নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সিনেমা পাগল। সিনেমায় খাই, সিনেমায় ঘুমাই, সিনেমায় পড়ি, সিনেমায় স্বপ্ন দেখি। জীবন সিনেমাময়।

লেখাজোকা শামীম

গল্প লেখার নেশা আমার আশৈশব। মাধ্যমগুলো বদলে গেছে সময়ে সময়ে - কখনও গল্প, কখনও উপন্যাস, কখনও নাটক, কখনও চলচ্চিত্র কিংবা কখনও টিভি নাটক। যে মাধ্যমেই কাজ করি না কেন, একই কাজ করেছি - গল্প বলেছি। আমি আজন্ম গল্পকার - এক সাদামাটা গল্পকার। মুঠোফোন : ০১৯১২৫৭৭১৮৭. বৈদ্যুতিক চিঠি : [email protected]ফেসবুক : http://www.facebook.com/shajahanshamim.scriptwriterদৃষ্টি আকর্ষণ : আমার নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম যেমন উপন্যাস ও নাটক - যা এই ব্লগে পোস্ট করেছি, তার সর্ব স্বত্ব সংরক্ষিত। আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া এসবের কিছুই কোনো মাধ্যমে পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।

লেখাজোকা শামীম › বিস্তারিত পোস্টঃ

উপন্যাস - নিষিদ্ধ জ্যোৎস্না - পর্ব -০৭

১৫ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:৩৪

সাত



এত বড় মহানগরের মাঝখানে আমার প্রিয়জনদের কোথায় খুঁজব ? মার খুব বেশি আত্মীয়-স্বজন নেই। ছোটবেলাতেই বাবা মা মরে গেছে। তিনি এবং তাঁর এক ভাই মামার বাড়িতে মানুষ। সেই মামার বাড়ির ঠিকানা আমি জানি না।

আমার বাবার মতো বদ লোকের কাছে বিয়ে দেয়ার জন্য মা তার মামাকে দায়ী করতেন। মামার সঙ্গে তিনি নিজেই সম্পর্ক রাখেন নি।

আব্বার সঙ্গে মার দাম্পত্য সম্পর্কে কোন দিন বনিবনা হয় নি। চরিত্রহীন স্বামীর সংসারে পনের বছর অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করে তিনি আজ শূন্য। হায় রে মানুষের জীবন!

এখন আমি কোথায় খুঁজি ? কার কাছে যাব ? ঠিকানাহীন গন্তব্যে কিভাবে পৌঁছব ?

মনে পড়ল, ভাবীর কথা। আমার বড় ভাইয়ার স্ত্রী। কিন্তু মা কি তার সৎ ছেলের বাড়িতে উঠবেন ? মনে হয় না। মায়ের আত্মসম্মানবোধ প্রখর। তবু একবার গিয়ে দেখা দরকার। বিপদে পড়লে মানুষ কি না করে।

পকেটে সামান্য টাকা আর ব্যাগ ভর্তি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রওয়ানা দিলাম। আচ্ছা, পনির লুনাকে কিছু বলে গেছে নাকি ? বলে যেতেও তো পারে। এত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। লুনাদের বাসায় কি যাব ? লুনা আবার অন্য কিছু ভেবে বসবে না তো ? তাহলে থাক। কিন্তু ওদের বাসায় গেলে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানা যেতে পারে। তাহলে তো যেতে হয়। ধ্যাত্তেরি, এত ভাবাভাবির কী হল ? গিয়েই দেখি না কী হয় ।

লুনাদের বাসার সামনে গিয়ে আমার পা আর চলে না। নিজেকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলাম ওদের বিশাল গেটের সামনে। দাড়োয়ান জিজ্ঞেস করল,‘কারে চান ?’

‘এডভোকেট সাহেব আছেন ?’

‘আছেন। কিন্তুক তেনি তো বাড়িত কারো লগে দেহা করেন না। আপনে চেম্বারে যান। চেম্বারের ঠিকানা জানেন তো ?’

