নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রতিনিয়ত নিজেকে শেখার চেষ্টা করছি :)

আলামিন মোহাম্মদ

১৯৮৮ সালের বন্যার কথা বলছি। নভেম্বর মাস কিন্তু এখনো বন্যার পানি পুরোপুরি সরে যায়নি। বন্যায় রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে গেছে। সেই সময় টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামের চান মিয়া খুবই চিন্তিত হয়ে আছেন। বাড়িতে পুরুষ ব্যক্তি বলতে একমাত্র সে। তার অনেক দায়িত্ব কারণ তার ভাগনির সন্তান হবে যেকোন মুহুর্তে ব্যথা উঠে যেতে পারে। আশেপাশে কোথাও ডাক্তার নেই, দাই একমাত্র ভরসা। দাইকে খবর দিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি একবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছেন যদি হাসপাতালে নিতে হয় তাহলে তো মহা বিপদ। ভাগনির স্বামীও সাথে নাই। ঢাকায় কাজে গেছে। দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে। এমন সময় রসুই ঘর থেকে একটি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসলো। পুত্র সন্তান হয়েছে আজান দেয়া লাগবে। কিন্তু আলাদা করে আজান দেয়া লাগে নাই। আসরে নামাজের জন্য আহবান করা চারদিকের সকল মসজিদের আজান যেন নতুন ভুমিষ্ট শিশুকে বরণ করে নিল। চান মিয়া আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেন। সন্তানের পিতাকে খবর জানানো দরকার। ঢাকায় গিয়ে চান মিয়া সন্তানের বাবাকে খুঁজে পেলেন না। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বাড়ির প্রতিবেশীকে খবর দিয়ে রাখলেন যাতে বাড়িতে আসা মাত্র টাঙ্গাইলে চলে যায়। পুত্র সন্তান হয়েছে আর পিতা কিনা দূরে তা কি করে হয়? এক সপ্তাহ পর শিশুর পিতা বাড়িতে আসলো এবং পুত্র সন্তানের খবর শুনেই টাঙ্গাইলের পানে ছুটলেন। শিশু পুত্রকে দেখতে চাইলেন কিন্তু গ্রাম্য রেওয়াজ বাধা হয়ে দাঁড়ালো।স্বর্ণ দিয়ে শিশু পুত্রের মুখ দেখতে হবে। শিশুর পিতার তখন এত সামর্থ্য ছিল না স্বর্ণ কেনার। তাহলে কি উপায়? স্বর্ণ ও হলুদ একই ধরনের ধরা হয়। তখন একটি হলুদের টুকরো হাতে নিয়ে শিশুর হাতে দিলেন। সেটি ছিল শিশুর প্রথম উপহার। সেই উপহারটিকে যত্ন সহকারে তার নানী সিকায় তুলে রাখলেন। এভাবে চলে যেতে থাকলো দিন মাস বছর। এভাবে যখন শিশুর আঠারো বছর পূর্ণ হল তখন শিশুর নানী তার হাতে একটি শীর্ণ ও শুকিয়ে যাওয়া একটি হলুদ তুলে দিলেন এবং সেদিনের কথাগুলো পুনব্যক্ত করলেন। ১৮ বছর আগের প্রথম উপহার পাওয়া সেই হলুদ এখন সযত্নে আছে দেখে সেই কিশোরবালক অনেক পুলকিত হল। এরপর লজ্জা পেল যখন সে নানীর বাসনার কথা জানতে পারলো। বাসনা অনুযায়ী এই হলুদ দিয়েই নাতির গায়ে হলুদ দিতে চান। গত ১০ নভেম্বর ২০১২ সেই কিশোরবালক ২৪ বছর অতিক্রম করে ২৫ এ পা দেয়। আজো সেই কিশোরবালক তার নানীর ইচ্ছা পুরণ করতে পারে নাই। আর সেই কিশোরবালক হচ্ছে এই আলামিন মোহাম্মদ

আলামিন মোহাম্মদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভোটকা-ভোটকী !

২০ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:২২

অনিকের স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। স্কুলে থাকতেই সে এই স্বপ্ন দেখা শুরু করে। স্কুলে থাকতে তাদের কাশেম স্যার বলেছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা দিয়ে হাঁটলেও অনেক জ্ঞান পাওয়া যায়।বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিতে গলিতে অনেক জ্ঞান ছড়িয়ে আছে। তখন থেকেই অনিকের স্বপ্ন ছিল এই জ্ঞান রাজ্যে বসবাসের সুযোগ পাওয়ার। অনেক হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে সে এখানে বসবাসের সুযোগ পায়। আজ দুপুর ৩.০০ টায় তাদের প্রথম ক্লাস হবে। সে খুব উত্তেজিত।

টিএসসির অর্ধবৃত্তাকার বেদীতে বসে অনিক আর তার বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছে। দুপুর ৩.০০ টা বাজতে এখনো অনেক সময় বাকী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তো পূরণ হল কিন্তু কলেজে থাকতে নুরুন নাহার ম্যাডাম যে কথা বলেছিলেন সে কথা এবার পূরণ করতে হবে।কলেজের প্রথম ক্লাসে নুরুন নাহার ম্যাডাম এসে বললেন-কলেজে উঠে সবাই রঙ্গিন চশমা পরে ঘোরা শুরু করে। জীবনকে তখন রঙ্গিন মনে হয়। সেই রঙ্গিন চশমায় সকল মেয়েদের রঙ্গিন মনে হয়।মেয়েদের সাথে রঙ্গিন চশমা পরে প্রেম না করে ভালোমত পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে শুধু মেয়ে কেন মেয়ের মাও তোমার পিছনে ছুটবে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবার জন্য।

ম্যাডাম আরও বলেছেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রেম কর তখন যদি রাস্তায় দেখা হয় তখন আমি যেচেই বলবো মেয়েটির সাথে পরিচয় করে দাও তো।

ম্যাডামের সেই কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনিক রঙ্গিন চশমা খুলে সাদাকালো চশমা পরে চলাফেরা করেছে। দুষ্টামি ফাইজলামি করলেও পড়াশোনা ঠিক মত করেছে।আজ সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।তার শিক্ষাগুরুর কথামত এখন অলিতে গলিতে জ্ঞান অনুসন্ধান করছে। চোখে রঙ্গিন চশমা পরে ক্যাম্পাসটাকে দেখছে।



