নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মামুনের ব্লগ

আল মামুন খান

একজন অতি সাধারণ মানুষ যে নিজের মনের আনন্দে লিখতে ভালোবাসে।

আল মামুন খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভালবাসার পনের শ' সেকেন্ড -১ম পর্ব

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:২০

সিনেমা হলটি নবীনগর থেকে ঢাকা যেতে রাস্তার বামে পড়েছে।

'সেনা অডিটোরিয়াম'। বিশাল ডিসপ্লেতে ছবির নাম আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর বিশাল ছবি দেখা যাচ্ছে। ছবির নাম 'চোরের রাণী'। আর 'আসিতেছে' শীর্ষক পোষ্টারে আছে ' ডেয়ারিং লাভার'।

সবে ছ'টার শো দেড় ঘন্টা মত শেষ হয়েছে। এখন সাড়ে সাত বাজে। শো শেষ হতে এখনো এক ঘন্টা বাকি। সিনেমা হলটির সাথেই একটি রেস্তোরা রয়েছে। একবার ভাবে সেখানে কি ঢু মেরে দেখবে নাকি? যদি কাউকে পাওয়া যায়। ভালবাসার অন্তত একজন মানুষ খুবই দরকার ওর।

ও হল...

কি পরিচয় দেবে নিজের? মানুষ বললেই হবে, না কি তাঁর বুকের সামনের স্ফীত অংশ দুটো থাকায় মেয়ে মানুষ বলবে? তাতেও তাঁর পরিচয় সম্পুর্ণ হবে না। তবে থাক। আচ্ছা নাম বলবে কি... নাম তো কতগুলোই হয়েছে ওর। কোনটা বলবে? রেখা, ময়না, কাজল নাকি শিরিন? নামের বড়াই করো নাকো নাম দিয়ে কি হয়, নামের মাঝে পাবে নাকো সবার পরিচয়।

চিকন লাল পাড়ের সাদা শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা ব্লাউজ। হাতের লাল চুড়ির সাথে ম্যাচ করা টিপ... ঠোটটি ও রক্ত লাল। হাঁটার সাথে সাথে চুড়ির ঝনঝন শব্দে পথচারীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। আকর্ষণ করার জন্যই তো এগুলো পড়া। তবে ওর কমনীয় মুখে জোড়া ভ্রু'র নীচে কাজল দেয়া কালো চোখ... সেখানে দর্শকের প্রতি যদি শুধু মাত্র মদির আহ্বানটুকু না থাকত- তবে এক পাশে ছেড়ে দেয়া এলো চুলে এখন ওকে যা লাগছে, তা যে কোনো পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে যথেষ্ট।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে নবীনগর বাস-কাউন্টারগুলোর দিকে হেঁটে যেতে থাকে মেয়েটি। ওভার ব্রীজের আশেপাশে প্রায়ই ভালবাসার মানুষ পাওয়া যায়। যারা টাকা দিয়ে ওর কাছ থেকে ভালোবাসা কিনে নেয়।

হ্যা, সে একজন বারবনিতা!

লেখকদের বইয়ে মানুষভেদে ওদের নামও ভিন্ন হয়ে থাকে। সে পতিতা থেকে শুরু করে দেহপসারিনী, বেশ্যা, মক্ষীরানী ইত্যাদি নামে ভূষিত হয়। তবে ছেলে-ছোকড়ারা নিজেদের ভিতর কথা বলার সময় এমন একটি শব্দে ওকে সম্বোধন করে, তখন নিজের কাছে খুবই খারাপ লাগে। জগতের সব চেয়ে মধুর শব্দটির সাথে আর একটি বর্ণ লাগিয়ে সেকি হৃদয়চেরা অনুভূতি এনে দেয় ওরা!

ওভারব্রীজের ফুটপাতের ফলের দোকানের সামনে দাঁড়াতে হল বেশ খানিকটা সময়। অনেকগুলো অনুসন্ধানী চোখ ওকে দেখে গেলো... ওর সারাটা দেহকে চাটলো মনে হল ওর কাছে। এখন এসব অভ্যেস হয়ে গেছে। তারপরও নিজের ভিতরে কোথায় যেন একটা অতৃপ্তি... একটু রুচিবোধের লঙ্ঘন সে টের পায়।

রুচিবোধ! তাও ওর মতো মেয়ে মানুষের? তাঁর আবার লঙ্ঘন? প্রচন্ড হাসি পায় ওর। একটু শব্দ করে হেসেও ফেলে। পাশ দিয়ে যাওয়া দুজন যুবক ওর হাসির শব্দে ওর দিকে তাকায়। প্রথমে একটু চমকায়... ফিরে যায় এবং দ্বিতীয়বার আবার তাকায়... এবং চিনে ফেলে।আসলে ওদেরকে সহজেই চিনে ফেলা যায়। প্রকৃতি-ই এই সহজে চিনিয়ে দেবার কাজটি করে থাকে। না হলে তো ওরা না খেয়ে মরে ভুত হতো এতোদিনে।ছেলেটি হেঁটে যেতে যেতে অন্যজনকে বলে, ' দ্যাখ, মাগি একা একা হাসে।' অন্যজন এটা শুনে খিক খিক করে হাসে এবং ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ' কি যাইবি নাকি?' তাঁরা থামে না। এক সাথে আরো মজার কিছু একটা বলতে বলতে চলে যায়।