‘আমি তো কোন কেসের ব্যাপারে আসি নি। অন্য একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই।’

‘ও আচ্ছা’, দাড়োয়ান গেট বন্ধ করে ভেতরে চলে গেল। আমি ওদের বিশাল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, আমি আসলে কত গরীব। এই রকম বাড়ি তো দূরের কথা, এই রকম একটা গেট বানানোর সাধ্যও আমার নেই। দাড়োয়ান কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল,‘আহেন আমার লগে।’

ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল বাগান। অদ্ভুত সুন্দর। শেষ বিকেলের আলোয় গোলাপ, ডালিয়া আর নাম না জানা পাতা বাহারের অপরূপ সমাহার। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

হঠাৎ মনে হল, লুনা কি উপর থেকে আমাকে দেখতে পেয়েছে ? নিজের অজান্তেই শার্ট এবং চুল ঠিক করে নিলাম। লুনা যদি আমাকে দেখে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই নিচে নেমে আসবে।

দাড়োয়ান আমাকে বাড়ির সামনে নিলে এল। বিশাল বারান্দা। ইজি চেয়ারে বসে ঢাউস সাইজের একটা বই পড়ছেন একজন প্রৌঢ়। তাঁর চোখে ভারি চশমা। জুলফিতে নাটকীয় পাক ধরেছে। বুঝলাম, তিনি লুনার বাবা। আমি সামনে গিয়ে সালাম দিতেই তিনি মুখ তুলে তাকালেন।

‘কী ব্যাপার ?’

‘আমি আপনাদের পেছনের বাড়িতে থাকি। হাবিবুর রহমান সাহেবের ছেলে।’

‘ও আচ্ছা, আমার কাছে কী জন্য এসেছ ?’

‘আমি ... একটু ... মানে ... একটা জরুরী ব্যাপারে আলাপ করতে চাই।’

‘বল, কী বলবে ?’

‌‘আপনাকে নয়।’

‘তাহলে ?’

‘আমি একটু লুনার সাথে দেখা করতে চাই।’

তিনি ঝট করে বই বন্ধ করলেন। চোখ থেকে ভারী লেন্সের চশমাটা খুললেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার সাথে দেখা করতে চাও ?’

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘লুনার সঙ্গে।’

তিনি আমার দিকে স্থির চোখে তাকালেন। আমি পুরোপুরি ঘাবড়ে গেলাম। হাত পা কাঁপছে। তিনি গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,‘লুনার কাছে তোমার কী দরকার ?’

‘আপনাকে ঠিক বলা যাবে না। ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত।’

তিনি বইটা কাছে টিপয়ে নামিয়ে রাখলেন। অনর্থক গাল চুলকালেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,‘আমাকে বলা যাবে না। ব্যাপারটা ব্যক্তিগত। কিন্তু লুনাকে বলা যাবে। ফাজলেমি পেয়েছ ?’

‘আপনি ঠিক ....’

‘কোন কথা নয়। দেখে তো ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হয়। কিন্তু তুমি যে আস্ত ক্রিমিনাল সেটা আগেই বুঝেছি। কোন কথা না বলে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।’

‘জ্বী, মানে ..’

ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, ‘আই সে গেট আউট।’

দাড়োয়ান দৌড়ে এল। আমি আশেপাশে তাকালাম। না, কেউ নেই। কোন কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। চোখ ফেটে পানি আসার যোগাড় হল। নিঃশব্দে রুমাল বের করে চোখ মুছলাম।

এ রকম কেলেংকারি হবে জানলে যেতামই না। মাঝখান থেকে অপমানিত হলাম। এই বুড়োকে একবার জুত মতো পেয়ে নেই। অপমান কাকে বলে শিখিয়ে দেব।

ভাবীর কাছে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবী অসুস্থ। জ্বর এসেছে। তবু ভাবীকে রেখে বড় ভাইয়া কাজে গেছে। গরীব মানুষের কাজে না গিয়ে উপায় নেই।

ভাবী বলল,‘ভাই, বাসায় একটা লোক নাই যে, আমার মাথায় দেয়ার জন্য একটু পানি এনে দেবে।’

আমি তৎক্ষণাৎ বালতি নিয়ে রওয়ানা হলাম। গলির কাছের কল থেকে পানি আনতে হবে। কম ভাড়ার টিনসেড বাসায় এর চেয়ে বেশি সুবিধা আশা করা যায় না।

বালতি রেখে ঘরে ঢুকতেই ভাবী আমার মুখের সামনে বাটিভর্তি ঝাল মুড়ি এগিয়ে দিল। বলল, ‘আগে মুড়ি খেয়ে নাও। পানি আনার পুরস্কার।’

আমি ভদ্রতা করে বললাম, ‘আপনি এ সব করতে গেলেন কেন ?’

