভালবাসল। আর যে আপনাদের সাথে শত্র“তা পোষণ করল সে আল্লাহর সাথে শত্র“তা করল।”
“হে আল্লাহ আমি যদি রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলি বাইতের চেয়ে আপনার নৈকট্য প্রাপ্ত অন্য কোন শাফায়াতকারী পেতাম, তাহলে তাদেরকে আমার শাফায়াতকারী নির্ধারণ করতাম। সুতরাং নিজের প্রতি তাঁদের যে অধিকার ওয়াজিব করেছেন, আপনার কাছে তাঁদের প্রকৃত পরিচয় প্রার্থণা করছি। প্রার্থণা করছি তাঁদের অধিকার জানার। আপনার রহমতের মাধ্যমে তাদের শাফায়াত প্রাপ্ত হওয়ার তাওফিক দান করুন। নিশ্চয় আপনি পরম দয়ালূ। হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলি বাইতের উপর দরুদ বর্ষন করুন। এবং তাঁদের প্রতি অসংখ্য সালাম বর্ষণ করুন। আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট; আর তিনি কতইনা উত্তম অবিভাবক এবং সাহায্যকারী।”
ছাত্রগণ ঃ
যদিও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি এবং জালিমদের অত্যাচার ইমামগণ (আ.) থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগকে অত্যন্ত সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিল। তথাপি কুরআন ও আহলি বাইতের জ্ঞান পিপাসু কিছু ব্যক্তিবর্গ তাদের যোগ্যতানুযায়ী ইমাম হাদী (আ.)-এর জ্ঞান সাগর থেকে উপকৃত হতে পেরেছিলেন এবং ঈমান ও মারেফাতের উচ্চ পর্যায়ে পৌছেছিলেন। শেখ তুসী (রহঃ) ১৮৫ জন রাবি, যারা ইমাম হাদী (আ.) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক উজ্জ্বল চেহারা পরিলক্ষিত হয়; নিম্নে আমরা তাদের কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরব ঃ
(১) হযরত আব্দুল আযীম হাসানী ঃ তিনি একজন বিশিষ্ট রাবি এবং অত্যন্ত জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। সংযম এবং তাকওয়ার শীর্ষে পৌছেছিলেন। তিনি ষষ্ট, সপ্তম ও অষ্টম ইমামের কিছু সাহাবিদের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং তিনি নিজেও ইমাম জাওয়াদ (আ.) ও ইমাম হাদী (আ.)-এর প্রখ্যাত সাহাবী ও রাবি ছিলেন। সাহেব ইবনে ইবাদ লিখেছেন ঃ আব্দুল আযীম হাসানী দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন এবং দ্বীনী মাসলা মাসায়েল ও কোরআনের বিধান সম্পর্কে সম্পুর্ণ অবগত ছিলেন।
আবু হিমাদ রাযী বলেন ঃ ইমাম হাদী (আ.)-এর খেদমতে পৌছে ধন্য হলাম এবং কিছূ প্রশ্ন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। যখন ইমামের (আ.) কাছে বিদায় চাইলাম, ইমাম আমাকে বললেন ঃ যখনই কোন সমস্যার সম্মুখীন হবে, আব্দুল আযীম হাসানীর কাছে জিজ্ঞাসা করবে। আর তাকে আমার সালাম পৌছে দিও।
