![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অবশেষে সবই ঝরে যায়/সময়ের হলুদ হাওয়ায় স্মৃতিমাত্র লিখা থাকে নাম/সেইখানে আমিও ছিলাম...
::: প্রথম পর্ব ::::
বিপি স্কুলের হেড স্যারের নাম ছাত্ররা রেখেছে ডুগি স্যার। নামের সার্থকতাও মারাত্মক। কারণ তার শরীরের অধিকাংশ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোল। বিশেষ করে ভুঁড়িটা বেশ আকর্ষণীয়। হাঁটার সময় ভুঁড়ি দুলতে থাকে। তার মুখটাও ভুঁড়ির মতোই অদ্ভুতরকম গোল। চোখ দুটো সে তুলনায় ছোট। নাক বলতে দুটো ফুটো আছেÑ এই যা।
ডুগি স্যারের আসল নাম নজরুল ইসলাম। বাবা-মা খুব আদর করে বিদ্রেহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে মিল রেখে নামটা রেখেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি কাজী নজরুলের পুরো উল্টো। বিদ্রোহী কবির ঝাঁকড়া চুল থাকলেও তার পুরো মাথা টাক। কানের ওপর কয়েক গোছা সাদা মেঘের মতো কিছু চুল ঝুলে আছে। বাম পাশের এক গোছা চুল ডুগি স্যার বড় করেছেন। সেই চুলে চুপচুপা করে তেল দিয়ে বাঁ পাশ থেকে টাকের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ডান পাশে আঁচড়ে আনেন। চার-পাঁচটা চুল দিয়ে টাক ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টার মানে কী কে জানে!
মজার ব্যাপার হচ্ছে ডুগি স্যার দেখতে গোল হলেও তার বুদ্ধি বেশ লম্বা। ছাত্রদের একবারে টাইট করে রেখেছেন। আড়ালে ডুগি বলুক আর ডুগডুগিই বলুক, কেউ এই স্কুলের নিয়মের বাইরে যেতে পারে না। বিশেষ করে পড়াশোনাতে কোনো ছাড় নেই। প্রশ্ন তিনি নিজের হাতে মডারেট করেন। পরীক্ষায় নকল করলে তার জন্য এক বিশেষ উন্নতমানের শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। কোত্থেকে কটকটা কালো টুপি এনে স্কুলের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছেন। সেই টুপির নাম দিয়েছেন ‘গাধার টুপি’। শুধু নামে গাধার টুপি না, সেই টুপিতে সাদা ফেব্রিক্স দিয়ে বড় বড় করে লেখা ‘গাধার টুপি’।
ডুগি স্যার এই টুপি কোথায় থেকে জোগাড় করেছেন কে জানে। কেউ নকল করলে গাধার টুপি পরিয়ে পুরো স্কুল সাত পাক দেয়াবেন। পাক দেয়ার সময় সেই ছাত্র কান ধরে বার বার বলবেÑ আমি গাধা, আমি গাধা। এখানেই শাস্তি শেষ না। স্কুল গেটে দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকবে। রাস্তা দিয়ে কেউ গলেই জোরে চিৎকার করে বলবে, আমি গাধা, আমি গাধা।
এমন লজ্জার মধ্যে সর্বশেষ যার শাস্তি হয়েছিল তার নাম মুকুল। এই এলাকার সবচেয়ে বড় উকিলের ছেলে। তার উকিল বাপের মাথায় নানান প্যাঁচ থাকলেও মুকুলের মাথায় কিছুই নেই। বরং সে গাধার টুপি মাথায় দিয়ে বেশ খুশি। অবনকে ডেকে বলল, আয় আমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলবি।
