নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

কমিউটার্স ডায়রি: জীবন যখন একটা সিস্টেমলস মাত্র

২৯ শে মে, ২০১৭ রাত ১০:৫৬

আজকের কথাই বলবো। গতকালের খানিক বৃত্তান্ত দিয়ে শুরু করতে হবে আরকি।

গত সপ্তাহ দেড়েক হলো নিয়মিত পাঠাও সার্ভিস ব্যাবহার করছি। উবারের মতনই পাঠাও-ও ইন্টারনেটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা পরিবহন সেবা দেওয়ার একটি নেটওয়ার। এটি বাইক সার্ভিস। রিকোয়েস্ট পাঠানোর ২ থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই সাধারনত সবসময় উত্তর আসে। দোর গোড়ায় বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন চালক। ভাড়াটাও সম্ভাব্য কত হতে পারে তাও জানা যায় আগেই। ফলে, আরোহীর সময় বাঁচে। পরিশ্রমও বাঁচে।

কিন্তু গতকাল প্রথম দেখলাম প্রায় আধাঘন্টা চেষ্টা করতে হলো বাইক পেতে। ভাবলাম, বোধহয় নেটওয়ার্কের বা অ্যাপের কোনো সমস্যা। বিকেল সাড়ে চারটায় বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ থেকে রওয়ানা হলাম। ভূতের গলি পৌঁছুতে ৬টা মতন বাজলো। জ্যামের এই বহর দেখে ভাবলাম, আগামীকাল সাড়ে তিনটার মধ্যেই ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যাবো।

আসি এবার আজকের কাহিনীতে।

বেলা তিনটা ৫/৭ বাজার সাথে-সাথে ব্যাগ-পত্তর গুটিয়ে ফেল্লাম। সোয়া তিনটা নাগাদ পাঠাও-এ রিকোয়েস্ট পাঠালাম। কিন্তু ২ মিনিট, ৩ মিনিট, ৫ মিনিট যায়। কেউ রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে না। কোনো বাইক রাইডার সাড়া দেয় না। ৫-৭ মিনিট পর রিকোয়েস্ট ক্যান্সেল করি। আবার রিকোয়েস্ট পাঠাই। ৫/৭ মিনিট যায়। কেউ সাড়া দেয় না।

আমি ভাবি, কী হলো! এমন তো হয় না! আবার ক্যান্সেল করি। আবার রিকোয়েস্ট পাঠাই। একজন সাড়া দেন। ফোন করেন। পাঠাও থেকে বলছি। আপু, কোথায় আছেন একজ্যাক্টলি? লোকেশান বলি। রাইডার আছেন কাকলী মোড়ে। আমি আতাতুর্ক অ্যাভিনিউএ। এআইইউবির ক্যাম্পাস-৭। ওখান থেকে হেঁটে এলে সর্বোচ্চ ৫/৭ মিনিট। কিন্তু রাইডার আমার লোকেশান জেনে উত্তর দেন: সর‍্যি, আপু। ওখানে আসতে হলে মোড় ঘুরতে হবে। রাস্তায় রাশ। প্লিজ, আপনি রিকোয়েস্টটা ক্যান্সেল করে দেন। আমি আচ্ছা বলে বিদায় নিই।

ফোন কাটতে-কাটতে ভাবি, শহরটা কোথায় গিয়ে ঠেকলো! বিশেষত এই রোজায়। গতকালের ঘটনায় জেনেছি, রোজার কারণে রাস্তায় ভীষণ জ্যামের ভয়ে বাইকাররা ভেবে চিন্তে রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করছেন। আরেকটা জেনেছি, জ্যাম এড়াতে অনেক মানুষ পাঠাও-এর দ্বারস্থ হচ্ছেন। এই অবস্থায় পাঠাও একটু দুস্প্রাপ্য ঠেকছে।

এইসব ভাবতে-ভাবতে আমি আবার রিকোয়েস্ট পাঠাই। আরেকজন কল করেন। আপু, স্লামালেকুম। আমি পাঠাও থেকে বলছি। আপনি কোথায়? লোকেশান জানাই। উনি বলেন, আপু, আমিও বনানী ১১ নম্বরের কাছাকাছি আছি। কিন্তু রাস্তায় জ্যাম আছে। আমার আসতে টাইম লাগবে। জানতে চাই, কতক্ষণ? উনি বলেন, ১০-১৫ মিনিট তো লাগবেই। আমি বলি, ভাইয়া তাহলে কি আমি ক্যান্সেল করে দিয়ে আরেকবার ট্রাই করবো? যদি কাছে পিঠে কাউকে পাই? উনিও বলেন, জ্বী আপু। সেটাই ভালো হবে।

আবার রিকোয়েস্ট ক্যান্সেল করি। আবার রিকোয়েস্ট পাঠাই। এবার অন্য নাম্বার থেকে ফোন আসে। স্লামালেকুম, আপু। আপনি কোথায় আছেন? লোকেশান জানাই। উনি বলেন, আপু, আমিও কাছাকাছি। ১১ নম্বর ব্রিজের কাছে। কিন্তু আসতে তো অনেকক্ষণ লাগবে। আমি বলি: হুমম। অনেকক্ষণ। উনি বলেন, তাহলে বেটার আপনি ক্যান্সেল করে আবার ট্রাই করেন, আপু।

এইসব করতে-করতে পৌনে চারটা বাজে। আমি ঘড়ির দিকে চেয়ে মনে ভাবি: ভেবেছিলাম ঠিক সোয়া তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা নাগাদ বেরিয়ে যাবো। চারটা/ সোয়া চারটা বা সাড়ে চারটায় বাসায় যাবো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে-দেয়ে পড়তে বসবো। নতুন সিমেস্টার। নতুন কোর্স। মেলা পড়া আছে। লেকচার বানাতে পড়তে হয়। আর সময় করতে পারলে একটা সিনেমা দেখবো।

