নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘুম

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১১:২১

কিচেনের লাইটটা বন্ধ করতে গিয়ে একটু অবাক হলেন অধ্যাপক আজমল। সিঙ্ক-এর ইঞ্চি তিনেক উপরে দেয়ালের উপর দু’টো তেলাপোকা একটা আরেকটার গায়ে সেঁটে আছে। তাদের পরস্পরের পেছন দিকটা একসঙ্গে লাগানো। এই অবস্থায় তারা স্থির হয়ে আছে। বলা যায়, ধ্যানস্থ যেনো।

তেলাপোকাদের সঙ্গম-দৃশ্য কখনো দেখেননি তিনি। এই দৃশ্য দেখামাত্রই নিজের নড়াচড়া থামিয়ে দিয়ে, এমনকি নিঃশ্বাসটাও প্রায় নিঃশ্বব্দ করে, জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছেন অধ্যাপক। তার নড়াচড়ার শব্দে বা পদক্ষেপের কম্পনে তেলাপোকা দু’টো ভড়কে গিয়ে বা বিরক্ত হয়ে এই মিলনমূহুর্ত যেনো ভেঙে না যায় তাই নিথর হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।

প্রায় মিনিট কয়েক নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি আঁচ করলেন তিনি। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে বসলেন খাবার টেবিলের একটা চেয়ারে। চেয়ারটা এমনি নিঃশ্বব্দে শূন্যে তুলে নিয়ে আবার জায়গা মতন বসালেন যেনো একটা পাতা পড়ার মতন শব্দও হলো না। চেয়ারে বসে টেবিলের উপর ডান হাতটা রেখে, ডান হাতের তালুর উপর থুৎনিটা রেখে উনি তাকালেন তার সামনে থাকা রেগুলার সাইজের চেয়ে একটু বড় আকারের তেলাপোকাদের দিকে।

রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। ঘুমোতে যাবার আগে কিচেনের বাতিটা বন্ধ করেতে এসে এই মাঝরাতে দু’টো তেলাপোকার টানে আটকে গেলেন অধ্যাপক আজমল সাহেব। তেলাপোকাদের এই সঙ্গমকে তার কাছে মনে হচ্ছে যনো মহাজাগতিক কোনো ঘটনা। এই ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ না করে তাই আর কিছুতেই ঘুমোতে যেতে তার মন চাইছে না। অথচ তার এখনই ঘুমিয়ে যাওয়া দরকার। সকালে তার ক্লাশ আছে আটটায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আজমল। চুয়াল্লিশ কি পয়তাল্লিশ হবে বয়স। এখনো বিয়ে-শাদী করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চমৎকার কোয়ার্টারে তার একার সংসার। বই আর গান ছাড়া আর কিছু তার জীবনে জরুরি নয়। তার ঘর-বাড়ি একেবারে ঝকঝকে তকতকে করে গুছিয়ে রাখা। নিজের ঘর তিনি নিজেই গোছান। বেডরুম ও ড্রয়িংরুমে সবসময় ফুল রাখতে পছন্দ করেন তিনি। এমনকি ফুলদানীর পানিটাও তিনি নিজের হাতেই পাল্টান।

এই এক বাতিক উনার। তার কেবলি মনে হয় নিজের কাজটা নিজে না করলে বুঝি কোথাও একটুখানি অসম্পূর্ণতা রয়ে গেলো বুঝি। পরিবার, পরিজন, বন্ধু, সহকর্মীরা বিয়ের জন্যে বহু বলে-বলে ক্ষান্ত হয়েছেন। এখন আর কেউ বলেন না তেমন একটা। সকলে বুঝে গেছেন, ড. আজমল সংসারে থাকেনও বটে, সংসারী-ও বটে। কিন্তু বিয়ে আর সংসারকে ঠিক একই লাইনে দেখেন না ইতিহাসের অধ্যাপক ড. আজমল হক কোরাইশী।

তার ঘরে তেলাপোকা দু’টোকে তিনি আগেও দেখেছেন। কিন্তু তেলাপোকাগুলোকে তার বাসার রাঁধুনি জগন্নাথ মারতে গেলে তিনি বলেছেন, তেলাপোকাগুলোকে মেরো না, জগন্নাথ। অসহায় প্রাণী মেরে কী লাভ! নিত্য দিন তো কত অনাচার-ই সয়ে যাই! এই দূর্বল প্রাণীদের সাথে আর শক্তি দেখিয়ে কী লাভ! থাকুক ওরা, বাসাতেই থাকুক।

ড. আজমলের কথা শুনে পাঁচক জগন্নাথ মনে-মনে ভেবেছে, জ্ঞানী মানুষ! কী জানি, কী ভাইবা তেলচুরাগুলারে মারতে নিষেধ করে!
জগন্নাথ ছুটিতে তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে গেছে। তাই, রান্নাঘরের বাতিটা নিজেই নিভাতে এসেছেন অধ্যাপক। কিন্তু এখন এই মাঝরাতে প্রাণী দু’টোর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে আছেন।