তিনি ঈমান ও মারেফাতের এমন স্তরে পৌছেছিলেন যে ইমাম হাদী (আ.) তাকে বলেন ঃ তুমি আমাদের প্রকৃত বন্ধুদের মধ্যে একজন। তিনি একদা তার আক্বিদা ও বিশ্বাস সম্পর্কে তার জামানার ইমাম হযরত হাদী (আ.)-কে অবহিত করেন। ইমাম (আ.) তার বিশ্বাসের স্বীকৃতি †দন।
তিনি বলেন ঃ আমার মাওলা ইমাম হাদী (আ.)-এর কাছে উপস্থিত হলাম, তিনি আমাকে দেখে বললেনঃ স্বাগতম হে আবুল কাশেম! সত্যিই তুমি আমাদের বন্ধু। নিবেদন করলাম ঃ হে রাসূলের সন্তান আমার দ্বীন সম্পর্কে আপনাকে জানাতে চাই। আপনি যদি অনুমোদন দেন তাহলে আমরন এ পথে অবিচলিত থাকব। ইমাম (আ.) বললেন ঃ বল! বললাম ঃ আমি বিশ্বাস করি যে আল্লাহ এক এবং ্কোন কিছুই তার অনুরূপ নয়। তিনি বাতিল ও উপমা এই দুই সীমার উর্ধে। (বাতিল ঃ অর্থাৎ আ্ললাহকে কিছুই মনে না করা, উপমা ঃ অর্থাৎ তাঁকে সৃষ্টির সমতুল্য এবং সমমানে মনে করা)। আললাহর না শরীর আছে, না চেহারা। তিনি বস্তু উপজাত নন, নন বস্তু সত্বাও, বরং তিনিই শরীর সমূহকে সৃষ্টি করেছেন এবং চেহারা সমূহকে আকৃতি দান করেছেন। তিনি বস্তু উপজাত এবং বস্তু সত্বার সৃষ্টিকর্তা। তিনি সকল কিছুর প্রতিপালক, মালিক, পরিচালক এবং সৃষ্টি কর্তা। আরও বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর মনোনিত বান্দা এবং প্রেরিত শেষ রাসূল (সা.)। কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন রাসূল আসবে না। তাঁর শরীয়ত সমস্ত শরীয়তের সমাপক এবং কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন শরীয়ত আসবে না। আরও বিশ্বাস করি যে ঃ রাসূল (সা.)-এর পর আলীই (আ.) তাঁর উত্তরাধিকারী, ইমাম এবং অভিভাবক। অতঃপর ইমাম হাসান (আ.), ইমাম হুসাইন (আ.), ইমাম আলী ইবনিল হুসাইন (আ.), মুহাম্মাদ ইবনে আলী (আ.), জাফর ইবনে মুহাম্মদ (আ.), মুসা ইবনে জাফর (আ.), আলী ইবনে মুসা (আ.), মুহাম্মাদ ইবনে আলী (আ.) এবং আপনি [আলী ইবনে মুহাম্মাদ (আ.)] হে আমার মাওলা।
ইমাম হাদী (আ.), এরশাদ করলেন ঃ অতঃপর আমার পুত্র হাসান ইবনে আলী (আ.)। তৎপর তাঁর পুত্র ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কে জনগণকেকেমন মনে করছ? নিবেদন করলামঃ হে আমার মাওলা তিনি কেমন হবেন? এরশাদ করলেনঃ তিনি অদৃশ্য থাকবেন। তাঁর আবির্ভাব পর্যন্ত তাঁর নাম মুখে উচ্চারন করা ঠিক নয়। তিনি পৃথিবীকে শান্তি ও শৃংখলাতে পরিপূর্ণ করবেন, যেমনটি অন্যায় অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বললাম ঃ সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তাঁদের বন্ধুরা আল্লাহর বন্ধু এবং তাঁদের শত্র“রা আ্ললাহর শত্র“। তাঁদের আনুগত্য করার অর্থ আল্লাহর আনুগত্য। তাঁদের অবাধ্য হওয়া খোদার অবাধ্য হওয়ার সমান।