আজ দুপুরে খেতে গিয়ে জুৎ হয়নি। বরং কিঞ্চিত ভজঘট হয়েছে। খাওয়া হাফ-ডান ছিল। আমি ঠিক একটায় খাই। ফলে, ঘন্টা দুই যেতে না যেতেই ক্ষুধা লাগতে শুরু করেছে। আমি ভাবলাম, এখন আর খাবো না। আধাঘন্টার মধ্যেই তো বাসায় যাচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে খাবো।

কিন্তু আধাঘন্টার বেশি চলে গেছে। কোনো রাইডারকেই পাইনি। আমার উশখোশ, হা-হুতাশ, কোনো রাইডার না পাওয়া জনিত মনোলগ দেখে ও শুনে, আমার আশপাশে উপস্থিত অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার ম্যাডাম? রিকোয়েস্ট নিচ্ছে না? এইসব নিয়ে আলাপ হয়। কেউ পরামর্শ দেন: সিএনজি নেন। আমি বলি: না না, স্যার! সিএনজি পাওয়া এক কঠিণ কাজ। যাবেন-যাবেন করতে-করতে মুখ ব্যাথা হয়ে যায়। আর যে যেতে রাজি হবে, সে এমন দাম চাইবে আপনার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার দশা হবে। তার উপর যে জ্যাম!

এইসব কথায় কিছু হাসাহাসি হয়। ততক্ষণে আমার ক্ষুধা চাগিয়ে উঠতে থাকে। আমি ভাবি, ধুর! এখন খাওয়ার ঝামেলায় না যাই। আরেকবার ট্রাই করি। আবার ট্রাই করি। কয়েক মিনিট যায়। কেউ রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে না।

অন্য আরেক শিক্ষক হয়তো জিজ্ঞেস করেন, বাস ধরে যাওয়া যায় না? আমি বলি, যাবে না, তা না। কিন্তু খুব হুজ্জত হবে। আর যা ভীড়! তার উপরে জ্যাম তো আছেই। আর আমি চিকনগুনিয়া থেকে উঠার পর হাঁটতে কষ্ট হয়। কাকলী পর্যন্ত হাঁটতে পারবো না। তাই, পাঠাও-এ যাই।

এইসব আলাপ করতে-করতেই রিকোয়েস্ট ক্যান্সেল করে আমি আবার রিকোয়েস্ট পাঠাই। ততক্ষণে চারটা ছাড়িয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার মন খারাপ হয়। বাইরে আবার আকাশ মেঘলা। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামি-নামি ভাব। এমন সময়, ডিন স্যারের রুম থেকে আলাপ শেষ করে যাবার সময় এক ম্যাডাম বলেন, ইশ ম্যাডাম! আপনি এখনো ট্রাই করছেন! এখনো পান নাই! আমি বলি, এই শেষ ট্রাই ম্যাডাম। এইবার উত্তর না পেলে, বেরিয়ে যাবো। রিকশা ধরবো। সিএনজির ভেতরে বসে থাকতে আমার ভালো লাগে না।

আরেকজন পাশ থেকে জিজ্ঞেস করেন, রিকশায় কিভাবে যাবেন। আমি বিবরন দিই:

প্রথমে হেঁটে কাকলী মোড় পাড় হবো। সেখান থেকে রিকশায় যাবো সৈনিক ক্লাব পর্যন্ত। ওখানে নেমে রাস্তা পাড় হয়ে আরেকটা রিকশা নিয়ে যাবো মহাখালী রেলগেট। ওখানে রিকশা থেকে নেমে রাস্তা পাড় হয়ে মহাখালী রেলগেট মোড় থেকে রিকশা নেবো। পশ্চিম নাখাল পাড়ার ভেতর দিয়ে ওই রিকশা কারওয়ান বাজারে সোনার গাঁ হোটেলের সামনে গিয়ে নামাবে। সেখানে নেমে রাস্তা পাড় হয়ে সুন্দরবন হোটেলের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে বাসায় যাবো।

আমার বৃত্তান্তু শুনে একজন বলেন, ওরে বাবা! আমি বলি, ম্যাডাম, রিকশা অনেক নিরাপদ। আর আরামেরেও। রিকশা আমার বেশ পছন্দ। সিএনজির ভেতরে বসে থাকতে কেমন দমবন্ধ লাগে।

আমি এর মধ্যে আবার ফ্রেশ রুমে যাই। হাতে মোবাইল। ভাবি, হয়তো কেউ রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করবে। ফোন আসবে। কিন্তু ফোন আসে না। আমি ফ্রেশ রুম থেকে বের হয়ে রিকোয়েস্ট ক্যান্সেল করে গতকাল যে বাইক রাইডারের সাথে গিয়েছিলাম উনার ফোন নাম্বার কল লিস্ট থেকে খুঁজে বের করি।

গতকাল উনার সাথে অনেক আলাপ হলো। উনার অফিসটা ঠিক আমার ইউনিভার্সিটির উল্টো দিকে। একটা বিদেশী ফাইনান্স কোম্পানির আইটি সেকশানে কাজ করেন। তার বাসাও ঠিক আমার বাসার আগের গলিতে। উনার স্ত্রী ডাক্তার। উনি পাঠাও-এ ফ্রিল্য্যান্স সার্ভিস দেন। গতকালই আলাপের আন্তরিকতায় আমাদের কথা এখানে শেষ হয়েছিল যে, ভাইয়া, আগামীকাল আপনি অফিস থেকে কখন বের হবেন? ঠিক নেই, আপু। সাড়ে চারটা পাড় হয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম, আমি আগেই বের হবো। সাড়ে তিনটা/চারটা নাগাদ। যদি আমি কোনো রাইড না পাই তাহলে কি একবার আপনাকে ফোন দিবো কালকে? জ্বী, আপু। দিয়েন। যদি সময়ে মিলে যায়, একসাথে আসা যাবে।

