![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগের পর্ব
সবাই হয়তো চিন্তা করছে কিভাবে সহকারী ক্যাপ্টেন হলাম। সহজ কথা, রুপা, নুশরাত আর সুমনার সাহায্যে। অবশ্য শেষের দুইজন নিজের অজান্তে করে ফেলেছে।
রুপা সহ ওর চার ফ্রেন্ড আমাকে ভোট দিয়েছে তারপর তার কিছু ম্যানেজ করেছে। নুশরাত নিজের সহ সে মনে হয় দুই তিনজনকে সে ম্যানেজ করেছে। সবচেয়ে বেশী হেল্প করেছে সুমনা আর নির্জন এই দুই ভাইবোন মিলে। ঠিক নুশরাতের মত সেও হয়তো চিন্তা করেছিল আমাকেতো আর শুন্য ভোট দেয়া যায় না তাই সে আর নির্জন আমাকে ভোট দিয়েছিল। আর নির্জনের ভোটই আমাকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করল। আগেই তো বলেছিলাম নির্জনের অনেক মেয়েভক্ত আছে। নির্জন যেদিকে যাবে এই মেয়েগুলিও তার পিছে পিছে ঠিক সেভাবে যাবে।
যদিও আমি নির্জনের ভোট আশা করি নাই। এটা আমার জন্য বিগ টার্ন পয়েন্ট ছিল।
যাকগে এসব কথা এবার আসল ঘটনায় আসি।
আমি আবার দ্বিতীয়বারের মত সবার সামনে দাড়ালাম। তবে এবার আমাকে কিছু বলতে হলনা। সুমনাই সব কিছু বলতে লাগল, “আজ থেকে রেদোয়ান হক রানা সহকারী ক্যাপ্টেন, যদি কোনো সমস্যা আমাকে না বলতে পার তাহলে তোমরা সবাই ওকে বলবে। আর তোমরা মনে হয় সবাই বুঝতে পেরেছ কেন আমি সহকারী ক্যাপ্টেন রাখলাম, কারন একা প্রায় পঞ্চাশজনের মত ছাত্র-ছাত্রী দিকে রাখা একটু হলেও কষ্টসাধ্য। তাই সবার কাছে আমি সাহায্য পাব এটাই আমার আশা,” এবার আমার দিকে তাকিয়ে, “তা রানা তোমার কোন কথা আছে এদের কাছে।”
“ধন্যবাদ সবাইকে। আমিও আশা করি সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পাব।” এই বলে আমি চুপ করে গেলাম।
“আচ্ছা ঠিক আছে একটু পরে ক্লাস শুরু হবে যে যার জায়গায় গিয়ে বস।” এই বলে সুমনা নিজের বেঞ্চের দিকে গেল, আমিও আমার বেঞ্চের দিকে গেলাম।
গালে হাত দিয়ে বসে আছি আর ভবিষৎ পরিকল্পনা করছি। পুরো ব্যাপারটা আরেকবার খতিয়ে দেখলাম, কি লাভ-ক্ষতি হল আমার। লাভের মধ্যে তেমন কিছুই দেখতে পেলাম না, আর ক্ষতির মধ্যে একটাই ক্লাস পালাতে পারবনা। একটা ক্যাপ্টেন কিভাবে ক্লাস মিস দিয়ে থাকে!
কিন্তু নো প্রবলেম, আমি আমার কাজ ঠিকই করে যাব। কথায় আছে না ‘ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’, আমারো ঠিক তাই অবস্থা হবে। কয়েকদিন যাক পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক তারপর সব দেখা যাবে। হুড়ুম-ধাড়ুম করে সব কিছু করলে আম-ছালা দুটোই যাবে আমার।
হঠাৎ করেই পিঠে চাপড় পড়ল, বেশী জোরে না তবেও চাপড়তো। আর ইদানিং খেয়াল করেছি আমার পিঠের উপর বদনজর পড়েছে। আর বলতে গেলে আমার এই অঙ্গের উপর সবাই অ্যাবিউজ করছে!
সজল আমার পাশে ধা করে বসে পড়ল, “যাক ক্যাপ্টেন হলি তাহলে।”
“সকারী ক্যাপ্টেন।” আমি শুধরে দিলাম।
“ওই এক কথা, চিন্তাও করতে পারি নাই তুই যে ক্যাপ্টেন হবি।”
“আমিও নিজেও না,” মিথ্যেটা বললাম, “সব মনে হয় সুমনার প্ল্যান করা।”
“হতে পারে, তবে আমি ব্যাপারটা এনজয় করব।” সজল হালকা হেসে বলল।
“কিভাবে?”
সজল আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। চুপ করে বসে থাকল। আমিও কি করব বসে থাকলাম, বাইরে বের হওয়া যাবে না কারন এখন লায়লা আপু… সরি ম্যাডামের ক্লাস।
আর সবসময়ের মত ক্লাসে পুরো ঝড় তুলে আসল লায়লা ম্যাডাম। কলেজের আলোচনার বন্যা ভাসিয়ে দিয়েছেন এই ম্যাডাম। কারন কলেজে সুন্দরী ম্যাডাম খুবই কম থাকে, কিন্তু আগুনের মত রুপ এটা শুধু নাটক-সিনেমায় হয় বাস্তবে তেমন হয়না। অনেক ছেলের মতে উনি যদি দুই কি তিন দিন মিডিয়া লাইনে ঘোরা-ঘুরি করে তাহলে তাহলে নাটক সিনেমার নায়িকা খুব সহজে হতে পারবেন।
অনেকেই অনেক কথা বলে থাকবে লায়লা ম্যাডাম সম্পর্কে্, সে এটাতে গেলে মানাবে, কিংবা ওটাতে গেলে মানাবে। আমার মতে সে যে বর্তমানে শিক্ষিকা হিসেবে আছে সেটাই তাকে অনেক মানিয়েছে। আমি মনে করি তার এই পেশায় থাকা উচিত। যদিও এই মহিলা যেখানে থাকবে সেখানে আমি নাই!
