নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রযত্নে, নরসুন্দা নদ

০২ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৪৫

মানুষ পরিচয় চায়। মানুষের। মানুষের পরিচিত হতে হয়। মানুষের সাথে। মানুষের ঠিকুজি-কলুজি থাকতে হয়। থাকতে হয় নাম ও ধাম।

মহাবিশ্বের পরিসরে ক্ষুদ্র এই নীল গ্রহের মানচিত্রের ভেতরে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক দেশে আমার বাস। মহাবিশ্বের পরিসরে ধরিত্রী পৃথিবীই যেখানে তিলেক বিন্দু সম সামান্য একটি ডট হয়ে আছে মাত্র্র, সেখানে আমি কে!

শরৎ-বাবুর গল্পে বর্ণিত গ্রামের মতন পাখির কূজন ভরা নির্জন এক সবুজ গ্রামে আমার মাতুলালয়ে ছিল আমার জন্মের প্রথম ক্রন্দন। সেই নাড়ী পোঁতা ভিটার জন্যে আজো আমার মন কেমন করে।

প্রায় মৃত এক নদের ধারে পিতৃগৃহে বেড়ে উঠেছিলাম। আমার কোষের ভেতর, আমার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে, আমার হিয়ার ভেতর সেই মৃত নদ আজো সজীব হয়ে বয়।

বর্ষায় ঝুম বৃষ্টিতে সেই নদের বুকে আকাশ থেকে নামতো স্বর্গের মায়াবী বৃষ্টি-সুতো। রোদের দিনে ভর দুপুরে সেই নদের বুকে ছলকে-ছলকে উঠা ঢেউয়ে হাজার প্রদীপ জ্বলতো। সেই মরা নদের জন্যে আমার মন কেমন করে। মরা নদের হাওয়ার জন্যে মন কেমন করে।

মন কেমন করার সাথেই কি লেখা থাকে মানুষের প্রকৃত পরিচয়?

পরিচয়। নাম-ধাম-ঠিকুজি-কলুজি। কিন্তু পরিচয় প্রসঙ্গে আজকাল আমার বড় দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। নিজের পরিচয় লিখতে গিয়ে আমি থমকে থাকছি বহুক্ষণ। বলার মতন নিজের কোনো পরিচয় খুঁজে পাচ্ছি না। আর পরিচয় বলে অন্যেরা যেগুলোকে ঠিকুজি-কলুজি হিসেবে নির্দেশ করছেন তাকেও ঠিক যেনো হচ্ছে না আমার মনপুত পরিচয়।

কবি ও লেখক হবার সুত্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও প্রকাশনায় পরিচিতি চাওয়া হয়। কবিকেই লিখে দিতে বলা হয় তার পরিচয়।

কিন্তু পরিচিতির কথা এলেই আজকাল বড্ড খটকা লাগে। কী আমার পরিচয়?

ধরা যাক, আমি রোগী। আমার বুকের বাম পাশে ব্যাথা। যেতে হলো ডাক্তারখানায়। সেখানে আমার পরিচয় ‘চেস্ট পেইনের রোগী’। রোগীর নাম আফরোজা সোমা।

ধরা যাক, কোনো সেমিনারে শিক্ষক পরিচয়ে গেছি কোনো একটা পেপার পড়তে বা পেনেলিস্ট হিসেবে কথা বলতে। সেখানে আমার পরিচয় বক্তা। বক্তার নাম অমুক। তিনি অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের তমুক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।

এই যে রোগ-শোক-সুখ ভেদে দশা-পরিচয়, পেশা-পরিচয় এগুলো আংশিক সত্য। এগুলো দেয়া সহজ। এগুলো অংশত: আমি বটে। কিন্তু এগুলোর মধ্যে আমি পুরোটা নাই-ও বটে।

তাই, কবি বা লেখকের পরিচিতি জানতে চেয়ে যখন লিখতে বলা হয় ‘পরিচিতি’ তখন দিকচিহ্নহীন লাগে।


