নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সংবাদপত্র সমাজের দপণ। দপণে যেমন নিজের চেহারা প্রতিবিম্বিত হয়, তেমনি দেশ, জাতি, সমাজ এমনকি সমকালীন বিশ্বের চলমান ঘটনা, জীবনযাত্রা, চিন্তাচেতনা, জাতীয় স্বাথে দিক নিদেশনা সংবাদপত্রের পাতায় ছাপা হয়। সামাজিক উন্নয়ন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা,সত্য-সুন্দর এবং ন্যায় ভিত্তিক সমাজ গঠনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে মানুষের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন সংগ্রামের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নে সংবাদপত্রের অবদান অনস্বীকার্য। সংবাদপত্র যে প্রকৃত পক্ষে 'ফোর্থ স্টেট' এ ধারণাটিও মূলত শতাব্দী পুরোনো। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্যালারিতে উপস্থিত সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের লক্ষ্য করে রাষ্ট্র কাঠামোতে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা বুঝাতে এডমন্ড বার্ক বলেছিলেন, তারা এই রাষ্ট্রের 'ফোর্থ স্টেট'।চলমান জীবনে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। সংবাদপত্র পৃথিবীকে মানুষের মুঠোর মধ্যে নিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা-স্বার্বভেীমত্ব, জাতীয় স্বার্থ, মানবাধিকার উন্নয়নে ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণে,গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করণে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের ভুমিকা সবচেয়ে বেশী।
সংবাদপত্র এমন একটি দলিল যা যুগ যুগ ধরে সংরক্ষন করে রাখা যায়। সংবাদপত্রকে গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার বিকল্পহীন প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণেই গণতন্ত্র বিপন্ন হলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিপর্যয় ঘটে আবার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব হলে গণতন্ত্রও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। সংবাদপত্র মূলত পাঠকের জন্য এবং সে পাঠক অবশ্যই সমাজমনস্ক পাঠক। সংবাদপত্র যখন নির্বিঘ্নে সমাজের অবিকৃত নানা ঘটনার একটি নিরপেক্ষ সংবাদচিত্র পাঠকদের উপহার দিতে পারে, তখন সে সংবাদপত্র শুধু পাঠকের খোরাক যোগায় না, একজন সাধারণ পাঠককেও সপ্রতিভ নাগরিক করে তোলে। একজন নাগরিক রাজনৈতিকভাবে সচেতন না হলে সে যেমন জাতির কল্যাণ সাধন করতে পারে না, তেমনি নিজের কল্যাণ সাধনও তার পক্ষে সার্থকভাবে করা সম্ভব নয়। নাগরিকদের রাজনৈতিক জ্ঞান অর্জনের যত উপায় আছে, তার মধ্যে সংবাদপত্রের স্থান সর্বাগ্রে। সংবাদপত্রের জগতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হওয়ায় এবং পৃথিবীর গণমাধ্যমগুলো অতিবৈজ্ঞানিক ত্বরিত সেবা প্রদান করতে সক্ষম হওয়ায় সংবাদপত্রের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংবাদপত্রের গুরুত্ব সম্পকে আমেরিকার দু'বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেফার এক সাংবাদিককে লিখেছিলেন যে, তাঁকে যদি সংবাদপত্রহীন সরকার এবং সরকারবিহীন সংবাদপত্র বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রের জগত্ই বেছে নেবেন। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি বলেন, 'সংবাদপত্র যেখানে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং জনসাধারণ যেখানে পড়তে জানে সেখানে সবকিছুই নিরাপদ।' সংবাদপত্রহীন একটি গণতান্ত্রিক দেশের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। সংবাদপত্র ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা গণতান্ত্রিক সমাজের অপরিহায অঙ্গ। আজকে, রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেটের যুগেও প্রিন্ট মিডিয়ার গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। কাগজের পাতায় ছাপার অক্ষরে চিরস্থায়ী লেখাগুলোই হয়ে থাকবে কালের সমুজ্জ্বল সাক্ষী।
সাংবাদিকতা পেশার গুরুত্ব
যারা সাংবাদিকতাকে একটি মিশন তথা মহান পেশা হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের কাছে দলীয় সংকীর্ণতার ওপর পেশাগত সততা এবং আদর্শ বড় বলে বিবেচিত হয়। দল ও দলীয় নেতা ভুল করলে তারা তাও তুলে ধরেন। দলীয় আনুগত্যের চেয়ে দেশপ্রেমকে বড় করে দেখেন। সংবাদপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা হলো সাংবাদিকদের।‘সাংবাদিকতা‘ হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সম্মানজনক পেশা। সেজন্যই সাংবাদিকদের সমাজের অতন্দ্র প্রহরী বা ‘গেট কীপারস‘ বলা হয়। সাংবাদিক সমাজ জাতির বিবেক হিসেবে চিহ্নিত; যারা রাষ্ট্র,সমাজ ও মানুষকে নিরলসভাবে সেবা দেয়।
পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম পছন্দের। কারণ সাংবাদিকতার মাঠ এখন অনেক বিস্তৃত। একটা সময় ছিল যখন সাংবাদিকতা শুধু খবরের কাগজের গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। এখন খবরের কাগজের স্থান কিছুটা হলেও দখল করে নিয়েছে টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেলগুলো। অবশ্য তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় খবরের কাগজগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইন এডিশন বের করছে। পত্রিকা আর টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি সাংবাদিকতার সুযোগ রয়েছে রেডিওতেও। এখানে রয়েছে অনেক সম্মান। সম্মানীও কম নয়। সৃজনশীল ব্যক্তিরা টিকে থাকতে পারেন এ পেশাতে।
অনেকে মনে করছেন টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেল বৃদ্ধির সাথে সাথে সংবাদপত্রের গুরুত্ব লোপ পেতে পারে। আসলে এটা ঠিক নয়। সংবাদের গ্রহণযোগ্যতা ও পেছনের ভূমিকা উপস্থাপন এবং সংবাদের পেছনের সংবাদ খুঁজতে সংবাদপত্রের বিকল্প নেই। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সংবাদপত্রই উৎকৃষ্ট স্থান। সংবাদপত্রে যারা কাজ করেন তারা হলেন সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, নগর ও বার্তা সম্পাদক, সিনিয়র রিপোর্টার, বৈদেশিক সংবাদদাতা, মফস্বল সংবাদদাতা, সাব এডিটর, ক্রীড়া সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিক, চীফ মেক আপমেন এবং গ্রুফ রিডার।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্র
