নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

লিজার হত্যাকাণ্ড: নির্বিকারত্বের ‘স্বাভাবিকতা’ আর কতকাল?

২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১:০২

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। হ্যাঁ। আসাই বলতে পারেন। যার আর কিচ্ছুটি করার নেই, হৃদয়ের ভার লাঘব করতে সে আপনাদেরই স্মরণ নিয়েছে।

বছরে দশের ছোট্ট মেয়ে লিজা। শরীয়তপুরের ভেতরগঞ্জে বাড়ী। তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া এই একরত্তি বালিকাই হয়েছে মর্মান্তিক খুনের শিকার। নিখোঁজ হবার আট দিন পর অর্ধ-গলিত অবস্থায় ক্ষেতের মধ্যে পাওয়া গেছে তার কর্দমাক্ত মরদেহ। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। মৃতদেহের সুরতহাল করতে গিয়ে জানা গেলো, লিজার দেহে হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, লিভার, কিডনি ও জরায়ুর মত প্রত্যঙ্গগুলো নেই।

এই মর্মুন্তত ঘটনার খবর কয়েক লাইন পড়ে আর পড়তে পারিনি। আধ-পড়া অবস্থায় এই সংবাদ পাশ কাটিয়ে গেছি। হ্যাঁ। পাশ কাটিয়েই গেছি। খুনের এই বিবরণ পাঠে গা গুলিয়ে আসছিলো। ভেতর থেকে উগলে আসছিলো সব। গলা রুদ্ধ করে ঠেলে উঠছিলো কান্না।

এইসব খবরগুলো— যা আমাদের নাড়িয়ে দেয়, অস্থির করে তোলে, যা আমরা বইতে অপারগ— সেগুলো আজকাল আমি এড়িয়েই বরং যাই। নইলে খাবার টেবিলে বসলে গলায় ভাত আটকে যায়। অকারনেই চোখ গলে পানি আসে। এসব ঘটনায় মনোনিবেশ করলে হৃদয় বিকল হয়ে যায়; মানসিকভাবে ভেঙে পড়া একটা শরীর টেনে বেড়ানো বড্ড কঠিণ হয়ে ওঠে; ‘ব্যাহত হয় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’।

হয়তো আপনিও আমারই মতন। ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে’ চান না। যেসব খবরে গভীর মনোননিবেশ করলে আপনার চিত্ত অতিসংবেদনশীলতায় ব্যাকুল হয়ে উঠতে পারে সেগুলোকে তাই হয়তো আপনিও সচেতনেই এড়িয়ে যান। আপনারো হয়তো ‘নিত্যদিনকার স্বাভাবিক জীবনকে’ নিরুপ্রদপ রাখারই এক সামান্য বাসনা মনে।

কিন্তু একটা চিঠি এসে আজ ভেঙে দিয়ে গেছে আমার স্বাভাবিকতা। এলোমেলো করে দিয়ে গেছে আমার দিনের কর্মসূচী। চিঠিটা এসে আমাকে জানান দিয়ে গেছে, স্বাভাবিকতার নামে একটা কীটবৎ-অতিসতর্ক-সাবধানী-ভীত-উটপাখিবৎ এক জীবন যাপন করে চলেছি। কী জানি, হয়তো আপনিও তাই। হয়তো সমন্বিতভাবেই আমরা সকলে মিলে রচনা করে চলেছি এই নির্বিকারত্বের ‘স্বাভাবিক’ জগত।

খুনীর ছুড়িতে ফালা-ফালা হওয়া বছর দশের ছোট্ট লিজার ঘটনাটা পড়ে আমার এক আপনজন অন্তরে ভেঙে পড়েছেন। কাতর হয়ে দিশাহারা চিত্তে তিনি আমাকে পাঠিয়েছেন বিপর্যস্ত এক মনের আকূল অনুভূতি। ফেসবুকের ইনবক্সে পাঠানো ইংরেজীতে লেখা সেই চিঠির কিছু অংশ বাংলায় আমি আপনাদের নিবেদন করছি।

“বছর দশের একরত্তি মেয়ে। জানি না, এই ধরনীতে কী ছিল তার অপরাধ। আমরা কেউ জানবো না মৃত্যুর আগে কী ছিল তার শেষ আকুতি। জানি না, সে কোনো দিন আমাদের ক্ষমা করবে কিনা।

