নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিবেক বিক্রি হলে দাস-মন ছাড়া কিছুই থাকে নাকো। আদর্শের তবু নৈতিক বিজয় থাকে।

বেলায়েত হোসেন আখন্দ

বিবেক বিক্রি হলে দাস-মন ছাড়া কিছুই থাকে নাকো। আদর্শের তবু নৈতিক বিজয় থাকে।

বেলায়েত হোসেন আখন্দ › বিস্তারিত পোস্টঃ

খাদ্যের দুর্ভিক্ষের চেয়েও ভয়াবহ চিত্তের দুর্ভিক্ষ

১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১২:১২

মনুষ্য মূল্যবোধ-ক্ষয়িত অলসতা ও পলায়নপরতাই চিত্তের দুর্ভিক্ষ। আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধ—বিশেষত দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যবোধের অবক্ষয় প্রবলভাবে নিম্নাভিমুখী। আমরা প্রতিনিয়ত আস্থাহীনতায় ভুগছি, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছি। চরম অমানবিক পরিবেশের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমবর্ধমান অপরাধকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যাচ্ছি, আর পরোক্ষভাবে অপরাধীকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। বিশেষত রাজনীতির ঘেরাটোপে পড়ে—মহাজনের ভয়ে দেনায় ডুবতে থাকা—আমরা যে গলিপথে প্রবেশ করেছি, এ পথেই সামনে পতিতালয়, তারপর গলির শেষে গোরস্থান।

বাহ্য-চাকচিক্যের সংস্কৃতি যাদের কাছে সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড, আত্মার পরিপূর্ণতা বা উন্নতিকে তারা গ্রাহ্যই করে না। তারা মানুষকে বোকা বানিয়ে, ফাঁকি দিয়ে, শোষণ করে একা ভালো থাকার আয়োজনে মত্ত হয়; টিকে থাকার লড়াইয়ে দুর্নীতিকে আশ্রয় করে নীতিবানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। কোনো সমাজ বা দেশের এমন পরিস্থিতিকেই বলা হয় ঐ সমাজ বা দেশের চিত্তের দুর্ভিক্ষ। এ প্রসঙ্গে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের মহাবাণী স্মরণীয়, “দুর্ভিক্ষ তো কেবল খাদ্যাভাবে হয় না, খাদ্যের দুর্ভিক্ষের চেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ চিত্তের দুর্ভিক্ষ।”



ব্যক্তিপূজা ও দলবাজিতে গলদঘর্ম জাতীয় চেতনাহীন অন্বেষাহীন স্বচ্ছতাহীন জবাবদিহিতাহীন চিত্তপ্রবাহহীন কেতাবি-প্রসাধনজীবন আমাদের, আমাদের রক্তপ্রবাহ কেবল মুখমণ্ডলে, সমস্ত শরীরে নয়। এমন জীবন সুস্থ নয়, স্বাস্থ্যকর নয়; খোলস-সর্বস্ব কঙ্কালমাত্র। মিথ্যা ও বিকৃতি দিয়ে গড়া আমাদের জাতীয় চরিত্র—অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার সংকট আমাদের পরিবারে-সমাজে-বন্ধুমহলে, রাজনীতিতে, সর্বত্র। আমাদের চিত্ত অসুস্থ-অমানবিক। তাই, আমরা একেকটি অপঘাতের পর সরবে প্রশ্নের জাবর কাটি—দেশে কোনো আইন আছে? আইন তার নিজের গতিতে চলতে পারছে? মন্ত্রী-এমপি-নেতার-পার্টির ছত্রছায়ায় অত্যাচারী প্রায়শ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় ঘুরে বেড়ায়, আর পালিয়ে বেড়ায় অত্যাচারিত বিচারপ্রার্থী নিরীহ মানুষগুলো। এরা সচরাচর বিচার পায় না। বিচারের নামে ঘটনার সাথে সম্পর্ক নেই এমন কাউকে ধরে নিয়ে নাটক-প্রহসন হয়; সময়ক্ষেপণ হয়; ইতোমধ্যে নতুন অপঘাতের ঘটনা ঘটে। নতুনকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়, পুরাতনকে সবাই বেমালুম ভুলে যায়। মানুষ কত অপঘাতকে মনে রাখবে! তাই দেখি, একটি অপঘাত আরেকটি অপঘাতের ঘটনাকে চাপা দেয়। কুমিল্লায় তনুর রক্ত না-শুকাতেই রাজশাহীতে রেজাউল করিম সিদ্দিকীর রক্ত ঝরে। চট্টগ্রামে মিতু হত্যার রেশ না কাটতেই সিলেটে খুন হয় খাদিজা। খাদিজার খুনি বদরুল। বদরুল ছাত্রনেতা, এটা খুব তুচ্ছ পরিচয় তার অপরাধের কাছে। বদরুলের মতো যারা কুলাঙ্গার, ছাত্রনেতা নয়, তারা অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ও ঘৃণিত হোক আমাদের কাছে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের বিচার হোক।



