নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দেশ , মানুষ

জীবনের সব কিছু আললাহর সন্তুষ্টির জন্য

আল মাহদী ফোর্স

কোরান ও নবী পরিবারের আঃ অনুসারী।

আল মাহদী ফোর্স › বিস্তারিত পোস্টঃ

ওয়াহাবি মতবাদের স্বরূপ

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৫০

মোহাম্মাদ রেজওয়ান হোসাইন

‘ওয়াহাবি’ মতবাদও অপরাপর বহু ফেরকার মতো একটি ফেরকা। ওয়াহাবি মতবাদের মূল ভাবনাগুলো গৃহীত হয়েছে ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারা থেকে। তাই প্রথমেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো সংক্ষেপে পর্যালোচনা করে নেওয়া জরুরি। ৬৬১ হিজরিতে তাকিউদ্দিন আহমাদ ইবনে আবদুল হালিম তৎকালীন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাররান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইবনে তাইমিয়া নামেইবেশি পরিচিত।

দামেস্কে যাবার পর ‘দারুল হাদিস’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ইবনে তাইমিয়ার পিতা। সেখানে ইবনে তাইমিয়া পড়ালেখা করেন। তিনি তাঁর যৌবনকাল কাটান দামেস্কে। তাঁর পিতাসহ হাম্বালি মাযহাবের বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তিনি ফিকাহ, হাদীস, উসূল, তাফসীর, কালামশাস্ত্র ইত্যাদি শেখেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং কোরআনের তাফসীর পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হন। ইবনে তাইমিয়া অন্যান্য ধর্ম এবং মাযহাব নিয়েও পড়ালেখা করেন এবং এমন কিছু ফতোয়া দিতে থাকেন যেগুলোর সাথে আহলে সুন্নাতের চার মাযহাবেরও কোনো মিল ছিল না।

ইবনে তাইমিয়া নিজেকে ‘সালাফি’ বলে মনে করতেন। সালাফি শব্দের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে পূর্বপুরুষদের নিঃশর্ত অনুসরণ করা। তবে ‘সালাফিয়া’ একটি ফেরকার নাম যে ফেরকায় মহানবী (সা.), তাঁর সাহাবীবর্গ এবং তাবেয়ীদের অনুসরণের দাবি করা হয়। (তাবেয়ীন বলতে বোঝায় এমন শ্রেণির লোকজনকে যাঁরা এক বা একাধিক সাহাবীর সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন।) সালাফিরা মনে করত ইসলামের সকল আকিদা-বিশ্বাস সাহাবী এবং তাবেয়ীদের আমল অনুযায়ী বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। আর ইসলামী আকিদা কেবল কোরআন ও সুন্নাত থেকেই গ্রহণ করতে হবে, আলেমদের উচিত হবে না কোরআনের বাহ্যিক অর্থের বাইরে কোনো দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে কোনো কিছু আমল বা বাস্তবায়ন করা। সালাফিদের চিন্তায় বিবেক-বুদ্ধি বা যুক্তি তথা গবেষণার কোনো স্থান নেই, তাদের কাছে কেবল কোরআন-হাদীসের মূল টেক্সটের বাহ্যিক অর্থই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট।

ইবনে তাইমিয়া যখন তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনাপ্রসূত বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, তখন তাঁর সেসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তিনি আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ্্ সশরীরী একটি সত্তা এবং তিনি আকাশসমূহের ঊর্ধ্বে থাকেন। (আলফাতওয়া, ৫/১৯২; আররাসায়েল ওয়াল মাসায়েল, ৫/২০৯) ইবনে তাইমিয়াই প্রথম মুসলিম যিনি আল্লাহর সশরীরী সত্তার প্রবক্তা এবং এর পক্ষে লেখালেখিও করেছেন। তিনি মহানবী (সা.)-এর রওজা শরীফ যিয়ারত করা কিংবা তাঁর সম্পর্কে কোনো স্মরণসভা বা কোনো অনুষ্টান করাকে হারাম এবং র্শিক বলে মনে করতেন। (ইবনে তাইমিয়া, আততাওয়াসুল ওয়াল ওয়াসিলা, পৃ. ১৫৬; যিয়ারাতুল কুবুর, পৃ. ১৭-১৮)

ইবনে তাইমিয়া মহানবীসহ সকল ওলি-আউলিয়ার কবর মেরামত করা বা পবিত্র কোনো কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণ করারও বিরোধী ছিলেন এবং এ ধরনের কাজকে তিনি র্শিক বলে মনে করতেন। তাঁর এসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাযহাবের আলেমগণ তীব্র প্রতিবাদ জানান। (প্রাগুক্ত) ইবনে তাইমিয়ার মত মুসলিম মনীষীদের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কারণেই তাঁরা তার বিরোধিতা করেছেন। (ইবনে হাজার আসকালানী, আদদুরারুল কামিনাহ, ১/১৪৭; শাওকানী, আলবাদরুত তালে’,২/২৬০, ১/৬৭ ও ইয়াফেয়ী, মিরআতুল জিনান, ২/২৪২)

মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত বিশ্বাসের সাথে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সাংঘর্ষিক হবার ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যার পরিণতিতে ৭০৫ হিজরিতে সিরিয়ার আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মিশরে নির্বাসনের রায় দেয়। ৭০৭ হিজরিতে তিনি কারামুক্ত হন এবং কয়েক বছর পর আবার সিরিয়ায় ফিরে আসেন এবং তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে পুনরায় লেখালেখি করতে থাকেন। ৭২১ হিজরিতে আবার তাঁকে আটক করা হয় এবং ৭২৮ হিজরির জিলকদ মাসে দামেস্কের কেল্লা কারাগারে মারা যান।

ইবনে তাইমিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর চিন্তাদর্শনেরও প্রায় মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ শতাব্দী পর মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদি নামের এক ব্যক্তি ইবনে তাইমিয়ার আকিদার ভিত্তিতে নতুন করে একটি ফেরকার জন্ম দেন। তাঁর ঐ ফেরকার নাম হচ্ছে ‘ওয়াহাবিয়্যাত’ বা ওয়াহাবি মতবাদ। এই মতবাদের প্রতিষ্টাতা মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব ১১১৫ হিজরিতে সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে তিনি ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন এবং পুনরায় সালাফি মতবাদের প্রচার ঘটান।

মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহাব মদীনাতেও ইসলামের নবীর শরণাপন্ন হওয়া বা তাঁর রওজা যিয়ারত করতে আসা মানুষের সমালোচনা করতেন। ওয়াহাব ধর্মের সরল সঠিক পথ থেকে এত তবেশি বিচ্যুত হন যে, আপামর মুসলমানকে ‘কাফের’ ও ‘মুশরিক’ বলে বেড়াতে শুরু করেন, এমনকি মুসলমানদের হত্যা করাকে ওয়াজিব বলেও মন্তব্য করেন। ধর্মীয় পবিত্র স্থাপনাগুলো দখল করা এবং ধ্বংস করাকে তাঁর অনুসারীদের ওপর ওয়াজিব বলে ঘোষণা করেন। সহিংসতা ছিল আবদুল ওয়াহাব এবং তাঁর অনুসারীদের আচরণগত প্রধান বৈশিষ্ট্য। (উনওয়ানুন মাজদ ফি তারিখিন নাজদ, পৃ. ৩৪-৪৩, আলুসি, তারিখে নাজদ, ৩য় অধ্যায়, পৃ. ৯৫; তারিখে আলে সাউদ, ১/৩১) মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের আকিদার বিষয়টি ¯পষ্ট হবার পর তাঁর বিরুদ্ধে বড় বড় বহু আলেম এগিয়ে আসেন। স্বয়ং তাঁর ভাই শায়খ সোলায়মান, যিনি ছিলেন একজন হাম্বালি আলেম, তিনিও ওয়াহাবের আকিদা প্রত্যাখ্যান করে একটি বই লেখেন। (উলামাউ নাজদ, পৃ. ৩৫০-৩৫৭) তারপরও আবদুল ওয়াহাব তাঁর জাহেলি বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকেন এবং যে কেউ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করলে তাকে ‘কাফের’ বলে সাব্যস্ত করেন।

এমনিতেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এ সময় চারদিক থেকে মুসলিম বিশ্বকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা পূর্বদিক থেকে ভারতের বৃহৎ অংশ দখল করে পারস্য উপসাগর উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তারা প্রতিটি মুহূর্তে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। ফরাসিরা নেপোলিয়নের নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে ভারতের দিকে যাবার চিন্তা করছিল। রুশরাও চেয়েছিল ইরান এবং তুরস্কে বারবার হামলা চালিয়ে তাদের সাম্রাজ্য একদিক থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত অন্যদিকে সুদূর পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে। সে সময়ের আমেরিকাও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল। তারা লিবিয়া এবং আলজেরিয়ায় গুলিবর্ষণ করে মুসলিম বিশ্বে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এমন একটি কঠিন পরিস্থিতিতে যখন শত্রুদের মোকাবেলায় মুসলমানদের মধ্যে পার¯পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক হৃদ্যতার প্রয়োজন ছিল, ঠিক সে সময় মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে মুসলিম ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন।

ওয়াহাবি মতবাদ প্রচারের একেবারে শুরুতেই যে কাজটি করা হয় তা হলো উয়াইনায় অবস্থিত সাহাবীদের এবং অলি-আউলিয়ার মাযারগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব আল্লাহর অলিদের শরণাপন্ন হওয়াকে র্শিক এবং মূর্তিপূজার মতো অপরাধ বলে গণ্য করত এবং যারা একাজ করত তাদেরকে কাফের বলে সাব্যস্ত করতেন। তাদেরকে হত্যা করা জায়েয এবং তাদের মালামালকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই ফতোয়া পেয়ে তাঁর অনুসারীরা হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছে। (শাহ ফাজলে রাসুল কাদেরী, সাইফুল জাব্বারিল মাসলুল আলাল আ’দা, ইস্তাম্বুল থেকে প্রকাশিত, পৃ. ২ এর পর থেকে) মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব বিভিন্ন শহরের লোকজনকে তাঁর মতবাদের দিকে আহ্বান জানাত। যারা গ্রহণ করত তারা নিরাপদ ছিল, আর যারা বিরোধিতা করত তাদের জান-মালকে হালাল ঘোষণা করে আক্রমণ চালানো হতো। নাজদ এবং নাজদের বাইরে ওয়াহাবিরা এরকম বহু যুদ্ধ করেছে। ইয়েমেন, হেজাজ, সিরিয়ার উপকন্ঠ ও ইরাকে ওয়াহাবিরা যত যুদ্ধ করেছে সবই তাদের মতবাদ গ্রহণে অস্বীকৃতির কারণেই করেছে। ওয়াহাবের দৃষ্টিতে পবিত্র কোনো স্থাপনা, যেমন অলি-আউলিয়া, আহলে বাইতের ইমামদের মাযারের মতো মহান স্থাপনাগুলো যিয়ারত করা র্শিক। তাই এসব স্থাপনা যিয়ারতকারীদের জানমাল হরণ করা সওয়াবের কাজ। মক্কা দখল করার পর ওয়াহাবিরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে দেয়। নবীজী (সা.)-এর জন্মস্থানের গম্বুজ, কাবায় হযরত আলী (আ.)-এর জন্মস্থানের গম্বুজ, হযরত খাদিজা (আ.) ও হযরত আবু বকরের স্মৃতিময় নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। ওয়াহাবিরা এসব পবিত্র স্থাপনা ধ্বংস করার সময় তবলা বাজিয়ে গান গেয়ে নেচে নেচে উল্লাস করত। মুসলিম বিশ্বে ওয়াহাবিদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।

ওসমানী সাম্রাজ্য সে সময় হেজাজ, ইয়েমেন, মিশর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং ইরাকের মতো মুসলিম ভূখণ্ড জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ওসমানী বাদশাহ মিশরের গভর্নরকে আদেশ দিয়েছিলেন ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলি পাশা ওসমানী সরকারের পক্ষ থেকে ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করে তাদেরকে পরাজিত করে মক্কা, মদীনা ও তায়েফকে মুক্ত করতে সমর্থ হন। এভাবেই ১২১৩ হিজরিতে অর্থাৎ ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহাবি মতবাদের প্রায় বিলুপ্তি ঘটে। এরপর অন্তত এক শতাব্দী সময়কাল পর্যন্ত ওয়াহাবি মতবাদের নামটিরও আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না কিংবা এই ফেরকাটি নিয়ে আর কেউ কখনো কোনোরকম চিন্তাভাবনা করেনি।

