| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মোগল সম্রাট
মানুষ মানুষের জন্য , জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভুতি কি মানুষ পেতে পারেনা...ও বন্ধু...
প্রথম পর্বটা লিখেছিলাম ২০২৩ সালে সেখানে বলেছিলাম মসজিদ সংখ্যায় বাড়লেও সমাজে তার কার্যকর ভূমিকা কেন কমে গেছে। দ্বিতীয় পর্বে এসে সেই প্রশ্ন আরও নির্দিষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়। দেশে সংখ্যায় এত বিপুল মসজিদ থাকার পরও সমাজ কেন এত অসহায়?
বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ ছোট-বড় মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা সরাসরি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় রয়েছে মাত্র ৬ থেকে ৭ হাজারের মতো, বাকি তিন লক্ষাধিক মসজিদ পুরোপুরি বেসরকারি ও কমিউনিটি-নির্ভর। অর্থাৎ সমাজ নিজেই মসজিদ বানিয়েছে, সমাজই মসজিদ চালায়। কিন্তু সেই সমাজই যখন বিপদে পড়ে, তখন মসজিদকে পাশে পায় না। এখানেই মূল বৈপরীত্য।
বিশ্বের বড় বড় মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। ইন্দোনেশিয়ায় আনুমানিক ৭.৫ থেকে ৮ লাখ মসজিদ আছে, ভারতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ, পাকিস্তানে আড়াই লাখ থেকে তিন লাখের মতো। ভৌগোলিক আয়তন ও অর্থনৈতিক সক্ষমতায় বাংলাদেশ এসব দেশের অনেক পেছনে থাকলেও, মসজিদের সংখ্যায় বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ তিন চারটি দেশের মধ্যে। গড়ে বাংলাদেশে প্রতি ৫০০ থেকে ৫৫০ জন মানুষের জন্য একটি মসজিদ রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো এই বিপুল সংখ্যক মসজিদ সমাজকে কী দিচ্ছে?
একটা গ্রাম বা মহল্লায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, জুমার নামাজ হয়, রমজানে দান ওঠে, ঈদে চাঁদা ওঠে। কিন্তু পাশের বাড়ির মানুষটা চিকিৎসার অভাবে মারা গেলে, কিংবা কোনো ছাত্র ফি দিতে না পেরে পড়াশোনা ছেড়ে দিলে মসজিদ সেখানে নীরব থাকে। যেন এসব ‘দুনিয়াবি বিষয়’ মসজিদের এখতিয়ারের বাইরে। কোন কোন মসজিদে তো বড় করে নোটিশ টাঙ্গানো আছে “মসজিদে দুনিয়াবি কথ বলা হারাম” অথচ ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাস বলে, মসজিদ ছিল মানুষের দুঃখ-কষ্ট শোনার প্রথম জায়গা।
মসজিদ কমিটিগুলোর বাস্তব ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অধিকাংশ মসজিদ কমিটিতে থাকেন সমাজের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা স্থানীয় ক্ষমতাবানরা। তাদের প্রায় সবার বৈঠকে আলোচনার বিষয় হয় মসজিদের মার্বেল বদলানো হবে কি না, এসি বাড়বে কি না, গম্বুজ কতটা উঁচু হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এলাকায় কয়জন বেকার, কয়জন বিধবা, কয়জন শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে এসব নিয়ে পরিকল্পিত কোনো আলোচনা বা ডাটাবেস খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়।
দান ও যাকাত ব্যবস্থাপনাও আরেকটি বড় সমস্যা। প্রতি জুমায়, প্রতি রমজানে বিপুল অর্থ ওঠে, কিন্তু সেই টাকার স্বচ্ছ হিসাব, সামাজিক বণ্টন বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সাধারণ মুসল্লির জানার সুযোগ নেই। হিসাব চাইলে অনেক জায়গায় সেটাকে প্রশ্ন তোলা বা ফিতনা হিসেবে দেখা হয়। অথচ স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো সমাজসেবা টেকসই হতে পারে না।
বিশ্বের দিকে তাকালে চিত্রটা ভিন্ন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার বহু মসজিদ শুধু নামাজের জায়গা নয় সেগুলো ফুড ব্যাংক চালায়, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প করে, হোমলেসদের আশ্রয় দেয়, বেকার তরুণদের স্কিল ট্রেনিং দেয়, যাকাত ও সুদমুক্ত ঋণ পরিচালনা করে। সেখানে মসজিদ মানে কমিউনিটি সেন্টার, সামাজিক নিরাপত্তার একটি স্তম্ভ।
বাংলাদেশে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগ থাকলেও, তা বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তি-নির্ভর। কোনো জাতীয় বা স্থানীয় কাঠামো নেই, যেখানে মসজিদগুলো সম্মিলিতভাবে দরিদ্র, অসুস্থ বা বেকার মানুষের দায়িত্ব নেবে। ফলে মসজিদ থাকে, দান আসে, কিন্তু সমাজে তার প্রতিফলন খুব কম দেখা যায়।
এই লেখার উদ্দেশ্য মসজিদ বা ধর্মকে আঘাত করা নয়। বরং প্রশ্নটা সৎভাবে তোলা এত মসজিদ থাকা সত্ত্বেও কেন সমাজ এত অনিরাপদ? সমস্যা ধর্মে নয়, সমস্যা ব্যবস্থাপনায়, অগ্রাধিকার নির্ধারণে এবং দায়বদ্ধতার অভাবে।
মসজিদ চাইলে খুব সহজেই পরিবর্তনের কেন্দ্র হতে পারে। প্রতিটি মসজিদে একটি শিক্ষা সহায়তা তহবিল, একটি চিকিৎসা ফান্ড, একটি যাকাত ডাটাবেস, একটি কর্মসংস্থান উদ্যোগ থাকলেই চিত্র বদলাতে শুরু করবে। ভবন বড় না হলেও চলবে, এসি কম হলেও চলবে কিন্তু সমাজে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে, মসজিদ কেবল একটি সুন্দর স্থাপনা হয়েই থেকে যাবে।
বাংলাদেশে মসজিদের অভাব নেই। অভাব আছে মসজিদ থেকে সমাজে ফেরত যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্তের। সেই সিদ্ধান্ত না এলে, এত মসজিদ থাকা সত্ত্বেও সমাজে মসজিদের অবদান শূন্যের ঘরেই রয়ে যাবে।
ঢাকা,
০৮ পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ।
ছবিঃ অন্তর্জাল।(মসজিদটি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি)’র ভিতরে।
©somewhere in net ltd.