নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোল্লাছুটের মাঠ পেরিয়ে

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ৯:৪৪

এক বালতি জলের মধ্যে এক ফোটা সবুজ রং মিশিয়ে দিলে যেমন হয় স্বচ্ছ সবুজ, তেমনি রঙের জলছাপ দেয়া ফ্রক পরে বিকেলের সোনারোদে পাড়ার গলির এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত দৌড়ে যাচ্ছে মেয়ে। একবার নয়, দুইবার নয়, আটবার, নয়বার, দশবার। বারবার বারবার সে দৌড়াচ্ছে; বাতাসে উড়ছে তার চুলের ঝুটি, ফ্রক।


গলির একদিকের শেষ মাথা যা পাড়ার ভেতর ঢুকে শেষ হয়ে গেছে উত্তর দিকে, সেই দিক থেকে গলির অন্য দিকের শেষ মাথা যা দক্ষিণ দিকে গিয়ে বড় রাস্তায় মিশেছে এবং যেই বড় রাস্তার গা ঘেষে ধীরলয়ে বয়ে চলেছে নরসুন্দা নদ-- সেই দিকে নেশাগ্রস্থের মতন বালিকা দৌড়ায়। এই নেশার নাম বাতাস। বিকেলে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে দৌড়ানোর সময় বালিকার কানের পাশ দিয়ে কী সুন্দর শীস কেটে যায় বাতাস! এই শীস প্রাণ ভরে শুনবার জন্যেই বালিকা দৌড়ায় সারাটা বিকেল।


সেই বালিকা আজও কী গভীর আকর্ষণে আমাকে টানে। আমাকে টানে ফড়িঙের পিছু পিছু ঘুরে তার কতনা দুপুর কাটিয়ে দেওয়া অবর্ণনীয় সুন্দর দিন।


আজ মনে হয়, রূপকথায় বর্ণিত গল্পগুলোতেই বুঝি যাপন করেছি আমার শৈশব। শৈশবে ভিডিও গেমস, র্কাটুন ছিল না আমার কাছে। কিন্তু ছিল কেচ্ছার অসামান্য চরিত্র সকল, ছিল গল্প আর গীতের এক বিরল সমাহার, ছিল দস্যিপনা আর ভূতের ভয়ে ভীতু মেয়ের অদ্ভুত সম্মিলন।


শৈশবে আমাদের পাড়ায় যে কয়টা ঘর ছিল তা আজও আমার মুখস্থ। আর ছিল মাঠ। মাঠের পরে মাঠ। ছিল গল্প। পাড়ার একেক কোণায় একেক গল্প। ভরদুপুরে পড়া বাড়িতে যাওয়া যাবে না; গেলে জ্বীনে-ভূতে ধরার গল্প। শিমুল গাছে যে ভূত থাকে অসময়ে সেই ভূতের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রেগে গিয়ে সেই ভূতে আছর করার গল্প। বাঁশঝাড়ে থাকে যে দেও, সেই দেও দুপুরে গোসল করে মাঠে বসে চুল শুকানোর সময় সেই চুলে ভুল করে পা পড়ার কারণে মানুষের উপর দেও-এ ভর করার গল্প।


এইসব গল্পের মধ্যেই আরেকটা গল্পের মতনই বয়ে গেছে আমার শৈশব; আমার বালিকাবেলা। শৈশব আর বালিকাবেলাকে আলাদা করছি, করতে হচ্ছে। কেননা আলাদাই ছিল শৈশব আর বালিকাবেলার অভিজ্ঞতা। শৈশব সকলেরই হয়। কিন্তু বালিকাবেলা কেবলই মেয়েদের। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক নিষেধ, সীমানার অনেক কাঁটাতার। একটা বয়সের পর খেলার সাথী ছেলে বন্ধুরা যখন বাধা-নিষেধ ছাড়াই আগের মতনই বল্গাহীন চলে কিন্তু বালিকাটি পারে না তখনই বালিকার বালিকাবেলার শুরু।


আমার জীবনে প্রথমত আমার শৈশব বেশ প্রলম্বিত হয়েছে। আর ‘বালিকাবেলা’তেও নিষেধের কাঁটাতার ভেঙে, বালিকার সীমানা ভেঙে আমি বারবার সীমা লঙ্ঘন করেছি অথবা বলা যায়, ফিরতে চেয়েছি আমার শৈশবে।