আপামর জনগণ ওয়াহাবিপন্থীদের ভয়ে যেভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল সেই ভয় মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে কেটে যায়। কিন্তু ওসমানী সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ইতিহাসের বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আবদুল আযিযের আগমনে সৌদ বংশের শক্তি যেমন ফিরে আসে তেমনি বিচ্যুত ঐ ওয়াহাবি মতবাদের চর্চাও পুনরায় শুরু হয়।

সালাফিয়া আকিদায় বিশ্বাসীদের আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো তারা মনে করে কেবলা হচ্ছে আল্লাহর সশরীরী উপস্থিতির স্থান। নামায পড়ার সময় এভাবেই আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামীন সকল মুসল্লির সামনে উপস্থিত থাকেন বলে তাদের বিশ্বাস। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ইবনে হাজার মাক্কি তাঁর ‘আলফাতাভি-আল-হাদীসা’ নামক গ্রন্থে ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে লিখেছেন : ‘খোদা তাকে অন্ধ, বধির, গোমরাহ, হীন এবং অপদস্থ করে দিয়েছেন। তার সমকালীন আহলে সুন্নাতের ফকিহ ইমামগণ, যেমন ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ইমাম মালেক (রহ.), ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর অনুসারী ফকিহগণ তাইমিয়ার চিন্তা-চেতনা এবং কথাবার্তা সম্পর্কে বলেছেন : ‘ইবনে তাইমিয়ার কথাবার্তা মূল্যহীন এবং সে বেদআত সৃষ্টিকারী, গোমরাহ ও ভারসাম্যহীন।’

ইবনে তাইমিয়া আরো বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ্্ রাব্বুল আলামীনকে আমাদের বাহ্যিক চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব। ওয়াহাবিরা আল্লাহ্্কে দেখার বিষয়টি নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি করেছে, এত বেশি সীমালঙ্ঘন করেছে যে, বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনো সচেতন চিন্তার মানুষই তাদের ওই চরমপন্থী কথাবার্তায় বিস্মিত না হয়ে পারেন না। ইবনে তাইমিয়া বিশ্বাস করেন কিয়ামতের দিন আল্লাহ্্পাক তাঁর নিজ চেহারায় মানুষের সামনে আসবেন এবং আত্মপরিচয় দিয়ে বলবেন : ‘আমি তোমাদের আল্লাহ্।’

ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারার অন্যতম প্রচারক মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব বলেছিলেন : ‘যারা ফেরেশতা, নবী-রাসূল এবং আল্লাহর অলিদেরকে নিজেদের শাফায়াতকারী হিসেবে চিন্তা করে কিংবা তাঁদের উসিলায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশা করে, তাদেরকে হত্যা করা বৈধ এবং তাদের ধনসম্পদ মোবাহ (অর্থাৎ কেড়ে নেয়া যাবে)।’ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব তাঁর এই মনগড়া চিন্তাধারার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন এবং কোনো রকম প্রমাণ ছাড়াই নিজের বিচ্যুত চিন্তাধারাকে ইসলামের ধর্মীয় চিন্তা বলে উল্লেখ করেছেন। শিয়াদের ব্যাপারে ওয়াহাবিরা কুফ্রির অভিযোগ এনে তাদের হত্যা করাকে হালাল বলে ঘোষণা করলেও বাস্তবতা হলো এই যে, আল্লাহর একত্ব, নবী করিম (সা.)-এর রেসালাত, কোরআনের প্রতি ঈমান, পরকালের প্রতি ঈমান ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের সাথে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন।

ইসলামে যিয়ারতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যিয়ারত মুসলমানদের ইবাদতের কর্মসূচিগুলোর একটি। মুসলমানরা শাফায়াতের প্রতি বিশ্বাস অনুযায়ী তাওয়াসসুল এবং পূত-পবিত্র ব্যক্তিত্ববর্গের কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে তর্কাতীত বিষয় বলে মনে করে। কিন্তু সালাফিয়া মতবাদের প্রতিষ্টাতা ইবনে তাইমিয়া নবীজী (সা.)-এর কবর যিয়ারত করাকে, এমনকি যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করাকেও হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বুযুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত করাকে ‘কবর পূজা’ বলে অভিহিত করে এটাকে জাহেলিয়াতের যুগের মূর্তিপূজার সাথে তুলনা করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দীতেও মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব আলে সৌদের সহযোগিতায় ইবনে তাইমিয়ার আকিদার বিস্তার ঘটান, যিয়ারতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং হারাম শরীফের নিকটবর্তী কবরসমূহ ও অন্যান্য পবিত্র স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলেন। অথচ যিয়ারত সম্পর্কে স্বয়ং নবী করিম (সা.)এর একটি হাদীস হলো, ‘বেশি বেশি কবর যিয়ারত করবে যাতে পরকালীন পৃথিবীর কথা মনে জাগে।’ আরেকটি হাদীস এরকম, ‘কবর যিয়ারতে যাবে। কেননা, তার মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা।’ এই দুটি হাদীস ও এরকম আরো অনেকে হাদীসের (ইবনে হাজার হাইসামী মাক্কী, আততোহফাহ, ৩/২০৬ ও ৭/৭৪; আলমুগনি আলমুহতাজ, ১/৩৪১ও ৩৬৭) আলোকে ইবনে তাইমিয়ার কথাবার্তা কেবল যে ভিত্তিহীন এবং বাতিল তাই নয়; বরং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি চরম অবমাননা ও বেয়াদবিপূর্ণও বটে।

