নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টাটা অনেক বেশি রাজনৈতিক। এদেশে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনেরই অংশগ্রহণ থাকে। মুসলমান সম্প্রদায়ের উত্সব ঈদুল ফিতর , ঈদুল আজহা ও ঈদে মিলাদুন্নবী, হিন্দু সম্প্রদায়ের দূর্গা পূজা, বৌদ্ধদের প্রধান উত্সববুদ্ধ পূর্ণিমা, আর খ্রীস্টানদের বড়দিন-এই দিবসগুলোতে রাষ্ট্রীয় ছুটি থাকে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত দুষ্ট চিন্তা থেকে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সুপরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হিসাবে দেখানোর অপচেষ্টা চলে। বাংলাদেশের জনগণ ধর্মপ্রাণ; কিন্তু ধর্মীয় উন্মত্ততা নেই। একই গ্রামে হিন্দু মুসলমানরা পাশাপাশি ঘর বাড়িতে সহাবস্থান করে। মুসলমানদের অনুষ্ঠানে বৌদ্ধদের দেখা যায়, হিন্দুদের দুর্গাপূজার মণ্ডপ ও মেলায়ও মুসলমানরা যায়। ঈদের দিনের আনন্দে প্রতিবেশী খ্রিস্টানরাও অংশীদার হয়, বড়দিনের অনুষ্ঠানে মুসলিমরাও অংশগ্রহণ করে। মুসলমানরা সনাতন হিন্দু ধর্মের আচারে অভ্যস্ত কোনো হিন্দুকে দূরে সরিয়ে রাখে না। খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ জনগণও ধর্মাচরণে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় না। সাম্প্রদায়িকতার হীনম্মন্যতায় তাই এ সমাজে তেমন কেউ ভোগে না।
অপরদিকে প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর যে কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকেই বেশি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে থাকে। ভারত হল হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও শিখধর্মের উৎপত্তিস্থল।এই চারটি ধর্ম একত্রে ভারতীয় ধর্ম নামে পরিচিত। ভারতীয় ধর্মগুলি আব্রাহামীয় ধর্মগুলির মতোই বিশ্বের একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় যূথ। বর্তমানে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম যথাক্রমে বিশ্বের তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম ধর্মবিশ্বাস। এই দুই ধর্মের অনুগামীদের সংখ্যা ২ বিলিয়নেরও বেশি। লিঙ্গায়েত ও আহমদিয়া ধর্মমতের উৎপত্তিস্থানও ভারত। ফলে এটা স্পষ্ট যে, ভারতের জনসাধারণের মধ্যে ধর্মকেন্দ্রিক ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ভারতের ৮০% মানুষ হিন্দুধর্মের অনুগামী। ১৩% মানুষের ধর্ম ইসলাম। তা সত্ত্বেও শিখধর্ম, জৈনধর্ম ও বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব শুধু ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বে প্রতীয়মান। খ্রিস্টধর্ম,জরথুস্ত্রবাদ, ইহুদি ধর্ম ও বাহাই ধর্মের কিছু প্রভাব ভারতের সংস্কৃতিতে থাকলেও, এই ধর্মগুলির অনুগামীর সংখ্যা এদেশে অত্যন্ত কম। ধর্ম ভারতীয়দের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও নাস্তিকতাও সংশয়বাদের অস্তিত্বও সমাজে দেখা যায়। পরধর্মসহিষ্ণুতাও ভারতীয়দের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বলা হলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উপাসনালয়ে হামলা দেখা যায়।
যারা নিজ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন তারাই আমাদেরকে ধর্ম থেকে রাজনীতিকে পৃথক করার কথা বলেন। রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করে ফেললে রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীদের ভালো-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের ধারণাটা কোথায় পাবে? ধর্মবিশ্বাস ও ধর্ম চর্চা অনেকের মাঝে বন্ধন তৈরি করে যা আত্মীয়তার-ব্যবসায়িক-সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলতে সহায়ক হয়। পারস্পরিক সম্পর্ক-যোগসূত্র রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে। দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভবের মূলে থেকেছে