নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গল্প লেখার নেশা আমার আশৈশব। মাধ্যমগুলো বদলে গেছে সময়ে সময়ে - কখনও গল্প, কখনও উপন্যাস, কখনও নাটক, কখনও চলচ্চিত্র কিংবা কখনও টিভি নাটক। যে মাধ্যমেই কাজ করি না কেন, একই কাজ করেছি - গল্প বলেছি। আমি আজন্ম গল্পকার - এক সাদামাটা গল্পকার। মুঠোফোন : ০১৯১২৫৭৭১৮৭. বৈদ্যুতিক চিঠি : [email protected]ফেসবুক : http://www.facebook.com/shajahanshamim.scriptwriterদৃষ্টি আকর্ষণ : আমার নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম যেমন উপন্যাস ও নাটক - যা এই ব্লগে পোস্ট করেছি, তার সর্ব স্বত্ব সংরক্ষিত। আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া এসবের কিছুই কোনো মাধ্যমে পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গল পনিরের ডাকাডাকিতে। হঠাৎ মনে হল, এ আমি কোথায় এসে গেছি ? আমার আজন্ম পরিচিত সেই ভাঙ্গাচোড়া ঘরটি কোন যাদুস্পর্শে এত সুন্দর হয়ে গেছে ?
‘কী হল ভাইয়া ? ওঠো।’
‘উঠছি। ক’টা বাজে রে।’
‘আটটা।’
‘সর্বনাশ !’, আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম।
পনির হাসল। বলল, ‘মিথ্যে কথা। মাত্র সাতটা বাজে।’
‘সত্যি করে বল, ফাজিল।’
‘সত্যি করে বলছি, সাতটা বাজে।’
যাক, বাঁচা গেল। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে খাটে বসলাম। ইচ্ছে হচ্ছে, আরেকটু গড়িয়ে নেই।
‘কী হল ? বসলে যে ? মামা নিচে নাস্তা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।’
‘এত সকালে নাস্তা !’ আমি তো পুরো অবাক।
পনির ঠোঁট বাঁকা করে বলল, ‘হ্যা। এটা তো আমাদের বাড়ি নয় যে, কোন দিন নাস্তা হবে, কোন দিন হবে না।’
হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে দেখি, মামা নাস্তা করছেন। তার সাথে বসেছে তার দুই ছেলে শফিক ও সমিক। শুক্লা ও পনির পাশে দাঁড়িয়ে নাস্তা এগিয়ে দিচ্ছে।
আমাকে দেখে মামা বললেন, ‘এসো, নাস্তা করো। আমার আবার একটু বেরুতে হবে।’
আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। শুক্লা বলল, ‘ রঞ্জু সাহেবের ঘুমের বোধ হয় বিরাট ব্যাঘাত করা হয়েছে।’
আমি কাচুমাচু হয়ে গেলাম। অনেকটা বিড়বিড় করে বললাম,‘হ্যা, তা হয়েছে কিছুটা।’
‘তাহলে তো রঞ্জু সাহেবকে নাস্তার পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়’, শুক্লা দুটো প্লেট এগিয়ে দিল। একটা প্লেটে পরোটা আর আরেকটা প্লেটে ঘন ডাল। পরোটার ম ম গন্ধে আমার ক্ষুধা জানান দিল। এই রকম ডাল দিয়ে গরম ধোয়া ওঠা পরোটা খাই নি অনেক দিন।
আমি নাস্তা খাওয়ায় মন দিলাম। আধখানা পরোটা সাবাড় করার আগেই শুক্লা একটা পরোটা আমার প্লেটে তুলে দিল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। দেখি, ও মিটিমিটি হাসছে। একটা মৃদু হি হি শব্দে তাকিয়ে দেখি, টেবিলের উল্টো দিকে বসা শফিক সমিক ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে।
শুক্লা বলল, ‘খাও, খাও, এটাই তো খাওয়ার বয়স।’
মামা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কোন লজ্জা করো না। নিজের বাড়ি মনে করে খাও।’
কিন্তু আমার অস্বস্তি লাগছে। এই রকমভাবে চারপাশে ঘিরে ধরে জীবনে আমাকে কেউ খাওয়ায় নি। অস্বস্তিতে বোধ হয় আমার কপালে চিকন ঘাম দেখা দিয়েছে।
মামা ঝটপট নাস্তা সেরে উঠলেন। বললেন,‘কিছু মনে করো না, রঞ্জু। আমার একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। তুমি দুপুরের খাবার এখানে খেয়ো।’
আমি বিনয়ে বিগলিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, ‘ঠিক আছে, মামা।’
মামা চলে গেলেন। শুক্লা আমার প্লেটে আরেকটা পরোটা দিয়ে দিল। ধুর, এরা কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছে নাকি ? আমি পরোটাটি বাটিতে উঠিয়ে রাখলাম।
শুক্লা বলল, ‘এই বয়সে এত কম খেলে হবে ?’
