![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১. বঙ্গবন্ধুর ওই সময়ে ওই রংপুরে সবসময়ই তিন মাস খাদ্যাভাব ছিল। সেইটাকে কাজে লাগাইছে বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা। পাকিস্তান যে হারছে, ওই হারা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল অনেক। তারা সমানে ওই জায়গাটা নিয়া পত্রপত্রিকায় লিখছে। আমরা এত বোকা ছিলাম যে, একটা মেয়েলোক জাল পইরা সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারে! মাছ তোলার জাল, সেইটায় কি সম্ভ্রম রক্ষা সম্ভব! আমরা বুঝি নাই। আমিও বুঝি নাই। ইত্তেফাকের একজন ওই ছবিটা তুলছিল। রাজিব না কি নাম! শালা মারাও গেছে। শালা মারা যাওয়ার আগে বলছে যে, আমার কাজ হইলো ছবি তোলা বিখ্যাত হওয়া। ও বিখ্যাত হইছে। জাল পরে সম্ভ্রম রক্ষা করা সম্ভব! সবই তো দেখা যাবে। সে কি করছে রংপুর স্টেশনে একটা লোক বদহজমের কারণে বমি করছে। সে এক বুভুক্ষু লোককে ধইরা আইন্যা কইছে, তোরে একশ ট্যাকা দিমু, তুই খালি ভঙ্গি করবি যে তুই এইটা খাইতাছস। এইটা ওই কুত্তার বাচ্চা ফটোগ্রাফার পরে স্বীকার করছে। ওই ছবি তুইল্যা দিল। ওইটা দেইখ্যা আমি কবিতা লিখছি। এইটা দেইখ্যা আমার সহ্য হয় নাই যে কীসের স্বাধীনতা।
সূএ: রফিক আজাদ ("ভাত দে হারামজাদা" খ্যাত কবি) / যার চেতনার স্তর যত উন্নত, তার কবিতাও তত উন্নত (সাক্ষাৎকার)। [ বাংলামেইল - সোমবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ ]
২. আজকের লেখায় আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব আনসার ব্যাপারীর সাথে। নিজ এলাকায় কারো কারো কাছে তিনি 'আনসার চেয়ারম্যান' নামেও পরিচিত। আনসার আলী, বয়স হবে ৬৭/৬৮ বছর। সহজ্-সরল-বিনয়ী স্ব্ভাবের বেঁটে খাটো মানুষটি আমার অতি অন্তরঙ্গ। থাকেন তিনি কুড়িগ্রামের চিলমারীতে, রমনা বাজারের কাছে। একসময় পাটের ব্যবসায়ী ছিলেন বলে তিনি 'ব্যাপারী' হিসেবে পরিচিত হন। পরে হলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ছিলেন। এখন মানসিক সমর্থন থাকলেও বয়সের কারণে রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন; বছর দু'তিন আগে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন, তাও বন্ধ। জমিজমা যা ছিল, বিক্রি করে খেতে খেতে নি:শেষ প্রায়। এখন তার দিনকাল কাটছে খুব অর্থ-সংকটের মধ্য দিয়ে। বড় ছেলেটি, বিয়ে করেছে, কিন্তু বেকার। ইন্টার মিডিয়েট পাশ করে কিছু একটা চাকুরির জন্য ঘুরছে।
তার ছেলের কথা থাক, বলি আনসার আলীর কথা। আপনাদের অনেকের জানার কথা নয় যে, আজকের বৃদ্ধ এই আনসার ব্যাপারী কিংবা আনসার চেয়ারম্যান বাংলাদেশের সংবাদপত্রের প্রকাশিত দু'টি সাড়া-জাগানো ছবির নেপথ্য নায়ক। '৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় ইত্তেফাকে চিলমারীর বাসন্তী-দুর্গতির যে ছবি ছাপা হয়, তা তুলেছিলেন কিছুদিন আগে ঢাকায় এক সড়ক দূর্ঘটনায় আহত আলোকচিত্রী আফতাব আহমদ। বাসন্তীর জাল-পরা ছবিটি সে-সময় দেশ-দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু, চিলমারীর ঐ জেলে বসতিতে আফতাব আহমদকে নিয়ে গিয়েছিলেন কে? ঐ আনসার আলী। আফতাব আহমদ যে নৌকায় করে ঐ গ্রামে যান, তার পথনির্দেশক ছিলেন আওয়ামী লীগের গ্রামকর্মী আনসার আলী। নৌকায় আরো ছিলেন তৎকালীন রংপুর জেলা প্রশাসনের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা। তিনি এখন উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার ডেপুটি কমিশনার। আনসার অলীই যে তাদের নৌকাটিকে বাসন্তী-দুর্গতিদের বসতিতে ভিড়িয়েছিলেন তা আজও তার মনে আছে।