ধর্মের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও সে দেশের রাজনীতি ধর্ম থেকে বিযুক্ত নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট শপথবাক্য পাঠ করেন বাইবেল ছুঁয়ে। একমাত্র ক্যাথলিক খ্রিষ্টান প্রেসিডেন্ট John Fitzgerald Kennedy (1917-1963) মারা যান ঘাতকের গুলিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলেছে প্রধানত খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধকে অনুসরণ করে। এ পর্যন্ত কোনো ইহুদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি। ফলে তাদের কাছ থেকেও ধর্মীয় সম্প্রীতির তালিম নেয়ার প্রয়োজন নেই।
রাজনীতি আর ধর্মকে আলাদা করতে চাওয়ার মানে হচ্ছে ধার্মিক আর রাজনীতিবিদকে আলাদা করা, হিন্দু-মুসলমান আর আওয়ামীলীগ-বিএনপিকে আলাদা করা। কিন্তু মানুষকে নিয়েই যে রাষ্ট্র গঠিত হয়। মানুষ যেমন তার মাতৃভাষাকে ভুলে যেতে পারেনা, তার মাকে ভুলে যেতে পারে না তেমনি সে তার চেতনা বা আদর্শকেও ভুলে যেতে পারে না। এটাতো আর এমন নয় যখন সে মসজিদে যায় তখন মুসলমান, যখন ভোট দিতে যায় তখন মুসলমান থাকেনা হয়ে যায় আওয়ামীলীগ কিংবা জামায়াত। দিনরাত তথা জীবনের পুরো সময়টাতেই মানুষ তার নানান আত্মপরিচয় ধারণ করে। দেশের মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ হলেই কেবল রাষ্ট্রধর্ম নিরপেক্ষ হতে পারে। তাছাড়া আইন করে রাষ্ট্রকে বিশুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ করা অসম্ভব। ধর্ম থেকে রাজনীতি বা রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা সম্ভবপর নয়।
ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসার শুরু হয়েছিল ১২০০ শতকে। সম্প্রতি শৌখিন এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ রংপুরের রামজাপুরনামের গ্রামে পেয়েছেন এমন এক মসজিদের ধ্বংসাবশেষ, যেটিসপ্তম শতকে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। সত্যতা প্রমাণিত হলে এটিই হয়তো হবে দক্ষিণ এশিয়ায় নির্মিত প্রথমমসজিদের নিদর্শন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা যাবে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায়ই বাতাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম ধর্ম। ফলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, হাজার বছর ধরে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সম্প্রীতিতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বিরাজ করেছে এ উপমহাদেশ।
সতেরো শ’ সাতান্ন থেকে ঊনশি শ’ সাতচল্লিশ পর্যন্ত ইংরেজদের কাছে শোষিত এজাতি আজও মেরুদন্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারেনি। অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত বলে মনে করে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার কখনও ভাল কিছু বয়ে আনেনি, ধর্ম ও রাজনীতিকে আলাদা রাখতে হবে। যুক্তি হিসাবে দৃষ্টান্ত পেশ করতে যেয়ে বলেন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্ষতিকর প্রভাব রাষ্ট্রকে কতভাবে আক্রান্ত করতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো তার প্রমাণ। যে যাই বলুক, ব্যক্তিজীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চাকারী নেতা কর্মী ছাড়া পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল গঠনই সম্ভব নয় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রতো অনেক দুরের কথা।
সতেরো শ সাতান্ন সালের তেইশ জুন থেকে উপমহাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হয়। সিরাজ-উদ-দৌলা সম্পর্কে বিদ্বেষ ছড়াতে গিয়ে ইংরেজরা হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের বীজ ছড়ায়েছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে অন্যতম হাতিয়ার করে দু’শ’ বছর শাসন করে গেছে ইংরেজ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যে বীজ তারা সযত্নে রোপণ করেছিল তা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি এ অঞ্চল।গোটা উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এখনও সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব বাস্তবতা অনুযায়ী এ অস্ত্র প্রয়োগ হয়।