‘আমি কমই খাই।’
শফিক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রঞ্জু ভাই, আজকে আপনার হালুয়া টাইট হবে।’
পনির পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বলল,‘শফিক ভাই, আজকে দুপুরে আপনার হালুয়া টাইট হবে।’
‘তাই নাকি ? কী করে ?’
‘সময়েই দেখতে পাবেন।’
কিভাবে হালুয়া টাইট দেয়া হয় বুঝি না। যার হালুয়া সে টাইট দিক, টাইট দিয়ে হালুয়াকে মাঠা বানিয়ে দিক, আমার কী ? আমার হালুয়া ঠিক থাকলেই হল। আচ্ছা, হালুয়াটা আসলে কী ? ধুর, কী আবোল তাবোল ভাবছি।
সমিক নাস্তা খেতে খেতে পনিরের দিকে তাকিয়ে বলল,‘কিন্তু তুমি আপার মতো পারবে না। আপা, হুমায়ূন ভাইকে যে অবস্থা করে। বেচারার কয়েক বার পেট খারাপ হয়েছে।’
শুক্লা হুংকার দিয়ে উঠল,‘সমিক, চুপ করবি নাকি কান ধরে বের করে দেব ?’
আমি মজা পেয়ে বললাম,‘হুমায়ূন ভাইটি কে ?’
‘বিরাট ইঞ্জিনিয়ার। আব্বার বন্ধুর ছেলে।’
‘উঠ। বেরো’, শুক্লা সমিককে কান ধরে উঠাল। সমিক খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল। শুক্লা সমিককে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সমিক চেয়ারে বসে পড়ে নিজেকে সামলাল। শফিকও হেসে উঠল।
মা এলেন চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে। ট্রেতে করে সাজানো কাপ-পিরিজ-কেতলি। শফিক ও সমিক চায়ের কাপ নিয়ে পড়তে চলে গেল। পনির চা না পেয়ে রাগ করে চলে গেল। আমার ছোট বোনটি কেবল প্রমাণ দিতে চেষ্টা করে সে বড় হয়েছে। বড় হওয়ার যন্ত্রণা জানলে সে এত তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার চেষ্টা করত না।
আমি চায়ের কাপ টেনে নিলাম। পাশের ঘর থেকে শফিক ও সমিকের পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। জানালা দিয়ে আসা সকালের আলোয় ঘরটা ঝলমল করছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনটা ভরে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মা চুপ করে বসে রইলেন। আমি বললাম,‘তারপর কিছু ভাবলেন ?’