লায়লা ম্যাডাম সবার দিকে তাকিয়ে, “শুনেছি তোমরা নাকি, আরেকজন ক্যাপ্টেন বানিয়েছ, কে সে ?”
“রেদোয়ান হক রানা,” সুমনা দাঁড়িয়ে বলল, “সে আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন।”
“ওহ, তাই নাকি,” লায়লা ম্যাডাম বলল, “কই সে তাকে দেখছি না তো।”
ফাজলামি করছে নাকি! সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সে জায়গাটা কিছুটা উচু করে বানানো। সেটাকে কি বলে আমার ঠিক মনে নাই। তবে সব স্কুল কলেজে থাকে। সেখান থেকে সবাইকে যাতে ভালভাবে দেখা যায় ঠিক সেইভাবে বানানো। সে আমাকে নির্ঘাত দেখতে পেয়েছে তারপরেও না দেখের ভান করছে। এই মহিলা আমার সাথে সারাজীবন ফাজলামি করে গেল, আমার হাড় জ্বালিয়ে গেল।
আমি গোমড়া মুখে উঠে দাড়ালাম।
“ও, তুমি।” এমনভাবে বলল যেন আমাদের মাঝে আজকেই প্রথম দেখা, কয়েকদিন আগে যে আমার উপর বেত চালানো হল সেটার কথা কি হজম করে ফেলল নাকি!
সে তার কথা চালিয়তে যেতে লাগল, “তুমিতো আমার গাইডে আছ, যাক আমার গাইডের দুইজন এক ক্লাসের ক্যাপ্টেন,” মুখে হাসি রেখেই বলল, “তা বাড়ির কাজ এনেছেন?”
প্রশ্নটা আমার বুকে বাড়ি মারল। না আজকে বাড়ির কাজ আনা হয় নি আমার।
মাথা নাড়িয়ে বললাম, “না, আনা হয় নি।”
“কেন, জানতে পারি ?”
“কারন এর আগের যত গুলো বাড়ির কাজ দিয়েছিলে…এন সেটা আপনি দেখেননাই,” একটু থামলাম, আরেকটু হলে তুমি করে বলে ফেলেছিলাম, “তাই আজকে সেই আশায় আমি বাড়ি কাজ আনি নাই।”
“কত সুন্দর অজুহাত, তা গেট আউট।”
“কোথায়?”
“ক্লাসের বাইরে, চাঁদ।”
সারা ক্লাসে হাসির রোল উঠল।
এতদিন বাড়ির কাজ দেখে নাই, আজেকে ক্যাপ্টেন হলাম আর আজকে বাড়ি কাজ দেখার প্রয়োজনীয়তা বাড়ল। এই অজুহাতে আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হল। কি করা বের হতে হবে আমাকে। দরজার কাছে আসতেই, “বাইরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই,” লায়লা ম্যাডাম বলে উঠল, “তোমার তো আবার পিছলিয়ে যাবার স্বভাব।”
ক্লাসরুমের বাইরে দাড়িয়ে আছি, লায়লা ম্যাডামের লেকচার আবছা আবছা শুনতে পাচ্ছি। আমার মনোযোগ অবশ্য সেদিকে নাই। ইংরেজী বিষয়ের উপর আমার কোন বিতৃষ্ণা নাই, অন্যকোনো বিষয়ের উপরতোই নাই। তবে পড়ানোর উপর আমার বিরক্তি এসে গেছে। সে কবে থেকে একটা ইংরেজী বই বারবার কিনে সেই একই ধরনের জিনিষ পড়ে যাচ্ছি। ব্যাপারটা পীড়াদায়ক!
আর যে পরিমান বই দেয়া হয়, বাবাগো! যেন ক্লাস টেন পাস করার আগে পিএইচডি বানানোর মতলব। আর আমাদের অভিবাবকরাও মনে করেন বই বেশী না থাকলে ছেলে-মেয়েদের পড়া লেখা হয় না। তাদের কাছে বিদ্যা হল পাচমিশালী শরবতের মত ‘গুলে দাও আর গিলিয়ে দাও’ ।
যদিও এখন অনেকের এই ধ্যান-ধারনা কমছে। তবে এই ব্যাপারটার বৃদ্ধি অনেক কম। তবে আশার কথা এটা ভবিষত্যে আরো বাড়বে। আশা করি পড়ালেখার মান বাড়বে।
আহহহ~ আবার উড়াধুড়া চিন্তায় ভেসে গেলাম। আমার উচিত ছিল পলিটিশিয়ান হওয়া। আমার চাপায় জোর আছে সেটা অনেকেই বলে, তবে এর প্রমান আমি আগে তেমন দেখাতে পারিনাই, সামনে পারব নাকি দেখা যাক।
আমার অবশ্য সাইন্স নিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল না। আব্বা-আম্মা- এই কথা বলে ছিলাম। আম্মা খেমটি দিয়ে উঠেছিল। আব্বা চুপ ছিল। আমার তিন বোনের একটাও তেমন কিছু বলে নি, তবে আম্মার লাফালাফি দেখার মত ছিল। তার কথা ছিল, এই ফ্যামিলির একমাত্র ছেলে যদি সাইন্স না নিয়ে পড়ে তাহলে তার ফিউচার অন্ধকার। বর্তমানে বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারদের যুগ। এই ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে কোনো লাভ নাই, আরো হাবিজাবি।
আব্বার কথা হল, শোন বাবা এখন ইঞ্জিনিয়ারদের অনেক দাম। এমনকি বিয়ে করতে যাবি সেখানে পাত্র খুজবে ইঞ্জিনিয়ার, দেখিস!