বাংলাদেশের জন্মের সরাসরি বিরোধিতাকারী দলও স্বাধীনতার পর শাসন ক্ষমতার অংশীদার হয়ে দেশ পরিচালনা করেছে।এদেশের মানুষের হৃদয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের শক্তিশালীভাবে জায়গা না হলেও নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য অনেক রাজনৈতিক দলের কাছেও জামাই আদর পায় তারা। রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করতে হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার এ জায়গাটি বুঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক রাজনৈতিক দল দেশবিরোধী কাজও করে থাকে। বাংলাদেশে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার অনেক দেশের চেয়ে মাত্রা এবং চরিত্রগতভাবে সম্পূর্ণ আলাদা। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্যরাও ধর্মকে প্রয়োজনে জনমানুষের সমর্থনের জন্যে ব্যবহার করে।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আর ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক দল এক নয়। সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে মুসলিম লীগের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দু সম্প্রদায় আর জামায়াতে ইসলামীর লক্ষ্য হচ্ছে বামপন্থী প্রগতিশীল সহ সব ধরনের সেক্যুলার গোষ্ঠী। রাজনীতি ও সমাজ জীবনে ধর্মের বাড়াবাড়ি বেড়েই চলছে। দু’হাজার এক সালের এগারো সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে বোমা বিস্ফোরণের পর বিশ্ব রাজনীতিতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের চরম অবনতি এ সময়ের মৌলবাদী রাজনীতির উল্লেখযোগ্য দিক।বিশ্ব রাজনীতির নয়া মেরুকরণ এদেশের রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে।
আমি দেখেছি অনেক মাদ্রাসাতেও হিন্দু শিক্ষক, এক ধর্মের অনুসারীদের সাথে অন্য ধর্মের অনুসারীদের বন্ধুত্ব-সম্পর্ক-আদানপ্রদান-লেনদেন। শুনেছি ঝড়ের সময় মসজিদে আশ্রয় নিয়ে হিন্দুর মুখে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার কথা।ফলে এমন দেশে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছিটিয়ে ধর্মীয় সম্প্রীতিকে নষ্ট করার অপচেষ্টায় অনেক স্বার্থান্বেষী মহল জড়িত। ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ক্ষমতাশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে সহিংসতার বিস্তার ঘটায়। ধর্মীয় উগ্রতা-ধর্মান্ধতা-ধর্মীয় গোড়ামি কিংবা ধর্মীয় বিদ্বেষ আমাদের এঅঞ্চলের ঐতিহ্য নয়; আমাদের তিন হাজার বছরের ঐতিহ্য হলো ধর্মীয় সহাবস্থান। ফলে কেউ ধর্মকে ব্যবহার করে ঘৃণা কিংবা সহিংসতা ছড়াতে পারবে না। বাংলাদেশে কিছুক্ষেত্রে ধর্ম রাজনীতিতে ব্যবহারিত হচ্ছে ধার্মিক সেজে জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের আশায়। রাজনৈতিক ধর্ম, প্রাত্যহিক ধর্ম , ধর্মীয় রাজনীতি-এভাবে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করে তোলা হচ্ছে।যারা ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করার কথা বলেন তারা কি ধর্মের অপব্যবহার ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করার কথা বলেন। ধর্মকে অপব্যবহার করে ন্যায়ভিত্তিক ও সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না এটা চরম সত্য। শুধুমাত্র ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে সহিংসতার উত্থান ঘটেছে এমন ঢালাও মন্তব্য অনেকে করে থাকেন। তবে রাজনীতি থেকে ধর্মকে একেবারেই আলাদা করে ফেলার চেষ্টা বিভাজন-বৈষম্য-বিদ্বেষ ছড়ায়ে পরিশেকে ঘোলাটে করবে এটা নি:সন্দেহে বলা যায়।
©somewhere in net ltd.