বিশ্বাস করি মি’রাজ সত্য, কবরে প্রশ্নো-উত্তর সত্য, বেহেশত সত্য, জাহান্নাম সত্য, পুলসিরাত সত্য, মিযান (আমল পরিমাপক) সত্য। কিয়ামত দিবস অবশ্যই আসবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সে দিন আল্লাহতা’লা মৃতদেরকে পুনর্জীবিত করবেন। এটাও বিশ্বাস করি যে, বেলায়াত বা ইমামতের পর ওয়াজিবসমূহ হল নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, খুমস, জিহাদ, ন্যায়কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের নিষেধ। ইমাম (আ.) এরশাদ করলেনঃ হে আবুল কাসেম, আল্লাহর শপথ এটা সেই দ্বীন, যে দ্বীনকে আল্লাহতা’লা তাঁর বাšদাদের জন্যে মনোনিত করেছেন। সুতরাং এ বিশ্বাসের উপর অবিচল থেক। আল্লাহ তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে এ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্টিত রাখুন। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, হযরত আব্দুল আযীম হাসানী (তার উপর সালাম বর্ষিত হোক) শাসকদের অত্যাচারের স্বীকার হয়ে ইরানে পালিয়ে আসেন এবং রেই শহরে আত্মগোপন করেন। তাঁর জীবনীতে পাওয়া যায় ঃ হযরত আব্দুল আযীম হাসানী (তার উপর সালাম বর্ষিত হোক) অত্যাচারী খলিফার ভয়ে পালিয়ে ইরানের রেই শহরে প্রবেশ করেন। সেখানে এক শিয়ার ভূগর্ভস্থ গৃহে (সাক্কাতুল মা’লী) অবস্থান করেন। তিনি সেখানে ইবাদত করতেন। দিনে রোজা রাখতেন এবং রাত্র জেগে নামাজ পড়তেন। কখনো কখনো নীরবে বাইরে †যতেন এবং যে কবরটি বর্তমানে তার কবরের পাশে রয়েছে (বর্তমানে ইমাম যাদেহ হামযা নামে প্রসিদ্ধ) যিয়ারত করতেন এবং বলতেন ঃ তিনি ইমাম কাযিম (আ.)-এর সন্তান। তিনি ঐ গৃহেই জীবন যাপন করতেন এবং এখবর ক্রমে প্রায় সকল শিয়ারাই জেনে ফেলেন। একদা এক শিয়া রাসূলকে (সা.) স্বপ্নে দেখলেন যে তাকে বলছেন ঃ আমার সন্তানদের মধ্যে একজনকে “সাক্কাতুল মা’লী” থেকে এনে আব্দুল জব্বার ইবনে আব্দুল ওহাবের আপেল বাগানের পাশে সমাধিস্থ করা হবে এবং বর্তমানে যেখানে সমাহিত আছেন সেখানে ইশারা করেছিলেন। ঐব্যক্তি বাগানের মালিকের কাছে সেই জমি কিনতে গেল, জমির মালিক বলল ঃ কিসের জন্যে তুমি এটা কিনতে চাও? ক্রেতা বলল ঃ আমি এরকম স্বপ্ন দেখেছি। মালিক বলল ঃ আমিও ঠিক এরূপ স্বপ্ন দেখেছি। সে ঐ বাগানকে হযরত আব্দুল আযীম ও তাঁর অনুসারীদের জন্য উইল করে দিল। এ ঘটনার কিছু দিন পর হযরত আব্দুল আযীম অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে গোসল দেওয়ার সময় তার পকেটে একটি চিরকুট পাওয়া যায়, তাতে তাঁর বংশ পরিচয় লিপিবদ্ধ ছিল। হযরত আব্দুল আযীম ইমাম হাদীর (আ.) সময়ে মৃত্যুবরণ করেন। ঐ মহান খোদায়ী ব্যক্তিত্বকে এই হাদীস, যা মুহাম্মদ ইবনে ইয়াহিয়া আত্তার বর্ণনা করেছেন, তা থেকে উপলদ্ধি করা সম্ভব। ত্রেই শহরের অধিবাসী এক ব্যক্তি ইমাম হাদী (আ.) এর †খদমতে আসলে তিনি বলেন ঃ কোথা থেকে এসেছ? বলল ঃ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক যিয়ারতে গিয়েছিলাম।