সাংবাদিকতার অন্যতম ক্ষেত্র হলো টেলিভিশন বা চ্যানেল। টিভি সাংবাদিকতা আর সংবাদপত্রের সাংবাদিকতার মুল কাজ এক হলেও টিভি সাংবাদিতার ধরণ ভিন্ন। এখানে সাংবাদিককে ঘটনাস্থল থেকে তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে বিভিন্ন ঘটনার প্রতিবেদন তৈরি করতে হয়। সাংবাদিক এখানে খবরের বিভিন্ন উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে সোর্ফ তৈরি করেন এবং খবর জন্ম দেয় এমন লোকও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নিয়ে থাকেন। এসব কাজের জন্য সংবাদ সংস্থা পরিবেশিত খবর, বিভিন্ন সাময়িকীসহ তথ্যের বিভিন্ন উৎস থেকেও তথ্য সংগ্রহের কাজ সাংবাদিকরা করেন। এরপর তারা চলমান ছবি ব্যবহার করে নিজের কণ্ঠে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। কখনো কখনো তাদের ঘটনাস্থল থেকে কোনো রকম স্ক্রিপ্ট ছাড়াই সংবাদ পরিবেশন করতে হয়। কোনো কোনো সাংবাদিক সংবাদ পাঠকের কাজও করে থাকে।
বর্তমানে রেডিও সাংবাদিকতার একটি অন্যতম ক্ষেত্র। মোবাইল সেটে এফ এম রেডিওর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। ক্লাসের ফাঁকে, আড্ডায়, হাঁটতে, চলতে মোবাইলে বাজছে রেডিও। রেডিওর এ জনপ্রিয়তা শুধু গান দিয়েই নয়। প্রত্যেক ঘণ্টায় নিউজ আপডেটের মাধ্যমেও। বাংলাদেশ বেতার ছাড়াও বর্তমান ৫/৬টি রেডিও চ্যালেনের মধ্যে রেডিও ফুর্তি এবং এবিসি প্রত্যেক ঘণ্টায়ই সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। অন্যান্য রেডিও এফএম চ্যানেলগুলোও শীঘ্রই তাদের শিডিউলে আনবে নিউজ। এ নিউজ সংগ্রহ, উপস্থাপন সাংবাদিকদের মাধ্যমেই হবে। রেডিও সাংবাদিকতায় কণ্ঠের গুরুত্ব একটু বেশি।
এছাড়াও সাংবাদিকতার সুযোগ রয়েছে সংবাদ সংস্থায়। বর্তমানে দেশে অনেক সংবাদ সংস্থা রয়েছে। যেমন- বাসস, ইউ এনবি, বিডি নিউজ, এনএনবি, ফোকাস বাংলা ইত্যাদি। এসব সংস্থায় চাকরি করতে গ্রাজুয়েট ডিগ্রিধারি হতে হয়। ইংরেজি ভাষায় দখল থাকলে ভালো হয়। সাধারণ কোনো পত্রিকায় যোগ্যতা প্রকাশ করতে পারলে বড় বড় পত্রিকা ডেকে নেয়। আর দিন দিন বাড়ছে মিডিয়া। সাংবাদিকরা সাংবাদিকতাকে চাকরি হিসেবে না নিয়ে নেন আনন্দ হিসেবে। একজন সাংবাদিকের কাজই হলো জনগণের কাছে সঠিক তথ্য তুলে ধরা। এটাকে তাই পেশা নয় সেবা হিসেবেই নেন সবাই।
সংবাদ
সংবাদ বলতে মুদ্রণজগৎ, সম্প্রচার কেন্দ্র, ইন্টারনেট অথবা তৃতীয় পক্ষের মুখপাত্র কিংবা গণমাধ্যমে উপস্থাপিত বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের একগুচ্ছ নির্বাচিত তথ্যের সমষ্টি যা যোগাযোগের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। একটি সূত্র দাবী করছে যে, চতুর্দশ শতাব্দীতে নিউ শব্দের বহুবচন হিসেবে নিউজ বা সংবাদ শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হতো। মধ্যযুগীয় ইংরেজী হিসেবে নিউজ শব্দটির সমার্থক ছিল নিউইজ (newes), ফরাসী শব্দ নোভেলেজ (nouvelles) এবং জার্মান শব্দ নিউয়েজ (neues)। লোকমুখে 'নিউজ' শব্দটিকে বিশ্লেষণ করা হয় - এন (নর্থ), ই (ঈষ্ট), ডব্লিউ (ওয়েস্ট) এবং এস (সাউথ)। এক সময় বলা হতো, ‘ নিউজ ইজ সেক্রেড , ওপিনিয়ন ইজ ইওরস ’। মানে হলো সংবাদ পবিত্র, মতামত আপনার নিজস্ব। এম.ভি. চার্নলি বলেছেন, ‘সংবাদ হলো আজকের মোড়কে দেওয়া আগামী দিনের ইতিহাস।’
সংবাদপত্র
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঐতিহ্যগতভাবেই অধিকাংশ বৃহৎ শহরে সকাল এবং বিকালে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। প্রচারমাধ্যমের সম্প্রসারণ এবং সংবাদের ক্ষেত্র অসম্ভবরকমভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় অধিকাংশ বিকালের সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে কেবলমাত্র সকালেই সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।সকালে সংবাদপত্র প্রকাশের ফলে কম ক্ষতি হয়। মূলতঃ সংবাদের গুণগত মান ও দৃষ্টিভঙ্গীই এতে সম্পৃক্ত। সাধারণতঃ সংবাদ ৫টি ডব্লিউ'র উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়। হু, হুয়াট, হোয়েন, হোয়ার, হুয়াই ছাড়াও আরও একটি ডব্লিউ (হাউ) রয়েছে। এগুলোকে ভিত্তিমূল হিসেবে ধরে যে-কোন বিষয় বা ঘটনা নিয়ে সংবাদ তৈরী করা সম্ভবপর। এশব্দগুলোর মাধ্যমে সংবাদ অনুসন্ধান কার্যক্রমের পর আর কোন প্রশ্ন বাকী থাকে না। প্রথম পৃষ্ঠায় সাধারণতঃ গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ উপস্থাপন ও তথ্য পরিবেশনকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। এরফলে ব্যস্ত পাঠকেরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাদের অভিষ্ট সংবাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে থাকেন।
ক্যাবল নিউজ চ্যানেল হিসেবে বিবিসি নিউজ, ফক্স নিউজ, এমএসএনবিসি, সিএনএন সংবাদের গুরুত্ব অনুসারে প্রচারের ব্যবস্থা করে। ১৬০৫ সালে প্রকাশিত রিলেশন অলার ফুর্নেমেন আন্ড গেডেনঙ্কুরডিগেন হিস্টোরিয়েনকে বিশ্বের ১ম সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন শহর বা দেশে যে ঘটনাগুলো প্রতিটি মুহূর্তে ঘটছে তা প্রাপ্তিসাপেক্ষে দ্রুত প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে রেডিও বা বেতার, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়।
