![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আগের পর্ব
যদি কয়েকদিনের মধ্যে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কথা বলতে চাই তাহলে সেটা হল সুমনার সাথে আমার চরম সংঘর্ষ। ও যদি তেল হয় তাহলে আমি হলাম পানি। সে যদি একটা বলে তাহলে আমি আরেকটা বলি। তার মতের সাথে আমার মতের মিল হয় না। একটা উদাহরন দিই, আগে আমাদের ক্লাসে সাতদিন পর পর খোজ করা হত কোন কোন ছাত্র ছাত্রী বেশী পরিমানে অনুপস্থিত। আমি সেটাতে ‘ভেটো’ দিলাম। কারন আমার ক্লাস মিস দিতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল। আর স্যাররা তো বাধ্য-বাধকতা করে দেয় নাই যে সাত দিন পর পর দেখতে হবে কে কত দিন অনুপস্থিত। আমার সাথে ক্লাসরুমের আরো কয়েকজন (বলতে গেলে সবাই) আমার পক্ষে ছিল। এখানে সুমনার কিছু করারই ছিল না। বর্তমানে সেটা প্রতি মাসে দেখা হবে অনুপস্থিতির পরিমান।
আরেকদিনের ঘটনা, আমরা ক্লাসে বসে আছি,যে যার মত আছে। আমিও বসে ভেরেন্ডা ভাজছিলাম। সুমনা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে একটা গলা খাকারি দিল তারপর বলে উঠল, “আমাদের উচিত প্রতি মাসে বেঞ্চের জায়গা পরিবর্তন করা, সবাই এক বেঞ্চে সারা বছর ধরে বসবে এটা হবে না,” তারপর একটু থেমে, “যে একবার ওই বেঞ্চে বসবে একমাস তাকে ওইখানেই বসতে হবে, সে আর বেঞ্চ পরিবর্তন করতে পারবে না। পরের মাসে তাকে অন্য বেঞ্চে বসতে হবে।”
সারা ক্লাস থেমে গেল তার কথা শুনে, বলে কি মেয়েটা। সে কি পাগল হয়ে গেল নাকি পেট খারাপ, নাকি দুটোই! বুঝা যাচ্ছে সে এর আগের বারের পরাজয় এখনো হজম করতে পারে নাই। তাই নতুন কোন এক বুদ্ধি নিয়ে হাজির হতে চেয়েছে। কিন্তু এই বুদ্ধি!
আর কথাটা যে আমাকে উল্লেখ করে বলা সেটা বুঝতে আমার দেরি হল না। আমি পিছনের দিকে একটা বেঞ্চ বলতে গেলে দখল করে আছি, এবং ওইটাতে আমি একাই বসি। সজল এসে মাঝে মধ্যে বসে। কিন্তু আর কেউ আমার পাশে এসে বসে না। মেয়েটা দেখছি আমার পিছনে ভাল ভাবেই লেগেছে। আমাকেই এর ব্যাবস্থা করতে হবে। আমি উঠে দাড়ালাম, “কলেজে এমন কোন নিয়ম নাই যে প্রতিমাসে বেঞ্চের জায়গা পরিবর্ত করতে হবে,” আমি সবার দিকে তাকালাম, “সবাই নিজের ইচ্ছেমত জায়গায় গিয়ে বসবে এটাই আমার কথা। কি বল সবাই?”
সবাই আমার কথায় সায় দিল(সবাই না হলেও বেশ কয়েকজন)।
এর মাঝে একটা মোটামত ছেলে দাঁড়িয়ে বলল, “আমিও তাই মনে করি,” সুমনা দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে, “আসলে যে যেখানে ইচ্ছে বসতে পারে, ‘দিজ ইজ হিউম্যান রাইটস’।” এরপর সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে বলতে চাইল, ‘বেষ্ট অব লাক।’
আমি মনে মনে ছেলেটাকে বাহ বাহ দিলাম, ওকে আমি পরে একটা বাটার বন খাওয়াবো।
সবার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, “কে কে সুমনার পক্ষে আছ হাত তোল।”
কেউ হাত তুলল না। জানতাম কেউ তুলবেও না।
“তাহলে এইটাই ফাইনাল যে যেখানে ইচ্ছে বসতে পারবে।”এই বলে সুমনার দিকে তাকালাম, “শোনো এইসব ছোট ব্যাপার নিয়ে এত মাথা ঘা্মানোর দরকার নাই। আরো অনেক ব্যাপার আছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাও।”
এটা শোনার পর সুমনা আমার দিকে দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হল সে তার ওই দৃষ্টির মাধ্যমে আমাকে ভস্মে পরিনত করতে পারত তাহলে মনে হয় শান্তি পেত। মেয়েটা ভালই রেগেছে, রাগে তার মুখ পুরো লাল হয়ে আছে। বুঝা যায় সে হারতে অপছন্দ করে। রাগে সে ফোস ফোস করছিল, দূর থেকে আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল রাগে একটা চশমা পড়ে বিড়াল ফোস ফোস করছে। আমার মনে হল আরেকটু রাগানো যায় নাকি?
“আরে লক্ষীসোনা এত রাগ করে না!”
ধাম!
বলতে দেরী কিন্তু ফলাফল পেতে দেরী হয়নি আমার। একটা বোতল উড়ে এসে আমার নাকের মধ্যে লাগল। আর এর মাঝে কে যেন বলে উঠল, ‘বুলস আই।’
কপাল ভালো আমার এই কারনে বোতলের সাইজ ছোট ছিল আর অর্ধেক খালি ছিল। আমি বোতলটা ডেস্কের উপর রেখে আশেপাশে তাকাতে লাগলাম, কে এই ‘বুলস আই’ বলেছে। আর ওদিকে সুমনা রাগে লাল হয়ে আছে। আরেকটা খোচা দেবার সাহস করলাম না, এবার বোতল ছুড়ে মেরেছে পরেরবার কি ছুড়ে মারে কি জানে!
*
বায়োলজী ম্যাডাম আমার লাল হয়ে যাওয়া নাকের দিকে আরেকবার তাকিয়ে তারপর হোয়াইট বোর্ডের দিকে তাকালেন। এই নিয়ে মনে হয় দশবারের বেশী হবে তিনি আমার দিকে তাকালেন। আরেকটা কথা বলে রাখি, বায়োলজি ল্যাবে আমাদের গ্রুপ সামনের দিকে বসেছে। কপাল খারাপ হলে যা হয়।
ম্যাডাম আমার নাকের দিকে তাকানোর ফলে আমার নাকটা চিনচিন করে উঠল। কিন্তু ধরার সাহস পেলাম না। নাকে এখনো ব্যাথা আছে তবে কোনো রক্তপাত হয়নি। আমি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছি, আর সুমনা আমার পাশে বসে আছে, আর তার পাশে নুশরাত। আর আমার উল্টোমুখে নির্জন আর সজল। আমি ওদের পাশে বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু আর কোনো টুল না থাকার কারনে ওই পাশে বসে পারি নাই। আমি এইটুকু টের পাচ্ছিলাম যে আমার পাশ থেকে একটা ভয়ানক আভা বের হচ্ছে, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আমি যদি একটু এদিক-ওদিক করি তাহলে আমার খবর আছে।
“এই ছেলে তোমার মনোযোগ কোথায়?”
ম্যাডামের এই কথায় আমার হুশ আসল।
“জ্বি ম্যাডাম।”
“ক্লাসে বসে অন্যমনস্ক হয়ে আছ কেন, কি চিন্তা করছিলে?”