যখন ক্লাশ টু থ্রি-তে পড়ি সেই সময়ে পাড়ার সকল ছেলে-মেয়ে দল বেঁধে গোল্লাছুট, বৌচি, কানামাছি, ইচিং-বিচিং, দাড়িয়াবান্ধা, চোর-পুলিশসহ আরো কত খেলা খেলেছি। আর ডাংগুলি খেলাকে আমাদের এলাকায় ডাকা হতো ‘গুডবারি’। গুডবারি খেলাকে ছেলেদের খেলা এবং দুষ্টুদের খেলা হিসেবেই দেখা হতো। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই খেলা খেলতে-খেলতে আম্মি’র চোখে ধরা পড়ে কতইনা পিটুনি খেয়েছি।


এরচেয়েও বেশি পিটুনি খেয়েছি মার্বেল খেলার অপরাধে। বাড়ির সীমানা ছেড়ে, মানুষজনের আনাগোনা যেখানে কম, তেমন জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে মার্বেল খেলে পাড় করেছি দুপুর, বিকেল। মায়ের হাতে ধরা পড়ার পর, মা যখন মার্বেল নিয়ে লুকিয়ে ফেলেছে, অথবা ফেলে দিয়েছে তখন বদ্দিরাজের বিচী দিয়ে অথবা সুপারি গাছ থেকে ঝরে পড়া ছোটো ছোটো বিচী দিয়ে ‘মার্বেল’ খেলেছি। এইসব দিয়ে খেলতে গিয়েও ধরা খেয়েছি, পিটুনি খেয়েছি; আবার খেলেছি।


একা একাই বাড়ির পাশে খেলতে খেলতে কোনো সময়ে হঠাত যখন মনে হয়েছে, বানিয়ে তোলা খেলার প্রাসাদ সাজানোর জন্য ফুল দরকার তখন ঢুকে গেছি গোরস্তানে। গোরস্তানে কত ফুল! ইচ্ছে মত ফুল তুলে এনে ঘর সাজিয়েছি। এমনকি গোরস্তানে গিয়ে মায়ের কাছে ধরাও পড়ি নি। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল কন্ট্রাক্টর বাড়ির দুইটা পুুকুর। পাড়ার ছেলে-মেয়ে সেই পুকুরে গোসলে যায়। অথচ আমার যাওয়া বারন। কিন্তু চুরি করে নেমে গেছি পুকুরে। সাঁতরে চোখ লাল করে ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরেছি। এই অপরাধে পিটুনি খেয়েছি।


আর বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে দুইটা মাঠ পাড় হয়ে ছিল বজুলর দীঘি। সেই দিঘীতে গোসল করতে যেতো আমার দাদি। কারণ, টিউবওয়েলের পানি দিয়ে গোসল করলে না-কি তার গোসল হয় না, শরীর না-কি আঠা-আঠা লাগে। দাদু গোসলে যাবার সময় মাঝে মাঝে দাদুকে বলতাম: “তুমার লগে আমারে লইয়া যাও।” দাদু বলতো: “পুষ্কুনিত গেলে তর মা তো তরে মারবো।” আমি বলতাম: “ না না, তুমি কইলে কিচ্ছু কইত না। তুমি কও। ”


এভাবেই কখনো বলে কখনো না বলে বার বার সীমানা ছাড়িয়েছি। সীমা লঙ্ঘন করাই ছিল আমার শৈশবের অন্যতম মূল অপরাধ। আমার মা ছিলেন খুব কড়া। বিধি-নিষেধে আমাকে রেখেছেন সবসময়। আর আমি নিয়ম ভেঙেছি বারবার। নিয়ম ভেঙে পিটুনিও খেয়েছি প্রচুর।


তবু, মন যদি চাইতো কোনো একটা ঘুড়ি’র পিছু নিয়ে ছুটতে, তখন মনের কথাই পাক্কা। ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছে ছেলের দলের সাথে ছুটতে ছুটতে পাড়া ছাড়িয়ে চলে গেছি অন্য পাড়ায়। আবার কোনো কোনো দিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মন চাইতো অন্যদের সাথে নদীতে নেমে যেতে। তখন নিজের শরীরটাকে মনের চ্যালা করে ছেড়ে দিতাম। অন্যদের সাথে নরসুন্দায় কলার ‘বুরা’ (ভেলা) চালাতাম। একটা কি দুইটা শাপলার মালা জড়িয়ে রাখতাম গলায়।


