নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

মানবীয় সম্পর্কের জটিলতার গল্প ‘ডুব’

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪০


ফারুকীর সাথে দর্শক হিসেবে আমার পরিচয়:


“We can express our feelings regarding the world around us either by poetic or by descriptive means. I prefer to express myself metaphorically.”

আন্দ্রেই তারকোভোস্কির এই বচনখানি দিয়ে, বর্তমানে বাজে রকমভাবে সমালোচিত চলচ্চিত্র, ‘ডুব’ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হতে পারে। রুশ নির্মাতা তারকোভস্কি বলেছেন, তিনি নিজেকে রূপকার্থে তুলে ধরতেই পছন্দ করতেন। আর ডুব দেখে আমার মনে হলো, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজেকে তুলে ধরেছেন কাব্যিকতায়।

ডুব নিয়ে আমার বক্তব্য প্রকাশের আগে কয়েকটি কথা বলে রাখা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।

এযাবৎ, ফারুকী নির্মিত কোনো সিনেমাই আমার বিশেষ ভালো লাগেনি। ব্যাচেলর তো লিবিডো তাড়িত একদল মানুষের অবদমনের চটুল গল্পের কুড়মুড়ে উপস্থাপন। ‘থার্ড পার্সন সিংগুলার নাম্বার’ও সেই থোড় বড়ি খাড়া খাড়া বড়ি থোড়! একা নারীর লড়াইকে ফুটিয়ে তোলার নামে সিনেমাতে যেভাবে, যা দেখানো হয়েছে তাতে লড়াই কতটা এসেছে আর বাতুলতা কতখানি এসেছে তা নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ আছে। ‘টেলিভিশন’ চলচ্চিত্রের গল্পটি সুন্দর। কিন্তু এটিতেও তিশার ঠোঁটের কোণে ভাঁজ ফেলানো অতি ব্যাবহৃত সেই অভিব্যাক্তি; মোশাররফ করিমেরও সেই গৎবাঁধা উপস্থাপন।

অকপটে বলছি, ফারুকীর সিনেমাকে আমার মনে হতো গভীরতাহীন, চটুল, আর বাজার ধরার সিনেমা বানানোর সফল কৌশল। এই অনুভূতির কারণে আর ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ দেখতে যাইনি। কারণ গড়পড়তা ফর্মুলা সিনেমার বাইরে যে কিছু হবে না এমন একটা ধারণা জন্মেছিল মনে। একই ধারণা জন্মেছিলো ডুব সিনেমার ট্রেইলার মুক্তি হওয়ার পরেও। বিশেষত, ডুব-এর প্রচারণার কৌশল হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ এবং তার পরিবারগুলোকে পরোক্ষে সম্পৃক্ত করাটা ভালো লাগেনি। হুমায়ুনকে ঘিরে হাইপ তৈরি করাটাকে একধরণের চাতুর্য বলেই বোধ হয়েছে।

ডুব দেখতে যাবো এমন ভাবনা ছিল না। কিন্তু ডুব মুক্তি পাবার পর প্রথম দুই দিনে ফেসবুকে চোখের সামনে যত মন্তব্য এসেছে তার প্রায় শতভাগই দেখেছি নেতিবাচক। দর্শকদের এতো বিবমিষাভাব আর অসন্তুষ্টি দেখে আমি মনে-মনে যুগপৎ বিস্মিত হয়েছি এবং খটকায় পড়েছি। বিস্মিত হয়েছি এই ভেবে যে, চানাচুরের মতন ক্রিসপি সিনেমা বানিয়ে এতোদিন উপচে পড়া দর্শক হলে টেনেছেন যে ফারুকী, হঠাৎ কী এমন হলো যে, লোকে আর তার সিনেমা নিচ্ছে না! নাকি তিনি লোক টানার মন্ত্র ভুলে গেছেন! আর খটকায় পড়েছি এই ভেবে যে, নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছে। নইলে ফারুকীর মতন চলচ্চিত্রকারের সিনেমা নিয়ে এমন রিভিউ কেন আসবে! কিন্তু ধরতে পারিনি সেই খটকার ব্যাপারটা কী!

তাই, চোখের সামনে ডুব নিয়ে দর্শকদের যেসব মতামত এসেছে, সেগুলো পড়েছি। দর্শকদের অসন্তুষ্টির জায়গাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি। সেই সব নেতিকথা পড়তে-পড়তেই কেনো যেনো মন বলে উঠলো: ফারুকী এবার হয়তো ‘সত্যিকারেই’ একটা সিনেমা বানানোর চেষ্টা করেছেন। হয়তো তেমন সিনেমা, যেমন সিনেমা বানানোর স্বপ্ন তিনি দেখেছেন বহুকাল। নইলে ফারুকীর মতন অভিজ্ঞ, বাজার ভেজে খাওয়া পরিপক্ক একজন পরিচালক তার দর্শক হারানোর ঝুঁকি নিতেন না। হ্যাঁ, নিতেনই না। তার মানে দর্শক হারানোর মত ভয়ানক আশঙ্কাকেও তিনি বাজি ধরেছেন আরো বড় কিছুর জন্য। এই ভেবেই সিনেমাটা দেখার সিদ্ধান্ত নেয়া এবং বসুন্ধরায় গিয়ে সপ্তাহান্তের ছুটিতে, শনিবারে, টিকিট কেটে ঢুকে যাওয়া।

২.
ডুব: ফারুকীর ব্রাহ্মক্ষণ:


ডুব একটি অসাধারণ নির্মাণ।একটি দূর্দান্ত চলচ্চিত্র। সমসাময়িক বাংলা সিনেমায় ডুব একটি মাইলফলক। যত নিন্দাবাক্য আজ ডুবের ভাগ্যে জুটুক না কেন বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ডুবের নাম লেখা থাকবে বাঁক বদলের প্রতিনিধি হিসেবে, এই আমার অনুমান।