আমি বিশ্বাস করলাম, কারন আমার বাবা যা বলেন তা অধিকাংশ ভুল হয় না।
আরো যোগ করেছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার পাশ করার পর তুই যা ইচ্ছা তাই করতে পারিস, এমনকি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ও, তবে বাবা পাছার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সিলটা মারতে ভুলিস না!
আসলেই আমার আব্বা একটা কুল !
আপিও তাই বলেছে। তারপর আর কি আমি এখন সাইন্সে আছি।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে স্কুলটা দেখা যায়। এই স্কুল আর কলেজ একই ট্রাস্টির আন্ডারে। তাই পাশা-পাশি একসাথে অবস্থান করছে। এমনকি স্কুল-কলেজের মাঠই একই। স্কুলটা তিনতলা, সে তিনতলার এক জানালার পাশে দেখলাম একট মেয়ে বসে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।
আমিও কি মনে করে মেয়েটার দিকে লক্ষ্য করে হাত নাড়ালাম, তখনই আমার কানের একপাশ জ্বলে উঠল।
আআআইইইই~~
লায়লা ম্যাডাম আমার কানটা চেপে ধরেছেন, “ক্লাস থেকে বের হয়েও ইতরামী, স্কুলের মেয়েদের সাথে লাইন মারা হচ্ছে,” বলে কানে আরেকটা মোচড় দিলেন, “যাও ক্লাসে বাইরে রেখেও শান্তি পাওয়া যাবে না।”
কানে হাত দিয়ে গোমড়া মুখে আমি ক্লাসে ঢুকলাম। কানের মধ্যে হাত বুলাচ্ছি, জ্বলছে ওই জায়গাটা। সবাই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। গেছে আমার ক্যাপ্টেনগিরি।
*
ক্লাসে স্যারের বকবক শুনতে শুনতে মাথা ধরে গিয়েছিল মেয়েটার। বোরিং লাগছে তার কাছে। এমনকি তার বান্ধবী এখন ঝিম মেরে বসে আছে। তার এই অবস্থা গত কয়েকদিন ধরে, জিজ্ঞেশ করলে কিছু বলেনা। সে যতটুকু জানে তার বান্ধবীর এক বয়ফ্রেন্ড আছে। সে কলজের সেকেন্ড ইয়ারে পরে।
ছেলের সাথে সমস্যা?
না তাতো হওয়ার কথা না। সে যতটুকু জানে, ছেলেটা অনেক ভাল। বর্তমানে কিছু লাফাঙ্গা টাইপ আছে তাদের মত না। আবার কিছু রোমিও টাইপের আছে, আজকে এই মেয়ে কালকে ওই মেয়ে সেটাও এই ছেলের মধ্যে নাই। অনেকটা সিরিয়াস টাইপের কেয়ারিং ছেলে। যেটা অনেক মেয়ের কাম্য।
ওই ছেলে রিলেশনঘটিত ব্যাপারে খুবই সিরিরাস। ব্রেকআপের কথাই আসে না এখানে তাহলে কি হয়েছে?
আরে জিজ্ঞেশ করলেও তো সে কিছু বলে না। তার বান্ধবী কি তাকে বিশ্বাস করেনা ?
তারা সেই ক্লাস সিক্স থেকে বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে, এখন তারা ক্লাস টেনে পা দিয়েছে। আর কয়েক মাসের মধ্যে টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হবে। প্রায় পাচ বছরের মত হয়ে গেছে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব বজায় আছে। এর মধ্যে একবারও তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি, তবে তর্ক হয়েছে অনেক। আজকে ধরতে হবে ওকে কি সমস্যা ওর?
সে এবার জানাল দিকে তাকাল। কলেজের একটা ছেলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাড়িয়ে আছে মনে হয় একটা দেবদাস দাড়িয়ে আছে!
অবশ্য আমার পাশে মনে হয় আরেকটা মহিলা দেবদাস বসে আছে! মনে মনে বলল সে।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকল, মনে হয় কিছু ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করছে।
হাত নাড়াব নাকি, মনে মনে বলল মেয়েটা।
এটা মাথায় আসতেই তার বুক ধক করে উঠল। সে জীবনে ঠিকমত কোনো ছেলের সাথে কথা বলে নি। ছেলেটাকে হাই দিতে তার ইচ্ছে করছিল, কিন্তু মন থেকে কেমন যেন দ্বিধা করছিল। ছেলেটা যদি অন্য কিছু মনে করে!
সেতো শুধু মজা করার জন্য হাত নাড়িয়েছিল!
অবশ্য ছেলেটার চেহারা খারাপ না, দিয়ে দিই যা হবার হোক।
এই বলে ছেলেটার দিকে লক্ষ্য করে হাতা নাড়াল। ছেলেটাও এবার তার দিকে অবাক হয়ে তাকাল, তারপর তার দিকে লক্ষ্য করে হাত নাড়াল।
আআআ~~ সে আমাকে হাই বলে হাত নাড়িয়েছে, মনে মনে বলল মেয়েটা।
কিন্তু এরপর যে ঘটনা হল সেটার কারনে সে হাসবে নাকি কাদবে সেটা বুঝতে পারল না।
একটা সুন্দরীমত ম্যাডাম এসে তাকে কান ধরে ক্লাসরুমের ভিতর নিয়ে গেল। সে একটু অবাক হল তবে ছেলেটার মুখের ভাবভঙ্গি দেখে সে ফিক করে হেসে ফেলল।
মেয়েটার বান্ধবী অন্যদিকে চিন্তায় মগ্ন থাকলেও সে ঠিকই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ছিল, কি করে দেখছিল। সে সবই দেখেছে। সসে তার বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে হালকা একটা হাসি দিল। তবে সেই হাসি কেউ দেখল না।
*
কানের ব্যাথা কমেছে তবে কান যে এখনো লাল হয়ে আছে সেটা আমি ভাল করেই বুঝতে পেরেছি। এই ধরনের কাল মলা আমাকে সে অনেক বার দিয়েছে, আরো ঘন্টা খানেক থাকবে এই লাল লাল ভাব।
বাইরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব কিন্তু এক কান লাল হয়ে আছে সেটা নিয়ে বাইরে ঘোরঘুরি করা ঠিক হবে না। মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে!