ঘরে থাকতে মন চাইতো না। আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে কোনো কোনো দিন চলে যেতাম পশ্চিম পাড়ায়। কোনো দিন অনেক দূরে, হিমাগার পাড় হয়ে চলে যেতাম মাকখোয়ার বিলে। আবার কোনো কোনো দিন কেবল পাখি ধরার পেছনেই কেটে গেছে সারা দুপুর। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর এইসব খবর কখনই গোপন থাকতো না। কোনো না কোনো ভাবে পৌঁছে যেতই আমার মায়ের কাছে।


আমার মা আমাকে ঘরের ভেতর রাখতে পারে নি। দুপুরে ভাত খাবার পর ঘুম পাড়াতে পারে নি। আমি চোখ বুজে প্রতিদিন দুপুরে বিছানায় পড়ে থেকেছি, কিন্তু ঘুম আসে নি। ঘুমের ভান ধরে শুয়ে শুয়ে ভেবেছি: ইস! মাঠের উপর এখন কী সুন্দর রোদ!


ঘরের ভেতর আমাকে রেখে বাইরে দিয়ে দরজায় শেকল তুলে দিয়েও আমাকে আটকাতে পারে নি। ঘরের ভেতর থেকে শেকল খোলার একটা টেকনিক আমি আবিষ্কার করেছিলাম।


বনে-বাদাড়ে রোদে ছেলে-মেয়ের দলের সঙ্গে অথবা একলা একলাই ঘোরা-ঘুরি আটকাতে না পেরে অবশেষে আমার মা আমাকে দুই-চার বার মাঠ থেকে হয় আরজু কাকা অথবা বাক্কার ভাইকে দিয়ে ধরিয়ে এনে ঘরের ভেতর আমার পড়ার টেবিলের সামনের চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারের হাতলের সঙ্গে আমার হাত বেঁধে রেখেছে!


হাত বাঁধা একটা বিরাট অপমানের কাজ। আম্মিকে তখন শত্রু বলে মনে হতো। তখন রাগের চোটে কামড়ে হাতের দড়ি খুলেও দুই-একবার বাইরে বেরিয়ে গেছি। দু’য়েকবার আমার দাদু খুলে দিয়েছে বাঁধন।


আর কাঠালের মৌসুমের সময়, আমাদের বাড়ির গাছে গাছে আমার বিচরণ। কিন্তু আমার মা আমাকে গাছে চড়তে দেবে না। গাছে উঠলে নামার পরে হয় বকা নয় পিটুনি।
মাঝে মাঝে এমন হয়েছে, হয়তো বাসায় নানুবাড়ি থেকে নানু বা খালামণিরা কেউ বেড়াতে এসেছে সারাদিনের জন্য রিকশা সঙ্গে নিয়ে, তখন সুযোগ পেলেই সেই রিকশা চালাতে চালাতে উঠে গেছি বড় রাস্তায়। অপরাধ করলেও এই দিন সাজা নাই। কারণ নানু বা খালামণিরা আমাকে মারতে দেবে না।


নানু বাড়ি! আহা! নানু বাড়ির গ্রামটাকে আমার মনে হয় বাংলার রূপকথায় বর্ণিত গ্রাম। নানু বাড়ির প্রতি আমার ছিল খুব টান। সেখান থেকে কেউ বেড়াতে এলে তারা যাবার সময় আমি কান্নাকাটি শুরু করতাম সঙ্গে যাবার জন্যে। মাঝে মাঝে এমন হতো, আমার নানা আমাকে সঙ্গে করে দুপুর বেলায় বাড়িতে নিয়ে পৌঁছালো, কিন্তু সন্ধ্যে বেলাতেই বাড়ি ফেরার জন্য আমি আবার কান্না শুরু করতাম। তখন আমার নানা, আমাকে কাঁধে করে বাড়ি থেকে দুই-আড়াই কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে (তখন যখন-তখন অতো রিকশা গ্রামে পাওয়া যেতো না) মেইন রোডে এসে বাসে উঠতেন। আমাকে পৌঁছে দিতেন বাড়ি। তো, খুব ঘন ঘন নানার কাঁেধ চড়ে এরকম আসা-যাওয়া করতে করতে নানার মাথার চুলের ঘষায় একবার আমার থুতনিতে চামড়া উঠে গেলো।