পাঁচ মিনিটি, দশ মিনিট, বিশ মিনিট, পয়ত্রিশ মিনিট চলে গেলো। কিন্তু তেলাপোকগুলোর রতিক্রিয়া শেষ হওয়ার কোনো নাম নেই। মাঝে মাঝে বরং তারা একটুখানি নড়ে কেবল। এই দুই ডিগ্রি থেকে পাঁচ ডিগ্রির মতন অল্প একটা নড়াচড়া। কিন্তু সেটাও খুব দ্রুত নয়। বরং ধীর লয়ে। তারপর আবার স্থির। তেলাপোকা দু’টোর একটার পুচ্ছ আরেকটার দিকে স্পর্শ করে আছে। আর তাদের মুখ ভিন্ন দিকে। মাঝে মাঝে তেলোপোকারা তাদের সামনের সুংগুলোকে কেমন আলতো করে নাড়াচ্ছে। এছাড়া এই পর্যন্ত দুইবার পুরুষ তেলাপোকাটা একটু বেশি নড়েছে। নড়েচড়ে সেটি আসলে আরো একটু জুৎ হয়ে সেঁটে গিয়েছে তার সঙ্গীনীর গায়ে।

তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তাদের গায়ের রং, গায়ের কোথায় রং একটু গাঢ় কোথায় একটু হালকা, তাদের চোখগুলো কতখানি গোল, কতখানি চ্যাপ্টা, চোখের রংটা কতখানি গহীন কালচে এইসব তিনি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পরখ করেছেন। পরখ করতে-করতে, তেলাপোকাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ড. আজমলের মনে হঠাত প্রশ্ন জেগেছে, আচ্ছা তেলাপোকাদেরও কি অর্গাজম হয়?
মিলনরত তেলাপোকাদের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে তার কেমন যেনো একটা অদ্ভুত নেশা ধরে গেছে। পাশাপাশি একটা কেমন অদ্ভুত কৌতুহল-ও চেপেছে যেনো। উনি ভাবছেন, দেখি তো কতক্ষণে তেলোপোকাগুলো শেষ করে ওদের কাজ। উনি ওদের শেষটা দেখতে খুব উদগ্রীব বোধ করছেন। কিন্তু এইদিকে ঘড়িতে রাত একটা ছাড়িয়ে গেছে। সকালে উনার ক্লাশ। ক্লাশের জন্য একটু আগেভাগেই ঘুমানো দরকার। কিন্তু এখন এই তেলোপোকাদের সমাপ্তিটা না দেখে উঠতেও মন সায় দিচ্ছে না। উনার সারা জীবনে এই প্রথম এমন একটা ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করছেন। আর সারা জীবনে কখনো করবেন কি-না জানেন না। তাই এদের শেষটা তাকে খুব আকর্ষণ করছে।

কিন্তু তাকিয়ে থেকে আরো প্রায় বিশ মিনিট যাবার পর উনি আর পারলেন না। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে। বসে থাকতে-থাকতে একবার চোখে ঝিমুনি এসে মাথা ঝুঁকে গিয়েছিল টেবিলের উপর। তাই, অনিচ্ছা নিয়েও উঠলেন। কিন্তু বাতিটা নেভালেন না। ভাবলেন, বাতিটা নেভালে হয়তো হঠাত করে পরিবেশে একটা পরিবর্তন আসায় তেলাপাকাগুলো ভয় পেয়ে যেতে পারে। আর ভয় পেলে অতৃপ্তি নিয়েই হয়তো ওরা অসম্পূর্ণ অবস্থায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তাই, বাতিটা না নিভিয়েই তিনি নিজেকে তুলার মতন নিঃশব্দে টেনে নিলেন বাথরুমে। দাঁত মাজলেন। বেডরুমের বাতি নিভিয়ে ঘড়িতে সাতটায় এলার্ম দিয়ে, পাশে নীল আলোর ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু শুতে গিয়ে মনটা উশখোশ করছে। তাই রান্নাঘরে একবার উঁকি দিলেন। ভাবলেন দেখি, ওরা এখনো আছে কিনা। দেখলেন তেলাপোকা দুইটার মুখ আগে ছিল উত্তরে-দক্ষিণে। এখন সেগুলো নড়তে-নড়তে পূবে-পশ্চিমে মুখ করেছে।

উনি এসে শুয়ে পড়লেন। কিন্তু মিনিট দুয়েক শুয়ে ভাবলেন, এটা কোনো কথা হলো! দুটো তেলাপোকার এমন মোহময় একটা ঘটনা, যা সারা জীবনে আর হয়তো দেখার সুযোগ হবে না সেটার শেষ না দেখে এমন ঘুমোতে যাওয়াটা অন্যায়।

