নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা এমন একটা প্রচার দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে এসেছে। মেজর শরিফুল হক ডালিমের স্ত্রীর সঙ্গে সে সময়ের রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার অসদাচরণকে এ ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে । বলা হয়, এ কারণে সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। এক সময় তো এই অপপ্রচারটা ছিল শেখ কামালকে নিয়ে। বলা হতো, শেখ কামাল নাকি মেজর ডালিমের স্ত্রীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন! কিন্তু সেটা যে ডাহা মিথ্যা তা জেনেছিলাম অনেক পরে, এ বিষয়ে বিভিন্ন বই পড়ে।
দীর্ঘদিন মিথ্যা শুনতে থাকলে এক সময় সেটাই সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। এটা আমার কথা না। হিটলারের প্রচারণা প্রধান গোয়েবলসের বহুল ব্যবহৃত ও আলোচিত উক্তিটি যে কতো সত্য তা আমি নিজের অভিজ্ঞতায় শিখেছি। সম্প্রতি মেজর ডালিমের ওয়েবসাইটের খবর দিলেন ফৌজদারহাটের এক বড় ভাই। সেখানে ওই বহু আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা সম্পর্কে তার ভাষ্য পড়লাম।
এটা ছিল ১৯৭৪ সালের ঘটনা। মেজর ডালিমের বর্ণনায়, “১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি ……আমার খালাতো বোন তাহ্মিনার বিয়ে ঠিক হল কর্নেল রেজার সাথে। দু’পক্ষই আমার বিশেষ ঘনিষ্ট। তাই সব ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছিল আমাকে এবং নিম্মীকেই (ডালিমের স্ত্রী)। ঢাকা লেডিস ক্লাবে বিয়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে।” ওই অনুষ্ঠানে একটি ঘটনায় ডালিমের শ্যালক বাপ্পীর সঙ্গে তখনকার রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেদের বিরোধ দেখা দেয়। ডালিম লিখেছে, বিয়ের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে “হঠাৎ দু’টো মাইক্রোবাস এবং একটা কার এসে ঢুকল লেডিস ক্লাবে। কার থেকে নামলেন স্বয়ং গাজী গোলাম মোস্তফা আর মাইক্রোবাস দু’টো থেকে নামল প্রায় ১০-১২ জন অস্ত্রধারী বেসামরিক ব্যক্তি।” গাজী গোলাম মোস্তফার সহযোগীরা প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা আলম ও চুল্লুকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এর মধ্যে চুল্লুর মুখে গাজীর লোকেরা অস্ত্র দিয়ে আঘাত করায় তার ভীষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তারা ডালিমকেও জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এ অবস্থায় ডালিমের স্ত্রীও তার স্বামীকে একা যেতে দিতে চাইলেন না। তিনি এবং কনে তাহমিনার আম্মাও মাইক্রোবাসে উঠলেন।
গাড়িবহর শেরেবাংলা নগরের দিকে এগোতে থাকলে ডালিম ধারণা করছিলেন, গাজী গোলাম মোস্তফা তাকে রক্ষীবাহিনীর ক্যাস্পে নিয়ে নির্যাতন করবেন। তাই তিনি বললেন, “গাজী সাহেব আপনি আমাদের নিয়ে যাই চিন্তা করে থাকেন না কেন; লেডিস ক্লাব থেকে আমাদের উঠিয়ে আনতে কিন্তু সবাই আপনাকে দেখেছে। তাই কোন কিছু করে সেটাকে বেমালুম হজম করে যাওয়া আপনার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না।” এরপর গাজী তাদের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসার সামনে নিয়ে আসেন। বাইরের রাস্তায় এদের রেখে গাজী বাড়ির ভেতরে যান।
ডালিম তার ওয়েবসাইটে লিখেছেন, তাদের এভাবে তুলে আনার ঘটনা জানার পর তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম (বর্তমানে ব্যারিস্টার তাপসের ওপর বোমা হামলা মামলায় গ্রেপ্তার আছেন) এবং তার ছোট বোন মহুয়ার স্বামী আবুল খায়ের লিটু (বর্তমানে ব্যবসায়ী ও বেঙ্গল গ্রুপের কর্নধার) ছুটে যায় এসপি মাহবুবের (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা) বাসায়। উদ্দেশ্য মাহবুবের সাহায্যে গাজীকে খুঁজে বের করা। তারা বেইলি রোডের বাসায় এসপি মাহবুবের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। ডালিম জানান, এ সময় বঙ্গবন্ধুই মাহবুবকে ফোন করে তার বাসায় ডাকেন।
মেজর ডালিমের বর্ণনায় জানা যাক পরবর্তী ঘটনাবলী। বঙ্গবন্ধু বললেন,
“-মাহবুব তুই জলদি চলে আয় আমার বাসায়। গাজী এক মেজর আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের ধইরা আনছে এক বিয়ার অনুষ্ঠান থ্যাইকা। ঐ মেজর গাজীর বউ-এর সাথে ইয়ার্কি মারার চেষ্টা করছিল। উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। বেশি বাড় বাড়ছে সেনাবাহিনীর অফিসারগুলির।
সব শুনে মাহবুব জানতে চাইলো,
-স্যার গাজী সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন মেজর ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের কোথায় রেখেছেন তিনি?
