নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা

নরসুন্দা নদের হাওয়া

আফরোজা সোমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

মহামারীর দিনগুলি-২: সহাবস্থান

২৮ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:০৮

পাখির ডাকে চারপাশ মুখরিত। দিনমান চলছে। এভাবেই। ভোর থেকে শুরু। তারপর দিনভর । থেকে থেকে পাখিদের ডাক। হ্যাঁ!। ঢাকায়। এই উৎকট শব্দদূষণের শহরে পাখির লাগাতার কূজনে বনবিহারের ভ্রম হয়েছে দুপুর বেলায়।

এরকম পাখির কূজন বাড়িতে ছিল। ভোর থেকে শুরু করে দিনমান কত পাখি ডাকতো! ভোরের পাখি, দিনের পাখি, রাতের পাখি, ঝিঝিঁ পোকা। আহা! শৈশবের দিনগুলি! বাড়ির সামনে নদী বয়ে যেতো। সন্ধ্যা না হতেই চারদিকে জোনাকীর আলোয় যেনো রূপকথা নামতো। আর মাথার উপর থাকতো অজুত-নিযুত তারার হাতছানি।

এখন বাড়িও আর আগের মতন নেই। বাড়ির পরে বাড়ি। খোলা জায়গা নেই। বড় আকাশ নেই। জোনাকীরা সব দল বেঁধে দেশান্তরি হয়েছে। নদীটাকেও খেয়েছে দু’পেয়ে জন্তুর দল। কিন্তু এই রাজধানীর বুকে ভরদুপুরে বিরামহীনভাবে পাখি ডাকছে। নৈশব্দের ভেতর পাখির ডাকাডাকি! ভরদুপুরে আশপাশের অট্টালিকার গায়ে চকচক করছে রোদ। আমার শোবার ঘরের বারান্দা রোদে ভরপুর। এত কড়া রোদ যে, মিনিট কয়েক বসে থাকলেই গা পুড়ে যায় তাপে।

সেই রোদে বসে থেকেছি ঘন্টা দুয়েক। রোদে আমার নেশা লাগে। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে ছুটির দিনেও দিনের বেলায় বারান্দায় যাওয়া যায় না। পাশের ভবনে নির্মাণ কাজ চলছে। সারাদিন সেখানে হল্লা চলে। মানুষের, যন্ত্রের। এর মধ্যে মানুষেরই ত্রাহি ত্রাহি দশা। আর থাক পাখির কূজন!

ইউনিভার্সিটি থাকলে ভোরে উঠি। ছয়টা সাড়ে ছয়টায়। আমাদের ভবনটার পাশেই প্রতিবেশীদের দুইটা আম গাছ, নারিকেল গাছ আছে। আরো কয়েকটা গাছ আছে। একটা বড় ঝাকরা ডুমুর গাছ ছিল। নির্মাণাধীন ভবনের সুবিধার্তে সেটিকে কেটে দেয়া হয়েছে। যেদিন ছেলেটা গাছটাকে কাটছিলো কী যে কান্না লাগছিল আমার! এই গাছটা আমার গত দুই বছরের সঙ্গী। এই গাছে দোয়েল বসতো। শিস দিত। অন্য পাখিরা বসতো। চড়ুই, শালিক, কাক। এখনো ভোরে চোখ খুলেই পাখির কিচির-মিচির শুনতে পাই। বিছানা ছাড়ার আগে মাঝে-মাঝে শুয়ে শুয়ে কয়েক মিনিট কলকাকলী শুনি।

তবে, একটু দেরী করে উঠলেই পাখির ডাকটা আর পাওয়া যায় না। তখন থাকে যন্ত্রের র্ঘঘর, মানুষের হল্লা। এই ২ কোটি মানুষের শহরে গাড়ির শব্দ, এসির শব্দ, ফ্যানের শব্দ, টিভির শব্দ, ফ্রিজের শব্দ, রিকশার শব্দ, মানুষের কোলাহল মিলিয়ে যে সম্মিলিত শব্দলহরী তৈরি হয় এর মধ্যে আর সংখ্যালঘু পাখির কণ্ঠ শুনতে না পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু করোনার নিয়ামত হিসেবে এখন দিনমান পাখির ডাক শুনছি।

মহামারীর কাল। মানুষের জন্য সময়টা বড্ড খারাপ। দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল। ঘরে ঘরে বাঁচা-মরার শঙ্কা। ব্যাবসা-বাণিজ্য বন্ধ। কর্পোরেটদের মাথায় হাত। আর জীবনে যাদের হররোজ রোজা সেই সব দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের কথা তো বাদই দিলাম। ভোগান্তির প্রকৃত চিত্র এখনো সামনে হাজির হয়নি। কিন্ত হবে। ক্রান্তিকাল সমাগত।

এর মধ্যেও আমার একটা আনন্দ কাজ করছে। হয়তো বিষয়টিকে কারো কাছে পৈশাচিকও মনে হতে পারে। তবু সত্যটা স্বীকার করা ভালো।

গত ক’দিন ধরেই আমার মনে হচ্ছে, জননী বসুন্ধরা জিরিয়ে নিচ্ছেন যেনো। যেনো প্রাণ ভরে দম নিচ্ছেন তিনি। মানুষের উৎপাতে পৃথিবী উৎপীড়িত। ধরণীর প্রধান শত্রু মানুষ। মাতা বসুধাকে ড্রিল করে তার অভ্যন্তর থেকে সব বের করে নিচ্ছে পিশাচ মানুষ। গাছ কেটে, নদী মেরে, সাগরের উ্পরে-গভীরে সবখানে সাম্রাজ্য বিস্তার করে ধরিত্রীকে দমবন্ধ করে মারার উপক্রম করেছে এই মনুষ্যগোত্র।