সিনেমাটা দেখতে-দেখতে, ফারুকীর প্রতি মনে-মনে একটা শ্রদ্ধা জন্মেছে। ফারুকী ক্রমাগত নিজেকে উত্তরণের চেষ্টা করে গেছেন; নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন; একটা নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাষা তৈরি করার চেষ্টায় রত থেকেছেন; নিজের তৈরি ছাঁচ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরো গভীরতর কিছু করতে চেয়েছেন। এই চেষ্টা প্রশংসা ও সম্মানের দাবী রাখে। সেইসব চেষ্টা ও সাধনারই ফল হলো ডুব-এর মতন নীরবতার চাপকে প্রধান করে সিনেমা বানানোর ব্রাহ্ম মুহূর্তে পৌঁছাতে পারা।

ডুব দেখতে-দেখতে মনে হলো, ফারুকী আগের যত ‘দর্শক হলে টানা’ জাতীয় ছবি বানিয়েছেন সেগুলো করে তিনি আসলে হাত মক্সো করেছেন। তিনি যেভাবে সিনেমায় নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, চলচ্চিত্রের যেই ভাষা তিনি খুঁজে ফিরছিলেন ‘ডুব’ হচ্ছে তার সেই চূড়ান্ত প্রকাশ। নিজের অতল থেকে যে স্থিতধী ফারুকী উঠে এসেছেন তার নাম ডুব।

ডুব নির্মিত হয়েছে মানবীয় সম্পর্কের জটিলতাকে ঘিরে। গল্পটি মূলত বলা হয়েছে এক কন্যার দৃষ্টি দিয়ে। অসম প্রেমের সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের কারণে পারিবারিক ভাঙনের প্রসঙ্গ ডুব-এ এসেছে। কিন্তু এই কাহিনীর অন্যতম প্রধান উপজীব্য এক কন্যার চোখের সামনে তার প্রিয়তম জনক-জননীর সম্পর্কে যোগযোগহীনতা তৈরি হওয়া এবং ক্রমশই অনতিক্রম্য হয়ে উঠা সেই জটিলতা, দূরত্ব ও যোগযোগহীনতাকে শত চেষ্টাতেও জয় করতে না পারার আক্ষেপ ও বেদনা। তাই, মূলত পিতাকে ঘিরে এক ‘বাবা-ন্যাওটা’ কন্যার গভীরতর ভালোবাসা, তীব্র অভিমান আর দু:খবোধের গল্প ডুব।

৩.
‘নিন্দারো কাটা যদি না লাগিল গায়’:


ডুব দেখতে-দেখতে ভাবছিলাম, দারূন এই সিনেমা নিয়ে মানুষের এতো নেতিবাচক কথা, এতো নিন্দা, এতো ছি ছি করার কী কারণ!

ফেসবুকে একজনকে দেখলাম লিখেছেন, ফারুকীর এই সিনেমায় কোনো ডায়লগ নাই। খালি নীরবতা আর নীরবতা। আরেকজন বলেছেন, সিনেমার কিছু দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই তার ভালো লাগে নাই। আরেকজনকে দেখলাম, ডুব সিনেমাকে অত্যন্ত বোরিং বলে বর্ণনা করেছেন।

নিশ্চয়ই একই সিনেমা দেখলেও একেকজন দর্শকের একেক অনুভূতি হবে এতে দ্বিমতের কিছু নেই। আন্দ্রেই তারকোভস্কিও এই সত্য মেনে বলেছিলেন, “A book read by a thousand different people is a thousand different books.”

কিন্তু সিনেমাতে ডায়লগ কম থাকলেই সেটি সিনেমা হয়নি, বাজে কাজ হয়েছে এটি কেমন যুক্তি? কিম কি-দুক-এর ‘স্প্রিং সামার ফল উইন্টার এন্ড স্প্রিং’ যারা দেখেছেন তারা জানেন নিশ্চয়ই যে, সেই সিনেমায় সাকুল্যে কয়টা ডায়লগ আছে! কিন্তু সেই সিনেমাকে ‘খারাপ সিনেমা’ বলার সাধ্যি কার! ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘সাইলেন্স’ বা ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি’ বা আব্বাস কিয়ারোস্তমির ‘টেস্ট অফ চেরি’ যারা দেখেছেন তারাও জানেন, সেই মাস্টারপিসগুলোতেও ডায়লগের ব্যাবহার কত স্বল্প। ডায়লগের স্বল্প ব্যাবহার হওয়া এই সিনেমাগুলো নিজেদের আঞ্চলিক সিনেমায় তো বটেই, বিশ্ব চলচ্চিত্রেও একেকটি মাস্টারপিস বলেই বিবেচিত!

সমসাময়িক যুগের আরেকটি বিখ্যাত স্প্যানিশ ছবি ‘ইউলিয়েটা’। মানবীয় সম্পর্কের জটিলতা, সন্তান ও মায়ের মধ্যে তৈরি হওয়া পাহাড়সম দূরত্ব আর অনন্ত অপেক্ষার গল্প পেড্রো আলমোডোভোর-এর ইউলিয়েটা। বিষন্নতায় ভরা মনোজগতের গল্প বলতে গিয়ে এই সিনেমারো মূল ভাষা হয়েছে মৌনতা।

চলচ্চিত্র গল্প বলে। কিন্তু এই গল্প বলার ভিন্নতাটা তৈরি হয় কে কেমন করে বলে সেটির উপর ভিত্তি করে। তাই, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ‘কী বলা হলো’কেও অনেক ক্ষেত্রেই ছাপিয়ে যায় ‘কেমন করে’ বলা হলো। ‘ওয়াইল্ড স্ট্রেবেরি’ বলুন বা ‘মিরর’ বলুন বা বলুন ‘দি ট্রি অফ লাইফ’ এর কথা-- এইসব সিনেমায় এমন কোনো গল্প বলা হয়নি যা পৃথিবীবাসীর কাছে ছিল একেবারেই অচেনা বা অজানা। বরং এইসব সিনেমাগুলো বিখ্যাত হয়েছে সেই চিরচেনা একাকীত্ব, বিষন্নতা, স্মৃতি তর্পন বা আত্মানুসন্ধানের গল্পগুলো বলার মায়াময় ভিন্নতার কারনে।

ফলে, কেমন করে গল্পটা বয়ান করা হলো, সেই বিবেচনায় ডুব একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র।

