নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সবার কথা

আহমেদ রশীদ

আহমেদ রশীদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শেখ হাসিনা ॥ জীবন পথের জয়ধ্বনি

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:২০



বাঙালী জাতির জীবনে একইসঙ্গে আনন্দ ও বেদনা মিলেমিশে থাকে। জাতির বেদনা এমনই গভীর যে সেই বেদনার ক্ষত এক জীবনে শুকোবে না। আবার এমন অপার আনন্দও আছে, তা তুলনা কোন কিছুর সঙ্গে হবে না। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়কাল ১৯৭১। নতুন পরিচয়ে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য এ জাতিকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। জাতির সেরা সন্তানদের দিতে হয়েছে আত্মাহুতি। রক্তের দামে কেনা আমাদের এ স্বাধীনতার আনন্দের নেপথ্যে অমূল্য করুণ গাথা।

আবার, জাতীয় জীবনের একটি আনন্দের সময় ১৯৮১। সময়টা আনন্দের এ কারণে যে, একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় পেরিয়ে এসে সে বছর জাতি পেয়েছিল এক নতুন দিনের সন্ধান। ১৯৭৫ সালের জাতির জনক নিহত হওয়ার পর থেকে যে অন্ধকার দিনের শুরু, সেই আঁধারের পর্দা সরিয়ে ফেলার দিন ১৯৮১ সালের ১৭ মে, যেদিন বিদেশের মাটি থেকে দেশে ফিরেছিলেন তিনি। বাঙালী জাতির জন্য সেই দিনটি ছিল অতিশয় আনন্দের। সেই থেকে জনমানুষের নেত্রী স্থান করে নিয়েছেন বাঙালীর মানসে। পেরিয়ে গেছে তিন দশক।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মানসকন্যা তিনি। পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের নকসী কাঁথার মাঠ তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র। মানুষ আরাধ্য তাঁর, দীক্ষা কল্যানব্রতে। সেদিক দিয়ে তাঁর লক্ষ্য স্থির। দেশকে স্থান দিয়েছেন সবার ওপরে। দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিকল্প কিছু ভাবেননি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘নূতন ও পুরাতন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা একটি অত্যন্ত জীর্ণ প্রাচীন নগরে বাস করি; এত প্রাচীন যে এখানকার ইতিহাস লুপ্তপ্রায় হয়ে গেছে; মনুষ্যের হস্তলিখিত স্মরণচিহ্নগুলি শৈবালে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে; সেইজন্য ভ্রম হচ্ছে যেন এ নগর মানব-ইতিহাসের অতীত, এ যেন অনাদি প্রকৃতির এক প্রাচীন রাজধানী। মানব-পুরাবৃত্তের রেখা লুপ্ত করে দিয়ে প্রকৃতি আপন শ্যামল অক্ষর এর সর্বাঙ্গে বিচিত্র আকারে সজ্জিত করেছে। এখানে সহস্র বৎসরের বর্ষা আপন অশ্রু“চিহ্নরেখা রেখে গিয়েছে এবং সহস্র বৎসরের বসন্ত এর প্রত্যেক ভিত্তিছিদ্রে আপন যাতায়াতের তারিখ হরিদ্বর্ণ অঙ্কে অঙ্কিত করেছে। একদিক থেকে একে নগর বলা যেতে পারে, একদিক থেকে একে অরণ্য বলা যায়। এখানে কেবল ছায়া এবং বিশ্রাম, চিন্তা এবং বিষাদ বাস করতে পারে। এখানকার ঝিল্লি­মুখরিত অরণ্যমর্মরের মধ্যে এখানকার বিচিত্রভঙ্গি জটাভারগ্রস্ত শাখাপ্রশাখা ও রহস্যময় পুরাতন অট্টালিকাভিত্তির মধ্যে, শতসহস্র ছায়াকে কায়াময়ী ও কায়াকে মায়াময়ী বলে ভ্রম হয়। এখানকার এই সনাতন মহাছায়ার মধ্যে সত্য এবং কল্পনা ভাইবোনের মতো নির্বিরোধে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ, প্রকৃতির বিশ্বকার্য এবং মানবের মানসিক সৃষ্টি পরস্পর জড়িত-বিজড়িত হয়ে নানা আকারের ছায়াকুঞ্জ নির্মাণ করেছে। এখানে ছেলেমেয়েরা সারাদিন খেলা করে, কিন্তু জানে না তা খেলা, এবং বয়স্ক লোকেরা নিশিদিন স্বপ্ন দেখে, কিন্তু মনে করে তা কর্ম। জগতের মধ্যাহ্ন-সূর্যালোক ছিদ্রপথে প্রবেশ করে কেবল ছোটো ছোটো মানিকের মতো দেখায়, প্রবল ঝড় শত শত সংকীর্ণ শাখা সংকটের মধ্যে প্রতিহত হয়ে মৃদু মর্মরের মতো মিলিয়ে আসে। এখানে জীবন ও মৃত্যু, সুখ ও দুঃখ, আশা ও নৈরাশ্যের সীমাচিহ্ন লুপ্ত হয়ে এসেছে; অদৃষ্টবাদ এবং কর্মকাণ্ড, বৈরাগ্য এবং সংসারযাত্রা একসঙ্গেই ধাবিত হয়েছে।’

