নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আজবছেলে

আমি সত্যিই আজব ছেলে

আজবছেলে › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমি কলেজ জীবন যেরকম আশা করেছিলাম, সেটা ঠিক সে রকম হল না ! [ব্যাকবেঞ্চার vs ফ্রন্টবেঞ্চার: অধ্যায়-১]

১৭ ই মে, ২০১৪ রাত ১১:০৬



আগের পর্ব



ভুমিকা



প্রথম দিন: অধ্যায়-১



প্রথম দিনঃ অধ্যায়-২



ব্যাকবেঞ্চার vs ফ্রন্টবেঞ্চার: অধ্যায়-১





রাত নয়টা।



ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার রাখছি। ডাইনিং টেবিল হতে কিছুটা দূরে সোফার মধ্যে বসে আপি বসে টিভি দেখছে, দেখছে বলতে কি খালি রিমোটের বাটন টিপে টিপে চ্যানেল পরিবর্তন করছে। এটা আপি বদ অভ্যাস। জ্ঞান হবার পর থেকে আমি আপিকে এই পর্যন্ত দেখিনাই যে ভালভাবে টিভি দেখতে, একটা চ্যানেল সে পাচ সেকেন্ডের চেয়ে বেশী দেখেনা, তবে সে প্রচুর বই পড়ে। এই তার কারনে আমি বই পড়ার অভ্যাসটা পেয়েছি।



ও, আগে আমার আপির পরিচয় দিয়ে নিই, আমার আপির পুরো নাম রুকসানা হক রুনা। তার বয়স উল্লেখ করলে আমাকে প্যাদানি খেতে হবে তাই বললাম না । এইটুকু বলে রাখি সে ভীষন জেদী একটা মেয়ে, যেটা বলে সেটাই সে করে। আমাদের বাড়ি খুলনা শহরে, সেখানে নিজেদের বাড়ি আছে, বেশ বড় বাড়ি। কিন্তু আপির সেখানে মন টিকলনা, সে সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকায় গিয়ে পড়বে, তার সাথে থাকবে লায়লা আপু। বাসায় এই নিয়ে অনেক কাহিনী, সেটা বলতে গেলে একটা উপ্যন্যাস হয়ে যাবে তাই বললাম না। শেষের বেলায় বাবা-মা রাজি হন কিন্তু মা তার ছোট বোন মানে আমাদের খালা আসমা খাতুনকে পাঠিয়ে দেন উনাদের সাথে। আসমা খালা ওখানে কয়েক বছর কাটিয়ে কোমর ব্যাথার রোগী হয়ে ফিরে আসেন, ততদিনে আপি চাকরি করা শুরু করে দিয়েছে, আর আমি কলেজে পা দিয়েছি।



আম্মা এবার হুকুম দিল আমাকে, ঢাকায় যেতে আপিকে বোঝাতে, খুলনায় আসতে। কিন্তু তো ঢাকায়তো এসে আমার নিজের প্রায় বারোটা বেজে যাওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে। আমি ঢাকায় পা দিয়েছি এই ভেবে লায়লা আপু এখনতো আপির সাথে ঢাকায় থাকেনা। ঐ সময় আমি শুনেছিলাম সে নাকি খুলনায় ফিরে এসেছে, কিন্তু এখন দেখছি সে কলেজের টিচার হয়ে এসেছে এবং বোনাস হিসেবে আমার গাইড টিচার হয়ে গেছে।



আসল কথা হল আমার আপিকে নিয়ে। আমি একশত ভাগ নিশ্চিত যে সে জানে লায়লা আপু এই কলেজে ম্যাডাম হিসেবে জয়েন করেছে। আমাকে ইচ্ছে করে বলেনি, আর এই জন্য সে এত নিশ্চিত ছিল যখন আমি এই কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছি।



টেবিলে প্লেট রাখার পর আমি আপিকে জিজ্ঞেশ করলাম, “আপি, তুই কি জানতি যে লায়লা আপু আমাদের কলেজে ম্যাডাম হিসেবে জয়েন করেছে ?”



“কেন জানলে তুই কি করতি ?” আমাকে সে পাল্টা প্রশ্ন করল।



অবশ্যই ঐ কলেজে আর ভর্তি হতাম না। যদিও মনে মনে সেটা বললাম।



“কেন প্রথম দিনেই কি প্যাদিয়েছে নাকি?” টিভির রিমোট টিপতে টিপতে বলল।



“না।”



“ওর কাজেই তো প্যাদানো।”



তুইও বা কম কিসে, এটাও মনে মনে বললাম।



“সে আমার গাইড টিচার হয়েছে।”



“জানি গতকালই সে আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। তোকে গতকালই জিজ্ঞেশ করতাম কিন্তু কালকে দেরী করে আসার কারনে জিজ্ঞেশ করতে ভুলে গিয়েছি।”



“সে কি তোমাকে আপটুডেট সব জানাচ্ছে নাকি। ” আমি প্রায় চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।



“হুম, আমাদের মধ্যে তো এই কথায় হয়েছে। তোকে দেখে শুনে রাখার দরকার” নির্বিকার ভাবে বলল সে।



আমার মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম।



“আমাকে দেখে শুনে রাখা মানে ?!”



“মনে করছিস তোর খবর আমি রাখিনা, ক্লাস এইট থেকে তোর পাখা গজিয়ে গেছে। রেগুলার স্কুল পালাতিস। যেখানে সেখানে আড্ডা দিতিস, আবার শুনেছিলাম মাস্তানি…”



“এতদুর যাইনি আমি” আপিকে থামিয়ে আমি বললাম।



“কিন্তু কলেজে তুই এইসব করবি না তার নিশ্চয়তা কি ? ”



আমি কিছু বললাম না। এইটুকু বলে রাখি আপি আমাকে অনেক কেয়ার করে রাখে যেটা আম্মা কখনো করে নাই। করে নাই মানে করার চান্স পায় নাই এই আপির কারনে!



হাহ, এই করে বড় এক দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম আমি।



“খেতে আয়।” ডাক দিলাম, “খাবার রেডি।”



টিভি অফ করে আপি টেবিলে এসে বসল।



খেতে খেতে ভাবতে লাগলাম আর সবার সাথে তর্ক ভালভাবেই করতে পারি, কিন্তু এই আপির সাথে কেন যেন তর্ক করতে পারি না। মনে হয় আর বাকী জীবনে পারব।



খাওয়া প্রায় শেষ হঠাৎ করেই আপি বলে উঠল, “আপা ফোন দিয়েছে, তোর খোজখবর নিল।”



আপা মানে আমার বড় বোন, আফসানা হক। স্বামীর সাথে চিটাগাং থাকে, দুই বাচ্চার মা সে।



আমি জিজ্ঞেশ করলাম, “কি বলল ?”