মা আমার দিকে তাকালেন। নিষ্প্রভ দৃষ্টি। বললেন, ‘কী আর ভাবব ? সবই আল্লাহর ইচ্ছা। ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে।’
আমি চুপ করে গেলাম। মা হতাশ হয়ে পড়েছেন। লড়তে লড়তে একটা সময় সবাই ক্লান্ত হয়। সবাই চায় একটু বিশ্রাম নেয়া সুখী গৃহকোণ। কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল। মা, আমি ওই লোকটিকে কোনক্রমেই ক্ষমা করতে পারব না। সে আমাদের সবার জীবন নিয়ে কুৎসিত মজা করছে। আরও একটি জীবন সে নষ্ট করতে যাচ্ছে। কিন্তু আমি চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তার আর কোন পরিকল্পনাই সফল হবে না।
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরুলাম। প্রতিভার ওখানে যেতে হবে। আজ যদি টাকাটা নেয়া যায়।
প্রতিভার ওখানে পৌঁছে দেখলাম, ওদের মেইন গেটে বিরাট তালা ঝুলছে। ধুর, আগে থেকেই বোঝা দরকার ওরা সবাই খালাতো বোনের বিয়েতে যাবে। আজ না এলেই পারতাম। কিন্তু প্রতিভা তো জানায়নি, ওরা এত দিনেও ফিরবে না।
এখন টাকার ব্যবস্থা কী করব বুঝতে পারছি না। মুন্নার পিকনিকের চাঁদা ছাড়াও আরও টাকা দরকার হবে। হঠাৎ মনে পড়ল রমিজের কথা। রমিজকে আমরা সবাই ‘রমিজ ব্যাংক লিমিটেড’ বলে ডাকি। আমাদের বয়সী ছেলেরা ওর মতো হাড় কেপ্পন হয় না। টাকা জমিয়ে গন্ধ শুঁকেই যেন ওর সুখ।
রমিজের ওখানে পৌঁছে শুনলাম, ও বাজারে গেছে। ওর ছোট বোন রোমেনা দরজা খুলে দিল। এই মেয়েটাকে আমি সহ্য করতে পারি না দুটি কারণে - গায়ে পড়া স্বভাব এবং গায়ের দুর্গন্ধের জন্য। ঘামের দুর্গন্ধের জন্য ওর কাছে দাঁড়ানো যায় না। নতুন জামাইয়ের মতো রুমাল চেপে তো কারো সঙ্গে কথা বলা সম্ভব না।
‘রঞ্জু ভাই, অনেক দিন পর এলেন। এত দিন ছিলেন কোথায় ?’, রোমেনা তেলতেলে হাসি দিচ্ছে। কিন্তু ওর হাড়গিলে মুখের ওপর বড় বড় দাঁতের কারণে মনে হচ্ছে কামড়াতে আসবে এক্ষুণি। একটা সূক্ষ্ম ঘামের দুর্গন্ধে আমি একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম। সোজাসাপটা বললাম, ‘তাহলে আমি একটু ঘুরে আসি।’
‘না, না, আপনি ভেতরে এসে বসুন। ভাইয়া এসে পড়বে এক্ষুণি।’
আমি যাব নাকি ভেতরে ঢুকে বসব বুঝতে পারছি না। এভাবে সিঁড়িকোঠার মধ্যেও তো হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হঠাৎ রোমেনা আমার হাত চেপে ধরল, ‘আসেন না, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি ?’
আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে রোমেনা দরজা লাগিয়ে দিল। ঘরটা প্রায় অন্ধকার। কেন যেন ওরা দরজা জানালা বন্ধ রাখে। এ জন্যই ঘরটা গুমোট। আবারও কেমন একটা সূক্ষ্ম দুর্গন্ধ পাচ্ছি। রোমেনা বাতি জ্বালিয়ে দিল। বাতিটার অল্প আলোর কারণে অন্ধকার পুরোপুরি কাটল না।
মাঝারি সাইজের ঘরটার মধ্যে একটা পুরোনো সোফা সেট এবং তারচেয়ে পুরোনো শো কেস ছাড়া আর কিছু নেই। আমি গিয়ে সোফায় বসলাম।
‘একটু বসুন, আমি এক্ষুণি আসছি’, বলে রোমেনা চলে গেল। ও এত তাড়াতাড়ি চলে গেল যে, আমি কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। সোফায় এমন একটা জায়গায় বসেছি, যেখান থেকে ওর চলে যাওয়া দরজাটা দেখা যায়। দরজার ওপাশে অন্ধকার। ওরা কি সব সময় দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকে ? শুনেছি, ওর মায়ের মানসিক সমস্যা আছে। মাঝে মাঝে খুব সুস্থ থাকেন মহিলা। তখন তার হাসিখুশী চেহারা দেখা যায়। কিন্তু বছরের একটা সময় তিনি বিগড়ে যান। তখন ওরা দরজা জানালা আটকে বসে থাকে।
শো কেসে ধূলা জমেছে। প্রায় অন্ধকার বলে শো কেসের ভেতরে রাখা ছোট্ট ছোট্ট পুতুলগুলো ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। পাশের দেয়ালের রং ও পলেস্তারা খসে পড়েছে। বন্ধ জানালায় মাকড়সার ঝুল ঝুলছে।
খেয়াল করলাম, পুরোনো সোফার ফোম দেবে গেছে। ভ্যালভেটের সোফার কভারটা অনেক পুরোনো। গাঢ় মেরুন রংটা আরো কালচে হয়ে গেছে। কয়েক জায়গায় ভ্যালভেটের আঁশ উঠে গেছে ঘেঁয়ো কুকুরে চামড়ার মতো। দুর্গন্ধটা কি সোফার কভার থেকে আসছে ?
