![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঘুরতে ভালবাসি। সময়-সুযোগ-টাকা তিনটা খাপে খাপ মিলে গেলে আমাকে পাওয়া যায় না কখনোই। কম খরচে ট্রাভেলিং একটা আর্ট মনে করি। যা জানি তা জানানোর চেষ্ঠা করি আর যারা জানে তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্ঠা করি।
রাত 3.00 টার কিছু পরে সামিটের জন্য বের হয়ে সকাল 6.40-45 নাগাদ সামিটে পৌছে গিয়েছিলাম।
মাথায় একটা টেনশন কাজ করছিল যে, যে করেই হোক আজকের মধ্যে সবগুলো ক্যাম্প ক্রস করে বেস ক্যাম্প (WAN) এ পৌছাতে হবে। এছাড়া আগেই কয়েকটা ভুল সিদ্ধান্ত আর উল্টাপাল্টা খরচের জন্য আমার টাকা বাজেট থেকে অনেকটাই কমে গিয়েছিল। লাস্ট দিন তাহমিদ আর ইমরানের সাথে পরামর্শ করে তাহমিদের কাছ থেকে 2000 রুপি ধার করতে হয়েছিল। তারপর ভোর 5.30 এর ওয়ান থেকে রিশিকেষের একমাত্র বাস ধরত হবে নয়তো আমার কাছে যে পরিমান টাকা (রুপি) আছে তা দিয়ে হয়তো খুব ভালোমতো অনেকটা রাজার হালে দিল্লি পৌছানো গেলেও সময় আর টাকা বেশি খরচ হবে কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। রন্টিস্যাডল এর জন্য ইন্ডিয়া আসলেও হঠাৎ একটা জরুরী কাজে 20 তারিখে মধ্যেই ঢাকা থাকতে হতো আমাকে। এখন যদি কোনভাবেই ভোরের ওয়ান-রিশিকেষ বাসটা মিস হয় তাহলে সময়মতো দেশে পৌছানো যাবে না। তাই সামিট শেষে খুব দ্রুত ভাগুয়াবাছার জন্য রওনা হয়ে যাই যদিও চোখের সামনে এমন স্বপ্নের মতো সাড়ি সাড়ি পাহাড় চূড়া দেখে মনে হচ্ছিল আরেকটু সময় বেশি থেকে যাই এখানে।
ভাগুয়াবাছা যখন পৌছালাম তখন ঘড়িতে 9.00 টার একটু বেশি। ম্যাগি নুডুলস আর চা-সিগারেট খেয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে একাই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম পাথরনাচুনীর দিকে। আমরা রুপকুন্ডে এই মৌসুমের শেষ কয়েকটা টিমের মধ্যে একটা ছিলাম। তখন হাটতাম আর চিন্তা করতাম তাহমিদ আর ইমরান বোধয় এখন রুপকুন্ড পার হয়ে গেছে। তাহমিদ আর ইমরান বোধয় এখন ওখানে আছে। ওরা বোধয় এখন এটা করছে ওটা করছে। কুলু বিনায়কে খানিকক্ষণ রেস্ট নিয়ে আবার পথ চলতেই কেমন যেন একা একা লাগছিল। এখান থেকে বেসক্যাম্প একদম ডাউনহিল। মাঝখানে দু-তিনটা জায়গায় সামান্য 100-200 মিটার আপহিল থাকলেও রাস্তা প্রায় 18 কিলোমিটারের মতো। আমি হিসাব করতাম হেলে দুলে রেস্ট নিয়ে ঘন্টায় 3 কিলোমিটার আগাবো। পাথরনাচুনীতে যখন আমি তখনই মাত্রই একটা বাঙ্গালী টিম এসে পৌছালো। তারা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলছিল দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তারা কোলকাতা বা তার আশেপাশের। একটু সময় বাদে তাদের সাথে আলাপ হলো- সবাই এডভোকেট আর ছোটবেলার বন্ধু। বছরে একবার পূজোর ছুটিতে গেট টু গেদার করতে ঘুরতে বের হন। বাংলাদেশ নিয়ে অনেকক্ষণ গল্প হলো। ততক্ষণে অনিন্দ্য দা চলে এসেছিল তারকিছু সময় পর অনুপম দা আর তার ওয়াইফ। একসাথে অনেকক্ষণ গল্প করে চা নাস্তা সেড়ে আমি আর অনিন্দ্য বেদেনি বুগিয়ালের দিকে রওনা হয়ে গেলাম। পাথরনাচুনী থেকে বেদেনী বুগিয়াল প্রায় 4 কিলোমিটারের মতো আর সম্পূর্ণ পাথুরে রাস্তা। দেশ বিদেশ, সাইক্লিং ট্রেকিং আর রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করতে করতে কিছু সময়ের মধ্যে (1.40 ঘন্টা) পৌছে গিয়েছিলাম বেদেনী বুগিয়াল।