অবন সরু চোখে তাকাল। বাচ্চা গাধা বলে কী? কিন্তু মুকুলের তেমন ভাবাবেগ নেই। সে বলল, ঠিক আছে তুই না তুলতে চাইলে বাদ দে।
আজকের সমস্যাটা এই মুকুলকে নিয়ে। শুধু যে সমস্যা তা না। মহা সমস্যা। কারণ মুকুলের মোবাইলটা বেশ দামি। উকিল সাহেব নাকি মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ স্কুলে আসার পর থেকে মোবাইলটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলে এই নিয়ে বেশ তোলপাড়। ডুগি স্যার তিন নম্বর বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। পড়া না পারলে কিংবা ফেল করলে গাধার টুপির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু চুরির শাস্তি কী হতে পারে? এটা তিনি ভাবেননি।
স্কুলে চুরি যে এর আগে হয়নি তা না। এক ছাত্র অন্য ছাত্রের কলম চুরি করেছে। খাতা টেনে ছিঁড়েছে। বড় জোর পঞ্চাশ-একশ’ টাকা চুরি করেছেÑ এমন রেকর্ড আছে। তবে চুরির শাস্তি দিত খগেন স্যার। তার শাস্তির ধরনও ছিল বিচিত্র। যেহেতু তিনি ছিলেন গণিতের শিক্ষক, তাই শাস্তি দিতেন জ্যামিতিক পদ্ধতিতে। সমকোণী ত্রিভুজের তিন কোণের সমষ্টি একশ’ আশি ডিগ্রি। এ কারণে চুরির শাস্তি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমে ডান হাতে তিন নম্বর বেত মারা হবে। দ্বিতীয়ত কানমলা, কানমলা দেবে ক্লাসের সব ছাত্র একবার করে। কানমলা দেয়ার সময় বলবেÑ তুই চোর। এরপর নীলডাউন। এই শাস্তি চলবে একশ’ আশি মিনিট।
ইদানীং এই শাস্তিতে একটু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সরকার থেকে কঠিন ঘোষণা দেয়া হয়েছে, কোনো ছাত্রকে শারীরিকভাবে মারা যাবে না। এ কারণে শাস্তি কীভাবে শুরু হবে এই নিয়ে খগেন স্যার চিন্তিত ছিলেন। অবশেষে তিনি শাস্তিতে পরিবর্তন আনলেনÑ ত্রিভুজের যে কোনো দুই বাহুর সমষ্টি তৃতীয় বাহু অপেক্ষা বৃহত্তম। এই পদ্ধতিতে প্রথম দুই বাহুর সমষ্টি বের করতে তিনি কানমলা এবং নীলডাউন শাস্তি অপরিবর্তিত রাখলেন। তার মতে, এই দুই শাস্তি শারীরিকভাবে কার্যকরী এবং মানসিকভাবে লজ্জা পেলে ছাত্রদের উন্নতি ঘটবে। তৃতীয় শাস্তি হিসেবে তিনি একশ’ ইম্পরট্যান্ট অঙ্ক দিতেন। যেগুলো তাকে সাত দিনের মধ্যে তিনবার করে কষে দেখাতে হবে। তিনি এসব অঙ্কের মধ্যে ছোট্ট একটা পরীক্ষা নেবেন। যদি কোনো ভুল করে তাহলে একশ’ অঙ্ক আবার কষতে হবে।
আজকের সমস্যাটা ভিন্ন। কারণ খগেন স্যার স্কুলে নেই। তিনি গেছেন বোর্ড থেকে খাতা আনতে। বাধ্য হয়ে ডুগি স্যার তিন নম্বর বেত নিয়ে ক্লাসে এলেন। সবাই নিশ্চুপ। তিনি বেত দিয়ে ইশারায় মুকুলকে ডাকলেন। মুকুল ভয়ে দুই ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছে। স্যার বেত ঘুরিয়ে বলল, কী চুরি গেছে? মোবাইল?
হুম।
হু কীরে, বল জি।
জি স্যার।
দেখতে কেমন?