‘কে ?’
আমি চমকে দরজার দিকে তাকালাম। রমিজের মা। সম্ভবত এখন তার অসুস্থকাল চলছে। তিনি গায়ে একটা নোংরা শাড়ি পরে আছেন। নোংরার কারণেই সাদাটে রংটা চটে গেছে। শাড়িটা কেমল এলোমেলো ভঙ্গিতে গায়ে পরেছেন।
আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আমি।’
‘আমি কে ? আজকাল রোমেনার কাছে আজেবাজে ছেলেরা আসে। তুমি আবার কোন বদমাশ ?’
আমি ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললাম, ‘আমি রঞ্জু। রমিজের বন্ধু।’
‘সবাই তো তা-ই বলে। কিন্তু সব কটা রোমেনার সঙ্গে আড্ডা মারে। মনে করেছ আমি কিছু বুঝি না। আমি সব বুঝি। সব ইতরের চোখ আমার রোমেনার দিকে।’
আমি কি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকব নাকি দৌড়ে চলে যাব বুঝতে পারছি না। এ কী রকম বিপদে পড়লাম ? এ পাগলীকে কিভাবে বোঝাব, আমি আর সবার মতো নই ? আমার কোন খারাপ ইচ্ছে নেই। বরং আপনার মেয়েই সবার গায়ে পড়ে কথা বলে।
‘দাঁড়িয়ে আছ কেন ?’, মহিলা হুংকার ছাড়লেন, ‘দেখতেই পাচ্ছ রমিজ নেই। তারপরও দাঁড়িয়ে আছ কেন ? ছেলে বন্ধুর জন্য ঘরে এসে বসে থাকতে হয় না। যাও, রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। তোমরা তো রাস্তারই ছেলে।’
আমি দরজার দিকে রওয়ানা হলাম। এরপরও দাঁড়িয়ে থাকলে মহিলা হয়তো লোকজন ডাকবেন। এ রকম অপমানের আগে কেটে পড়াই ভালো।
বেরুতে যাব এমন সময় রোমেনা এসে ঢুকল ট্রে হাতে। তার মায়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল।
‘মা, তুমি এখানে এলে কেন ? যাও, রেস্ট নেও গিয়ে।’
ওর মা কেমন একটা ভেংচি কেটে বলল,‘হ্যাঁ, আমি যত রেস্ট নেই, ততই তোর মজা। ছেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতে সুবিধা। তুই এত খারাপ হবি জানলে জন্মের সাথে সাথে গলা টিপে মেরে ফেলতাম।’
রোমেনা হাতের ট্রে সোফার টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল,‘মা, তুমি যাও তো। সব সময় আজেবাজে কথা বল।’
মহিলার তেজ আরও বেড়ে গেল। বলল,‘আমি আজেবাজে কথা বলি ? তুই কী করিস ? তোর কাছে এত ছেলেরা আসে কেন ? কেন আসে ?’