. .. তাকে খুন করবার সময় একটিবারো কি খুনিরা তার চোখের দিকে তাকায়নি! ছোট্ট দেহটিকে ফালা-ফালা করার সময় একটুও কি কাঁপেনি তাদের হাত! আমি জানি না. .. আমি সত্যিই জানি না ... আমার হৃদয় কতটা ভারাতুর তা আমি বোঝাতে অপারগ।

.. . ইচ্ছে হচ্ছে, যদি পরকালে ওর সাথে দেখা হয়, তবে ওর কাছে শুনতে চাইবো তার অন্তিম কথামালা! পরকালে দেখা হলে গভীর আলিঙ্গনে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ওকে জানাবো আমার সহমর্মীতা, আর ওর কাছে ক্ষমা চাইবো আমাদের এই নৃশংসতার জন্য।”

আকুল করা এই চিঠির শেষ দু’টি লাইনের বাংলা দাঁড়ায় এরকম: “আমি লেখায় তত পারঙ্গম নই। আমাদের হয়ে তুমি লেখো। যেনো এই লেখা দিয়ে আমরা সকলে সমন্বিতভাবে ক্ষমা চাইতে পারি একরত্তি মেয়েটির বিদেহী আত্মার কাছে; যেনো আমরা ক্ষমা চাইতে পারি ওর রেখে যাওয়া পরিবারের প্রিয় স্বজনদের কাছেও।”

এই চিঠি পড়ে আমার ভেতর রোদন জেগেছে। মনে হয়েছে, কষ্টজাগানিয়া খবরগুলোকে নির্বিকারভাবে আমাদের এড়িয়ে যাওয়ার চর্চাও কি দায়ী নয় এইসব মৃত্যুর জন্য! এই যে উটপাখির মতন বালিতে মুখ গুঁজে থাকছি, কেবলি নিজের ভালোটা দেখে, নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখতে নিজের আত্মাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি রোজ— সেই প্রশিক্ষণের প্ররোক্ষ ফলই কি নয় ছোট্ট এই লিজার খুন!

আজ লিজা গেছে। কাল আর কেউ যাবে। পড়শু অন্য কেউ। যেমন অতিতে গেছে। বিশ্বজিৎ, তনু, রোমেল, ত্বকী, লিমনসহ আরো আরো নাম সব মুছে গেছে খবরের পাতা থেকে। হারিয়ে গেছে আমাদের স্মৃতি থেকেও। আজ ঘটেছে লিজার ঘটনা। কাল আসবে অন্য নতুন লিজার কাহিনী। কিন্তু এইসব মৃত্যুগুলোকে ‘ভাগ্যবিড়ম্বিত’ বলে লেবেল এটেঁ দেয়া কি অন্যায় নয়? এইসব খুন আর অনাচার কি নয় আমাদেরই সমন্বিত উদাসীনতার ফল!

বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোকে আহ্বান করছি। আসুন, লিজার খুনের এই ঘটনাটিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই আপনারা অবস্থান ঘোষণা করুন। এই খুনের বিষয়টিকে পত্রিকার জন্য একটি স্ট্যান্ডিং ম্যাটার হিসেবে ঘোষণা করুন। আজ থেকে যতদিন পর্যন্ত এই খুনের সঠিক তদন্ত না হবে, খুনী ধরা না পড়বে এবং বিচার না হবে ততদিনই প্রতিদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় এককলামে অন্তত এক ইঞ্চি জায়গায় লিখবেন: আজ লিজা হত্যার অততম দিন। আজো খুনী ধরা পড়েনি।

বাংলাদেশের টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলগুলোকেও আহ্বান করছি। আসুন, আপনারাও নিজেদের প্রাইমটাইম নিউজে লিজাকে জায়গা দিন। লিজার জন্য প্রতিদিনের বুলেটিনে বরাদ্দ রাখুন অন্তত দশটি সেকেন্ড। বুলেটিনের ফার্স্টলিডে যাবার আগে সেই দশ সেকেন্ডে বলুন: আজ লিজা হত্যার অততম দিন। আজো খুনী ধরা পড়েনি।


আমাদের সমন্বিত উদাসীনতা ও নির্বিকারত্বের সুযোগে যদি অনাচার বাড়তে পারে, তবে জেনে রাখুন, সমন্বিত প্রতিবাদে এই পরিস্থিতির বদলও ঘটা সম্ভব।