“এই আগের মত টো টো করি কিনা।”



‘টো টো’ মানে স্কুলে থাকতে আমার এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করা।



হাহ, তিন বোনের এক ভাই। অনেকেই হয়তো আমাকে দেখে বলবে ব্যাটা অনেক ভাগ্যবান, তিনটা বড় বোন। একেবারে লালে লাল অবস্থা। লালে লাল!



হা আমার একদম লাল, তিন বোন যখন একহয় আমি তখন চারিদিকে লাল রংতো দেখবই। এ বলবে এর কাছে থাক ও বলবে না আমার কাছে থাক। এই বলে টানাটানি। পিচ্চি কাল এই টানাটানি খেতেই গেছে। এখনো কিছুটা আছে এই টানাটানি।



দিন কয়েক আগে আমি শুনেছি আপা আমার জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছে। শুনেতো আমার মাথায় বজ্রপাত। বলে কি ! এখনো আঠারোতে পা দেইনি এর আগে পাত্রী। এটা আপাকে বলছি, তার কথা এই দেশে টাকা থাকলেই সব হবে। আমার শুধু মাথা ঝোকালেই হবে, পাত্রী নাকি অলরেডী নাকি প্রস্তুত করা আছে। আমি সরাসরি মাথাটা ডানপাশ-বামপাশ করে নাড়িয়ে জানিয়ে দিয়েছি আমি বিয়ে করব না।



আপা অনেক চেষ্টা করেছে আমাকে পটানোর। । আমি রাজী হই নাই। এই আপা হল একটা কারন ঢাকা আসার জন্য। না হলে আমি খুলনা হতে নড়তামই না। আপু আছে তবে তার কথা আমি সেটা পরে বলব।



আপি তা কথা চালিয়ে যেতে লাগল, আমি সব কথা শুনতাম নাকি সন্দেহ আছে কিন্তু ওই বিয়ে শব্দটা আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসল, আপি বলল, “ তোর বিয়ে জন্যতো আপা ক্ষেপেছে।” আপি এই বলে ফিক ফিক করে হাসল, “বলেছে মেয়েটার ছবি মেইলে করে পাঠিয়ে দিবে।”



দীর্ঘএক নিঃশ্বাস ফেললাম। হটাৎ করেই মনে হল কথাটা, “আপা মেইল পাঠানো শিখল কবে ?”



“কি জানি, মনে হয় রাতুল পাঠিয়েছে।”



হয়তো বা আপা আবার ইলেকট্রিক ব্যাপারে খুবই দুর্বল। উনি যেকোন ইলেকট্রিক মেশিনে হাত দিলে সেটা দুই তিনদিনের বেশি টিকেনা। তবে আশ্চর্যজনকভাবে টিভিটা কিভাবে যেন টিকে আছে।



“হুম রাতুলে পাঠিয়েছে।” এই বলে মাথা ঝাকালাম। আমার ভাগ্নে, এগারোতে পা দিল। কম্পিঊটারের পাগল সে। আগে গেমসে ছিল এখন সে ইন্টারনেটে চলে গিয়েছে সে। হুম বর্তমান জেনারেশন দেখছি অনেক দূর যাচ্ছে, ওর বয়সে আমরা কানামাছি, মাংসচোর আরো অনেক কিছু খেলেছি। তখন মাত্র টিভিটা ছিল। কম্পিউটার, মোবাইল এগুলো তখন চিনতামই না।



“কিরে দেখবি নাকি মেয়েটার ছবি।” আপি একটা ফিচেল মার্কা হাসি দিয়ে বলল।



বুঝেছি জ্বালাবে আমাকে এই ব্যাপার নিয়ে আমাকে। তার আগেই একটা ব্যাবস্থা নিতে হয়। মনে মনে বললাম, সরি আপি।



গলাটা কেশে পরিষ্কার করে নিলাম, “শোন আপি, তুমি কি আপার প্ল্যান কি এখনো ধরতে পারোনি।”



আপি ভ্রু কুচকে বলল, “আপার প্ল্যান মানে? কি বলতে চাস?”



“আপা আসল প্ল্যান হল আমাকে চিটাগাঙে নিয়ে যাওয়া। এবং আমাকে ওইখানে সেটল করা। আপাকেই দেখনা, দুলাভাইকে নিয়ে সে ওইখানে থাকছে। আমার মনে হয় ওইখানেই সে থাকবে। আর সেই চিটাগাঙের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিবে।”



“তো কি হয়েছে, বিয়ে করার পর ঢাকায় আসবি, এইখানে থাকবি।”



ইয়েস! তীর একদম সঠিক নিশানা বরাবর যাচ্ছে। এখন শুধু ভালভাবে গাথা দরকার।



“তুমি কি আপাকে এতই বোকা পেয়েছ নাকি। আমি গেলাম, বিয়ে করলাম আর চলে আসলাম। দিবে আমাকে আসতে? বলবে, এখনো তো ইনকাম করা শিখলি না, বউকে খাওয়াবি কি তার চেয়ে আমার কাছে থাক। আমি সব ব্যবস্থা করে দিব।”



আপি চুপ করে রইল। সব কিছু তলিয়ে দেখছে। হ্যা আপি চাকরি করে ঠিকই, তবে সে এমন বেতন পায়না যে আমাকে এবং এর সাথে আরেকজন মেয়েকে ভরন-পোষন করতে পারবে।



“তাহলে বাপের কাছ থেকে টাকা আনবি।” আপি ঠাস করে বলে দিল।



আরে খাইছে নিজের বিয়ের আগে সে আমার বিয়ে নিয়ে দেখছি সিরিয়াস!