রঙ্গিন চশমা পরে সে যখন আশেপাশে তাকাচ্ছিল তখনই সে একটি মেয়েকে দেখতে পায়। এত মোটা আর এত লম্বা মেয়ে সে এর আগে দেখেনি।অনিক সাথে সাথে তার বন্ধুদের মেয়েটির দিকে তাকাতে বলে।অনিক তার বন্ধুদের বলে চল মামা মেয়েটির সাথে একটু মজা নেই। তখন অনিকের বন্ধু জহির বলে উঠে- না, এই আটার বস্তার সাথে মজা নিয়ে লাভ নেই।

আরে আয় মামা। ভার্সিটিতে উঠেও যদি একটু মজা না করি তাহলে হয় কি করে? স্কুল কলেজে এত সংযম করে আসলাম। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেই তো অসংযম হবার সময়।

অনিক আর জহির মেয়েটির কাছাকাছি গিয়ে বলতে লাগলো- চাউলের বস্তা তো ফেটে গেল। সব চাউল বের হয়ে আসতেছে।

এরপর জহির বলল- কোন গুদামের চাল খান? কে বলছে বাংলাদেশ গরীব দেশ? ওনারে নিয়ে দেখাইলেই তো বাংলাদেশ ধনী দেশ হয়ে যাবে।

এই কথায় অনিক আর জহির দুইজনেই হাসিতে ফেটে পড়ল। সেই মোটা মেয়েটি তাদের কথা শুনেছি কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ মেয়েটির মধ্যে কোন ভাবান্তর হচ্ছে না।মেয়েটি এক মনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কি যেন দেখছে।

এবার অনিক জহিরকে বলল- আচ্ছা মেয়েটির সাইজ বলতে পারবি?

জহির মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল- ৭২,৯০,৭২

অনিক অবাক হয়ে জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল- মামা, তোর চোখ দেখি পাকা মাপ বলতে পারে।

অনিক আবার ঐ মেয়েটির দিকে গবেষণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল- আচ্ছা মামা, এই মেয়ের জামা বানাতে কত গজ কাপড় লাগে? কোন দর্জির কাছ থেকে বানায়?

জহির বলল, আমি কি করে বলবো?

ওনার যে স্বামী হবে তার কত দুঃখ হবে। একসাথে রিকশায় চড়তে পারবে না। তার স্বামী তাকে কোলে তুলে আদর করতে পারবে না। বুকে জড়িয়ে ধরলে দুই হাতে ঠায় নিবে না।

অনিকের এই কথা শুনে জহির হো হো করে হেসে উঠলো। তোর এই কথা শুনে আমার একটি প্যারোডী গানের কথা মনে পড়ে গেছে। একটু সুর দিয়ে শোনাই তোরে- তুমি এত মোটা, এত মোটা! পাই না দুই হাতে বেড় তুমি এত মোটা!

জহির যখন অনিককে গান শোনাচ্ছিল তখন আরেকজন শ্রোতা এসে তাদের সাথে যোগ দিল।সেই মোটা মেয়েটি কখন খুব কাছে এসে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তারা টের পায়নি। মেয়েটি যখন হাততালি দিয়ে উঠল তখন জহির গান থামিয়ে চোখ বড় করে মেয়েটির দিকে তাকালো। তার গলা শুকিয়ে আসছে। মেয়েটি কি না কি করে বসে। আসলেই এত মজা করা উচিত হয়নি।

মেয়েটি জহিরের দিকে তাকিয়ে বলল- আপনার গানের গলাতো বেশ মিষ্টি। এই গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালো শোনাবে। প্যারোডী গান আপনার সাথে যাবে না।

এরপর মেয়েটি অনিকের দিকে তাকালো। অনিক সাথে সাথেই তার চোখ মাটিতে নামিয়ে নিয়ে আসলো। সে ভাবতে লাগলো-কলেজে থাকতে কত মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছে, কোন মেয়েই এভাবে এগিয়ে আসেনি। এই মেয়ের সাহস আছে।এখন কোন অঘটন না ঘটালেই হল। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন আর আজই এমন ঘটনার মুখোমুখি সে হল।



আমার দিকে তাকান। ভালো করে তাকান। তাকিয়ে আপনিই বলুন আমার সাইজ কত?, আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছেন কেন?

এই কথা বলার পরেও যখন অনিক মাথা নিচু করে আছে তখন মেয়েটি আবার বলল- আহা তাকাচ্ছেন না কেন? আর আপনাদের একটা কথা বলি- I am not stout, I am easy to see



এই কথা বলে মেয়েটি সেখান থেকে চলে গেল। অনিকের কানে মেয়েটির সেই শেষ কথাটি কানে বাজতে লাগলো। মেয়েটি কত ইতিবাচক চিন্তা করে। নিজেকে নিয়ে কখনো অস্বস্তিতে ভোগে না। আসলে আমরাই মানুষকে অস্বস্তিতে ভোগাই।

স্কুলের কাশেম স্যার ঠিকই বলেছেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিতে গলিতে জ্ঞান ছড়িয়ে আছে। আজ টিএসসির সামনে দাঁড়িয়ে অনিক যে জ্ঞান পেয়েছে তার জ্ঞান চক্ষুকে খুলে দিয়েছে। ইতিবাচক হিসেবে চিন্তা করতে শিখিয়েছে।



অনিকের ভেতর এক অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো। সে ধিম মেরে ঐখানেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। জহিরের কথায় তার ধ্যান ভাঙ্গলো।

- তিনটা বেজে যাচ্ছে, চল ক্লাসে যাই।

- ওহ, চল তাড়াতাড়ি ক্লাসে যাই

- আজকে প্রথম ক্লাস কার?