“জ্বি কিছু না ম্যাডাম,” এই বলে আমি আমার আশেপাশে তাকালাম, সুমনা তেতো মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর বাকী দুজন আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে আর নির্জন পাথরের মত মুখ করে বসে আছে।
“তোমার নাকের এই অবস্থা কেন?” ম্যাডাম জিজ্ঞেশ করলেন।
“সিড়িতে হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।”
ক্লাসে একটা হাসির রোল উঠল, ম্যাডাম সবার দিকে তাকিয়ে, “এই সবাই চুপ।”
মনে মনে ভাবছিলাম সজলের পাশে গিয়ে বসব নাকি। যেই ভাবা সেই কাজ, এটা মাথায় রেখে টুলটা সরাতে যাব। দেখলাম ম্যাডাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“সাইড চেঞ্জ করতে পারি?” ম্যাডামকে বললাম।
“সমস্যা হলে কর।”
তারপর ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে হেসে সজলের পাশে বসলাম, এই এক ফাকে আমি সুমনার দিকে সুমনার দিকে তাকালাম, না সে এখনো রেগে আছে।
*
আসলেই আমার নাকের অবস্থা খুবই খারাপ। মনে হচ্ছে নাকের উপর আমার নাক আর নাই একটা লাল টমেটো হয়ে গেছে। টয়েলেটের আয়নায় নিজের প্রায় জোকার টাইপ চেহারা দেখছি আর নাকের উপর রুমাল চেপে রেখেছি(রুমাল থেকে খুব সুন্দর একটা সুবাস আসছে, হয়তোবা আমার নাকের ভুল)। নির্জন কোথা থেকে একটা রুমাল এনে দিয়েছিল সেটাই ভিজিয়ে নাকের উপর নিয়ে রেখেছি।
টয়লেটে আরেকজন ছাত্র ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সে নিজের কর্ম সম্পাদন করতে লাগল। সে যখন আমার পিছনে দাড়াল, আমি সরে গেলাম।
“ধন্যবাদ,” ছেলেটা বলল।
আমি মাথা ঝাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। কিছু বললাম না।
“তোমার নাকের ঘটনা শুনলাম আমি।”
ছেলেটার কথা শুনে অবাক হলাম, এত তাড়াতাড়ি রটে গেল নাকি ঘটনাটা।
“কে বলেছে?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“তোমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে, নাম রুপা সে বলেছে।” ছেলেটা হাত ধুতে ধুতে বলল।
সে আবার বিবিসি হওয়া শুরু করল কবে, তাকে ধরতে হবে, কি দরকার এক ক্লাসের খবর আরেক ক্লাসে দেওয়া।
“হুম,”
“ও, আমি জাহেদ,” ছেলেটা তার হাত বাড়িয়ে দিল, “আমি সেকশন-B তে।”
তার সাথে হাত মিলিয়ে ,“রানা।”
“চিনি তোমাকে,”জাহেদ বলল।
আরে আমি বিখ্যাত নাকি কলেজে মনে হচ্ছে সবাই আমাকে চিনে আর আমি রেগুলার কি করি সেটা মনে হয় সবাই জানে। মনে মনে পিন্ডি চটকালাম, কাকে চটকালাম সেটা জানি না, তবে যেই হোক রুপা অথবা অন্য কেউ।
“আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি,” জাহেদ বলতে লাগল।
“কি প্রশ্ন?”
“সুমনার সাথে তোমার সম্পর্ক কি?”
আজিব প্রশ্ন! তা কি মনে করে এই প্রশ্ন করল সে কি সিরিয়াস নাকি? না চেহারা দেখে বোঝা যায় সে সিরিয়াস।
আমি নিরবতা পালন করলাম, জাহাদের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলাম সে কি ধরনের উত্তর চায়।
“হঠৎ করেই এই প্রশ্ন কেন?” এই বলে আমি আবার আয়নার দিকে তাকালাম।
“আমি সুমনাকে পছন্দ করি।”
মনে করেন কোথাও বোম ফাটল, বোমা ফাটার পর একধরনের নিস্তবতা আসে সেটা এখন এই টয়লেটে বিরাজ করছে। আর এটা বলার পর জাহেদ কেমন জানি উশখুশ করতে লাগল। সে আমার জবাব পাবার অপেক্ষায় আছে। আমিও ভবালাম যাক মজা নিই না কেন এই ছেলের সাথে। যদিও তার সাফল্য নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। আরেকটু নাচানো যায় ছেলেটাকে, “তা ভাল কথা,” আমি রুমাল আবার পানিতে ভেজাতে ভেজাতে বললাম, “তা আমার এখানে ভুমিকা কি?”
“ওর সাথে তোমার কি সম্পর্ক?” এবার একটু জোড় গলায় বলল সে।
“তাতে তোমার লাভ?”
“তাহলে আমার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।”
“তাহলে আমি কি তোমার পথের কাটা!”
আমার এই কথা শুনে সে থতমত খেল। এরপর কি বলবে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে বলল, “আমার জবাব চাই।”
“এক্ষুনি?”
“হ্যা,” সে দুহাত মুঠো করে চেচিয়ে বলল, “এক্ষুনি চাই…”
আরো কিছু মনে হয় বলতে চেয়েছিল কিন্তু টয়লেটে আরো দুজন ঢুকে যাওয়ায় তাকে সেখানে থামতে হল। আর ছেলে দুটো আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছুটা অবাক হবেই বা না কেন, একটা ছেলে নাকে রুমাল চেপে মুখ কিছুটা উপর করে রয়েছে আর আরেকটা ছেলে কাউকে প্রপোজ করার মত দাঁড়িয়ে থাকলে দুনিয়ার আর সবাই অবাক হবে।
“আজকে মধ্যে আমার জবাব চাই,” এই বলে জাহেদ টয়লেট থেকে বের হয়ে গেল।
আরে আমিতো তার ভালোই চাচ্ছিলাম, যে মেয়ে কিনা কথায় কথায় ফ্যাচ করে উঠে, মাঝে মধ্যে বোতল ছুড়ে মারে(আজকে অভিষেক হল) তার সাথে রিলেশন করতে যাওয়া মানে বুকে ডিনামাইট নিয়ে মাইনফিল্ডে হাটা। যাক ছেলের যখন খায়েশ হয়েছে সুমনার সাথে সম্পর্ক করার করুক, দুইদিন পর যখন গলা ছেড়ে কাদবে তখন না হয় তার দিকে তাকিয়ে ভালভাবে হাসা যাবে।
আমি দুই আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বের হয়ে গেলাম।
কপালটা মনে হয় আমার খারাপ ছিল, বের হতে না হতেই একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম, মেজাজ গেল খিচড়ে, “চোখের মাথা খেয়েছ নাকি,” এইটা বলার পর আমি সামনে তাকালাম। দেখলাম আমার সামনে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে মিজানুর হায়দার স্যার। কপালে হাত বুলাচ্ছে। আশেপাশে কয়েকজনের হাসির আওয়াজ পেলাম আমি।
“সাইলেন্স,” স্যার চেচিয়ে বলল, “কোন শব্দ না আর তুমি…” আমার দিকে তাকাল আমাকে মনে হয় চিনতে পারল স্যার, “তুমি বেয়াদব ধাক্কা খাওয়ার পর সরি না বলে উলটাপালটা কথা বলেছ।”
“দুঃখিত স্যার দেখতে পাইনি” উঠে দাড়াতে দাড়তে বললাম আমি, তারপর স্যারের দিকে হাত বাড়ালাম।
“লাগবে না বুড়ো হয়ে যাই নাই আমি,” এই বলে স্যারও উঠে পড়ল, “পচিশ বার বুক ডাউন দাও”
“হ্যা?”
