![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটা নির্দিষ্ট ভালবাসা ছিল,তা হারিয়ে ফেলেছি।এখন আর কোন কিছুর প্রতি ভালবাসা মনে জাগে না।
এক গ্রামে টুইন্না কইয়া এক পোলা আছিলো। বড্ড দুরন্ত আছিলো টুইন্না, সারাদিন দুষ্টামি করতো। কখনো এর গাছের আম পাড়ে, কখনো তার গাছের লিচু খায়। সবসময় একটা না একটা কিছুতে তার দুষ্টামি আছেই। টুইন্নার জ্বালায় তার বাপ মাও অতিষ্ঠ। পড়াশুনায় মন নাই। পাঠশালায় গেল কি গেল না, সারাদিন হয়তো দেখা যাইবো খেলার মাঠে, নয়তো কারো বাড়ি গিয়া ফলমূল চুরি, এই-ই চলে। লোকজন আগে বাপ মারে নালিশ করতো, এখন নিজেরাই লাঠি নিয়া দৌড়ায়।
গ্রামের উপর দিয়া যে রাস্তাটা গেছে, সেই রাস্তার ধারে একটা কামরাঙ্গার গাছ আছিলো। টুইন্না প্রায়ই পড়া ফাঁকি দিয়া এই গাছে উইঠা বইসা থাকতো। একদিন বইসা বইসা পা দুলায়া সে লবণ মরিচ দিয়া কামরাঙ্গা খাইতাসে, হঠাৎ দেখে নীচে দিয়া একটা বুড়ি কুজা মাইরা লাঠিতে ভর দিয়া যায়, পিঠে বড় একটা ছালা ধরা। টুইন্যা উপর থিকা কইয়া উঠলো,
"তোর ছালায় কিরে বুড়ি!"
টুইন্যার কথায় বুড়ি থামে, উপরে তাকায়া হাইসা কয়,
"কেডারে .. অ-মা! অ-মা! গাছে উঢি কিয়া-রে খাস?"
"আমি টুইন্না। কারফাঙ্গা খাইয়ের, খাবি নে?"
"নারে ভাই, আমার দাঁত ব্যাক-গুন পড়ি গেছে। টক খাইতামও পারি না, কামড় দিলে দাঁত শিনশিনায়। "
কইয়া বুড়ি গাছের তলায় নিজের ছালাটা রাইখা আস্তে আস্তে পাশে বসে। একটা হাই তুইলা আবার কয়,
"আর চলতাম পারি নারে ভাই, অনেক তিয়াস লাগছে। আমারে একটু জল খাওয়াইতে পারস?"
"জল খাবি নে? খাড়া -" কইয়া ঝুপ্পুড়-ঝাপ্পুড় কইরা লাফাইয়া নামে টুইন্না। টুইন্না বান্দর হইলে কি হইবো, এমনে মনটা ভাল আছিলো। কারো কিছুতে দরকার হইলে ঠিকই যায়। টুইন্না দৌড়াইয়া গিয়া একটা মাটির ভান্ডে কইরা পুকুরের থিকা জল নিয়া বুড়িরে দেয়। বুড়ি জল খাইয়া, টুইন্নার গায়ে আদর কইরা হাত বুলায়া দিতে দিতে কয়,
"পোলাডা অনেক ভাল তুই.. এই গেরামে থাকস নে?"
"হ.. বুড়ি তোর ছালায় কিরে অইডা? লড়ে ক্যা? আমারে দেখাবি?"