মুসলমানরা সবসময়ই দ্বীনের মহান মনীষীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাঁদেরকে স্মরণ করে এসেছে। এমনকি তাঁদের সমাধিসৌধ নির্মাণ করে মাযারের পাশে মসজিদ তৈরি করে ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে মনীষীদের স্মৃতিকে মনের ভেতরে জাগ্রত রেখে এসেছে। কিন্তু ওয়াহাবিরা আল্লাহর অলি, সালেহীন, এমনকি নবীদের কবরের ওপরেও মসজিদ কিংবা সমাধিসৌধ নির্মাণ করাকে বেদআত বলে অভিহিত করেছে। ১৯২৬ সালে মদীনায় বাকী কবরস্থানে নবী করিম (সা.)-এর সাহাবীবৃন্দ এবং তাঁর বংশের ব্যক্তিত্বগণের মাযারগুলোকে ধ্বংস করার ঘটনা ওয়াহাবিদের সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ধৃষ্টতামূলক আচরণ হিসেবে পরিগণিত। (মিন আখবারিল হিজায ওয়ান নাজদ, পৃ. ১০৫) অথচ আজ পর্যন্তও সালাফি বা ওয়াহাবি আলেমরা তাদের এই অমানবিক, নোংরা ও ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজের পক্ষে দ্বীনি প্রমাণ তো দূরের কথা, বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো যুক্তিও দেখাতে পারেনি।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, শিয়া মাযহাবের অনুসারিগণ রাসূলে খোদা (সা.)-এর সন্তান এবং তাঁর বংশধরদের কবরের ওপর স্থাপনা বা সৌধ নির্মাণ করেছেন। সুন্নি মাযহাবের অনুসারীরাও শহীদান এবং বুযুর্গানে দ্বীনের কবরের ওপর গম্বুজ ও স্থাপনা নির্মাণ করেছেন এবং তাঁদের কবর যিয়ারত করেন। সব মুসলমানই নবী-রাসূলসহ আল্লাহর অলিদের কবর যিয়ারত করাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি উপায় বলে মনে করেন। সে লক্ষ্যে এগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করাটাও ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের অংশ বলে মনে করেন। কেবল ওয়াহাবি মতবাদের অনুসারীরাই এর বিরুদ্ধে গিয়ে পবিত্র স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে ফেলায় বিশ্বাস করে। ওয়াহাবি মতবাদের আবির্ভাবের আগে ইসলামের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনী লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা ছাড়াও তাঁর ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহৃত জিনিসপত্র, যেমন আংটি, জুতা, মেসওয়াক, তলোয়ার, ঢাল, এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.) যেসব কূপ থেকে পানি খেয়েছেন সেই কূপগুলো পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ওয়াহাবিদের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সেগুলোর খুব কমই এখন অবশিষ্ট রয়েছে।

ইবনে তাইমিয়ার সমকালীন বিখ্যাত আলেম তাকি উদ্দিন সুবকি (মৃত্যু ৭৫৬ হিজরি) ইবনে তাইমিয়া সম্পর্কে লিখেছেন : ‘ইবনে তাইমিয়া কোরআন এবং সুন্নাহর অনুসরণের আড়ালে ইসলামী আকিদায় বেদআত ঢুকিয়ে ইসলামের মৌলিক স্তম্ভগুলোকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সে মুসলমানদের সামগ্রিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।’ আলেম সমাজ ইবনে তাইমিয়ার লেখা বইগুলো পর্যালোচনা করে বলেছেন, আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর সত্তাসহ ইসলামের অন্যান্য বিধান সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যগুলো একান্তই শিশুসুলভ। সেসব বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, ইসলামের গভীর এবং মূল্যবান তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।

নতুন নতুন আবিষ্কার যদি ইসলামের জন্য ক্ষতির কারণ না হয় তাহলে সেগুলোকে ইসলাম স্বাগত জানায়। অথচ ওয়াহাবিরা তাদের বিকৃত এবং ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোকে বেদআত বলে মনে করে। তারা বলে, এগুলো মানুষকে আল্লাহবিমুখ করে তোলে, তাই এগুলো ব্যবহার করা র্শিক। সৌদি আরবে মহিলাদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ এ ধরনের আরো অনেক প্রতিবন্ধকতার কারণে আধুনিক টেকনোলজির কল্যাণ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। কিছুদিন আগেও সৌদি আরবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা র্শিক হিসেবে গণ্য ছিল। এখনো ওয়াহাবি আলেমদের দৃষ্টিতে বৈজ্ঞানিক অনেক প্রযুক্তির ব্যবহার হারাম।

ওয়াহাবিরা নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অন্যান্য মুসলমানকে মুশরিক বলে ঘোষণা করে এবং তাদের জান-মাল, এমনকি নারীদেরকে নিজেদের জন্য হালাল বলে ঘোষণা করে। উগ্র এই মতবাদের সহিংসতার অসন্তোষজনক পরিণতি এখন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিকৃত চিন্তাধারার অধিকারী ওয়াহাবি মতবাদের ধারক হচ্ছে এযুগের সহিংসতাকামী গোষ্টী তালেবান, আল-কায়েদা এবং এ জাতীয় আরো অনেক সন্ত্রাসী গোষ্টী। আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইরাকসহ আরো অনেক দেশে পাশবিক হামলা চালিয়ে এরা বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামকে ভয়ঙ্কর চেহারায় তুলে ধরছে। ভয়াবহ এই সালাফি গোষ্টীগুলো অন্যান্য মুসলমানকে মুশরিক ভেবে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। এবারে উগ্র এই গোষ্টীগুলোর পেছনের ইতিহাসের দিকে নজর দেয়া যাক।

আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী এবং ওয়াহাবি গোষ্টী তালেবান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের যৌথ প্রচেষ্টায় সৃষ্টি হয়েছে। তাদের নেতা হলো মোল্লা মুহাম্মাদ ওমর। এই গোষ্টীটি ১৯৯৬ সালে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখল করে এবং দেশের শাসনভার হাতে তুলে নেয়। তারা ওয়াহাবিদের কাংক্ষিত সরকারের নমুনা জনগণের সামনে তুলে ধরে। তারা ইসলামের নামে নৃশংস এবং মূর্খতাপূর্ণ আইন-কানুন চালু করে। সিনেমা থিয়েটার বন্ধ করেদেয়। জনগণকে বেত্রাঘাত করে জামাআতে নামায পড়তে বাধ্য করে এবং লম্বা দাড়ি রাখতেও বাধ্য করে। তালেবানরা মেয়েদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং নারীদেরকে ঘরের বাইরে কাজ করতে নিষেধ করে। তালেবানরা তাদের আকিদার বিরোধীদের হত্যা করে সে সুন্নি হোক কিংবা শিয়া। এই উগ্র গোষ্টীটি মুসলমানদের ঐক্যকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং পশ্চিমা মিডিয়াগুলোকে ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালাবার মোক্ষম সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।