আনসার আলীর সাথে তখনও (১৯৭৪) আমার পরিচয় হয়নি, তবে নাম জানতাম। পরিচয় হল '৭৮ সালের শেষদিকে। খাদ্যসংকটের ওপর সরেজমিনে প্রতিবেদন তৈরীর জন্যে চিলমারী গেলাম। আমার সঙ্গে গণকন্ঠের রংপুর প্রতিনিধি মুকুল মোস্তাফিজ (যে এখন দৈনিক খবরের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি)।
অনেকদিন পর আনসার আলীর সাথে আবার দেখা হয়েছে। আমি জানতে চেয়েছিলাম, 'আনসার ভাই, '৭৮ সালের ছবিটার কথা বাদ দেন, সে-সময় আর আওয়ামী লীগ সরকার নেই। কিন্তু '৭৪-এর ছবিটার জন্যে আপনি ফটোগ্রাফারকে বাসন্তী-দুর্গতিদের গ্রামের পথ দেখিয়েছিলেন কেন? জাল-পরা ছবিটি ছাপা হবার ফলে তো তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারই পরোক্ষভাবে নাজুক অবস্থায় পড়েছিল। আওয়ামী লীগের একজন শেকড় পর্যায়ের নেতা হিসেবে এটা করা কি আপনার ঠিক হয়েছিল?' আনসার আলী প্রশ্ন শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর বলেছিলেন, 'দেখেন মোনাজাত ভাই, অন্য সবার কথা জানি না, তবে আমি রাজনীতি করি শুধু দলের জন্য নয়, আমার রাজনীতি দেশের জন্য। সেই মানুষগুলোর দুর্গতি চাপা দিয়ে রাখব কেন?' এ জবাব শুনে আমি আর দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করিনি। তার এই ভাষ্যের বিপরীতে কী আর বলব আমি? [খবরের কাগজ/৪ জানুয়ারী, ১৯৯০]
সূএ: মোনাজাতউদ্দিন (সাংবাদিক) / পথ থেকে পথে। [ মওলা ব্রাদার্স - জানুয়ারি, ১৯৯১ । পৃষ্টা: ১৯-২২ ]
৩. রাস্তায় পড়ে থাকে চলচ্ছক্তিরহিত নর-নারী। গাড়ি করে যাওয়ার সময় ওদের চোখের দিকে, ওদের কঙ্কালসার দেহের দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠি। বাচ্চা কোলে শত ছিন্নবস্ত্রে লজ্জা ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াশ করছে মা। বাচ্চাটি মায়ের শুকিয়ে যাওয়া মাই চুষে কিছু না পেয়ে কঁকিয়ে ওঠে। জোরে কাঁদবার শক্তিও নেই। মানুষ আর কুকুরের পার্থক্য ঘুচে গেল। ডাস্টবিন ঘেঁটে উভয়েই খাদ্য খুঁজে প্রাণান্ত হয়। দেশের উত্তরাঞ্চল অপেক্ষাকৃত দরিদ্র এলাকা বিধায় সেখানে দুর্ভিক্ষের প্রকোপ তীব্র আকারে ছড়িয়ে পরল। অনাহারে অসংখ্য মৃত্যুর সংবাদ প্রতিদিন কাগজে ভরপুর। রংপুর জেলার অবস্থা সবচাইতে শোচনীয়। বিভিন্ন জেলা থেকে অগণিত আদম সন্তানের অনাহারে জীবনহানির সংবাদ এল।
বহুল বিতর্কিত বস্ত্রের অভাবে নাকি জাল দিয়ে গা ঢেকে লজ্জা নিবারণের প্রচেষ্টায় লিপ্ত যুবতী বাসন্তীর ছবি খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে দেশে-বিদেশে আমাদের লজ্জা রাখার ঠাঁই রইল না। কেউ কেউ সাফাই গেয়ে থাকে, বাসন্তী ছিল পাগলিনী। তাই ও শরীরে জাল জড়িয়েই রেখেছিল। সরকারকে বিব্রত করতে ওর ছবি ছাপানো হয়েছে। যেন বিব্রত হওয়ার মতো ঘটনা আর ঘটেনি! যেন দুর্ভিক্ষটাও পাগলের কান্ড, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার প্রচেষ্টা। অসংখ্য লোকের অন্নাভাবে মৃত্যু কেবল অতিরঞ্জিত রটনা! '৭৪ সেই দুর্ভিক্ষ জাতির জন্য সবচাইতে বড় কলঙ্ক এবং সরকারের চরম ব্যর্থতার ইতিহাস হয়ে রইল। এই সর্বনাশা দুর্ভিক্ষ জাতীয় জীবনকে বড় ধরনের নাড়া দিয়ে গেল। দুর্ভিক্ষ হঠাৎ করে আসে না। আধুনিক বিশ্বে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং পরিকল্পনা গ্র্হণ করলে এ ধরণের বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু সামন্ত-মানসিকতার বিচার-বিবেচনা নিয়ে ট্রাইবাল চিফদের মতো দেশ শাসন করলে তার পরিণতি এমনিই হতে বাধ্য।