বুড়ি একটু হাসে, কয়, "দেখবি নে? দেখ তাইলে-" কইয়া ছালার মুখ একটু ফাঁক করে। কিন্তু টুইন্না ভাল কইরা দেখতে পারে না। অনেকক্ষণ ধইরাই তার অনেক আগ্রহ ছালাটা নিয়া। টুইন্না আরেকটু ভাল কইরা দেখার লেইগা যেই ছালায় উঁকি মারে, অমনি বুড়ি টুইন্নারে ধইরা ছালায় ভইরা, ছালার মু্খে শক্ত কইরা একটা হড়কা মাইরাই দেয় দৌড়! বুড়ির আসলে এই কুজা মাইরা হাঁটাহুটি, টুইন্নারে দিয়া জল নিয়া আহন সবই ভান, গায়ে আসলে অসুরের মত জোর। হঠাৎ ধুড়মুড় কইরা ছালায় পইড়া টুইন্না কোন তালগোল পায় না। একটু পরেই বুঝে যে ছালায় একা না, তার মত আরেকজন আছে ছালায় কিন্তু তার হাত পা বান্ধা। টুইন্না ডরাইয়া চিল্লানি শুরু করে, ছালার মধ্যে থাইকাই হাত পা ছুড়াছুড়ি করতে থাকে, ইচ্ছামত লাত্থি ঘুষি চালায়। বুড়ি প্রথমে একটা দাবড়ানি দেয়, পরে তাড়াতাড়ি কইরা একটা জায়গায় থাইমা চারদিক দেখে। তারপর ছালার মুখ খুইলা শক্ত হাতে টুইন্নার ঘেডি ধইরা মুখ আর হাত পা বাইন্ধা আবার ছালায় ভরে। কথা কইবো কী, একটুও লড়তে পারে না টুইন্না। এইবার বুড়ি আর দৌড়ায় না। তার ছালার ভিত্রে লড়াচড়া আগের চাইতে বাইড়া যায়। বুড়ি মুখে একটা হাসি ঝুলাইয়া হেইলা দুইলা রাস্তা দিয়া যাইতে থাকে।
বিরাট রাস্তাটা যেখানে দুইভাগে ভাগ হইয়া গেছে, বামদিকের রাস্তাটা ধইরা বনের দিকে নাইমা আসে বুড়ি। অনেক জায়াগায় অনেক বান্দ্রামি করছে টুইন্না, কিন্তু গ্রাম থিকা এতদূরে কখনো আসে নাই আগে। ছালার ভিত্রে টুইন্না আর সেই পোলা আবছা আবছা দেখে সবকিছু। কাছেই একটা বড় দিঘী, বুড়ি আস্তে আস্তে দিঘীর ঢালে নামে। ঘাটের নরম প্যাকে একটা কলাগাছের ভেলা একটা লম্বা লগিতে বান্ধা আছিলো, সেইটায় চইড়া বুড়ি লগি ছুটায়া ভেলা ঠেইলা নিয়া যাইতে থাকে ঐপারে।
ভেলা আস্তে আস্তে দিঘীর পারের কাছে আসলে ছালার ফাঁক দিয়া টুইন্না দেখে, পারের একটু ভিত্রে একটা ভাঙ্গাচুরা বাড়ি। বুড়িরে আইতে দেইখাই একটা মাইয়া লাফাইতে লাফাইতে আইতে থাকে। বুড়ি কয়, "বউ, ছালাটা ধর-ছে। আইজকা দুইডারে ধরসি।"
"কস কি বুড়ি! দুইডা ধরসস! কী মজা!.." কইয়া হাততালি দিতে থাকে মাইয়াটা। টুইন্না কথাবার্তায় বুঝে, এই মাইয়া বুড়ির পোলার বঊ।
বুড়ি আর বুড়ির বউ দুইজনে ছালা খুইল্লা তাগোরে বাইর কইরা আনে। এতক্ষণে টুইন্না তার লগের পোলাটারে দেখতে পায়। আরে এইটা তো পূবপাড়ার বলাই! বলাইও টুইন্নারে দেইখা কী জানি কইতে চায়, কিন্তু দুইজনেরই মুখ বান্ধা, কিছু কইতে পারে না। হঠাৎ বউ জিগায়, "মা কোনটারে রান্ধুম ক।"
এই কথা শুইনা শিউরাইয়া উঠে টুইন্না, কয় কী! খাইবো মানে?