আমি পালাতে পারলে বাঁচি। আমতা আমতা করে বললাম, ‘ঠিক আছে, খালাম্মা, আমি চলে যাচ্ছি। রমিজকে বলবেন।’
রোমেনা বলল, ‘আপনি বসুন। বুড়ির পাগলামি আমি বের করছি।’
হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। মায়ের প্রতি এ কেমন ব্যবহার ! শুনেছিলাম, রমিজের মায়ের মাথায় সামান্য গোলমাল। কিন্তু এই রকম ভয়াবহ অবস্থা তা জানতাম না। জানলে এই বাড়িতে ঢোকার সাহস করতাম না।
রোমেনা তার মাকে তীব্র ধমক দিল, ‘এখান থেকে যাও। নইলে অবস্থা খারাপ করে দিব।’
মনে হল, মহিলা ভয় পেয়েছেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে মহিলা নিঃশব্দে চলে গেলেন।
রোমেনা আমার দিকে তাকাল। কেমন অপ্রস্তুত অবস্থায় হাসির চেষ্টা করছে। বলল, ‘আপনি বসুন। আমাদের বাসায় যখন এসেছেন, তখন এটুকু সহ্য করতেই হবে। এ ছাড়া কোন উপায় নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবারও রোমেনা আমার হাত ধরল। আমি তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। সোফায় গিয়ে বসলাম। সোফার হাতলটা হাতড়াতে হাতড়াতে বললাম, ‘খালাম্মার কোন চিকিৎসা করা যায় না ?’
‘সম্ভব নয়। আমার নানীও পাগল হয়ে মরেছেন। এটা আমাদের বংশগত রোগ। আমিও হয়তো পাগল হয়ে মরব। নিন, চা নিন।’
চা নিলাম। মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে গেছে। মানুষের জীবন কত কষ্টের ! এত কষ্টের পরও মানুষ বেঁচে থাকতে চায়।
রমিজ বাজার নিয়ে ফিরল। আমাকে দেখে মুখে তেলতেলে হাসি ঝুলিয়ে দিল। ওকে নিয়ে বেরুলাম। ওর চেহারা চিমসে যাচ্ছে। মাথার চুলও কমে যাচ্ছে। কোন কঠিন অসুখ বাঁধিয়েছে বোধ হয়। শালা, আবার কোন নেশা টেশা করছে না তো ? আজকাল তো নেশা করাটা একটা ফ্যাশন। অবশ্য ওর মতো হাড় কেপ্পনের পক্ষে নেশা করা সম্ভব নয়।
ওদের বাড়ির পাশে একটা ছোট্ট খেলার মাঠ আছে। আমরা দু’জনে মাঠের এক পাশে একটা গাছের নিচে দাঁড়ালাম। তাতানো একটা রোদ উঠেছে। মাঠে কেউ নেই।
আমরা এটা সেটা আজাইরা আলাপ করলাম প্রথমে। তারপর এক সময় আসল কথা পাড়লাম, ‘দোস্ত, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন।’
ও এমন ভঙ্গি করল, যেন তলপেটে ভয়ানক বেগ চেপেছে। ওর এই এক অভ্যাস। সব কিছুতেই দুশ্চিন্তা প্রকাশ।
‘দোস্ত, তুই এমন সময় চাইলি যখন আমার হাতে একেবারে টাকা নেই। এ মহল্লায় রমিজ নামে এক লোক থাকে। গতকাল এসে টাকা চাইল। না করতে পারলাম না। হাজার হোক মিতা তো। অবশ্য টুয়েন্টি পারসেন্ট ইন্টারেস্ট দিতে চেয়েছে।’
অবিশ্বাস্য কথা ! এ ছেলে দাঁদন ব্যবসায় নেমেছে। আমি রসিকতা করে বললাম, ‘তুই দেখি সত্যি সত্যি ব্যাংক দিয়ে ফেলেছিস।’
ও কথাটা গায়ে মাখল না। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘এখন তোকে কোত্থেকে টাকা দেই ? কাল দিলাম পাঁচ হাজার। আচ্ছা, তোর কত টাকা দরকার ?’