ইমাম (আ.) বললেন ঃ জেনে রাখ, যদি তোমাদের শহরে আব্দুল আযীম হাসানীকে যিয়ারত করতে, তাহলে ঐ ব্যক্তির সমান সওয়াব পেতে যে ব্যাক্তি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রওজা মোবারক যিয়ারত করেছে।
হযরত আব্দুল আযীম ইমামগণের (আ.) সময়ে এক বিশ্বস্ত আলেম এবং বিশিষ্ট রাবি হিসাবে পরিগণিত হতেন। তিনি লেখকও ছিলেন। তিনি আলী (আ.)-এর খোৎবা সমূহের উপর একটি বই লিখেছেন। তার অপর একটি বইয়ের নাম হল “ইয়াওমুন ওয়া লাইলাতুন”।
(২) হুসাইন ইবনে সাঈদ আহওয়াযী ঃ তিনি ইমাম রেজা (আ.), ইমাম জাওয়াদ (আ.) এবং ইমাম হাদী (আ.)-এর সাহাবী ছিলেন। তিনি ঐ মহান ইমামগণের (আ.) সকলের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রধানত কুফার অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তার ভাইয়ের সাথে আহওয়াযে চলে আসেন। সেখান থেকে কোমে যান এবং সেখনেই মৃত্যু বরন করেন। হুসাইন ইবনে সাঈদ ফেকাহ, আদব ও আখলাকের উপর মোট ৩০টি কিতাব রচনা করেন। তার কিতাব সমূহ ওলামাদের মধ্যে বহুল পরিচিত। মরহুম প্রথম মজলিসী বলেনঃ “তার বিশ্বস্ততার উপর এবং তার বর্ণিত হাদীসের উপর প্রত্যেক বড় আলেমগণকেই আমল করতে দেখা যায়।” এবং মরহুম আল্লামা মজলিসী বলেনঃ তিনি অতি মহৎ ওলামাদের আদর্শ এবং আস্থা ভাজনব্যক্তি ছিলেন। মরহুম শেখ তুসী (রহঃ) লিখেছেন ঃ হুসাইন ইবনে সাঈদ, তার এলমি মর্যাদা ছাড়াও, জনগণকে উপদেশ দিতেন ও †হদায়াতের পথে আহ্বান করতে সচেষ্ট ছিলেন। আর সে কারণেই ইসহাক ইবনে ইব্রাহীম হাযীনী ও আলী ইবনে রীয়ানকে ইমাম রেজা (আ.) এর খেদমতে নিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে তারা সঠিক মাযহাবকে চিনতে পারে এবং শিয়া হয়। আব্দুল−াহ ইবনে মুহাম্মাদ হাযীনী সহ আরও অন্যান্যকে ইমাম রেজা (আ.)-এর কাছে নিয়ে যান এবং তারা ইসলামের সাথে পরিচিত হন, এমনকি অতি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হন। এবং ইসলামের বহু †খদমত করেন।
(৩) ফাযল ইবনে শাযান নিশাপুরী ঃ তিনি মহৎ, বিশ্বস্ত, প্রখ্যাত ফকীহ এবং বলিষ্? কালামশাস্ত্রবিদ (মুতাকালি−ম) ছিলেন। ইমামগণের (আ.) কিছু সংখ্যক মহান সাহাবীদেরকে প্রত্যক্ষ করেন যেমনঃ মুহাম্মাদ ইবনে আবু উমাইর, সাফওয়ান ইবনে ইয়াহিয়া পঞ্চাশ বছর তাদের সাথে ছিলেন এবং তাদের থেকে উপকৃত হন। যেমনটি তিনি নিজেই বলেন ঃ হিশাম ইবনে হাকামের মৃত্যুর পর ইউনুস ইবনে আব্দুর রহমান তাদের খলিফা হয়। তার মৃত্যুর পর সাক্কাক বিরোধীদের †মোকাবেলায় তাদের খলিফা হন। বর্তমানে আমি হলাম তাদের খলিফা।