আর ‘সিনেমা বোরিং’ লাগা তো সাব্জেক্টিভ ব্যাপার! কারো কাছে বেদের মেয়ে জোছনা বা চাচ্চু ভালোলাগবে। আবার কারো কাছে ভালো লাগবে মাটির ময়না। আবার কাউকে হয়তো দুইটাই আনন্দ দিতে পারে। ভালোলাগার ভিন্নতার মানে এই নয় যে, কেউ উচ্চমার্গের বা কেউ নিম্নমার্গের হয়ে গেলো। এই ভালোলাগার সাথে থাকে দর্শকের অর্থাৎ ব্যক্তির অভিজ্ঞতা ও অভ্যস্ততার সম্পর্ক।

হলিউডি সিনেমার ইতিহাসেই আছে, ক্লাসিক মুভ্যি ‘ব্লেডরানার’,‘ ব্রাজিল (১৯৮৪)’, ‘ফাইট ক্লাব’ মুভিগুলো বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু এই সিনেমাগুলো যে একেকটি মাইলফলক পরবর্তীতে তা স্বীকৃত হয়েছে।

অবশ্য, ক্লাসিক সিনেমার বক্স অফিসে ও দর্শকদের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ার ইতিহাস খুঁজতে আমাদের হলিউডে যাবার দরকার নেই। বাংলা সিনেমার প্রবাদ-পুরুষ অস্কার বিজয়ী সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীই এর প্রকৃষ্ট উদাহরন। পথের পাঁচালী দেখে লোকের মন-না-পছন্দ-হওয়ার মনোভাব সেই সময়ে দর্শক গোপন রাখেনি। তখন ফেসবুক ছিল না বলেই হয়তো আজ আমরা সেগুলো দেখতে পারছি না। ফেসবুক থাকলে হয়তো আমরা পথের পাঁচালীর হ্যাশট্যাগ দিয়ে সার্চ দিলেই যত সব নিন্দা-মন্দ-তাচ্ছিল্য বাক্য-বাণ আজ চলে আসতো আমাদের চোখের সামনে।

আন্দ্রেই তারকোভস্কি একবার তাঁর এক সাক্ষাতকারে সিনেমাকে আর্ট হিসেবে বিবেচনা করা এবং সিনেমাকে বাজারে প্রদর্শন করে লগ্নি তুলে আনার চাপের বিষয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। সেই সাক্ষাতকার হয়তো ইউটিউবে সার্চ দিয়ে কেউ চাইলে বের করে দেখতে পারেন। সাক্ষাতকারটি আমি দেখেছিলাম, তারকোভোস্কির ‘আন্দ্রেই রুবেলভ’ সিনেমার ডিস্কে। সংযোজিত অংশ হিসেবে। তার সেই কথাটির সারমর্মটা অনেকটা এইরকম, আমি স্মৃতি থেকে সারমর্মটা বলছি, সিনেমাকে একটা আর্ট বলা হয়। কিন্তু পরিচালকের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারটা হলো সিনেমা দিয়ে, একই সঙ্গে, পরিচালককে টাকা উসুল করে আনার কথাও ভাবতে হয়। ফলে, টাকা উসুল করে আনার চাপ, প্রডিউসারকে খুশী করার চাপ, হলে দর্শক টানার প্রত্যাশার চাপ-- এসব কারণে একজন পরিচালকের পক্ষে মনের মতন ‘আর্ট’ বা ছবি বানানো একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।

ফারুকির ডুব-এর ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য বলে বোধ হচ্ছে। ডুব হয়তো লোকে গ্রহণ করতে না-ও পারে। হয়তো ব্যাচেলর বা টেলিভিশনের মতন এটি ব্যাবসা সফল না-ও হতে পারে। হয়তো এটি বক্স অফিসে পড়তে পারে মুখ থুবড়ে। কিন্তু বক্স অফিসে সফল হওয়া বা না হওয়ার সাথে একটি চলচ্চিত্র কতখানি চলচ্চিত্র হলো কি হলো না বা চলচ্চিত্রটিতে ‘পোয়েটিক হারমোনি’ দিয়ে কতখানি দ্যোতনা তৈরি করা হয়েছে কি হয়নি-- এর কোনো সম্পর্ক নেই।

ডুব দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তারকোভোস্কির ‘মিরর’ বা ‘আইভান্স চাইল্ডহুড’ বা আকিরা কুরোসাওয়ার ‘ড্রিমস’ বা টেরেন্স মালিকের ‘দি ট্রি অফ লাইফ’-এর কোনো-কোনো দৃশ্য যেমন অবচেতনের ভেতরে ঢুকে বসে আছে, ডুবের অনেক দৃশ্যকে মনে হয়েছে তেমনি অভিঘাত নির্মাণে সক্ষম।


৪.
ডুব: বাংলা চলচ্চিত্রে মাইলফলক:


একটি চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি, সিনেমায় গল্প বলার কৌশল, সম্পাদনা, ব্যাবহৃত শব্দ ও সঙ্গীত, পাত্র-পাত্রীর অভিনয় ইত্যাদিসহ আরো নানান বিভাগ মিলিয়ে সিনেমাটি তৈরি হয়। এই সকল বিভাগ মিলিয়ে ভিন্ন আরেকটি দ্যোতনা অনেক সময়ই অনেক ফিল্ম তৈরি করে বা করতে পারে। আর সেই দ্যোতনাটিকেই ডাকা হয় ‘পোয়েটিক হারমোনি’।

ইঙ্গমার বার্গম্যান-এর ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি’ সিনেমায় একাকী মানুষের অন্তর্জগত আর তার টানাপোড়েন নিপুনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নেচার বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে একটা ঐকতানের মাধ্যমে। এই ঐকতানের ভাষা ভিজুয়াল বিউটি। এই টেকনিকটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু তারকোভোস্কি যখন তার মিরর সিনেমার শুরুর দিকে একটি দৃশ্যে বাড়ির সামনের আঙিনায় অন্যতম মূল চরিত্র নারীকে বসে থাকতে দেখান এবং সেই বসে থাকার সময় সামনের সবুজ ক্ষেত থেকে যেভাবে বাতাস বয়ে আসে সেই দৃশ্যের তুলানাতিত সৌন্দর্য ও অভিঘাত এবং এর কাব্যিক ব্যাঞ্জনা তারকোভস্কির আগে পৃথিবীকে কেউ আর সেভাবে দেখাননি।