ধাঁধাঁ কাটাতে আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করি। মানে যারা পরিচিতি লেখার অনুরোধ করেন তাদের কাছেই আমি জেনে নিতে চাই, কত শব্দের পরিচিতি চান? কী কী উল্লেখ থাকবে সেই পরিচয়ে? এসব প্রশ্নের জবাবে ঘুরে ফিরে যে বিষয়গুলো আসে তা মূলত জন্ম, বেড়ে উঠা, পড়া-লেখা, কর্ম-পরিচয়, বই-পুস্তক প্রকাশনা ইত্যাদি।

এসব প্রশ্নের উত্তর সুবোধ শিক্ষার্থীর মতন লিখে দিই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেগুলো পাঠও করা হয়। আমি অমুক। এই আমার নাম-ধাম। এই আমার কর্ম-বৃত্তান্ত। পরিচয় দিয়ে কর্তৃপক্ষ বর্তে চায়। কিন্তু আমার বেদিশা ভাব কাটে না। বরং প্রশ্ন ঘুরতে থাকে মনে, কী আমার পরিচয়?

দশা-পরিচয়, পেশা-পরিচয়, পিতৃ-পরিচয়, বিবাহ-পরিচয় আমারই তথ্য বটে। কিন্তু এই তথ্যের সমাহারই কি আমি? নাকি এটি তথ্যলিপি মাত্র?

সব পরিচয় মুছে গেলেও মানুষ বোধহয় কোথাও বাঁধা পড়ে থাকে। কোনো কোনো পরিচয়ের জন্য মানুষের বোধ হয় মন কেমন করে। আর সেটিই বোধহয় ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয়।


কিন্তু আচার-অনুষ্ঠানের বাঁধা ছাঁচে এই পরিচয় হয়তো দেবার রীতি নেই। রীতি না থাকার কারণে ব্যক্তির যে পরিচয়টির প্রতি ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি আচ্ছন্ন, যেই পরিচয়ের মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে খুঁজে পাই, সেই পরিচয় সবখানেই উহ্য থেকে যায়; থেকে যায় অনুল্লেখ্য।

পরিচয় নিয়ে এতো কথা বিশেষ ভাবে মনে এলো সেদিন। একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। আয়োজকেরা অতিথিদের পুষ্পযোগে বরণ করে নিলেন। অতপর এলো পরিচয়ের ক্ষণ। আমার পরিচিতি, দ্বিধা থরো-থরো মনে যা আমারই লিখে দেয়া, পাঠ শুরু হলো।

পরিচয়লিপি যিনি পাঠ করছিলেন তিনি এবং অনুষ্ঠানে উপস্থিত যারা ছিলেন তারা-ও পরিচিতির একটি অংশে যেনো থামলেন। কারণ আমার পরিচিতির মধ্যে আমি লিখে দিয়েছিলাম, ‘আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া’।

এতো বায়বীয় পরিচয় দেখলে একটু হয়তো কেমন লাগারই কথা বটে।

কিন্তু আমারো তো এইসব ছাঁচে-বাঁধা পরিচিতি লিখতে-লিখতে কেমন লাগে! আমারো তো কেমন লাগে যখন দেখি, আমার বর্নণা আমি দিচ্ছি কিন্তু সেইখানে নরসুন্দা নেই। আমার জীবনী যদি লেখা হয় নরসুন্দা নদের উল্লেখ ব্যাতিরেকে তা তো হবে না আমার জীবনী। তা তো থেকে যাবে আবছা, ধূসর ও অসম্পূর্ণ। তাই, আমাকে যদি কেউ এক লাইনেও আমার একটা পরিচিতি লিখতে বলে, আমার ভেতর থেকে কেউ বলে উঠে, ‘আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া’।

নরসুন্দা কে? এক মৃত নদ। আশৈশব তাকে দেখে বড় হয়েছি। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই নদে ইজের পড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে পানির মধ্যে কাটিয়ে দুই চোখ লাল করে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে বেদম পিটুনি খেয়েছি। এই নদের পাড় ছিল এক সবুজ ক্যানভাস। নদের তীরে কাশের বনে করেছি মাখামাখি। এই নদের শাপলার লতা ও ফুল দিয়ে মালা গেঁথে পড়েছি গলা ও মাথায়। প্রত্যহ প্রভাতে এই নদের হাওয়া মেখে প্রাণে তার তীরে হেঁটেছি আশৈশব।