বেদেনী বুগিয়ালে প্রায় 3.00 টার দিকে চলে এসেছিলাম আমরা। এর মধ্যেই সবাই জেনে গিয়েছিল যে আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি আর আমি আজকেই ওয়ান চলে যাবো। সাধারণত, কেউ সামিট শেষে একদিনেই ওয়ান চলে যায় না। পাথর নাচুনী নয়তো বেদেনী বুগিয়ালে থেকে যায়। বেদেনী বুগিয়াল থেকে ওয়ান প্রায় 12 কিলোমিটারের ট্রেক। একটু পরের ডাউন হিল শুরু নীলগঙ্গা পর্যন্ত। নীল গঙ্গা থেকে সামনে প্রায় 400-500 মিটার আপহিল তারপর আবার ডাউন হিল নেমে গেলেই ওয়ান।
ম্যাগি আর চা দিয়ে দুপুরের খাবার শেষ করে বেদেনী বুগিয়ালের এদিক সেদিক ঘুরে দেখছিলাম আমি আর অনিন্দ্য দা আজকে রাতে এখানে থেকে যাবেন তাই টেন্ট পিচ করার জন্য ভাল একটা ক্যাম্প সাইট খুজছিলেন। আমাকে সবাই বলছিল তোমারতো অনেকটা পথ যেতে হবে তার উপর তুমি আবার একা। দেরী করা ঠিক হবে না পথে অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। সেদিন পূর্ণিমা ছিল। এমনিতেই চাঁদ আমার অনেক প্রিয় একটা বিষয় তার উপর পূর্ণিমা আর আকাশের কোটি কোটি তারা তো আছেই। আমি ধরনা করেছিলাম, পূর্নিমায় রাস্তা পুরা চকচক করবে তাছাড়া 12 কিলোমিটার পর হতে আমার খুব বেশি সময় লাগবে না যেহেতু 90% রাস্তাই ডাউন হিল আর পুরো রাস্তাটাই পাথর দিয়ে বানানো।
অনিন্দ্য দা’র টেন্ট পিচ করা শেষ হলে আমরা জমপেশ একটা আড্ডা দিয়ে ঘড়িতে যখন ঠিক 4.45 তখন আমি ওয়ানের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এখন থেকে প্রায় 3 কিলোমিটার নিচে নামলেই ঘোড়ালীপাতাল। যেটা কিনা ইন্ডিয়া হাইকস রুপকুন্ডে তাদের ক্যাম্প-1 হিসেবে ব্যবহার করে। একটা দোকান আছে যেখানে আমরা যাওয়ার দিন দুপুরের ভাত, ডাল, সবজি আর চাটনী খেয়েছিলাম। আমি নিচের দিকে হাটছি আর মোবাইলে ছবি তুলছি আর দূরের নন্দাঘুন্টি আমাকে ডাকছিল। এ ডাক কানে শোনা না গেলেও উপেক্ষা করা কঠিন। ঘন বনের মধ্য দিয়ে পাথর বাধানো আকা বাকা রাস্তায় আলো-আধারি খেলা দেখতে দেখতে প্রায় সাড়ে পাঁচটার দিকে ঘোড়ালীপাতাল এসে পৌছবো তার কয়েকশ ফিট উপরে একজন পোর্টারের সাথে আমার দেখা। সে জানতে চাইলো আমি কই যাবো। আমিও ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে উত্তর দিলাম ওয়ান যাবো। সে জিজ্ঞেস করলো আমার গাইড, পোর্টার বা পার্টনার কোথায়। আমি বললাম তারা রন্টি চলে গেছে আর এখন আমি একা নেমে যাবো। শুনে সে প্রায় আকাশ থেকে পড়লো। বিশ্ময়ের সুরে বললো ওয়ান যেতে হবে তুমি নিচে থেকে যাও। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আবার বললো এখানে প্রচুর কালো ভাল্লুক আছে। তার কথায় আমি পাত্তা না দিয়ে আবার হেলতে দুলতে নিচে নামতে থাকি। ঘোড়ালীপাতাল পৌছেই সেই দোকানদারের সাথে দেখা। সে আমাকে চিনতে পেরেছিল যে আমি কুশাল সিং এর সাথে গিয়েছিলাম। সে কুশাল সিং এর কথা জানতে চাইতেই বললাম ও আমার বাকি পার্টনারদের নিয়ে রন্টির জন্য চলে গেছে আর আমি ওয়ান চলে যাচ্ছি। শুনে সেও পুরো আকাশ থেকে পড়লো। এবার একটু কেমন কেমন যেন লাগলো আমার। আমাকে সে বারবার অনুরোধ করছিল যেন আমি তার এখানে থেকে যাই আর আমার মনে হচ্ছিল এগুলো টাকা নেয়ার ফন্দি। আমি একদমই নাছোড় বান্দা। কোন ভাবেই আমি সেখানে থাকবো না তারউপর আবার আমার কালকে ভোরে রিশিকেষের বাস ধরতে হবে। যখন দেখলো কোন ভাবেই সে আমাকে রাজি করাতে পারছে না আর আমিও বাস মিস করতে পারবো না তখন সে শুধু বলেছিল “তাহলে যাও। এখনো ঘন্টা খানে আলো থাকবে। যতদ্রুত পারো নিচে নেমে যাও। বনে ভাল্লুক আছে সেখলে সিধা এ্যাটাক করবে।” শুনে আমার তো ধড় থেকে প্রাণ উড়ে যাওয়ার যোগান। কেন জানি না এবার উপরের সেই পোর্টারের কথা বিশ্বাস হলো। তাছাড়া আমরা যখন রিশিকেষ থেকে ওয়ানের ডিরেক্ট বাস মিস করে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওয়ান পৌছাতে নিয়েছিলাম তখন একজায়গায় আমরা গাড়ী না পেয়ে বেশ কিছু রাস্তা হেটে পার হতে নিয়েছিলাম দেখে এক লোক বলেছিল- বনের পাশ দিয়ে পায়দাল হাটা ঠিক না। বন্য জন্তুরা মাঝেমধ্যেই হামলা করে। সব মিলিয়ে আমি অনেক ভয় পেয়ে গেলাম। ব্যাগপত্র নিয়ে মোবাইল পকেটে ভরে টর্চ লাইট হাতে নিয়ে রীতিমতো দৌড়ে নিচের দিকে নামতে লাগলাম। বেশ খানিকটা হাটার পর পুরো বন অন্ধকারে ঢেকে গেল। যতক্ষণ দিনের আলো ছিল বেশকিছু রাস্তা শর্টকাট করে নিয়েছিলাম। অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথেই বনের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর আওয়াজ, পাখির ডাক কানে ভেসে আসতে লাগলো। পাখির ডাক ছাড়া যেই শব্দই আমার কানে আসুক না কেন আমার শুধু মনে হচ্ছিল ভাল্লুক ডাকছে। এই বুঝি এখন ভাল্লুকের সাথে দেখা হবে আমার। ভাল্লুক যদি সামনে পরে যায় তো কি করবো আমি। হাতের ট্রেকিং পোলটা যদি ভাল্লুকের চোখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারি তাহলে ভাল্লুক কি আমাকে খেয়ে ফেলতে পারবে নাকি পালিয়ে যাবে। নাকি ছোটবেলা পড়া সেই গল্পটার মতো ভাল্লুক সামনে এলে মরার মতো নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে থাকবো। এমন হাজার হাজার আজগুবি চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আর আমি নিচে দৌড়াচ্ছিলাম। রাস্তা শেষ হচ্ছেই না মনে হয়। এর মধ্যেই রাস্তা চিনতে আমার একটু অসুবিধা হচ্ছিল। তারউপর বিভিন্ন জায়গায় আমার লাইটের আলো ভাঙ্গা গাছের গুরির উপর পড়লে সামনের দিকে একটা কালো ছাড়া পড়ছিল আর আমার মনে হচ্ছিল এই বুঝি কালো একটা ভাল্লুক বসে আছে। একটু সময় নামতেই আমি নীলগঙ্গার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। নীলগঙ্গার উপরে একটা ছোট চায়ের দোকান আছে ট্রেকারদের জন্য। মনে মনে চিন্তা করছিলাম সেই দোকানে কেউ থাকলে তাকে নিয়ে ওয়ান যাবো। তাতে যদি হাজার টাকা দিতে