উনি আবার উঠলেন। আবারো তুলার মতন নিজেকে নিঃশব্দে উড়িয়ে নিয়ে বসলেন চেয়ারে। টেবিলের উপর রাখলেন ডান হাত। ডান হাতের উপর রাখলেন থুৎনি। তারপর অপলক তাকিয়ে রইলেন তেলোপোকাদের দিকে। কতক্ষণ তাকিয়ে আছেন খেয়াল নেই। হঠাত মাথাটা ঝুঁকে পড়ে টেবিলে একটা ধাক্কা খাওয়ায় ঘাড়ে একটা টান খেয়ে উনি চোখ খুললেন।

চোখ খুলে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি সিঙ্ক-এর পাশে তেলাপোকাদের দিকে তাকালেন। কিন্তু দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ড. আজমলের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো! ব্যাথায় যেনো উনার কাঁদতে ইচ্ছে হলো। তেলাপোকাগুলো নেই! উনি আশপাশে ইতিউতি খুঁজলেন। নেই। সব সমাপ্ত করে ওরা ফিরে গেছে।

তারপরও খালি দেয়ালের দিকে কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটা অদ্ভুত বেদনা আর অতৃপ্তি নিয়ে বাতিটা নিভিয়ে ম্লানমুখে বেডরুমের দিকে এগুলেন অধ্যাপক।


২০.০৮.১৬


মন্তব্য ১৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:০৯

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: তেলাপোকার আভরনে নিজের শূন্যতাকেই কি দেখলেন অধ্যাপক!!!

ভাল লাগল পড়ে :)

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:২৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: হয়তো তাই, ভৃগু। নিঃসঙ্গ মানুষের মনোজগতের গল্পটা তো আলাদা বটেই।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

২| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৩০

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: এ এক পুলহ বর্ননা, অনেক সুন্দর করে কারোর দৃষ্টি ফুটায়ে তোলেছেন। ভাল লাগার শতভাগ।

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:২৯

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, সুজন। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারো আনন্দ হলো। ভালো থাকবেন।

৩| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯

সুমন কর বলেছেন: বর্ণনা পড়তে ভালো লাগল।

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:৩০

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, সুমন কর। ভালো থাকবেন।

৪| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:২৭

কালীদাস বলেছেন: গল্পের থিমটা অদ্ভুত। আমার ভাল লেগেছে, চালিয়ে যান।

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:৩২

আফরোজা সোমা বলেছেন: সময় দিয়ে গল্পটা পড়ার জন্য এবং আপনার মতামত জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ, কালীদাস। ভালো থাকবেন। অনেক শুভকামনা।

৫| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:০৬

কাজী নায়ীম বলেছেন: এক কথায় চমৎকার!

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৯:৪১

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, কাজী নায়ীম। ভালো থাকবেন। শুভকামনা।

৬| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৫০

আহমেদ জী এস বলেছেন: আফরোজা সোমা ,



খুব চমৎকার করে অতি পরিচিত ও সাধারন একটি দৃশ্য নিয়ে অদ্ভুত এক মনস্তাত্বিক গল্প লিখে ফেলেছেন ।
মানব মনের বিশ্লেষণে খুব গভীরে যেতে পারতেন আরো , সে রকম সুযোগটা ছিলো এখানে ।

ভালো লাগলো, কিছু নয় আবার অনেক কিছু এমন গল্পটি ।

৭| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৮:৫১

আহমেদ জী এস বলেছেন: আফরোজা সোমা ,



খুব চমৎকার করে অতি পরিচিত ও সাধারন একটি দৃশ্য নিয়ে অদ্ভুত এক মনস্তাত্বিক গল্প লিখে ফেলেছেন ।
মানব মনের বিশ্লেষণে খুব গভীরে যেতে পারতেন আরো , সে রকম সুযোগটা ছিলো এখানে ।

ভালো লাগলো, কিছু নয় আবার অনেক কিছু এমন গল্পটি ।

২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৯:৪৫

আফরোজা সোমা বলেছেন: এতো বিশ্লেষণধর্মী একটি মন্তব্য পেয়ে সত্যি খুব ভালো লাগছে। অনেক অনেক ধন্যবাদ, আহমেদ জী এস। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা।

৮| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৯:১৭

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:
একটা আদর্শ রূপক গল্পের প্রধাণ বৈশিষ্ট্য হল পাঠক গল্পের শব্দগুলোকে নিয়ে বিবেচনা করে বিবেচনা করবে শব্দগুলোর আড়ালের গল্পটাকে।

সেই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আপনার গল্পটা সত্যিকার অর্থেই আদর্শ একটা রূপকগল্প।

তেলাপোকার আড়ালে একটা নিঃসঙ্গ মানুষের কথা ফুঁটে উঠলো।

চমৎকার লেখনী। ++

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:১৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, রক্তিম দিগন্ত। খুব চমতকার বিশ্লেষণ করে অন্তর্ভেদী মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.