নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

জাদুকর

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:৪০

জাদুকরের হাতের সাদা রুমাল চোখের সামনে মুহূর্তে হয়ে গেলো একটা লাল মোরগ। মোরগের মাথায় লাল ঝুঁটি। ঝুঁটি দুলিয়ে-দুলিয়ে কয়েক কদম হেঁটে ডানা খুলে দুই পা উঁচিয়ে উপর দিকে গলা তুলে লাল-নীল-সোনালী-সবুজ রঙের পালকে মোড়ানো সুঠাম মোরগ ডাক দিলো কোককোরোওওওওওকোওওক।

সেই ডাকে দর্শক বিমোহিত। হাত তালির ফুয়ারা বইছে যেনো। ভরদুপুরে বাজারের মধ্যে চারিদিকে গোল হয়ে থাকা দর্শকের চোখ হতে বিস্ময় সরে না। অবিশ্বাস সরে না। তবু, এ সত্য। তারা দেখে চোখের সামনে একটা সাদা রুমাল হয়ে উঠে লাল মোরগ। চৈত্রের দুপুর কাঁপিয়ে বাজারে সে ডেকে উঠে কোককোরোওওওওওকোওওক।

সেই মোরগকে আবার আদর করে হাতে তুলে নিয়ে টুলের উপর রেখে রুমাল দিয়ে ঢেকে দেয় জাদুকর। টুলের উপরে নীল রুমালে ঢাকা মোরগের গায়ে জাদুকর কয়েকবার বুলায় হাত। তারপর সে রুমাল সরায়। রুমালের তল থেকে বেরিয়ে আসে গোলাপ। গোলাপের বাসনায় দর্শকেরা মাত হয়ে যায়। দর্শকেরা লম্বা করে শ্বাস টেনে বুকের ভেতরে ভরে নেয় জাদুর সুবাস। কেউ আবার হাত বাড়ায়। বলে, আমারে দেন। একটা দেন। বাড়ি নিয়ে যাই। গিন্নিকে দিবো।

জাদুকর হাতে তুলে নেয় গুচ্ছ গোলাপ। শুন্যে ছুঁড়ে মারে। শূন্যে ছুঁড়ে দেয়া গোলাপগুচ্ছের ফুল সকল একটা একটা করে ছড়িয়ে যায় একেক দিকে। সেই গোলাপ ধরতে দর্শকেরা হুড়াহুড়ি করে। দর্শকেরা কাড়াকাড়ি করে। একজনের ফুল আরেকজন কেড়ে নিতে গিয়ে ফুল ছিঁড়ে কুটি কুটি হয়। তবু টানাটানি চলে। কাড়াকাড়ি চলে। কেউ পায় কয়েকটা পাপড়ী। কেউ পায় ভাঙ্গা বোঁটা। আবার কেউ একজন হয়তো কোনো কাড়াকাড়িতে না গিয়েও জায়গায় দাঁড়িয়েই পেয়ে যায় একটা আস্ত গোলাপ। পেয়েই শার্টের ভেতরে মুহূর্তে আড়াল করে প্রেয়সীর হাতে তুলে দেবে বলে।

এখানেই শেষ। আশর ফুরায়। দর্শকদের হাতে কিছু তুলে দেয়ার পর সেই দিনের মতন জাদুর সেখানেই সমাপ্তি। এটাই তার নিয়ম।
বিস্ময়ে পরস্পরের সাথে আলাপ করতে-করতে মুগ্ধ দর্শকেরা যে যার কাজে যায়। জাদুকর ধরে তার পথ। কিন্তু ক’দিন তার পিছু নিয়েছে এক কিশোর। জাদুকরের পিছু পিছু সে হাঁটে। হাঁটে। হাঁটে একটা দূরত্ব রেখে। পিছু ছাড়ে না। কিছু বলে না। কিন্তু তার চোখ ভরা ঘোর।

জাদুকর আজ তাকে ডাকে। কাছে এসে কিশোর দাঁড়ায়। চোখ তুলে না। তার বাদামী মুখে কচি লাউয়ের মতন লোমগুলো আবছা সাদা আভা ছড়ায়। সেই সাদা আভায় চৈত্রের রোদ পড়ে বড় মায়া লাগে।

সময় যায়। নীরবতা ভাঙে। পরস্পরের কাছে নিজেদের সমর্পন করতে চায় পরস্পর।

সে জানতে চায়, গুরু, আপনি কেমনে বানান ফুল! কেমনে বানান পাখি! কেমনে বানান এমন কবুতর! সে আবার ডানা মেলে আসমানে উড়ে যায়!