“তিরিশ বার”
“কি দিব স্যার?”
“পয়তিরিশ বার বুক ডাউন।”
আমি স্যারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, স্যার বলে কি !
“আর যদি পুরোটা সম্পুর্ন না করতে পারো তাহলে বেত দিয়ে সেটা উসুল করা হবে,” এটা বলার পর চেচিয়ে, “তাড়াতাড়ি, দাঁড়িয়ে আছ কেন।”
এরপর কিছু বলার থাকে না, স্যার যা বলল তা করতে লাগলাম। অনেকেই দেখিছ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলাম না। পুশ আপ দিতে লাগলাম। যখন পুশ আপ করে উঠে দাড়ালাম তখন আমার কপাল বেয়ে ঘাম বের হচ্ছে। আর স্যারকে দেখলাম অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“তুমি কি প্রতিদিন ব্যায়াম কর?” স্যার নরমাল গলায় বলল।
“মাঝে মধ্যে… ”
“মাঝে মধ্যে নয়,” আমার কথা শেষ না করতে দিয়ে বলল, “প্রতিদিন করবে, খুব ভোর উঠে করবে। আর কাচা ছোলা খাবে।”
অবাক হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“আমি পিটি স্যারও, বুঝছ শরীর ফিট রাখবা, এখনকার কোন ছেলেকেই তো দশ বারের বেশী বুক ডাউন করতে পারেনা।” তারপর স্যারের মনে হয় এতক্ষনে আমার চেহারার দিকে নজর দিল, “তোমার নাকের এই অবস্থা কেন?”
“হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।”
“আ,” তারপর চুকচুক শব্দ করে সমবেদনা জানিয়ে, “সাবধানে চলবে বুঝছ।”
“জ্বি স্যার, উপদেশের জন্য ধন্যবাদ,” আমি বললাম, “স্যার ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে যাও,” এই বলে আমার পিঠে হালকা চাপড় মারলেন। তারপর চলে গেলেন।
আমিও ক্লাস রুমে ঢুকে দেখলাম সজল দাঁড়িয়ে আছে, “আজকে তো মনে করছিলাম মিজান স্যার তোকে কিমা বানাবে।”
“হুম” ঠোট উলটে বললাম।
“কিরে পয়তিরিশ বার পুশ আপ কম কথা না, জিমে যাস নাকি?”
“না।”
“হুম, ওই সুমনা তোকে খুজছিল।”
“কিসের জন্য?”
“তোর নাকের কি অবস্থা সেটা জানার জন্য,” সজল নিজের নাক চুলকে বলল।
ওই এখন আমার সামনে নাক চুলকাবি না।
“ওর চেহারা শুকনো দেখলাম, মনে হয় অপরাধবোধে ভুগছে সে।”
সজলের এই কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম, কিন্তু কিছু বললাম না। স্যার ক্লাসে ঢুকল, আমার বেঞ্চের কাছে যেতেই দেখলাম নির্জন আমার বেঞ্চে বসে আছে। আমিও কি করব তার পাশে বসে গেলাম, মেয়েটা দেখছি এখনো হাল ছাড়েনি, আমাকে মনে হয় সে পিছনের বেঞ্চ থেকে উঠিয়ে ছাড়বে।
স্যার ক্লাস শুরু করার পর, নির্জন আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে, “নাকের কি অবস্থা?”
“ভাল, তবে রুমালটা অনেকটা মেয়েলী ধরনের।”
আমার কথা শুনে মুচকি হাসি দিল নির্জন। যেটা খুবই বিরল…
*
বোতলটা রানার মুখ বরাবর ছুড়ে মারার পরও সুমনার রাগ বিন্দুমাত্র কমেনি। সে আসলেই এই ছেলেটাকে সহ্য করতে পারছে না, যেই কাজ করতে চায় সেটাতেই এই ছেলেটা বাগড়া দিয়ে বসে। আচ্ছা এইসব হয়তো সহ্য করা যায় কিন্তু যখন খোচা মেরে কথা বলে তখন সত্যি কথা মেজাজটা একদম বিগড়ে যায়। বোতলটা ঢিলে মারাতে এখনো সে আফসোস বোধ করছে না উচিত সাজা হয়েছে বান্দরটার!
ঘন্টাখানেক পর সে যখন রানার নাকের দিকে তাকাল তখন সুমনা বুঝতে পারল আসলে সে মনে হয় রাগের চোটে একটু বেশী বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, এটা মনে হতেই সে নিজের উপর রাগ করে বসে রইল (আর রানা কিনা মনে করেছে সুমনা এখনো তার উপর রাগ করে আছে!)
সুমনা মনে মনে নিজেকে গালাগালি করতে লাগল, ছিঃ আমার কি কোনোদিন শিক্ষা হবে না। এই বদমেজাজের কারনেই আমার আজ এই অবস্থা, কি দরকার ছিল আজকে এই বেঞ্চ বিষয় নিয়ে কথা বলার? এত অহংকার কেন আমার? কেন পরাজয় মানতে পারি না ? আজকে আমার কারনে রানা আঘাত পেল। এর আগেও আমি অনেককে আঘাত করেছি। আচ্ছা আমি এত খারাপ কেন?
এভাবেই চিন্তার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ ল্যাব ম্যাডমের কথা শুনে হুস আসল তার। ম্যাডাম অবশ্য সুমনাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলে নি, ম্যাডাম রানার দিকে তাকিয়ে, “এই ছেলে তোমার মনোযোগ কোথায়?”
রানা একটু থতমত খেয়ে
“জ্বি ম্যাডাম।”
“ক্লাসে বসে অন্যমনস্ক হয়ে আছ কেন, কি চিন্তা করছিলে?”
“জ্বি কিছু না ম্যাডাম,” এই বলে সে সুমনার দিকে তাকাল, তারপর আর বাকী সবার দিকে।
“তোমার নাকের এই অবস্থা কেন?” ম্যাডাম এবার জিজ্ঞেশ করলেন।
“সিড়িতে হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।”
ক্লাসে একটা হাসির রোল উঠল, ম্যাডাম সবার দিকে তাকিয়ে, “এই সবাই চুপ।”
এটা শোনার পর সুমনা যেন কুকড়ে যাচ্ছিল, সে কড়া চোখে রানার দিকে তাকাল, কি দরকার ছিল মিথ্যে কথা বলার! এত মহৎ সাজার দরকার ছিল কি? সত্যি কথা বললে কি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত?