১৭৮৩ সালে যুদ্ধশেষের সময়ে ৪৩টা পত্রিকা প্রকাশিত হতো। নতুন জাতির উন্নয়নের নানাদিক নির্দেশনায় প্রেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো। নতুন নতুন সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হলো। নতুন আলোকে তুলে ধরতে লাগলো রাজনৈতিক মতামত। ১৯১০ সালের ভেতর আধুনিক সংবাদপত্রের অনিবার্য অবয়ব উদ্ভূত হলো। আমাদের সময়ে, রেডিও ও টেলিভিশন ধীরে ধীরে দেশের প্রাথমিক তথ্য-উৎস, সংবাদপত্রকে যেভাবে স্থানচ্যুত বা উচ্ছিন্ন করছে তাতে ইতিহাসে এর ভূমিকা অনুধাবন করা কঠিন হতে পারে। বাংলা সংবাদপত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখব যে, ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথমার্ধে শ্রীরামপুরের ‘ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি’র ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’ প্রেস থেকে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়। এটিকে ভারতীয় ভাষার প্রথম সংবাদপত্র হিসেবেও ধারণা করা হয়, যদিও কোনো কোনো ঐহিহাসিকের মতে, গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য কতৃক প্রকাশিত, বাংলা সাপ্তাহিক, ‘বেঙ্গল গেজেট’ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। এর আগে বাংলা মাসিক পত্রিকা, ‘দিকদর্শন’-এর সফলতা ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি’র মিশনারিদেরকে আবারও বাংলা ভাষায় সংবাদপত্র প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করে। উদ্যোগটি নিয়েছিলেন জশোয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড। প্রায় একই সময় হারাচন্দ্র রায় (Harachandra Roy) কোলকাতার চোরবাগান ( Chorebagan Street) স্ট্রীটে তাঁর নিজস্ব ছাপাখানা থেকে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। তাঁর প্রকাশনার আগেই, ১৮১৮ সালের ২৩ মে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস ‘সমাচার দর্পণ’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করে ফেলে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা ছিল। তার মধ্যে ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক খবর, দৈনিক অব জারভার উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের মতো ঘন বসতিপূর্ন দেশে হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র কখনোই যথেষ্ট ছিলো না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার ছিল ; তা হলো নির্ভরযোগ্য সংবাদ পরিবেশনার অভাব। সঠিক সংবাদের জন্য আমাদেরকে বেশীরভাগ সময় বিদেশী মিডিয়ার উপর নির্ভর করতে হতো। তখন বিদেশী মিডিয়া বলতে আমি বিবিসি, ভয়েজ অফ আমেরিকাকে বুঝাতে চাচ্ছি।
“Were it left to me to decide whether we should have a government without newspapers or newspapers without a government, I should not hesitate for a moment to prefer the latter.” টমাস জেফারসন আক্ষরিক অর্থে এই কথাটি বলেননি। কিন্তু একটি দেশে সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও ভূমিকা বোঝাতে তার এই উক্তিটি প্রাতঃস্মরণীয় বলে বিবেচিত হয়। সংবাদপত্র বলতে এখানে বিভিন্ন মত ও পথের অধিকারকে বোঝানো হয়েছে। এটি ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনা করা যায় না। জেফারসন দু’শ বছর আগে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতাকে সরকারের ওপর স্থান দিয়েছে।
সাংবাদিক
কখনও বলা হয়েছে সাংবাদিকতা হবে নিরপেক্ষ, কখনও বলা হয়েছে সাংবাদিকতা হবে বস্তুনিষ্ট। ব্যাপকভাবে বেসরকারী ও বাণিজ্যিক রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্রের বা কর্পোরেট মিডিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে। সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত অবস্থার স্বীকার করা হয় মিডিয়ার আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই। বিগত দুই দশকে এক শ্রেণীর সাংবাদিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হলেও সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার উন্নয়ন হয় নি বরং অবনতি হয়েছে। এ অবনতির কারণ সংবাদপত্রকে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রভাব-প্রতিপত্তির হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা। সাংবাদিকতা পুরোপুরি পণ্যে পরিণত হয়েছে। এরপর আছে মূর্খতা। অতীতে সাংবাদিকতায় আসতো মেধাবীরা। সাধারণত রাজনৈতিক কর্মীরা স্বাধীন পেশা হিসেবে ওকালতি ও সাংবাদিকতা বেছে নিতেন। বিগত দুই-তিন দশকে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা পেশা হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে বেছে নিয়েছেন। আর সাংবাদিকতায় এসেছে কোথাও চাকরী না-পাওয়া তরুণেরা নেতাদের সুপারিশ নিয়ে। নেতাদের কাছে কর্তৃপক্ষের নানান দায়বদ্ধতা আছে, ফলে তরুণদের না নিয়ে উপায় নেই। এভাবে সাংবাদিকতায়-আসা মেধাহীন মূর্খরা দু’লাইন লিখতে না পারলেও সাংবাদপত্রের বড় বড় পদ এদের দখলে। এদের অনেকে প্রকাশ্যে বলে, আমি তো লিখি না, লিখে কী হবে? ভালোই তো আছি। এতোকাল জানতাম, যে সাংবাদিক ভালো লেখেন, বেশী লেখেন এবং যার লেখার ধার যত বেশি তিনিই তত বড় সাংবাদিক, নামকরা সাংবাদিক। কিন্তু আজকের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সাংবাদিক হতে হলে প্রয়োজন খবর সম্পর্কে বোধ ও গভীরতা। ইংরেজিতেও বলে নিউজ সেন্স। পরিবেশন করা খবর পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারছে কী-না, তা একজন সাংবাদিকের যোগ্যতার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সময়ের সাথে সমানতালে চলার মানসিকতা ও স্বচ্ছ পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি ভালো সাংবাদিক হয়ে ওঠার চাবিকাঠি। সাংবাদিকতার কাজে দায়িত্ব অনেক বেশি। প্রিন্ট মিডিয়ার ক্ষেত্রে কোনো খবর সংগ্রহ করতে না পারলে অন্য সাংবাদিকদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কোনো ছবি একবার ধরতে না পারলে আর সুযোগ পাওয়া যায় না। তাই চব্বিশ ঘণ্টা চোখ কান খোলা রাখতে হয়। একটানা অনেকক্ষণ কাজ করার মত শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতাও থাকা লাগে। সাংবাদিকতায় লেখার হাত ও কথা বলার গুণ থাকতে হয়। শিল্পের প্রতি আগ্রহ থাকলেও এ পেশায় জায়গা করে নেয়া সম্ভব।