গালে হাত দিয়ে বসে আছি। ক্লাসের বাকী ছাত্র-ছাত্রীরা কি করছে সেটা দেখছি। কয়েকজন আবার আমার দিকে তাকাল। তবে তেমন কিছু বলল না।
হঠাৎ করেই নুশরাত আর সুমন আমার সামনে এসে দাড়াল।
“কি হে ক্যাপ্টেন হতে না হতেই প্যাঙ্গামো শুরু করেছ ?”
প্যাঙ্গামো! এটা আবার কি!
“ওটা একটা দুর্ঘটনা,” আমি বললাম, “ওই মেয়ে আগে আমাকে হ্যালো বলে হাত নড়িয়েছে।”
“ও, এখন আবার হ্যালো বলেছে?” সুমনা বলে উঠল।
“আরে, বলতেই তো পারে, সে একটা স্বাধীন দেশের মেয়ে, তার কোনো অধিকার নাই কোনো ছেলেকে…”
আমার কথা শেষ হল না।
“আছে,” সুমনা আমার দিকে আঙ্গুল তাক করে, “তবে তোমার মত ছেলের কাছে তার দূরে থাকাই ভাল।”
“কি বলতে চাও?”
“আমি একটা মেয়ে, তাই আমি চাইনা সে কোনো ভুল করুক।” এই বলে সুমনা মাথা ঝাকাল।
“তা কি কারনে এখানে এসেছ ?” প্রসংগ পরিবর্তন করে করলাম, “নিশ্চয়ই নিজের চেহারা দেখাতে আমার কাছে আস নাই।”
আমার চোখ যদি ভুল না করে, সুমনার চেহারা লাল হয়ে গেল, “ফালতু কথা বাদ দাও, ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়েছে কি গালে দিয়ে বসে থাকার জন্য ?”
“অবশ্যই না,” বললাম, “তবে করবটা আগে থেকে একটু ধারনা দিতে হবে না।”
সুমনা এবার থম মেরে গেল। একটু ভেবে, “সবার দেখ-ভাল করতে হবে।”
নুশরাত সুমনার পিছে দাড়িয়েছিল, এটা শুনে কপালে হাত দিল সে।
“আমিতো এখানে বেবিসিটিং করতে আসি নাই, আর আমার ধারনা ক্লাসের সবাই নিজের দেখভাল নিজেই করতে পারবে।” বলে সুমনার দিকে তাকালাম।
সুমনা ঠোট কামড়ে ধরল, মনে হচ্ছে সে তার রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। আঙ্গুল দিয়ে নিজের চশমাটাকে একটু উপরে তুলল।
তাকে আরেকটু খোচা দেবার লোভ সামনলাতে পারলাম না, “ফেক চশমা পড়ে আলাদা ভাব নেয়ার দরকার নেই।”
আমার এই কথা যেন তার মুখে হাতুড়ির আঘাত করল। তার মুখে একটাই ভাব ফুটে আছে, তুমি জানলে কিভাবে?
তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলাম। সুমনা যেন কিছু বলতে চাইছে কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ভাবলাম আরেকটা খোচা দিব নাকি! কিন্তু পরে নিজেকে বিরত, অবস্থা খারাপ হয়ে যেতে পারে। মেয়েটা কিন্তু আমার দিকে একাধারে তাকিয়ে আছে, ব্যাপারটা আমার কাছে অস্বস্তিকর। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার কেমন যানি অস্বস্তি লাগে।
কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগল আমার, এই মেয়ে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকে না, প্লিজ, প্লিজ…
মনে মনে বলতে থাকলাম, নুশরাত এতক্ষন পিছন থেকে সব দেখছিল, কিন্তু আমার চেহারা হঠাৎ করেই ভেবড়ে যাওয়ায় সে এবার সামনে এগিয়ে আসল। সে সুমনার কাধ ধরল, “অনেক হয়েছে চল।”
সুমনা তার ক্তহা কানে নিল না, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিজেকে কি মনে কর? হ্যা,” বিড়ালের মত হিসহিসিয়ে বলল সে, “আমার সাথে এত টাল্টিবাল্টি করতে এস না, আমি কিন্তু মেয়েটা বেশী ভাল না।”
শেষ কথাটা কেমন জানি ফাপা ফাপা লাগল।
নুশরাতের কারনে আমার কনফিডেন্স আরো বেড়ে গিয়েছিল, “আমি কি করেছি?” বললাম, “আর সবার সাথে যেমন মজা করি তোমার সাথেও আমি তেমনি মজা করছিলাম। এত সমস্যা কিসের। যদি ভাল না লাগে বল।”
“আমার সাথে কেউ মজা করুক সেটা আমার ভাল লাগে না।”
“এটা মুখের কথা না মনের কথা ?”