হয় তাতেও আমার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু নীলগঙ্গা আর সেই দোকানের কোন খবর ছিল না। মনে হচ্ছিল আমি অনন্তকাল ধরে শুধু নিচেই নামছি। রাস্তা ট্রেকারদের মালপত্র বহন করার গাধার মল ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এগুলাই আমার রাস্তা চেনার জন্য সাইন হিসেবে কাজ করতে লাগলো। রাস্তায় একটু পর পর মিউলের গোবর দেখলেই আমি বুঝতেছিলাম আমি ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি। একটু পরেই সেই দোকানটা দেখা গেল। দোকান পুরা অন্ধকার ছিল আর আমারও ভয় বাড়তে লাগলো। শেষ আশা টাও হয়তো শেষ। কিছুসময় দোকানের বেঞ্চিতে বসে আবার পুরো দমে নিচের দিকে দৌড়ানো শুরু করলাম। নীলগঙ্গার শব্দ এত তীব্রভাবে শোনার পরও নীলগঙ্গা বহুদূর। একসময় নীলগঙ্গার সামনে এসে দুটো রাস্তা চলে গেছে দুদিকে। আমি দুইদিকেই কান পেতে শুনতে চেষ্ঠা করলাম কোন দিকে পানির শব্দ বেশি। বা দিকে থেকে তুলনামূলকভাবে ডানে পানির শব্দ বেশি পাচ্ছিলাম তাই আমি ডান দিকে হাটা শুরু করি। বেশিকিছু সময় মিউলের গোবর না দেখে আবার রাস্তাও কেমন অপরিচিত লাগার পর বুঝলাম আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি। এবার বাচার আশাটাই মনে হচ্ছিল একবারে শেষ। ঘুরে আবার দৌড় তো দৌড়। টর্চ হাতে থাকলেও একটু জ্বালিয়ে রাস্তা দেখে দৌড়ে পাড় হচ্ছিলাম আবার লাইট জ্বালাচ্ছিলাম এই ভয়ে যদি লাইট অন করে হাটলে যদি ভাল্লুকের নজরে পড়ে যাই।
নীলগঙ্গার সামনে এসে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে চিন্তা করছিলাম যে, পাড় হবো কিনা। বনে কোথাও পানির সোর্স নেই। এটাই একমাত্র পানির উৎস। যদি এখানে কোন ভাল্লুক আছে পানি খাওয়ার জন্য তো স্বেচ্ছায় তার মুখে সামনে চলে যাওয়া মানে এই ব্রীজ পার হওয়া। চিন্তা করতে করতেই যত দোয়া দুরুদ জানা ছিল সব পড়ে একদৌড়ে পার হয়ে গেলাম নীলগঙ্গা। তারপরই শুরু নতুন বিপত্তি। এবার আপহিল। গতবার নামার সময় আশে পাশে তেমন কিছু খেয়াল করিনি বিধায় এবার রাস্তা চিনতে অসুবিধা হচ্ছে। তারউপর একটু আগেই একবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডাউন হিল দৌড়ে নামা গেলে আপহিলে একটু উঠতেই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। একটু একটু উঠছিলাম আর একটু জিড়িয়ে নিচ্ছিলাম। যখন দাড়াচ্ছিলাম তখনই বনের ভাল্লুকের চেয়ে বেশি আমাকে মনের ভাল্লুক চেপে ধরছিল।
অনেকক্ষণ উপরে উঠছি কিন্ত মিউলের গোবর দেখছিলাম না কোথাও। তাছাড়া এখানে পাথড় বাধানো রাস্তাও নেই। রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি নিশ্চিত। একবার চিন্তা করলাম স্লিপিং ব্যাগটা বের করে এখানেই কোন এককোনে ঘুমিয়ে পড়ি। যা হয় সকালে দেখা যাবে। লাগবে দেশে ফেরা। আগে জীবনটা বাচুক। পরক্ষণেই আবার ভয়ের চোটে দৌড়। মনে পড়ছিল এখান দিয়ে নামার সময় আশে পাশে কোথাও একটা পানির সোর্স ছিল। সেটাও খুজে পাচ্ছিলাম না। তবে কি আমি রাস্তা হারিয়েই ফেলেছি শেষ পর্যন্ত?
[চলবে]
©somewhere in net ltd.