এইসব ভাবতে ভাবতেই পুরো ল্যাব ক্লাস শেষ হয়ে গেল। সুমনা কি করবে সেটা সে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। সে কি রানার কাছে ক্ষমা চাইবে নাকি? নাহ সেটা করতে পারবেনা। সে যদি ক্ষমা চায় আর ওই সময় যদি রানা ফিচেল মার্কা হাসি দেয় তাহলে তো আরেকটা দক্ষ-যজ্ঞ লেগে যাবে।
সে ভাবতে ভাবতে তার কামিজের পকেটে হাত ঢুকালো।
পিং তার মাথায় একটা লাইট জ্বলে উঠল। সে নির্জনের কাছে চলে গেল। অন্তত এই কাজটা করলে সে হয়তো মনে কিছুটা শান্তি পাবে।
*
মাশফিয়া সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। জানালার পাশে বসে আছে। জানলার পাশের এই জায়গা তার জন্য একদম ফিক্সড। কেউ এই জায়গায় বসে না। তার হাতে একটা রঙ্গিন খাম, সে জানে এই খামে কি আছে। লাভ লেটার। সে বলতে গেলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এই ধরনের চিঠি পেতে পেতে। মাশফিয়া যদি এই পর্যন্ত যত চিঠি পেয়েছে তা যদি সে জমিয়ে রাখত তাহলে এতদিনের সেটা অন্তত কয়েক খন্ড বিশ্বকোষের সমান হয়ে যেত।
কলেজের যদি সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে কে যদি জিজ্ঞেশ করা হয়, তাহলে সবাই এক কথায় মাশফিয়ার নাম মুখ আনবে। মাশফিয়া অনেক জায়গা থেকে মডেলিং করার প্রস্তাব পেয়েছে, কোন এক ডিরেক্টর তাকে নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাবও দিয়েছিল। মাশফিয়া কোনোটাতেই রাজী হয় নাই। আসলে সেটা তার স্বভাব। সবার মুখের উপর না বলার পর তাদের চেহারায় এক ধরনের হতাশ ভাব ফুটে উঠলে মাশফিয়া একধরনের তৃপ্তি বোধ করে। সেটা আরো বেড়ে যায় যখন তারা আরো মরিয়া হয়ে যায় তাকে পাবার জন্য।
মাশফিয়া মনে মনে ভাবছিল, সে কি পড়বে নাকি পড়বে না এই চিঠিটা। পড়লেও কি আবার না পড়লেও কি সেতো আর এটার জবাব দিবে না আর এর শেষ গন্তব্য হবে ক্লাসরুমের কোনায় সেই ময়লার ঝুড়িতে।
সাইলেন্স!
এত জোরে চিৎকার শোনার পর চমকে গেল মাশফিয়া। তাড়াহুড়া করে সে চিঠিটা তার ডেস্কের ভিতর লুকালো। তারপর আশে তাকাল জানালার দিকে তাকাতেই দেখল মিজানুর হায়দার স্যারকে, দেখেই মুখ কুচকে গেল তার। এই স্যারকে তার একদমই পছন্দ না, খালি মেয়েদের সাথে আলগা ভাব দেখাতে চায়, সবচেয়ে বড় কথা সে এই স্যারের গাইডে আছে। স্যারতো তাকে দেখলেই একটা তেলতেলে হাসি নিয়ে কথা বলতে আসে।
বিরক্তিকর!
মিজানুর স্যার একটা ছেলেকে ধমকাচ্ছে। ছেলেটার চেহারা খারাপ না, মনে মনে বলল মাশফিয়া। তবে সে দূর থেকেই দেখে বুঝল, ছেলেটার নাক লাল হয়ে আছে নির্ঘাত কারো সাথে মারামারি করেছে মনে হয়। সে তার পিছনে বসা মেয়েটিকে বলল, “কি হয়েছে? স্যার চেচাচ্ছে কেন?”
মেয়েটা ওইদিকেই তাকিয়ে ছিল, সে সব ঘটনাটা দেখেছে সে বলে উঠল, “ওই ছেলেটা স্যারের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে প্লাস স্যারও পড়ে গেছে।”
ছেলেটার কপাল খারাপ, মনে মনে বলল। আর কাউকে পেল না একদম এই মিজানুর স্যারের সাথে ধাক্কা খেতে গেল কিসের জন্য।
স্যার আর ছেলেটার মধ্যে কি কথা চলল, সেটা সে শুনতে পেল না। । তারপর স্যার আবার চেচিয়ে উঠল। আসলেই এই স্যার খুব চেচায়।
একটু পড়েই দেখা গেল ছেলেটা পুশ-আপ দেয়া শুরু করেছে। এবার মাশফিয়া পেছনে তাকিয়ে বলল, “বাজী লাগবি নাকি?”
“কিসের বাজী?” মেয়েটা প্রশ্ন করল, ব্যাক্তিগতভাবে সে মাশফিয়াকে পছন্দ করে না কিন্তু মাশফিয়া এমনভাবে কথা বলে যে তাকে উপেক্ষা করে থাকা যায় না।
“ছেলেটা কয়বার পুশ-আপ দিতে পারবে এটা নিয়ে।”
মেয়েটা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, “না আমি এইসব বাজী-টাজির মধ্যে নাই,” এই বলে ছেলেটার দিকে তাকাল, “তবে আমার ধারনা সে বিশ বারের বেশী পুশ-আপ দিতে পারবে।”
“কিভাবে বুঝলি?”
“ছেলেটা পুশ-আপ দেয়ার ভঙ্গি দেখে বুঝা যায়, আর বেশী দিতে পারবে মনে হয়।”
“তুই এইসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নাকি?” মাশফিয়া বাকা চোখে জিজ্ঞেশ করল।
এটা শোনার পর মেয়েটার মাথা গরম হয়ে গেল বলল, “আমার ভাই প্রতিদন ‘হেইয়ো হেইয়ো’ বলে ব্যায়াম করে তাই জানি।”
এটা শোনার পর মাশফিয়া কিছু বলল না, কারন ছেলেটা তিরিশের ঘরে পা দিয়েছে তারপরেও চালিয়ে যাচ্ছে, পয়তিরিশটা করবার পর সে উঠে দাড়াল। ছেলেটার হাইট খারাপ না, ভালই লম্বা সে, মনে মনে বলল সে।
স্যারকেও দেখা গেল ছেলেটাকে কি যেন বলছে, অবশ্যই ধমকের সাথে নয়।
“আগে দেখি নাই তার মানে ফার্ষ্ট ইয়ারে পড়ে,” বিড়বিড় করে বলল মেয়েটা, “ইন্টারেস্টিং,” এটা বলার পর সে ডেস্কের ভিতর রাখা চিঠিটা নিয়ে ছিড়ে ফেলল।
*
“তোর নাকের কি হয়েছে?”
“ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বল নাকে লেগেছে।”
“তাই নাকি,” এই বলে আপি ভাত মুখে দেবার পর বলল, “কলেজে মনে হয় ভালই মজা পাচ্ছিস।”
মজা পাচ্ছি মানে, পুরো ষোল আনাই মজা পাচ্ছি!
যে কলেজে ডাইনী টাইপ ম্যাডাম থাকে, মেয়েরা যখন তখন সবার সামনে কলার চেপে ধরে শাসানি দেয় তারপর পানির বোতল ছুড়ে আমারে সেখানে তো ভালই মজা পাবার কথা!
“আপার সাথে কথা হয়েছে?”
“হ্যা, রাতুলকে এখানে পাঠাবে বলেছে। তুমি কি বলেছ, সে কি আসবে এখানে?”
“আমি বলেছি সমস্যা নাই, তবে এর সাথে সাথে দাফন-কাফনের ব্যাবস্থা করতে।”
কথাটা শোনার পর আমার গলায় ভাত আটকে গেল। কথাটা আপি এমনভাবে বলল, যেন কিছুই না। বলে কি নিজের আপন ভাগ্নে কে নিয়ে এমন কথা বলে নাকি।
“আপা কিছু বলে নাই তোমার এই কথা শোনার পর ?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“না, মনে হয় থম মেরে গিয়েছিল, পরে বলেছি পারলে একটা বাদরের চামড়া পড়িয়ে দিয়ে চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দিতে।”
“!!!”
