নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং নগরের নি:স্ব শ্রেণীর মানুষের অপেক্ষাকৃত ভাল জীবনযাপনের আশার অপূরণজনিত অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।একদিকে স্থানীয় অভিবাসন বাড়ছে, তৈরী পোশাক শিল্প জাতীয় আয়ে বড় ভুমিকা রাখছে আরেকদিকে ফরেন রেমিটেন্সও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আর এসবগুলোর পেছনে বিরাট ভুমিকা রাখছে নি:স্ব মানুষেরা।যারা সবচেয়ে বড় বড় বিল্ডিং গড়ছে তাদের স্থান বস্তি কিংবা ফুঁটপাতে। যারা শিল্পকারখানায় কাজ করে নিজেদের দুমুঠো অন্ন আর পরিধেয় বস্ত্রের সংস্থান করতে পারেনা তাদেরই অবদানে পুজিঁপতিরা বিলাসী যিন্দেগী যাপন করে। যারা রোগে শোকে মরলেও অর্থের অভাবে চিকিrসা করতে পারেনা, সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠাতে পারেনা, শীতেও গরম কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারেনা তাদেরই শ্রম শোষণ করে বড়লোক আরো বড়লোক হন। অনেক ফোটা গাম, বহু চোখের অশ্রু, শরীরের লাল রক্ত এমনকি মূল্যবান জীবনের বিনিময়ে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের বিত্ত বৈভব- প্রভাব প্রতিপত্তি গড়ে ওঠে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনে এদের ভুমিকাকে সবসময় খাঁটো করা হয়।সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধির জন্যে এদেরকে যতটা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়, এদের যাপিত জীবনের অনিবার্য বাস্তবতাগুলোকে ততটাই গুরুত্বহীনভাবে বিবেচনা করা হয়।
আর বহুবিধ সংকট ও সমস্যা সৃষ্টির জন্যে যারা মূলত দায়ী তাদেরকে বেকারত্ব নিরসনে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী মহৎ মানুষ হিসাবে পরিবেশন করা হয়। তারা যেভাবে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশের বস্তি কিংবা ফুটপাতে থাকে, মানবেতর জীবন যাপন করে, অমানুষিক পরিশ্রম করে তাতে মৌল মানবিক চাহিদা অপূরণ থাকা যৌক্তিক নয়। কর্মক্ষম মানুষ অলস-বেকার-কর্মহীন হলে তথা বৈধ উপায়ে মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হলে সমাজে অশান্তি বাড়বে।বিদ্যমান বাস্তবতায় নগর প্রলেতারিয়েতের জীবন-জীবিকা, টিকে থাকার সংগ্রাম, বঞ্চনার ইতিহাস, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও নানাবিধ পরিবর্তনকে বুঝা এবং এ সংক্রান্ত গবেষণা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।
আরবান প্রলেতারিয়েতের জীবন ও জীবিকার প্রসঙ্গটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশে অনেকে নগর নি:স্ব জীবনের বহুবিধ সংকট আছে। ইংরেজিতে Proletariat শব্দের বাংলা হিসাবে সর্বহারা ব্যবহার করা হয়। Proletariat শব্দটা এসেছে লাতিন Proletarius শব্দ থেকে ফরাসী ভাষায় মাধ্যমে। প্রলেতারিয় শ্রেণী আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডের ঘটা শিল্প বিপ্লবের সৃষ্টি। বৃহদায়তন মেশিন পত্রের উদ্ভাবন শিল্পকে তুলে দেয় বড় বড় পুঁজিপতিদের হাতে এবং শ্রমিকের সম্পত্তিকে অকেজো করে। উৎপাদনের সকল উপায় চলে যায় পুঁজিপতিদের দখলে এবং শ্রমিকরা নি:স্ব হয়ে পড়ে। প্রাচীন রোমে একদল মানুষ ছিল খুবই গরীব। এদের বলা হতো প্রোলেতারিস। এরা ক্রীতদাস ছিল না। ছিল মুক্ত নাগরিক। কিন্তু এরা ছিল খুবই গরীব। এদের অনেক সন্তান হতো। যাদের নিয়ে এরা খুবই গরীবি হালে বাস করতো।