মরহুম শেখ তুসী (রহঃ) তাকে ইমাম হাদী (আ.) ও ইমাম আসকারী (আ.)-এর সাহাবী বলে উলে−খ করেছেন। কিছূ সংখ্যক রেজালবিদরা তাকে ইমাম জাওয়াদ (আ.), ইমাম হাদী (আ.) এবং ইমাম আসকারী (আ.)-এর সাহাবী বলে মনে করেন। ফাযল ইবনে শাযান বহু সংখ্যক গ্রন্থ লিখেছেন এবং তিনি †মাট ১৮০টি কিতাব লিখেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য “আল ঈযাহ” যা কালাম শাস্ত্র, সাহাবা এবং হাদীস স¤পর্কে লিখিত হয়েছে। বইটি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃষ্টপোষকতায় ১৩৯২হিজরীতে ছাপানো হয়েছে। ফাযল ইবনে শাযানের উক্তি ও অবদান সম্মানিত আলেমদের নজর কেড়েছে এবং তারা তার উক্তির ভিত্তিতেই রাবিদেরকে গ্রহন ও বর্জন করতেন। মরহুম শেখ কুলাইনী (রহঃ) তার বাণী ও দৃষ্টি ভংগির অংশ বিশেষকে তার মূল্যবান গ্রন্থ উছুলে কাফীতে বর্ণনা করেছেন। এছাড়া মরহুম †শখ সাদুক (রহঃ) ও মরহুম শেখ তুসী (রহঃ) ও তার বাণী ও ভাষ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।
জামে আর রেওয়াতের লেখক বর্ণনা করেছেন ঃ তিনি আমাদের (শিয়াদের) †নতা এবং অতি মহান। তিনি এত সম্মানিত যে আমাদের পক্ষে তার মর্যাদা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ফাযল ইবনে শাযান এক সফরে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর খেদমতে পৌছেন এবং বিদায় নেওয়ার সময় তার লিখিত বইটি হাত থেকে পড়ে যায়। ইমাম (আ.) বইটি তদেখলেন এবং তার প্রতি দোয়া করে বললেন ঃ আমার খোরাসানের অধিবাসীর উপর ঈর্ষা হয় যে, তাদের মধ্যে ফাযল ইবনে শাযানের মত ব্যক্তি রয়েছে। অন্য এক বর্ণনা অনুযায়ী তার “আল ইয়াওম ওয়াল লাইলাহ” বইটি ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-কে দেখানো হলে, তিনি তিন বার তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করেন এবং বলেন ঃ এই বইটি আমল করার উপযুক্ত।
মহান শহীদ কাজী নুরুল্লাহ শুশতারী ফাযল ইবনে শাযান সম্মর্কে বলেনঃ তিনি মুতাকালে−মদের মধ্যে মহৎ, মুফাসসের ও মুহাদ্দেসদের মধ্যে শ্রেষ্ট। ফকীহ ও মুজতাহিদগণের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয়, কারীদের মধ্যে প্রসিদ্ধ এবং ব্যকারণবিদ ও শ্রেষ্ট আভিধানিক ছিলেন। ফাযল ইবনে শাযান নিশাপুরে জীবন যাপন করতেন, আব্দুল্লাহ তাহের তাকে শিয়া হওয়ার কারণে নির্বাসন দেয় এবং তিনি বাইহাকে চলে যান। যখন খারিজিরা খোরাসানে বিদ্রোহ করে তিনি তাদের ভয়ে সেখান থেকে চলে আসেন এবং পথিমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ইমাম হাসান আসকারী (আ.) এর ইমামত কালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে নিশাপুরে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে তার সমাধিস্থান শিয়াদের যিয়ারতগাহে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই সেখানে কল্যাণ অনুসন্ধান করে।
দরবারী আলেমদের প্রতিকুলে ইমাম হাদী (আ.)
