নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিবেক বিক্রি হলে দাস-মন ছাড়া কিছুই থাকে নাকো। আদর্শের তবু নৈতিক বিজয় থাকে।

বেলায়েত হোসেন আখন্দ

বিবেক বিক্রি হলে দাস-মন ছাড়া কিছুই থাকে নাকো। আদর্শের তবু নৈতিক বিজয় থাকে।

বেলায়েত হোসেন আখন্দ › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবিতা একা কবির সৃষ্টি নয়, পাঠকও একে সৃষ্টি করেন

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫০

এক:
খেয়ালের ছলে বাঁধানো-কুয়ার জলে ঢিল ছোড়ার প্রতিধ্বনিই কবিতা। কবিতার চোখের ভাষা লুকিয়ে থাকে মনে, সব ভাষা তার যায় না পড়া অভিধানে। মনন ও সংবেদন তাড়িত হয়ে সৃজনবেদনায় বুক-উথলিয়া উঠে কবিতার ভাষা। কবিতা নদীর গতিতে এসে বৃক্ষের ন্যায় ধীরস্থির ভালবেসে কাব্য করে, মনকে খেলায়। আমার কাছে ‘ঢিল’, ‘বাঁধানো-কুয়ার জল’, ‘প্রতিধ্বনি’ যথাক্রমে কবিতার জন্য সুনির্বাচিত শব্দ, কবিতার সুগঠিত দেহ ও কবিতার অর্থব্যঞ্জনা। অপরের দৃষ্টিতে এর অন্য অর্থ হলেও হতে পারে। কারণ, পাঠকের পক্ষে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নমত পোষণের অবকাশ রয়েছে।

দুই:
কবিতা একা কবির সৃষ্টি নয়, পাঠকও একে সৃষ্টি করেন। কবিতা পাঠকের মনকে খেলায়, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যের কারণে সব পাঠকের খেলা এক রকম হয় না। সব পাঠকের কাছে কবিতার অর্থও সবসময় এক থাকে না। তাই, দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস ও হাসান আজিজুল হক কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত ‘বনলতা সেন’ কবিতার ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’-এ পঙক্তিটির দুইরকম অর্থ করতে পারেন, এর ভিন্ন অর্থ উপলব্ধি করি আমিও—
১. দুলাল পঙক্তিটিতে নায়িকা বনলতার প্রত্যাখ্যানের ব্যাথা অনুভব করেন।
২. হাসান চিরজীবনের কাঙ্ক্ষিতের প্রথম দর্শনলাভের অসাধারণ বিস্ময় অনুভব করেন।
৩. আর আমি অনুভব করি, জীবনসংগ্রামের বন্ধুর পথে ভেদবৈষম্যের আঘাতে দুই দিগন্তে ছিটকে পড়া প্রেমিক-প্রেমিকার পুনর্মিলনের বিশ্বাসী-প্রতীক্ষার অবসানের-বাণী, কুশলবাণী—“এত দিন কোথায় ছিলেন?”
পুনর্মিলনের বিশ্বাসের জোরেই প্রেমিক পুরুষ হাজার বছর ধরে পথ চলতে পারেন; বিশ্বাসী-প্রতীক্ষা জাগরূক ছিল বলেই প্রেমিকার বুকের দরদ উথলে উঠলেও তার জিজ্ঞাসা কিন্তু ধীরস্থির ও সংযত। অপরদিকে, মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের দিক থেকে দেখলে এ প্রেমিক তো মহাকালেরই অভিযাত্রী; ঈপ্সিত সভ্যতার নীড় বিনির্মাণের পথে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যার অব্যাহত বিশ্বাসী অভিযাত্রা। এ যাত্রার আবেগরক্তিম উদ্যম চিরকালই নবীন, রঙও চিরকালই সবুজ। পাঠকের মনের নিভৃত গহীনে অর্থব্যঞ্জনার এই যে রহস্যময় খেলা একেই বলা হয় কাব্যময়তা। কাব্য করলেই কবিতা হয়, না করলে হয় না। সুতরাং কবিতা তা-ই যা কাব্য করে। কবিতা কবির দিক থেকে যায়ও, পাঠকের দিক থেকে ফিরেও আসে। এককভাবে শব্দের কোনো ক্ষমতাই নেই, যা কাব্যতৃষ্ণা মেটাতে পারে। শব্দকে খেলাতে হয়, খেলতে দিতে হয়। কবিতায় কবি আর পাঠকই শুধু খেলেন না, শব্দ-পঙক্তিও খেলে। যে শব্দ-পঙক্তির অন্তরে গোটা কবিতার কাব্যব্যঞ্জনার বীজ সঞ্চিত থাকে অন্য শব্দ-পঙক্তিগুলো তার দ্বারাই তাড়িত হয়।