‘দেবরের জন্য এইটুকু করতে হয়।’

তিনি অতি কষ্টে হাসলেন। আমি খেয়াল করলাম, তিনি অনেক শুকিয়ে গেছেন। এক মুঠ ঝাল মুড়ি নিয়ে বাটিটা ভাবীর দিকে এগিয়ে দিলাম। তিনি হাত দিয়ে বাটি সরিয়ে বললেন, ‘জ্বরে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু খেতে পারি না।’

আমি একাই একটু একটু করে ঝাল মুড়ি খেতে লাগলাম। ভাবীর ঘরে তেমন কিছু নেই। একটা চৌকি, একটা মিটসেফ, আলনা এবং পুরোনো একটা আলমারি। তারা খুব একটা ভালো নেই। ভাইয়ার স্বল্প বেতনের চাকুরিতে সংসার চালানোই কষ্ট।

হঠাৎ ভাবী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এই ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছ ?’

আমি এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। ভাবীকে কি সত্যি কথাটা বলব ? না, অসুস্থ শরীরে উনাকে ভয়ংকর ঘটনাটা বলা উচিত হবে না। পরে না হয়, ধীরে সুস্থে বলা যাবে। আর জানিয়েই বা কী লাভ ? আমাদের ভাগ্য কি বদলাবে ?

‘কী হল ? যাচ্ছ কোথায় ?’

‘বিশেষ কোথাও না। এক বন্ধুর বাড়িতে দিন সাতেক থাকব। ’

‘হঠাৎ বন্ধুর বাসায় কেন ?’, ভাবীর চোখে কৌতুকের ঝিলিক, ‘বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে নাকি ?’

আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, ‘আরে না, বন্ধুর বাসার সবাই গ্রামের বাড়ি গেছে। ও একা একা ভয় পায়। তাই সঙ্গ দিতে যাচ্ছি।’

‘কোন কাপুরুষ তোমার বন্ধু ? একবার নিয়ে এসো তো, বীরপুরুষ বানিয়ে দেব।’

‘সে দেখা যাবে। আমি এখন যাই, ভাবী।’

আমি ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভাবী বললেন,‘ কী জন্য এলে তা তো বললে না।’

‘এমনি। এ দিক দিয়ে এলাম, তাই দেখা করে গেলাম।’

‘তাহলে আবার এসো, ভাই।’

আমি রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। মানুষ সব পারে। কী সুন্দর মিথ্যা কথা বলে অভিনয় করে গেলাম। ভাবী টের পায় নি।

আমি সোজা মুন্নার বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজ রাতটা মুন্নার বাসায় থাকব। মুন্নার সঙ্গে পরামর্শ করে কাল পনির ও মাকে খুঁজে বের করব। এই ব্যাপারটার একটা ফায়সালা করতে হবে।

‘এই যে, রঞ্জু, এই’, মেয়েলি কণ্ঠে পেছনে তাকালাম।

সোমা এবং ওর প্রায় সম-বয়সী একটি মেয়ে। ওদের হাতে বড় বড় পলিথিনের ব্যাগ। সম্ভবত শপিং করছে। সোমা রহস্য করে বলল, ‘কী ব্যাপার রঞ্জু মিয়া, কোথায় যাচ্ছেন ?’

‘কোথাও না।’

‘তাহলে কাঁধে ব্যাগ কেন ?’

কী মুশকিল ! সবাই দেখি খালি ব্যাগের কথা জিজ্ঞেস করে। আমি বানিয়ে বললাম, ‘এমনি। পোছপাছ।’

‘তোর পোছপাছ ছোটাচ্ছি।’

সোমা হ্যাঁচকা টানে ব্যাগ কেড়ে নিতে চাইল। আমি চট করে দূরে সরে গেলাম। ওর সাথের মেয়েটি ওর কীর্তি দেখে হাসছে। ওর সাথের মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল,‘কী পাগলামি করছিস ?’

আমি বললাম,‘শপিং করছিস মনে হয়।’

‘হ্যা। তবে এ শপিং আমার নয়, ওর। আরতি, তুই চলে যা। ওর সাথে আমার একটা জরুরী কথা আছে।’

আমি বিস্মিত হওয়ার ভান করলাম। বললাম, ‘আমার সাথে কী কথা ?’