-ওদের সাথে কইরা লইয়া আইছে গাজী। গেইটের বাইরেই গাড়িতে রাখা হইছে বদমাইশগুলারে। জানালেন প্রধানমন্ত্রী।
-স্যার গাজী সাহেব ডালিম আর নিম্মীকেই তুলে এনেছে লেডিস ক্লাব থেকে। ওখানে ডালিমের খালাতো বোনের বিয়ে হচ্ছিল আজ। জানাল মাহবুব।
-কছ কি তুই! প্রধানমন্ত্রী অবাক হলেন।
-আমি সত্যিই বলছি স্যার। আপনি ওদের খবর নেন আমি এক্ষুণি আসছি।
এই কথোপকথনের পরই মাহবুব লিটুকে সঙ্গে করে চলে আসে ৩২নং ধানমন্ডিতে। মাহ্বুবের ভিতরে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেহানা, কামাল ছুটে বাইরে এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে যায়। আলম ও চুল্লুর রক্তক্ষরণ দেখে শেখ সাহেব ও অন্যান্য সবাই শংকিত হয়ে উঠেন।
-হারামজাদা, এইডা কি করছস তুই?
গাজীকে উদ্দেশ্য করে গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে নিম্মী এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।”
এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর জানাজানি হয়ে যায়। তখন ঢাকা শহরে অস্ত্র উদ্ধার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। সেনাবাহিনীর একটি দল ঢুকে পড়ে গাজীর বাসায়। আর ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসার পরিস্থিতি সম্পর্কে ডালিম লিখেছেন, “হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। রেড ফোন। শেখ সাহেব নিজেই তুলে নিলেন রিসিভার। গাজীর বাসা থেকে ফোন এসেছে। বাসা থেকে খবর দিল আর্মি গাজীর বাসা রেইড করে সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় সমস্ত শহরে আর্মি চেকপোষ্ট বসিয়ে প্রতিটি গাড়ি চেক করছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিডন্যাপিং এর খবর পাওয়ার পরপরই ইয়ং-অফিসাররা যে যেখনেই ছিল সবাই বেরিয়ে পড়েছে এবং খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মীকে। সমস্ত শহরে হৈচৈ পড়ে গেছে। গাজীরও কোন খবর নেই। গাজীকে এবং তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদেরও খুঁজছে আর্মি তন্নতন্ন করে সম্ভাব্য সব জায়গায়। টেলিফোন পাওয়ার পর শেখ সাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেল।”
বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে এ নিয়ে সালিশ হলো। বঙ্গবন্ধু নিম্মীর কাছে গাজীকে ক্ষমা চাইতে বললেন। সেনাপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ এসময় ৩২ নম্বরে চলে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। স্বস্ত্রীক সেনা কর্মকর্তাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় সেনানিবাসেও প্রতিক্রিয়া হলো। এ সব ঘটনা ও প্রতিক্রিয়ার অনেক কিছু জানা যায় কর্নেল শাফায়াত জামিল (অবঃ)-এর লেখা “একাওরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” এবং মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অবঃ) বীর বিক্রমের “এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক” বই দুটো থেকে। আর এ ঘটনায় যেহেতু ডালিমের বর্ণনায় মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম ও চুল্লুর নাম এসেছে, তাই তাদের বক্তব্য জানার চেষ্টা করা যায়। দুজনই আমার পরিচিত। চুল্লু ভাইয়ের নম্বারটা মোবাইলেই ছিল। ফোনে তার কাছে জানলাম ওই দিনের ঘটনা।
চুল্লু ভাই আওয়ামী লীগের আগের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) শিক্ষামন্ত্রী এএসএইচকে সাদেকের ছোট ভাই। খুবই সরল-সোজা মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় চুল্লু ভাই ২ নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশাররফের অধীনে ঢাকার গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। বড় ভাই সাদেক সাহেবের বাসা ছিল তাদের অস্ত্র রাখার জায়গা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে শহীদ রুমির সহযোগী ছিলেন আলম ভাই ও চুল্লু ভাই। ১৯৭১-এর ২৯ ও ৩০ আগস্ট পাক সেনারা ঢাকার গেরিলা যোদ্ধা ও তাদের সহযোগী বদিউল আলম (প্রাক্তন ফৌজিয়ান, বীর উত্তম, শহীদ), সামাদ, রুমি, জামি, শরীফ ইমাম, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, আজাদ- এদের সঙ্গে চুল্লু ভাইকে ধরেছিল। এই মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ আর ফিরে আসেননি। আর ১৭ ডিসেম্বর পর চুল্লু ভাই কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পান।