ফারুকীর ডুব সিনেমায় বান্দরবানের রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে যথন মায়ার সাথে জাভেদ হাঁটতে বের হয়, তারা যখন সেই সবুজের মধ্যে বসে কথোপকথন করে তখনকার দৃশ্যের যে কাব্যিক ব্যাঞ্জনা বা মায়াকে জন্মদিনের উপহার দেবার জন্য সাবেরী ও তার ভাই যখন আশুলিয়ায় নিয়ে যায় সেখানে যে দৃশ্যগুলো রচিত হয়েছে তা দূর্দান্ত।

চরিত্রগুলোর ভেতরের নৈঃশব্দ, আকুলতা, শূন্যতা, পরস্পরের সাথে নিজেদের যোগাযোগহীনতার বাস্তবতার সাথে সাযুজ্য রেখে ডুব-এর বিভিন্ন দৃশ্য যে প্রতীকি-ব্যাঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়।

মায়া ও জাভেদ হলিডে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পাহাড়ী আঁকা-বাঁকা পথের অশেষ সবুজের ভেতর দিয়ে হাঁটে, বসে, কথোপকথন শুরু করে এবং কথোপকথনের একপর্যায়ে আলাপ তিক্ততায় রুপ নেয়। সেই বিশাল সবুজের পটভূমিকায়, দুইটি ত্যাক্ত মানুষের যোগাযোগহীনতা আর হৃদ্যতা ভেঙে পড়ার সময় চারিদিকে শো শো বেগে তীব্র হাওয়া বয়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ ধরে সেই হাওয়া বইতে থাকে। সেই হাওয়ার মধ্যে, সবুজের মধ্যে পাশাপাশি যোগাযোগহীন বসে থাকে ক্ষদ্র দু'টি প্রাণ-- মায়া ও জাভেদ।

এই দৃশ্যটি কেবলি কাব্যিকতা হিসেবে হাজির করা হয়নি। আমার মনে হয়েছে, মায়া ও জাভেদের জীবনে যে তুমুল ঝড় আসছে, জীবন উলোট-পালট করে দেয়া তুমুল পরিবর্তন আসছে, তারই পূর্বাভাস সেই প্রলম্বিত হাওয়ার দৃশ্য। এই দৃশ্যের মতনই আরো অনেক ভিজুয়াল সাবটেক্সট ফারুকী তৈরি করেছেন ডুব সিনেমায়।

মায়া ও জাভেদ তাদের নতুন বাসার কাজ-কর্মের তদারকী করতে গিয়ে নিতুর ফোন নাম্বার ওয়ান-টু-ওয়ানে সেভ করে রাখা নিয়ে বিতণ্ডাতে মাতে এবং বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায় গাড়ির ভিতরে গিয়ে তারা আরো তিক্ত বাক্যবানে লিপ্ত হয়। তারই একপর্যায়ে জাভেদ গাড়ি থেকে নেমে চলে যায়। লম্বা সময় ধরে লং শটে দেখানো হয় জাভেদের চলে যাওয়া। গাড়ীর ভেতর থেকে জাভেদের চলে যাওয়া দেখে মায়া। জাভেদ যে মায়ার জীবন থেকে চিরতরেই দূরে সরে যাচ্ছে, মায়ার যে কিছুই করার নেই, সে যে কেবলই চেয়ে দেখছে তারই প্রতীকী রূপ হিসেবে এসেছে এই দৃশ্য।

এরপরের একটি দৃশ্যে মায়া যখন কম্পিত হাতে, আত্মবিশ্বাসহীন চিত্তে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে তখনই বোঝা যায়, জীবনে নির্ভর করবার মতন দিন তার ফুরিয়েছে। এখন থেকে নিজের ভার নিজেকেই বয়ে নিতে হবে।

আর দারুণ লেগেছে চরম ঝগড়ার মুহূর্তে ঘরে খাবার টেবিলে পানি পান করতে গিয়ে জগে জাভেদের পানি না পাওয়ার দৃশ্যটি। ‘জীবন যখন শুকায়ে আসে’ তখন তা আসলে সামগ্রিক অর্থেই এমনি করুণ হয়েই আসে। এই যে জগে পানি না থাকা, সেটির এমন মোক্ষম প্রতীকী ব্যাবহার অনেকের জন্য ভবিষ্যতে অনুকরণীয় হবে বলেই বোধ করি।

পানি না পাওয়ার দৃশ্যের কিছু সময় পর জাভেদ চলে যেতে থাকে। এসময় সাবেরী পেছন থেকে বাবার জন্য পানি ভরা গ্লাস নিয়ে দৌড়ে যায়। অদ্ভুত মমতা, জটিলতা, ব্যাকুলতা মাখানো এই দৃশ্য!

পানির গ্লাস নিয়ে দৌড়ে যাবার এই দৃশ্যটা এতো প্রতীকী! এতো যুৎসই! এই একটা দৃশ্য দিয়েই এই পুরো চলচ্চিত্রে সাবেরী চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্যটা ধরা পরে। এই মেয়েটি সব সময় বাবা-মায়ের মরে যেতে থাকা অনাকর্ষনীয় সম্পর্কের গোড়ায় জল ঢেলেছে। চেয়েছে মরা বাগান আবার জেগে ওঠুক। কিন্তু পারেনি। পানি না পেয়ে তৃষ্ণার্ত বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে সাবেরী পানি ভরা গ্লাস হাতে দৌড়ে গিয়েও সে বুঝেছে, ‘জীবন যখন শুকায়ে আসে’ তখন তাতে জল ঢেলে লাভ নেই। আর এই বোধ তাকে ঠেলে দিয়েছে আরো বেশি হতাশায়। এই সিনেমার সাবেরী চরিত্রে তিশার অভিনয় হয়েছে অসাধারণ, দূর্দান্ত।