ফালা-ফালা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে কবরে মিলিয়ে গেছে ছোট্ট লিজা। ওর কাছে ক্ষমা চাওয়া বা না চাওয়ায় লিজার আর কিছুই এসে যায় না। মুখ ভার করে কথা না বলে থাকা বা খুশী হয়ে খিলখিল করে হেসে উঠার সুযোগ লিজামণির আর নেই। কিন্তু এই করুণ মৃত্যু, এই জঘন্য খুনের ঘটনায় আমরা কে কী প্রতিক্রিয়া দেখালাম তাতে আমাদের এসে যায়। কেননা আমাদের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া দিয়েই ক্রমাগতভাবে আমরা রচনা করে চলেছি আমাদের সমন্বিত ভবিষ্যত।

লিজার মতন প্র্রাণের অকাল করুণ প্রস্থানে লজ্জায় ও শোকে যেদিন আমরা পতাকা অর্ধনমিত রাখতে পারবো সেদিনই এই দেশ প্রকৃত মানবিক হয়ে উঠবে। আমার কাছে পাঠানো পত্রের সেই প্রেরকের মতন নিজের হৃদয়ের দিকে তাকালেই জানা যাবে, কোথায় আমরা অমানবিকের মতন নির্বিকার আর কোথায় দিচ্ছি ফাঁকি।

আত্মশুদ্ধির প্রথম ধাপ হচ্ছে নিজের পাপ ও অন্যায়কে স্বীকার করে নেয়া। তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আসা এবং মুক্তির পথ খোঁজা।

অতএব আসুন, লিজার এই ঘটনাটিকেও আর দশটি ঘটনার মতন হারিয়ে যেতে না দিই। একরত্তি মেয়ের এই করুণ বিদায়টি যে আমাদের সমন্বিত ব্যার্থতাকেই প্রকাশ করেছে, আসুন, আমরা সেই সত্য স্বীকার করি। স্বীকার করে লিজার জন্য সমবেতভাবে শোকাচ্ছন্ন হই। আর তারপর রাষ্ট্রকে বাধ্য করি লিজার খুনীকে খুঁজে বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে। এইটুকু যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে লিজার কাছে ক্ষমা চাওয়া হবে কেবল একটা বুলি। আর লিজার জন্য এক মুহূর্তের একটা দীর্ঘশ্বাস হবে ফাঁকির নামান্তর।

২৫শ জুলাই ২০১৭


মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১:২৬

চিটাগং এক্সপ্রেস বলেছেন: লিজার খবরটা কি কোন চ্যানেল নিউজ করেছিল। এই ব্লগেই একজনের পোস্ট থেকে লিজার বিষয়টি জানতে পারি।
হিংস্রতা বোধহয় আমাদের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে ।

২৬ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৫

আফরোজা সোমা বলেছেন: হুমম . এই হিংস্রতার কোনো তুলনা চলে না বুঝি।

২| ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ১:৫৬

প্রামানিক বলেছেন: লিজা হত্যার বিচার হওয়া দরকার

২৬ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: জ্বী। নিশ্চয়ই।

৩| ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ২:০৩

অসমাপ্ত কাব্য 21 বলেছেন: ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পরে হত্যা এখন কোনো বিশেষ খবর নয় বরং না ঘটলে সেটাই বিশেষ খবর !
সুযোগ পেলে প্রতিটা মানুষই ধর্ষক কিংবা ধর্ষিতা হয়ে ওঠে ! কারণ মানুষের আত্মা মরে গেছে বিবেক পঁচে গেছে ! আমরা এখন জীবন্ত পঁচা লাশ !

২৬ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: :(

৪| ২৬ শে জুলাই, ২০১৭ রাত ২:১৮

চাঁদগাজী বলেছেন:


২ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল; ঘটনা এখন কি অবস্হায় আছে?

২৬ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:৫৭

আফরোজা সোমা বলেছেন: জানি না।

৫| ২৭ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ৭:১৯

চাঁদগাজী বলেছেন:



আপনি তো ঐতিহাসিক মানুষ, ২০১২ সালে সর্ব-শেষবার কমেন্ট করেছেন!

২৭ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১:২৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: ;)

৬| ৩১ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:১৭

আফরোজ ন্যান্সি বলেছেন: :|

০৬ ই আগস্ট, ২০১৭ সকাল ৯:২৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: :(

৭| ২১ শে আগস্ট, ২০১৭ সকাল ১১:৫৮

লিযেন বলেছেন: X(( X(( X(

২১ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৩

আফরোজা সোমা বলেছেন: :(

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.