সূএ: শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন (মুজিব সরকারের প্রথম চীফ হুইপ) / বলেছি বলছি বলব। [ অনন্যা - সেপ্টেম্বর, ২০০২। পৃষ্ঠা: ২৩৪-২৩৬ ]
৪. আজকের এই বৃদ্ধ আনসার অলী বাংলাদেশের সংবাদপত্রে প্রকাশিত দুটি সাড়া জাগানো ছবির নেপথ্য-মানুষ। এর একটি হলো বাসন্তি-দুর্গতির সেই জাল পরা ছবি। '৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় ইত্তেফাকে বাসন্তি-দুর্গতিদের জাল পরা যে ছবিটি ছাপা হয়, দেশ দুনিয়ায় ব্যাপক আলোড়ন তোলে, আলোকচিত্রী আফতাব আহমদকে এই আনসার আলীই নৌকায় করে ঐ জেলে বসতিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। একজন সাংবাদিকের প্রতিবেদন কিংবা চিত্র সাংবাদিকের তোলা ছবির নেপথ্যে থেকে যায় যেমন অনেক মানুষ, আনসার আলী তাদেরই একজন। কিন্তু এ লেখায় চিলমারীর মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষটিকে আবারো পাঠকের সামনে টেনে আনলাম এ কারণে যে, তার রাজনীতি সম্পর্কিত ব্যাপারটি দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হোক।
ভুল ভ্রান্তি কিংবা পরিশুদ্ধ যা-ই, নির্নীত হোক। '৭৪-এর আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও আফতাব আহমদকে তিনি বাসন্তি-দুর্গতিদের বসতিতে নিয়ে গিয়েছিলেন কেন? জাল পরা ছবিটি ছাপা হবার ফলে তো তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারই পরোক্ষভাবে নাজুক অবস্থায় পড়েছিল। সে সময় আনসার আলীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম : 'ব্যর্থতা রাখ ঢাক করবার নীতি যখন সকল সরকার আমলেই প্রচলিত, সেসময় আওয়ামীলীগের একজন শেকড় পর্যায়ের নেতা হিসেবে এটা করা কি আপনার ঠিক হয়েছে?' জবাবে আনসার আলী খুব খটখটে কন্ঠে বলেছিলেন: 'দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি, কেবল দলের জন্য নয়। দেশের মানুষগুলোর দুর্গতি চাপা দিয়ে রাখবো কেন?'
সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই এটা মুখের বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের নামে ব্যক্তি স্বার্থ সিদ্ধি, ক্ষমতার গদিতে বসে ব্যাপক দুর্নীতি, সম্পদের পাহাড় নির্মাণ হচ্ছে। ভোটের সময় ভোট নিয়ে তাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা তো দূরের কথা ভোটদাতাদের কাছাকাছি পর্যন্ত যাচ্ছেন না অনেক জনপ্রতিনিধি। ফলে একটি মানুষের জন্যে বিশাল জনগোষ্ঠি ঐ দল তো বটেই, রাজনীতির ওপর থেকেই আস্থা হারাচ্ছেন। অন্তত: শেকড় পর্যায়ে তা-ই দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক সংকটের এক চরম গহ্বরে পতিত দেশের একজন শেকড় পর্যায়ের নেতা আনসার আলী দলের চেয়ে দেশের মানুষকে বড় করে দেখেছেন, দলের স্বার্থটিকে পাশে সরিয়ে রেখে মানুষের দুর্গতিকে প্রকাশিত করেছেন। রাজনৈতিক মহল কি এটাকে গ্রহণ করবেন? নাকি বিরোধী দলে থাকলে বক্তৃতা বিবৃতিতে সরকারকে নাস্তানাবুদ করে দেয়া আর সরকার গঠন করার পরই 'সব কুছ ঠিক হ্যায়' বলে ক্ষতের ওপর রঙ্গের প্রলেপ দিয়েই দেশ পরিচালিত হতে থাকবে?
সূএ: মোনাজাতউদ্দিন (সাংবাদিক) / চিলমারীর এক যুগ। [ আগামী প্রকাশনী - জানুয়ারি, ১৯৯৫ । পৃষ্ঠা: ৩০-৩১ ]
বিশেষ কৃতজ্ঞতা: কাই কাউস (Kai Kaus)।।
©somewhere in net ltd.