জাভেদের মৃত্যুর পর টয়লেটের কল খুলে রেখে সাবেরী নিথরের মতন বসে থাকে বাথটাবে। তার চোখে কোনো পানি নেই। কিন্তু দর্শক বুঝতে পারে, বাবার সঙ্গে গভীর বন্ধুতার সর্ম্পক থাকা কন্যা, যে কিনা বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার সময় ফোন পেয়ে অঝরে কেঁদেছে কিন্তু অভিমান ভেঙে কথা বলেনি, বাবার মৃত্যুতে সে আজ মুহ্যমান। অথচ তার চোখে পানি নেই। কিন্তু পরিচালক দেখান, কল ছেড়ে রাখা পানিতে সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছে! কী অসাধারন প্রতীকী রুপায়ন! মনোবেদনার, কান্নার কী ভীষণ গভীরতর প্রকাশ।

জাভেদ চরিত্রে ইরফানের মতন শক্তিমান অভিনেতাকে ভালোলেগেছে। সিনেমা যতই ডিরেক্টরস মিডিয়াম হোক না কেন, সিনেমার ক্ষেত্রে অভিনেতা অভিনেত্রীর তারকাখ্যাতি একটি ব্যাপার। এই সত্য অস্বীকারের উপায় নেই। ফলে, ইরফানের মুখ দিয়ে নির্ভুল বাংলা বের করে আনার সফল প্রচেষ্টাটা ভালো লেগেছে। তবে, ইরফানের উচ্চারণগুলো যে ঠিক নিত্য-নৈমিত্যিক ঘরোয়া বাংলাদেশী বাঙ্গালীদের উচ্চারনের মতন নয় সেটি হাল্কা মনে হতে পারে। এই ক্ষেত্রে ফারুকী হয়তো আরো একটু যতœবান হতে পারতেন।

৫.
দর্শকের গ্রহণ-বর্জন বনাম সিনেমার ‘ভালো’ ‘মন্দ’ তকমা:


ডুব মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সেরা কাজ। আব্বাস কিয়ারোস্তমি বা টেরেন্স মালিক বা কিম কি-দুক দেখে যারা মুগ্ধ হয়েছেন তারা কেন ফারুকীর ডুবকে সমালোচনা করছেন তা আমার বোধগম্য নয়।

সিনেমার যে ভাষা ফারুকী রপ্ত করতে চেয়েছিলেন, যেই সিনেমা নিয়ে তিনি বিশ্ব সিনেমায় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাংলাদেশের সিনেমাকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন প্রতীক্ষার দিন শেষে সেই দিন সমাগত। নিজের বৃত্ত ফারুকী ভেঙেছেন।

আমার ধারণা, এই সত্যটি ফারুকীও উপলব্ধি করতে পারছেন। আর তাই দর্শকেরা তার এই ছবিটিকে ফারুকীর আগের চটুল সিনেমাগুলোর মতন বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে গ্রহণ না করলেও তিনি তাতে মন খারাপ করবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

বাংলাদেশে আবু সাইয়িদ বলে একজন চলচ্চিত্রকার আছেন। তার অন্যতম দারুণ ছবি শঙ্খনাদ। কিন্ত ধারণা করি, সিনেমা হলে এই সিনেমা আড়াই দিনও টিকবে না। তার মানে এই নয় যে, শঙ্খনাদ একটি বাজে সিনেমা। ফলে, ডুব হলে না চললেও আশা করি ফারুকী হতাশ হবেন না।

ফারুকীর যে সব ছোটো-খাটো সাক্ষাতকার এই পর্যন্ত পড়েছি তা থেকে মনে হয়েছে, কেবলি পয়সা উসুল করা সিনেমার পরিচালক হওয়া নয়, বরং ‘গ্রেট’ বা ‘মহান’ চলচ্চিত্রকার হওয়া তার ব্রত। যদিও সেই ব্রতের সাথে তার চটুল সিনেমাগুলোকে বৈপরিত্যপূর্ণ বলেই আমার মনে হতো।


৬.

দর্শক কর্তৃক ডুবকে নিন্দা বনাম ডুবের দৃশ্য বন্দনা


বিংশ শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও মিডিয়া বিশ্লেষক মার্শাল ম্যাকলুহান অলঙ্ঘনীয় এক সত্যের সন্ধান দিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, মাধ্যম নিজেই ঠিক করে দেয় মেসেজ বা বার্তাটা কেমন হবে। অর্থাৎ কোন কথা কিভাবে বলবেন তা মাধ্যমই ঠিক কওে দেবে; আপনি না। যেমন ধরুণ, রেডিওতে আপনি চাইলেও নাচের অনুষ্ঠান দেখাতে পারবেন না বা চাইলেও কোনো দৈনিক পত্রিকায় লাইভ শোনাতে পারবেন না কোনো কনসার্ট। অর্থাৎ একেক মাধ্যমের দাবী আলাদা। সেই দাবী মেনেই আপনাকে গল্প বলতে হবে। তবে, স্ট্রষ্টার মুন্সিয়ানা হলো মাধ্যমের সীমাবদ্ধতার মধ্যেই অশেষ ও অসীমের ঘোর রচনা করা। যেমনটা আমরা করি, মানুষেরা। সীমিত আয়ুর মধ্যে অসীমকে ধরার সাধনা।

মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের ভাষা দৃশ্য। দৃশ্য দিয়েই গল্পটা বুনন করতে হয়। তাই দৃশ্য দিয়ে যে যত নিপুনভাবে এই বর্ণনা দেবেন সেই তত ঘাত তৈরি করবেন লোকের মনে।

ডুব নিয়ে বহু নিন্দা মন্দ হলেও ডুবের দৃশ্যায়ন বিষয়ে শংসা-বচন চোখে পড়েছে। কেউ বলছে, ডুবের কিছু দৃশ্য খুব কাব্যিক। আর কেউ বলেছেন, ডুবের দৃশ্যায়ন ছাড়া আর কিছইু প্রশংসা করার নেই।

কিন্তু কোনো চলচ্চিত্রকার কি তার সিনেমায় এমন কোনো দৃশ্য সংযোজন করেন যা তার সিনেমার গল্পের সাথে বা চরিত্রের বাস্তবতা বা মনোজগতের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়? অর্থাৎ সিনেমাকে বাদ দিয়ে শুধুই অপ্রাসঙ্গিক ভিজুয়াল বিউটি বা দৃশ্যাবলীর সমাহার পরিচালক সিনেমায় সাধারণত করেন না। দৃশ্যই যেহেতু সিনেমার গল্পকে বুনন করার একমাত্র মাধ্যম তাই, এই ক্ষেত্রে বলা হয়, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় দৃশ্যাবলীকে কতো অব্যার্থ এবং কত কাব্যিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হবে সেটিই মূল চ্যালেঞ্জ।