অবাক হওয়া ছাড়া আমার আর কি করা ছিল। আপি কি সত্যিই সহ্য করতে পারে না রাতুলকে? অবশ্য অনেক কারন আছে তাকে সহ্য না করার জন্য।
“তুই কি মনে করিস ওকে ঢাকায় আনা উচিত?” আপি আমার মতামত জানতে চাইল।
“আনলে খারাপ হয় না, আমার যতটুকু ধারনা আপার সাথে থাকলে সে আরো বখে যাবে। তাই বলি কি রাজী হয়ে যা। রাতুল এমনিই তোকে অনেক ভয় পায়,” আমি বলতে লাগলাম, “আর আমাদের কলেজের পাশে তো একটা স্কুল আছে, ওখানে লায়লা আপুও ক্লাস নেয়, দুই জায়গায়… মানে সে টাইট অবস্থানে থাকছে।”
বাপরে আরেকটু হলে বলে দিচ্ছিলাম ‘জলে কুমিড় ডাঙ্গায় বাঘ’ থাকেল চিন্তা কিসের! ঠিক সময়ে থামতে পেরেছি। এটা বের হলে আজকের রাতের খাবার আর হজম করা লাগতা না।
“আচ্ছা আপা কি তোকে কোনো ঘুষ দিয়েছে নাকি?” আপি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেশ করল, “কারন রাতুলের হয়ে তাবেদারি করছিস… মানে টা কি?”
ইয়াক! ধরে ফেলল নাকি। আপি দেখছি এখনো অনেক শার্প। সাবধানে কথা বলাতে হবে নাইলে আম ছালা দুটোই যাব আমার।
আপি ঠিক ধরেছে, আমি আপাকে বলছিলাম, আমাকে একটা গ্রাফিক্স কার্ড আর আরেকটা মাদারবোর্ড লাগবে, তাহলে আমি আপির কাছে রাতুলের হয়ে কথা বলব।
আপির দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে বললাম, “আরে কি যে বলিস না, আমি রাতুলের ভালোর জন্য বলেছি, আমি চাই না সে অল্প বয়সে দেবদাস হয়ে যাক।”
“হুম, দেবদাসের কথা শুনে মনে পড়ে গেল, ক্লাস নাইনের তোর কি জানি হয়েছিল, আম্মার কাছে শুনে ছিলাম তুই নাকি কয়েকদিন ঝিম মেরে পড়েছিলি।”
আপির কথা শুনে আমার বুকে যেন ধাম করে আঘাত করল, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলাম না, “আরে ওইটা ফালতু কথা, বই মেলার জন্য ঢাকায় আসতে চাইছিলাম আম্মা তাতে রাজী হয় নাই তাই রাগ করে ঝিম মেরে বসে ছিলাম।”
আপি ঠোট উলটে বলল, “কি জানি,” এই বলে সে খাবারের টেবিল থেকে উঠে গেল যাওয়ার সময়, “টেবিল পরিষ্কার করে যাস।”
আপির দিকে তাকিয়ে থাকলাম এখানে আমার কিছুর বলার ছিল না। সে যখন বলেছে তখন আমাকেই এক কাজ করতে হবে। আপি হাত মুছতে মুছতে ডাইনিং রুমে আসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “রানা অনেক দিন হল তোর গালে চুমু দেয়া হয় না।”
এটা শোনার পর আমার মাথায় বাজ পড়ল, বলে কি? মাথার তার সব ছিড়ে গেল নাকি!
“কি সব আজে বাজে কথা বলিস,” আমি তাড়াতাড়ি টেবিলের প্লেট নিতে নিতে বললাম।
“আজে বাজে কথা মানে, আমরা তিন বোন তোর গালে চুমু না দিলে তোর রাতের ঘুম হত না।”
মিথ্যে কথা, এটা উল্টো হবে তোরা ঘুমাতে পারতি না আর তোরা তো চুলোচুলি লাগতিস পরে আম্মা এসে ঝাড়ু বাড়ি দিয়ে তোদের ঠান্ডা করত।
আমি মুখ গোমড়া করে বললাম, “আমি অনেক বড় হয়েছি, এই ধাষ্টামো ভাল লাগে না।”
“আজকে একটা দেই, অনেক দিন দেই না,” আপি আদুরে গলাইয় বলে উঠল, “অবশ্য পিচ্চিকালে তোর গাল অনেক ফোলা ফোলা ছিল।”
“আমি এসবের মধ্যে নাই, আর বিরক্তি করি না, কাজ শেষ করতে দে।”
“প্লীজ একটা…”
“একটাও না, টিভি দেখ না হলে ঘুমাতে যা,” আমি চেচিয়ে বলে উঠলাম।
আপি মুখটা ফুলিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
*
ক্লাসে বসে বই পড়ছি, মাত্র প্রথম পিরিয়ড শেষ হল। আমার হাতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ বই। অসধারন একটা বই, আমাদের দেশে এমন লেখক আছে সেটা ভাবাই যায় না। বইয়ের যত ভেতরে যাচ্ছি তত মনে হয় ডুবে যাচ্ছি। বিশেষ করে ‘হাড্ডি খিজির’ চরিত্রটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে।
ও ভাল কথা আমার নাক এখন কিছুটা ভাল অবস্থায় এসে পড়েছে, সে তার আসল রঙ ফিরে পেতে যাচ্ছে খুবই শীঘ্রই। নাকের কথা বাদ দেই এখন বইয়ের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার, ভাল বই কখনও ফেলে রাখতে হয় না। বইয়ের ভিতরে যখন আবার নাক গোজালাম তখন পিঠের মধ্যে টোকা পড়ল।
আরে আজিব ব্যাপার তো! আমার পিঠ কি কোন কাঠের দরজা নাকি যে বারবার টোকা মারতে হবে। ডাক দেয়া যায় না আমাকে? আমি ভ্রু কুচকে টোকা মারার মালিকের দিকে তাকালাম, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছি, চেহারার মধ্যে একধরনের উদ্যত ভঙ্গি। এইসব মেয়েদের পাত্তা দিতে নাই, দিলে এরা গাছে উঠে পড়ে, বিড়বিড় করে বলে আবার বইয়ের দিকে নজর দিলাম।
“সমস্যা কি এই ছেলের, এই তোমার সাথে একজন কথা বলবে,” মেয়েটা বলে উঠল।
“কে?” বই থেকে মুখ না তুলে বললাম।
“আগে বের হও তারপর দেখ কে তোমার সাথে কথা বলতে চায়,”
“তাহলে দরকার নেই,” এই বলে মেয়েটার দিকে তাকালাম, “আর ওর যদি এতই দরকার পড়ে আমার সাথে কথা বলার তাহলে সরাসরি কথা বলতে বল, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যম আমি পছিন্দ করি না।”
মেয়েটা মনে হয় দমল না আমার কথা শুনে সে তার উচু নাক আরো উচু করে বলল, “মাশফিয়া রহমানকে চেন।”
মাশফিয়া রহমান কে সে? এখানকার ভিআইপি নাকি সে! জানতাম না তো।
“না,” আমি জবাব দিলাম।
আমার জবাব শুনার পর মেয়েটা থম মেরে গেল। আমার আশেপাশের কয়েকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, এর মধ্যে কয়েকজন ছেলের বিষ দৃষ্টি আমার উপর বর্ষিত হল। আরে কি হল সবাই আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন। কি এমন পাপ করলাম যে এই মেয়েটাকে না চিনে।
“সত্যিই কি তুমি মাশফিয়া রহমানকে চিন না?” মেয়েটা ঠান্ডা গলায় বলল।
“না, সত্যি কথা আমি জানিনা কে সে।”
সত্যিই কে সে ?