জনমত গঠনে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, তবুও সাংবাদিকতাকে একটি ঝুকিপূর্ণ পেশা ও সংবাদপত্রকে একটি ঝুঁকিবহুল শিল্পের নাম বলা হয়। কেননা সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র হচ্ছে গোপনীয়তার শত্রু। যেখানেই সমাজ বিরোর্ধী দুর্নীতিবাজ স্বার্থন্বেষী অশুভ চক্রের ষড়যন্ত্র, সেখানেই সাংবাদিক তৎপর হন জানমালকে বাজি রেখে।
সংবাদপত্রের চ্যালেঞ্জ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন,'পত্রিকার দিন শেষ৷ কাগজ বিক্রির হিসাব কমছে৷ হালফিলের কাগজগুলো টিমটিম করে টিকে আছে৷ কিন্তু পড়তি কারখানার মতো এই টিকে থাকার সঙ্গে কখনওই স্বর্ণযুগের সংবাদপত্রের দাপটকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না৷' সংবাদপত্রে মৃত্যুর মূল কারণ হিসেবে ইন্টানেটের রমরমাকেই দায়ী করেছেন ওবামা৷ কিন্তু সিনেমার জন্মের পরও তো সমানভাবেই ছিল বইয়ের আকর্ষণ? মানুষ তো ভুলে যায়নি বই পড়তে? তবে কেন ইন্টারনেট কেড়ে নেবে সংবাদপত্রের গুরুত্ব? ওবামার ছোটো-হাসি জবাব, 'কারণটা সহজ৷ ব্যবসা৷ তার মন্তব্য, 'দেখুন, মধ্যবিত্তের সুখের দিন গিয়েছে৷ রোদে পিঠ দিয়ে বসে খবরকাগজ পড়াটা এখন বিলাসিতা৷' আমেরিকার একের পর এক সংবাদপত্র দপ্তরগুলির দরজায় তালা ঝুলছে৷ বেকার হচ্ছেন শয়ে শয়ে সাংবাদিক৷ কাজ হারিয়ে পথে বসছেন অসংখ্য ছাপাখানার কর্মী৷ বিজ্ঞাপনদাতারাও অধিক ভরসাযোগ্য মনে করছেন সাইটগুলিকেই৷ নিয়মিত সেখানেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন তারা৷ ফলে, শুকিয়ে যাচ্ছে খবর কাগজ৷ শুকিয়ে যাচ্ছে, সাদাপাতার ওপর কালো কালো অক্ষরের বর্ণময় জাদু৷ ছাপার কালির গন্ধ৷
আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রকাশনা 'ওয়াশিংটন পোস্ট'-এর উপর গ্রাহাম পরিবারের ৮০ বছরের আধিপত্য শেষের পথে। ২৫ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এই সংবাদপত্রের মালিকানা হাতে নিতে চলেছেন 'আমাজন ডট কম'-এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ বিজো। ইন্টারনেট রিটেল ব্যবসায় সফল জেফ জানিয়েছেন, এই বহুল প্রচলিত প্রকাশনাটির 'সাংবাদিকতার ঐতিহ্য' আগের মতই বজায় থাকবে। মিডিয়ার দুনিয়ায় সাম্প্রতিক ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাণ বজায় রাখা ও পাঠককে ধরে রাখা জেফের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১৯২০ সালে রেডিও ব্রডকাস্টিং হৈ চৈ ফেলে দেয় মিডিয়া জগতে। সমাজে প্রাথমিক তথ্য সরবরাহকারী হিসেবে তাদের ভূমিকা পুর্নমূল্যায়ন করতে থাকে সংবাদপত্রগুলো। আজকের দিনের নতুন মিডিয়া টেকনোলজির মতো, কমমূল্যের ও বিকল্প মিডিয়া-মাধ্যম বলাবলি শুরু করলো যে, নিউজপেপার ইনডাস্ট্রিকে ভূ-লুণ্ঠিত করে দেবে রেডিও। এই নতুন প্রতিযোগিতার জবাবে, পত্রিকার আবেদন প্রশস্ত ও অপেক্ষাকৃত বিস্তারিতভাবে পরিবেশনের জন্য আর্টিকেল বৃদ্ধি করলেন সম্পাদকরা; পত্রিকার ফরম্যাট ও বিষয়বস্তু ঢেলে সাজালেন । রেডিওর সাথে মানিয়ে নিতে না নিতেই সংবাদপত্রের সামনে আরেকটি নতুন ও অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মাধ্যম এসে হাজির হলো, হা হচ্ছে, টেলিভিশন। ১৯৪০ থেকে ১৯৯০ সালের ভেতরে আমেরিকার নিউজ সার্কুলেশন দুইজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন গ্রাহক থেকে তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন গ্রাহকে নেমে এলো। জনপ্রিয়তা হ্রাস সত্ত্বেও, টেলিভিশনের ব্যাপক উপস্থিতি নিউজপেপারের ভূমিকা অকেজো করতে পারলো না। কিছু কিছু পত্রিকা, যেমন USA Today প্রযুক্তির এই অগ্রগতিতে রুখে দাঁড়ালো। রঙিন-রূপে সাজলো, ব্যবহৃত হলো টেলিভিশনের মতো সংক্ষিপ্ত, ত্বরিত ও মূল বিষয়ের উপস্থাপনা ।
আজকের প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঐতিহ্যবাহী সংবাদ-মাধ্যমের সামনে ছুঁড়ে দিচ্ছে নতুন নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সম্ভাবনা। এর আগে এতো তথ্যের সমাহার বিপুল জনগোষ্ঠির নিকটে সমাগত হয়নি। ১৯৯০-এর শেষের দিকে ওয়েবসাইট ছিলো ৭০০, আজ তা হাজার হাজার। ইন্টারনেটে তথ্যের সংখ্যা ও তাৎক্ষণিক উপস্থিতি অতুলনীয়। তবে এ-ও সংবাদপত্র প্রকাশের বিদায়-সঙ্কেত দেয় না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলীর উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের জন্য সংবাদপত্র শক্তিশালী মাধ্যম। WAN ( Wide Area Network / টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক) – এর হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর এক বিলিয়ন (একশো কোটি) লোক এখনও প্রতিদিন সংবাদপত্র পাঠ করেন।
অনেকে বলেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে সংবাদপত্রের প্রভাব কমবে এটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ সবকিছু তাৎক্ষণিকভাবে দেখে ফেলছে। জেনে যাচ্ছে। তাই সংবাদপত্রের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেখা সংবাদ পরদিন সংবাদপত্রে দেখলে তা তো বাসি পানসেই মনে হবেই। অতীতে যা সংবাদপত্রে তরতাজা খবর ছিল এখন তা ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যানেল টেলিভিশনে চলে গেছে। কিন্তু না, এটা কোনো কারণ নয়। যদি তাই হতো তাহলে বিশ্বের অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে সংবাদপত্র উঠে যেতো। কারণ ওইসব দেশে টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি, সেই তুলনায় আমাদের দেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা অনেক কম। আমাদের প্রতিবেশী ভারতেও টিভি চ্যানেলের ছড়াছড়ি। এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ভারতে তিন শতাধিক চ্যানেল আছে। অথচ সেই ভারতে সংবাদপত্রের পাঠকসংখ্যা হ্রাসের পরিবর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৮ সালের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, গত বছর ভারতে সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। অথচ আমাদের দেশে এ সংখ্যা বাড়ছে না। রেডিও সংবাদ, টেলিভিশনের সংবাদ, আর পত্রিকার সংবাদের স্বাদ ভিন্ন। অধুনা তিনটি মাধ্যম তিন রূপে হাজির হয়েছে। এ তিন মাধ্যমের মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে না তা নয়, তবে তার চেয়ে বেশি সমন্বয় হচ্ছে। রেডিও-টেলিভিশন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর প্রচার করছে। অপরদিকে সংবাদপত্রের বুকে স্থান পেয়েছে রেডিও-টেলিভিশনের প্রকাশিত সংবাদ, অনুষ্ঠানসূচি ইত্যাদি।