“আব্বা বলেছে, বিয়ে করলে সে আমাকে ত্যাজ্য পুত্র করবে।” আমিও বললাম।



“কিন্তু বিয়েতো করাচ্ছে আপা।”



“করছিতো আমি। আব্বার কথা হল, পাগল যদি ব্রীজ নাড়ায় সেখানে পাগলের কোন দোষ নাই দোষ হল তার যে পাগলকে ব্রীজ নাড়াতে সাহায্য করে।”



“তাহলে মেয়ে বাপে…” এই বলে আপা আবার চুপ করে গেল। আপি যৌতুকের বিপক্ষে।



আমি আর সুযোগ দিলাম না, “সহজ কথা আমার বিয়ে হলে, চিটাগাঙে আমার সেটল হতে হচ্ছে।”



আপি হঠাৎ করেই উঠে গেল বলল, “আমি এই বিয়ে হতে দিব না। তুই আমার কাছেই থাকবি দেখি কে আমাকে ঠেকায়।”



“দ্যাটস মাই আপি।” আমি একতাল দিলাম, “তবে আপাকে এখনই না বলনা।”



“কেন ?” ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকাল।



“এখনই যদি না বল,তাহলে তো তাহলে আপা চলে আসবে ঢাকায়, তারপর বগলদাবা করে নিয়ে যাবে, কয়েকদিন মুলো ঝোলাও তারপর দিবা কাচ কলা দেখিয়ে।”



“হু তাই সই।” এই বলে আপি খাবারের টেবিল গোছাতে লাগল। আমাদের দুজনরেই খাওয়া শেষ।



আমি উঠতেই বলল, আমি সব গুছিয়ে দিচ্ছি তুই গিয়ে রেষ্ট নে যা। যাক তীর একদম ভালভাবে লেগেছে। যে আগে টেবিল গোছানো তারপর খাওয়ার পর বাসন-কোসন মাজা আমাকেই করতে হত, আজেক সে নিজেই সেধে করছে। একটা মুচকি হাসি দিয়ে আমি চলে গেলাম।



*



ফুড়ুৎ করেই সাতটা দিন চলে গেল।



এই সাতদিনে তেমন কিছুই হয়নি। আপা অবশ্য বার কয়েক ফোন দিয়েছিল, আপি হু হা করে এড়িয়ে যাচ্ছে, যাক আমার কথা কাজে দিয়েছে।



বর্তমানে লাইব্রেরীতে বসে আছি, হাতের কাছে দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বইটা। বেশীদুর যেতে পারি নাই। বইটা বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। লাইব্রেরীর নিস্তব্ধতা উপভোগ করছি। বই পড়ার অভ্যাস আমি পেয়েছি আপির কাছ থেকে, সে প্রচুর বই পড়ত এবং এখনো পড়ে। আর ছোটকালটা আমার আপির সাথেই বেশী কেটেছে। অন্যান্য বোনেরা আমার কাছে আসতেই পারতনা, আমার যখন বয়স সাত কি আট তখন প্রায়ই তিন বোনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যেত কার সাথে আমি ঘুমাতে যাব আমি। বলা বাহুল্য আপিই জিতত।



চিন্তার জাল আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাচ্ছিল কিন্তু লাইবেরী ম্যাডামের পায়ের আওয়াজে চিন্তার জালটাকে ছুটি দিতে হল। আমাদের লাইব্রেরী ম্যাডাম কালো বর্ণের, চেহারার মধ্যে এক শান্ত-সিগ্ধ ভাব আছে। এই এই আসলেই লাইব্রেরীয়ান জন্য একদম পারফেক্ট।



ম্যাডাম আমার সামনে আসল। আমাকে দেখে বলল, “ কি ব্যাপার ক্লাস ফাকি দিচ্ছ নাকি, পরপর দুই পিরিয়ড এখানে বসে আছ । ”



“না ম্যাম প্রথম পিরিয়ড ম্যাথ, আমার ম্যাথ নাই। আর এখন অফ পিরিয়ড চলছে।” আমি অনায়াসে মিথ্যাটা বলে ফেললাম।



“ও, আচ্ছা। ” এই বলে আমার হাতে দিকে তাকালেন। আমি দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বইটা নিয়ে বসে ছিলাম।



“তুমি দেখছি খুব ডেঞ্জারাস ধরনের বই পড়”, লাইব্রেরী ম্যাডাম বললেন। আমি কিছু বললাম না মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম।



“শোন সারাদিন এই বই পড়লেতো হবে না এর সাথে পড়ার বইও সাথে পড়তে হবে।”



“জ্বি ম্যাডাম। আমি পড়ার সাথে সাথে এইসব বইও পড়ি।”



“তাহলেতো ভালই। ঠিক আছে পড় এখন।” এই বলে ম্যাডাম চলে গেল।



লাইব্রেরী ম্যাডাম চলে যাবার পর আমি মনে মনে ভাবলাম এখানে বেশীক্ষন থাকা ঠিক হবে না। বারবার একই মিথ্যা বলা যাবেনা।



লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে কলেজ ট্যুরে বের হলাম। কলেজটা বেশী বড় না। উপর থেকে দেখলে “W” এর মত দেখতে চারতলা এই কলেজ। এর সামনে একটা বাস্কেটবল গ্রাউন্ড তারপরে ছোট একটা মাঠ । প্রথম তিনতলা বিজ্ঞান, বানিজ্য আর কলা শাখার ক্লাস। আর চার তলায় সব শাখার ল্যাব ক্লাসরুম। আর দুইতলার এককোনায় হল লাইব্রেরী। আমি সেই লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে ট্যুরে বের হলাম।



ট্যুর শেষ হতে বেশি সময় লাগলনা। কিছুক্ষন মাঠে ঘোরাঘুরি করে সময়টা পার করার চেষ্টা করলাম। এক সময় ঘন্টা বাজল, ক্লাস শেষ হল। নতুন ক্লাসের অপেক্ষা। আমি ট্যুর করে আসায় ক্লান্ত হয়ে ক্লাসরুমে বসে আছি। একটা ব্যাপার আশ্চর্যজনক হলেও বলতে হয় এই সাতদিন আমি মিজানুর স্যার এর মুখোমুখি হয়নি, উনি কি আমাকেই দেখলেই এড়িয়ে যান না কাকতালীয়ভাবে আমার সাথে উনার দেখা হয় না। যাই হোক উনি একটা পেইন দেয়ার মানুষ, উনার কাছ থেকে দূরে থাকাই সর্বউত্তম উপায়।



আমি আমার চিরায়িত জায়গায় বসে আছি, মানে পিছনের বেঞ্চে। চুপচাপ বসে আছি, এখনো সবার সাথে ভালভাবে পরিচয় হইনি। আসলে সময় পাইনা, কিভাবেই বা পাব সারাদিন কলেজের এদিক ওদিক যাই, ক্লাস মিস দেই। সজল ছেলেটা মিশুক বলে তার সাথে বন্ধুত্বটা ভালই হয়েছে। তবে একটা সমস্যা সে ক্লাস মিস দেয় না। তার কথা হল মিস দিলে পুরো কলেজের ক্লাস মিস দিব।



যার কথা ভাবছিলাম সে এসেই হাজির, বাচবে অনেকদিন । আমার পাশেই ধপ করে বসল সজল। আমার কাধে হাল্কা চাপড় মেরে বলল, “কিরে ভাই, কই গিয়েছিলি পরপর দুই পিরিয়ড উধাও।”



সে জানে আমি কোথায় কোথায় ছিলাম তারপরেও এই কথা। আমি তার কথার জবাব দিলাম না। আমি পালটা জিজ্ঞেশ করলাম, “এখন কার ক্লাস ?”