সেটটা দামি ছিল। মালয়েশিয়া থেকে আনা। রঙ ছিল সাদা।
এত দামি সেট নিয়ে স্কুলে আসার দরকার কী? এখনকার বাবা-মায়েরা ছাত্রদের নষ্ট করে ছাড়বে।
মুকুল মাথা নিচু করে আছে। ডুগি স্যার দফতরি বাবলুকে দিয়ে সব ছাত্রের ব্যাগ চেক করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু মোবাইল কোথাও নেই।
চিন্তিত ডুগি স্যার বেত উঁচিয়ে বললেন, এত বড় একটা সেট হাওয়ায় গায়েব হয়ে যাবে এটা তো ভাবনার বিষয়। স্কুলের রেপুটেশন খারাপ হবে। না না, এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি কাকে শাস্তি দেবেন এটাও ঠিক বুঝতে পারছেন না। কারণ বিনা দোষে ছাত্রদের শাস্তি দেয়াটা বিরাট অন্যায়। শিক্ষক হিসেবে তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাই একজন আদর্শ শিক্ষকের ধর্ম। তিনি কী করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।
মিরন উঠে দাঁড়াল। বলল, স্যার, সেটটা অবন নিয়েছিল।
অবন নিয়েছিল মানে।
আমি ওর হাতে দেখেছিলাম।
অবন উঠে বলল, স্যার ওটা তো আমি দেখার জন্য নিয়েছিলাম। আর মুকুল আমাকে দেখতে দিয়েছিল।
স্যার মুকুলের দিকে তাকাল। মুকুল বলল, হ্যাঁ স্যার সেটটা আমি অবনকে দেখিয়েছিলাম। কিন্তু ওটা ও দেখেই ফেরত দিয়েছে।
ডুগি স্যার রাগী চোখে মিরনের দিকে তাকালেন। ছেলেরা ইদানীং মিথ্যে বলায় ওস্তাদ হয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ না। এতে শিষ্টাচার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ছেলেদের শিষ্টাচারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
ইদানীং সামাজিক পরিবর্তনটা এত বেড়েছে যে কোনো কিছু কন্ট্রোলে রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। মিরন নামের ছেলেটা ইদানীং খুব বেড়েছে। বাজারের পেছনে বেলতলায় বেশ ক’দিন তাকে সিগারেট খেতে দেখা গেছে। ব্যাপারটা তার বাবাকে জানানো দরকার। এই বয়সে সিগারেট খুব ভালো কথা না। এটা একেবারে নিষিদ্ধ কাজ। মহান আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির প্রথমে গন্দম ফল নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় দুনিয়াতেও অনেক কিছু নিষিদ্ধ করেছেন। সিগারেট সেই নিষিদ্ধের তালিকায় এক নম্বরে। অথচ কিনা তার স্কুলের এক ছেলে সিগারেট টানছে। কী ভয়াবহ কথা! এই ছেলে অন্য ছেলেদের নষ্ট করবে। আর নষ্ট জিনিসটা গরুর চোনার মতো; আশিমণ খাঁটি দুধের মধ্যে এ ফোঁটাই যথেষ্ট। তিনি বিষয়টা নিয়ে মিরনের বাবার সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু সময় আর সুযোগ মিলছে না। যদিও গত সপ্তাহে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। কারণ সামনে ইলেকশন। ইলেকশনের আগে তিনি কত বড় জনদরদী? কত বড় শিক্ষানুরাগী এটা প্রমাণ করা জরুরি। যদিও বিষয়টাতে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। কিন্তু কমিটির সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার তার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড স্যার আজিজ সাহেব নাকি এমপি সাহেবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে চলেছেন। গত সপ্তাহে চার কেজি ওজনের বিলের শোল মাছ এমপি সাহেবকে দিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য তাকে হটিয়ে হেড স্যারের চেয়ারটা দখল করা। শিক্ষকদের এমন নৈতিক অধঃপতন তিনি একেবারেই মেনে নিতে পারছেন না। বুকের বাম পাশে ইদানীং ব্যথা হয়।
