![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Poet।Prose writer।Playwright।Researcher।Geopolitical analyst। Theologian।Blogger & Online Activist
ছবিঃ সংগৃহীত
তাবলীগ জামাতকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে সৌদি আরব, পাশাপাশি জুম্মার নামাজে এই সংগঠনের ব্যাপারে ইমামদেরকে মুসল্লীদের সতর্ক করার আহ্বান সম্বলিত টুইট করেছে দেশটির ইসলাম বিষয়ক মন্ত্রী ড. আব্দুল লতিফ আল শেখ। অনেকের মতোই আমিও এই নিউজ দেখে একটা বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছিলাম। একটা দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামের বিভিন্ন মাজহাব, মানহাজ, প্রচলিত বিভিন্ন দল-উপদল, সংগঠন সম্পর্কে স্টাডি করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এর ফলে তাবলীগ বিষয়েও স্টাডি করা হয়েছে। চলুন দেখে নেয়া যাক এই সংগঠন ও এর কার্যক্রমের ব্যাপারে।
তাবলীগ জামাত কি?
তাবলীগ জামায়াত একটি উর্দু শব্দ যার অর্থ ‘প্রচারকদের সমাজ’। আরব বিশ্বে এই সংঘঠনটি ‘আহবাব’ নামেও পরিচিত যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় বন্ধুগণ। এটি একটি সুন্নী মুসলিম অরাজনৈতিক সংগঠন বা আন্দোলন যার মূল লক্ষ্য হলো সমাজের সাধারণ জনগণের মধ্যে ইসলাম বিষয়ে মৌলিক প্রয়োজনীয় ধারণাগুলো দেয়া ও নন-প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদেরকে প্র্যাক্টিসিং মুসলিমে পরিণত করা। পাশাপাশি “তাজকিয়াতুন নাফস” বা আত্মশুদ্ধির দিকে পরিচালিত করা, যাতে করে তারা পরিশুদ্ধ মানুষে পরিণত হতে পারে। মানুষকে দুনিয়ার প্রতি কম এই সংগঠনটি মূলত হানাফি মাজহাব এর অনুসারী দেওবন্দি মানহাজ অনুসরণ করে থাকে। তারা নিজেদের কার্যক্রম বা আলাপ-আলোচনাকে কঠোরভাবে রাজনীতি থেকে দূরে রাখে ও ব্যাক্তিগত জীবনে ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতির চর্চাকেই প্রোমোট করে থাকে। এক কথায় বলা যায় নিরীহ গোছের একটি অরাজনৈতিক আত্মশুদ্ধিমূলক সংগঠন।
এই সংগঠনটি মূলত মুহাম্মাদ ইলিয়াস কান্ধলভী নামক একজন দেওবন্দি ঘরানার ইসলামি পন্ডিতের হাত ধরে ১৯২৬ সালে যাত্রা শুরু করে। যাত্রার পর থেকেই নিতান্তই নিরীহ গোছের সংগঠনটি অরাজনৈতিকভাবে নন-প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের মাঝে ব্যাক্তিজীবনে ইসলাম চর্চার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই সংঘঠনটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় সক্রিয় ও প্রায় ১৮০ – ২০০টি দেশে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। শান্তিপূর্ণ ভাবে দ্বীন ইসলামের বানী ছড়িয়ে দেয়া ও ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরা ও আর্ত-মানবতার সেবার ক্ষেত্রে সংগঠনটির জুড়ি নেই।
সৌদি সরকার কেনো সংগঠনটির উপর ক্ষিপ্ত?