আমাদের মধ্যে যাদের আত্মা অশুদ্ধ, তারাই আবার গলা ফাটিয়ে আত্মশুদ্ধির আহ্বান জানাই। আমরা অঘটনঘটনপটিয়সী। বিচার না-পেয়ে না-পেয়ে বিচার-প্রার্থণায় আশ্চর্য অনীহা তৈরি হয়েছে। কেননা, এই দেশে নিরাপত্তাহীনতার অনিশ্চয়তা বিচারপ্রার্থীকেই কুড়ে কুড়ে খায়। আমার দেশের তরুণরা যখন দারুণভাবে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে স্বাভাবিক সামাজিক নৈতিক জীবনগড়ার শিক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসে, একটা চমৎকার জীবনের আয়োজনে নামে তখন তারা প্রবলভাবে অস্বাভাবিকতা-অসামাজিকতা-অনৈতিকতার ধূসর-মলিন-বিবর্ণ বিষণ্নতার সঙ্গে পরিচিত হয়। এই পরিচয় তাদের হতাশ করে, অথবা অস্বাভাবিক-অসামাজিক-অনৈতিক জীবনের বাহ্য-চাকচিক্যের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য করে। গালভরা নিয়মের কথা বলে তারাও একদিন অসঙ্গতির সঙ্গী হয়। যারা আদর্শে আপসহীন-অনমনীয় তারা অন্দরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে, আর সদরে এসে আপ্রাণ চেষ্টায় হেসে বলে—ভালো আছি।

নষ্ট রাজনীতিপ্রসূত পেশিশক্তির কাছে মার খাচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মশক্তি—অর্থ ও ক্ষমতা এবং আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কোটার চাপে পিষ্ট হচ্ছে মেধাবীরা। এই দেশে টাকা দিয়েও নাকি মনোনয়ন কেনা যায়; সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ব্যক্তিপূজক ও দলবাজ নয় এমন কারো জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগও কমছে দিন দিন। এই দেশে জমি বেচলে চাঁদা দিতে হয়, জমি কিনলে চাঁদা দিতে হয়, কেনা জমিতে বাড়ি করতে গেলেও চাঁদা দিতে হয়। এই দেশের দুষ্টচক্র শিশু অপহরণ করে চাঁদা চায়, চাটুকাররা নেতার জন্মদিন উদযাপন করতেও চাঁদা তোলে। এই দেশে চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হয়, পদোন্নতির জন্য ঘুষ দিতে হয়। এই দেশের মানুষ বদলি ঠেকাতে ঘুষ দেয়; শুনেছি, আলাদীনের চেরাগ-পাওয়া কিছু লোক পদোন্নতি ঠেকাতেও ঘুষ দেয়। এই দেশের শিক্ষকরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ-উপাচার্য হওয়ার জন্যে রাজনীতিকদের বাসায় বাসায় দৌড়ধাপ করে। এই দেশে সাদাকে সাদা বলা বিপজ্জনক। এই দেশের মানুষ ভিন্ন মতের ও পথের মানুষকে শত্রু ভাবে, হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। রাজনীতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফায়দা লাভের অপচেষ্টায়ও অহরহ গুম-খুনের ঘটনা ঘটে। ক্রসফায়ার তো ইতোমধ্যে মাকরুহ-বৈধতাই পেয়ে গেছে। বানরের রুটি বণ্টনের গল্পের ইঁদুরের মতো অসহায় হয়ে পড়েছে এই দেশের সাধারণ মানুষ। সাংবাদিক-লেখক-শিক্ষক বুদ্ধিজীবীরাও দলকানা-কুম্ভকর্ণ। আমরা সমাজের নিয়মের প্রতি, রাষ্ট্রের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই, সংবেদনশীল নই। আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে মানবিক সংবেদনশীলতার চর্চা নেই। পারস্পরিক মান্যতা নেই বলে শৃঙ্খলাও নেই। আমাদের সামাজিক মর্যাদা-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় কালোটাকার ভিত্তির উপর। হালাল উপার্জন ও নিয়মের মধ্যে জীবনযাপন আমাদের পরিবারে-সমাজে কোথাও আর প্রশংসিত হয় না। পরিবার-সামাজ আমাদের মাথা গুঁজে আত্মসমর্পণে নিশ্চিন্ত হতে প্ররোচিত করে। চিত্তের দুর্ভিক্ষের অনুরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের চারপাশে।