জাদুকর বলে, আমি কিছু বানাই না তো। তারাই আমারে বানায়। যে পাখি উড়তে চায় সে আমারে ডেকে নেয়। বলে ওড়াও। আমি উড়াই। যে মোরগ ডাকতে চায় আমি তার ডাকের উপলক্ষ হই। যে ফুল ফুটতে চায় আমি তার মাধ্যম হই। আমি কিছু বানাই না। তারাই আমাকে বানায়। জাদুকর।

কিশোর কিছু বোঝে না। জাদুকর বোঝে যে, সে কিছু বোঝে না। কিন্তু চুপ করে থাকে। মাথা নিচু করে ঘাড় কাঁৎ করে উৎকর্ণ হয়ে থাকে। সময় যায়। দিনে দিনে কিশোর করে পর্যবেক্ষণ।

সে বলে, আমিও বানাতে চাই এমন পাখি। এমন ফুল।

জাদুকর বলে, আমি কিছু বানাই না, বাবা। আমি হতে চেয়েছিলাম পর্যটক। হতে চেয়েছিলাম বিদ্যাধর। হতে চেয়েছিলাম বড় কারবারী। কিন্তু আমি দেখলাম, জাদু আমারে টানে। টানে। টেনে নেয়। আমার সকল ধ্যান ভেঙে দেয়। খালি তার দিকে টানে। আমার সকল ধ্যান তাকে ঘিরে পুঞ্জিভূত হয়।

ফলে, আমি তার দিকে যাই। জাদুর দিকে। আমার গুরুর দিকে। গুরুর হাতে দেখি ফুটে ফুল। গুরুর হাতে ডাকে পাখি। সেই পাখির ডাকে আমি ঘর ভুলে যাই। সেই ফুলের সুবাসে আমি ভুলে যাই বাড়ির ঠিকানা। এভাবেই ফুল-পাখি-কবুতরের মায়া-ঘোর আমাকে ঘুরিয়েছে দেশে দেশে। ফলে, আমার ঘর নাই কোনো। দেশ নাই কোনো। আমার শুধু তেনারা আছেন। ফুল-পাখি-কবুতরেরা। তাঁরা আমাকে করেছেন নির্বাচন। আমার মধ্য দিয়ে তারা হন প্রকাশিত ।

বালক বোঝে না। জাদুকর বোঝে, বালক বোঝে না। সময় যায়।

জাদুকর বলে, তুমি যে ধরছো আমার পিছু কেন ধরছো, বলো।

জাদু আমার ভালো লাগে।জাদু আমাকে টানে, বলে কিশোর।

কেন জাদুই তোমাকে টানে, বাবা? কেন কৃষিকাজ টানে না? কঠিন মাটির তলে যে লুকানো আছে এমন রসালো টমেটো, তা জেনেও কেন তুমি সেইটারে ভাবো না জাদু? কেন তুমি সেই দিকে দেও না মন? শুষ্ক কাঠের ভেতর, দেখছো কী করে লুকানো থাকে কাঁঠালের মুচি? সেই মুচি বড় হয়। কাঁঠাল হয়। রসে হয় টুইটম্বুর। কেউ যদি নিজের চোখে না দেখে, বললে কি করবে বিশ্বাস যে, এই কাঠের ভিতরে গোপন আছে এই রস? এ্মন মধু? চোখে যদি না দেখে, বললে কি কেউ করবে বিশ্বাস যে, কাটাভরা এই চিকন গাছের ভেতর গোপন আছে এতো সুঘ্রাণ? এমন টকটকা লাল গোলাপ!