ছেলেরা দেখছি সবাই বিড়বিড় করে কি যেন বলছে আমার দিকে তাকিয়ে, মেয়েরা তেমন পাত্তা দিচ্ছে না তবে কয়েকজন দেখছি এইদিকে তাকিয়ে আছে।
“যাই হক মাশফিয়া তোমাকে ডাকছে, সে তোমার সাথে কথা বলতে চায়।” মেয়েটা বলে উঠল।
“দুঃখিত এখন আমি বই পড়ছি, আর কয়েক মিনিট পর ক্লাস শুরু হবে,” মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “টিফিনের সময় আমার সাথে দেখা করতে বল। এখন পারব না বলে আবারো দুঃখিত।”
মেয়েটা আমার কথা শুনে মনে হল সে আকাশ থেকে পড়ে গেল। আরে, আমিতো না বলি নাই বলেছি দেখা করব কিন্তু এখন না, এখন লায়লা আপু… দুঃখিত লায়লা ম্যাডামের ক্লাস। যদি সে আমার চেহারা না দেখতে পায় ক্লাসে তাহলে আমার পাছার ছাল আর অক্ষত থাকবে না। মেয়েটা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল, “কাজটা ভাল করলে না, পরে পস্তাবে,” এই বলে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল।
পুরোই সিনেমার মত ডায়ালোগ মেরে গেল, মেয়েটার গমন পথে চেয়ে রইলাম। সে যখন ক্লাস রুম থেকে বের হয়ে গেল তখন আমি আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলাম।
ধাম!
এবার আমার পিঠের মধ্যেখানে জোরেসোরে একটা চাপড় পড়াল, এর সাথে সাথে সারা দেহে একটা জ্বালাময়ী অনুভুতি। গরম চোখ করে এবার মালিকের দিকে তাকালাম, আজকে এর দফারফা কান্ড হবে। সজল আর নির্জন দেখি দাঁড়িয়ে আছে, সজলের মুখে একটা মেকি হাসি আর নির্জনতো সবসময়ের মত সাইবর্গ ভঙ্গিতে আছে।
“কিরে মাশফিয়ার সাথে তোর সম্পর্ক কি?”
“আজকে এই প্রথম নাম শুনলাম।”
“তাই নাকি?”
“তোর কি মনে হয়?”
“তোকে ভিজা বিলাই মনে হয়,” সজল একই ভঙ্গিতে বলল।
“আচ্ছা, সিরিয়াসলি বল মাশফিয়া কে?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম, “আর কি কারনে তুই আমার উপর খেপে আছিস।”
“আমি খেপে আছি! দেখিস না আমি কেমন হাসি মুখে আছি। আমি কি করে রাগ করি।”
নির্ঘাত খেপে আছে, তা সমস্যা কি ওর একটা মেয়ে আমার খোজ-খবর নিতে এসেছে তাতে ওর এত জ্বলে কেন। সে আমার প্রশ্নের জবাব দিবে না আমি জানি তাই এবার আমি নির্জনের দিকে তাকালাম। সে কিছু বলার আগেই লায়লা ম্যাডাম এসে পড়ল। আপাতত কথা বাদ দিয়ে সে আমার পাশে বসে পড়ল। আমি ভ্রু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে আমার পাশে বসাতে আমার কিছু অসুবিধা হচ্ছে। আগে আমার আশেপাশে তেমন কেউ বসত না কিন্তু এখন অনেক মেয়ে দেখছি পেছনের দিকে বসার জন্য পাগল হয়ে আছে। এতে আমার শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। আজকেই দেখলাম তিন চারজন এসে বসেছে এই দিকে।
নির্জনের দিকে তাকালাম, সে সেই সাইবর্গ ভঙ্গিতে বসে আছে। ওইদিকে লায়লা ম্যাডাম তার বকবক করা শুরু করে দিয়েছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে কোলের উপর বইটা রাখলাম তারপর পড়া শুরু করলাম। একটু পরেই মনে হল কে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে তীব্র দৃষ্টিতে। বই থেকে মাথা তুলে দেখলাম নির্জন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তার দিকে তাকিয়ে, “কোনো সমস্যা?”
“ক্লাস হচ্ছে,” এই বলে সে বোর্ডের দিকে তাকাল।
মুখটা গোমড়া করে বইটা বন্ধ করলাম তারপর ক্লাসের দিকে মনোযোগ দিলাম।
টিফিন পিরিয়ড।
ক্যান্টিনের দিকে দৌড় দিলাম। ভিড় হবার আগে আমাকে ক্যান্টিনে যতে হবে। ঠেলাঠেলি করা আমার ধাতে সয় না আর পছন্দও না। ক্যান্টিনের যাবার পথে দেখলাম একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ভালই সুন্দরী বলা যায় তাকে। অনেকেই তার দিকে একবার তাকিয়ে দ্বিতীয়বার তাকাতে বাধ্য হবে আমিও হতাম কিন্তু ক্যান্টিনে আগে যেতে হবে তাই আমি তার দিকে সেভাবে নজর দিলাম না। কিন্তু মেয়েটা আমার দিকেই আসল।
“তুমি কি রানা না?” সে জিজ্ঞেশ করল।
আঃ দেরী হয়ে যাচ্ছে।
“আমি, রেদোয়ান হক,” এই বলে আমি ক্যান্টিনের দিকে ছুট দিলাম, এখনই বলতে গেলে ভিড় জমে যাচ্ছে। ইয়া আলী বলে দিলাম এক দৌড়।
ক্যান্টিন থেকে বের হতে হতেই দেখলাম সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। এখন ব্যাপার আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার, এই মেয়েই নিশ্চয়ই মাশফিয়া। এইজন্যই সব ছেলে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে ছিল, আর এর সাথে সাথে সজল আমাকে পিঠে চাপড়টাও মেরেছিল। ঠিকই আছে যে কেউ এই মেয়ের প্রেমিক হতে পারলে বর্তে যাবে।
“তুমি বোধহয় আমাকে সকালে আমার সাথে কথা বলেতে চেয়েছিলে?” আমি তার সামনে গিয়ে বললাম।
মেয়েটা হাসি দিল, ঝকঝকে সাদা দাত বের হয়ে আসল। আর হাসিটাও অনেক মিষ্টি টাইপের। যে কেউ গলে যাবে এই দেখলে। আমার বুকের বাম পাশটাও একটু করে হলেও ধক করে উঠল।
“তোমার নাম কি রানা নাকি রেদোয়ান হক?”
“দুটোই।”
“হ্যা আমি সকালে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“কিসে জন্যে?”