সর্বশেষ হুমকি হয়ে এসেছে অনলাইন মাধ্যম। এটি রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের পরিবেশিত সংবাদের চরিত্র একসঙ্গেই প্রস্ফূটিত করতে পারে। এখানে শ্রবণ, দর্শন ও মুদ্রণ একসঙ্গে ব্যঙ্গময় হয়ে উঠতে পারে। রেডিও বা টেলিভিশনে একবার শোনার পর দ্বিতীয়বার শোনার সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে বারবার শোনা যায়, দেখা যায়, পড়া যায়। ছোট লেখা বড় করা যায়, বড় লেখা ছোট করা যায়। ইতিমধ্যেই এই শক্তিশালী মাধ্যমটিকে সঙ্গী করে নিয়েছে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশন। সব মাধ্যমের এখন ‘অনলাইন ভার্সন’ আছে। তবে অনলাইনের আলাদা রেডিও, টেলিভিশন বা সংবাদপত্র নেই। সম্ভবত প্রয়োজন নেই। অনলাইন নিজেই তিনটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেডিও, টেলিভিশন সংবাদপত্রকে বিদায় দিতে পারেনি। অনলাইনের হুমকি মোকাবেলা করে সংবাদপত্র কি তার রাজত্ব রক্ষা করতে পারবে? এ নিয়ে দুনিয়া জোড়া বিতর্ক। আমাদের দেশেও এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। প্রবীণরা বলছেন, সংবাদপত্রের মৃত্যু নেই। নতুনরা বলছে, সংবাদপত্রের পত্রচ্যুত হলে ক্ষতি কী? অনলাইনে সংবাদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তো কোনো বাধা নেই। কণ্ঠ মিলিয়েছে পরিবেশবাদীরা। সংবাদপত্রের জন্য বৃক্ষ নিধনে তারা ঘোর বিরোধী। এ ক্ষেত্রে প্রবীণ ও নতুনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য আছে। প্রবীণদের ডিজিটাল দেয়ালে সংবাদ পড়ায় অনীহা। নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তিবান্ধব। তারা এ যন্ত্র দিয়ে পুস্তক থেকে সংবাদপত্রণ্ড সবই পড়ছে, বড় বড় লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ছে, পছন্দমতো বই খুঁজে নিচ্ছে। বই খরিদও করছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে সংবাদপত্র হাতে নেওয়ার কোনো গরজ নেই। কোনো পরিবারের মা-বাবা যখন তাদের সন্তানকে খবরের কাগজের টাটকা কাহিনী শোনাতে যান, তখন সন্তান বলে, ওটি সে রাতে অনলাইনে পড়েছে। প্রযুক্তিবান্ধব নতুন প্রজন্ম লাইব্রেরির চেয়ে ডিজিটাল লাইব্রেরিতে বই পাঠ, সংবাদপত্রের চেয়ে অনলাইনে সংবাদ পাঠেই আগ্রহী।
অনলাইনের প্রবল আধিপত্যের মুখে পশ্চিমা দুনিয়ায় সংবাদপত্র সংকটের মুখে পড়েছে। একদা মার্কিন পত্রিকা নিউজ উইক ৮০ বছর দাপটের সঙ্গে চলেছে, এখন তার মুদ্রণ মাধ্যম বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। নিউজ উইক বলতে এখন কেবল অনলাইন ভার্সনই বোঝাবে। পশ্চিমা দুনিয়ায় সংবাদপত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে দিন দিন। এখন সেখানে নতুন প্রজন্ম অনলাইনে সংবাদ পড়ে। সেটিই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মও অনলাইনেই এখন সংবাদ দেখছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদপত্র ঝুঁকিতে পড়েনি, তার কারণ সুস্পষ্ট। এখানে কম্পিউটার এখনও সাধারণের কাছে পৌঁছায়নি। যাদের ঘরে কম্পিউটার আছে তারাও কম্পিউটার বান্ধব হয়ে ওঠেনি। অন্যদিকে গ্রামবাংলায় যোগাযোগ কাঠামোর প্রসার ঘটায় সেখানে সংবাদপত্র প্রবেশ করছে। যে কারণে সংবাদপত্রের বাজার অক্ষুণ্ন আছে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রসারও ঘটছে। এর মানে এই নয় যে, পশ্চিমা বিশ্বে সংবাদপত্র গুটিয়ে গেলে এখানে ব্যতিক্রম হবে। বড়জোর আয়ু দীর্ঘ হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা যদিও গোটা বিষয়টিকে নতুন প্রজন্মের পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন৷ তাদের মতে, আই-প্যাড স্ক্রিনের পর্দায় ভেসে ওঠা নিউজ আপডেটে অভ্যস্থ জেন-ওয়াইয়ের কাছে কাগজের পাতা ওল্টানোটা সত্যিই 'বিলাসিতা'৷ পাশপাশি তাদের মন্তব্য, এই প্রজন্ম সচেতন থাকতে চায় না৷ চায় হাতগরম গল্প৷ খবরকাগজ পড়লে সচেতনতা বাড়েতো ঠিকই, সেই সঙ্গে বাড়ে সাক্ষরতাও৷ ফলে, সহজেই বোঝা যায়, কেন কাগজেরপাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এই প্রজন্ম৷
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন-সংবাদের কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং আরও খোলামেলাভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সংবাদের শিরোনাম, সংবাদের বিজ্ঞাপন-বিরতি, খেলার সংবাদ, বাণিজ্য-সংবাদ ইত্যাদি নানা স্লট একেকটি কোম্পানির সৌজন্যে প্রচারিত হয়। এভাবে দেখা যাবে, সংবাদের কোনো অংশই আর টেলিভিশনের নিজের নয়, অন্যের সৌজন্যে সেসব প্রচারিত হচ্ছে। বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলো যেমন বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে পত্রিকার ব্যবসায় সহায়তা করে, তেমনি পত্রিকাও তাদের একেবারে সংবাদমূল্যহীন কর্মকাণ্ডকে পত্রিকায় ছেপে দায়বদ্ধতা পূরণের কাজটি করে থাকে। যেমন: জন প্লেয়ারের সমুদ্রসফর অবলীলায় সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় রঙীন ছবিসহ স্থান করে নেয়। বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে দায়বদ্ধতার কারণেই লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা, ফেয়ার এন্ড লাভলি বেনসন এন্ড হেজেস স্টার সার্চ, নেসক্যাফে সঙ্গীত সন্ধ্যা, পেপসি কনসার্ট ইত্যাকার বিষয়গুলো যেকোনো পৃষ্ঠায় সবচেয়ে বড়ো সংবাদ আকারে ছাপা হয়ে থাকে।