নানুবাড়ির পুকুরগুলো ছিল আমার রাজ্য। যতক্ষণ ইচ্ছে সাঁতার কাটতাম। চোখ লাল করে রাখতাম। এহসান খালাকে সঙ্গে করে জাল দিয়ে পুকুরে মাছ ধরতাম, কখনো গামছায় ছেকে ওঠাতাম মাছ। কোনো দিন সকালে যখন কেউ হাঁসের পাল নিয়ে যেতো বিলে তার সঙ্গে আমিও জুটতাম, হাঁসের জন্য শামুক কুড়িয়ে আনার জন্য বন্দে যেতাম। ধান রোপনের সময় বড়দের বলে-কয়ে রুয়েছি ধানের ‘জালা’ (চারা)। দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত, যেটিকে নানুদের এলাকায় ‘বন্দ্’ বলে ডাকে, সেই বন্দে ঘুরে বেরিয়েছি কত না বিকেল।


নানুবাড়ির গ্রামে তখন বিদ্যুত ছিল না। সন্ধ্যের আযান হতে না হতেই তখন রাতের খাওয়া হয়ে যেতো। রাতের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝে মাঝে কুপি বাতির টিমটিমে আলোয় কুদ্দুস নানা সুর করে শোনাতেন রাজকন্যা, পরী আর রাক্ষসের কেচ্ছা। বড়দের সাথে বসে অথবা পাটিতে শুয়ে গানের সুরে সুরে বয়ান করা সেই কেচ্ছা শুনতে শুনতে মনের ভেতর কেমন যে লাগতো! আজও তা বর্ণনার ভাষা আমি পাই না।


শুধু কেচ্ছা নয়, নানুবাড়ির কথা মনে হলেই আমার স্মৃতি ভরে যায় গীতে। আমার নানুর মা, যাকে বুড়িমা বলে ডাকতাম, তিনি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। কী সুন্দর ছিল তার গীতের গলা! রাতে ঘুমের আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অথবা বিকেলে গাছের ছায়ায় বসে তিনি যখন গাইতেন: “নাম কুলি আষাঢ়ে, নামো কুলি জমিনে/ খাইয়া যাও গো কুলি সরলি বাটার পান।”/ তখন মনের মধ্যে আমার কেমন কেমন যে লাগতো!


মনের মধ্যে কেমন-কেমন করার যে কতো ধরণ হতে পারে তা হয়তো বলা মুস্কিল। কিন্তু বুড়িমা’র গীত শুনে মনের ভেতরের কেমন-কেমন করা আর আমি একটু বড় হয়ে ক্লাশ সিক্সে পড়ার সময়ে আমার উপরে নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি হবার পর মনের মধ্যে যে কেমন-কেমন করাটার শুরু হলো তার আজও কোনো শেষ হলো না।


একটু বড় হবার পর, মানে কিশোরীভাবটাই শরীরে যখন বেশি, তখন থেকেই মেয়েদেরকে নিয়ে মায়েদেরকে অতিসচেতন হয়ে উঠতে দেখেছি। এমনকি আমার মা-ও আমাকে বলেছে: অমুক কাকা যদি লজেন্স দেয়, যদি তার সাথে জঙ্গলের মধ্যে পাখি দেখতে যাইতে কয় তাইলে যাইবি না।


আমি যাই নি। আরও অনেকেও যায় নি। কিন্তু কেউ কেউ গেছে। এবং অঘটন ঘটেছে। ওই বয়সে পাড়ায় হঠাত হঠাত শুনতাম, আজকে অমুক মিয়ার বিচার হবে। আমরা শিশু কিশোর সবাই সাগ্রহে সেই বিচারের কারণ জানতে চাইতাম। কিন্তু দেখতাম কিছু কিছু বিচারের ক্ষেত্রে কিশোরী ও কিশোরদের উপস্থিতি নিষেধ।


সেই নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের কৌতুহল আরো বাড়তো এবং আমরা জানতে পেতাম যে, অমুক বাড়ির অমুক কাকা তমুক বাড়ির তমুকের মেয়েরে লজেন্স দেওয়ার কথা কইয়া অথবা পুষ্কুনিতে যাওনের সময় পাশের উকক্ষেতে (আখের ক্ষেত) নিয়া খারাপ কাজ করছে অথবা খারাপ কাজ করনের চেষ্টার সময় ধরা পড়ছে। অথবা শুনতাম তমুকের বাচ্চা ছেরিরে বাড়িতে একলা পাইয়া ঘরের মধ্যে অমুকে জাইত্তা ধরছে। পরে ছেরির চিল্লান ফুইন্যা আইয়্যা তমুকরে মাইনষ্যে হাতে-নাতে ধরছে। অহন হেই ঘটনারই বিচার অইতাসে।