ইচ্ছে করলে একটা প্রচন্ড খারাপ ভাষায় ছেলে দুটোকে গালি দিতে পারত... তাতে হয়ত মনের ভিতরে সৃষ্ট রাগ...ক্ষোভের সাময়িক উপশম হতো। কিন্তু দিন-রাত ২৪ ঘন্টা হৃদয়ে যে ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে... সে এবং তাঁর মত আরো অনেক মেয়ে; তাঁদের এটা তো নিত্যকার পাওনা। সমাজের কাছ থেকে পাওয়া উপহার। গিফট ফ্রম দ্য সিভিল সোসাইটি। না হলে তাদেরকে ২ নাম্বার বলে উল্লেখ করত না কেউ। তাঁরা তো সভ্য সমাজের চোখে এ দেশের দ্বিতীয় সারির নাগরিক। যাদেরকে রাখা হয়েছে ১ম সারির মানুষের বিশেষ করে পুরুষদেরকে মনোরঞ্জন করার জন্য।

আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। ফিরে যাবে নাকি ভাবে একবার। কিন্তু টাকাও তো প্রয়োজন। হাত একেবারে খালি। ঘাটে ঘাটে দিতে হবে অনেক টাকা। টাকার ক্ষাক্কষের মতো একটা জটিল সিস্টেম ধাপে ধাপে হা করে আছে ওর... ওদের দিকে। ওর এভাবে ওপেন 'ভালবাসার মানুষ' খোঁজায় টাকা পেলে কেউই বাঁধা দেবে না। নবীনগর থেকে সেই শ্রীপুর সিনেমা হলটি পর্যন্ত ওর এরিয়া। এই দু'টি সিনেমা হল এবং তাঁর আশে পাশে ওরা চিহ্নিত কয়েকজন সেবাদাসী রয়েছে।

আচ্ছা ওদেরকে হেরেমের বাসিন্দা বললে কেমন হয়? রাজা-বাদশাহরা তো শুনেছে এভাবে হেরেমে যুবতী মেয়েদেরকে ভোগ করার জন্য রেখে দেয়। সেখানেও কি ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয় ওনাদের? দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, ইস! যদি কোনোভাবে হেরেমের বাসিন্দা হতে পারত!! পরক্ষণেই ভাবে, 'আরে! আমার দেশটাই তো একটা প্রকান্ড হেরেম। যেখানে আমিও একজন সেবাদাসী... তবে আমি স্বাধীন। আর মরুর ওরা পরাধীন।'

এক ভ্রাম্যমান পান-সিগ্রেটওয়ালার কাছ থেকে জর্দা দিয়ে একটা পান কিনে। এই লোকটাও ওকে চেনে। টুকটাক কথা-বার্তা বলে। একটা সিগ্রেট টানবে কিনা ওকে জিজ্ঞেস করলে কৃত্তিম চোখ পাকিয়ে ওকে ভয় দেখায়। সে-ও ভয় পাবার মিথ্যে অভিনয় করে। এই সামান্য সময়ে দু'জন ভিন্ন পেশার মানুষের ভিতরের এই খুনসুটি টুকু আসলেই সুপার্ব! কারন এ যেন সম্পর্কহীনতার মাঝে সম্পর্কের পায়ে পায়ে কাছে আসা। কতগুলো মুখোশধারী মানুষের ভিতরে মুখোশহীন চিরচেনা অবয়ব! সবাই তো ওর কাছে আসে দেহটাকে খুবলে ছিন্ন-ভিন্ন করবে বলে। সেদিক থেকে পান-বিড়ি ওয়ালা নিম্নশ্রেনীর পশুর মত কাছে আসলেও সেখানে মমতা রয়েছে... রয়েছে নিজেদের ভিতরে একই শ্রেনীবোধ।

জাতীয় স্মৃতিসৌধের মেইন গেটের সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। ওর পাশ দিয়ে ছেলে-মেয়েরা একে অপরের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কি সুন্দরই না লাগছে দেখতে! মেয়েটির খোঁপায় গোঁজা ফুল... ছেলেটির হাতে কয়েকটি ব্রেসলেট। কি স্বাভাবিক ভাবেই না কথা বলছে, একজন অপরজনের চোখে চোখে তাকিয়ে হাসছে... দু'একটা কি কথায় যেন মেয়েটি হেসে গড়িয়ে ছেলেটির গায়ে পড়ছে।

খুব সুন্দর একটি দৃশ্য! সে অপলক চেয়ে থাকে... ওর দৃষ্টির সামনে দিয়ে দু'জনের সুখী জুটিটি অদৃশ্য হয়ে যায়... অনেকদূর পর্যন্ত সে চেয়ে থাকে। স্মৃতির পর্দায় নবীনগর বিস্মৃত হয়! স্মৃতিসৌধ... ওভারব্রীজ...সেনা অডিটোরিয়াম সব কিছু, এমনকি সে নিজেও হারিয়ে যায়। একটি গ্রাম দেখা দেয়... দুপাশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ নিয়ে ছোট্ট লম্বা একটি পায়ে চলা পথ! আকাশে কালো মেঘ! দু'পাশে বেনী করা চুল নিয়ে এক কিশোরির দ্রুত ছুটে চলা...এরপরের দৃশ্যগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে... নিজের চোখের জল-ই যে এর জন্য দায়ী সেটা বুঝতে পারে না। সে যে এইমাত্র নিজেকেও বিস্মৃত হয়েছে!!

জাতীয় স্মৃতিসৌধের একেবারে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে একজন বারবনিতা নিজের বিগত জীবনে ফিরে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাঁর চোখের জলে মুখের প্রসাধনী ধুয়ে মুছে যায়। সে পরিণত হয় এক সাধারন নারীতে। প্রতিটি বারবনিতা-ই তো প্রথমে একজন নারী। ধীরে ধীরে আমরা-ই তাঁকে পতিত এই সমাজে একজন পতিতা হয়ে উঠতে বাধ্য করি।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.