“দুটোরই। তোমার সাথে আলগা খাতির করার ইচ্ছা আমার নাই। সহকারী ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়েছ তাই পরামর্শ দিতে এসেছিলাম।”
“সেই জন্য ধন্যবাদ।” আমি বললাম
আমি যা ধারনা করেছিলাম তা কিছুটা প্রমান হচ্ছে। বুঝতে পারলাম আগুনটাকে আরো উসকে দিতে হবে, একটা শিক্ষা না দিলে মেয়েটা কিছুই শিখবে না।
“এত দেমাগ ভাল না।” আমি বললাম।
সে চলে যাচ্ছিল, আমার কথা শুনে দাড়াল সে।
“আমার সাথে বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু খবর আছে তোমার।” সুমনা কাপা গলায় বলল। বোঝা যাচ্ছে সে তার সহ্যের সীমায় চলে যাচ্ছে।
“কি করবে তুমি?” মুখ ভেংচে বললাম, “হয়তো স্যার ম্যাডামকে বলবে, স্যার এই ছেলে আমাকে ডিস্ট্রাব করে, আমাকে ঠিক মত কলেজে ক্লাস করতে দেয় না, এইতো।”
“বাস, অনেক দূর হয়েছে, অনেক সহ্য করেছি তোমার কথা, নিজেকে…” চেচিয়ে বলল কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না। নুশরাত তার কাধ চেপে ধরল। তার কানে ফিসফিস করে কি যেন বলল।
যা হবার তা হয়ে গেছে সবাই আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
যাক মেয়ে ফাদে পা দিয়েছ!
এবার ঘুঘু র ফাদ দুটোই দেখাব আমি তোমাকে।
*
ক্লাসরুমে ঢুকতেই দেখলাম সুমনা একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কি কথা যেন বলছে। প্রথমে সে্টা এড়িয়ে যেতে চাইলাম। পরে মনে হল যাই দেখি, মেয়েটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কেদে ফেলবে।
“কি সমস্যা?”
আমার এই হঠাৎ আগমন তাদের দুজনকে চমকে দিল। সুমনা প্যাঁচার মত মুখ করে বলে উঠল, “একটা প্রবলেম নিয়ে আলোচনা করছি দেখছ না।”
“কি ব্যাপার জানতে পারি?”
সে বোধহয় বলতে চেয়েছিল, সেটা তোমার ব্যাপার না। কিন্তু আমি যে ক্লাস ক্যাপ্টেন হয়েছি সেটা তার মনে পড়ল। সে চুপ করে গেল তারপর মেয়েটার দিকে তাকাল। মেয়েটাই এবার আমাকে বলল, “চাচার বিয়ের উপলক্ষ্যে আমরা ফুল ফ্যামিলি গ্রামের বাড়ী গিয়েছিলাম। তাই গত সপ্তাহ আমি আসতে পারি নাই, আজকে আসতেই শুনলাম ক্যাপ্টেন নাকি আমার নামে রিপোর্ট দিয়েছে স্যারের কাছে।”
“তাই নাকি।”
“হ্যা, এখন কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না, আর ক্যাপটেনও বলছে সে নাকি কিছুই করতে পারব না কারন সে রিপোর্ট জমা দিয়েছে আর আমার গাইড টিচার অনেক কড়া কি করব কিছু বুঝতে পারছি না…”
মেয়েটা মনে হয় আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, আমি থাকিয়ে বললাম, “অ্যাপ্লিকেশ্ন জমা দাও, আমি দেখছি কি করে যায়।”
“তুমি কি করে করবে?” মেয়েটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেশ করল।
“আরে গত সপ্তাহতো আসো নি তাই জানো না,আমি এখন সহকারী ক্লাস ক্যাপ্টেন,” আমি বললাম, “তাড়াতাড়ি আমাকে অ্যাপলিকেশনটা দাও স্যারের সাথে আমি কথা বলব।”
সুমনা এতক্ষন চুপ করে ছিল, এবার বলে উঠল, “আরে এটা কি হচ্ছে?”
“কিছুই না, কেউ একজন বোকার মত কাজ করেছে সেটার মাশুল দিচ্ছি।”
“তাহলে তুমি বলতে চাইছ আমি বোকার মত কাজ করছি।”
“তাহলে না জেনে শুনে মেয়েটার নামে রিপোর্ট করেছ কেন স্যারের কাছে।”
“মেয়েটার উচিত ছিল আমাকে জানানোর কিন্তু জানায়নি…”
“তোমার কন্ট্রাক নাম্বার জানে সে, তোমাকে যে জানাবে।”
“আমি কেন যাকে তাকে আমার কন্ট্রাক নাম্বার দিব। ”
“তার কোন ফ্রেন্ডের কাছে জিজ্ঞেশ করেছ কেন সে আসেনি?”
“না।” সুমনা বলল।
“আমার যতটুকু ধারনা তুমি তার নামও পর্যন্ত জানতে না রিপোর্ট করার আগ পর্যন্ত,” আমি একটু রাগের সাথেই বললাম, “”দেখেছ সাতদিনের মত অ্যাবসেন্ট জাস্ট স্যারের কাছে রিপোর্ট করে দিয়েছ।”
সুমনাকে থতমত খেতে দেখলাম। তারমানে আমি যা ধারনা করেছি তা সত্য।
“আমার এখন কিছু করার নেই।”
এটা শোনার পর আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। এত সেলফিশ হয় কি করে, ভুল করেও সেটা স্বীকার করে না। পাশের মেয়েটা যাকে নিয়ে এত কিছু সে এবার বলে উঠল, “আমি অ্যাপ্লিকেশন লিখে আনছি।” এই বলে সে চলে গেল।
আমিও সুমনাকে কিছু না বলে আমার জায়গায় চলে গেলাম।
মেয়েটার সমস্যা কি? সেকি একদম সেলফিশ টাইপের নাকি। কারো প্রতি তার মায়া-দয়া নেই। এই চিন্তা করতে করতে আমার বেঞ্চের দিকে গেলাম। ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে আমি পড়া শুরু করলাম। এখন অফ পিরিয়ড চলছে। বইটা পড়া শুরু করলাম।
“এক্সকিউজ মি!”