এরকম আরো কিছু গোষ্টী আছে পাকিস্তানে। তালেবান এবং সৌদি আরবের সহযোগিতায় সৃষ্টি হয়েছে এই গোষ্টীটি। এরা ওয়াহাবিদের চেয়েও বেশি উগ্র। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সকলকে তারা নির্দয়ভাবে হত্যা করছে। মসজিদে নামাযরত অবস্থায়ও এই উগ্র গোষ্টীটি মুসল্লিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করছে।

আল-কায়েদা এরকম আরেকটি গোষ্টী। ওসামা বিন লাদেনের মাধ্যমে এই গোষ্টীটির জন্ম হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এই গোষ্টীটির গোপন সম্পর্ক রয়েছে। তবুও ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলার পেছনে এই গোষ্টীটির হাত থাকার অজুহাতে আল-কায়েদার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আফগানিস্তানের ওপর মার্কিনীরা হামলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করে। ওয়াহাবি সন্ত্রাসীগোষ্টীটি এখন বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নামে ইরাক, ইরান, ইয়েমেন, সিরিয়া, সোমালিয়াসহ আরো বহু মুসলিম দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মুসলমানদেরকেই তাদের প্রধান শত্রু বলে মনে করছে।

এরাই ইসলামের নামে বিভিন্ন দেশে হাটে-বাজারে, †লাকালয়ে বা জনসমাগম স্থলে, মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে, নারী ও শিশুদেরকে হত্যা করছে, সিরিয়ায় সরকারি সেনাকে হত্যা করে কাঁচা কলিজা চিবিয়ে খেয়েছে। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, রাসূলের প্রতি ভালোবাসা, সালেহিন এবং সকল মানুষকে ভালোবাসা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। ওয়াহাবিদের মতো উগ্র গোষ্টীগুলোর কার্যক্রমের ফলে সুযোগসন্ধানী ইসলামের শত্রুরা ভালোবাসা এবং প্রেমের ভিত্তিমূলে সৃষ্ট এই ঐশী ধর্মকে এখন বিকৃতভাবে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। ওয়াহাবিদের কার্যক্রমকে কাজে লাগিয়ে তারা ইসলাম এবং সব মুসলমানকে উগ্র এবং সন্ত্রাসী বলে প্রচার চালাচ্ছে।

আরব দেশগুলো ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও যেখানেই ওয়াহাবিরা উপযুক্ত মনে করেছে সেখানেই প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে তাদের ভ্রান্ত মতবাদ প্রচারের চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ গঠন করা, আর্থিক এবং রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা দেওয়া থেকেও তারা পিছিয়ে নেই। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরেও সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতায় তালেবান নামের দলটি গড়ে তোলে। মিশরেও তারা সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণকে ওয়াহাবি মতবাদে আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্টীর ওপর ভর করে তারা তৎপরতা চালাচ্ছে।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলমানরা ওয়াহাবিদের নীতি আদর্শে প্রভাবিত। ককেশাস এবং মধ্য-এশিয়ার নেতৃবৃন্দ তাদের এলাকায় ওয়াহাবিদের অবস্থান শক্তিশালী করার প্রচেষ্টার ব্যাপারে বহুবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতির কারণেই এই অঞ্চলের দেশগুলোতে বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ওয়াহাবি মতবাদ বিকাশ লাভ করতে পেরেছে। ভারতও একই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। সেখানে বহু ধর্ম ও মাযহাব রয়েছে। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী দেশ ভারত থেকে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পর সে দেশটিও ওয়াহাবি মতবাদ প্রচার থেকে মুক্ত ছিল না। কারণ, ভারতের মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক থাকায় ওয়াহাবিরা তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি ওয়াহাবি মতবাদও প্রচার করে।

ওয়াহাবি ফেরকা গড়ে ওঠার শুরুর দিকে তাদের মূর্খতা আর গোড়ামির কারণে নতুন নতুন সকল আবিষ্কারকে বেদআত ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। রাসূলের(সাঃ) যুগের পদ্ধতিতে জীবনযাপন করতে হবে এই অজুহাত দেখিয়ে তারা মানব সভ্যতার নতুন নতুন সকল উদ্ভাবনীর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল। সালাফিরা অবশ্য এখন তাদের ফতোয়া বা কর্মপদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনের মানে হলো তারা ইবনে তাইমিয়া এবং মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহাবের বহু আকিদা বিশ্বাস থেকে সরে এসেছে। ওয়াহাবি আলেমরা দেখলেন যে, মানব সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় এইসব প্রযুক্তির বিরুদ্ধে মূর্খের মতো ফতোয়া জারি করলে বর্তমান বিশ্বে তাঁদের অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাবে, যার ফলে ইতিহাসের আস্তা-কুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন শীঘ্রই। এ কারণেই তুলনামূলকভাবে কম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ওয়াহাবি মুফতিরা তাঁদের ফতোয়ায় পরিবর্তন এনেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মোবাইল, সাইকেল, গাড়ি, টেলিভিশন, ক্যামেরা ইত্যাদির ব্যবহারকে এক সময় ওয়াহাবি আলেমরা হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন, কিন্তু এখন এগুলোর ব্যবহার হালাল বলে গণ্য করা হচ্ছে। আগের মতো এখন আর এসব প্রযুক্তির ব্যবহারকে র্শিক বলে মনে করা হচ্ছে না। এ থেকেই তাদের আকিদা অর্থাৎ ওয়াহাবি মতবাদ এবং তার বাস্তব প্রয়োগের মাঝে ব্যাপক বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। আর এই বৈপরীত্য থেকেই বোঝা যায়, ওয়াহাবি মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ এবং এই মতবাদ এখন পতনোন্মুখ।