“আজমত স্যারের ক্লাস।”



আজমত স্যার মানে ম্যাথ। তার মানে পেইন, বেসিক জিনিষ বুঝতে বুঝতে জান শেষ। দ্বীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কি আছে। কিছুক্ষন আগেইতো লাইব্রেরী ম্যাডামের কাছে এই ম্যাথ নিয়ে অজুহাত দেখালাম।



আরেকটা দ্বীর্ঘ শ্বাস ফেলে মাথার উপর ফ্যানের দিকে তাকালাম। বনবন করে ফ্যানটা ঘুরছে। সেদিকে তাকাতে ঘোর লেগে যেতে লাগল। কি করে এই ম্যাথ ক্লাস পার করা যায়! হুম আইডিয়া!



আমি সজলের দিকে তাকিয়ে বললাম, “লাইব্রেরী কার্ড এনেছিস ?”



“হ্যা, অবশ্যই।”



“তাহলে চল একটা বই ইস্যু করাতে হবে। ” আমি হাত টেনে সজলকে নিয়ে চললাম।



“তোর লাইব্রেরী কার্ডের কি হয়েছে।”



“নিয়ে আসি নাই, তাই তোরটা দরকার।”



“স্যার এর ক্লাস মিস দিয়ে বই পড়বি ?” সরাসরি প্রশ্ন।



সেক্ষেত্রে বুলস আই!



“আরে দূর এত পক পক করিসনা চল।”, আমি এই বলে তাকে হ্যাচকা টান দিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠালাম। সজল আর কি করবে, সে আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগল।



দরজার সামনেই আসতেই একটা ছেলের সাথে ধাক্কা খেলাম, ছেলেটা আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেল, সরি-টরি কিছুই বললনা। মাথা হঠাৎ গরম হয়ে গেল, কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখন সজল আমাকে বাধা দিয়ে বলল, “থাক কিছু বলার দরকার নেই, ক্লাস ক্যাপ্টেনের ভাই, আর কিছু বলতে গেলে তোর গোমর ফাস হয়ে যাবে, তাই অফ যা ।”



আমার গোমর মানে! আমি আবার কি ধরনের পাপ করলাম যে ক্লাস ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে এড়িয়ে চলতে হবে। আমি সজলকে জিজ্ঞেশ করতে বাধ্য হলাম, “কেন, ক্লাস ক্যাপটেন আমাকে খুজছে নাকি, আমি কি করলাম আবার।”



“আমাদের ক্লাসে আপনে সবচেয়ে বেশী অ্যাবসেন্ট, তাই ক্যাপ্টেন আপনার সন্ধান দিতে বলেছেন।”



“মাত্র সাত দিন হল, এখনই অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে লাফালাফি ।” আমি অবাক হয়ে বললাম।



“কিছু করার নাই।”



“হুম কোন স্যার খুজছে ?”



“না তবে আসলে, ধরতে পারে।”



“মানে, স্যার ম্যডামরা কোন খোজ-খবর নিচ্ছে না ?”



“আপাতত না, এটা ক্লাস ক্যাপটনে নিজ থেকে শুরু করছে। তার কথা এটা করলে তারই লাভ, সে এটাই বলেছে।”



হুম, সজলের কথাই শুনলাম, আমার মতে এখন শান্ত থাকাই ভাল। কিছু বললাম না। লাইব্রেরীর দিকে এগোলাম আমরা। তবে যাওয়ার আগে সেই ছেলের দিকে তাকাতে ভুল করলাম না। কিন্তু তার পিঠ ছাড়া আর কিছুই নজর এল না। কারো একজনের সাথে কথা বলছে। দেখে মনে হল কোন এক মেয়ের সাথে।



*



ম্যাথ স্যার চলে যেতেই আমি বইটা বন্ধ করলাম। অনেকেই বাইরে বের হয়ে গেছে অল্প কয়েকজন ক্লাসের মধ্যে আছে। সজল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে বাইরে যাবি না । ”



“না, বইয়ের আসল জায়গায় এসে গেছি।” আমি উত্তর দিলাম।



সজল তখন আমার পাশে এসে বসল ভ্রূটা কুচকিয়ে বলল, “দোস্ত,তুই আসলেই এক বোরিং পাবলিক।”



আমি হেসে বললাম, “কেন আমাকে দেখে তোর কি মনে হয়ে ছিল।”



“ আসলেই বই পড়া পাবলিকরা সবসমইয় বোরিং হয়, এককথায় আতেল।”



আমার চেহারা থেকে হাসি মুছে গেল, আমি সব জিনিষ মানতে পারি কিন্তু আমাকে গাধা বা এই জাতীয় কিছু বললে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হল দেই বলে মুখের উপর কিছু বলে। কিন্তু করলাম না। এই ধরনের ফালতু জিনিষ নিয়ে লাগে মেয়েরা। যেমনঃ ১ম মেয়ে, “জানিশ কালকে ওই ড্রেস পরে তোকে কিছুটা মোটা লেগেছে, খাওয়া দাওয়া গরু মত করিস না।”



“কি বললি, আমি গরুর মত খাই। তুই না নাইমার বার্থডেতে তিন প্লেট বিরিয়ানি,এক প্লেট জর্দা আর… ” ২য় মেয়ের কথা শেষ না হতেই ১ম মেয়ে



“হ্যা এখনতো তাই বলবি, তোকে গরু বলেছি না।”



“অ্যাই আমাকে গরু বলবি না, আমি গরু হলে তুই হাতি”



“কি আমি হাতি, তাহলে তুই—”



“—”



“–”



এভাবে চলবে যদিনা ৩য় পক্ষ আসে।



অতএব আমি তর্ক করা থেকে বিরত রাখি। তারপরেও আমি পালটা খোচা দেয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না।



“কিছু বললাম না কারন মার্ক টোয়েন বলেছেন ‘নিচু লোকদের সাথে তর্ক করতে যেও না, তাহলে তারা তোমাকে নিজের পর্যায়ে নিয়ে আসবে’।”



এই বলার পর আমি আমার নিজের বইয়ের প্রতি মনোযোগ দিলাম। সজল নির্বিকার ভাবে বসে রইল যেন কিছুই হয় নি। আমি মনে মনে নিজের উপর সন্তুষ্ট হলাম। হুহ, আমার সাথে লাগতে আসা!