“এমনি, কালকে দেখলাম মিজানুর স্যার তোমাকে পুশ-আপ করতে দিল।”
“ও… হুম,” এই বলে আমি বাটার বনের প্যাকেট ছিড়ে ফেললাম, আর আরেকটা মাশফিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে মাথা নাড়ালো মানে খাবে না। কি করা সেটা পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।
আমরা করিডোরে হাটছি, অদ্ভুত এক নিরবতা বিরাজ করছে। মাশফিয়াই নিরবতা ভাঙল, “রুমানাতো তোমার উপর ক্ষেপে আছে।”
আমি তার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলল, “আরে যে মেয়ের সাথে কথা বললে।”
“ও, সে। না তখন লায়লা ম্যাডামের ক্লাস ছিল, উনার ক্লাস মিস দেওয়া যায় না তাই বের হতে চাই নি।”
“ও তাই নাকি,” মাশফিয়া বলল, “শুনেছি কলেজের অনেক ছেলেই তাকে পছন্দ করে ফেলেছে। উনি খুবই সুন্দরী মহিলা।”
“হুম,” বাটার বনে কামড় দিয়ে বললাম।
তারপর আবার এক নিরবতা। আসলে পাশে যদি একটা অচেনা সুন্দরী মেয়ে থাকে তাহলে একটা অস্বস্তিবোধ লাগে, কি বলব না বলব, যদি এই কথা বলি তাহলে সে কিছু মনে করবে না তো এইসব ভাবনা শুধু মাথায় খেলে।
“আপনি মনে হয় সেকেন্ড ইয়ারে,” আমি বললাম আসলে নিরবতা আমার ভাল লাগছিল না।
“হ্যা, বানিজ্যতে,” এবার সে আমার দিকে তাকিয়ে , “তুমি কি আমার সাথে থাকতে বিরক্ত হচ্ছ?”
“না, তবে হঠাৎ করে কথা বলতে আসায় কিছুটা অস্বস্তি লাগছে।”
“কি বল তুমি?” অবাক হয়ে আমাকে বলল, “তোমাকে তো দেখি তোমার ক্লাসমেট দের সাথে ভালভাবেই কথা বল।”
“সেটা আলাদা কথা, ওদের সাথে আমি বেশ কয়েকদিন কথা বলেছি তাই…”
“তাই বুঝি, আচ্ছা তোমার কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”
এহেন প্রশ্নে কিছুটা অবাক হলাম, পুরোপুরি না।
“না, নেই,”
“কাউকে তুমি পছন্দ কর?”
“হ্যা,”
“কাকে?”
চুপ করে রইলাম কিছু বললাম না। মনে হল নিরবতা পালন করাই এখন সবচেয়ে উত্তম কাজ। আর মাশফিয়া… দুঃখিত সেতো আমার চেয়ে বড়, মাশফিয়া আপু হবে, সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। কি খোজার চেষ্টা করতে লাগল তারপর বলে উঠল, “তোমার সাথে কথা বলে ভাল লাগল, তোমাকে আমার ভাল লেগেছে, পরে আরো কথা হবে।”
“জ্বি আপু!”
এটা শোনার পর মাশফিয়া আপুর ভ্রুটা মনে হয় একটু হলেও কুচকে গেল। মনে হয় আমার চোখের ভুল। সে যাওয়ার সময় আবার আমার দিকে তাকাল তারপর হাত নাড়িয়ে হেসে চলে গেল। সত্যি কথা মাশফিয়া আপুর হাসি দেখে আমি মনে হয় হার্টবিট আরেকটা মিস করলাম।
দ্বিতীয় বাটার বনের প্যাকেট খুলে সেটা মুখে দিতেই দেখি সজল এসে হাজির, তার মুখে তখনও ওই মেকি হাসি লেগে আছে, “কিরে তুই দেখছি আরেক কদম এগিয়ে গেলি।”
মুখে বনটা নিয়ে বললাম, “মানে, কোথায় এগিয়ে গেলাম আমি?”
“সাধু সাজার চেষ্টা করিস না, একটু আগেই দেখলাম মাশফিয়ার সাথে কথা বলতে।”
“ও তোর চেয়ে বড় না, মাশফিয়া আপু বলে ডাকবি।”
আমার কথা শোনার পর সে বাকা চোখে তাকাল, “তাহলে তুইও আপু বলে ডাক।”
“ডেকেছি তো।”
সজল আমার কথা শুনে মনে হল পাথর হয়ে গেল, তারপর আমার দিকে সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, “তুই জানিস মাশফিয়া প্রতিদিন…”
“মাশফিয়ার পর মনে হয় আপু হবে।”
“আরে ধ্যাত্তেরি তোর আপু,” একটু ঝাঝ নিয়ে সজল বলল, “জানিস সে প্রতিদিন একটা করে প্রেমপত্র পায়, বাসায় টিভি নাটকের ডিরেক্টর এসে নাটক করার প্রস্তাব দিয়ে যায়।”
“তো।”
“তো…মানে কি?”
“তো আমি কি করব?” এবার আমি বললাম, “তুই কি এখন চাস আমি ঐ মেয়ের সাথে লাইন মারা শুরু করি?”
“মাশফিয়া কি কিউট না?”
“… হ্যা সে কিউট, আচ্ছা তোর কি ধারনা সে কি আমার সাথে…”
“এতক্ষনে লাইনে আসলি, আমার ধারনা মাশফিয়া তোকে পছন্দ করেছে।”
“ও, তাই বুঝি,” এই বলে আমি প্যাকেট দুইটা ডাষ্টবিনে ফেলে বললাম, “দেখি আগে ঘটনা কত দূরে যায় তারপর ভেবে দেখা যাবে।”
ক্লাসরুমের দরজার সামনে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে দেখে সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তার বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কি ?”
“দাও।”
“কি দিব?” সন্দেহের চোখে তাকালাম, সে কি খন ভিক্ষে নেয়া শুরু করল নাকি চাদাবাজি।
“রুমালটা।”
“ও আচ্ছা রুমাল, সেটা আনতে ভুলে গিয়েছি।” একটু অস্বস্তির হাসি হেসে বললাম। আসলেই আনতে ভুলে গেছি। সেটা মনে হয় আমার টেবিলের ড্রয়ারে আছে।
“কালকে এনো।”
“ঠিক আছে।”
নির্জন ক্লাস রুমে ঢোকার পর একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ওর সাথে কথা বলতে গেলে মনে কম কথা বলা হয়, সেটা ভালো দিক তবে তার উপস্থিতি যে একধরনের চাপ তৈরী করে সেটা তো সহ্য করা কঠিন। এই যাই হোক এরপর রসায়ন ল্যাব। আমার সবচেয়ে প্রিয় একটা সাবজেক্ট। এই ল্যাব ক্লাস আমি সহজে মিস দিতে চাই না। ব্যাগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম না, কারন ব্যাগে দুইটা খাতা ছাড়া আর কিছুই নাই। একটা খাতা নিয়ে আমি রসায়ন ল্যাবের দিকে গেলাম।
রসায়ন ল্যাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার সাথে আমার গ্রুপের সবাই আছে। ম্যাডাম দরজা বন্ধ করে ভিতরে বসে আছে। ম্যাডাম সুমনাকে দেখে বলেছেন, দশ মিনিট অপেক্ষা করতে। আমরা সবাই তাই অপেক্ষা করে আছি। ‘অল লেডিস’ গ্রুপের মধ্যে রুপা আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রেলিং ঘেষ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখনো ক্লাস ঠিকমত শুরু হয়নি। দেখলাম কয়কজন দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ এর মধ্যে আমি মাশফিয়া আপুকেও দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াল সে, আমি এর উত্তরে কিছুই বললাম না শুধু তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলাম।
“আরে আরে, সম্পর্ক দেখছি অনেক দূর চলে গিয়েছে,” রুপা বলে উঠল।
“তোমার দিকে আমি যদি দূর থেকে হাত নাড়াই তাহলে তুমি কি করবে?”