ওয়াহাবিরা কথায় কথায় সবকিছুকে বেদআত বলে প্রচার চালায়। তাদের কিছু প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাসের উদাহরণ দেয়া হলো যা সুন্নি সমাজে বেশ প্রভাব ফেলেছে। যেমন, প্রচলিত নিয়মে সুর করে মিলাদ পড়া, মিলাদে দাঁড়ানো বেদআত। শবে বরাত, শবে মেরাজ, বিশ্বনবী (সা.)-এর জন্মদিন বা ঈদে মিলাদুন্নবী পালন বেদআত, পীর-মুরিদ ও বাইয়াত পদ্ধতি বেদআত। চল্লিশা, মৃত্যু দিবস, কুলখানি, মৃতের জন্য কুরআন খতম, দোয়া ইউনুস খতম, মানুষ মারা গেলে কান্নাকাটি করা বেদআত ইত্যাদি। সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি বিন বাজ ফতোয়া দিয়েছেন, রাসূলের মাযারে কান্নাকাটি করা যাবে না, মেয়েদের কন্ঠস্বর বাইরের কোনো পুরুষ যেন শুনতে না পায়, যদি অফিসে নারী-পুরুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হয় তাহলে তাদেরকে অবশ্যই একই নারীর দুধ খাওয়া দুধ ভাই-বোন হতে হবে অন্যথায় এক অফিস বা প্রতিষ্টানে কাজ করা হারাম, হযরত আলী(আঃ) ও ইমাম হোসাইনের(আঃ) মাযারসহ বিশ্বের সব ওলির মাযার ভেঙে ফেলা উচিত, এমনকি রাসূলের মাযারও রাখা ঠিক নয়, আহলে কিতাবের অনুসারী হওয়ার কারণেই ইহুদি-খ্রিস্টানরা ভালো এবং শিয়ারা খারাপ, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে বলে বিশ্বাস করলে সে কাফের হয়ে যাবে। এ ছাড়া, ছবি তোলা, টিভি দেখা হারাম, মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়া পাপ ইত্যাদি।

মুফতি নাসের আল ওমর তাঁর ফতোয়ায় বলেছেন : ...১০ই মুহররম বা আশুরার দিন উৎসব পালন করা এবং শিয়াদেরকে এ উৎসবে যোগ দিতে বাধ্য করা উচিত।’

এই মুফতি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকার বিরোধী বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী বিদ্রোহীদের মনোরঞ্জনের জন্য ও তাদের জিহাদি চেতনা ধরে রাখার জন্য মুসলিম নারীদের ‘যৌন জিহাদ’-এ অংশ নেয়ার জন্য সিরিয়ায় যাওয়ার ফতোয়া জারি করেছেন।

ডক্টর এসাম আল এমাদ ইয়েমেনের একজন নামকরা ওয়াহাবি মুফতি ছিলেন। তিনি অনেক অধ্যয়নের পর বুঝতে পারলেন যে, ওয়াহাবি মতবাদ একটি ভ্রান্ত মতবাদ। সে কারণে ঐ মতবাদ ছেড়ে দিয়ে তিনি আহলে বাইতের ভক্ত হয়ে যান। তিনি বলেন : ‘আমি সৌদি আরবের সাবেক মুফতি বিন বাযের কাছে লেখাপড়া করতাম। তবে সবসময় ভাবতাম যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরও এখনো কেনো মানুষের মনে ইমাম আলী (আ.) কিংবা ইমাম হোসাইন (আ.) এবং অন্যান্য মহান ইমামের চিন্তাদর্শ জাগ্রত রয়েছে, কেনো এগুলো পুরনো হয়ে যাচ্ছে না। অন্যদিকে সৌদি আরবের শিক্ষামূলক সভা বা অধিবেশনগুলোতে ইমাম আলী (আ.) এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ব্যাপক সমালোচনা হতো। আবার আশ্চর্যভাবে লক্ষ্য করতাম ইয়াযীদ ও তার পিতা মুয়াবিয়ার অত্যাচারগুলোর পক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়া হতো। একবার এক সভায় দেখলাম অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে আলী (আ.)-এর সমালোচনা করা হচ্ছে আর তাঁর ব্যাপারে নোংরা শব্দ ও কথা ব্যবহার করা হচ্ছে। বিষয়টা আমাকে একটু ভাবিয়ে তুললো। বাধ্য হয়ে আহলে বাইতের সদস্যদের নিয়ে পড়ালেখা শুরু করে দিলাম। পড়ালেখার একটা পর্যায়ে বুঝতে পারলাম ইমাম আলী (আ.)-এর সকল কথাই ছিল যৌক্তিক এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ। তখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, ওয়াহাবিদের সকল ব্যাখ্যা বা বক্তব্যই যুক্তিবহির্ভূত এবং অশালীন।’

মুফতি এসাম আলি ইয়াহিয়া আল-এমাদ বলেন : ‘ওয়াহাবিদের সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যাটি হলো সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড।’ তাঁর মতে, অধিকাংশ ওয়াহাবিই মূর্খতার কারণে বিপথগামী। তারা কোরআনের বক্তব্যকে ভুলভাবে গ্রহণ করেছে। এটাই তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো মার্কসইজম, বাহায়ি, ইসরাইলি ও মার্কিনীদের মতাদর্শের বিরুদ্ধে ওয়াহাবি মুফতি বা আলেমদের লেখা কোনো বই নেই, তাঁদের যতো লেখা সব মুসলমানদের বিরুদ্ধে। ওয়াহাবিদের ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসের চাইতে আরো বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, এদের যাবতীয় কার্যক্রম লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইসরাইল ও মার্কিন নেতৃত্বে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পক্ষে তারা কাজ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলবিরোধী ইরান, সিরিয়া, হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো প্রতিরোধ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ওয়াহাবিরা। বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইল ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোই ইসলামের নামে আল-কায়দা, তালেবান নামে বিভিন্ন উগ্র গোষ্টীর জন্ম দিয়েছে যাদের লক্ষ্য ইসলামের নামে ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া, ইউরোপ ও আমেরিকায় মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ইসলাম ও মুসলমানদের প্রভাব বিস্তারে পাশ্চাত্যের সরকারগুলো চিন্তিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তারা আল-কায়দা ও তালেবানের মতো উগ্র গোষ্টীগুলোর হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে ইসলামপন্থীদের কাজ বলে প্রচার চালাচ্ছে যার উদ্দেশ্য ইসলামের সৌন্দর্য ও শান্তিকামী চেহারাকে ধ্বংস করা এবং মানুষকে প্রকৃত ইসলাম বুঝতে না দেয়া।