বই পড়তে গিয়েই হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেটা কথা, আমি সজল্কে জিজ্ঞেশ করলাম, “আচ্ছা যার সাথে ধাক্কা খেলাম তার নাম কিরে ?”



সজল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “বললাম না ক্লাস ক্যাপ্টেনের ভাই।”



“নাম নাই নাকি ?”



“আছে, …নির্জন।” একটু থেমে ঝাঝে সাথে বলল।



“এমন ভাবে বললি যেন সে তোকে কামড় দিয়েছে। ”



নাক দিয়ে একটা ঘোৎ শব্দ করল কিন্তু কিছু বললনা।



“আরে কিছু করেছে নাকি তোকে ?” আমি একটু যেচেই জিজ্ঞেশ করলাম, “মাইর দিয়েছে নাকি?” আরো যোগ করলাম।



“আরে তা না, আসলে সে কলেজের সব মেয়ের ক্রাশ, এমনকি কয়েকজন সিনিয়র আপু পর্যন্ত তাকে দেখে ফিদা হয়ে গেছে। তার নাম নির্জন।”



“আর ক্লাস ক্যাপ্টেন তার বোন।” আমি যোগ করলাম



“হ্যা জমজ তারা” সজল যোগ করল, “ওই দেখ হ্যারি পটার টাইপ চশমা পরে মেয়েটাই ক্লাস ক্যাপ্টেন। সুমনা।”



ক্যাপ্টেনের দিকে তাকালাম, চুল মাঝখান দিয়ে সিথি করে দুই পাশে বেণী করা, ঠিক মা-দাদীরা যেভাবে বেণী করে। সাধারন মেয়েদের লম্বায় কিছুটা বেশী হবে। তাকে দেখলে মনে হবে ঠিক সত্তর দশকের মেয়ে বর্তমানে উঠে এসেছে। তার সবকিছুতেই মনে হয় ভিন্টেজ ভিন্টেজ ভাব।



“দেখলে মনে হয়না যে নির্জনের বোন,তাই না।” সজল বলল।



আমি কিছু বললাম না শুধু ঠোট উল্টালাম।



“ওর সাথে কথা বলেছিস ?”



“কে ক্যাপটেনের সাথে, না ।” সজল বলল।



বিরক্ত হলাম, “আরে বেক্কল ক্যাপটেনের ভাইয়ের সাথে।”



“না, দুজনরই সাথে বলি নাই। ”



হুম এই বলে আমি আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম।



হঠাৎ করাই পিঠের কাছে আরেকটা চাপড়, এবার সত্যি পিত্তি জ্বলে গেল।



দেখ নুশরাত তোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়েছে।



“মরুক গিয়ে। ” আমি ঝাঝের সাথে বললাম।



সজল আমার দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করল যে আমি এক বোরিং ছেলে ছাড়া আর কিছু না। সে উঠে চলে গেল।



সে চলে যেতেই আমি আবার বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু চারিদিকে গুনগুন আওয়াজের কারনে বেশীক্ষন মনোযোগ দিতে পারলাম না । বইটা বন্ধ করে ক্লাসের এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। সবাই নিজের মত করে গল্প-গুজব করছে। কয়েকজন ভিতরে আসছে আবার বের হচ্ছে। হঠাৎ করেই ক্লাস ক্যাপ্টেনেরদিকে চোখ গেল। মনোযোগ দিয়ে অ্যাটেন্ডেন্স খাতা চেক করছে। সে এবার খাতা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল, তারপর তার পাশের মেয়ের দিকে তাকিয়ে কি যেন জিজ্ঞেশ করল।



মেয়েটার ভাবসাব ভাল লাগলনা তাই তাড়াতাড়ি কেটে পড়ার চিন্তাটা মাথায় আগেই আসল এবং সেটা বাস্তবায়ন করতে সময় লাগল না।



বের হয়ে এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে যাব তখনি আরেকজনের মুখোমুখি হলাম। লায়লা ম্যাডাম। ছোট আপুর বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিল এককালে, ইংরেজী ক্লাসটা নেন। সুন্দরী এবং বোকাসোকা চেহারার এক মানুষ। বোকাসোকা দেখতে হলেও মানুষকে কিভাবে লাটিমের মত পাক খাওয়াতে হয় সেটা তিনি ভাল মত জানেন। আর জানেন কিভাবে প্যাদাতে। তাকে দেখতে আমার বুকটা শুকিয়ে গেল। আমার পাংশুটে চেহারা দেখেও না দেখার ভান করে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,“কি ব্যাপার বাইরে ঘোরাঘুরি করছ কেন ক্লাসতো শুরু হবে।”



তার মিষ্টি হাসি দেখেও ভুলেও কেউ পটবেননা আগেই বলে দিচ্ছি।কারন তিনি যখন হাসেন তখন সেটা তুফানের আলামত।



আমি একটা ঢোক গিলে বলল, “জ্বি আপু…”



“আবার আপু, কতবার না বলছি কলেজে আপু ডাকতে না।”, হাসিমুখে কথাটা শেষ করলেন।



“জ্বি ম্যাডাম…” আবার বললাম।



“মনে হয় ম্যাডামও ডাকতে না করে…”



“সরি, জ্বি ম্যাম।” পুনরায় বললাম।



“এই তো হচ্ছে কোথায় যাচ্ছ, ক্লাস মিস দিচ্ছ না তো ।”



“ কি যে বলেননা ম্যাডা… ম্যাম, আমি কেন কালস মিস দিতে যাব, আমি টয়লেটে যাব।, তাই যাই ম্যাম ইমার্জেন্সী।’’ এই বলে আমি শিং মাছের মত পিছলিয়ে আসলাম।



এরপর আক্কাস স্যারের ক্লাস। আর যাই হোক এই স্যারের ক্লাস মিস দিই না আমি, স্যার যখন প্রথম দিনে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন আমি তখনই বুঝে যাই, আর যাই হোক এই স্যারের ক্লাস মিস দেয়া যাবে না। স্যারকে দেখলে মনে পড়ে যায় তালপাতার সেপাইয়ের কথা, কিন্তু সজলের কাছে যে বিবরন শুনলাম তাকে উনাকে আর তালপাতার সেপাই মনে হয়নি। আর গতপরশু এক বড় ভাই মানে সেকেন্ড ইয়ারের ভাইকে যে মাইর দিসে, এমন মাইর কোন মালিক তার গাধারে দেয়না



টয়লেট সেরে আসতেই দেখলাম স্যার আসছে, আমিও তাড়াতাড়ি ক্লাসে ঢুকে পড়ি এবং সুন্দরভাবে বইখাতা রেডী করে রাখি।



…….