সোমা মুখ ভেংচে বলল,‘আরামের কথা। বেরামের কথা। আরতি, তুই চলে যা। আমি একটু পরে আসছি।’

আরতি অর্থপূর্ণ হাসি দিল। বলল,‘আপনার কথা ওর মুখে অনেক শুনেছি।’

‘এই মিথ্যে বলছিস কেন ?’, সোমা তেড়ে গেল।

আরতি হাসতে হাসতে বলল,‘দাদা, আমি কখনও মিথ্যে বলি না।’

‘হয়েছে সত্যভাষী সাধু আমার। এবার বিদায় হ।’

আরতি একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে আবারও একটা রহস্যময় হাসি দিল।

আরতি মেয়েটি কে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। সোমা খুব মুখ খোলা । ফট করে একটা বাজে কথা বলে বসবে। কী দরকার সেধে অপমানিত হওয়ার ?

সোমা আমার পাশে হাঁটছে। ও কি আরো মোটা হয়েছে ? কেমন থপ থপ করে হাঁটছে। আমার তো এখন ওকে নিয়ে ঘোরার সময় নেই। এই বিপদের সময় ও আঁঠার মতো লেগে গেল। আমি বিপদে পড়ে গেলাম। ওকে দেখেই মুন্নার বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরছে - ‘কালি ভুটকি’। এই কালি ভুটকিকে কিভাবে ঝেড়ে ফেলি ? হায় ! হায় ! আমিও দেখি মুন্নার মতোই ওকে ‘কালি ভুটকি’ বলতে শুরু করলাম। ভাগ্যিস প্রকাশ্যে বলি নি। ও জানলে আমার মাথার সবগুলো চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলত।

ফোড়ন কেটে বললাম,‘এখনও রিক্সা নিবি নাকি ?’

সোমা বোকার মতো তাকাল। জিজ্ঞেস করল,‘কেন, রিক্সা কেন ?’

‘এই সোডিয়াম লাইটের আলোয় তুই যদি কালো হয়ে যাস।’

সোমা হাতে একটা চাপ দিল। কানের কাছে ফিস ফিস করে বলল, ‘বেশি রকম চাপাবাজি ভালো না।’

আমার ওর সঙ্গ ভালো লাগছে না। ওর এই গায়ে-পড়া স্বভাবটা আমার একদম পছন্দ না। তবু বিরক্তি লুকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,‘তুই আমার সঙ্গে কোথায় যাবি ?’

‘তোর মতোই। কোথাও না। একটুখানি তোর সাথে হাঁটব আর জরুরী কথাটা বলব।’

‘তাহলে শুরু কর।’

সোমা আমার কনে আঙ্গুলটা খুঁটতে লাগল। বলল,‘এত ছটফট করছিস কেন ? তোর কি কোন কাজ আছে ?

‘তা নেই।’

‘তাহলে চল না, খানিকটা হাঁটি।’

‘এই রাতে ?’

‘রাত কোথায় ? সবে তো সন্ধে হল।’

আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল। মনে হল, কাদার মধ্যে হাতটা ডুবে গেল। আমার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, চারপাশের সব লোক আমাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।

‘হাত ধরছিস কেন ? হাত ছাড়। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না।’

‘তুই আসলে মানুষের মন বুঝিস না’, ও হাত ছেড়ে দিল।

আমি চমকে ওর দিকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম,‘এ কথা বললি কেন ?’

‘না, এমনি’, ও একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আমি চুপ মেরে গেলাম। এ মেয়েকে কিভাবে বিদায় করা যায় তা-ই ভাবতে লাগলাম। অন্য সময় হলে অন্য সঙ্গ খারাপ লাগত না। কিন্তু আমার সামনে এখন অন্ধকার সময়। এক বিন্দু সময় নিয়ে নষ্ট করার।

সোমা বলল,‘ তোকে একটা কথা বলব। একটা সুপরামর্শ দিবি ?’

‘কী ব্যাপারে ?’

‘আমার একদম ব্যক্তিগত ব্যাপারে।’

‘মেয়ে মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি কী পরামর্শ দেব ?’