পাশ্চাত্যে ইসলাম ও মুসলমানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকানোই এর উদ্দেশ্য। এ ছাড়া, ইরান ও হিজবুল্লাহর মতো শিয়া গোষ্টী ইসরাইল ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কারণেও ওয়াহাবিরা শিয়াদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

যাহোক, আমি ইসলামের অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়কে সহজ ও সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা সবাই মুসলমান এবং আমাদের শত্রু অভিন্ন। সেই শত্রুকে চিহ্নিত করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের জন্য বর্তমানে যা করা প্রয়োজন তেমনি দুটি বিষয় নিয়ে নিচে আলোচনা করছি।

ক. ইসলামী বিপ্লব ও ধর্মভিত্তিক জনগণের শাসন ব্যবস্থা

মুমিন মুসলমানদের মূল লক্ষ্য হলো সকল মতবাদের বিপরীতে ইসলামকে প্রতিষ্টিত করা অর্থাৎ ইসলামী বিপ্লব সাধন ও ইসলামী সমাজ নির্মাণ। ইসলামী বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম এমন এক বাস্তবতা যেখানে বাতিলের সাথে, অলসতার সাথে কিংবা দুনিয়াপূজার সাথে কোনো প্রকার আপোস চলে না। ইসলামী বিপ্লব হচ্ছে মানুষের প্রতিষ্টিত সব মতবাদ বা সরকার ব্যবস্থাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে আল্লাহর মনোনীত শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। এ বিপ্লব মানেই আমূল পরিবর্তন। এ পরিবর্তন হতে হবে চিন্তা জগতে, দেশ পরিচালনায়, রাজনৈতিক ব্যবস্থায়, বিচার ব্যবস্থায়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, প্রচার মাধ্যমে, প্রতিরক্ষা শক্তিতে, শিক্ষা ব্যবস্থায়...।

এ ছাড়া, আলেম সমাজ ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিতদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্টার পরিবেশ সৃষ্টি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার বিপ্লবকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার অন্যতম শর্ত। বিশেষ করে আদর্শিক ক্ষেত্রে জনগণের মাঝে বিরাট কোনো ব্যবধান থাকা উচিত নয়। এ এমন এক ইসলামী বিপ্লবী সমাজব্যবস্থা যেখানে শয়তানি শক্তির অনুপ্রবেশের কোনো সুযোগই থাকবে না। আর তাহলেই কেবল ইসলামী বিপ্লব চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছতে পারবে এবং এ ধরনের ইসলামী বিপ্লবী সরকারের পক্ষেই কেবল গণমানুষের কল্যাণে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব। বর্তমান বিশ্বে এ বিপ্লবের একটি মাত্র উদাহরণ হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান, যে দেশটি শত বাধাবিপত্তি ও ষড়যন্ত্র ডিঙ্গিয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে।

ইরানে ধর্মভিত্তিক জনগণের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্টিত। বিপ্লবী আদর্শের প্রতি সম্মান রেখে রাজনীতি করা ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার ইরানে আছে। প্রচলিত গণতান্ত্রিক বিশ্বে যে কেউ প্রেসিডেন্ট বা দেশের শীর্ষ কোনো পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। কিন্তু ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে তার কিছু যোগ্যতা থাকতে হয়। প্রথমেই তাকে মুসলমান হতে হবে, ইসলামী বিপ্লব ও সরকারে তার অবদান থাকতে হবে, দেশ ও জাতির খেদমতে অতীত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো মামলা থাকতে পারবে না এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার প্রতি অনুগত থাকতে হবে। তবেই একজন ব্যক্তি ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। ফলে যিনিই নির্বাচিত হন না কোনো জনগণের হতাশ হওয়ার কিছুই নেই। অন্যান্য মুসলিম দেশে প্রচলিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে সরে এসে ইরানে যে ধর্মভিত্তিক জনগণের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্টিত হয়েছে তার সুফল অশেষ। এর অন্যতম হচ্ছে ভিন্নমত বা ভিন্ন আদর্শের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্টার নামে অনৈসলামিক কোনো দল বা সংগঠন গড়ে ওঠার সুযোগ নেই। যদি এ ধরনের কোনো গ্রুপ গড়ে উঠত বা সুযোগ দেয়া হতো তাহলে ইসলামের শত্রুরা ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এসব জনসমর্থনহীন অতি ক্ষুদ্র গ্রুপকে হাতিয়ার করে এবং তাদেরকে প্রচুর অর্থ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিপ্লব, ইসলামী সরকার ও জনকল্যাণমূলক সমাজব্যবস্থা ধ্বংসের চেষ্টা চালাতো, জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতো, সরকারের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টি করত। এভাবে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রেই অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাতো। অনৈসলামিক এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বা সংগঠনের ওপর ভর করেই শত্রুরা সমস্ত ষড়যন্ত্র বা নীলনক্সা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাতো।

কিন্তু সেই সুযোগ ইরানে নেই এবং বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্টার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি দিক দিয়ে ইরানকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটাই হচ্ছে ইসলামী বিপ্লব ও ধর্মভিত্তিক জনগণের শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বা সাফল্য। বিপ্লব সফল করতে হলে জনগণের মধ্যে আদর্শিক ঐক্য সৃষ্টি করা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক, আর এ ক্ষেত্রে শিয়া মাযহাবগত কিছু বৈশিষ্ট্য শিয়া ধর্মীয় নেতাদের কাজকে আরো সহজ করে দিয়েছে, যে সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে।

খ. প্রচলিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইসলামী আন্দোলন

সুন্নিপ্রধান মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর চলমান ইসলামী আন্দোলন বা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে কখনো কখনো ক্ষমতায় আসা ইসলামপন্থী সরকারের চিত্র সম্পুর্ণ ভিন্ন। যুগের পর যুগ ধরে সুন্নিপ্রধান মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামী আন্দোলন চলে আসছে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনকারীরা অসংখ্য দল, মত ও সংগঠনে বিভক্ত। আলেমদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। তাঁরা ইসলামের বিপ্লবী চেতনা থেকে সরে এসে প্রচলিত বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামী সমাজ কায়েম করার কথা বলেন।