আক্কাস স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল।



এখন টিফিন বিরতি। আহ কি শান্তি!



সজলের খোজে আমি এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। ওর সাথে আমি প্রতিদিন টিফিনটা সারি। , তাকে কোথাও দেখলাম না। মনে হয় সে আগে ভাগে ক্যান্টিনে চলে গিয়েছে। কি আর করা যাই একা একা। পেছনের দরজা দিয়ে বের হতে যাব হঠাৎ পিঠে টোকা পড়ল, পিছনে ফিরতেই দেখি নুশরাত দাঁড়িয়ে আছে, হাসি মুখে।



“কি ব্যাপার ?” জিজ্ঞেশ করলাম।



“না কথা ছিল ।” সে বলল।



“কি কথা ?” এবার কিছুটা বিরক্ত হলাম, গলার মধ্যে সেই বিরক্তভাবটা লুকিয়ে রাখলাম না।



“সুমনা তোমার সাথে কথা বলবে। ”



ভ্রু কুচকালাম, “সুমনা কে, তোমার পাশে নানী টাইপ মেয়েটা। ”



ফিক করে হেসে ফেলল, মুক্তার মত সাদা ঝকঝকে দাত বের হয়ে আসল। আসলেই যে এই মেয়ের জীবনসঙ্গী সে আসলেই ভাগ্যবান।



“খুব সুন্দর টাইটেল দিয়েছ, হ্যা আর সে হল ক্লাস ক্যাপ্টেন।”



“জানি, সে নিজে এসে কথা বলুক ।”



“সেটা কি ভালো হবে ?” কথাটা নুশরাত হাসিমুখেই বলল, কিন্তু গলার স্বর অন্যরকম ছিল।



থমকে গেলাম, তার দিকে আমি তাকিয়ে থাকলাম। সে কি আমাকে সাবধান করছে নাকি মজা নিচ্ছে। যাই হক আমি কোন কেয়ার করি না।



“টিফিন খেতে যাচ্ছি, এরপরে এসে কথা বলব।” এই বলে হুস করে বের হয়ে গেলাম।



ক্লাস থেকে বের হয়ে ক্যান্টিনের দিকে দৌড় দিলাম, এই টাইমে পুরো হুড়হুড়ি লেগে যায়। আমি এইসব হুড়োহুড়ি ম্যানেজ করতে গিয়ে ক্লাস ক্যাপ্টেনের কথা ভুলে গেলাম।



ক্যান্টিন থেকে আমার প্রিয় ‘বাটার বন’ কিনে খুশি মনে ক্লাসের দিকে রওনা দিলাম। আমি ভাজা-পোড়া জিনিষ বেশী পছন্দ করি না। ক্লাসে বসে আমি মোড়ক খুলে বাটার বন খেতে লাগলাম এবং বই পড়তে লাগলাম।



খাওয়া শেষ হতেই দেখি, ক্লাস ক্যাপটেন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা খাতা। আরে সেখন এখানে আসল, তার আসার কোন শব্দ পেলাম নাতো, বিড়ালের মত চলাফেরা করে নাকি মেয়েটা!



মেয়েটা চশমার ফাক দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে সেই চোখ দিয়ে আমার মনের সব কথা পড়ে ফেলতে চাইছে।



শুকনো এক হাসি দিয়ে বললাম, “কি খবর ?”



মেয়েটা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, আগের মতই করে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করাই বলল, “তোমার ক্লাসে উপস্থিতির সংখা অনেক কম।”



একদিম সরাসরি আসল কথায় চলে আসল, কোন রকম ভুমিকাই ছাড়া। আসলেই সিরিয়াস টাইপের মেয়ে সে।



“হুম, তাই নাকি। সাত দিন তো হল মাত্র, এত আগেই অ্যাবসেবন্টের হিসাব নিচ্ছ কেন।”



“আমার নিজের সুবিধার জন্য। আর আমি চাই আমার ক্লাসে সবাই যেন সবকটা ক্লাস করে। ”



বলে কি মেয়েটা! সবকটা ক্লাস করলে আমি বেচে থাকব নাকি? কলজে জীবন শেষ হবার আগে আমার নিজের জীবন আগে শেষ হয়ে যাবে।



“মাত্রই তো কয়েকটা ক্লাস, তার জন্য এত লাফালাফি করার কি দরকার।” আমি বলে উঠলাম।



“আমার এত টেনশনে বা লাফালাফি কোনকিছুরই করার ইচ্ছা নাই, এই ক্লাসে একমাত্র তোমার উপস্থিতি একদম কম।”



“ও, তাই বুঝি।”



“হ্যা হিসাব দেখাব আমি তোমার যে কি অবস্থা ?”



“দেখাও।”

“হুম…” এই বলে সে তার খাতাটা খুলল, আমার কাছেই আর সাধারন খাতার মতই লাগল।



“বাংলা তিনটা ক্লাসে মধ্যে দুটোই নেই, ইংরেজীতে মাত্র একটা, আমার সন্দেহ প্রথম ক্লাসটা শুধু করেছ।”



কারেক্ট! আমি মনে মনে বললাম আর সেটা লায়লা আপুর। আমাদের ইংরেজী ক্লাস দুইজন নেন।

সে বলতে লাগল।



“রসায়নে দুটো, অংকে আজকে নিয়ে দুটো, বায়োলজিতেও একটা, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় পদার্থ বিজ্ঞানে তিনটাই ক্লাসে প্রেজেন্ট।”



“ফিজিক্স স্যারের ক্লাস মিস দেওয়া বিপদজনক।” আমি জবাব দিলাম, “খুবই কড়া মানের স্যার উনি।”



এই বলে মাথা ঝাকালাম।



সে খাতাটা ঠাস করে বন্ধ করল, এবং চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আমি চাই তুমি সব ক্লাস ঠিক মত কর, নাইলে…”