বুড়ি বলাইয়ের দিকে তাকায়া কয়, "মোটাটারেই কাট এহন, অনেক ক্ষুদা লাগিয়ের। আর এইটারে পিছনের ঘরে নিয়ারে বাঁধি থো।"
এই কথা শুইনা বউয়ে এক হাতে দাও নিয়া হাসি হাসি মুখে বলাইরে টানতে টানতে লইয়া যায় ঘরের পিছে। বলাই গুঙ্গাইতে থাকে কিন্তু মুখ বান্ধা থাকায় কিছু কইতে পারে না। টুইন্না বান্ধা অবস্থায় খালি তড়পায়, তার চোখ বাইয়া জল পড়ে। একটু পরে ঘরের পিছ থিকা যখন বুবা চিৎকার আর দাওয়ের কোপের শব্দ আসে, টুইন্না বমি কইরা দেয় মুখ বান্ধা অবস্থাতেই। অজ্ঞান হইয়া পইড়া থাকে ঘরের কোনে।
টুইন্নার যখন জ্ঞান ফিরে তখন সন্ধ্যা হইয়া গেসে, দেখে বুড়ি আর বুড়ির বউয়ে মাটিতে বইসা কচমচ কইরা খাইতাসে কি জানি। টুইন্নারে দেইখা বউয়ে হাসে, "খাবি নে? খিদা লাগসে নে?"। টুইন্না আবারও ফিট যায়। সেইরাত্রে আর জ্ঞান আসে না টুইন্নার।
এমনে কইরা দুইদিন ভইরা বলাইরে খায় বুড়ি আর বুড়ির বউ। টুইন্না বুঝে, এডি এক ধরনের ডাইনী। এডির গল্পই তার ঠাকুরমা তারে কইসে অনেক গল্পে। এডি মানুষ খায়। টুইন্না এই কয়দিন কিছুই কইতে পারে না, বোবার মত পইড়া থাকে হাত পা বান্ধা অবস্থায় ঘরের কোনে। সেই অবস্থাই হাগে, মুতে। দুইবেলা তার লেইগা ফলমূল আইনা দেয় বউটা। হাত মুখের বান্ধন খুইলা শুধু পা বাইন্ধা রাখে শিকল দিয়া। টুইন্না খাওন ছুইয়াও দেখে না। টুইন্না খালি পালানের পথ খুঁজে।
পরদিন টুইন্না আর পারে না। ক্ষিদা লাগে অনেক। হাতের কাছে ফলগুলি লইয়া খায় গোগ্রাসে। বুড়ি ছালা নিয়া বাইরাইতে আছিলো ঘর থিকা, যাওনের আগে বউরে কয়,
"বউ শুন, আই বাইরে যাইয়ের। পাই তো আরেকটা নি আসুম। আইজকা এইডারে কাট। ভাল করি পাক কর, বুঝলি। " - কইয়া হাটা দেয় বুড়ি।
বউ হাইসা টুইন্নার কাছে আসে, কয়, - "কিরে খাইসত নে? বাব্বা, একদিন না খাই কেমনে থাকস রে পোলা?"
টুইন্না বউটারে দেখে মরা চোখে, প্রথমবারের মত মুখ খুলে, কয়, "আর আছে নি? ম্যালা ক্ষিদা লাগসে"।
"মাগ্গো-মা! তোর দাঁতগুন কি লাল রে? কেমনে করলি রে? ক না! ক না!" টুইন্নারে কথা কইতে দেইখা কইয়া উঠে বউ।
টুইন্নার পান খাওনের অভ্যাস। বড়গো লুইকাইয়া পান খায়, এর লেইগা মা বাপের কাছে মাইরও খাইছে। একে খায় পান, আবার দাঁত মাজে না। টুইন্না হাসে, তার দাগপড়া লাল লাল দাঁত বাইরাইয়া পড়ে। টুইন্না কয়, "তুইও দাঁত লাল করবি নে?"
"হ হ! আমিও লাল করতাম চাই! কী সুন্দর! কেমনে করুম? ক না, ক না!" ঘ্যানাইতে থাকে বউটা।
"এইটা করতে হইলে তো একটু ব্যাদনা হইবো, পারবি নে?" , জিগায় টুইন্নায়।
"পারুম, পারুম! কী করতে হইবো ক-ছে খালি!"