চুল্লু ভাই জানালেন, গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেরা বিয়ের অনুষ্ঠানে বাপ্পীর সঙ্গে বেয়াদবি করে। ডালিম এ কারণে ওদের চড়-থাপ্পর মেরেছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে গাজী গোলাম মোস্তফা তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে হাজির হন। তিনি জানান, গাজী তখন রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছাড়াও সংসদ সদস্য ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। ৫/৬ জনের সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়ে তিনি সে সময় চলাফেরা করতেন। আমার ধারণা, ওই সময়ে সর্বহারা পার্টি ও জাসদের সশস্ত্র রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগের অনেকেরই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ছিল।
বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেই গাজী ও তার সশস্ত্র লোকেরা হম্বিতম্ভি করায় তাদের শান্ত করতে হাবিবুল আলম ও চুল্লূ এগিয়ে যান। গাজীর লোকেরা তাদের হাত তুলতে বলে। আলম ভাই হাত তুললেও চুল্লু ভাই রাজি হননি। তক্ষনি গাজীর লোকেরা তাকে মারধর করে। ওদের একজনের রাইফেলের বাটের আঘাতে চুল্লু ভাইয়ের নাক-মুখ রক্তাক্ত হয়। এরপর তাদের তুলে নেয়া হয় মাইক্রোবাসে। একইভাবে ডালিম, তার বউ এবং বিয়ের কনে তাহমিনার মাকেও গাড়িতে তোলা হয়। পুরো বিষয়টা ছিল গাজীর মাস্তানি। চুল্লু ভাই মনে করেন, শেরেবাংলা নগরে নিয়ে তাদের হত্যার পরিকল্পনা করেছিল গাজী। ওখানে তখন সংসদ ভবন নির্মানের জন্য প্রচুর ইট-পাথর, বালুসহ নির্মান সামগ্রী স্তুপ করা ছিল। সেখানে ইটের স্তুপে তাদের মেরে ডাকাতির ঘটনা সাজানো যেত। কিন্তু লেডিস ক্লাবে এতো লোকের সামনে থেকে তুলে আনায় এ ঘটনা সামাল দেয়া কঠিন হতো। তাই শেষে মত বদলে গাজী এদের নিয়ে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। ৩২ নম্বরে আহত, রক্তাক্ত চুল্লু ভাইয়ের সুশ্রষা করেন শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুও সত্য ঘটনা জেনে ক্ষুব্ধ হন।
এ ঘটনায় পানি অনেক ঘোলা হয়। কর্নেল শাফায়াত জামিল তার “একাওরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বইতে লিখেন, ঘটনার পরদিন সে সময়ের কর্নেল এইচ এম এরশাদ একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার অফিসে যান। এরশাদ এ সময় সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ দাবি করেন। শাফায়াত জামিল নিজে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি লিখেন, জিয়াউর রহমান এরশাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে তিরস্কার করেন। জিয়া এ সময় বলেন, এরশাদের এই আচরণ কোর্ট মার্শাল হওয়ার যোগ্য।
পরে ওইদিনই বিকেলে বঙ্গবন্ধু তার কার্যালয়ে সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, এরশাদ ও শাফায়াত জামিলকে ডেকে নেন। বঙ্গবন্ধু এরশাদের আচরণের জন্য সবাইকে কঠোরভাবে তিরস্কার করেন। কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। শাফায়াত জামিল তার বইতে সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