ফ্রেশ রুম থেকে বেরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, চারটা কুড়ি। ভাবলাম, উনাকে ফোন দিই। যদি উনার কাজ শেষ হয়। কিন্তু জানা গেলো, আজকে উনার কাজ পড়েছে বেশি। একটু বেশি দেরি হবে। পৌনে পাঁচটা লেগে যাবে। বেশিও হতে পারে।

এইবার পথে নেমে যাই। পথে নেমে দেখি বৃষ্টির ছোটো ছোটো ফোটা পড়ছে। মনে ভাবি: এখন যদি জোর বৃষ্টিটা নামে তবে খবরই আছে।

চিকনগুনিয়ার পর হাঁটতে কষ্ট হয়। নিরুপায় না হলে দশ গজের বেশি হাঁটি না। নিরুপায়ই বটে। ধীরপায়ে হাঁটতে-হাঁটতে কাকলী মোড়ের দিকে এগুলাম। আমি সিএনজির চেষ্টাও করলাম না। সিএনজির ভিতরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাছাড়া যতক্ষণ সিএনজি খুঁজবো ততক্ষণে আমি মহাখালী রেলগেটে চলে যাবো রিকশায়।

হাঁটতে-হাঁটতে আমি যখন কাকলী মোড়ে রাস্তার এক পাশের সিগন্যাল পাড় হয়ে পথের মাঝখানে ভীড়ের সাথে অপেক্ষা করছি বাকি রাস্তা পাড় হবো বলে, তখন আবার গতকালকের সেই পাঠাওয়ের রাইডার ভাইয়ের ফোন।

হ্যালো, আপু, আপনি কি রাইড পেয়েছেন? না, ভাইয়া। পাইনি। কিন্তু বেরিয়ে গেছি। উনি বলেন, ওহ হো! সরি। আমি আপনাকে অপেক্ষা করাতে চাইনি। আমার আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে। তাই, ফোন দিলাম।

একবার ভাবলাম, ফিরে যাবো নাকি? আরেকবার ভাবলাম, নাকি এখানেই অপেক্ষা করবো। উনি এলে উঠে যাবো? কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে। এতোক্ষণ রাস্তায় না দাঁড়িয়ে সামনেই তো রিকশা, মোটে আর কয়েক গজ পথ বেরোলেই হয়। সাত-পাঁচ ভেবে উনাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিলাম।

এদিকে ক্ষুধায় আমার পেটের ভেতরে জ্বলছে। আমার হাইপোগ্লাইসোমিয়ার ধাত। ক্ষুধায় মাথার ভেতর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আর একটু হলেই শরীরে কাঁপুনি শুরু হবে। ব্যাগে চকলেট আছে। পানিও আছে। অন্য সময় হলে রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে খেয়ে নিতাম। কিন্তু আজ ইতস্তত লাগলো। চারিদিকে যত বাড়াবাড়ি দেখছি, খেতে গিয়ে আবার কে না কে ঘাড়ের উপর কী না কী বলবে। তখন মেজাজ হয়তো আমারো বিগড়াতে পারে। তাই, আমি ভাবছি কোনো মতো রাস্তাটা পাড় হয়ে রিকশাটায় উঠলেই হলো। রিকশায় উঠেই খাবো।

কিন্তু রাস্তা পাড় হয়ে দেখি, যেখানে রিকশা লাইন ধরে দাঁড়ায় ওখানে কোনো রিকশাই নেই। মনে মনে হাসলাম। মরফিস ল। এমনি তো হওয়ার কথা।

মনে মনে হাসতে-হাসতে দাঁড়িয়ে রইলাম। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যেই। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করতেও ইচ্ছে হলো না। পাশেই ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। আমি ডালের বড়া কিনে ব্যাগে রাখতে-রাখতে মনে-মনে নিজেকে স্বান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আর কয়েক মিনিট। রিকশায় উঠেই খাবো।

আমার মতো আরো অনেকে রিকশার অপেক্ষা করছেন। একটা রিকশা আসতে দেখলাম। কিন্তু আমার পর্যন্ত আসার আগেই আরেকজন নিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ পর আরেকটা রিকশা আসতে দেখে আমি আগেই দূর থেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইলাম। রিকশাচালক আমাকে খেয়াল করলেন। আমার পর্যন্ত আসতে-আসতে অন্য যারা ডকেছেন তাদেরকে না করে দিয়েছেন। কম অপেক্ষা করতে হয়েছে ভেবে আমি নিজের মনেই পরিতৃপ্ত হলাম।

রিকশায় উঠেই পানি খেলাম। ব্যাগের ভেতর খাবারের প্যাকেট রেখে চুরি করে টিফিন খাওয়ার মতন একটু-একটু করে আমি ডালের বড়া খেতে থাকলাম। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে এরকম লুকিয়ে খেতাম। ক্লাস চলার সময়। শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে। বুড়া বয়সে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্মৃতি মনে এনে দিলো ‘মূর্তি’ নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে উঠা রমজান মাসের ঢাকা।

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিলাম। রিকশাচালক বল্লেন আরো ৫ টাকা দেন। আমি বল্লাম, কেন? উনি বল্লেন, রোজার মাস। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। তাই, এই মাসে ৫ টাকা বাড়াইয়া দিছি।