যদিও আব্বাসীয় খলিফাদের নীতি এই ছিল যে জনগণকে দরবারের ফকীহদের দিকে আকৃষ্ট করবে এবং তাদের রায়কে স্বীকৃতি প্রদান করবে। কিন্তু ইমাম হাদী (আ.) সামেররাতে থাকা কালীন সময়ে দরবারি আলেমদের মধ্যে একই ফতোয়ায় মতভেদ দেখা দিলে অগত্যা ইমাম হাদী (আ.)-এর শরনাপন্ন হয়। আর ইমাম তাঁর ইমামতি জ্ঞান ও স্পষ্ট দলিলের মাধ্যমে এমন ভাবে মাসলাগুলোকে বিশ্লেষন করতেন যে দরবারী আলেমরা অগত্যা তাঁর নিকট আত্মসমর্পণে বাধ্য হত। নিম্নে এরূপ দু’টি উদাহরণ তুলে ধরছি ঃ
(১) খ্রীষ্টান ব্যভিচারীর শাস্তি ঃ একদা এক খ্রীষ্টান যে এক মুসলমান নারীর সাথে জেনা করেছিল তাকে মুতাওয়াক্কিলের কাছে আনা হয়। মুতাওয়াক্কিল তাকে শরিয়ত মোতাবেক শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, এমতাবস্থায় খ্রীষ্টনটি ইসলাম আনয়ন করে। প্রধান বিচারক ইয়াহিয়া ইবনে আকছাম বলল ঃ ইসলাম গ্রহন করাতে তার সকল গোনাহ মাফ হয়ে গেছে এবং তাকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অন্যান্য দরবারী আলেমরা বললঃ তিনবার তার উপর হাদ জারী (ইসলামী বিধান) করতে হবে। অপর এক দল ভিন্ন ফতোয়া দিল। রায়ের বিভিন্ন তার কারণে মুতাওয়াক্কিল নিরুপায় হয়ে ইমাম হাদী (আ.) এর কাছে এ ব্যপারে প্রশ্ন করল। ইমাম (আ.) বললেন ঃ এত বেশী পরিমাণে চাবুক মারতে হবে যেন সে মারা যায়।
ইমামের ফতোয়া ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য দরবারী আলেমদের বিপক্ষে যাওয়াতে, তারা ইমামের কাছে এ বিষয়ে কোরআনের দলিল পেশ করতে মুতাওয়াক্কিলকে বলল। মুতাওয়াক্কিল বিষয়টি ইমামকে (আ.) জানাল, ইমাম হাদী (আ.) এভাবে জবাব দিলেন ঃ “এবং যখন তাহারা আমাদের আযাবকে প্রত্যক্ষ করিয়াছে তখনই তাহারা বলিয়াছে, ‘আমরা এক আল্লাহর উপর ঈমান আনিলাম এবং আমরা যাহাদিগকে তাঁহার সহিত শরিক করিতেছিলাম, তাহাদিগকে অস্বীকার করিলাম। কিন্তু যখন তাহারা আমাদের আযাবকে প্রত্যক্ষ করিল, তখন তাহাদের ঈমান তাহাদের কোন উপকারে আসিল না। ইহাই আ্ললাহর বিধান, যাহা তাঁহার বান্দাগণের মধ্যে প্রবর্তিত হইয়া আসিতেছে। এই ভাবে কাফেররা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। (সুরা গাফির- ৮৪-৮৫) মুতাওয়াক্কিল ইমামের যুক্তিযুক্ত দলিলকে গ্রহণ করল এবং জেনাকারীকে ইমামের (আ.) ফতোয়ানুযায়ী শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ দিল। ইমাম এই আয়াত উল্লেখ করে তাদেরকে বুঝিয়ে দিল যে, যেমনটি মুশরিকদের ঈমান আনয়ন তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারেনি, এই খ্রীষ্টানের ঈমান আনয়নও তাকে শাস্তি থেকে রক্ষা করবে না।