বর্তমানে বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজ এর সময় থেকে, বিশেষ করে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ইবনে আব্দুল আজিজের ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণের পর আমরা সৌদি আরবে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পেয়েছি। মূলত সৌদি আরবে বর্তমান বাদশা নামে মাত্র প্রধাণ। পেছনে থেকে আসল কলকাঠি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানই নেড়ে থাকেন।
মূলত সৌদি রাজপরিবারের নিয়ম ভেঙ্গে এক প্রকার জোরপূর্বকভাবে নিজ চাচাতো ভাই মোহাম্মদ বিন নায়েফ’কে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করে ক্ষমতায় বসেন এই যুবরাজ। ব্যাপক ভাবে আমেরিকা ও ইজরায়েল প্রভাবিত এই যুবরাজ ক্ষমতায় আসার পর তার ভিশন-২০৩০ প্রকাশিত করেন। এই ভিশনটি দেখলে যে কেউই একমত হবেন যে, এই ভিশনটির মাধ্যমে মূলত আধুনিকীকরণের নামে আরবদের যে নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্র্যাক্টিস আছে, তাকে পাশ কাটিয়ে মূলত যুবরাজ এক প্রকার জোর পূর্বক পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এর জন্য অবশ্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
এই প্রজেক্টের অংশ হিসেবে প্রথমেই ক্ষমতায় এসে তার পথের কাটা হতে পারেন এমন সালাফি ঘরানার আপোষহীন ইসলামিক স্কলারদের একেরপর এক গ্রেফতার করা হয়। এরপর সৌদি রাজতন্ত্র ও আমেরিকা-ইজরায়েলের অনুগত একদল কথিত সালাফি স্কলারদের নিয়োগ দেয়া হয়, যারা আমেরিকা ইজরায়েলের প্রতি অনুগত থাকবে ও সৌদি রাজতন্ত্রের যেকোনো কার্যক্রম, এবার সেটা ভালো হোক বা মন্দ, একে বৈধতা দানের জন্য ফতোয়া দিবে। মূলত রাবী আল-মাদখালির অনুসারী হওয়ার কারণে এরা “মাদখালী” নামে পরিচিত।
এরপর বিনোদনের নামে পাশ্চাত্যের ধাঁচে কথিত ‘হালাল নাইটক্লাব’ চালু করা হয়। এরপর রিয়াদ সামিটের নামে এক বছর ব্যাপী কনসার্ট, নাচ-গান, বেলিড্যান্স সহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। মোট কথা পাশ্চাত্যের ভোগবাদী সভ্যতাকে প্রোমোট করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সবই মোহাম্মদ বিন সালমান করেছেন।
এখন ভোগবাদ ও পূঁজিবাদের প্রমোটের পথে যারা যারা বাঁধা হতে পারে, সেসব ব্যাক্তি, গোষ্ঠী বা সংগঠনকে তারা হয় গ্রেফতারের আওতায় এনেছে, না হয় নিষিদ্ধ করেছে। এই নিষিদ্ধের তালিকায় অবশেষে যুক্ত হলো তাবলিগ জামাতের মতো নিতান্তই নিরীহ গোছের অরাজনৈতিক সংগঠন। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, কিভাবে তাবলিগ জামাত সৌদি প্রজেক্টের বিরুদ্ধে? তারা তো এসব বিষয়ে মাথা ঘামায় না, তারা তো ব্যাক্তি জীবনে ইসলামের প্র্যাক্টিস নিয়ে থাকে।
হ্যা, আপনার কথা সত্য। কিন্তু তাবলিগের প্র্যাক্টিসের দিকে যদি আপনি দেখেন, তাহলে দেখবেন যে, তারা মানুষকে পরিশুদ্ধ হওয়ার দিকে ডাকে। তারা মানুষকে ভোগবিলাষ পরিত্যাগ করে স্বাভাবিক মিনিমালিস্ট জীবন-যাপনের দিকে আহ্বান করে। অর্থাৎ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ঠিক যতোটুকু প্রয়োজন ঠিক ততোটুকুই অর্জনের জন্য তাগিদ দেয় তারা। যেটা সুস্পষ্টভাবে মোহাম্মদ বিন সালমান যে ভোগবাদের প্রসার ঘটাতে চাচ্ছেন আরব উপদ্বীপে এর সাথে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে তাবলিগ জামাত মানুষকে ব্যাক্তি জীবনে ইসলামী সংস্কৃতির বাস্তবায়নের দিকে ডাকে, যেটা মোহাম্মদ বিন সালমানদের পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রসার ও আরব উপদ্বীপে গডলেস সোসাইটির বাস্তবায়নের পথে প্রধাণ বাঁধা।
তাই অন্যান্য সংগঠনের মতো “শিরক-বেদাত” এর ছুঁতো দিয়ে তাবলিগকে কৌশলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এখন অনেকেরা বলবেন যে, তাবলিগে অনেক ভুল আছে। আমিও মানছি ভুল আছে। তা সেই ভুলগুলোকে চাইলে সৌদি স্কলাররা তাবলিগের স্কলারদের সাথে একাডেমিক ডিসকাশনের মাধ্যমে যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু তারা সেই পথে না হেটে হাটলেন নিষিদ্ধ করার পথে। যেটা সম্পূর্ণরূপে আন্তর্জাতিক আইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানুষের ধর্মপালনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের আওতায় পড়ে। না হয় এমন একটা নিরীহ সংগঠনকে এভাবে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার কোনো মানে দেখছিনা। আমি নিজে ব্যাক্তিগতভাবে তাবলিগ করি না। তবে তাবলিগের প্যাক্টিসকে বাঁধা দেয়া হোক তাও আমি চাই না। মূলত সব দল-মত-নির্বিশেষে সব ঘরানার মুসলিমরা স্বাধীনভাবে তাদের মানহাজ অনুসরণ করে চলার স্বাধীনতাটুকু পাক এটাই আমার চাওয়া।
©somewhere in net ltd.