বিষয়টি নিয়ে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার “এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক” বইতে লিখেছেন, বিয়ের অনুষ্ঠানের ঘটনার প্রতিশোধ হিসাবে মেজর ডালিম তার কিছু সঙ্গী সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিক নিয়ে গাজী গোলাম মোস্তফার বাসা আক্রমণ ও তচনচ করে। এর ফলে সামরিক শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে প্রশাসনিক আদেশে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, মেজর ডালিম এবং মেজর এস এইচ এম বি নুর চৌধুরী। এরা দুজনই ১৯৭৫-এর আগস্টে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তত্ত্ববধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা এই সেনা কর্মকর্তা জিয়ার অনুসারী এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে আওয়ামী লীগের সমালোচক। আর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা কর্নেল শাফায়াত জামিল আড়ালেই থাকেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় ঢাকায় ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন। তার অধীনের সেনা কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ ও পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা নিয়ে সে সময়ের সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ও শাফায়াত জামিলের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ আছে। তবে এরা দুজনই আজো বঙ্গবন্ধুর সমর্থক।
১৫ আগস্টের পর দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাকে ব্যক্তিগত আক্রোশের ফল হিসেবে চালানোর চেষ্টা কম হয়নি। এক্ষেত্রে গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ কামাল, মেজর ডালিম, ডালিমের স্ত্রীর নাম বারবার এসেছে। ঘটনা যদি সত্য হয়, তাহলে মেজর ডালিম বা নুরের ক্ষোভ থাকার কথা গাজীর বিরুদ্ধে। ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু, তার স্বজনদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। গাজী গোলাম মোস্তফা ছিলেন অক্ষত। তার বাড়িতে একজন সৈনিকও যায়নি। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় দুর্নীতির অভিযোগে। এই অভিযোগেরও আবার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
শেখ কামালকে “ব্যাংক ডাকাত” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। ১৯৭৪ সাল থেকে এই প্রচারণার শুরু। আমিও এই প্রচারে বিভ্রান্ত ছিলাম দীর্ঘদিন। আমি নিশ্চিত এই লেখার পাঠকদের অনেকে এখনো বিশ্বাস করেন, দলবল নিয়ে ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামাল গুলিবিদ্ধ হন। সুযোগ পেলেই বিএনপি নেতারা, এমনকি বেগম খালেদা জিয়া নিজেও শেখ কামালকে ‘ব্যাংক ডাকাত’ বলে থাকেন। জাতীয় সংসদের সাম্প্রতিক কার্যবিবরণীতেও তাদের এমন বক্তব্য পাওয়া যাবে।
এ নিয়ে মেজর জেনারেল মইন তার “এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক” বইতে স্বাধীনতাত্তোর অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে নানা তথ্য দেন। তিনি লিখেন, ১৯৭৩ সালের বিজয় দিবসের আগের রাতে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, সিরাজ শিকদার তার দলবল নিয়ে এসে শহরের বিভিন্নস্থানে হামলা চালাতে পারেন। এ অবস্থায় সাদা পোশাকে পুলিশ গাড়ি নিয়ে শহরজুড়ে টহল দিতে থাকে। সর্বহারা পার্টির লোকজনের খোঁজে শেখ কামালও তার বন্ধুদের নিয়ে মাইক্রোবাসে করে ধানমন্ডি এলাকায় বের হন। সিরাজ শিকদারের খোঁজে টহলরত পুলিশ মাইক্রোবাসটি দেখতে পায় এবং আতংকিত হয়ে কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই গুলি চালায়। শেখ কামাল ও তার বন্ধুরা গুলিবিদ্ধ হন। গুলি শেখ কামালের কাঁধে লাগে। তাকে তখনকার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জেনারেল মইন তখন ৪৬ ব্রিগেডের অধিনায়ক। বিজয় দিবসে মানিক মিয়া এভিনিউতে সম্মিলিত সামরিক প্যারেড পরিচালনা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সালাম নেন। জেনারেল মইন লিখেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব অত্যন্ত গম্ভীর ও মলিন মুখে বসে ছিলেন। কারো সঙ্গেই তেমন কথা