“পাত্তাই দিতাম না।”
আশেপাশে হালকা হাসির রোল উঠল।
হুম হুম হাউ ফানি !
“তবে ওদের দুজনকে মানাবে ভাল,” মাঝখান দিয়ে সুমনা বলে উঠল।
এটা বলার পর আমাদের গ্রুপের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রইল, রুপাও হা হয়ে তাকিয়ে থাকল।
“আচ্ছা আমি কি কোনো ভুল কথা বলেছি?” আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেশ করল। কিন্তু সে জবাব পেল না। সবাই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকল।
আমিও নিজেই আশা করেছিলাম, সে হয়তো বলত, “সুন্দরের সাথে বান্দর কিভাবে মানাবে!”
সুমনা আজকে কি খেয়ে এসেছে। নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি।
“সুমনা তুমি আজকে ঠিক আছ?” আমি জিজ্ঞেশ করলাম।
“কি বলতে চাও?”
“আজকে হঠাৎ মিষ্টি ব্যাবহার।”
“আজিব ব্যাপার আমি কি আমার মতামত জানাতে পারি না?” ঝাঝিয়ে বলে উঠল সুমনা।
না, এটাই আসল সুমনা, আজকে মনে হয় একটু ফিউজ হয়ে আছে, এই যা।
রসায়ন ল্যাবের দরজা খুলে গেল, ম্যাডাম বলল, “সবাই ক্লাসে ঢুকো, সময় হয়ে গেছে, আর কেউ কি ল্যাব কোট সাথে এনেছ?”
হায় হায় আমিতো ল্যাব কোট আনতে ভুলেই গিয়েছি। আশেপাশে সবার দিকে তাকালাম, আমি বাদে সবাই ল্যাব কোট সাথে করে এনেছে।
“যারা ল্যাব কোট নিয়ে আসো নাই তারা আজকে ল্যাব ক্লাসে ঢুকতে পারবে না,” ম্যাডাম ঘোষনা দিয়ে দিল।
সবাই দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। দূর আমি এইসবের ড্যাম কেয়ার করি, আজকের ল্যাব মিস দিলে এমন কোন ক্ষতি হবে না। এই ভেবে উল্টো দিকে হাটা শুরু করতে যাব, তখন সুমনা বলে উঠল, “আরে ক্লাসরুমের ভিতর দেখি একটা ল্যাবকোট আছে। ম্যাডাম ওটা কি আজেকের জন্য দেয়া যায় রানাকে।”
“উমম, দেয়া যায়। এই ছেলে ভিতরে আসো,” ম্যাডাম কড়া গলায় বলল, “আজকের দিনের জন্য দিলাম, পরে যদি ল্যাব কোট না আনো তাহলে ঘাড় ধরে বের করে দেব।”
কিছু না বলে গোমড়া মুখে ল্যাব কোট পড়ে নিলাম, কয়দিন ধরে ধোয়া হয়না কে জানে কেমন একটা বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে। কিছু করার নাই। আমি আমার গ্রুপের টেবিলে গেলাম। তবে সবচেয়ে বড় কথা হল এই ল্যাবে কোন টুল নাই। প্রথম দিন অবশ্য ম্যাডাম বলেছিল, “রসায়নের কাজ ক্রতে হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, তাহলে নিজদের একধরনের গবেষক মনে হবে আর সতর্কতাও বেশী থাকবে।”
আজকে আমাদের ট্রাইটেশনের বিক্রিয়া করানো হবে। ম্যাডাম তার লেকচার দেয়া শুরু করল। আমিও সেটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করতে লাগলাম।
“মেয়েটার নাম কি?” সুমনা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তার হাতে এসিডের বীকার। এটাতে অর্ধেক পরিমান এসিদ আছে, যদিও পানি মেশানো তারপররেও বিপদজনক।
“মাশফিয়া,” এটা বলার পর আঙ্গুল দিয়ে তার বীকারের দিকে তাক করে বললাম, “বিপদজনক জিনিষ হাতে নিয়ে কথা বলতে নেই, টেবিলের তাকে রাখ।”
ল্যাবের প্রত্যেক টেবিলেই তাকের মত জায়গা আছে সেখানে বিভিন্ন ধরনের রাসায়ানিক পদার্থ আছে। আমি বুরেট আর পিপেট পরিষ্কার করছিলাম। আর বাকী সবাই অন্যান্য জিনিষ আনতে গিয়েছে।
“আরে এটাতে তো পানি মেশানো আছে সমস্যা হবে না।”
আমি তাতে তেমন একটা খুশি হতে পারলাম না, বললাম, “এই বিপদজনক জিনিষ হাতে রাখতে হয় না দুর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগে না।”
“আচ্ছা, বুঝেছি বুঝেছি,” এই বলে সে বীকারটা উপরের তাকে রাখল। আজকে তাকে অনেক খুশি দেখাচ্ছে কারনটা কি? আজেক কি এমন ভাল ঘটনা ঘটল যে সবার সাথে ভাল ব্যাবহার করছে। আগে তো সবসময় গোমড়া মুখ করে থাকে। যাক সে যদি খুশি থাকে তাহলে আর বাকী সবাই মনে হয় খুশিতে থাকবে।
“তোমার জুতোর ফিতে খোলা…” আমি বললাম।
হঠাৎ করেই ম্যাডাম বলে উঠল, “আরে এখানে না পিউর হাইড্রোক্লোরিক এসিডের বীকার রেখেছিলাম সেটা গেল কই।”
আমি গোলগোল চোখ করে সুমনার দিকে তাকালাম, এই মেয়ে মনে হয় আজেক আকাশে ভাসছে, পানি মেশানো এসিডের জায়গায় আসল এসিড নিয়ে এসেছে।
কিন্তু এরপর যা ঘটল তা শুধু একটা স্লো মোশন মুভির সাথে তুলনা দেয়া যায়। সুমনা জুতোর ফিতা বাধার জন্য নিচু হতে গেল কিন্তু সে টেবিলের সাথে বড়সড় ধাক্কা খেল। উপরের তাকে ছিল এসিডের বীকার সেটা ধাক্কার চোটে নিচে পড়ে যেতে লাগল একদম সুমনার উপর।
“ওই সুমনা সরে যাও,” আমি এই বলে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। এসিডের বীকার টেবিলের উপর পড়ে কিছু পরিমান এসিড ছিটকে পড়ল। আমি এরই মাঝে সুমনার কাছে পৌছে গেলাম। টের পেলাম আমার বাহু উপর গরম কি যেন পড়ল, আর সারা দেহে একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। আর এর সাথে সাথে একটা কটু গন্ধ নাকে এসে লাগল।
২| ১৯ শে মে, ২০১৪ সকাল ১১:০৭
গরল বলেছেন: এবার একটু বেশী নাটকীয় হয়ে গেল
২১ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:৫২
আজবছেলে বলেছেন: হয়তো বা, তবে ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
৩| ২০ শে মে, ২০১৪ সকাল ৭:৩০
মোঃ মাহমুদুর রহমান বলেছেন: খুব ভাল লাগছে.....।পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম...
২১ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:৫৩
আজবছেলে বলেছেন: ভালো লেগেছে শুনে খুশি হলাম। আমার মত নতুন লেখকে জন্য সেটা অনেক কিছু।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে মে, ২০১৪ সকাল ১০:৫৪
তানজিব বলেছেন: +