আমি যে এই নদের বর্ধিত রূপ তা আমি জানিনি। এই মৃত নদ যে আমার পরিচয় তা-ও আমি জানিনি। জানিনি কোনো দিন নুরসুন্দার হাওয়া হয়েই আমি বইছি। জানিনি কোনো দিন, আমার ভেতর দিয়েই নরসুন্দাও বইছে।

তাহলে জেনেছি কখন? জেনেছি ক্রমে। বাড়ি থেকে এই দূর নগরে এসে ক্রমে নিজেকে করেছি আবিষ্কার। দূর নগরে এসে ক্রমে নিজের সাথে হয়েছে পরিচয়। এই দূর নগরে এসে ক্রমে আমি জেনেছি নিজের পরিচয়।

রোগীর পরিচয়ের মতন অধিকাংশ পরিচয়ই সাময়ীক। বুকে ব্যাথা সেরে গেলে আর আপনি নন চেস্ট পেইনের রোগী। অতএব, পরিচয় তামাদি হয়ে যায়। পেশা পাল্টে নিলে সাংবাদিক শিক্ষক হয়ে ওঠে, শিক্ষক উন্নয়ন সংস্থার কর্তা হয়ে যায়।

দেশ-কাল-অবস্থার ভেদে পরিচয় বদলায়। পরিচয় ধ্রুব কিছু নেই।

পরিচয়ের এই ফাঁকি ঘোচাতে গিয়েই কি রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’?

নিশ্চয় করে জানি না উত্তর। তবে, মনে হয়। জমিদার পুত্রের আচকানের নিচে, প্রজা প্রতিপালনের দায়িত্বের আড়ালে, বিশ্বখ্যাত কবির ঈশ্বরসম সমীহ ও ভালোবাসার মধ্যেও নিজের পরিচয়ের ধাঁধাঁ হয়তো ঠাকুরেরো মনে এসেছিলো। হয়তো মনে-প্রাণে তার সকল পরিচয়কে সেই একটি পরিচয়ের সাথেই তিনি গেঁথে নিতে চেয়েছিলেন। সেই চাওয়ারই সারমর্মই বুঝি ছিল “মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক”!

নিশ্চয় করে জানি না যদিও, কিন্ত মনে হয়, সব মানুষই বুকের ভেতর তার নিজের একটা পরিচয় পুষে রাখে।

পরিচয়ের সেই আকুতি থেকেই কি উৎসারিত হয়েছিল মধুসূদনের কপোতাক্ষ বন্দনা? ‘রেখো মা দাসেরে মনে’ বলে তিনি কি তার পরিচয়কেই রাখতে চেয়েছিলেন অমলিন?

প্রায় এক দশক আগে যখন মধুসূদনের প্রাসাদ দেখতে যাই, সেই বাড়ি প্রাঙ্গনে দাঁড়ানোর পর শুধু কপোতাক্ষই আঁকড়ে ছিল আমায়। এই নদের ঢেউয়ে ও হাওয়ায় যার কোষে-কোষে স্মৃতি জমেছে তাকে ভুলিয়ে রাখে পৃথিবীতে আছে কোন সে হিরণ্য নগর! নাই। নাই। তাই দারুণ ভার্সাই নগরীও হেরে যায় সকরুণ সবুজ কপোতাক্ষের কাছে।

এই একই পরিচয়ের টানেই কি জীবননান্দ ফিরতে চেয়েছিলেন ধানসিঁড়িটির তীরে? পরিচয়ের এই মায়ার কাছে ফিরতে চেয়েই কি তিনি ‘কার্তিকের এই নবান্নের দেশে’ ফিরতে চেয়েছিলেন? ‘কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন’ ‘এই কাঁঠাল ছায়ায়’ মানুষ না হোক, অন্তত শালিক হয়েও, ‘ভোরের কাক’ হয়েও তিনি কি আসতে চেয়েছিলেন নিজেরই পরিচয়ের কাছে?