হয়তো তার মুখের উপর কয়টা ‘ন্যায্য কথা’ শোনানো যেতো। কিন্তু আমি ভাবলাম, সিএনজিওয়ালা তো ৫ টাকা দাবী করে না। ৮০-১০০ বা সময় ভেদে তার চেয়েও বেশি নেয়। দামাদামির সুযোগ নাই। আরো ৫ টাকা ব্যাগ থেকে বের করে দিয়ে রাস্তা পাড় হয়ে আরেক রিকশা নিলাম। সেখানে সারি-সারি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চালক। তাদের সবার মুখে ক্লান্তি, ঘাম। কিশোর থেকে প্রৌঢ়, স্বাস্থ্য ভালো থেকে শীর্ণকায় শরীর— সব চালকের মুখেই সে-কী গভীর ক্লান্তি মাখা।

আমি রিকশায় যেতে-যেতে ভাবি, সব জিনিষের দাম বেড়েছে। কথা সত্য। কিন্তু মানুষের আয় তো বাড়েনি। মধ্যবিত্তের না হয় কোনো মতে চলে। কিন্তু শুধু ডাল চরচরি আর কোনো একটা ভর্তা বা ভাজি দিয়ে এক বেলার আহার সাড়ে যে পরিবার, সেই পরিবারে ডালের বাড়তি খরচটা আসবে কোথ্থেকে? যদি বাড়তি খরচটা না আসে, তাহলে সেই পরিবারে ডাল আর ভুনা-ভুনা থাকবে না। পাতলা হবে। দাম যত বাড়বে ততই পাতলা হতে থাকবে ডালের ঘনত্ব। অতএব, এই রিকশাওয়ালাকে আর ‘ন্যায্য কথা’ শুনিয়ে কী লাভ!

সাত-পাঁচ মাথার মধ্যে ঘুরতে-ঘুরতেই মহাখালীতে রিকশা এসে থামলো। ভাড়া দিয়ে রেললাইন পাড় হয়ে, মেইন রোড পাড় হয়ে রেলগেটের মুখে গেলাম রিকশায় উঠবো বলে। কিন্তু একী! একটাও রিকশা নেই। শুধু দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় জনা পনেরো কি কুড়ি মানুষ। দূর থেকে একটা রিকশা আসতে দেখেই সব মানুষ লম্বা-লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন অন্য সবার আগে রিকশাকে নিজের গন্তব্যে নিয়ে যাবার আশায়। কিয়ৎক্ষণ পরে-পরে রিকশা আসে। একটা-দুইটা করে। তাদের একসাথে ঘিরে ধরে ৫/৭ দশজন অপেক্ষমান পথচারী।

আমিও অপেক্ষমান। কেউ কারওয়ান বাজারে আসতে রাজি হচ্ছে না। অবশেষে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, কী হইছে? আজকে কেউ কারওয়ান বাজার যাইতে চায় না কেন? উনি বল্লেন, ব্যাটারির গাড়ি কারওয়ান বাজারে আসার পথে আটকায়। তাই, ব্যাটারির গাড়ি যাইবো না। পায়ে চাপা রিকশা জিগান।

আমি অপেক্ষা করি। পায়ে চাপা রিকশা বা ব্যাটারি চালিতের বিভেদ না করে আমি সকলকেই নির্বিশেষ আর্জি জানাই: যাবেন? যাবেন? যাবেন? যাবেন? যাবেন? যাবেন? সব উত্তর না।

এই তরিকায় দশ মিনিট যাওয়ার পর ভাবলাম, হাঁটি। সামনে যাই। একটু এগুতেই দেখি যাত্রী নিয়ে একটা রিকশা আসে। চলতির মধ্যেই ওকে হাত দেখিয়ে চেঁচিয়ে বল্লাম, ভাই, কারওয়ান বাজার যাবেন নাকি? গেলে আসেন। সে একটু স্লো করে বল্লো, ৭০ টাকা। আমি দ্বিরুক্তি না করে বল্লাম, আসেন। আমি দাঁড়াইলাম।

আমি হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। যেনো কিছুতেই সে আমাকে ভুলে না যায়। আমিও তাকে ভালো করে খেয়াল করে রাখলাম। হলুদ গেঞ্জি গায়ে ছেলেটা। অন্য রিকশাগুলোর পিছনে দাঁড়িয়েছে। সে ফিরে এলো। আমি রিকশায় উঠতে যাবার সময় রিকশাওয়ালাকে বল্লাম, একটু দাঁড়ান। আমি ওই মেয়েটাকে ডাক দিই।

সাদা জামা পড়া এক তরুণীও আমার মতই অনেক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাবে ফার্মগেট। কিন্তু কোনো রিকশা রাজি হচ্ছে না। এমনকি যেই রিকশা আমাকে নিতে রাজি হয়েছে, সেই চালককেও মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছিল। তাই ভাবলাম, আমার যাবার পথে মাঝখানে মেয়েটিকে কোথাও সুবিধাজনক জায়গায় নামিয়ে দেবো। তারপরে বাকিটা পথের জন্য সে সহজেই রিকশা পাবে।

মেয়েটিকে ডাক দিলাম। তাকে বল্লাম, দেখলাম আপনিও অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। চলুন, কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে নামিয়ে দিই। সে বল্লো, আচ্ছা। আমরা রিকশায় উঠতে যাচ্ছি। এমন সময় চালক হুট করে বল্লো, দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনি আমাকে ভাড়া দিবেন ১২০ টাকা। আমি বল্লাম, আরে নাহ। আপনি ভুল বুঝছেন। উনাকে আমি ফার্মেগেটে নামাতে যাবো না। আমার যাবার পথে মাঝখানে উনি নেমে যাবেন।

উত্তরে সে বল্লো, না, দুইজন নিবো না। আপনারেও নিবো না। এই বলে সে রিকশা নিয়ে টেনে চলে যেতে লাগলো। আমি পেছনে ডাকতে লাগলাম: আরে! আরে! কথা তো শুনে যান!