বলেননি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে জেনারেল মইন বইতে লিখেন, ওইদিন শেখ মুজিব তার সঙ্গেও কথা বলেননি। ‘৭২ সাল থেকে অনেকবারই তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু এতোটা মর্মাহত কখনো তাকে আগে দেখেননি। মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধের সময় জেনারেল ওসমানীর এডিসি শেখ কামালও জেনারেল মইনের ঘনিষ্ট ছিলেন। প্যারেড শেষে মইন পিজিতে যান শেখ কামালকে দেখতে। হাসপাতালে বেগম মুজিব শেখ কামালের পাশে বসেছিলেন। মইন লিখেন, প্রধানমন্ত্রী তার ছেলের ওই রাতের অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং শেখ কামালকে হাসপাতালে দেখতে যেতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানান। পরে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে যান।
জেনারেল মইনকে এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শেষে তিনি লিখেন, “এদিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা এই ঘটনাকে ভিন্নরূপে প্রচার করে। ‘ব্যাংক ডাকাতি’ করতে গিয়ে কামাল পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে তারা প্রচারণা চালায় এবং দেশ-বিদেশে ভুল তথ্য ছড়াতে থাকে। যদিও এসব প্রচারণায় সত্যের লেশমাত্র ছিল না।”
ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালীদের ছেলেমেয়েরা সব সময়েই রাজনীতিতে নানা সমস্যা তৈরি করে থাকে। শেখ কামালকে আমি কখনো দেখিনি। তবে কেন যেন অল্প বয়স থেকেই তার সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা আমার হয়ে আছে। সত্য জানার পরও সে ধারণা পুরো দূর হয়নি। তবে এটা বুঝতে পারছি, শেখ কামাল সম্পর্কে বিরূপ প্রচারও প্রচুর হয়েছে। ইতিহাসের সত্যানুসন্ধানে এসবের অনেকই মিথ্যাচার, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার হিসেবে প্রমাণ হচ্ছে এবং হয়তো আরো হবে। তবে বঙ্গবন্ধুর ছেলে হওয়ার সুবাদে শেখ কামাল যে ক্ষমতার নানা অপব্যবহার করেছেন তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা এর নজির বারবারই দেখে আসছি।
[ধারাবাহিকের এই পর্বটা আগের তুলনায় নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি এসেছে। ‘৭৫-এর ঘটনাবলী এতো জটিল এবং নানামুখী ডালপালা ছড়ানো যে এ নিয়ে ভালো করে সতর্কভাবে লেখার বিকল্প নেই। কারণ আর যাই হোক সত্য বিকৃত করা আমার কাজ না। সচেতনভাবেই সত্যের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি।]
copyright ©
https://cadetcollegeblog.com/999/16989
ক্যাডেট নাম : সানাউল্লাহ
ক্যাডেট নম্বরঃ ৯৯৯
ব্যাচঃ ২১তম
কলেজঃ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ
অবস্থানকালঃ ১৯৭৪-৮০
২| ২৭ শে আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৯
শেরজা তপন বলেছেন: আসলে যে কোনটা সত্যিকারে সত্য সেটা বোঝা মুশকিল হলেও তথ্যগুলো অনেক নির্ভরযোগ্য!
যে কোন ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠ হলে পড়তে ভাল লাগে- শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
২৭ শে আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৪৭
আজব লিংকন বলেছেন: জী দাদা ঘাটাঘাটি করে ঊনার অনেক তথ্য ধরে আরো নতুন কিছু তথ্য পযন্ত পৌছা যাবে, ধন্যবাদ সানাউল্লাহ সাবেক কে উনি খুব গুছিয়ে লিখছেন তাই আমার বেশ ভাল লেগেছে।
৩| ১৮ ই আগস্ট, ২০২৪ রাত ১২:৩৩
আকতার আর হোসাইন বলেছেন: অথেনটিক রেফারেন্স। তথ্যবহুল পোস্ট। পেইজ নাম্বার উল্লেখ করে দিলে নিজে দ্রুত চেক করা যেত। তবে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ বিতর্কিত বিষয়টি নিয়ে এমন গোছানো পোস্টের জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে আগস্ট, ২০২১ রাত ১১:১০
নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
সত্য সুন্দর, সত্য চিরস্তর!! সত্য আর আগুন
কখরনাে চাপাা দিয়ে রাখা যায়না। সত্য একদিন
প্রকাশিত হবেই !!