‘কী করব ? তুই ছাড়া যে আমার এমন কোন বন্ধু নেই যাকে এই কথাগুলো বলতে পারি।’

আমি সোমার দিকে তাকালাম। ওর চোখ ছল ছল। মনে হচ্ছে, এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। মুহূর্তের মধ্যে আমার বুকের ভেতরে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। মেয়েটা যে আমাকে এত আপন মনে করে জানা ছিল না। ওকে মনে মনে ‘কালি ভুটকি’ বলা উচিত হয় নি। কোন এক সময় মাফ চেয়ে নিতে হবে।

সোমা বলল,‘আগে প্রমিজ কর, তুই কাউকে ঘটনাটা বলবি না।’

এ আরেক নতুন ঝামেলা। ঘটনা যদি এত গোপনই হয়, তবে অন্যকে বলার দরকারটা কী ? আমি বললাম,‘‘করলাম প্রমিজ। এবার বল।’

সোমা আশেপাশে তাকাল। তার গোপন কথা কেউ শুনে ফেলবে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার আম্মিকে তোর কেমন মনে হয় ?’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিলাম না। কী বলব ভেবে পেলাম না। কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলি, তাই রিস্ক নিলাম না। মুরুব্বীদের সম্পর্কে যে কথা বলতে হয়, সেই কথাটি গৎ বাঁধা বুলির মতো করে বললাম, ‘উনি খুব ভালো মানুষ।’

সোমা তাচ্ছিল্য করে হাসল। বলল, ‘তোর ধারণা ভুল। আমার আম্মি একটা অমানুষ।’

কী মন্তব্য করব ? হতভম্ব হয়ে গেলাম। শুধু উপদেশের সুরে ক্ষীণকণ্ঠে বললাম, ‘গুরুজন সম্পর্কে এই রকম করে বলা উচিত না।’

ও মুখ চোখ শক্ত করে বলল, ‘সব গুরুজন এক না। কারো কারো গুরুজন হওয়াই উচিত না।’

আমি আমতা আমতা করে বললাম,‘হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা কী ?’

‘ব্যাপারটা বলতে আমার খুব লজ্জা লাগছে। কিন্তু না বলেই পারছি না।’

আমি অপেক্ষা করে রইলাম। জানি, ও নিজে থেকেই বলবে। খোঁচাখুঁচি করলে বলবে না।

ও বলা শুরু করল,‘তুই তো জানিস, কয়েক বছর আগে আমার বাবা মারা গেছেন। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। কিন্তু আমার আম্মি বাবার এক বন্ধুর সাথে বাড়াবাড়ি রকমের ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলছেন। আমার মনে হচ্ছে, তারা হয়তো খুব শিঘ্রি বিয়ে করবে। তুইই বল, তার কি সেই বয়স আছে ?’

বোকার মতো চেয়ে রইলাম। কী বলব ? আমিই তো ঘরপোড়া গরু। আরেক জন দুঃখীকে কিভাবে সান্ত¦না দেব ? আমার সাড়া না পেয়েও ও থামল না। বলে যেতে লাগল,‘জানিস, আমি ভেবেছিলাম, মা আমার জন্য একটা চমৎকার বর যোগাড় করে দেবেন। উনি নিজের বর যোগাড়েই ব্যস্ত। আমাকে দেয়ার মতো সময় তার কোথায় ?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, ‘এ জন্য কি তুই খুব দুঃখী ?’

‘আমার চেয়ে দুঃখী এই পৃথিবীকে কেউ নেই।’

আমি হাসলাম। তাচ্ছিল্যের হাসি। বললাম, ‘শোন, মানুষের জীবনে দুঃখ থাকবে, কষ্ট থাকবে, তবু এই জীবনটাকে সাজিয়ে রাখতে হবে।’

‘সুখে থাকলে এই রকম মিষ্টি মিষ্টি কথা অনেক বলা যায়।’

ওর কথার ধরনে আমার হা হা হাসি পেয়ে গেল। এখন ওই রকম করে হাসলে ও মনে চোট লাগতে পারে ভেবে হাসিটা চেপে গেলাম। মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে নিজের অনুভূতিটাই সবার চেয়ে বড় ।

বললাম, ‘তোর ধারণা ভুল। সবার জীবনেই অনেক দুঃখ থাকে। কেউ সহ্য করতে পারে, কেউ যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠে। যারা সহ্য করে যায়, তাদের সম্পর্কে চারপাশের মানুষের ধারণা হয় যে, তারা সুখী। যেমন তুই আমাকে ভাবছিস। তোর জীবনের চেয়েও দুঃখজনক ঘটনা আমার জীবনে আছে। ’

সোমা আমার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি। আমি বললাম,‘তাহলে শোন, আমার মায়ের সাথে বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, সেটা তো আগেই বলেছি।’

‘হ্যা, বলেছিলি। পনির তোর সৎ বোন।’

‘কিন্তু বাবা আজ আমার ছোট মাকেও তালাক দিয়ে দিয়েছেন। আমি প্রতিবাদ করায় আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন।’

সোমা আর্তনাদ করে উঠল,‘আয় হায়, বলিস কী ! এখন কী হবে ?’