- টুম্পা নামে এক ম্যাডামের।



বিজনেস ফ্যকাল্টির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাস রুমে বসে আছে অনিক। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকলেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝামছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাস আজকে আর আজকেই সে একটা অস্বস্তিকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। সে আবার বিড়বিড় করে বলতে লাগলো – I am not stout, I am easy to see

সে যখন বিড়বিড় করে এটা বলতেছিল তখনই ক্লাসে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। ম্যাডাম ঢুকেছেন। সবার দেখাদেখি অনিক দাঁড়াল।অনিক তখনো ম্যাডামকে লক্ষ্য করেনি। ম্যাডাম যখন ডায়াসে উঠে দাঁড়ালেন তখনই অনিকের চোখ চড়াক গাছে উঠল। সে জহিরের দিকে একবার তাকালো। সে দেখলো জহিরও তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম এখন বড় বড় ফোটা হয়ে ঝড়তে লাগলো। তাদের প্রথম ক্লাস নিতে আসা টুম্পা ম্যাডাম আর কেউ না একটু আগে উত্যক্ত করা সেই মোটা মেয়েটি।



- আমার ভোটকী মা কি করে?

- মা, ভার্সিটিতে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাই আড়ালে আমাকে ভোটকী বলে ডাকে আর তুমি দেখি প্রকাশ্যে ভোটকী ডাকা শুরু করেছো।

- ভোটকী এটা ভালোবাসার ডাক। এটা প্রকাশ্য হওয়ায়ই ভালো

- মানে তুমি বলতে চাইছো যারা আমাকে ভোটকী ডাকে তারা আমাকে ভালোবাসে?

- অবশ্যই তোকে ভালোবাসে। তুই যদি দুইদিন ক্যাম্পাসে না যাস, এরপরের দিনই তোর খোঁজ শুরু হয়ে যাবে।তাদের ভোটকী ম্যাডাম এর কি হল?

- হয়েছে, আর বলতে হবে না। কি বলবে বল?

- তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে, তোকে দেখতে এসেছে।

- মা, আর কত?

- তোর শুধু মিছে ভয়, কত কানা খুড়ার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আর তোর বিয়ে হবে না?

- মা ভয় নয়, কানা খুড়ার বিয়ে হচ্ছে যৌতুক দিয়ে

- দরকার হলে তোকেও যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিব

- না মা, তা কখনোই নয়। আমার সব কিছু মেনে যে বিয়ে করবে তাকেই আমি বিয়ে করবো।

- বিদেশের কত মেয়েকে দেখলাম মোটা। তোর চেয়েও মোটা। তাদের পর্যন্ত বিয়ে হয়ে যাচ্ছে

- মা, এটা বাংলাদেশ। এদেশের ছেলেদের চিকনী চামেলী মেয়ে পছন্দ, আটার বস্তার মুনমুন নায়িকা তাদের পছন্দ হবে না

- ছি ছি এভাবে বলছিস কেন?

- যা সত্যি তাই বলছি। আমার বান্ধবী মৌসুমি এর কথা তোমার মনে আছে?

- হুম, মনে আছে। কি হয়েছে ওর?

- ওর চার বছরের রিলেশন ভেঙ্গে গেছে

- কিভাবে?

- রিলেশন এর শুরুর দিকে মৌসুমি চিকনই ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে সে মোটা হতে শুরু করে। ওর বয়ফ্রেন্ড ওরে বলেছিল আরেকটু স্বাস্থ্য কমাতে। এতে মৌসুমি খিপ্ত হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় ঝগড়া। সেই ঝগড়া থেকে ওর বয় ফ্রেন্ড ওকে ছেড়ে চলে যায়। যাবার সময় বলে যায়-যদি স্বাস্থ্য কমাতে পারো তবেই ওর কাছে আসতে।

- হুম, দুঃখজনক

- মা, এখনো ভালোবাসা শরীর দেখে হয়, মন দেখে ভালোবাসা কয়জনে করে?

- সবাই তো এক না। এবারের যে ছেলে তোকে দেখতে এসেছে ওদের আগে থেকেই বলে দিয়েছি মেয়ে স্বাস্থ্যবতী। এরপরেও তোকে তারা দেখতে এসেছে

- হা হা, স্বাস্থ্যবতী! স্বাস্থ্যবতী আর ভোটকী দুইটার মধ্যে পার্থক্য আছে মা

- আর বেশি কথা বাড়াস না। রেডি হয়ে নে।



টুম্পা আয়নার সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। আজ সপ্তমবারের মত তাকে দেখতে এসেছে। এর আগে যতগুলো ছেলে ওরে দেখতে এসেছিল সবাই তাকে দেখে আর বিয়ের কথা শুরু করেনি। এর কারণ একটাই। কারণ সে মোটা। রাস্তায় চলাচল করলে সবাই ঐ লোকের বৌকে নিয়ে খোটা দিবে। দেখ দেখ লোকটার বউ কত মোটা। লোকটি তাকে বিয়ে করে অস্বস্তিতে পড়বে। কি দরকার একজনকে অস্বস্তিতে ফেলানো। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। সে ক্লাস নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু মা, এই কথাটি বুঝতে চায় না। মোটা মেয়েদের কত দুঃখ তা কেউ বুঝতে চায় না।



আদিকালের মেয়ে দেখার মত টুম্পা নীল রঙের একটি শাড়ি পরে আর চুলে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা গেঁথে নিচু চোখে প্রবেশ করলো।গরু দেখার মত এখন তাকেও অনেক ঘুরিয়ে ফিরে দেখা হবে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা এই পরিচয় তার মোটা শরীরের নিচে ঢাকা পড়ে যাবে। এটা কোন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না। সে মোটা এটাই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।টুম্পা এই ধরনের মেয়ে দেখাদেখি পছন্দ না করলেও তার মায়ের সুখের কথা চিন্তা করে তাকে এই অপছন্দের কাজটি করতে হয়। তাকে বিয়ে দিতে পারলেই মা যেন বেঁচে যায়। মাঝে মাঝে টুম্পা ভাবে-কোন এক রিকশাওয়ালাকে ধরে বিয়ে করে ফেলবে। তাকে বলবে তুমি শুধু আমার স্বামী হয়ে থাক। আমিই তোমাকে খাওয়াবো, পড়াবো।

কিন্তু সে এটা চায় না। সে চায় কেউ একজন তাকে ভালোবাসুক। তার সব কিছু মেনেই তাকে ভালোবাসুক। প্রতিদিন রাতে তাকে বলুক-ভালোবাসি তোমায়। তাকে নিয়ে জোছনা দেখুক। বৃষ্টিতে ভিজুক। তার এই দীর্ঘকায় শরীরে যে ছোট্ট শিশুমন বসবাস করে তাকে ভালোবাসুক। কিন্তু এমন ব্যক্তি সে পাবে কোথায়? আর কত অপেক্ষা করতে হবে।টুম্পার চোখ ছল ছল হয়ে উঠছে। সে তার কান্নাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে কিন্তু পারছে না। আর ঠিক তখনই সে চমকে উঠলো।