তিন:
বাহ্যত, ‘বনলতা সেন’ বাগানের সুনির্বাচিত প্রিয় ফুলের মতো কোন প্রিয়া। বস্তুত, ‘বনলতা সেন’ কবির স্বপ্নকল্পনারই নিরাকার নারীমূর্তি; তিল তিল কল্পনায় গড়া মানসীপ্রিয়া—আলোর জগতে তার অস্তিত্ব নেই, সে স্বপ্নেই শুধু আসে, দু-দণ্ডের জন্য সে স্বপ্নাতুর চোখেই শুধু ভাসে। এই মানসীপ্রিয়া যতটা মানবী তার চেয়ে বেশি যেন নিসর্গসৌন্দর্য, সে নারীর মতোই প্রেম বহন করে এনেছিল কবির জীবনে। যিনি ‘হাজার বছর ধরে’ পথ হাঁটেন তিনি মহাকালে ভ্রাম্যমান। মহাপৃথিবীর বুকে এই পথহাঁটা নিরবিচ্ছিন্ন মহাকালে প্রজন্ম-পরম্পরায় নিরবিচ্ছিন্ন মহাপ্রাণ প্রেমিক পুরুষের মহাযাত্রা। তিনি আবহমানকালের অভিযাত্রী। সাধারণ অর্থে এই যাত্রার গন্তব্য বনলতা সেন নামের একজন নারী। বনলতাকে কবি এমন নাম-ঠিকানা-বংশ পরিচয়ে উপস্থাপন করেছেন যে তাকে বাস্তবজীবনের রক্তমাংসের নারী বলেই গ্রহণ করতে হয়। পাঠককে বিশ্বাস করতে হয় কবি যেন সত্যিই নাটোরের বনলতার প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু, যে বনলতা সেন ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ তুলে জানতে চান, ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’—তিনি ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে প্রেমময়ী নারীসত্তা রূপে প্রেমিক পুরুষের আশ্রয় হন।
কিছু ভুল হবে কি?—
১. যদি বলি, কোন নারী নয়, রমণীয় মাধুর্যে ভরা রূপসী বাংলার বুকই সে-আশ্রয়—মৃত্যুর পরেও কবি যে বুকের আশ্রয়ে ফিরে আসতে চান। বাস্তবজীবনের অস্থিরতা আর অবিশ্বাসের হাওয়ায় সমস্ত মনপ্রাণ যখন বিষাদগ্রস্ত তখন বাংলার প্রকৃতিই একান্ত নির্জন আশ্রয়ের জগৎ রূপে আবির্ভূত হয়েছিল, তাঁকে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল। শান্তি স্থায়ী হলো না—কারণ, প্রকৃতির নিয়মেও আছে ধূসরতা।
২. যদি বলি, সমস্ত অবলম্বনের বন্ধন ছিঁড়ে গেলেও স্বপ্ন থাকে। বর্তমানও অতীত হয়ে যায়, ভবিষ্যতের তবু আশা থাকে। সবকিছু যখন মিথ্যা হয়ে যায়, তখনও আশা বেঁচে থাকে—“থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।” তাহলে, আবহমানকালের প্রেমিকপুরুষ ঠিক কার মুখোমুখি হন? কল্পনার মুখোমুখি হন—কল্পনার রাজ্যেই ডুব দেন; বনলতা সেন আসলে কল্পনার-আশ্রয়। কল্পনায়ও ছেদ ঘটে—সুনিশ্চিত আশ্রয় এও নয়।
৩. যদি বলি, যখন ‘থাকে শুধু অন্ধকার’, তখন ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’-এর উপস্থিতি যান্ত্রিক-সভ্যতার অন্ধকারে মানবিক-সভ্যতার আস্বাদ-আবেদনকেই তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে।
কিংবা, যদি বলি, নারীর প্রেম আর নিসর্গের সৌন্দর্যে গড়া বনলতা সেন। বনলতার উপস্থিতি বিশুদ্ধ চৈতন্যের জাগরণ, বনলতার আশ্রয় প্রাণের আশ্রয়। অস্বীকার করতে পারবেন?
[রচনাকাল: ২০০৭ খ্রিস্টাব্দ, চবি ক্যাম্পাস।]

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৩

শরতের ছবি বলেছেন:

'নারীর প্রেম আর নিসর্গের সৌন্দর্যে গড়া বনলতা সেন।
বনলতার উপস্থিতি বিশুদ্ধ চৈতন্যের জাগরণ, বনলতার আশ্রয় প্রাণের আশ্রয়।'

এই বনলতাকে যে যেভাবে ভাবছে তার জন্য বনলতা তাই । এখানেই কবিতার মজা , নিজস্ব কল্পনা জগতের স্বাধীনতা থাকে ।
আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যাগুলো ও দারুণ লেগেছে ।

পড়তে বেশ ভাল লেগেছে । বেশ তাৎপর্যপূর্ণ লেখা ।

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:০৭

বেলায়েত হোসেন আখন্দ বলেছেন: আপনার সংবেদনশীলতাও অসামান্য।

২| ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ৯:৪৩

আহমেদ জী এস বলেছেন: বেলায়েত হোসেন আখন্দ ,



সুন্দর লেখা ।

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:০৯

বেলায়েত হোসেন আখন্দ বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.