পৃথিবীব্যাপী সংবাদ পরিবেশনে এপি, এএফপি, রয়টার্স – এই তিনটি সংবাদসংস্থাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সংবাদসংস্থা তিনটি পশ্চিমা – যথাক্রমে আমেরিকান, ফরাসি ও ব্রিটিশ। ফলে আন্তর্জাতিক সংবাদগুলোতে একপাক্ষিক পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি পরিবেশিত হয়। আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, পশ্চিমা ও সাম্রাজ্যবাদী দেশের সরকার ও গণমাধ্যমের যে-মতামত পাওয়া যায়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও সেই একই সুর শোনা যায়। অপরদিকে পুঁজির বাজারও এখন গণমাধ্যমের দায়িত্বপালনে প্রধান অন্তরায়। পূর্বে সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ধরণ পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কারণ এখানে অন্তরায় হয়ে আছে বাজার। কিন্তু গণমাধ্যমকে ভাবতে হলে, এই বিরাট চ্যালেঞ্জকে মাথায় রেখেই নতুন ধারার সাংবাদিকতা বিকাশের জন্য কাজ করে যেতে হবে। আর বিদ্যমান গণমাধ্যমকে কীভাবে অধিক মাত্রায় জনসংশ্লিষ্ট করা যায় সেবিষয়েও নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
সেলিম রেজা নিউটন বাংলাদেশের মূলধারার কর্পোরেট মিডিয়ার সাংবাদকিতার ৫টি ‘কর্মসূচি’র কথা উল্লেখ করেছেন।এই কর্মসূচিগুলো হলো:১. নিজ নিজ বিজনেস-গ্রুপের পুঁজি-মুনাফা-ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করা;২. সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের বা ব্যবসায়িক খাতের সামগ্রিক স্বার্থ রক্ষা করা;৩. দেশী-বিদেশী কর্পোরেট পুঁজির অনুকূল সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ গঠন করা, তথা মার্কিন কায়দায় পুরোপুরি একটা ‘ভোগবাদী সমাজ’ গঠন করা;৪. ব্যবসার অনুকূল রাজনৈতিক ‘স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করা অর্থাৎ পশ্চিমা ঢঙের দ্বি-দলীয় ‘গণতান্ত্রিক’ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে চালু করার চেষ্টা করা, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তির বাইরে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ করা; এবং৫. আমাদের দেশে শক্তিশালী বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক অনুপস্থিতিতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-বেসরকারী পরিসরের এলিটদের নিয়ে রাজনীতিবিদগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলের পাল্টা সামাজিক শক্তি হিসাবে ব্যবসায়ীদের পরিচালনাধীন একটা ‘সুশীল সমাজ’ গঠন করা এবং তার নেতৃত্ব ঐ ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি হিসাবে সংবাদপত্রের বা মিডিয়ার হাতে রাখা।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো পড়তে গেলে মনে হয় এ-সংবাদপত্র নয়, যেন বিজ্ঞাপনপত্র পড়ছি। কারণ মাঝে মাঝে সংবাদই গৌণ হয়ে পড়ছে, বিজ্ঞাপনকে খাতির করতে গিয়ে সংবাদ তার বেশভূষা পাল্টাচ্ছে। এমন কিছু বিজ্ঞাপন দেখা যায় যেগুলো একেকটা সংবাদকে কিনে নিচ্ছে। বিশেষত খেলার খবরগুলো সহজেই অন্যের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। সেই সংবাদগুলোর মেক-আপ দেখলে এটা বুঝতে কোনো বেগই পেতে হবে না। সংবাদটির ছবি, ছবির ক্যাপশন, শিরোনাম যেমন সংবাদটির অংশ, বিজ্ঞাপনটি তেমনই ঐ খবরের অংশ। এভাবে শুধু একটি সংবাদ নয়, প্রায় পুরো পত্রিকাই বিক্রি হয়ে আছে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে। আমাদের দেশের সংবাদপত্রের মালিকদের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে থাকেন। সংবাদপত্রে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে সংবাদ ছাপা হওয়ায় অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সময়কালে মিডিয়ার বেসরকারীকরণ হয়েছে। ফলে নব্বই দশকের প্রথম দিকে মুদ্রণমাধ্যমের ‘বুম’ হয়েছে। নতুন শতকে হয়েছে সম্প্রচারমাধ্যমের বুম – সবই বেসরকারী খাতে। এই বাণিজ্যিক টেলিভিশন ও এফএম রেডিওগুলোতে দেখা যায় বিনোদনের আধিক্য, বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের বহুজাতিক এবং ব্যক্তিমালিকানাধিন বড়ো বড়ো কোম্পানিগুলোর মূল কাজ হলো বাইরের জিনিস এনে এদেশে বিক্রি করা। বাণিজ্যই এদের মূল ভিত্তি। বিশ্বায়ন-প্রক্রিয়া দ্বারা এরা উৎসাহিত। এরাই আবার কোনো কোনো পত্রিকার মালিক। তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই বৈশ্বিক গণমাধ্যমগুলোর মতোই এখানকার সংবাদপত্রের মূল কাজ হলো বাজারের সেবা প্রদান করা। আবার বিনোদন ছাড়া বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও এফএম রেডিওতে সংবাদ উল্লেখ্যযোগ্যমাত্রায় পরিবেশিত হয়। কিন্তু সেই সংবাদ অনুষ্ঠান শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞাপন প্রচারের স্লটেই বিভক্ত থাকে। আর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একদিকে পণ্যের প্রসারের উদ্যোগ যেমন নেয়া হচ্ছে, তেমনি ভোক্তাসংস্কৃতিকে পাকাপোক্ত করা হচ্ছে।
সংবাদপত্রের ভবিষ্যত
আমাদের দেশে পাঠক সংবাদপত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সারা দুনিয়ায় চিত্র ভিন্ন। মাত্র ক’দিন আগে মে মাসে (২০০৯) বাংলাদেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, গত এক বছরে (২০০৮) বিশ্বব্যাপী সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা ১ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে এশিয়া মহাদেশে বেড়েছে বেশী। এশিয়ার অংশ হিসেবে আমাদের দেশেও সংবাদপত্রের পাঠক বাড়ার কথা, কিন্তু বাড়ে নি। এ ক্ষেত্রে আরো একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো-ইলেকট্রনিক মিডিয়ার যুগে সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধনের যে প্রয়োজন তা আজো করা হয় নি। সর্বোপরি আজো আমাদের দেশে সাংবাদিকতা- রিপোর্টিং-এ তিনি বলেন, আরো বলেন-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধতাও পাঠককে বিশেষভাবে বিরক্ত করছে। সংবাদপত্রে জনগণের চিন্তা-চেতনা, দুঃখ-সুখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার যে প্রতিফলন ঘটার কথা তা ঘটছে না। ফলে পাঠকদের ক্ষোভ-দুঃখ হতাশায় পরিণত হবারই কথা।