- ম্যাডাম, আসসালামু আলাইকুম

- কি ব্যপার অনিক! আপনি এখানে যে

- আমার বড় ভাই এর সাথে এসেছি। আর এসেই দেখি পাত্রী আপনি নিজেই

- আপনাদের সাথে আমার কালকে ক্লাস আছে না।

- জ্বী ম্যাডাম

- এসাইনমেন্ট করেছেন? কালকেই কিন্তু জমা নিব

- ম্যাডাম এখনো শেষ করতে পারিনি।

- আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার জন্য দুইদিন সময় বাড়িয়ে দিলাম



অনিক তাদের ভোটকী ম্যাডামকে এখানে দেখে খুব চমকে গেছে।সে এমন চমকে গিয়েছিল যেদিন তাদের প্রথম ক্লাস হয় সেদিন। তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস নেয় এই ভোটকী ম্যাডাম। সে অবশ্য এখন আর তাকে ভোটকী ম্যাডাম বলে ডাকে না। সে ডাকে টুম্পা ম্যাডাম।

তাদের প্রথম ক্লাসে টুম্পা ম্যাডাম যখন প্রবেশ করে তখন সবাই মনের অজান্তে হেসে ফেলেছিল। টুম্পা ম্যাডাম ডায়াসে উঠে বলেছিল যা হাসার এখনই হেসে নেন। কারণ আপনারা আর হাসার সুযোগ পাবেন না। আপনারা এই বিভাগের সপ্তম ব্যাচ। সপ্তম ব্যাচ দেখে আপনারা আবার ভাববেন না আপনারা লাকী সেভেন ব্যাচ! আপনাদের লাকী সেভেনকে আনলাকী করে দিবো। তবে ঠিকমত পড়াশোনা করলে, আমার কথামত চললে আপনারা লাকী সেভেন হয়ে উঠবেন।



ম্যাডামের কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল তারপরেও কিছু দুষ্টু ছেলে মিটিমিটি করে হাসছিল কারণ ম্যাডাম যখন কথা বলছিলেন তখন তার শরীরের চর্বি মেশানো চামড়া দুলছিল।ম্যাডামের উঁচু বুক খুব ছন্দময়ভাবে আকৃষ্ট করছিল। ম্যাডাম একটু মোটা হলেও খুবই আবেদনময়ী।তিনি প্রথম ক্লাসে তার শরীর নিয়ে চমৎকার একটি কথা বললেন। সেই কথা আজো অনিকের কানে বাজে। ম্যাডাম হোয়াইট বোর্ডে লিখলেন- ‘যা থাকবে অঙ্গে তা যাবে সঙ্গে’

আসলেই, আমাদের এত টাকা পয়সা, ধন দৌলত কিছুই আমাদের মৃত্যুর পর সাথে যাবে না। শরীরে যা থাকবে তাই আমাদের সাথে যাবে। তাহলে শরীর নিয়ে এত অবহেলা কেন?

এরপর ম্যাডাম আরেকটি সুন্দর ইংরেজি বাক্য বললেন- Packet is not important, product is important আমি মোটা এটা আমার প্যাকেট কিন্তু আমার জ্ঞান, আমার মেধা এটা আমার প্রোডাক্ট। আমি আমার প্রোডাক্টের গুনেই আজ বিশ্ববিয়ায়লয়ের শিক্ষিকা।তাই নিজের ভেতরটাকে আগে সুন্দর করতে হবে। আমি কালো না কদাকার না মোটা এগুলো কোন বিষয় না, আমার ভেতরে কি আছে সেটাই মুখ্য বিষয়।

এইসব সুন্দর কথা ক্লাস লেকচারে মানায়, বাস্তব দুনিয়ায় কেউ মানতে চায় না। তার প্রমাণ পেল তার বড় ভাই অমিত তার কানে কানে যখন বলল- তোদের ম্যাডাম দেখি অনেক মোটা। আমি নিজে মোটা হলে একটা কথা ছিল, একটা ভারসাম্য হত। তোদের ম্যাডামকে বিয়ে করলে আমাকে ফতুর হতে হবে। কত কেজি ভাত খায় কে জানে!

তার বড় ভাই এর কথায় সে একটু ভদ্রতার হাসি দিলেও তার মন গভীর বিষাদে ভড়ে উঠল। আসলেই মোটা মেয়েদের অনেক দুঃখ।



শিল্পী হায়দার হোসেনের একটি বিখ্যাত গান আছে-আমি ফাইসা গেছি মাইনকার চিপায়। অনিকের অবস্থা এখন ঠিক তাই হয়েছে।

অনিকরা দুই ভাই। তার বড় ভাই অমিতের বিয়ের বয়স পাড় হয়ে যাচ্ছে এখনো বিয়ের জন্য পাত্রী পছন্দ হচ্ছে না।অনেক জায়গায় এখন পর্যন্ত পাত্রী দেখা হয়ে গেছে। শেষ যে পাত্রী তারা দেখতে গিয়েছিল সেখানে যে তাদের বিভাগের ম্যাডাম পাত্রী হয়ে ধরা দিবে অনিক তা কল্পনাতেও আনতে পারে নাই।

অনিক মনে মনে খুশি হয়েছিল। ডিপার্টমেন্টের ম্যাডাম যদি তার ভাবী হয় তাহলে আর কি লাগে। সিজিপিএ ৩.৫০ এর উপরে থাকবে এটা নিশ্চিত। এমনিতেই তাদের বিভাগে ভালো সিজিপিএ উঠে না। টুম্পা ম্যাডামের সব ঠিক আছে শুধু সমস্যা হচ্ছে তার শরীরের ব্যাস নিয়ে। অমিত ভাই ইশারা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে ওনাকে বিয়ে করা যাবে না। তার উপর দায়িত্ব পড়েছে এই কথাটা ম্যাডামকে জানিয়ে দেয়ার। এখন এই কথাটি সে কিভাবে বলবে? আগামী পাঁচটি বছর ম্যাডামের মুখোমুখি হতে হবে। ওনার ক্লাসে বসে ক্লাস করতে হবে। সে লজ্জায় মুখ দেখাবে কি করে?