সিনেমায় থাকে ভিজ্যুয়াল সাবটেক্সট। সিনেমার গল্প বা গল্পের কোনো চরিত্র বা চরিত্রের কোনো মনোভাবকে কথায় বা আচার-আচরণে যতটা দেখায়, অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি দেখানো হয় ভিজুয়ালি। অর্থাৎ সিনেমায় যেমন ওভার্টলি গল্পটা বয়ান করা হয়, তেমনি আবার দৃশ্যেও সাবটেকস্টের ভেতর কাভার্টলি কিছু তথ্য গেঁথে দেয়া হয় লেটেন্টে বা অন্ততর্নিহিত গল্প হিসেবে। আর এভাবেই মেনিফেস্টেট ও লেটেন্ট বা প্রকাশ ও অন্তর্নিহিত বয়নের সমন্বয়ে সিনেমায় গড়ে উঠে ভিজুয়াল সাবটেক্সট।

যখন চরিত্রের কথা ও শারিরীক অঙ্গভঙ্গির মতনই আরো গভীরতর অর্থের বাহক হিসেবেই পারিপার্শ্বিক দৃশ্যাবলিও যুক্ত হয় তখন তা হয় একে অন্যের পরিপূরক। যেমন, মায়াকে গাড়ির ভেতর রেখে জাভেদ যখন চলে যাচ্ছে, তার সেই চলে যাওয়া যখন লং শটে দীর্ঘক্ষণ ধরে দেখানো হচ্ছে তখন এই চলে যাওয়া আর গাড়ির ভেতর বসে মায়ার সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার দৃশ্যটি গল্পের গুঢ়তর আভাসবহনকারী। আর এই আভাসবহনের কারনেই এই লংশটটিও মায়া ও জাভেদের মতন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। কারণ লং শটের এই দৃশ্যটি এখানে যাত্রার বিবেকের ভ’মিকা পালন করে।

ধরে নেয়া যাক, জাভেদ ও নিতু সিগেরেট ভাগাভাগি খাবার দৃশ্যটি। বারবার-বারবার-বারবার কওে পরস্পরের হাত বদল করার দৃশ্যটিকে প্রলম্বিত করে এই এক দৃশ্যেও ভেতরেই বলে দেয়া হচ্ছে যে, নিতুর সাথে জাভেদের যে মানসিক দূরত্ব ও আড়ষ্ঠতা ছিল তা ধীওে ধীওে সরে যাচ্ছে, ঘুচে যাচ্ছে; তারা আরো সচ্ছন্দ ও অভ্যস্ত হয়ে উঠছে পরস্পরকে দিয়ে।

ডুবকে বর্ননা করতে গিয়ে এরকম আরো বেশ কিছু সাবটেক্স ফারুকী ব্যাবহার করেছেন। আর তাই, আমি বলবো, ডুবের ভিজ্যুয়াল বিউটি বা দৃশ্যায়নগত সৌন্দর্য যতটা না প্রশংসার দাবীদার তারচেয়েও বহুগুণ প্রশংসার দাবীদার ঘটনা বর্ণণা করতে গিয়ে ডুবে অবলীলায় ব্যাবহৃত কবিতার মতন সুন্দর দৃশ্যগুলোকে অনিবার্যভাবে ব্যাবহার করার মোক্ষম কৌশল।

এতো দারুণ কার্যকরভাবে এমন নিটোল কাব্যিক দৃশ্য দিয়ে ভিজুয়াল সাবটেক্সট তৈরি করে বাংলাদেশী সিনেমায় এইরকম ‘পোয়েটিক হারমোনি’ নির্মাণের উদাহরণ কয়টা আছে?

৭.
ডুব ও হুমায়ুন বৃত্তান্ত:


মানবীয় সম্পর্কের জটিলতার গল্প হিসেবে ডুব অসাধারণ। কিন্ত ডুব কেবলি যে মানবীয় সম্পর্কের যে কোনো একটি গল্প নয়, বাংলাদেশের মানুষের কাছে তা প্রতীয়মান হয়েছে। জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জীবন নিয়ে ডুব তৈরি হয়েছে বলে গুজব রটেছে বা স্বেচ্ছায় রটানো হয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না ডুব হুমায়ুন আহমেদের জীবনীভিত্তিক ছবি। বরং এটিকে বলা যায়, হুমায়ুনের জীবনের সবচেয়ে টুইস্টেট অংশটি দিয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্মিত কাহিনীচিত্র।

লেখক হুমায়ুন যেমন আলোচিত, ব্যক্তি হুমায়ূন-ও মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করে কম আলোচিত নন। সেই আলোচিত ব্যক্তির আরো আলোচিত জীবনাংশ নিয়ে বানানো সিনেমা দেখতে মানুষ হুড়মুড়িয়ে হলে ঢুকবে--এই কি ছিল ফারুকীর ঢাকাই দর্শক হলে টানার কৌশল? এই প্রশ্নের উত্তর পরিচালকের কাছ থেকে জানতে পারলে ভালো লাগতো।

কাহিনীচিত্র হিসেবে ডুব তুলনাতীত সুন্দর। গল্প, গল্পের উপস্থাপন, পাত্র-পাত্রির অভিনয়, কাব্যিক সুষমা সব মিলিয়ে সিনেমাটি দেশের বাইরে যে কোনো উৎসবে উচ্ছসিত প্রশংসিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা আর্ন্তজাতিক পরিসর থেকে ভিন্ন। আন্তর্জাতিক দর্শক হুমায়ূন দিয়ে তাড়িত দর্শক নন। তারা দেখবেন কাহিনীচিত্র। কিন্তু এই দেশে এখনো হুমায়ুনের আগের ঘরে জন্ম নেয়া সন্তানেরা আছেন। হুমায়ুনের বিয়ে করা দ্বিতীয় স্ত্রী বেঁচে আছেন। হুমায়ূনভক্তরা আছেন। হুমায়ূনের জীবনের ঘটনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্মিত কাহিনীচিত্রে নিতু নামের চরিত্রের আবছায়াতে আসলে শাওনকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে দর্শক কারো পরামর্শ ছাড়াই ভেবে নিচ্ছে।

নিতুকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, বাস্তবের শাওনের জন্য তা যদি কেউ অসম্মানজনক মনে করে, তাতে কি খুব একটা ভুল হবে?