ডুগি স্যার প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার পদ নিয়ে চিন্তিত না। কিন্তু তার দৃষ্টিতে আজিজ সাহেব শিক্ষক নামের কলঙ্ক। এমন একজন কলঙ্কিত শিক্ষকের হাতে বিপি স্কুলের দায়িত্ব তুলে দেয়া যায় না। এটা হাজার হাজার ছাত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা। তিনি ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারবেন না। শিক্ষক হবেন নির্লোভ, আত্মসম্মানবোধ হতে হবে প্রখর। শিক্ষক শিক্ষকই, শিক্ষক কেন মাথা নোয়াবেন? এসব বিষয় ভাবলে তার মুখ তিতা হয়ে আসে। একজন শিক্ষকের নৈতিক অবক্ষয়ের সঙ্গে মুখ তিতার কী সম্পর্ক তিনি তা খুঁজে পান না। স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক কুদরত-ই-খোদা স্যারকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে হবে।
স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ক্লাসে এসে এমন অন্যমনস্ক তিনি কখনো হননি। এটা কেন হলো? না না, ছেলেরা কী ভাববে? এটা ফাঁকিবাজি। ফাঁকিবাজ শিক্ষকের কাছে ছাত্ররা ভালো কিছু শিখবে কী করে? না না, এটা ঠিক হয়নি। তিনি বিব্রতমুখে তাকিয়ে আছেন।
একজন উঠে বলল, স্যার ঘণ্টা পড়ে গেছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই তো? কিন্তু মোবাইলটার তো কোনো গতি হলো না। স্কুলে চুরি। এটা তো ভালো কোনো কথা না।
স্যার মিহির চাচাকে ডাকলেই সমস্যা সমাধান।
ডুগি স্যার চমকে উঠলেন। মিহির আলী অবনের বাবা। মূলত সে সাপুড়ে। অনেকে বলে কালো জাদুকর। নানান তন্ত্র-মন্ত্র পড়ে। আগে তিনি এসব বিষয় নিয়ে ভাবতেন না। বিশ্বাসও করতেন না। তবে মিহির আলীর বিষয়টা ভিন্ন। বিশেষ করে ঝালুনের বিষয়টার পর মিহির আলীর বিষয়ে তার আর কোনো সন্দেহ নেই। লোকটা জানে, সত্যিই জানে। যদি তার কালোজাদু মানুষের কল্যাণের জন্য হয় তাহলে তা খারাপ কী?
স্যার মিহির চাচাকে কি খবর দিবো?
ডুগি স্যার আবারো চমকে উঠলেন। এই ছাত্রের নাম তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। শিক্ষক হিসেবে এটা অত্যন্ত লজ্জার কথা। তিনি অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু নামটা মনে করতে পারলেন না। কিছুটা লজ্জিত ভঙ্গিতেই বললেন, অবন।
জি স্যার।
তোমার বাবাকে কাল আসতে বলো।
ঠিক আছে স্যার।
তোমরা যাও। আমি একটু বসে থাকি।
ছাত্ররা চিৎকার করতে করতে বের হয়ে গেল। একমাত্র ছুটির সময় ছাত্রদের এই উল্লাস শিক্ষকের খারাপ লাগে না। স্কুলজীবনের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছুটির ঘণ্টা। চিৎকার করে ক্লাস থেকে বের না হলে পুরো আনন্দটাই মাটি।
ছুটির বিষয়টা সত্যিই কি আনন্দময়? মানুষ কী সত্যিই ছুটিতে আনন্দ পায়? যে মানুষ ভালো কাজ করে, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে সে অবশ্যই শান্তি পায়। মহান আল্লাহ পাক মানুষকে ভালো কাজের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।