বর্তমান ডিজিটাল এ যুগে যার মাধ্যমে এসব খবর আমরা মুহুর্তের মধ্যে পেয়ে থাকি তা হচ্ছে অনলাইন ভিত্তিক সংবাদপত্র। যার পরিধি পুরো বিশ্বজুড়ে। বিশ্বের যেকোন প্রান্তে বসে যেকোন সময় পুরো বিশ্বে ঘটে যাওয়া সব খবর আমরা পেতে পারি এর মাধ্যমে। ঘটে যাওয়া যে খবর পত্রিকার পাতায় আসছে কাল সকালে কিংবা আরো পরে ওই খবর মুহুর্তেই চলে আসছে অনলাইন পত্রিকায়। খবর জানার সময় এখন পরে নয় এ দাবিটি পুরোটাই পূরণ করছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। বর্তমানে দেশে ও বিদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রচুর। এ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষ অনলাইন সংবাদ পত্রের পাঠক। যারা নিয়মিতভাবে অনলাইন সংবাদপত্র পাঠ করেন এর মধ্যে আবার বেশীরভাগ তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি। এ তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা অনলাইনে সচিত্র সংবাদ পাঠ করতে খুবই আগ্রহী, যা অনলাইন ভিত্তিক সংবাদ সংস্থাগুলোর জন্য অত্যান্ত উৎসাহ ব্যঞ্জক বটে। বর্তমানে আমাদের দেশে এর চাহিদা ও গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বহু অনলাইন ভিত্তিক সংবাদপত্র সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি নিউজ, আল-জাজিরা ও বিডিনিউজ তন্মধ্যে অন্যতম।
করণীয়:
সংবাদপত্রকে চিন্তা-চেতনায় সামগ্রিক পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে এবং পরিহার করতে হবে দাসত্বের মনোবৃত্তি। সেই সঙ্গে চিন্তা-চেতনায় দেশ-জাতি-জনগণকে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রাধান্য দিতে হবে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয়তা, আন্তর্জাতিকতার ওপর। গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর। এ ক্ষেত্রে এই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার যদি হয় পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ, অনুকরণ ও আনুগত্যের নিরিখে-তাহলে হবে না। এটা আসতে হবে সৎ মানসিকতা থেকে। তাহলে নিশ্চিত করে বলা যায়, সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তা অনেকাংশেই কমে আসবে। মানুষ আস্থা ফিরে পাবে। আর মানুষের আস্থা ফিরে এলে সংবাদপত্রে কিছু লেখা হলে ‘কিছু হবে না’ এধরনের অভিযোগ আর উঠবে না।
সংবাদপত্রকে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। তা না হলে সেই সংবাদ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেনা। পাঠক চায় সঠিক সংবাদ। সংবাদপত্রে এমন কোন সংবাদ প্রকাশ করা যাবেনা, যা জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারে। সংবাদপত্র দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের খবর সঠিকভাবে তুলে ধরবে এই প্রত্যাশা সকলের। কিন্তু ইদানীং বেশ কিছু সংবাদপত্র দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ পরিবেশন করছে, যা মোটেই কাম্য নয়।
সাবেক মাকিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছেন, যদি কখনও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খব করা সম্ভব হয় তবে জনসাধারণের বাক স্বাধীনতা, শিক্ষার স্বাধীনতা, বক্তব্য, সভা-সমাবেশের মতো মৌলিক অধিকারগুলো অথহীন হয়ে পড়বে। সংবাদমাধ্যম যতই দুর্বল হোক না কেন এর স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের নিরাপত্তা কখনো নিশ্চিত হতে পারে না। যদি জনগণ স্বাধীন ও অবাধ তথ্য পায় তাহলেই তারা সঠিক ও সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ক্ষমতার সামনে যে মাধ্যম সত্য বলতে পারে তা হচ্ছে প্রকৃত সংবাদমাধ্যম। তবে সংবাদপত্রের এই সাহসের জোগান দিতে হবে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার মাধ্যমে। যারা সমাজকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখতে চান তারাই সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার অসৎ অভিপ্রায়ে লিপ্ত হন। মানুষের মতামত যেহেতু গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল সেহেতু তা নিয়ন্ত্রণ করার মানেই হচ্ছে তাদের সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করা। সরকার যদি তার নাগরিকদের স্বাধীনতা প্রদানে অপারগ হয় তাহলে সংবাদপত্র আর সাংবাদিকদের স্বাধীনতার কথা ভাবা একেবারেই অবান্তর।
দৈনিক পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য এখন কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু শুধু পুঁজি বিনিয়োগ করলেই একটা পত্রিকা দাঁড়ায় না। যে কোনো পত্রিকার প্রতিষ্ঠা অর্জনের ক্ষেত্রে যারা পত্রিকা পরিচালনা করেন ও তাতে নিয়মিত শ্রমদান করেন তাদের ভূমিকাই মুখ্য। একটি পত্রিকা কোন মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে পরিচালিত হবে তার নির্ধারক পত্রিকায় কর্মরত ব্যক্তিরা নন। বলাবাহুল্য, এটা নির্ধারিত হয় যিনি পুঁজি বিনিয়োগ করেন তার ধ্যান-ধারণা, নীতি ও প্রয়োজনের দ্বারা। সাংবাদিক সমিতি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন করে। কিন্তু তাদেরও অবাধ তথ্যপ্রবাহ ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিশেষ কিছু বলতে বা করতে দেখা যায় না। অনেক সময় তারা সাংবাদিকদের ওপর সরকারি হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এই হামলা তাদের ওপর আসে বিরোধী দলের সমর্থক হিসেবে কোনো কিছু করার কারণে, অথবা সরকারি লোকজনের কোনো দুষ্কৃতির বিরুদ্ধে সংবাদ পরিবেশনের জন্য। কিন্তু যারা এভাবে কিছু সাহসের পরিচয় দেন তারাও সংবাদ প্রবাহের ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতার কোনো প্রতিবাদ করেন না বা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এ ধরনের কোনো সংবাদ প্রকাশের চেষ্টা করেন না।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাফল্য-সম্ভাবনা ও উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা দরকার। তৃণমূলের খবরা খবর ওঠে না আসলে তাতে পরিপূণতা পায়না। দেশ জাতি এবং সমাজের কল্যাণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতপূর্বক পত্রিকার অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে একদিন তা বৃহত্তর মডেল হয়ে উঠতে পারে।পাঠক সংবাদপত্রে আশার আলো দেখতে চায়, চায় ভরসা। তাই সেই ভরসা, আশার আলো যারা দেখাচ্ছে পাঠকরা তাদের প্রত্যাখ্যান করে নি। তাদের পাঠকপ্রিয়তা বাড়ছে।