আচ্ছা মোটা মেয়েদের কি বিয়ে হয় না? বোবা-কানা তাদের বিয়ে কিভাবে হয়?আমি একজনকে বিয়ে করলাম এরপর বিয়ের পর সেতো মোটা হয়ে যেতে পারে এমনকি আমি নিজেই মোটা হয়ে যেতে পারি। এই ধরনের প্রশ্ন নিয়ে অনিক আর আগে না ভাবলেও সে এখন ভাবতে শুরু করেছে। সে এর আগে কত মোটা মেয়েকে উত্ত্যক্ত করেছে। তাদেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে আটার বস্তা, কোন গুদামের চাল খান বলে প্রশ্ন করেছে। টুম্পা ম্যাডামের পরিস্থিতি দেখে অনিকের নিজের কাছেই খারাপ লাগলো।



কলেজের নূরুন নাহার ম্যাডামের কথা ভুল। ম্যাডাম বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে মেয়ের মাও ছেলের পিছনে ছুটবে তার মেয়ের সাথে বিয়ে দেবার জন্য। টুম্পা ম্যাডাম তাদের বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। তিনিও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন এখন আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষিকা তাহলে ওনার সাথে ছেলের বিয়ে দেবার জন্য ছেলের মায়েরা কেন পিছু ছুটছে না? মেয়ে মোটা দেখে? সংসার করার জন্য শরীর মোটা না চিকন এটা কোন বিষয়?



অনিক তার বড় ভাই এর সাথে বেশ বন্ধুর মতই মিশে। সে বন্ধু সুলভ ভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল

- টুম্পা ম্যাডাম বেশ ভালো। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। অনেক ভালো পড়ান। ওনার উপস্থিত বুদ্ধি বেশ ভালো

- হুম বুঝলাম, তুই যে গুনের কথা বলছিস তা চাকরির জন্য দরকার বিয়ের জন্য দরকার নেই

- বিয়ে করার জন্য কি দেখতে সুন্দর হতে হয়?

- হুম, বিয়ের পর অনেকেই আমার বউকে দেখতে আসবে তখন যদি দেখে আমার বউ মোটা তখন তারা এটা নিয়ে হাসাহাসি করবে

- বউ কেমন সংসার করতে পারে সেটা মুখ্য তার দৈহিক গঠন কি কোন বড় বিষয়?মনে কর তুমি চিকনী চামেলী ধরনের মত কোন মেয়েকে বিয়ে করলে এরপর সে সারাদিন তোমার সাথে ঝগড়া করে তোমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল তাহলে সেই বউকে তুমি ভালো বলবে?

- মানুষ বিয়ে করে শুধু সংসার করার জন্য নয়

- তাহলে আর কিসের জন্য বিয়ে করে?

- সেটা তুই বুঝবি না। তুই ছোট

- ভাইয়া, আমি এখন ভার্সিটিতে পড়ি। আগের সেই ছোট অনিকটি নেই। তুমি বল

- আমি বুঝতে পারছি এই সম্বন্ধ ভেঙ্গে দেয়াতে তুই অনেক কষ্ট পাচ্ছিস। তুই হয়ত ম্যাডামের সামনে উপস্থিত হতে লজ্জা পাবি অনেক কিন্তু বিয়ে করার সময় এই ধরনের ভদ্রতার বিষয় চিন্তা করলে চলে না।

- তুমি আসল কথা বল। মানুষ বিয়ে করে আর কিসের জন্য?

- তুই আমার ভাই হলেও বন্ধুর মত। তোকে খুলেই বলি। মানুষের বিয়ের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে তার জৈবিক চাহিদা মেটানো। তোদের ম্যাডামকে দেখে আমার শরীরে আবেদন জেগে উঠবে না। আমি রাত কাটিয়ে মজা পাবো না। তাছাড়া আমার হাতে অপশন থাকতে আমি কেন ওনাকেই বেছে নিবো?



অনিক একটা গভীর নিশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে চলে গেল। দুনিয়া আসলেই অনেক কঠিন। সবাই ভোগের সময় ভালো জিনিসটাকেই বেছে নিতে চায়। আর ভালো জিনিসটাকে বাছতে সবাই মোড়ককেই গুরুত্ব দেয় মোড়কের ভেতরে পণ্যটাকে গুরুত্ব দেয় না।



পরের দিন অনিক খুব ভয়ে ভয়ে ক্লাসে ঢুকলো। তার ইচ্ছে করছিল ক্লাস মিস দিতে কিন্তু তাদের বিভাগে নতুন নিয়ম করেছে শতকরা ৭৫ ভাগের নিচে উপস্থিতি থাকলে পরীক্ষা দিতে দিবে না। এখন বাধ্য হয়ে অনিককে ক্লাস করতে যেতে হবে। টুম্পা ম্যাডাম যখন ক্লাসে প্রবেশ করলেন তখন অনিক ওনার দিকে একবার তাকিয়ে সাথেই সাথেই চোখ নামিয়ে ফেলল। অনিক দেখলো ম্যাডামের চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। রাতে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি। বিয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে এটা তিনি হয়ত আগেভাগেই বুঝতে পেরেছেন।



ম্যাডাম রোল কল করা শুরু করেছেন আর অনিক টুম্পা ম্যাডামের দুঃখ নিয়ে কল্পনা করতে লাগলো। ভারতীয় শিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী কত মোটা। মোটার কারণে গলার চামড়া ঝুলে পড়েছে। ওনার তো বিয়ে হয়েছে। বাপ্পী লাহিড়ী যদি মুখ ফুটে একবার বলে আমি আবার বিয়ে করতে চাই তাহলে মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়াবে। তাহলে মেয়েদের ক্ষেত্রে ছেলেরা কেন একই কাজ করবে না? অনিক চিন্তা করতে লাগলো বিশ্বে মোটা মোটা সেলিব্রেটি কারা আছেন। এদিকে টুম্পা ম্যাডাম নাম ধরে রোল কল করে যাচ্ছেন সেদিকে তার খেয়াল নেই।

মোরসালিন অনিক? মোরসালিন অনিক আছেন? এইতো পিছনের চেয়ারে বসা মোরসালিন অনিক আপনি কি চিন্তা করছেন?