দরকার চার শ’। ইচ্ছে করে বাড়িয়ে বললাম, এক হাজার। আমি জানি এই কেপ্পনের কাছে ভালো অংকের টাকা আছে। এত চাপাচাপি ভণিতা মাত্র - নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বানানোর চেষ্টা।
টাকার অংক শুনে ও যেন ঘাবড়ে গেল। বলল, ‘এক হাজার ! এরে বাবা ! ঠিক আছে দেখি। আয় আমার সাথে।’
‘আর যাব না। তুই নিয়ে আয়। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি।’
ও চলে গেল। তাতানো রোদ হলেও এই গাছের নিচটা যথেষ্ট ঠা-া। কী গাছ এটা ? কৃষ্ণচুড়া ? ভাবছি, কেপ্পনটা আনবে আর কত টাকা ? বড় জোর পাঁচ শ’। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও এক হাজার টাকাই নিয়ে এল। একবার ভাবলাম, বলি, এত টাকার দরকার নেই। কিন্তু সেটা বললে ও আমার চালাকিটা ধরে ফেলবে। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম বাজারে।
আমার চরম সিদ্ধান্তের একটা অংশ সম্পন্ন করতে যাচ্ছি। কীটনাশকের দোকান থেকে সেতু কর্পোরেশনে তৈরী ‘ফাইফানন’এর এক বোতল কিনলাম। বোতলের গায়ে লেখা - ‘বিষ, সাবধান।’
রিক্সা নিয়ে সোজা চলে এলাম বাসায়। ভাবছি, কাজটা কেমন হচ্ছে ? কাজটা না করলে হয় না ? কিন্তু অনেক ভেবে দেখেছি - এর বিকল্প যে নেই।
আব্বা বাসায় নেই। মেজ ভাইয়া দরজা খোলা রেখে ঘুমাচ্ছে। আমি ঘরে পা দেয়া মাত্রই মাথা উঁচু করে তাকাল। বলল, ‘ কি রে, কাল রাতে কোথায় ছিলি ?’
‘তুমি কিচ্ছু শোন নি ?’
‘শুনেছি। নুরীর মায়ের কাছে ’, ভাইয়া পাশ ফিরে শুল।
‘তোমার কাছে এ ঘটনা অন্যায় মনে হয় নি ?’
ভাইয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে উঁচু গলায় হাসল। বলল, ‘ধর্মে কি বৌ তালাক দেয়া নিষেধ নাকি ?’
আমার আর কথা বলার রুচি হল না। আব্বার ঘরে চলে এলাম। এই তো মোক্ষম সুযোগ। মেজ ভাইয়া ঘুমুচ্ছে এবং অন্য কেউ বাসায় নেই।
আমার বাপজান লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদখোর। সেই লাইসেন্স তিনি গর্বভরে সবাইকে দেখিয়ে বেড়ান। তার খাটের নিচে সব সময় কেরু কোম্পানীর মদের বোতল মজুদ থাকে।
খাটের নিচে উঁকি দিলাম। যথারীতি আছে দু’বোতল। লাইসেন্সপ্রাপ্ত মদখোর বলে কথা। বের করলাম বোতল দু’টি। ছুরি দিয়ে নিখুঁতভাবে সিল খুললাম। ‘ফাইফানন’এর বোতলটা থেকে দুই ভাগ করে দুই বোতলে মিশিয়ে দিলাম।
বেরুতে যাব, মেজ ভাইয়া বলল, ‘বেরুচ্ছিস নাকি ?’
‘হু।’
‘হঠাৎ এলি, আবার বেরিয়ে যাচ্ছিস, ব্যাপারটা কী ?’
‘ব্যাপার কিছু না। তুমি নিশ্চয়ই আমার কথা শুনেছ ?’
‘তুই কি সত্যি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিস ?’
‘হ্যাঁ, কয়েকটা কাপড় নিতে এসেছিলাম।’
‘একটা কাজ কর, গৃহত্যাগী নাগা সাধু হয়ে যা। তাহলে কাপড় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না’, মেজ ভাইয়া উঁচু গলায় হাসতে লাগলেন।
আমি কোন জবাব না দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
চলবে ...
পর্ব -০১ । পর্ব - ০২ । পর্ব - ০৩ । পর্ব - ০৪ । পর্ব - ০৫ ।
পর্ব -০৬ । পর্ব -০৭ । পর্ব -০৮ । পর্ব-১০ ।
আমার অন্যান্য ধারাবাহিক উপন্যাস :
কুষ্ঠ নিবাস
নাটকের মেয়ে
২| ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৪:০১
প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: ভালো এগোচ্ছে।
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৯:৫০
রাধাচূড়া ফুল বলেছেন: ভালো লাগল। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।