ডুগি স্যার মনের অজান্তেই চক দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর লিখলেন ‘মৃত্যু’। নিমিষেই তিনি ডুবে গেলেন ভাবনায়। এই অবধারিত সত্যকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা সবার নেই। তারপরও সবাইকে মেনে নিতে হয়। মৃত্যুর পর আসলে কী হয়? কেমন লাগে? কেউ জানে না। কারণ কেউ এখন পর্যন্ত ফিরে আসেনি। আসবেও না কখনো।
কিন্তু কেউ যদি মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে আসে তাহলে সে বদলে যায়। তাহলে কি যারা মৃত্যুর মুখোমুখি হয় তারা আজরাইল দেখতে পায়? ঝালুনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কারণ সে টানা আঠারো ঘণ্টা কবরে ছিল।
অবশ্য ঝালুনের বিষয়টা একটু অস্বাভাবিক। খরকা বিলে সবার সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। গর্তের ভেতর থেকে সবাই মাছ ধরে। সেও মাছ ধরছিল। কিন্তু হঠাৎই সাপে কামড়ে দেয় তাকে। পানি সাপ না। একেবারে জাত সাপ। বিলের গর্তে জাত সাপ থাকার কথা না। তারপরও ঘটনাটা কীভাবে ঘটল কে জানে।
ঝালুনকে পাঁজাকোলা করে স্কুল মাঠে আনা হলো। এলো জিল্লু ডাক্তারও। শক্ত করে পা বাঁধা হলো। প্রাথমিক চিকিৎসাও করা হলো। কিন্তু বিষ তার পুরো শরীরে উঠে গেছে। বিশেষ করে মাথায়। এ কারণে জিল্লু ডাক্তার আর কোনো কিছু করতেই পারল না।
বিকেলে সদর হাসপাতালে ঝালুনকে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু তাকে মৃত ঘোষণা করে তারা। ঝালুনের মা মাটি কামড়িয়ে কাঁদতে থাকে। সন্ধ্যায় ঝালুনের দাফন করা হয়।
মিহির আলী ফেরে পরদিন দুপুরে। সে গিয়েছিল কামরূপ-কামাখ্যায় গুরুর সঙ্গে দেখা করতে। এসেই সে ঝালুনের ব্যাপারটা জানতে পারে। এসেই বলে ঝালুন মরেনি। যে সাপে ওকে কেটেছে সে সাপের নাম বিষ কেউটে। এই সাপে কাটলে বিষ শরীরের নিচের দিক থেকে জমতে থাকে। রোগী কোমায় চলে যায়।
যে মেয়ের দাফন হয়ে গেছে তাকে কবর থেকে মিহির আলী তুলতে চায়। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। এলাকার অনেকেই বিষয়টাতে নারাজ। কালো জাদুকর, ঠকবাজ, ভেল্কিবাজ হিসেবে অনেকেই মিহির আলীর ওপর ক্ষ্যাপা ছিল। অনেকের ধারণা এসব কালোজাদু ভেলকির খেলা, পুরোটাই ঠকবাজির বিষয়।
অবশেষে এলাকার মুরব্বি জসি হাজী এলেন। তাকে সাত গ্রামের মানুষ মান্য করে। তিনি বললেন, এমন না যে কবর থেকে মুর্দা তোলা যাবে না। আর মিহির আলী তো শুধু চিকিৎসা করতে চাইছে। চেষ্টা করতে দোষ কী?
জসি হাজীর মুখের ওপর কথা বলে এমন কেউ নেই। তাই ঝালুনের লাশ তোলা হলো। অবাক করা ব্যাপার, ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মিহির আলীর ওষুধ আর মন্ত্রের বদলে ঝালুন উঠে বসল। সমস্যা একটাই ঝালুনের ডান হাতের বুড়ি আঙুল নেই। মনে হচ্ছে কেউ কামড়ে খেয়ে ফেলেছে।
এই ঘটনার পড় ঝালুনের মাঝে অদ্ভুত পরিবর্তন আসে। সে কারো সঙ্গে কথা বলে না। হঠাৎ দু’একটা বললেও তা ঠিক কথা বলা পর্যায়ে পড়ে না।
বাবলু ক্লাসে এসে অবাক হয়ে তাকাল। তার হাতে তালা-চাবি। সে ক্লাসরুম বন্ধ করতে এসেছে। বলল, স্যার আপনি এখনো একা একা বসে আছেন?
ডুগি স্যার কিছুটা চমকে উঠলেন। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তিনি এতক্ষণ অন্য ভুবনে ছিলেন। ইদানীং তিনি প্রায়ই গভীর ভাবনায় ডুবে যান।
স্যার কি আরো খানিকক্ষণ বসবেন?