‘এখন আমি পনির আর মাকে খুঁজে বের করব ?’

‘ওরা কি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ?’

‘হ্যা, কোথায় গেছে জানিয়ে যায় নি।’

‘কোন আত্মীয় স্বজনের বাসায় যেতে পারে।’

‘মার আত্মীয় স্বজন বলতে তার এক ভাই। কিন্তু তার সাথে আমাদের তেমন সম্পর্ক নাই। বাবার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় তিনি আমাদের বাসায় আসতেন না। আমরাও বাবার ভয়ে তার বাসায় যেতাম না।’

‘কিন্তু তার বাড়িটা কোথায় জানিস তো ?’

‘তা জানি, মুগদাপাড়ায়।কিন্তু উনার বাড়িটা চিনি না যে।’

‘উনার নাম জানিস তো ?’

‘নাম তো জানি। রফিকুল ইসলাম।’

‘নো প্রোবলেম। চল, দ্যাখ না কিভাবে খুঁজে বের করি।’

সোমার ধৈর্য বলতে হবে। ও সত্যি সত্যি মুগদাপাড়ার অনেকগুলো বাড়ি খুঁজে খুঁজে একে ওকে জিজ্ঞেস করে দেড় ঘণ্টার মধ্যে রফিক মামার বাড়িটা বের করে ফেলল।

মা লজ্জিত ও পনির বিস্ময়াহত। রফিক মামা উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘ভালো করেছ, এসেছ। কিন্তু তোমার সাথে এটি কে ?’

‘আমার সাথে পড়ে। মুগদাপাড়া চিনে বলে ওকে সাথে করে নিয়ে এসেছি।’

সোমা আমার হাতে মৃদু চাপ দিল। মা বললেন, ‘রঞ্জু, তুই হাত মুখ ধুয়ে আয়। সারা দিন বোধ হয় পেটে কিছু পড়ে নি।’

মা আমাকে রাত আটটায় খেতে বসিয়ে দিল। সোমা কিছুতেই খেতে বসবে না। কিন্তু রফিক মামার পীড়াপীড়িতে ওকেও বসতে হল। আমাদের সাথে পনির ও মামার বড় মেয়ে শুক্লাও এসে বসল। মামার দু’ ছেলে শফিক ও সমিকও আমাদের সাথে যোগ দিল। মামাকে আমাদের সাথে বসতে অনুরোধ করলাম। ক্ষিধে নেই অজুহাতে তিনি বসলেন না। তিনি অনেক রাতে খান। তখনই আমার মনে পড়ল, মামার স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছে। আশ্চর্য মানুষের জীবন। জীবন কখনও নিখুঁত হয় না।

খাবার খেয়ে সোমা সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। মামা বললেন, ‘আবার এসো, মা।’

আমি সিঁড়ি ভেঙ্গে ওকে রিক্সায় তুলে দিতে এলাম। সিঁড়িকোঠার অন্ধকারে দরজার আড়ালে ওকে ফিস ফিস করে বললাম,‘সোমা, তুই সত্যি একটি চমৎকার মেয়ে। এত চমৎকার মেয়ে আমি আর দেখিনি।’



চলবে ...



পর্ব -০১পর্ব - ০২পর্ব - ০৩পর্ব - ০৪পর্ব - ০৫

পর্ব -০৬পর্ব -০৮





আমার অন্যান্য ধারাবাহিক উপন্যাস :



কুষ্ঠ নিবাস



নাটকের মেয়ে









মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:৪৩

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: সামাজিক জীবনের নানাদিক ফুটে রয় লেখায়
সুন্দর কথা মালা
অনুভুতি মনোরম
বাস্তব দৃশ্য ফুটে জীবন সাজাবার বেলা

২| ১৬ ই জুন, ২০১৩ রাত ৩:০৩

বটবৃক্ষ~ বলেছেন: ভালোই যাচ্ছে কাহিনি>...+

৩| ১৬ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২১

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: আগের পর্বটা পড়ে তারপর আসতে হল, খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।

ভালো লাগছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.