বাবা, আমার ভেতর কী ছিল তা আমি জানি নাই। একমনে চেয়েছিল আমি বণিক হই। আর মনে পর্যটক হতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম হতে বিদ্যাধর। আমি চেয়েছিলাম, জীবনে একটু নিশ্চিন্তি। কিন্তু বাবা! তোমার ভেতরে যদি থাকে একটা কাঠাঁলের চারা গোপন, সেই চারাকে তুমি কেমন করবা অস্বীকার! সে তো তোমারে ডাকবে। ডাকবে। বহুরূপে। বহুস্বরে। সে তো তোমাকে ঘোরাবে; দেশে দেশে। তোমাকে তো সে করবে ঘর ছাড়া। তুমি ভাববা, বুঝি তুমিই ভালা পাও বন্ধুরে। বুঝি তুমিই পড়ছো বন্ধুর প্রেমে। কিন্তু নাহ! যারে ছাড়া তুমি পারো না থাকতে, যা ছাড়া তুমি আর থাকো না তোমার নিয়ন্ত্রনে তা তো তাহলে তোমার চেয়ে বড়। তোমার ইচ্ছার চেয়ে বড়। তুমি আর তারে করতে পারো না তারে নিয়ন্ত্রন। সেই তখন তোমারে চালায়। তুমি চলো তার ইচ্ছায়। আর মনে ভাবো, বুঝি তুমি চালাও তোমারে। বাবা, জাদুই আগে তোমার প্রেমে পড়ে তোমাকে করেছে নির্বাচন। তাই, তুমি নিয়েছো পিছু।

কিশোর বোঝে কি বোঝে না তা স্পষ্ট নয়। তবে, জাদুকর দেখে তার চেহারার ভঙ্গি বদল হয়।


২৪.০১.১৭

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:০৬

মাঝিবাড়ি বলেছেন: কাহিনীর সমাপ্তি ঘটতে যেয়েও ঘটেনি! মনোযোগ দিয়ে পড়লাম!! চমৎকার!!!!

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:৪৭

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, মাঝিবাড়ি। ভালো থাকবেন।

২| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:০৪

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: মাটির নিচে জাদু, কাঠের ভেতর জাদু, কাটায় ভরা গাছটাতেও জাদু। জাদু বুঝি জাদুতেও লুকিয়ে আছে!
আপনার লেখাতেও জাদু। আমাকে খালি টানে, টানে, বলে পড় ভালো করে মনোযোগী হয়ে। আমি পড়ি। শুধু পড়ি। পড়ে পড়ে পড়া শেষ করি, কিন্তু গল্প শেষ হয় না। আমি ঘর ছাড়া হতে চাই না ভাই, আমি মাটির ভেতরের জাদুর প্রেমের পড়ে গেছি। থাকতে চাই, মাটি আঁকড়ে ধরতে।


গল্পে ভালো লাগা রেখে গেলাম।

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:৪৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: মাটির প্রেমে পড়া মানুষের চেয়ে বড় জাদুকর কে আর আছে সংসারে!

খুব ভালো থাকুন। অনেক শুভকামনা।

৩| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৪০

কালীদাস বলেছেন: আমি ভাল আছি। আপনি কেমন? :)

পোস্টের ব্যাপারে আসি। আপনার লেখা আমার ভাল লাগে কারণ আপনি সহজ সরল প্লট সহজ ভাষায় লিখে যাচ্ছেন সবসময়। এটাও সেইম কারণে ভাল লেগেছে।

চালিয়ে যান :)

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১:৫১

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালো আছি, কালীদাস।

আপনার মতন পাঠক পাওয়া আনন্দময়। ভালো থাকবেন।

শুভ কামনা।

৪| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:০৬

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: আপনার লিখাটি অনেক অনেক ভাল লেগেছে। কি যেন লোকানো তথ্য আপনি প্রকাশ করছেন। এইতো সে মহান প্রয়াস, কি করে থাকে সে কে লোকায়ে রেখেছে সে যাদু!!!
ভাল লাগার সবটুকু।

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:২৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ, সুজন! ভালো থাকবেন। অনেক শুভ কামনা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.