ম্যাডামের কথায় অনিকের হুশ হল। সে তড়িঘড়ি করে ইয়েস ম্যাডাম বলে উঠল। এই বিভাগে এটেনড্যান্স পাওয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ৫ম ব্যাচে রুমি ম্যাডাম নাকি ১০০০ টাকা করে জরিমানা করেছে যাদের ৭৫ ভাগের নিচে উপস্থিতি আছে আর যাদের ৫০ ভাগের নিচে তাদের পরীক্ষাই নাকি নিবে না। এটা কোন কথা হইল? কোথায় ভার্সিটিতে পড়ে ছেলে মেয়েরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাস খেলবে, কার্জনের পুকুর পাড়ে বসে বাদাম খাবে। সেই সুযোগ আর রাখলো না।

- আপনি ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবেন। আপনার সাথে কথা আছে।

ম্যাডামের এই কথায় জহির কলম দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলতে লাগলো- কি ব্যাপার অনিক ভাইয়া, ভোটকী ম্যাডামকে পটানোর চেষ্টা করছো নাকি? কোন মেয়েকে পটাতে না পেরে শেষমেষ এই ভোটকী ম্যাডামকেই পছন্দ হল?

- চুপ কর শালা। তোকে না একবার বলেছি আমার সামনে ম্যাডামকে ভোটকী বলবি না, টুম্পা ম্যাডাম ডাকবি

- হা হা, টিএসসির সামনে কি যেন ঘটে ছিল? কে জানি বলেছিল কোন গুদামের চাল খান?

- বলেছিলাম তো কি হয়েছে। এখন থেকে আর বলবি না।

- কেন এই ভোটকী ম্যাডাম কি তোর গার্ল ফ্রেন্ড নাকি?

- হুম গার্ল ফ্রেন্ড। তোর কোন সমস্যা আছে?

- হা হা, তাহলে তুমিও মোটা হয়ে যাও মামা। মোটা না হলে ভোটকী ম্যাডাম তোমাকে পাত্তা দিবে না। বলবে করুণা করছো।

- আহা থামতো, ক্লাসে এত কথা বলছিস কেন? ক্লাস মনোযোগ দে।



অনিক ক্লাসে মনোযোগ দিল। ম্যাডাম খুব হাসিমুখে কথা বলেন। কথা বলার সময়ে ওনার মুখে হাসি ফুটে উঠে। ওনার সাথে কোন গোমরামুখি কথা বললে হাসতে বাধ্য। কারণ হাসি সংক্রামক। হাসিমুখি কোন মানুষের সাথে কথা বললে এমনিতেই মুখে হাসি চলে আসবে।গতকালকে ওনাকে দেখতে এসে পাত্র পক্ষ বিয়ের সম্বন্ধ করছে না এর কোন ছাপ ওনার মাঝে নেই। শুধু চোখের নিচে একটু কালো দাগ পড়েছে। এর কাহিনী শুধু সে জানলেও অন্য কেউ জানে না। ক্লাস শেষে ম্যাডাম তাকে দেখা করতে বলেছে। সে দেখা করে কিভাবে বলবে যে তার বড় ভাই ওনাকে বিয়েতে করতে রাজি না?



বিজনেস ফ্যাকাল্টির নতুন দশ তলা এমবিএ ভবনে টুম্পা ম্যাডামের রুম হচ্ছে আট তলায়।অনিক মৃদু কম্পন বুকে ম্যাডামের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিল।

- Yes come in.

অনিক দরজা সামান্য খুলে মাথা উকি দিতেই ম্যাডাম এবার বাংলায় বলে উঠলেন- ও অনিক, ভেতরে আসেন।

- আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম

- অলাইকুম আসসালাম। বসেন চেয়ারে।

অনিক এই প্রথম ম্যাডামের রুমে আসলো। ম্যাডামের রুমটি অনেক গোছানো। বুক শেলফে সারি সারি বই সাজানো। বোঝা যাচ্ছে ম্যাডাম অনেক পড়াশোনা করেন। বাপ্পী লাহিড়ী এর একটি ছবিও বুক শেলফের পাশে টাঙ্গানো। ওনার ছবি দেখে অনিক বেশ অবাক হল। ম্যাডাম বাপ্পী লাহিড়ীর অনেক ফ্যান নাকি?

- এই খামটি ধরুন

রুমের চারপাশে তাকানো বন্ধ করে অনিক ম্যাডামের হাতে ধরা খামের দিকে তাকালো। সে অবাক চোখে প্রশ্ন করলো- এই খামে কি ম্যাডাম?

- আপনার বড় ভাইয়ের দেয়া নজরানার ৫০০০ টাকা

- সেটা ফেরত দিচ্ছেন কেন?

- জানি বিয়ে হবে না। আর এই নজরানা নেয়া আমার কাছে খুব অপমানজনক লাগে। আম্মার চাপে নিতে হয়।

- কে বলেছে বিয়ে হবে না?

- আমি জানি। চেহারা দেখলেই বুঝি।

- আপনি কিছুই বুঝেন না। গতকালকে পাত্র আমার বড় ভাই ছিল না। পাত্র ছিলাম আমি নিজেই।

- হা হা। পাত্র আপনি নিজেই!

- হাসির কিছুই নেই। পাত্র ছিলাম আমি। বড় ভাই আমার সাথে ছিল শুধু। এখন পাত্রীকে আমার পছন্দ হয়েছে।

- আপনি কি ম্যাহুনা ছবির কাহিনী পেয়েছেন নাকি?

- কেন ছাত্র এর সাথে ম্যাডামের বিয়ে কি হতে পারে না?

- আপনার আর আমার বয়সের পার্থক্য জানেন?