গুণীজনেরা সংবাদপত্রে এলে সমাজ পরিবর্তন হয়। স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার বিকাশে সংবাদপত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। ইদানীং ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার কারণে অনেক খবর মানুষ আগেভাগে পেয়ে গেলেও পত্রিকার কাটতি কমেনি। পাঠক বাড়ছে, মানুষ বাড়ছে। পাঠকের চাহিদা পূরণে আসছে নতুন নতুন দৈনিকও। পত্রিকা বাড়লে সমাজের লাভ। দেখতে হবে দায়িত্বে কারা আছেন। জ্ঞানী ও গুণীজনেরা সংবাদপত্রে এলে সমাজ পরিবর্তন হয়। অন্যায়, দুর্নীতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সাংবাদিকদের। লেখনীর মাধ্যমে দেশের ভেতরের সব অন্যায়, অপকর্ম, কুকর্মের বিরুদ্ধে লেখা আমাদের কাজ। সকল বিবেচনায় সংবাদপত্র এখনো সমাজের দর্পণ। সংবাদপত্র জাতিকে জাগাতে পারে, দুঃসময়ে সাথি হতে পারে। তরুণ-যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করাই হওয়া উচিত গণমাধ্যমের কাজ। শুধু নেতিবাচক সংবাদ জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে না। নিরপেক্ষ, সঠিক ও দ্রুত সংবাদ পরিবেশন করলে খুব অল্প সময়ে কোন পত্রিকা ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করতে পারে। একজ়ন দক্ষ ও বিচক্ষন সাংবাদিক তার দেশ ও জাতিকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারেন। দেশ ও জাতিরও উচিত এদেরকে সঠিক মূল্যায়ন করা ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণে সচেষ্ট রয়েছি বটে, কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন হত্যা কিংবা গুমের সম্মুখীন হন, তখন তা গণতন্ত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতদিন হয়ে গেল আমরা আজও জানতে পারলাম না কারা এবং কেন সাগর-রুনী সাংবাদিক দম্পতিকে হত্যা করেছিল। সংবাদপত্রের কর্মীরা এই হত্যার বিচারের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছেন। সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীরা যখন অনিশ্চয়তারকরে আর যাই হোক সত্যিকারের গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যাবে না। আমরা চাই সংবাদপত্র লিখুক, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশিত হোক, সরকারর দোষ-ত্র“টি ধরিয়ে দিক, সমাজে সব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হোক, তাহলেই গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং গণতন্ত্রকে আমরা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব।
সংবাদপত্র: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
বাংলাদেশে পত্রিকা অসংখ্য। কেবল ঢাকাতেই সাড়ে ৩শ’র বেশি। বাংলাদেশে এখন একটি কাগজও সংবাদ নিরপেক্ষ নয়। প্রত্যেক কাগজই নিজের স্বার্থ ও দৃষ্টিকোন থেকে সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। কাগজ পড়েই পাঠক বলে দিতে পারে পাঠক কাগজটা কোন পথে চলছে। এখনতো সাংবাদিকের নাম শুনেই পাঠক বলে দেয় তিনি কোন পথের পথিক। আমি আশা করবো দৈনিক সকালের খবর যেন তেমন না হয়। মতামত প্রকাশের জন্যেতো সম্পাদকীয় পাতা রয়েছে। সেখানেও আমি আশা করবো সব মত ও পথের সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্টরা যেন মত প্রকাশর সুযোগ পাবেন। আমি জানি দৈনিক সকালের খবর এর মালিকরা ইচ্ছা করলে স্বাধীন ভাবে একটি কেন দশটি কাগজ চালাতে পারেন। ভয় করে বা স্বার্থের মুখাপেক্ষী হয়ে কখনই ভাল কাগজ বা সম্মানিত কাগজ প্রকাশ করা যায়না।
উপসংহার:
সংবাদপত্র হচ্ছে ‘দ্রুততর শিল্প’। সমাজের দর্পণ পত্রিকা। সমাজের চিত্র ফুটে উঠে পত্রিকার মাধ্যমে। বস্তুনিষ্ট সংবাদপত্র দেশ ও সমাজকে পরিচালনার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। স্বাধীকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভূমিকা রেখেছে সংবাদপত্র। ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্ম এবং দেশের মানুষের মনন পরিচালনার জন্য সংবাদপত্র দৃঢ় ভূমিকা রাখে।বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও নিভীক সংবাদ পরিবেশন তথা সাংবাদিকতাই হলো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। সংবাদপত্রের মূল দায়িত্ব ও কতব্য হলো, দেশ জাতির বৃহত্তর স্বাথে কথা বলা, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মূখপত্র হিসাবে কাজ করা। সংবাদপত্রের এমন একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান হওয়া আবশ্যক যা কারো ক্ষতির কারণ হবে না বরং মানুষের কল্যাণে তা নিবেদিত হবে। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সমতাভিত্তিক সমাজ নিমাণের জন্য সংবাদপত্র কাজ করতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ, সুষ্ঠু এবং সত্য সংবাদ প্রকাশ করে সমাজ, রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবে সংবাদপত্র। সংবাদপত্রের দায়িত্ব অনেক। দুর্নীতিকে না, মাদককে না, ধুমপানকে না বলতে সংবাদপত্র বলিষ্ট ভুমিকা রাখতে পারে। সমাজে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য যা যা করার দরকার সংবাদপত্র তা করতে পারে।
©somewhere in net ltd.