ডুব নির্মাণ করা হয়েছে কন্যার দৃষ্টিতে। সেখানে বাবার বিবাহিতা দ্বিতীয় স্ত্রী, যে কি-না আবার কন্যারই সহপাঠী তার প্রতি কন্যার যে ঘৃণা তা যে যুক্তিনির্ভর হবে না, সেটি সহজেই অনুমেয়। সেই হিসেবে, বাস্তবের হুমায়ুন-শাওন ঘটনার আলোকে দেখতে গেলে ডুব একপাক্ষিক কন্যার গল্প। এখানে দ্বিতীয় স্ত্রীর গল্প নেই।

সবসময়ই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ থাকে। তাই দর্শক ভাবছে, বাস্তবের শাওন ও বাস্তবের হুমায়ুনের জীবনের যে রসায়ন, যে প্রেম, যে গভীর মমতা তার ছিটে-ফোটাও এই সিনেমায় নেই।

উপরুন্তু, গল্পের নিতুকে সিডিউসকারী বা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ভালো লোকটাকে প্রেমে ফেলানোকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, এইকথা দর্শক ভেবে নিচ্ছে। এই চরিত্রায়ন বাস্তবের হুমায়ুন-শাওনের সম্পর্কটিকে অসম্মানজনক হিসেবেই একটি ধারণা কি দেয় না?

মনে রাখতে হবে, এই গল্পটি বয়ান করা হয়েছে এক কন্যার আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে। বাবার প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত কন্যা যে বাবাকে নির্দোষ আর নিষ্কলুষ জায়গায় রেখে নিজের বান্ধবীকে কেবলি ‘এটেনশান সিকিং গার্ল’ বলে খারিজ করে দিতে চাইবে এতে কোনো যুক্তি বা প্রমানের দরকার নেই। কিন্তু তার সেই একপাক্ষিক আবেগ আর বাস্তবতা যে এক না-ও হতে পারে সেইটুকু তুলে ধরার সততার বিষয়টি নিয়ে কি পরিচালক হিসেবে ফারুকী আরেকটু ভাবতে পারতেন?

হুমায়ুনকে বিয়ে করে শাওন যে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অপমান, অপবাদ আর গালমন্দ শুনেছেন তার কিয়দংশও আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজ হুমায়ুনকে দেয়নি। শাওন-হুমায়ুনের সম্পর্কের দোষ-গুণ ধরতে গেলে শাওনের চেয়ে প্রাজ্ঞ, বয়স্ক, বয়োজেষ্ঠ্য হুমায়ুনেরই দায়, দায়িত্ব বা দোষ বেশি সেই কথা কখনোই বলেনি এই সমাজ।

ফলে, নিতুরুপী শাওনের আবছায়াকে ডুবে নেতিবাচক, ডমিনেটিং চরিত্র হিসেবে তুলে ধরাটা হুমায়ুনের আগের ঘরের কন্যা বা পরিবার-পরিজনের কাছে গ্রহনযোগ্য হলেও অনেক দর্শকের কাছেই পরিচালকের এই চেষ্টাকে অনৈতিক বলে মনে হলে তাদের বাধা দেওয়ার উপায় কী!

অবশ্য ডুব আর হুমায়ুনের জীবনী নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার সাথে ২০১৪ সালে পাম ডি অর পুরস্কার বিজয়ী তুর্কি চলচ্চিত্রকার নুরি বিলগে সিলন-এর দদরিহঃবৎ ঝষববঢ়”মুভ্যির একটা সাদৃশ্য চোখে পড়েছে। এই সিনেমার কাহিনী নিয়েও এক ধরণের হাল্কা বির্তক আছে।

বলা হয়, রাশিয়ান লেখক আন্তন চেখভের ( Anton Chekhov) ছোটো গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই সিনেমা তৈরি হয়েছে। কিন্তু নুরি বিলগে কখনই এমন বলেননি যে, তার এই সিনেমাটি চেখভের গল্পের এডাপ্টেশান বা তার গল্প নিয়ে সিনেমা বানানো হয়েছে। বরং বিভিন্ন সময়ে আলাপে, বিভিন্নজনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, চেখভের ছোটো গল্প ‘দি ওয়াইফ’ দিয়ে উইন্টার স্লিপ’ বানানোর বহু বছর আগেই তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। পরবর্তীতে চেখভের আরেকটি গল্প ‘এক্সিলেন্ট পিপল’ দিয়েও তিনি উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এই দুইটি গল্পই, বিশেষত, দি ওয়াইফ থেকে নেয়া একটা অনুপ্রেরনা তার মনের মধ্যে ছিল। কিন্তু সিনেমার মূল গল্পটা তৈরি হয়েছে নুরি বিলগে সিলন এবং তার বোনের মধ্যকার বহু দিনের বহু কথোপকথন ও আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে। পরিচালক নিজেই বিভিন্ন সাক্ষাতকারে এই কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কোথাও স্বীকার করনেনি যে, তার সিনেমা চেখভের গল্প থেকে নেয়া বা চেখভের গল্পের এডাপ্টেশান। সেরকমটা না বলার পেছনে কারণ হিসেবে জানা যায়, চেখভের গল্প থেকে নেয়া পরোক্ষ অনুপ্রেরণার কথা কোনোভাবে উল্লেখ করলে দর্শক হয়তো চেখভের গল্পের এডাপ্টেশানের বিষয়টি দেখার প্রত্যাশা নিয়ে সিনেমাটা দেখতে যেতে পারে; যা কোনোভাবেই যথার্থ হবে না বলেই পরিচালক মনে করেছেন।