কার কথা কে শোনে! তাকে ঘিরে ধরেছে আরো অনেক মানুষ। মুহূর্তেই সে আরেক যাত্রী নিয়ে চলে গেলো।

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটিও বোকা বনে গেলো। আমার পাশে দুই তরুণ পথচারী চোখে করুণা নিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারা মনে-মনে আমাকে বেকুব বলেছিল কি-না জানি না। তবে একজন মুখে বল্লো, আপু! আগেই আপনার উঠে পরা উচিত ছিল। তারপর যদি উনাকে ডাকতেন তাহলেই হতো।

যাই হোক। দাঁড়িয়ে রইলাম। রিকশা আসে। আবার আর্জি জানাই: যাবেন? যাবেন? যাবেন? হঠাৎ একজন বল্লো, যাবো। ৮০ টাকা। আমি তার রিকশার হ্যান্ডেল প্রায় ধরি-ধরি নিকটে গিয়ে বল্লাম, এই মাত্র একজন ৭০ টাকায় যেতে রাজি হয়েছিল। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই উনি এমন সজোরে যাবেন না বলে মাথা ঝাঁকান যে, আমার আর দ্বিতীয় কথা বলার সাহস হয় না। একে তো বৃষ্টি পড়ছে। তার উপর দাঁড়িয়ে আছি মেলাক্ষণ। শরীরে বেশি চাপ পড়লে শেষে বাসায় গিয়ে দেখবো, পা ফুলে গেছে। দ্বিরুক্তি না করে রিকশায় উঠি। রিকশায় বসে চালককে বলি, মামা, একটু রাখেন। এই বলে আবার সেই মেয়েটিকে ডাক দিই। ততক্ষণে দেখি সে আরেক চালকের সাথে কথা বলছে। ডাক শুনে জানালো, আপু, আমিও পেয়ে গেছি।

রিকশা চালক বেজায় দ্রুত চালাচ্ছেন। একে তো ভাঙ্গা রাস্তা। তার উপরে সোয়ারীর গতর বলিষ্ঠ না। আমি চালককে আর্জি জানাই, মামা! একটু আস্তে যাবেন নাকি? রাস্তাটা তো খুব ভাঙা। ঝাঁকিটা একটু বেশি লাগে।

মামার উত্তর দেওয়ার টাইম নাই। মামা চালায়। কিছুক্ষণ পরে, আমি ভাবি মামা তো গতি কমালো না। উনি মনে হয় শুনতে পান নাই ঠিক মতন। আবার বলি, মামা, একটু আস্তে যাওয়া যায়? আমার শরীরটা একটু খারাপ আছে তো। ঝাঁকিটা বেশি লাগে।

মামার কোনো উত্তর নাই। একটু পরে, আরো মোলায়েম গলায় বলি, মামা! একটু আস্তে যাওয়া যায় না?

এইবার মামা, উত্তর দেয়। আরে রাস্তাই তো ভাঙ্গা। আস্তে গেলে আর কী অইবো। আমি তার উত্তরে রিকশায় ধরে বসি। আর আরো মোলায়েম গলায় বলি, ঠিক আছে। আপনার যেমনে সুবিধা হয় যান। মনে ভাবি, আরেকবার আস্তে যাইতে বল্লে যদি রিকশা থামিয়ে উনি বলেন, আপনি নামেন। আপনারে নিমু না, তাইলে বিপদ আছে।

যেতে-যেতে আমি ভাবি, অন্য ব্যাটারির রিকশা তো আসতে রাজি হলো না। কিন্তু ইনি কেন রাজি হইলেন? ইনি আবার আমাকে আগেই মাঝপথে নামিয়ে দিবে না তো?

মনে বলি: ও আল্লাহ! যেনো হাঁটতে না হয়।

কারওয়ান বাজারে ঢুকে উনি সোনার গাঁ’র সামনে যাবার রেগুলার রাস্তাটা না ধরে শুটকির আড়ৎ আর চালের আড়তের ভেতর দিয়ে বাঁয়ে যেই রাস্তাটা গেছে সেইটা ধরেন। আমি বলি, মামা! এইটা তো ঘুর-পথ। আপনের তো অহেতুক কষ্ট হবে।

উনি বলেন, ঘুরা হইলে আর কী করা! ওই রাস্তায় জ্যাম। এই রাস্তায় জ্যামের আগে যাওন যাইবো। আমি বলি, যান; আপনের যেমনে সুবিধা। উনি বাজারের শেষ মাথা দিয়ে বের হয়ে আরো বায়ের গলিটা ধরেন। আমি বলি মামা, আপনি তো ডান দিকেই যাইতে পারতেন। উনি বলেন, আপনি বসেন। কোনো অসুবিধা নাই।

উনি গলির মুখে গিয়ে রিকশা থামিয়ে দেয়। আমি বলি, রিকশা থামাইছেন কেন! আমি তো আরো সামনে যাবো। যান। উনি বলে, রিকশা আর যাইবো না। আমি বলি, আপনি কইলেই হইলো! যান। আমি হাঁটতে পারবো না। আমার যেইখানে নামার কথা ওইখানে নামান। উনি বলে, আরে ঝামেলা আছে। আপনি যান। আমি বলি, না। আপনি আরো সামনে যান। আমি হাঁটতে পারবো না।

বাধ্য হয়ে উনি আরেকটু সামনে যান। গিয়ে মোড়ের ১৫/২০ গজ আগে নামিয়ে দেন। আমি হেঁটে রাস্তা পাড় হয়ে তালশ্বাস কিনি।

ওইখানেই দাঁড়িয়ে একটা খাই। আমার খাওয়া দেখে পাশ থেকে এক ভ্যান-ওয়ালা আর এক রিকশাওয়ালা টিপ্পনি কাটে।