- হুম, আপনি আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়। সেটা কোন বিষয় না। আমি একটু মোটা হয়ে গেলে আপনার সাথে মানানসই হবে। বাজারে আজকাল অনেক ওষুধ পাওয়া যায়- চিকন স্বাস্থ্য মোটা করুন

- আপনার এই লেইম কথা অনেক সহ্য করেছি। আপনি এখনই সোজা চলে যান। এই বিষয়ে আর একটি কথা বললে আপনাকে এক্সপেল করে দিব।ছাত্রজীবন শুধু শুধু নষ্ট করবেন না।

- আমাকে এক্সপেল করে দেন। আপত্তি নেই। তবুও আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।

- আপনি কি এখনই এই রুম থেকে বের হবেন? ভিসি স্যার এর কাছে অভিযোগ করলে কিন্তু আজীবনের জন্য বহিষ্কার হবেন।কোন কথা শুনতে চাই না। এখনই এখান থেকে বিদায় হোন।

- আমি চলে যাচ্ছি তবে বলে যাচ্ছি আপনি অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন। এরজন্য আপনাকে পস্তাতে হবে।

- উফ! আপনি ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম করেছেন। এখনই এখান থেকে বিদায় হোন। বিয়ে কি ছেলে হাতের মোয়া?



অনিক ম্যাডামের রুম থেকে বের হয়ে আসল। সে কেন এই কথাগুলো বলল সে নিজেই জানে না। শুধু জানে টুম্পা ম্যাডামকে যে করেই হোক বিয়ে করতে হবে।



ভালোবাসা কেমন জানি এক অদ্ভূত বিষয়। যে ম্যাডামকে আড়ালে একসময় ভোটকী ম্যাডাম বলে সম্বোধন করত, তার স্বামীর কেমন দুঃখ হবে এই নিয়ে গবেষণা করত আর আজ সেই ভোটকী ম্যাডামের স্বামী হবার বাসনা কাজ করছে অনিকের ভেতর। এর কারণ কি? এর নাম কি ভালোবাসা না মোহ?

অনিক নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করলো।কেন জানি ম্যাডামের সেই হাসি মাখা মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।ম্যাডাম তার চেয়ে ছয় বছরের বড়। এটা একটি সমস্যা। সমস্যা হতে যাবে কেন? ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে ইতিহাসের অনেক পুরুষ ব্যক্তির স্ত্রী তাদের চেয়ে বড় ছিল। আমাদের নবী মোহাম্মদ (সঃ) এর স্ত্রী ওনার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তাহলে সমস্যা কোথায়?

সমস্যা হচ্ছে ম্যাডামকে নিয়ে। তিনি ভাববেন ওনাকে করুণা করা হচ্ছে। ওনাকে আমি ভালোবাসি না। এই ভুল ওনার ভাঙ্গাতে হবে। এর জন্য কি করা যেতে পারে? অনিক কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। কারো সাথে যে বিষয়টি শেয়ার করবে সেই উপায় নেই। জহিরকে বললে আগে তাকে পচাবে। তার কাছ থেকে ভালো কোন বুদ্ধি খুঁজে পাওয়া যাবে না।



নিরবতাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। অনিক নিরবতারই আশ্রয় নিল। রাতে ঘুমাতে গেলে অনিকের শুধু টুম্পা ম্যাডামের কথা মনে পড়ত। ওনাকে কিভাবে ভালোবেসে জয় করা যায় তার চিন্তা করত সে। ওনাকে পাওয়ার জন্যই অনিক মোটা হওয়া শুরু করলো। ডাক্তার এর শরণাপন্ন হয়ে সে বিভিন্ন ওষুধ সেবন করা শুরু করলো কিন্তু তখনো সে ভালোবাসা প্রকাশে নিরবই থেকে গেল।



এদিকে অনিকের নিরবতা দেখে টুম্পা ধরে নিল অনিকের ঐটা মোহ ছিল। তার মোহ এখন কেটে গেছে। টুম্পা মনে মনে হাসত সেদিনের ঘটনা মনে করে। তার জীবনের এই প্রথম কোন ছেলে তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। ছেলের বয়স কোন বিষয় না। সে যদি তার ভালোবাসা প্রকাশ সুন্দরভাবে করত তাহলে হয়ত সে রাজি হয়ে যেত। টুম্পা তার একাকী জীবন নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

তবে একদিনের ঘটনা অনিকের ভালোবাসার জন্য ইতিবাচক হয়ে ধরা দিল। টুম্পা ধরে নিয়েছিল অনিকের ঐটা মোহ ছিল। সে অনিককে সেদিনই ক্ষমা করে দিয়েছে কিন্তু অনিক ক্লাসে আগের চেয়ে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে আর তার স্বাস্থ্যও দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। এই দেখে টুম্পা বলল

- কি অনিক সাহেব, এখনই এত স্বাস্থ্য বানালে হবে? এখন ভালোমত পড়াশোনা করতে হবে। চাকরিতে ঢোকার পর স্বাস্থ্যর দিকে নজর দিতে হবে।

এই কথায় অনিক লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেল। সে ভেবেছিল ম্যাডাম হয়ত্ত আর তার সাথে কথা বলবে না। ম্যাডামের কথায় সে বেশ অবাক হল। এরপর ম্যাডাম যে কথা বললেন তাতে ক্লাসের ছেলে মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠলো

- এমন স্বাস্থ্য বানাতে থাকলে সবাই আপনাকে ভোটকা বলে ডাকতে থাকবে।

ম্যাডামের কথা শেষ হতেই জহির কলম দিয়ে খোচা দিয়ে বলল- ভোটকা ভোটকী মিলেছে খুব ভালোই।

- মানে?

- তুই ভোটকা আর ম্যাডাম ভোটকী। ভোটকা ভোটকীর সংসার। হা হা হা

- তোকে না বলেছি আমার সামনে ম্যাডামকে ভোটকী ডাকতে না।

- ঠিক আছে আজ থেকে তোকে ভোটকা বলে ডাকবো।

ম্যাডামের সেদিনের উক্তিতে অনিক তার ভালোবাসা ফিরে পাবার আশার আলো খুঁজে পেয়েছিল। সে ভালোবাসার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। কিন্তু তার এই ভালোবাসার প্রস্তুতিতে একদিন বাঁধা এসে দাঁড়াল। একদিন টুম্পা ম্যাডাম ক্লাসে এসে জানালেন তিনি পিএইচডি করতে বিদেশ চলে যাবেন। এই কথা শুনে অনিকের চোখে পানি চলে আসল। তবে কি তার ভালোবাসা এখানেই শেষ?