“নাইলে কি ?” আমি তার কথা শেষ করতে দিলামনা।



সে আমার দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “আমি বলছি ক্লাস ঠিক মত কর, নাইলে রিপোর্ট করব আমি গাইড টিচারের কাছে।”



বলে কি মেয়ে, এই রিপোর্ট যদি লায়লা আপুর কাছে যায় আমি শেষ। বুক কেপে উঠলেও আমি চেহারায় তা ফোটাতে দিলাম না। মেয়েটার ভাবসাব দেখে মনে সে চলে যাচ্ছে।

তখনি আমার কি যেন হল, আমি ঠাস করে বলে ফেললাম, “জান এই চশমা পরে থাকলে তোমাকে নানী নানী লাগে।”



বলেই বুঝে গেলাম আমি এবার ল্যান্ডমাইনে পা দিয়েছি, মেয়েটার চেহারা রাগে পুরো লাল হয়ে গেছে। এই চেহারা দেখে আমার টমেটোর কথা মনে পড়ে গেল। আর এই টমেটো আমার কাল হল। গাল বরাবর কি যেন উড়ে এল এবং ঠাস করে শব্দ হল।



মেয়েটা তার খাতা দিয়ে আমার গালে বাড়ি মারল। বাড়ির শব্দে পুরো ক্লাসে যে কথাবার্তা হচ্ছিল সেটা থেমে গেল।



“আমার সাথে ফাজলামি… একেতো ঠিকমত ক্লাস করে না আবার ফাজলামি করতে এসেছে।” মেয়েটা খ্যাপা বিড়ালের মত ফোস ফোস করছে আর বলছে।



আমিও থ মেরে গেলাম, কিন্তু সেটা কাটতে বেশী সময় লাগল না, “ঠিকই তো বলেছি, দাদী-নানিদের মত চেহারা হয়েছে তোমার। সত্যি কথা বললেই দোষ হয়ে গেল আমার।”

“আমার চেহারা নিয়ে তোকে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে ?”



হা ! এখন তুই তোকারি! আমার মাথা গরম হয়ে গেল, “আরে আসছে আমার বাংলা সিনেমার নায়িকারে, নায়িকার মত ডায়লোগ দেয়া শুরু করছে।”



“খবরদার, আরেকটা কথা বলবি তো থাপড় দিয়ে সব দাত ফেলে দিব।”



“দেখি কত শক্তি…”

“দামড়া, বুঝে শুনে কথা বল, আমি কিন্তু ক্লাস ক্যাপ্টেন।”

“আরে খাইছে আমার ক্লাস ক্যাপ্টনরে, মনে হয় ক্যাপ্টেন হয়ে বিশ্ব জয় করছে।”



“আরে আরে শুরু করছে কি এই দুজনে।” মাঝখান দিয়ে নুশরাত এসে পড়ল, মেয়েটার দিকে তাকিয়ে, “সুমনা শুরু করেছিস কি? ক্লাসে সবাই কি ভাবছে?” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, “তুমি না…”



আমি কি ? কথা শেষ করলে না কেন, হুমম…



কাধের পিছনে একটা টোকা পড়ল, মেজাজ আগে চড়ে ছিল এখন সেটা ফেটে গেল। পিছনে ঘুরে তাকাতেই সব রাগ পুরো বরফ পানির মত ঠান্ডা হয়ে গেল হয়ে গেল।



আমার রাগ বরফ পানির মত ঠান্ডা করার মত আর কে আছে এই কলেজে, হ্যা ঠিক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে লায়লা আফসারিন, তাও আবার হাসি মুখে।



আমার গলা দিয়ে ‘হিক’ করে একটা শব্দ বের হল, তারপর আর কোন স্বর বের হলনা।



“হায় হায়, আমার দুই গাইড স্টুডেন্ট ঝগড়া করছে, তা কি ঝগড়া… আ থাক থাক দুজনই আমার সাথে চল।”



নিজের কপালের সাথে সাথে সুমনা মেয়েটার পিন্ডি চটকাটে চটকাটে চললাম লায়লা আপু… সরি, ম্যামের পিছনে পিছনে চললাম।



*



টিচারস রুম।



আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার দুই হাত দূরে বসে আছে লায়লা ম্যাম, হাতে চিকন বেত।



টাশ…



ব্যাথায় চোখ দিয়ে পানি চলে আসতে লাগল, ইচ্ছে করছিল ব্যাথা লাগা জায়গায় একটু হাত দিয়ে ডলতে, আরাম পেতাম। কিন্তু অসম্ভব সেটা। আমি দু হাত উপরে করে দাঁড়িয়ে আছি। হাত নিচে নামতে গেলেই সপাং সপাং করে দুইটা বাড়ি পড়ছে।



“চুরি তো চুরি তার উপর সিনাজুরি, ক্লাস ঠিক মত করে না আর ক্যাপটেনের উপর খবরদারী করে।” এই বলে সপাং করে আরেকটা পড়ল বাড়ি। কোথায় পড়ল সেটা নাই বললাম, সাধারন বাংলাদেশের ছেলেরা আর কোথায় বাড়ি খায় সেটাতো জানই।



আবার ঐ জায়গা ডলতে ইচ্ছা করল, কিন্তু কিছু করলাম না, একটা ঢোক গিলা ছাড়া। বিড়বিড় করে সুমনা মেয়েটার পিন্ডি চটকাতে লাগলাম, লায়লা আপু আমাদের দুজনকে টিচারস রুমের ভিতর নিয়ে গেলেন। ভিতরে শুধু মিজানুর স্যার বসে আছেন। তিনি লায়লা আপুকে দেখে টিউব লাইটের মত করে জ্বলে উঠলেন। আর আমাকে দেখে জ্বলে উঠলেন কিন্তু কিছু বললেন না।



সুমনা সব কিছু সুন্দরভাবে সব বর্ণনা দিল। সুমনার প্রতিটি কথার সাথে সাথে লায়লা আপু আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমিও কুকড়ে যাচ্ছি। দূর থেকে মিজানুর স্যার আমাদের দিকে তাকিয়ে ঘটনা কি বুঝার চেষ্টা করছিলেন।



সুমনা চলে যেতেই লায়লা আপু তার চিকন বেত নিয়ে বলল, “হাত দুইটা উচু কর।”

“আমার কথাতো…”