(২) মুতাওয়ক্কিলের নজর ঃ মুতাওয়াকক্কিল অসুস্থ হলে, মানত করল যদি সুস্থ হতে পারে, তাহলে আল্লাহর রাস্তায় প্রচুর সদকা দিবে। সুস্থ হওয়ার পর দরবারী আলেমদেরকে একত্র করে বলল ঃ কি পরিমাণ সদকা দিলে তা প্রচুর হিসাব হবে? দরবারী আলেমরা বিভিন্ন জবাব দিল। মুতাওয়াক্কিল নিরুপায় হয়ে ইমামের (আ.) কাছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করল। ইমাম হাদী (আ.) জবাব দিলেন ঃ ৮৩ দিনার সদকা দাও। দরবারী আলেমরা আশ্চর্য বোধ করল এবং মুতাওয়ক্কিলকে বলল ইমামের (আ.) কাছে প্রশ্ন করুন যে কিসের ভিত্তিতে তিনি এ ফতোয়া দিয়েছেন। মুতাওয়াক্কিল ইমাম হাদীকে (আ.) ব্যাপারটি বলল। ইমাম এরশাদ করলেন ঃ আল্লাহ তা’লা কুরআন পাকে এরশাদ করছেন ঃ “নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদিগকে বহু (প্রচুর) রণক্ষেত্রে সাহায্য করিয়াছেন।” সকলেই স্বীকার করেন যে, রাসূল (সা.) এর জমানায় ৮৩টি যুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ এখানে কাছির বা প্রচুর বলতে ৮৩ টিকে বুঝানো হয়েছে।
ইমাম হাদীর (আ.) কিছু মূল্যবান বাণী ঃ
পরিশেষে সম্মানিত ও মহিমান্বিত ইমামের (আ.) বেলায়েতকে দৃঢ় ভাবে ধারণ করার জন্যে তাঁর কিছু পবিত্র বাণী বর্ণনা করাকে সমীচীন মনে করছি। ইমাম হাদী (আ.) তাঁর মহান পিতাদের সুত্রে বর্ণনা করেন যে রাসূল (সা.) বলেছেন ঃ “ঈমান হল অন্তঃকরণ দ্বারা গ্রহন করা, আমলের মাধ্যমে প্রকাশ করা ও স্বীকৃতি দেওয়া। আর ইসলাম হল তা, যা স্বীকার করার সাথে সাথে বিবাহ হালাল হয়ে যায়।”
(১) স্বার্থপর (আত্মপুজারী) ব্যক্তিকে কেউই পছন্দ করে না।
(২) ঠাট্টা রসিকতা নির্বোধদের আমোদ-প্রমোদের মাধ্যম এবং তা মুর্খদেরই কাজ।
(৩) যে ব্যক্তি তার বন্ধুত্ব, আকাংখা এবং মতামতকে তোমার ইচ্ছার উপর অর্পণ করেছে, তুমিও তার আনুগত্য কর এবং তাকে গ্রহন কর।
(৪) যে ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিত্বকে তুচ্ছ জ্ঞান করে এবং নিজের মর্যাদাকে বুঝেনা, তার অনিষ্ট থেকে নিজেকে রক্ষা কর।