কী জানি, ডুব-এর ক্ষেত্রেও হয়তো এমনি হয়েছে। ডুবের পরিচালক হয়তো হুমায়ুনের জীবনের নাটকীয় অংশ-- মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করার ঘটনা-- দিয়ে তাড়িত হয়েছেন। মৃত্যুর পর হুমায়ুনের মতন প্রখ্যাত মানুষের লাশ দাফন নিয়ে বর্তমান স্ত্রী ও আগের ঘরের সন্তানদের মধ্যে যে নাটকীয় দ্বন্দ তৈরি হয়েছিল সেই সিনেম্যাটিক ঘটনার ঘাত দিয়েও হয়তো পরিচালক তাড়িত হয়ে থাকতে পারেন। হয়তো সেই ঘটনার ঘাত থেকে তাড়িত হয়েই তিনি বানাতে চেয়েছেন একটা আপাদমস্তক কাহিনীচিত্র ; যে কাহিনীতে হুমায়ুন নেই কিন্তু হুমায়ুনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার ছায়া আছে।

তাই, ডুবকে যদি কেউ হুমায়ুনের জীবনী না ভেবে কেবলি একটি কাহিনীচিত্র ভাবেন তাহলে ডুব একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র। আমি সেভাবেই সিনেমাটি দেখেছি। বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে যারা বুক ভরে গর্ব করতে চান ডুব সেইরকমই এক অনন্য চলচ্চিত্র। যারা কিয়ারোস্তমি, বার্গম্যান বা তারকোভস্কির সিনেমা দেখে-দেখে ভেবেছেন, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকারেরা কবে এমনভাবে গল্প বলতে পারবেন, ডুব তাদের অপেক্ষার অবসান এনেছে।

কাব্যিক সুষমামণ্ডিত ডুব-এর সাফল্য কামনা করি। আর প্রত্যাশা করি, ফারুকীর মতন শক্তিমান ও প্রাজ্ঞ চলচ্চিত্রকার সামনের দিনে এমন চলচ্চিত্র বানাবেন যা দেখে আমরা আনন্দিত চিত্তে বলতে পারবো: তোমাদের আছে কিম কি-দুক-কিয়ারোস্তুমি-পেড্রো আলমোডোভার, আমাদের আছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

৩০.১০.২০১৭

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:০৭

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
চমৎকার রিভ্যিউ, বিস্তারিত উঠে এসেছে আপনার লেখায়
তার পরেও ডুব দেখার স্পৃহা নাই। কেন নাই তা আমি
আমার মতো করে ভাবি বলেই আপনার মতোর সাথে মিলবে না।
টেলিফিল্ম আর সিনেমা দুটো আলাদা স্বাদের। টেলিফিল্ম হিসেবে
এটা সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হতো, অযথা টেনে সিনেমার লেবাজ
পরিয়ে ডুবকে ব্যানানা ইন পায়জামা করা হয়েছে। তবে ওই যে বললেন,
কারো কাছে বেদের মেয়ে জোছনা, আর কারো কাছে মাটির ময়না ভালো লাগবে।
কারণ ভালো লাগার বিষয়টা আপেক্ষিক, আমি পদ্মা নদীর মাঝি ছবিতে আপ্লুত হই
সালমানের টিউবলাইটে নই।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:১৪

আফরোজা সোমা বলেছেন: জ্বী, পথ ও মত আপনা-আপনা।
আপনার মতামতের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

২| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৫

অরূপ দা বলেছেন: চমৎকার।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০২

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটি খুব উপভোগ করলাম।

৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০৩

আফরোজা সোমা বলেছেন: শুকরিয়া।

৪| ৩০ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৭

ক্যারোলাস নিকোলাস বলেছেন: অসাধারন।
না দেখে আর পারা যাচ্ছে না আপনার রিভিউ পড়ে :)
ধন্যবাদ।

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: লেখা পড়ে মতামত জানানোয় কৃতজ্ঞতা। তবে, আমি বলবো, রিভিউয়ে আস্থা রাখার দরকার নেই। হাতে সময় থাকলে, নিজেই দেখে আসতে পারেন।

৫| ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫২

জাহিদ অনিক বলেছেন:


বেশ গুছানো এবং বৃহৎ ।
চমৎকার বিশ্লেষণ।

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১:৪৭

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৬| ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:২৫

মনিরা সুলতানা বলেছেন: ডুবকে যদি কেউ হুমায়ুনের জীবনী না ভেবে কেবলি একটি কাহিনীচিত্র ভাবেন তাহলে ডুব একটি অসাধারণ চলচ্চিত্র। আমি সেভাবেই সিনেমাটি দেখেছি। বাংলাদেশের সিনেমা নিয়ে যারা বুক ভরে গর্ব করতে চান ডুব সেইরকমই এক অনন্য চলচ্চিত্র। যারা কিয়ারোস্তমি, বার্গম্যান বা তারকোভস্কির সিনেমা দেখে-দেখে ভেবেছেন, আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকারেরা কবে এমনভাবে গল্প বলতে পারবেন, ডুব তাদের অপেক্ষার অবসান এনেছে।

আপনার রিভিউ খুব ভালোলেগেছে ।


০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৬

আফরোজা সোমা বলেছেন: পড়ার জন্য এবং মতামত জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা।

৭| ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫২

সুমন জেবা বলেছেন: লেখাটা পড়ছিলাম যখন ! মনে হচ্ছিলো ৩য় আরেকটা চোখ দিয়ে ছবিটা আমি দেখছিও ..
বেশ গুছিয়ে ..উপভোগ করার মতো লিখেছেন আপনি !
আপনার কথাতেই বলি ... ডুব দেখতে যাবো— এমন ভাবনা ছিল না। কিন্তুূ আপনার এই লেখাটা পড়েই সিদ্বান্ত নিয়েছি এই weekend ই কোন দিন ডুব দিব "ডুব" সিনেমায় ।

ধন্যবাদ সুন্দর লেখনী'র জন্য ..

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ৮:৫২

আফরোজা সোমা বলেছেন: সুমন জেবা! অনেক ধন্যবাদ।

ডুব আপনার কেমন লাগলো সেটা যদি জানতে পারি তো আরো ভালো লাগবে। হ্যাপী ওয়াচিং!

ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.