মিসিসিপি নদীকে নিয়ে বব ডিলানের একটি গান আছে। যেখানে তিনি বলছেন, “ইউ ক্যান অলোয়েজ কামব্যাক”। মানে তুমি সর্বদাই ফিরে আসতে পারো।

কিন্তু ফিরে আসতে পারা গেলেও ফিরে যে আসলেই আর আসা হয় না বা যায় না সেই কথাটিও ডিলান বলে দিয়েছেন একি বাক্যে। ডিলানের ভাষায় “বাট ইউ ক্যান্ট কাম ব্যাক ওল দি ওয়ে”।

ফিরে আসা যায়। ফিরে আসা যায় না। সত্যই।

‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’-এর মতন মুখোমুখি বসিবার কপোতাক্ষ বা নরসুন্দা আর ফিরে না। কপোতাক্ষ ও নরসুন্দার কাছেও আমরা অবিকল ফিরতে পারি না আর।

আমরা বাঁধা পড়ে থাকি স্মৃতির কাছে। এই স্মৃতিকেই হয়তো বব ডিলান তার মিসিসিপি গানের শেষ প্যারার প্রথম চরণ দিয়ে খানিক ধরতে চেয়েছেন। ডিলানের ভাষায়, ‘দি এম্পটিনেস ইজ এন্ডলেস’। অশেষ শূন্যতা। অফুরান শূন্যতার অনুভূতি বড্ড শীতল। সেই শীতলতার বর্ণণা দিতে গিয়ে ডিলান বলেছেন, ‘কোল্ড এজ দি ক্লে’।

শীত। শূন্যতার অনুভূতি শীতের মতন। বুকের ভেতরে হিম বয়ে যায়। হিমের ভেতর বসে থাকে ফিরতে না পারার অশেষ শূন্যতা।


তবু, শূন্যতার মাঝেও কিছু রয়ে যায় বুঝি! রয়ে যাওয়ার নামই বোধহয় বন্ধন। রয়ে যাওয়ার নামই বোধহয় পরিচয়।

তাই, যতই খাপছাড়া লাগুক, যতই বেকুবির মতন শোনাক আমার পরিচিতিতে লেখা বাক্য ‘আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া’ আমি এই বেকুবি ভালোবাসি।

সেই নদ নেই। সেই আমি নেই। তবু সে আছে। তবু আমি আছি। আমি তার বর্ধিত রূপ। সে আমার চিহ্নরেখা। তাকে আমি বুকে বয়ে চলি।

কবীর সুমনের গানের কথা ধার করে বলি, “আমাকে পড়লে মনে খুঁজো এইখানে”। এইখানে, এই মরা নরসুন্দার বুকে লেখা আছে আমার পরিচয়। আমাকে পাঠাতে হলে চিঠি খামের উপর আমার নামের নিচে লিখে দিও: প্রযত্নে, নরসুন্দা নদ।

০২ নভেম্বর ২০১৮

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৫৬

রাজীব নুর বলেছেন: মানূষের পরিচয় তার কর্মে।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:২০

আফরোজা সোমা বলেছেন: হুমম। তা বটে।

২| ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:২০

মলাসইলমুইনা বলেছেন: মন খারাপ করে দিলেন তো খুব ! অনেক দিন আগে সেই ছেলে বেলায় যে চিলাই নদীটার বালুকা বেলায় আমরা বন্ধুরা মিলে খেলতাম তার কথা হঠাৎ কথা খুব মনে পড়লো আমার আপনার লেখাটা পরে। এখনো কি স্রোতস্বিনী হয়ে বয় আমাদের প্রিয় চিলাই নদীটা ? কারো কাছেই আর জানতে চাইবার সাহস হয় না ! আজকের শীতের বিষন্ন সকালে একটা উদাসী ভালোলাগা এনে দিলো লেখাটা। অনেক নস্টালজিক ভালোলাগার কথা মনে পড়লো । সুন্দর আপনার এই লেখাটা । খুব সুন্দর ।

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:১৯

আফরোজা সোমা বলেছেন: ভালো থাকুক চিলাই। ভালো থাকুক চিলাইকে বুকে নিয়ে বয়ে চলা প্রাণ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.