না। চলে যাব।
বাইরে তো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ছাতা এনেছেন?
না। হুট করে বৃষ্টি আসবে এটা তো জানা ছিল না। তা তোমার কাছে কি ছাতা হবে?
না। তবে ওলকচুর পাতা আছে। ওটা মাথায় দিয়ে বাড়ি যেতে পারেন।
না না, ওটা ঠিক হবে না। ছেলেরা হঠাৎ দেখে ফেললে প্রধান শিক্ষক হিসেবে মানসম্মান থাকবে না।
তাহলে স্যার এখন কী করবেন?
তুমি কি গরম গরম শিঙ্গাড়া আর চায়ের ব্যবস্থা করতে পারবে?
পারব স্যার।
তাহলে এক কাজ করো, ক্লাস রুম বন্ধ তরে অফিসরুমে আসো। গরম গরম শিঙ্গাড়া খেয়ে তবেই বাড়ির দিকে রওনা দেই।
বাবলু ওলকচুর পাতা মাথায় দিয়ে ভাঙা কেতলি হাতে বের হয়ে গেল। ডুগি স্যারের মনটা উদাস হয়ে আছে। স্কুলে তিনি কড়া নিয়ম-কানুনের ব্যবস্থা করেছেন। তারপরও চুরি হচ্ছে। তাহলে কি তিনি ছেলেদের সুশিক্ষা দিতে পারছেন না। মহানবী (সা.) তো চুরির শাস্তি হাত কেটে দিতে বলেছেন। ওই নিয়মটা প্রতিষ্ঠা করা গেলে সমাজের চুরি একেবারে বন্ধ হয়ে যেত। আফসোস আমরা ভালো নিয়ম মানতে চাই না।
বৃষ্টি এখন একটু থেমেছে। বৃষ্টির পর হালকা ঠা-া একটা বাতাস ছেড়েছে। শরীর জুড়ানো বাতাস। ডুগি স্যারের ইচ্ছে করছে ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে কাদা-পানিতে মাছ ধরে। এমন বৃষ্টিতে যে মাছটা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তার নাম চ্যাং মাছ। এই মাছটা অবশ্য অনেকেই খায় না। কিন্তু ডুগি স্যারের বেশ পছন্দ। বেশ বলদায়ক মাছ। অবশ্য টাঁকি মাছটাও বেশ পাওয়া যায় এমন ঘোর বৃষ্টির পর।
বাবলু চা নিয়ে ফিরেছে। তবে গরম শিঙ্গাড়া পায়নি। তবে সে চিতই পিঠা নিয়ে ফিরেছে। সঙ্গে শুঁটকি ভর্তা। ভয়াবহ ঝাল। ডুগি স্যার মাগরিবের নামাজ শেষ করলেন। নামাজের পর মনটা কেমন জানি সতেজ সতেজ লাগে।
স্যার শিঙ্গাড়া পাইনি।
চিতই পিঠাও ভালো? যদিও চায়ে চিনি বেশি দিয়ে ফেলেছে। বেশি মিষ্টি চা শরবত শরবত মনে হয়।
স্যার, শরবতও খারাপ জিনিস না।
তা ঠিক বলেছ।
স্যার চা-টা আনতে কেন তেরি হলো জানেন?
না।
এই চায়ের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। বলেন তো কী স্যার?
বলতে পারছি না। তুমিই বলো।
স্যার বৃষ্টির পানি দিয়ে চা-টা বানানো।
বাবলু বৃষ্টির পানির স্পেশাল চা এনেছে। সে চাচ্ছে স্যার যেন এই চায়ের প্রশংসা করে। কিন্তু ডুগি স্যারের কোনো প্রশংসার কথাই মনে পড়ছে না। ‘চা মারাত্মক হয়েছে, বহু বছর পর পারফেক্ট একটা চা খেলাম। বৃষ্টির পানির চা কখনো খাইনি। এবারই প্রথম খেলাম।’ এমন কোনো কথা কি সে বলবে? ঠিক বুঝতে পারছে না। তিনি বললেন, বাবলু তোমার এক চাচাত ভাই আছে না, সে সম্ভবত সৌদি আরব থাকে।
জি স্যার। তের বছর হইছে।
ওর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
আছে স্যার। আগের চাইতে যোগাযোগ বাড়ছে।
হঠাৎ যোগাযোগ বাড়ল কেন?