বাংলাদেশের মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারছে না—জনগণের বিজয় অনিবার্য। এই অবিশ্বাসপ্রসূত মনস্তাত্ত্বিক চাপ বা ভীতি মানুষের জীবনকে সংকুচিত করে, নতুন অপরাধের জন্ম দেয়, দিতে পারে। সমাজ ও রাষ্ট্রের বিধায়কদের অনৈতিক আচরণ আর ক্রমবর্ধমান খুন-ধর্ষণ-অপহরণের ঘটনা একটা পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে—নষ্ট জোয়ারের টানে ভাসছি আমরা। এর থেকে পরিত্রাণ চাই আমাদের। এক্ষেত্রে প্রত্যেককেই এগিয়ে আসতে হবে, কিন্তু মূল দায়িত্ব নিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকেই। দুর্নীতিবাজ ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের জন্য জেলায় জেলায় বস্তি হোক, একদা যেমন দেশে দেশে কুষ্ঠরোগীদের জন্য হয়েছিল, আমাদের জনপদে তারা অবাঞ্ছিত হোক। কারণ, যেকোনো সমাজ ও দেশের জন্য দুর্নীতি কুষ্ঠরোগের চেয়েও মারাত্মক ব্যাধি।

সমাজের নিয়ম ও রাষ্ট্রের আইন যে দুষ্টচক্রের দৌরাত্ম্যে ঘুরপাক খায়, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাফল্যগুলো যাদের স্বার্থপরতায় ম্লান হয়ে যায়—তারা সমাজ, দেশ ও মানবতার শত্রু। কারণ, তারা অর্থগৃধ্নু-ক্ষমতাগৃধ্নু; সাধারণ মানুষকে শোষণ করেই তারা তাদের ভোগবিলাসের রসদ সংগ্রহ করে। তারা উপায়কে লক্ষ্য বানিয়ে মানুষের গুণ ও চিন্তার বিকাশে বিঘ্ন ঘটায়। অথচ আপন আপন গুণ ও চিন্তার বিকাশের মাধ্যমেই মানুষের আত্ম-পরিপূর্ণতা সাধিত হয়, শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের কাজে দশের কাজে অন্তরের ছোঁয়া না-থাকলে দেশ ও দশের সেবক হওয়া যায় না, দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না, সুনাগরিক হওয়া যায় না। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র কথায় ও কাজে আস্থা অর্জন করুক। সমাজ-রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষের বন্ধন সত্য-আত্মীয়তা ও নিয়মানুবর্তিতায় সমুজ্জ্বল হোক, স্পর্ধিত হোক।

দেশ ও মানুষের সেবাই যদি লক্ষ্য হয়, তবে ভালো কাজে সহযোগী হই, মন্দ কাজে রুখে দাঁড়াই। তার আগে ভালো-মন্দ বুঝতে শিখি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:১৮

সিদ্ধার্থ আলম বলেছেন: ভাল লিখেছেন। যুগোপযুগী লেখা হয়েছে।
দেশ ও মানুষের সেবাই যদি লক্ষ্য হয়, তবে ভালো কাজে সহযোগী হই, মন্দ কাজে রুখে দাঁড়াই। তার আগে ভালো-মন্দ বুঝতে শিখি।
ভাল লাগল।

১০ ই অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১:৩৫

বেলায়েত হোসেন আখন্দ বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.