কবিগুরুর এই কথাগুলো যেন বাঙালীর চিরকালীন ললাট লিখন। সেই ললাট লিখন বদলে দেয়ার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে এক মহীয়সী নারী এই বাংলার মাটিতে পা রেখেছিলেন ১৯৮১ সালে। এ মাটি তাঁর চিরচেনা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর এই মাটির স্পর্শ থেকে বঞ্চিত ছিলেন তিনি। মানুষের সুখস্বপ্নের সঙ্গে নিজেকে নতুন করে জড়িয়ে প্রায় অচেনা মাটিতে পা রেখেছিলেন তিনি। সেই দৃপ্ত পদচারণায় আজ অবধি ছেদ পড়েনি। তিনি অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিকে নিয়ে যান দেশের মানুষকে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশের স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের অংশীদার করতে চান দেশের মানুষকে। মানুষ তাঁর শক্তি। মানুষেই আস্থা প্রোথিত তাঁর।

আবার, তাঁর একটি সবল প্রতিপক্ষ আছে। নেতিবাচক চিন্তার দোসর সেই প্রতিপক্ষ সবসময় নিজেদের অপকর্মকেই সৎকর্ম হিসেবে দেখতে ও দেখাতে চায়। অন্যের ত্রুটি সরবে প্রচার করতে সদা তৎপর এই প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করেই পথ চলতে হয় তাঁকে। পায়ে পায়ে পাথর সরিয়ে, পথের কাঁটা সরিয়ে পাড়ি দিতে হয় বন্ধুর পথ। কিন্তু তারপরও সরব প্রতিপক্ষ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চেঁচিয়ে বলা’ প্রবন্ধটি যেন এই প্রতিপক্ষের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ঐ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আজকাল সকলেই সকল বিষয়েই চেঁচিয়ে কথা কয়। আস্তে বলা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। চেঁচিয়ে দান করে, চেঁচিয়ে সমাজ সংস্কার করে, চেঁচিয়ে খবরের কাগজ চালায়, এমনকি, গোল থামাইতে গোল করে।...

কাজেই বঙ্গসমাজে চেঁচানোটাই চলিত হইয়াছে। পক্ষীজাতির মধ্যে কাকের সমাজ, পশুজাতির মধ্যে শৃগালের সমাজ, আর মনুষ্যজাতির মধ্যে বাঙালী সমাজ যে এ বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে, ইহা শত্রু“পক্ষকেও স্বীকার করিতে হইবে।’

এত বছর পেরিয়ে এসেও আজকের সমাজে এ কথার বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়। একটি প্রবল প্রতিপক্ষ কেবল মিথ্যাচারকে আশ্রয় করে জনস্রোতকে নিজেদের পক্ষে টানার কি প্রবল চেষ্টাই না করছে!

মুখে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিতে যাদের জুড়ি ছিল না, তাদের দৃষ্টিতে উন্নয়ন ধরা পড়ে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, ‘পোলিটিকল ইকনমিটাকে কেবল ঢাকের কাজেই ব্যবহার করা হয়, আর কোনো কাজে লাগে না।’