স্যার মোবাইলের যুগ না। এখন তো টস করে সেলফি তুলেই দেখা যায়। হয়তো ও চুল কাটল। চট করে সেলফি তুলে বলল, দেখ তো কেমন লাগছে? ভালো না লাগলে বল, ন্যাড়া করে ফেলি।
ও আচ্ছা।
স্যার ওর কথা জিগাইলেন?
তুমি ওকে একটা তথ্য দিতে বলবে।
কী তথ্য স্যার?
সৌদি আরবে চুরির শাস্তি হাত কেটে দেয়া।
জি স্যার জানি।
সবার জন্য এই শাস্তি সমান।
জি স্যার এটাও শুনেছি।
তুমি তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করবে সৌদি আরবে প্রতি মাসে চুরি জন্য কয়টা হাত কাটা হয়।
এটা জেনে কী করবেন স্যার?
এমনি। মানে এমনি এমনি ইদানীং অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে।
বৃষ্টিটা আরো জেঁকে বসল। অবশ্য বেশ ভালোই লাগছে। বৃষ্টির শব্দ তার ভালোই লাগে। তবে এখনকার বৃষ্টিতে ব্যাঙ তেমন ডাকে না। নানা পদের ব্যাঙ তাল মিলিয়ে ডাকবেÑ এটাই বৃষ্টির নিয়ম। কিন্তু সবই বদলে যাচ্ছে।
স্যার বৃষ্টি থামলেই চটজলদি বাড়ি যান। আমি বরং একখান রিকশা ডাকি। রাত বাড়লে বৃষ্টি আরো বাড়ব।
তা ঠিক।
বৃষ্টি কমল ঘণ্টাখানেক পর। শুধু থামলই না। আকাশজুড়ে উত্তাল মেঘের ওড়াউড়ি। তার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝেই চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ চাঁদের চকচকে আলো পুরো এলাকা উজ্জ্বল করে তুলছে আবার, আবার হঠাৎই অন্ধকার। এমন অন্ধকারেই ডুগি স্যার বেরিয়ে পড়লেন। বাবলু রিকশা পায়নি। কেউ এমন ঝড়বৃষ্টির রাতে নদীর ওপার যাবে না। আগে শিক্ষকদের আলাদা একটা মর্যাদা ছিল, এখন নেই। শিক্ষক বৃষ্টির রাতে ভিজতে ভিজতে গেলেই কী আর কাদায় পিছলে পড়ে গেলেই কী? সামাজিকতা এখন শিকেয় উঠে গেছে।
বাবলু অবশ্য তার সঙ্গে আসতে চেয়েছিল। বারবার বলছিল, স্যার অন্তত আপনাকে কাঠের ব্রিজ পর্যন্ত এগিয়ে দেই। কিন্তু ডুগি স্যার বাবলুকে কষ্ট দিতে চান না। সারাদিন বেচারা স্কুলের নানান কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ফুট-ফরমায়েশ করতে করতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
হালকা একটা বাতাস আচমকা এসে শরীরে লাগছে। শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে তার। বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে। এই সময়টা তার কাছে বেহেশতি সময় মনে হয়। অবশ্য বেহেশতে বৃষ্টি থাকবে কিনা কে জানে। থাকতেও পারে। মহান আল্লাহর এমন অপূর্ব সৃষ্টি চিরসুখের জগতে বাদ যাওয়ার কথা না।
কাঠের ব্রিজের কাছে আসতেই ব্যাঙের ডাক শুরু হলো। হরেক রকমের ব্যঙ ডাকছে। কোনাব্যাঙ, সোনাব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ। অদ্ভুত তাল তাদের। পাশের বিলের পানিও চকচক করছে। ইচ্ছে করছে বিলে শরীর ডুবিয়ে গোছল দেয়। অদ্ভুত রকমের ঠা-া পানিতে শরীর ডুবিয়ে রাখার মজাই আলাদা। যদিও বয়স হওয়ার পর শরীর সব নিয়মের বাইরে চলে যায়।
কাঠের ব্রিজের ওপর এসে ডুগি স্যার বসলেন। তখনই লক্ষ করলেন তার স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে গেছে। তিনি ওটা হাতে নিলেন। ঠিক এ সময় ওপাশ থেকে দু’জনকে ছুটে আসতে দেখলেন। দু’জনের হাতে টর্চ। তবে আসল টর্চ না। মোবাইল টর্চ। দু’জনেই এমন হিমশীতল বাতাসেও হাঁপাচ্ছে। রক্তিম কিছু বলার আগেই ডুগি স্যার বলল, কী হয়েছে?