বই থেকে মনোযোগ আমার সরে গেল। কতখন পড়ছিলাম জানিনা। বই থেকে মুখ তুলতেই দেখলাম সেই মেয়েতা দাঁড়িয়ে আছে হাতে অ্যাপ্লিকেশন।
“ও, আচ্ছা,” এই বলে আমি অ্যাপ্লিকেশন হাতে নিলাম, “স্যারের সাথে আমি কথা বলব, কিন্তু অ্যাপ্লিকেশনে তোমার অভিবাবকের সাইন লাগবে। তা নাহলে স্যারকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে।”
“আমি আনতে পারব।” আমার বাসা কাছেই মেয়েটা বলল, “এখন তো অফ পিরিয়ড চলছে।”
“হুম,” একটু চিন্তা করে, “চল স্যারের কাছে যাই উনার কাছ থেকে গেট পাস নিয়ে তারপর দেখা যাবে। বাসায় তোমার বাবা আছে না?”
“হ্যা আছে, আজকে উনি অফিসে যাননি।”
“ঠিক আছে।” এই বলে আমি ওকে নিয়ে টিচারস রুমে গেলাম।
“আমার নাম মিলি।” মেয়েটা বলল।
“হুম, আমি রানা।” বললাম।
জানি এই বলে মেয়েটা হাসল।
আমি বাধ্য হয়ে মেয়েটা মানে মিলির সাথে ওর বাসায় যাচ্ছি। ইচ্ছা ছিল না, বারবার বইয়ের দিকে মন যাচ্ছিল। স্যারকে বলছিলাম আমি এই কথা যে সে তো নিজেই যেতে পারে। বললতো পাচ মিনিটের মত লাগবে। স্যারের কথা হল, “মেয়েটা যদি সাইন নকল করে আনে।”
মনে মনে বললাম, আপনি স্যার হলেন কিভাবে এই বুদ্ধি নিয়ে! নকল করতে পারলে তো সে ক্লাসরুমেই করতে পারত। আর আমিও তো তাকে সাহায্য করতে পারি!
যত্তসব!
“সুমনা মেয়েটা এইরকমই আগে থেকে।”
মিলির কথা শুনে আমার ধ্যান ভাঙল, “মানে ?”
“আমার এক ফ্রেন্ড আর ও একই স্কুলে ছিল। মেয়েটা এইরকমই, নিজের ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই বোঝে না সে।”
“তাই নাকি?”
“হ্যা তার কারনে এক ছেলের টিসি পর্যন্ত হয়েছে।”
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম, বলে কি মেয়েটা! টিসি!
“ছেলেটা কি করেছিল?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“আর কিছুই না তাকে শুধু অফার করেছিল এই যা,তবে ছেলেটা হাল ছাড়েনি, বারবার তাকে জিজ্ঞেশ করত, আসলেই ছেলেটা তাকে পছন্দ করত।” মিলি একটু থেমে, “ওই মেয়ে আসলেই স্বার্থপর টাইপের।”
“ছেলেটার সম্যসা ছিল,” আমি বলে উঠলাম, “এখানে তো আমি সুমনার দোষ দেখি না।”
“কিভাবে?” এবার মিলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চোখের মধ্যে এক ধরনের কৌতুহল, “তুমি দেখছি এখন ওর পক্ষ হয়ে কথা বলছ।”
“আমি যদি বলি আমি তোমাকে ভালবাসি তাহলে তুমি কি করবে?”
আমার এই প্রশ্ন শুনে মিলি চমকে গেল, “সম্ভব না আমার পক্ষে।” তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
“না আমাকে ভালবাসতেই হবে।” আমি জোর গলায় বললাম।
“পারব না, আমি অন্য একজনকে পছন্দ করি।”
“তারপরেও।”
“এই নিয়ে আমি এখন কোনো কথা বলতে চাই না,”সে এবার কিছুটা রেগে গেল, “তোমাকে ভাল মনে করেছিলাম, কিন্তু তুমি দেখছি যাকে তাকে ‘ভালবাসি’ কথা বলা শুরু করেছ। আরেকবার এই নিয়ে কথা বললে আমি স্যারের কা…” আমার দিকে তাকিয়ে সে থেমে গেল। বোকা বোকা চেহারা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
তারপর মাথা নিচু করে রইল।
“তাড়াতাড়ি কর, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।” এবার আমি তাকে তাড়া দিলাম।
মিলি আর আমি কোনো কথা বললাম না। সে সত্যি কথাই বলেছিল তার বাসা বেশী দূরে না। সে যখন বাসায় ঢুকতে গেল আমি তখন বললাম, “শোনো, তোমার বাবার ফোন নাম্বার অ্যাপ্লিকেশনে লিখতে বল, নাহলে স্যার পরে পেইন দিবে। ”
আমার কথা শুনে সে কেপে থেমে গেল তারপর “জ্বি আচ্ছা” এই বলে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।
ফিরে আসার সময়।
“ধন্যবাদ।”
“আরে ধুর এটাতো ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব।” আমি হাত নাড়িয়ে বললাম।
“না, সুমনার ব্যাপারটা নিয়ে… ”
“আরে বাদ দাও,” আমি বলে উঠলাম, “ওসব ভুল সবারই হয়।”
“ওকে আমি স্বার্থপর বলেছি।” এই বলে মিলি মাথা নিচু করে রইল, “ওকে এতদিন ভুল বোঝে এসেছি আমি।”
“তোমরা কি একই স্কুলে ছিল?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
মাথা ঝোকাল সে, চোখের পানি মুছে মনে হয়। আমি শিউর না কারন সে মাথা নিচু করে ছিল।
“এটা ক্লাস এইটে থাকার সময় হয়েছিল,” মিলি বলতে লাগল, “সে আর আমি ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম। আর আমি যে ছেলেকে পছন্দ করতাম সে সুমনাকে পছন্দ করত… আমার সমস্যা ছিল না। আমি মেনে নিতাম… তবে ওর কারনে যখন সেই ছেলের টিসি হল… তখন আমি সুমনাকে ক্ষমা করতে পারি নাই।”
আমি এখন কি বলব সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। শক খেয়েছি সেটা ঠিক না। কিন্তু কেউ যখন কেদে উঠে আমি তখন একটু অস্বস্তিবোধ করি। কি বলে সান্তনা দিব সেটা বুঝে উঠতে পারি না। মিলি স্কুলে থাকতে সুমনার ফ্রেন্ড ছিল। একটা ছেলের কারনে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বটা ভেঙ্গে গেল। এটা কমন ব্যাপার সবজায়গায়।
“কিন্তু কিছুক্ষন আগে তোমারা যখন কথা বলছিলে তখনতো মনে হচ্ছিল কেউ কাউকে চিননা ?”