"একখান শিক গরম করি লাল হই গেলে আস্তে করি দাঁতের উপরে ধরতে হয়, তুই পারতি ন। তুই গরম করি নি-আয়, আঁই ধরুম নে।"
দাঁত লাল করার লেইগা নাচতে নাচতে একটা শিক গরম কইরা এক্কেরে লাল টকটইকা কইরা নিয়া আসে বউটা। উত্তেজনায় টুইন্নার কপাল ঘামতে থাকে, কয়,
"এদিক আয়.. আমারে দে.."
যেইনা বোকা বউটা টুইন্নার হাতে গরম শিক দিসে, টুইন্না এক্কেরে অর মুখ দিয়া ঢুকায়া দেয় শিকটা! গাক..গাক কইরা মাটিতে পইড়া উথালপাথাল তড়পায় বউটা! টুইন্না ঠান্ডা চোখে চাইয়া চাইয়া দেখে। তড়পানি শেষ হইয়া গেলে অর কোমর থিকা চাবি লইয়া পায়ের শিকলের তালা খুলে টুইন্নায়।
বেলা পইড়া আইলে বুড়ি ভেলা বাইয়া এই পার আসে। দেখে এক হাত ঘোমটা দিয়া বউ দাড়ায়া রইসে। বুড়ি কয়,
"এহ ঢং! আবার ঘোমটা দিসে! কই, রান্নাবান্না করসস, না সারাদিন এই রঙ-ঢঙ্গই করসস?"
এক হাত ঘোমটার তল থিকা টুইন্না উপরে নীচে মাথা নাড়ে। গলা মিহি কইরা কয়, "আয় বুড়ি ভাত বাড়সি..আমার অনেক খিদা লাগসিলো তাই খাইয়া ফালাইসি। তুই খা।" - কইয়া বুড়িরে কাটা মানুষের মাংস খাইতে দেয়। বুড়ির খিদা লাগসিলো অনেক, গপগপাইয়া খাইতে থাকে বুড়ি। টুইন্না কয়, "তুই খা বুড়ি আমি একটু স্নান কইরা আহি, গাটা ম্যাজ ম্যাজ করতাসে।"
খাইতে খাইতেই বুড়ির কেমন জানি খটকা লাগে, একটু জোরেই কয়, "এই বেলা আবার স্নান কী? অ বউ, তোর হইসে কী.." ।
খাওয়া শেষ কইরা থাল নিয়া বুড়ি বাইরে আইসা দেখে টুইন্না তখন ভেলা নিয়া মাঝ দিঘীতে, তার বউয়ের শাড়ি খুইলা ফালাইতাসে গায়ের থিকা। তারে দেইখাই নাইচা চিল্লাইয়া উঠে টুইন্না, " ও বুড়িইই-
তোর বউরে কাইট্টা তোরে খাওয়াইসি! আমার কোন ডাইল-ডা হইসে!
তোর বউরে কাইট্টা তোরে খাওয়াইসি! আমার কোন ডাইল-ডা হইসে! "
বুড়ি এই পারে খালি এদিক ওদিক করে আর ফুঁসে। হঠাৎ কুইদা লাফ দেয় দীঘিতে। সাঁতারাইয়া দিঘী পার হওনের চেষ্টা করে। টুইন্না ততক্ষণে পারে আইসা পড়সে। বিশাল দিঘী পার হইতে পারে না বুড়ি, এমনেই ভরা পেট, খুব তাড়াতাড়ি হাঁপাইয়া যায়। কয়বার মাথা উঁচা কইরা ভাইসা থাকনের চেষ্টা করে, কিন্তু খালি জল খাইতে থাকে। একসময় জল খাইতেই খাইতেই ডুইবা যায় বুড়ি। পারে দাঁড়ায়া সব দেখে টুইন্না, তারপর দেয় বাড়ির দিকে এক ছুট।
©somewhere in net ltd.