(৫) দুনিয়া একটি বাজার স্বরূপ এক শ্রেণী তা থেকে লাভবান হয় আর অপর শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
(৬) যে আল্লাহকে ভয় করে, মানুষও তাকে ভয় করে এবং যে আল্লাহর আনুগত্য করে মানুষও তার আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য করবে †স সৃষ্টির ক্রোধের তোয়াক্কা করবে না।
(৭) অত্যাচারী তার ধৈর্য, নম্রতা ও সহিষ্ণুতার কারণে ক্ষমা প্রাপ্ত হতে পারে।
(৮) যে ব্যক্তি সত্য ও সঠিক পথে আছে কিন্তু নির্বোধের ন্যায় কাজ করে, এই নির্বুদ্ধিতার কারণে তার সত্যের আলো নিভে যেতে পারে।
তথ্যসূত্র ঃ
(১) আল ইযাহ Ñআবি মুহাম্মাদ ফাযল ইবনে শাযান মৃত্যু ২৬০হিঃ।
(২) তারিখে ইয়াকুবী Ñআহমাদ ইবনে আবি ইয়াকুবী মৃত্যু ২১৪হিঃ।
(৩) মুরুজুয যাহযব Ñমাসুদী মৃত্যু ৩৪৬হিঃ।
(৪) মাকাতিলুত তালেবিন Ñআবিল ফারাজ ইসফাহানী মৃত্যু ৩৫৬হিঃ।
(৫) তুহাফুল উকুল Ñইবনে শাবাহ মৃত্যু ৩৮১হিঃ।
(৬) আমালী সাদুক цশখ সাদুক (রহঃ) মৃত্যু ৩৮১হিঃ।
(৭) এরশাদে মুফিদ цশখ মফিদ (রহঃ) মৃত্যু ৪১৩হিঃ।
(৮) ইখতিয়ার মারেফাতুর রিজাল цশখ তুসী (রহঃ) মৃত্যু ৪৬০হিঃ।
(৯) †রজালে †শখ তুসী цশখ তুসী (রহঃ) মৃত্যু ৪৬০হিঃ।
(১০) আ’লামুল ওরা Ñফাযল ইবনেল হাসান তাবরাসী মৃত্যু ৫৪৮হিঃ।
(১১) আল মুখতাসার ফী আখবারিল বাশার Ñইমাদ উদ্দীন ইসমাঈল আবিল গাদাদ মৃত্যু ৭৩২হিঃ।
(১২) ততিম্মাতুল মুখতাসার ফী আখবারিল বাশার Ñনুরুদ্দীন আমর ইবনুল ওয়ারদি মৃত্যু ৭৫০হিঃ।
(১৩) আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ Ñইবনে সাবাগ মলেকি মৃত্যু ৮৫৫হিঃ।
(১৪) তারিখুল খুলাফা Ñজালাল উদ্দীন সুয়ুতী মৃত্যু ৯১১হিঃ।
(১৫) এহকাকুল হাক Ñকাজী নুরুল−াহ তাসযী মৃত্যু ১০১৯হিঃ।
(১৬) জামে আর †রয়াত Ñমারহুম আরদেবেলী মৃত্যু হিঃ ১১শতাব্দি।
(১৭) বিহারুল আনওয়ার Ñমরহুম †মাল্যা মুহাম্মাদ বাকের মজলিসী (রহঃ) মৃত্যু ১১১১হিঃ।
(১৮) মুনতাহাল মাকাল Ñআবু আলী আল হায়েরী মৃত্যু ১২১৫হিঃ।
(১৯) নুরুল আবসার Ñশাবলানজী মৃত্যু হিঃ ১৩শতাব্দি।
(২০) তানকীহুল মাকাল цশখ আব্দুল−াহ মামকানী মৃত্যু ১৩৫১হিঃ।
(২১) আনওয়ারুল বাহিয়া Ñমুহাদ্দিস কুম্মী মৃত্যু ১৩৫৯হিঃ।
(২২) মুনতাহাল আমাল Ñমুহাদ্দিস কুম্মী মৃত্যু ১৩৫৯হিঃ।
(২৩) তাতিম্মাতুল মুনতাহা Ñমুহাদ্দিস কুম্মী মৃত্যু ১৩৫৯ হিঃ এবং অন্যান্ন কিতাবসমূহ।
©somewhere in net ltd.