বাবা, বাড়িতে সবাই তোমার চিন্তায় অস্থির। এত করে বলি একটা মোবাইল ইউজ করো। এটা মোবাইল যুগ। এই যুগে মোবাইল ছাড়া চলে।
কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই যন্ত্রটা ডুগি স্যারের কাছে অদ্ভুত প্যাঁচের মনে হয়। অবশ্য তিনি যে মোবাইলে কথা বলেন না, তা না। বলেন। তবে নিজে মোবাইল সঙ্গে রাখেন না।
তুমি এত দেরি করলে কেন বাবা? মা তো অস্থির হয়ে পড়েছে।
বৃষ্টির জন্য একটু দেরি হয়ে গেছে।
একটা রিকশা নিয়ে ফিরলেই তো হতো।
কেউ আসে না।
ঠিক আছে চলো। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
ডুগি স্যার ছেলের পাশাপাশি যাচ্ছে। ছেলে তাকে ধরছে না। তার ছেলে তাকে একটু ধরে ধরে নিয়ে গেলে ভালো হতো। কিন্তু ছেলেটা কেন জানি একটু দূরে দূরে থাকে। নতুন বিয়ের পর ছেলেরা মনে হয় একটু বদলে যায়।
রক্তিম চাকরি করে যমুনা ব্যাংকে। সারাদিন অফিস করে বাড়ি ফিরেই দরজা বন্ধ করে দেয়। বউয়ের সঙ্গে কী এত কথা বলে কে জানে।
ডুগি স্যার হাবুর দিকে তাকালেন। বললেন, এই হাবু, আমাকে একটু ধর তো। রাস্তা পিছলা হয়ে আছে। যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারি।
হাবু কিছুটা দূরে ছিল। সে দৌড়ে এসে ডুগি স্যারকে ধরল। রক্তিম কিছু বলল না। সে আগের মতোই জোরে জোরে হাঁটছে। কখন বাড়ি ফিরবে সেই তাড়া।
মাঝে মাঝে সামান্য ব্যাপারগুলোই অনেক কষ্টের হয়ে ওঠে। সেসব কষ্ট ধুয়ে ফেলা যায় না। তারপরও হয়তো মানুষ ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করে।
আবারো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। উত্তর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মাঝে মাঝেই বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে উঠছে।
(চলবে ..)
প্রতিভা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত, বইমেলা ২০১৭
২| ০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ৭:৪০
নাগরিক কবি বলেছেন: ভাল, সুন্দর
৩| ০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:৫১
হাতুড়ে লেখক বলেছেন: ভালো লেগেছে, তবে শিক্ষকের চিন্তাধারাটা মাঝে মাঝে বিদঘুটে লেগেছে। গল্পে সবই সম্ভব। অবশ্য আজকাল লেখকেরা সমাজ সংস্কারে ভাগি হতে চায় কম।
৪| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৭ রাত ১:৩২
আহমেদ ফারুক বলেছেন: গল্প তো গল্পই। তাই না?
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা মার্চ, ২০১৭ সকাল ৭:৩০
বুড়ো হিমু বলেছেন: শুরুটা ভাল। সহজ, প্রঞ্জল। শুভ কামনা রইল