ক্লাস শেষে অনিক সাহস করে ম্যাডামের রুমে কড়া নাড়ল। ম্যাডাম ভেতর থেকে ভেতরে আসুন বলার পরেও যখন অনিক ভেতরে ঢুকছিল না তখন ম্যাডামই এগিয়ে আসলেন দরজা খুলতে। দরজা খুলে তিনি অবাক।

- আরে অনিক যে, ভেতর আসছেন না কেন? ভেতরে আসুন

- আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে

- আমারও আপনার সাথে কিছু কথা আছে

- আগে আপনি বলুন

- না আগে আপনি বলুন

- আমি খেয়াল করছি আপনি ওষুধ সেবন করে মোটা হবার চেষ্টা করছেন। আর আপনার বন্ধুরা আমার আর আপনার নাম জড়িয়ে ছড়া বানিয়ে প্রচার করছে। এই কাজগুলো করবেন না।

- আমি এখনো আপনাকে চাই

- আপনার এই চাওয়াটা হাস্যকর। এই চাওয়াটা এসেছে আমার দুঃখ দেখে। এর নাম ভালোবাসা না।

- আপনি কি আমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চান?

- ভালোবাসার পরীক্ষা নেয়াটা আরও হাস্যকর। দেখুন অনিক, আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ করি। আপনাকেও আমি পছন্দ করি তবে সেটা ছাত্র হিসেবেই। এখন পছন্দ করলেই বা ভালোবাসলেই তাকে বিয়ে করতে হবে এর কোন মানে হয় না। আপনি আমার চেয়ে অনেক সুন্দরী, স্লিম ফিগার এর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেন।

- আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড় আমার এই নিরবতার ভাষাটা বুঝবেন। আসলে আপনি অবুঝ। আমাকে বুঝলেন না।

- আপনাকে বুঝতে হবে না। আপনি আপনার জীবন সুন্দরভাবে সাজান এটাই আমি চাই।

- আমি আপনাকে জোড় করবো না আমাকে বিয়ে করতে। আপনিও সাবালিকা আর আমিও সাবালক। আমি চাই আপনি নিজ থেকেই আমাকে বলুন চলো বিয়ে করে ফেলি।

- হা হা, আপনি আসলেই হাস্যকর। মোটা মেয়েকে বিয়ে করলে কি কি সমস্যা্য় পড়বেন আপনি জানেন? সবাই আপনাকে বলবে অনিকের বৌ ভোটকী।

- আমিও তো এখন ভোঁটকা। ভোটকা-ভোটকীর সংসার খুব জমবে ভালো।

- না না তা হয় না।

- আপনি আমার ম্যাডাম। আপনাকে জ্ঞান দেয়া আমার শোভা পায় না। তারপরেও ক্ষমা চেয়ে আপনাকে বলছি- পশ্চিম আফ্রিকার মরুদেশ মৌরিতানিয়া। এখানে কন্যা শিশু জন্মের পর পরেই শুরু হয়ে যায় মোটা তাজাকরণ প্রকল্প। তাদের ধারণা মেয়েরা যত মোটা হবে সে তত সুন্দরী। এমনকি বিবাহিত জীবনে মেয়ে সুখী কিনা তা মাপা হয় তাদের ওজন দিয়ে। সে হিসেবে বলা যায় আমি একজন সুন্দরীকে বিয়ে করতে যাচ্ছি আর আপনি বিয়ের পর সুখীই হবেন। আমরা একসাথে বৃষ্টিতে ভিজবো। একসাথে জোসনা দেখবো। আর আমার ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল আমার চেয়ে বয়সের বড় কোন মেয়েকে বিয়ে করা। আপনি আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারেন। আমার ধারণা এতে সংসার সুখের হবে।

- সংসার সুখের হবে কেন?

- কারণ স্ত্রী বয়সে বড় হলে সংসারে ঝগড়া কম হবে। ভুল বুঝাবুঝি কম হবে।

- হা হা, লুজ বলে ছয় মারতে চান

- হা হা। আপনার উপস্থিত বুদ্ধি অনেক ভালো। এরজন্য আপনাকে অনেক ভালো লাগে। টিএসসির সামনে আপনি যখন আমাদের সামনে আপনার ব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হলেন সেদিনই আপনাকে ভালো লেগে যায়। আপনার মত মেয়ে আমি খুবই কম দেখিছি। সেই ভালোলাগা সেদিন ছিল সুপ্ত আজ এখন এটা জাগ্রত।

- আপনি আমাকে ভালোবাসেন এর জন্য আমি ধন্য। তবে আমি হাস্যকর শোনালেও আপনার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চাই।

- আমি আপনার ক্লাস পরীক্ষায় কম নম্বর পেলেও আমার বিশ্বাস আপনার প্রেমের পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাবো।

- আমি তিন বছর পর বিদেশ থেকে দেশে আসবো। এই তিন বছর আপনি যদি অপেক্ষা করতে পারেন তাহলে বুঝবো এটা আপনার ভালোবাসা ছিল এটা কোন মোহ ছিল না। তবে এই তিন বছরে কোন সুন্দরী মেয়ে আপনার মনের জানালায় যদি উকি দেয় তবে তাকেই বিয়ে করে ফেলবেন। আমি এতে কষ্ট পাবো না।

- আমি আপনাকে মৌরিতানিয়ার ঘটনা বললাম না। আপনিই হচ্ছেন সবচেয়ে সুন্দরী। আমার আর সুন্দরী লাগবে না।

- হা হা

- পরীক্ষা দিতে রাজি হলাম। এবার আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?

- কি অনুরোধ?

- আমাকে তুমি করে ডাকবেন। আর আপনাকে আড়ালে তুমি ডাকবো তবে ক্লাসে বা সবার সামনে আপনিই ডাকবো।

- হা হা। আচ্ছা। তোমাকে আর আমাকে নিয়ে ক্লাসের ছেলে মেয়ে কি ছড়া বানিয়েছে? একটু শুনি

- শুনবে? হাসতে পারবে না কিন্তু

- আগে শুনি

- ভোটকা ভোটকী

লাগছে ফাইট

ভোটকায় কয় পারুম না,

ভোটকী কয় ছাড়ুম না।




হা হা হা। এমবিএ ভবনের আটতলার একটি কক্ষে দুটি মানুষের হাসির রোল বয়ে গেল তবেই এই হাসিতে ভালোবাসা ছিল। দুটি মনের এক হবার বাসনা ছিল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.