এই ‘জাইত্যা ধরা’ হলো জড়িয়ে ধরার আঞ্চলিক রূপ। এই জাইত্যা ধরা অবশ্য কেবলি জড়িয়ে ধরার অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ হলো, ‘খারাপ কাজ’ করার উদ্দেশ্যে জড়িয়ে ধরা। এই খারাপ কাজকেই বড় হয়ে রেপ বা ধর্ষণ নামে চিনেছি। কিশোরীরা এইসব রেপ-এর সহজ শিকার বলে মায়েরা বিশেষ সতর্ক ও ভয়ে থাকে।


আমার মা আমাকে বনে-বাদাড়ে একা একা ঘুরতে যেতে কেন নিষেধ করতো; ছোটোবেলায় যে সব ছেলের সাথে হুটোপুটি-লুটোপুটি করেছি, একসঙ্গে পুকুরে সাঁতার কেটেছি, মাঠে গোল্লাছুট, সাতচরা, দাড়িয়াবান্ধা খেলেছি ক্লাস সিক্সে-টিক্সে উঠার পর সেই সব ছেলেদের সাথে খেলতে কেন নিষেধ করতো তখন বুঝিনি।


ক্লাস সিক্সে-সেভেনে না পড়লেও অনেক সময় দেখতাম একটু স্বাস্থ্য ভালো মেয়েদেরকে মাঠে খেলতে বা দৌড়াদৌড়ির খেলা খেলতে নিষেধ দেওয়া হতো। সেই নিষেধের কারণ কখনো আমরা নিজ কানেই শুনেছি, কখনো শুনেছি অন্যজন মারফত। নিষেধের কারণ হিসেবে বলা হতো: ‘ছেরির বুক উঠতাছে।’


বুক উঠা মানে হলো মেয়েটির শরীরে কিশোরীসুলভ চিহ্নগুলো দেখা দিতে থাকা। আর তখন থেকেই মূলত নিষেধের বাড়াবাড়ি শুরু। আমার বেলাতেও তাই হয়েছে। এই সময়টা থেকেই আমার উপর শুরু হয়েছে দুপুর বেলায় একা একা মাঠে যাওয়া, জঙ্গলে পাখি ধরতে যাওয়া এবং দল বেধে আখক্ষেতে ঢুকে শেয়াল তাড়ানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা।


এতো সব নিষেধ আর কাঁটাতারের সীমানা দেখে সেই বয়সে আমার উঠতি বুকের উপরে আমার খুব রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এটাই আমার বন্দীত্বের কারণ। এমনকি কেন ছেলে হয়ে জন্মালাম না সেই জন্য সেই বয়সে আক্ষেপও হতো খুব। কিন্তু তখনো পুরোপুরি বুঝতে পারি নি বুক উঠার সাথে মাঠে না যাওয়ার সম্পর্ক; বুক উঠার সাথে ঘরবন্দী হওয়ার সম্পর্ক; বুকউঠার সাখে মেয়েলী জীভন শুরু হওয়ার সম্পর্ক।


কিন্তু এখন বুঝি যে, বুক উঠা দিয়ে যে বালিকাবেলার শুরু হয়ে ছিল বয়স তিরিশ হবার পরও আজও সেই বালিকাবেলা ফুরোয় নি। অথবা বলা যায়, নারীদের বালিকাবেলা হয়তো ফুরোয় না সহসা।


দিনে বা রাতে অফিস করে বা কাজ করে বা কোথাও থেকে যখন রিকশা করে বা হেঁটে বাসার পথে চলেছি তখন পথচারী পুরুষদের টিপ্পনি, তাদের সঙ্গে যাবার জন্যে নানাবিধ অফার আমাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে শৈশবে। শরীরের উপর অক্ষম রাগে ভরে গছে আমার মন। মাঝে মাঝে রিকশা থামিয়ে তাদের কাউকে ধমকেছি, হাত তুলে কাউকে চড় দেখিয়েছি, কাউকে চড় মেরেছি। কিন্তু মনের ক্লান্তি যায় নি।

যখন দিল্লীর চলতি বাসে ধর্ষিত হয় মেডিকেল শিক্ষার্থী বা যখন রাজধানীর অদূরে চলতি বাসে ধর্ষিত হয় গার্মেন্টসকর্মী তখন নিঃশব্দে আমার ভেতর কান্না উথলেছে। আর মনে মনে শতমুখে বলেছি: হে আমার ‘বালিকাবেলা’, কোথায় তোমার শেষ!
--------
লেখাটি দৈনিক সমকাল-এর সাহিত্যপত্রিকা কালের খেয়া-তে ৬ই জুন ২০১৪ শুক্রবার প্রকাশিত হয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.