আমি রাস্তা পাড় হয়ে সুন্দরবন হোটেলের সামনে আসি। কিন্তু এইখান থেকে ভূতেরগলি যাওয়ার জন্য রিকশাওয়ালার ৫০টাকা ভাড়া শুনে আমার চকিতে মনে হয়, মানুষ যে হঠাৎ ক্ষেপে যায় তারও কারণ থাকে। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করি, ভাই! শেষ কবে ৫০ টাকায় গেছেন! উনি বলে, আজকেই। দুই-তিনবার। উনার উত্তরে আমি লা-জওয়াব। অন্য রিকশা দেখি। একজন ৪০ টাকা বল্লো। তার রিকশায় উঠলাম।
রিকশায় আসতে-আসতে মনটা বড় বিষন্ন হয়ে আসে! এই একটা শহর! পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে যে একটা ধারণা পৃথিবীতে আছে এই বিষয়ে আমাদের কর্তৃপক্ষ বোধহয় মোটেও ভাবতে রাজি নন।

আমাদের দলগুলো ভোট সবার কাছ থেকেই নেয়। কিন্তু উন্নয়ন নীতি করার সময় শুধু অপেক্ষাকৃত সুবিধাপ্রাপ্ত বা ধনীক শ্রেনীর জন্য করেন। পাবলিকের টাকায়, মধ্যবিত্তের টাকায় এই শহরে কেবল একটা নির্দিষ্ট শ্রেনীর জন্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়। আর পাবলিক হচ্ছে গুরুত্বের দিক থেকে তলানীতে বসবাস করা মানুষ। ধনীদের জন্য পূঞ্জিভূত উন্নয়ন থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত আর মধ্যবিত্ত পাবলিকের কাছে যা আসবে তাই তাদের প্রাপ্য। পাবলিককে নিয়ে আলাদা করে তাদের উন্নয়নের জন্য ভাবতে হবে না। কারণ পাবলিক ‘এক’ হতে পারে না।

বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে খুন করে পাড় পায় ড্রাইভার। কারণ তারা ধর্মঘট ডেকে পাবলিককে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে পারে। ভুল চিকিৎসা দিয়ে মানুষকে হত্যা করে, রোগীর আত্মীয়কে মেরে-পিটিয়েও পাড় পায় ডাক্তার। কারণ তারা ধর্মঘট ডেকে পাবলিককে জিম্মি করে দাবি আদায় করতে পারে।

কিন্তু পাবলিক একদাবীতে এক হতে পারে না। তাই, পাবলিকের জীবন একটা অপচয়।

সত্যিই অপচয়। এই দেশে আমাদের টাকা খরচ হয়। কিন্তু সুচিকিৎসা আমরা পাই না। টাকা খরচ হয় কিন্তু বাজারে একটা ভালো ফল আমরা পাই না। টাকা খরচ হয় কিন্তু একটা ভালো গণপরিবহন সেবা আমরা পাই না। কিন্তু এই আমরা ‘আমরা’ হয়ে উঠতে পারি না। আমাদের নিয়ে ভাববে এমন কোনো জনবান্ধব, গণবান্ধব নেতার সাক্ষাতও আজও মেলেনি। ফলে, আমরা পাবলিক। আমাদের বেচে খায় রাজনীতিবিদ। আমাদের বেচে খায় বণিকের দল।

এইসব মাথার ভেতর ঘুরতে-ঘুরতে আনমনা হয়ে রিকশায় বসে আসতে-আসতে হঠাত দৃষ্টি আটকে যায় নর্থ সার্কুলার রোডে এক বিল্ডিং-এর সামনে। ফিরোজা রংয়ের শার্ট পড়া, হাতে প্লাস্টিকের একটা কাগজের ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রৌঢ় এক ভদ্রলোক বিল্ডিংয়ের উপরের দিকের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে গালাগাল করছেন। বলছেন, অ্যাই শয়তানের বাচ্চা! জানালা দিয়া রাস্তার মধ্যে মানুষের গায়ের উপরে পানি ফেলছে কোন্ শয়তানের বাচ্চা! অ্যাই, শয়তানের বাচ্চা। এইগুলা শয়তানের বাচ্চা।

উনার গালাগাল শুনে, বিশেষ করে বারবার বলা ‘শয়তানের বাচ্চা’ গালিটা শুনে হঠাৎ অনিয়ন্ত্রিতভাবে আমার হাসি চলে এলো। একা-একা রিকশায় আমি সশব্দ হেসে ওঠলাম! আমার হাসি এবং ভদ্রলোকের গালাগাল শুনে রিকশাচলক বললেন, আরে কইয়েন না! উপরে থিইক্যা পানি ফালায়। থুথু ফালায়।

আমি উনাকে বল্লাম, ভাই! খালি থুথু না। কাশি, সর্দিও ফেলায়।

একদিন গ্রীন কর্নারের গলি দিয়ে রিকশায় আসার সময় এক বাসা থেকে আমার গায়ের উপর, চুলে এসে পড়লো এক দলা কাশি। রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে আমার দেওয়া টিস্যু দিয়ে সেইসব পরিষ্কার করে দিলেন। আর একলা-একলা গালাগালি করলেন। আরেক দিন, ২০১৩ সালে, ভোর বেলায় আমি ও আমার পতিজী বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে ধানমণ্ডি লেকে হাঁটতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় এক বাসার জানলা দিয়ে আমার গায়ে, মাথায় এসে পড়লো দাঁত ব্রাশ করার পর মুখ ধোয়ার পানির একটা কুলি।