কিন্তু তার পরও অবিচল তিনি। পারিবারিক ঐতিহ্যকে মেনেই জনক্যলাণের যে ব্রত গ্রহণ করেছিলেন ৩২ বছর আগে, আজও সেই ব্রতসাধনে দৃঢ়চিত্ত। অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করতে শেখেননি, করেন না। সত্যকে সত্য হিসেবে জানেন ও মানেন। মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবেই বিবেচনা করেন। ‘মনুষ্য সমাজের এই অতি বৃহৎ জটিল মিথ্যা-ব্যবসায়ের মধ্যে পড়িয়া সত্যকে অবলম্বন করা আমাদের পক্ষে কী কঠিন ব্যাপার হইয়া পড়িয়াছে। চক্ষের উপরে চতুর্দিক হইতে ধুলাবৃষ্টি হইতেছেÑআমরা সত্যকে দেখিব কী করিয়া! আমরা জš§াবধিই গুটিপোকার মতো সামাজিক গুটির মধ্যে আচ্ছন্ন। অতি দীর্ঘ পুরাতন দৃঢ় মিথ্যাসূত্রে সেই গুটি রচিত। সত্যের অপেক্ষা প্রথাকে আমরা অধিক সত্য বলিয়া জানি। প্রথা আমাদের চক্ষু আচ্ছন্ন করিয়া ধরিয়াছে, আমাদের হাতে পায়ে শৃঙ্খল বাঁধিয়াছে, বলপূর্বক আমাদিগকে চিন্তা করিয়া নিষেধ করিতেছে, পাছে তাহাকে অতিক্রম করিয়া আমরা সত্য দেখিতে পাইÑবাল্যকাল হইতে আমাদিগকে মিথ্যা মান, মিথ্যা মর্যাদার কাছে পদানত করিতেছে; মিথ্যা কথন, মিথ্যাচরণ আমাদের কর্তব্যের মতো করিয়া শিক্ষা দিতেছে। আমরা বলি এক, করি এক; জানি এক, মানি এক। স্নায়ুর বিকার ঘটিলে যেমন আমরা ইচ্ছা করি একরূপ অথচ আমাদের অঙ্গ অন্যরূপে চালিত হয়Ñতেমনি বিকৃত শিক্ষায় আমরা সত্যের আদেশ শুনি একরূপ, অথচ মিথ্যার বশে পড়িয়া অন্যরূপ চালিত হই। প্রথা বলে অন্যায়চারণ করো পাপাচরণ করো তাহাতে হানি নাই, কিন্তু আমার বিরুদ্ধাচরণ করিয়ো না, তাহা হইলে তোমার মানহানি হইবে, তোমার মর্যাদা নষ্ট হইবেÑঅতি পুরাতন মান, অতি পুরাতন মর্যাদা, সত্য তাহার কাছে কিছুই নয়। এই-সকল সহ্য করিতে না পারিয়া মাঝে মাঝে মহৎ লোকেরা আসিয়া মানমর্যাদা, কুলশীল চিরন্তন প্রথা, সমাজের সহস্র মিথ্যাপাশ সকল ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসেন, তাঁহাদের সঙ্গে সঙ্গে শত শত কারাবাসী মুক্তিলাভ করে। কেবল প্রথার প্রিয় সন্তান-সকল বহুকাল শৃঙ্খলের আলিঙ্গনে পড়িয়া জড়শৃঙ্খলের উপরে যাহাদের প্রেম জšি§য়াছে, বিমল অনন্দ মুক্ত আকাশকে যাহারা বিভীষিকার স্বরূপে দেখে, তাহারাই তাহাদের ভগ্ন কারাপ্রাচীরের পার্শ্বে বসিয়া ছিন্ন শৃঙ্খল বক্ষে লইয়া মুক্তিদাতাকে গালি দেয় ও ভগ্নাবশেষের ধূলিস্তূপের মধ্যে পুনরায় আপনার অন্ধকার বাসগহ্বর খনন করিতে থাকে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সত্য-মিথ্যা ’ প্রবন্ধের এই কথাগুলো যেন তাঁর জীবনে সত্য হয়েই দেখা দিয়েছে। তারপরও তিনি কঠিন সত্যকে ভালবেসে সত্যকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছেন। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এই সমাজ-ধাঁধার মধ্যে পড়িয়া আমি সত্যের দিকে দৃষ্টি স্থির রাখিতে চাই। যেমন নানারূপে বিচলিত হইলেও চুম্বকশলাকা সরলভাবে উত্তর দিকে মুখ রাখে।...’ কারণ, ‘... চারিদিকের জটিলতা-সকল ছিন্ন করিয়া সমাজকে সরল করিতে হইবে। মানুষের চলিবার পথ নিষ্কণ্টক করিতে হইবে। সংশয় ভয় ভাবনা অবিশ্বাস দূর করিয়া দিয়া দুর্বলকে বলিষ্ঠ করিতে হইবে।’ (সত্য-মিথ্যা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, ‘আমাদের জাতি যেমন সত্যকে অবহেলা করে এমন আর কোনো জাতি করে কি না জানি না। আমরা মিথ্যাকে মিথ্যা বলিয়া অনুভব করি না। মিথ্যা আমাদের পক্ষে অতিশয় সহজ স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছে। আমরা অতি গুরুতর এবং অতি সামান্য বিষয়েও অকাতরে মিথ্যা বলি।’ সেই মিথ্যা ও অপপ্রচারের জাল ভেদ করে তিন দশকেরও বেশি সময় যিনি নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন বাংলার মানুষের কল্যাণে, তিনি শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা আজ বাঙালীর শীর্ষনেত্রী। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করেছে। এক সময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতির ‘ইমার্জিং টাইগার’।

আজ তাঁর জš§দিন। জš§দিনে তাঁকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এই দিনে জাতির পক্ষ থেকে একটিই চাওয়া আমাদের, আগামী দিনেও তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ ধরে রাখবে জঙ্গীবাদমুক্ত ইতিবাচক ইমেজ। সেই সুস্থ-সুন্দর বাংলাদেশের আগমনী সুরই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শারদীয় বাঁশির সুরে। কবিগুরুর ভাষায়Ñ



‘সেই বাঁশিতে শুনতে পাবে

জীবন-পথের জয়ধ্বনি

শুনতে পাবে পথিক রাতের

যাত্রামুখে নূতন প্রাতের

আগমনী।’

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.