বনের পশু, গাছের পাখি, অরণ্যের গাছ-পালা, প্রান্তরের হাওয়া, সন্ধ্যায় উঠোনে-পুকুর-পাড়ে-রাস্তার ধারে-জঙ্গলে জ্বলে উঠা জোনাক পোকা, এমনকি মামুলি ঘাসের দল কেউ ভালো নেই। মানুষের অত্যাচারে পৃথিবীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সর্বত্র এই শত্রুর সন্ত্রাস। পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানের চক্রটাকেই একেবারে গুবলেট করে দিয়েছে এই সর্বভুক খোক্ষসের দল।

মানুষ প্রকৃতিকে পদানত করতে পারাটাকে তার উন্নতি বলে শিখেছে। প্রকৃতির জঠরের মধ্যে থেকেও তার সাথে সহাবস্থান শেখেনি। মানুষ জৌলুসের পেছনে ছুটেছে। রাজনীতির মারপ্যাঁচ মেরে এক দেশ আরেক দেশকে ঘায়েল করতে শিখেছে। মা প্রকৃতিকে সবচেয়ে পবিত্র মেনে তাকেই সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেবার জন্য মনুষ্য প্রজাতি একজোট হয়ে একই পাটাতনে এসে দাঁড়াতে শেখেনি।

অতএব এই ভালো। এই গণমরণ। এই বিয়োগ ব্যথা, এই কাতারে কাতারে লাশের সারি দেখে যদি তবু মানুষের বোধোদয় হয়। মহামারী যদি এই লোভাতুর প্রজাতির জিভটা কিছু ছেঁটে দিয়ে যায়। এইবার যদি তারা প্লুটুক্রেসি থেকে একটুখানি সরে আসার কথা ভাবে। পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক অগ্রগতির নামে হয়ে আছে কর্পোরটেদের সেবাদাস।

তবে, আশার কথা মহামারীর দিনগুলিতে মানুষ এখন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানোর প্রয়োজন অনুভব করছে। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে নতুন চোখে দেখতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থনীতির জন্য মানুষ নয়, মানুষের সেবা ও কল্যাণের জন্যই অর্থনীতি— এই সত্য পৃথিবীর চিন্তকেরা আবারো জোরেশোরে তুলে ধরছেন। অথর্ব রাজনীতিবিদেরা কর্পোরটেদের সিপাহী হিসেবে কাজ করেছে। তাদের সুরক্ষা দেবার জন্য নীতি নির্ধারণ করেছে। তারা ভেবেছে, ধনীকে আরো ধনী হবার পথ করে দিলে ট্রিকল ডাউন থিউরি মেনে চুঁইয়ে-চুঁইয়ে গরীবের ঘরেও উন্নতি এসে পৌঁছুবে। কিন্তু না। এই পন্থা ফেল করেছে। এই ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করেছেন পৃথিবীর অর্থনীতিবিদ ও চিন্তকেরা।

এই মহামারীতে নগর যখন পুড়ছে, দেবালয়ও আর সুরক্ষা পাচ্ছে না। এখন ধনী-দরিদ্র সমান। গরীবের পর্ণকুটির আর ধনীকের প্রাসাদোপম বাড়ি সবখানেই জীবাণুর অবাধ গতায়াত। ধনীকেরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে কেড়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষের নীল আকাশ। দূষিত করে দিয়েছে বুক ভরে টেনে নেয়ার নির্মল বায়ু। কেড়ে নিয়েছে তারা ভরা রাতের আকাশ। কেড়ে নিয়েছে ভোরে পাখীর কূজন।

এই মহামারী মানুষকে সংঘবদ্ধ করুক। মানুষ আন্তরিকভাবে বুঝুক, সে বাস করছে মা প্রকৃতির জঠরের ভেতর। এই জঠরই প্রকৃত উপাসনালয়। শিবের তিন রূপই মা প্রকৃতির রূপ। তিনিই পালন করেন। তিনিই নাচেন প্রলয় নাচন।

মা প্রকৃতি! অনেক হয়েছে। এবার শান্ত হও। এই মৃত্যু ফিরিয়ে নাও। মৃত্যুর পরিসংখ্যানে চোখ রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠেছে তোমার সন্তানেরা। পৃথিবীতে কান্নার রোল পড়েছে। আমরা পাখির কূজন শুনতে চাই। কিন্তু মৃত্যুর মিছিলের বিনিময়ে নয়। শোকের মাতমের নিচে পাখির কূজন চাপা পড়ে যাবার আগেই এই প্রলয় নাচন থামাও। মহামারীর দিন শেষে তুমি শুধু আমাদেরকে সহাবস্থানের প্রজ্ঞাটুকু দিও, মা।

-----

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৩৫

রাজীব নুর বলেছেন: আমরা ১০ দিন ঘরে আছি।
প্রকৃতি ৪০% পরিশুদ্ধ হয়ে গেছে!

আমরা ১ মাস ঘরবন্দী থাকলে,
পৃথিবী ১০০ বছর পিছিয়ে বিশুদ্ধ হয়ে যাবে

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:২০

আফরোজা সোমা বলেছেন: হুমম। সেটাই।

২| ২৮ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১০:৪৬

নেওয়াজ আলি বলেছেন: উপভোগ্য আলোচনা ।

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:২১

আফরোজা সোমা বলেছেন: ধন্যবাদ।

৩| ২৯ শে মার্চ, ২০২০ রাত ১:২০

আর. হোসাইন বলেছেন: খুবই ভালো লাগলো

০৪ ঠা এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:২১

আফরোজা সোমা বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.