ইসলামের উন্নত শিক্ষার প্রভাবে সুন্নি সমাজের দীর্ঘ শত শত বছরের ইতিহাসে ইসলামের বিকাশ, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভৌগোলিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক বড় বড় সফলতার নজির রয়েছে। কিন্তু এসব সাফল্য তাঁরা †বশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। এসব সফলতা একটি পর্যায়ে গিয়ে থেমে গেছে এবং পরবর্তী প্রজন্ম এর সুফল ভোগ করতে পারেনি। সুন্নিপ্রধান মুসলিম দেশগুলোতে রয়েছে দুটি প্রধান সমস্যা। প্রথম সমস্যা হচ্ছে, ধর্মীয় দলগুলো ও নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, একক নেতৃত্বের অভাব ও জনবিচ্ছিন্নতা। আর দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে ইসলাম কায়েমের নীতি।

বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, কমিউনিস্টসহ বিভিন্ন মতাদর্শের নামে অসংখ্য রাজনৈতিক দলের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। দুর্নীতি, লুটপাট, বৈষয়িক স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অনৈসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঝগড়া-ঝাটি কিংবা সহিংসতায় দেশ ও জাতির ব্যাপক ক্ষতি হলেও ইসলামপন্থীদের তৎপরতা রোধে তারা আবার সবাই ঐক্যবদ্ধ। এ অবস্থায় ইসলামপন্থীরা যদি কখনো কোনো দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে রাস্তায় নামে তাহলে সন্ত্রাসী ও সহিংসকামী হিসেবে তুলে ধরে তাদের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে কোনো ইসলামপন্থী দলের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু যদি ক্ষমতায় যেতেও পারে তাহলে কি অন্য অনৈসলামিক বা ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো বসে থাকবে? তারা ভেতরের শক্তি ও বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সহায়তায় যেভাবেই হোক ইসলামী সরকারকে ক্ষতি করার বা তাদের বদনাম করার কিংবা অকার্যকর সরকার হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করবেই।

এ অবস্থায় ইসলাম কায়েমের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হলেও ঐ ইসলামী দলটি বেশি দিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না এবং জোর করে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর প্রবণতা দেখা যায়। এ ধরনের দুর্বল ইসলামী সরকার একদিকে যেমন দেশের ভেতরে ইসলামী সমাজ ও ধর্মীয় আইন প্রতিষ্টায় পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নির্যাতিত জাতিগুলো বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থে কিংবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অন্যায় ও অপকর্মের বিরুদ্ধে তারা শক্তিশালী কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। কারণ, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গেলেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মুসলিম দেশগুলোতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তায় ইসলামপন্থী সরকারকে নানাভাবে হয়রানি করবে, নিষেধাজ্ঞা দেবে, সাহায্য বন্ধ করে দেবে, অভ্যুত্থান ঘটাবে এবং পরিশেষে পতন ঘটাবে।

কেউ নিজেদেরকে ইসলামপন্থী দাবি করলে তাদেরকে অবশ্যই সমস্ত অন্যায়ের মোকাবেলা করতে হবে। কারণ, এটাই ইসলামের শিক্ষা। এ অবস্থায় দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে যে চাপ আসবে তা মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব এবং ইসলামপন্থী সরকার কিছুতেই ইসলাম প্রতিষ্টার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এ অবস্থায় ইসলামপন্থী দলগুলো শুধু অন্য দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে যা খুবই অবমাননাকর ও লজ্জাজনক। কারণ, এর ফলে ইসলামপন্থীদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বলতে কিছু থাকে না। এ পরিস্থিতি তাদের দীনতারই প্রমাণ।

এছাড়া, ধর্ম না থাকার কারণে অনৈসলামিক বা ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-নৈতিকতাবোধ থাকে না, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টিও থাকে না এবং এরা হয় চরম দুর্নীতিপরায়ণ ও স্বৈরাচার।

নির্বাচনে জিতে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা কেউই আগের সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় না। কারণ, তারা জানে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে নিজেরা যেদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকবে সেদিন তাদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ অবস্থায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাউকেই অবস্থান নিতে দেখা যায় না এবং ক্ষমতা দখল নিয়ে তারা হানাহানিতে ব্যস্ত থাকে। এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিবিদরা অবৈধ অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুললেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন হয় না। এরা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে অথচ ধর্মের ধারে কাছেও তারা নেই এবং যতটুকু ধর্মের কথা বলে বা নামায, রোযা, হজ করে তা সম্পুর্ণ লোকদেখানো মাত্র। আর এরাই হচ্ছে আসল ধর্ম ব্যবসায়ী। এরা নিজ স্বার্থে দেশ ও জনস্বার্থবিরোধী কাজ করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করে না। প্রচলিত রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো নেতা সৎ চরিত্রের হলেও অসৎ চরিত্রের রাজনীতিবিদদের স্রোতের তোড়ে তারা ভেসে যান। ইসলামপন্থীরা আল্লাহ্্কে ভয় করার কারণে তাদের মধ্যে অনেক সততা কাজ করে। এ অবস্থায় কোনো ইসলামী দল ক্ষমতায় থাকলে স্বাভাবিকভাবেই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সুযোগ সীমিত হয়ে আসে এবং যেভাবেই হোক নিজেদের স্বার্থে ইসলামী সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করে। এর বড় উদাহরণ হচ্ছে, মিশর পরিস্থিতি।

এত দীর্ঘ বছর ধরে সংগ্রাম ও ত্যাগতিতিক্ষার পর মিশরে ইসলামপন্থীরা সরকার প্রতিষ্টা করলেও তারা প্রচলিত বহু আদর্শিক বা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরেযেতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পতন ঘটেছে। মিশরে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় গেলেও স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো অবস্থায় তারা ছিল না। প্রচলিত বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্টা করা যে সম্ভব নয় তার প্রমাণ মিশর। ইসলামপন্থীরা মিশরে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেলেও সেক্যুলারপন্থী ও পাশ্চাত্যঘেঁষা বিরোধী রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশীরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পেয়েছে। বিদেশীরা মিশরের অনৈসলামিক দলগুলোর সহায়তায় এমনভাবে ইখওয়ানের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে যে, শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় সবেশিদিন থাকতে পারেনি। তাদের এ ব্যর্থতার ্পেছনে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কারণ রয়েছে।




মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.