এইসব! এই নিয়েই তো আমাদের বাস! খাদ্য, পুলিশ, ডাক্তার, আইন, শিক্ষা— জীবনের এই মৌলিক জরুরি জিনিষগুলো জনগণের জন্য নিশ্চিত করার কোনো অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ দেশে নেই। তাই, রোজায় জ্যামের ভয়ে এই শহরে পাঠাওয়ের সার্ভিসে যারা বাইক দিয়ে সেবা দেন এমনকি তারাও রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করতে ভয় পান। তারাই উল্টো রিকোয়েস্ট করে বলেন, আপু! রিকুয়েস্ট ক্যান্সেল করে আবার ট্রাই করেন।

এভাবেই আমার মতন যারা পাবলিক তারা আবার চেষ্টা করে। আবার। আবার। আবার। আবার চেষ্টা করে। জীবনভর। আর হয়তো রোজ প্রার্থনা করে, হে ধরণী, তোমার মতন সর্বংসহা করো। হে প্রভু, ধৈর্য দাও। ধৈর্য দাও।

ধৈর্য না ধরলে রোজ রাস্তায় ঝগড়া হবে। ফ্যাসাদ হবে। বিড়ম্বনা হবে। এইসব করতে-করতে জীবনি-শক্তি নাশ হয়। জীবন বিবর্ণ হয়। এই কারণেই যাদের সামর্থ আছেন তারা এই দেশের আইন, পুলিশ, প্রশাষন, ডাক্তার, চিকিৎসা সব নিজের আয়ত্বের মধ্যে নিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিনে নেয়ার চেষ্টা করেন। নিজের ও প্রিয়জনদের জীবনে নিশ্চিন্তি আনার চেষ্টা করেন। ক্ষমতাবান হয়ে উঠার চেষ্টা করেন। নিদেন পক্ষে, ক্ষমতাঘনিষ্ঠ জীবনের অধিকারী হয়ে উঠার চেষ্টা করেন।

আর যাদের না আছে সব কিনে ফেলার সামর্থ, না আছে ক্ষমতার জোর— তারা পাবলিক। রোজ মরে। মরাই তাদের নিয়তি।

এই যেমন আমি কেএসনেটওয়ার্ক নামে যেই ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে সেবা নিই তাদের ঘটনাটাই বলি। মাসে গড়ে ৫ বা ৭ দিন-ও বাসায় আমার নেটে বসা হয় না। সব কাজ ইউনিভার্সিটিতেই হয়ে যায়। বাকি কাজ যেমন নিউজ পড়া, ফেসবুকিং মোবাইলেই হয়। কিন্তু তবু বাসায় ব্রডব্যান্ড-এর কানেকশানটা আছে। একটা ব্যাকআপ। আমার যখন প্রয়োজন হবে তখনই হাতের কাছে ব্যাবহারের বিকল্প থাকে। শুধু অপশান খোলা রাখার জন্য মাসে-মাসে আমি ৮০০ করে বিল দিই। কিন্তু খোদা স্বাক্ষী! যেই ৫/৭ দিন আমি নেটে বসি সেই সময়টাতে-ও কোনো দিন আনইন্টারাপ্টেট আধাঘন্টা ইন্টারনেট পাইনি। আর স্পিডের কথা নাইবা বল্লাম। বারবার লাইন চলে যায়। সেদিন আমি গুনলাম, একঘন্টায় মোট ১৭ বার আমার লাইন চলে গেছে। আর আমি রিকানেক্ট করেছি। এইসব নিয়ে বহু কমপ্লেইন করেও কোনো লাভ হয়নি। অতএব মেনে নাও। কাউকে দেখার কেউ নেই। সবা্ই ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ করছে। এরই মাঝে উন্নয়ের চাকা ঘুরতে-ঘুরতে, ট্র্রিকল ডাউন থিওরির ব্যাখ্যা মোতাবেক, চুঁইয়ে চুঁইয়ে যতখানি আসে ততখানিতেই শুকরিয়া।

অতএব মেনে নেয়া। রোজ মরা। আবার চেষ্টা করা। চেষ্টা করা। চেষ্টা করা। আর কদাচিৎ অধৈর্য হয়ে ওই প্রৌঢ় ভদ্রলোকের মতন গালগাল দেয়া। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দিন শেষে, আমাদের জীবন একটা সিস্টেম লস। বারবার রিকোয়েস্ট পাঠাবো। নেটের ডাটা যাবে। পয়সা যাবে। সময় যাবে। ধৈর্য যাবে। কিন্তু কাজের কাজ হবে না। আমরা না চাইতেই নেমে যাবো আরো আরো গাড্ডায়।

তবু, আমাদের সমন্বিত চেতনায় বাজবে না গান: ‘বি অ্যা র‍্যাবল’। কারণ আমরা দেখেছি, ‘র‍্যাবল’ যারা হয়েছিল; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে দেশ যারা এনেছিল সেই ‘সকল মানুষের’ দেশের দর্শন আর বাস্তবে নাই। সেই কল্পদেশ আজ কাজীর গরু। কিতাবে আছে। বাস্তবে নাই। বাস্তবে খালি আছে-- অপেক্ষা। রিকোয়েস্ট পাঠানো। রিকোয়েস্ট ক্যান্সেল করা। আবার চেষ্টা করা। আবার। আবার। আবার।

২৯.০৫.১৭

মন্তব্য ১৯ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে মে, ২০১৭ রাত ১১:৪৭

দ্যা ফয়েজ ভাই বলেছেন: মনোযোগ দিয়ে পড়লাম।একটি দিনে গন্তব্যে পৌছানোর ভোগান্তি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন।
অফটপিক:আপনার চিকনগুনিয়া হয়েছিলো?এখন সুস্থ রয়েছেন কি?