“ওইটা মেয়েদের ব্যাপার বুঝবে না তুমি।” নাক টেনে বলল সে।
বোঝার দরকার নাই! খাচ্ছি দাচ্ছি আর বাশি বাজাচ্ছি ভালইতো আছি
হাতের ঘড়ির দিকে তাকালাম, আরে আর মাত্র পাচ মিনিট আছে ক্লাস শুরু হবার। এবার আমি বললাম, “তাড়াতাড়ি কর, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”
“হা… আচ্ছা,” এই বলে সে তার চোখে পানি মুছে ফেলল, “তুমিতো ক্লাসের ব্যাপারে সিরিয়াস না। কিন্তু এখন ক্লাস করার জন্য মুখিয়ে আছ।”
“তুমি বুঝলে কিভাবে?”
“সুমনা যার পিছনে লেগেছে তাকে আমি ভালভাবে লক্ষ্য করবনা সেটা কোনো কথা হল।”
আরে মেয়ে এখনো সুমনার প্রতি টান আছে!
ওই আমার উপর নজরদারি কিসের জন্য। আমি আবার কি করলাম ?, বলতে চাইলাম কিন্তু সেটা মনেই রেখে দিলাম।
“কি হলল বললে না তো?” সে এবার একটু জোর দিয়ে বলল, তবে রাগের সাথে নয় তার প্রশ্নের সাথে কৌতুহল ছিল।
“না, ক্লাস নিয়ে এখনো আমার কোনো মাথা ব্যাথা হয় না, তবে এখন…”
“এখন?”
“এখন আক্কাস স্যারের ক্লাস, ওই ক্লাস মিস দেয়া যাবে না!”
*
তাল বেগুন গুলো কেটে রাখছি। আজকে আপি বলেছে সে রান্না করবে। ইদানিং সে রান্না-বান্নার উপর মনোযোগ দিচ্ছে। আগে অবশ্য তার রান্না করা খাবার খাওয়া যেত না তবে এখন সে খারাপ রান্না করে না। মানে সে রান্না যেগুলো করে তা খাওয়া যায়। আগেরগুলি তো মুখে তুলতেই কষ্ট হত। অনেকেই প্রথমে দেখি কঠিন পদের রান্না করে যেমন, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, কিংবা গরু ব মুরগি। যারা এইসব আগে থেকে শুরু করে তারা কখনও ভাল ভাবে রান্না শিখতে পারে না। অন্তত আমার তাই ধারনা। যারা ডিম ভাজি আর আলু ভর্তা টাইপ জিনিষ দিয়ে শুরু করে তারা দেখেছি অনেক ভাল রান্না করে।
আপি যেদিন আমাকে বলল সে রান্না করতে চায়, সেদিন মনে হয়েছিল আজরাইলের সাথে আমার মোলাকাত হতে বেশী সময় লাগবে না। আঠার বছর হবার আগেই মনে হয় আমাকে অন্য দুনিয়ার পথে হাটতে হবে। তবে আপি ম্যানেজ করে ফেলেছে কিভাবে যেন!
বেগুনে হলুদ মেখে রেখে দিয়েছি। আপি কাজ হবে শুধু এসে রান্না করা। সব গোছানো শেষ আগে আপিকে ভাজা-ভাজি জিনিষটা ভালভাবে শিখিয়া তাপর নাহয় অন্য পদের রান্নাতে হাত দেয়াতে হবে। টাওয়েল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আমি রান্না ঘর থেকে বের হলাম। তখনই আমার মোবাইল বেজে উঠল। বেজে উঠা কি কেপে উঠল। আমি ভাইব্রারেশন মোডে রাখি আমার মোবাইল। উচ্চ আওয়াজের রিংটোন আমার মাথায় বাড়ি মারে।
স্ক্রিনে আপার নাম উঠল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করলাম, “কি হয়েছে?”
“বেয়াদব, কি হয়েছে এটা বলতে হয় নাকি, এর আগে কি কোনো হাই হ্যালো নাই!”
“সরি, ভুল হয়ে গেছে। তা কি হয়েছে?”
আপার বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্পীকারের মধ্যে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল, “তোদের তিন জনের কাছে জীবনে মনে হয় কোনদিন রেসপেক্ট পাব নারে।”
“আপুর সাথে যোগাযোগ করে ছিলে নাকি?” জিজ্ঞেশ করলাম।
আপু মানে আমার মেঝ বোন নাম সানজিদা হক, ডাক নাম সানু।
“হ্যা, একটা বিপদে পড়েছি তাই তার কাছে ফোন দিয়েছিলাম…”
“কিসের বিপদ ?” আপার কথা শেষ হবার আগেই আমি বলে উঠলাম।
“আগে কথা শেষ করতে দে হারামজাদা।” আপা হুংকার দিয়ে বলল, “বেয়াদবের মত কথা বলা শিখেছে, মুরুব্বিদের মুখের উপর কথা বলে। আগে আদব কায়দা শিখবি, বান্দর। ”
আমি মোবাইলটা আমার কান হতে এক হাত দূরে রাখার পরেও আপার কথা পরিষ্কার শুনতে পেলাম।
“তা কই যেন ছিলাম আমি ?”