আমার কথা শেষ হবার আগেই লায়লা আপু বেতে চালালেন। টাশ করে শব্দ হল।



“বলেছি হাত উচু করতে।”



হাত উচু করলাম আমি।



মাঝখান দিয়ে মিজানুর স্যার কোনখান থেকে এসে বলল, “ঠিক করছেন ম্যাডাম, এটাকে রেগুলার প্যাদানো উচিত। খুব বেশী ফাজিল এটা।”



“নিজের চড়কার তেল দিন আর আমার ব্যাপার আমাকে দেখতে দিন।”, তীক্ষ্ণ চোখে মিজানুর স্যারের দিকে তাকালেন। স্যার কেমন জানি ন্যাতানো মুড়ির মত মিইয়ে গেলেন।



এবার আমার দিকে তাকিয়ে, “ক্লাস ঠিক মত করো না কেন।”



আমি কিছু বললাম না।



টাশ…



“উত্তর কই।” বাড়ি মেরে বলল।



“ভাল লাগেনা।” ঠোটে ঠোট চেপে বললাম।



টাশ…!



“কেন ভাল লাগে না।”



“সরি ভুল হয়ে গেছে আপু…”



টাশ…!



“ম্যাম”



“সরি ম্যাম আর কখনও ক্লাস মিস দিবনা। ”



“সত্যি?”



“জ্বি, ম্যাম সত্যি।”



এবার লায়লা ম্যাম বেত টেবিলে নামিয়ে রেখে, “যাও, রেগুলার ক্লাস করবে, নাইলে এই বেত দিয়ে পাছার সব চামড়া তুলে দিব। ”



হাহ- একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আমি হাত নিচু করলাম। এবং ক্লাসে দিকে চলে গেলাম। সুমনা আগেই চলে গিয়েছিল, নিজের স্বঘোষিত রিপোর্ট জমা দিয়ে আর আমার বারোটা বাজিয়ে দিয়ে।



আঘাত পাওয়া জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে ক্লাসের দিকে গেলাম।



ক্লাসে রসায়ন ক্লাস হচ্ছে। আমি ক্লাসে ঢুকতেই সবার দৃষ্টি আমার দিকে আসল। সুমনার দিকে তাকালাম, বরাবর প্রথম বেঞ্চে বসে বোর্ডের দিকে নজর। যদিও সে আমাকে দেখে না দেখার ভান করতে লাগল। নুশরাত মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে একটা অসহায়ের হাসি দিল।



সত্যি কথা এই মেয়ে বিবাহিত না হলে আমি সত্যি এই মেয়েকে অফার করতাম। অবশ্য আমি এই শিউর না বিবাহিত কিনা, জিজ্ঞেশ করে নিব। তবে আমার মন বলছে সে বিবাহিত।



আমার বেঞ্চের কাছে আসতেই আমি দেখলাম সজল হাসি মুখে বসে আছে।



আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে লায়লা ম্যাডাম নাকি তোকে কুকুরের মত পিটিয়েছে।”

“কে বলেছে ঐ কথা, ক্যাপ্টেন নানী নাকি ?”



হু আজকে থেকে ওকে আমি ক্যাপ্টেন নানী বলে ডাকব, দেখি কি করে ও।



“আরে না ওতো ক্লাসে এসে চুপচাপ বসে আছে, সাদি বলছে, সে নাকি দেখছে ।”

“ওর সাথে পরে ব্যাপারটা দেখন, তা তুই কই ছিলি টিফিনের সময়।”



“সরি, আসলে আমার জিএফ(গার্লফ্রেন্ড) কল দিয়েছিল।”



“তুই কলেজে মোবাইল নিয়ে আসিস ?”



“হ্যা আসি তো, কেন তুনি নিয়ে আসিস না।” সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেশ করল।



আমার চুপ করে থাকা দেখে বলল, “আরে বাপরে যে কিনা লাগাতার ক্লাস মিস দেয়, সে কিনা মোবাইল নিয়ে আসে না কলেজে। ”



“কলেজের ক্লাস মিস দেয়ার সাথে মোবাইলের কি সম্পর্ক ?”



সজল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সামনে তাকাতে লাগল।



রসায়ন স্যার চলে যেতেই, ক্যাপ্টেন নানী মানে সুমনা বোর্ডের সামনে আসল বলল, “সামনে সপ্তাহ থেকে আমাদের ল্যাব ক্লাস শুরু হবে, এর জন্য প্রত্যেক গাইড থেকে গ্রুপ করে হয়েছে। আমি গ্রুপ নাম ও রোল নাম্বার বলে দিচ্ছি।”



একে একে সবার গ্রুপ বলতে লাগল। আমি আর সজল একই গ্রুপে, গ্রুপ কে।



সজল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “দোস্ত তোর কপাল খারাপ।”



“কপাল খারাপ মানে ?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।



“সুমনা আমাদের গ্রুপে ।” সজল এমন ভাবে বোমাটা ফাটাল, যেন কিছুইনা। আমার ধারনা সে এটাতে আরো মজা পেয়েছে। আমি সুমনার দিকে তাকালাম। তার চেহারা পাথরের মত নির্বিকার।



আমিও চুপ করে বসে রইলাম, কি করার আছে আমার। একসাথে ল্যাব ক্লাস করা আর এক গ্রুপে ল্যাব ক্লাস করার অনেক তফাত। এই মেয়েকি আমার পিছু ছাড়বেনা নাকি। তাছাড়া গ্রুপ হয় রোল অনুযায়ী কিন্তু এখানে এলোমেলো ভাবে সব করা হয়েছে। পুরো লটারি সিস্টেমের উপর।



আমি এবার দাঁড়িয়ে বললাম, “এই গ্রুপ সিস্টেমে সমস্যা আছে, কে করেছে এই গ্রুপিং ।”



“আমি করেছি ।” পিছন থেকে এক পরিচিত গলা বলে উঠল। আমার হৃপিন্ড গলার কাছে চলে এল।



ড্যাম, লায়লা আপু! পিছন থেকে এভাবে আসবেন না। এভাবে আসলে আমার হার্টের রুগি হতে সময় লাগবে না।



“কোন সমস্যা, রানা।” লায়লা আপু ঠান্ডা গলায় বলল।



আমি শান্ত সুবোধের মত বসে পড়ে বললাম, “ না কোন সমস্যা না।”



“তাহলে ঠিক আছে,… হ্যা সবাই এখন ক্লাস শুরু করি।”



আমি বসে একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুঝতে পারলাম, পেইনতো মাত্র শুরু।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.