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৫

আফরোজা সোমা বলেছেন: মন দিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ, দ্যা ফয়েজ।
হুমম। চিকন গুনিয়া ঝাড়া দুইমাস ভোগাইলো। এখনো ব্যাথা আছে। তবে, সহনীয়।

দেরীতে উত্তর দেয়ায় ক্ষমাপ্রার্থী।

২| ৩০ শে মে, ২০১৭ সকাল ৯:৪৮

সারাফাত রাজ বলেছেন: অনেক ধৈর্য সহকারে লেখাটা লিখেছেন। কিন্তু এই লেখার কোন ফল হবে কি? পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নামে যে একটা ব্যাপার থাকতে হয় তা এই শহরের কর্তাব্যাক্তিরা একেবারেই জানে না। আল্লাহ এইসব কর্তাব্যাক্তিদের কঠিনতম বিচার করুন।


আশাকরি আপনি এখন সুস্থ হয়েছেন।
ভালো থাকবেন।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৮

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, রাজ। সুস্থ্য হয়ে উঠেছি।

একদিন এই শহর মানবিক হবে সেই আশায় রইলাম।

ভালো থাকবেন।


বি.দ্র.: দেরীতে উত্তর দেয়ায় ক্ষমাপ্রার্থী।

৩| ৩০ শে মে, ২০১৭ দুপুর ২:২৯

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: খুব প্রয়োজনীয় আলোচনা করা হয়েছে পোষ্টে।
আমি মোবাইলেই নেট চালাই মোবাইলে নেট থাকলে কানেক্ট থাকে। মাসে ছয় থেকে আটশ যায়।

শুভকামনা আপনার জন্য,

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:০১

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ, নয়ন। ভালো থাকবেন।

৪| ৩১ শে মে, ২০১৭ রাত ১:১১

করুণাধারা বলেছেন: দীর্ঘসময় নিয়ে পোস্ট তৈরি করেছেন যাতে এই শহরে প্রতিদিন চলাচলের বিড়ম্বনা খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। এই শহরে পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট এর শোচনীয় অবস্থা, হাটার জন্য ফুটপাত নেই, থাকলেও তা ভাংগাচোরা। এসব যাদের দেখার কথা তারা সম্ভবত রঙিন চশমা পড়ে থাকেন আর আমাদের দুর্ভোগ বোঝেন না। এসব ভাবলে খুব হতাশ লাগে।

সুস্থ হয়ে উঠুন- শুভকামনা।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: চিকনগুনিয়া থেকে সেরে উঠেছি। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন, করুণাধারা।


বি.দ্র.: দেরীতে উত্তর দেয়ায় ক্ষমাপ্রার্থী।

৫| ০২ রা জুন, ২০১৭ ভোর ৫:২০

ফেরদৌসা রুহী বলেছেন: ঝরঝরে বর্নণায় লেখাটা শুরু করে শেষ করতেই হলো। খুব ভালো লিখেন আপনি।
আমাদের নিত্য দিনের ভোগান্তি দেখার কেউ নাই। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা তো নিজেদের লাভ ছাড়া আর কিছু ভাবেনা।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:১৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: সত্যি! আমাদের ভোগান্তি দেখার কেউ নেই!

খুব ভালো থাকবেন। শুভকামনা।

৬| ০৩ রা জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:২৭

ইয়াশফিশামসইকবাল বলেছেন: একজন মহিলা হোয়ে কি ভাবে একজন পর পুরুষের সাথে হোনডা দিয়ে যাবেন!!!!

৭| ০৮ ই জুন, ২০১৭ ভোর ৪:৩৬

সাংবাদিক জুলহাস বলেছেন: আপু আপনার আমার সবার সময় খাইয়া দিলেন! এত প্যাচাইতে যান কে? ছোট করে লিখতে পারেন না?

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:০৩

আফরোজা সোমা বলেছেন: আপনি এতো সুইট কেনো, জুলহাস?

৮| ১১ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:০৩

মুশি-১৯৯৪ বলেছেন:
সুস্থ আছেন জেনে ভাল লাগল আপু। আর আমি র‍্যাবল হতে চাই না। আজকাল কে আর অতীতের জন্য শোক করে, বর্তমানের জন্য ভাবে, ভবিষ্যতের আশাপথ চাহিয়া থাকে।

আর নাগরিক জীবনের সমস্যার কথা বলছেন। তুমি চলিয়া গেলে কি কেউ কি তোমার পশ্চাতে পড়িয়া তোমার জন্য বিলাপ করিতে থাকিবে। তবে উপনিবেশবাদ বা পরশাসন যে কী পরিমাণে আমাদের দেশের ক্ষতিসাধন করেছে, আমাদের ইদানিন্তন শাসক ধনবান শ্রেণী ইহার কারণ জানিবার প্রয়াসও করে না। তাঁহারা পশ্চিমা সাম্রাজ্য শাসকদের সহিত গাঁটছড়া বাধিয়া এই দেশ চালাইতেছেন। ইংরেজ শাসনের পাপ এখন মার্কিন সাম্রাজ্যের তাপে চাপা পড়িতেছে।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:১৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালো থাকবেন, মুশি। অনেক শুভকামনা।

৯| ১২ ই জুন, ২০১৭ দুপুর ১:৫২

বিজন রয় বলেছেন: কেমন আছেন?

আপনাকে ব্লগে কম দেখা যায়।

শুভকামনা রইল।

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:২২

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালো আছি, বিজন রয়। আপনি কেমন আছেন?

ব্লগে আরো বেশি সময় দিতে ইচ্ছে হলেও সময় করে উঠাটা মুস্কিল আরকি।

ভালো থাকবেন।

১০| ২৫ শে জুন, ২০১৭ রাত ৯:১৭

আহমেদ জী এস বলেছেন: আফরোজা সোমা ,




জীবন যখন একটা সিস্টেমলস মাত্র, তখন হাতের কাছের মধুর মূহুর্তগুলি একটিখানি ছুঁয়ে গেলেই তো হয় ......

০৫ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ২:২৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনাকেও ঈদের বিলম্বিত শুভেচ্ছা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.