“বান্দরের কথা বলছিলে।” আমি ধরিয়ে দিলাম।
“অ্যা হ্যা,…”
আরে সে কি আরো কথা বলতে চায় নাকি, আমাকে বেয়াদব বান্দর আর একটা গালি দিয়ে থামবে না নাকি!
“…আরে, রাতুল কে নিয়ে সমস্যায় পড়েছি।”
“কি সমস্যায় ফেলল তোমাকে ও।”
রাতুল এখন আমার ভাগ্নে। জিনিয়াস টাইপের ছেলে, তবে সে এক জিনিষ বেশীদিন নিয়ে থাকে না। বয়েস মাত্র তের কি চৌদ্দতে গেছে। ক্লাসে রেজাল্ট খারাপ না। তবে চেষ্টা করলে আরো ভাল করতে পারে সে। সে একেকদিন একেক জিনিষ নিয়ে পড়ে থাকে। যেমন এর আগে সে কম্পিউটার নিয়ে পড়েছিল। সে মনে হার্ডওয়্যার আর সফটওয়্যার সব নিয়ে পুরো ভাজা ভাজা অবস্থা, এমনকি ইন্টারনেটের নাড়িভুড়ি ওর জানা। মাঝে মধ্যে আমি ওর কাছে কম্পিউটার সম্পর্কে সাহায্য নিই।
“আরে, বলিস না ছেলে আমার পুরা মজনু হয়ে গেছে।” আপা ভাঙ্গা গলায় বললেন।
“মজনু মানে?” আপার কথা শুনে আমাকে কিছুটা অবাক হতে হল।
“আরে, বলিস না, কয়েক যাবত সে লাগাতার হিন্দি সিনেমা দেখছে, তাও আবার প্রেম মার্কা ছবি। এসব দেখে দেখে আমার ছেলে মজনু হয়ে গেছে। ”
হিন্দি সিনেমা দেখে কেও মজনু হয় নাকি? হলেতো হবে দেবদাস।
“এখনতো মজনু, কিন্তু এভাবে আরো কয়েকদিন চললেতো দেবদাস হয়ে যাবেরে।” আপা হাহাকার করে বলল।
“মাইর দাও। ”সমাধান দিলাম।
“প্রেমের ভুত কি লাঠি দিয়ে ছাড়ানো যায়রে!”
সঠিক কথা। প্রেম জিনিষটা খুবই খারাপ। একটা ছোয়াচে রোগের চেয়েও খারাপ যারে ধরে তাকে সহজে ছাড়ে না।
“তো এখন কি করবে?”
“আরে সানুকে বলেছিলাম ওর কাছে কয়েকদিন রাখতে, কিন্তু তার বাচ্চা হবে তাই সে রাখতে পারবে না বলে দিয়েছে। আরো বলেছে ওর বদলে একটা বান্দরকে পাঠিয়ে দিতে সে ওটাকে মানুষ করে পাঠিয়ে দিবে।” আপা এক টানে পুরো কথাটা বলল।
আপুর অবশ্য বলার কারন ছিল, সে আপুর একটা প্রিয় শাড়ি নিয়ে তাবু বানিয়ে খেলেছিল, এর কারনে ওই শাড়ি আর পড়ার মত হয়নি। আর আপুর বিয়ের ছবি তে পারমানেন্ট মার্কার পেন দিয়ে দাড়ি-গোফ একে দিয়েছিল সে, তার কথা এর কারনে ছবিতে একটা খানদানী ভাব এসে গেছে। আর দুলাভাইয়ের সাধের গোফটা টেনে ছিড়ে অর্ধেক বানিয়ে দিয়েছিল সে।
তখন বয়স অল্পছিল দেখে কিছু বলা হয়নি, আর আম্মাও কিছু করতে দেয়নি, কারন একটা মাত্র নাতি তার।
“তো এখন কি করবে?”
“ভাবছি তোদের কাছে পাঠাব, আম্মার কাছে পাঠালে সে আরো উচ্ছন্নে যাবে।”
আমার শান্তি বিনষ্ট হবে ভেবেই আতকে উঠলাম। আপাকে থামানো জন্য বললাম, “আরে এখানে আসলে তো আপি তার হাড্ডি মাংস আলাদা করে দেবে।”
“আরে, ওইটাই তো চাই, মাংস রুনার আর হাড্ডি আমার।”
কি ভয়ংকর কথা! হায় রাতুল তুই মনে হয় আঠারো বছরে পা দিতে পারবি না রে !
“দরকার কি, আর আপি তো এখন সারাদিন অফিসে থাকে। সে কি পারবে নাকি রাতুলকে কন্ট্রোল করতে?” আমি বললাম।
“আরে রুনা পারবে। ওকে তো শয়তানো সালাম দেয়। কোনো ব্যাপার না।” আপা বলল, “আর ওর একটা ফ্রেন্ড আছে না, নাম কি যেন… হ্যা লায়লা সে তো তোর কলেজে পড়ায়। তাই না?”
“হ্যা পড়ায়, কেনো?”
“তোদের কলেজের পাশে তো একটা স্কুল আছে? ভাবছি সেখানে ভর্তি করিয়ে দেই, দিনের বেলা লায়লার সাথে আর রাতে রুনার সাথে। দেখি কেমনে মজনুগিরি খাটায়।”
আমি মনে মনে বললাম, গেছে আমার বাসায় শান্তিতে থাকা আর রাতুলের মজনুগিরি!
“আপিকে বলেছ?”
“না বলেনি, ফোন দিচ্ছি ধরছে না। তাই তোকে ফোন দিলাম। এরপর লায়লাকে ফোন দিব দেখি ওই স্কুলে ওকে ভর্তি করানো যায় নাকি এই সময়ে।”
“হুম।”
“আচ্ছা তাহলে রাখি।” এই বলে সে লাইনটা রেখে দিল।
আমিও বিমর্ষ বদনে ফোনটা রেখে দিলাম।
©somewhere in net ltd.