প্রলেতারিয়েতের প্রতিশব্দ হিসাবে গ্রামশি ব্যবহার করেছেন সাবলটার্ন। Subaltern শব্দের সাধারণ অর্থ অধ:স্তন বা নিম্নস্থ। ইংরেজিতে এর সমার্থক শব্দ হলো সাবর্ডিনেট। সাবলটার্ন (ইতালীয় ভাষায় সুবলতার্নো) শব্দটির মাধ্যমে গ্রামশি দেখেছেন যেকোনো শ্রেণী বিভক্ত সমাজে ক্ষমতা বিন্যাসকে একটি সামাজিক সম্পর্কের প্রক্রিয়ার মধ্যে যার এক মেরুতে অবস্থিত প্রভুত্বের অধিকারী “ডমিন্যান্ট শ্রেণী’ অন্য মেরুতে যারা অধীন সেই সাবলটার্ন শ্রেণী। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সাবলটার্ণ শ্রেণী হলো শ্রমিক শ্রেণী। গ্রামশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াটির ওপর যার মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণী কেবল শাসনযন্ত্রে তার প্রভুত্বই প্রতিষ্ঠা করে না, সৃষ্টি করে এক সার্বিক সামাজিক কর্তৃত্ব বা হেজেমনি। সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের জগতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে হেজেমনিক বুর্জোয়া শ্রেণী তার শাসনের নৈতিক ভিত্তি হিসেবে সাবলটার্ন শ্রমিক শ্রেণীর কাছ থেকে সামাজিক সম্মতিও আদায় করে নেয়।
রণজিৎ গুহ সাবলটার্ন- এর বাংলা অনুবাদ করেছেন নিম্নবর্গ। আধিপত্যকামী ইতিহাসের আধুনিক পর্বে নিম্নবর্গকে দেখানো হয় চৈতন্য ও বিবেক বিবেচনাহীন। তাদেরকে ভাবা হয় প্রযুক্তিহীন, আধুনিকতাহীন ও বিজ্ঞানের আলো থেকে দূরের মানুষ হিসেবে। দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসবিদ যাঁরা ধারাবাহিক সংকলন Subaltern Studies এ সংযুক্ত, তাঁদের কাজের মাধ্যমে এই ধারা তৈরি হয়েছে। তাঁদের কাজের মাধ্যমে এই ধারা তৈরি হয়েছে। তাঁদের প্রয়োগে সাব অল্টার্ন বলতে বোঝায় যে কোনো অধস্তন সামাজিক গোষ্ঠী, তা সে শ্রেণী, লিঙ্গ, বয়স, জাতির কিংবা ধর্ম যে ভিত্তিতেই হোক না কেন। এই ইতিহাসবিদগণের অনেকেই বাংলাভাষী এবং তাঁরা নিজেরাই সাব-অল্টার্ন শব্দটির বাংলা করেছেন নিম্নবর্গ।
মার্কস Proletariat বলতে বুঝিয়েছেন সাধারণ খেঁটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষকে। তাদের কোন সম্পত্তি নেই। সম্পদের মালিকানা না থাকায় তারা জীবিকা অর্জন করে কেবল তাদের কায়িক শ্রম বিক্রি করে। প্রলেতারিয় শ্রেণী নিজেদের কোন উৎপাদন উপকরণ না থাকায় নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়।মূলধন থেকে প্রাপ্ত মুনাফার উপর নয় বরং শ্রম বিক্রয়ের উপরই যাদের জীবিকার উপায় সমগ্রভাবে নির্ভর করে।যার সুখ ও দু:খ, জীবন ও মৃত্যু, যার গোটা অস্তিত্ব নির্ভর করে শ্রমের চাহিদার উপর, নির্ভর করে সুসময় ও দু:সময়ের পরম্পরার উপর, বলগাহীন প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত হ্রাস বৃদ্ধির উপর। এককথায়, ‘প্রলেতারিয়েত’ বা প্রলেতারিয়ান শ্রেণী বলা হয় ঊনবিংশ শতকের শ্রমিক শ্রেণীকে।প্রলেতারিয়রা সকল রকমের মালিকানা থেকে বঞ্চিত, যারা নিজেদের এবং নিজ নিজ পরিবারবর্গের অস্তিত্ব ধারণের পক্ষে প্রয়োজনীয় উপায় সম্ভারের জন্য বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। একজন প্রলেতারিয় নিজের শ্রমকে বিক্রি করে ঘন্টা বা দিনের হিসাবে। প্রত্যেকটা প্রলেতারিয় হচ্ছে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণী ব্যবস্থার সম্পত্তি। সে তার শ্রম ইচ্ছামত বিক্রি করতেও পারে না। এই ক্রয় বিক্রয় নিয়ন্ত্রিত হয় মালিকপক্ষের প্রয়োজন ও চাহিদা দ্বারা।
নগরের প্রলেতারিয়দের ওপর বিভিন্ন পরিসরে উন্নয়ন পলিসি এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব, বহুবিধ সংকট, জ্ঞাতি সম্পর্কের রদবদল, পরিবার ও গৃহাস্থলীর পরিবর্তন, সম্পর্কের নয়া মেরুকরণ, অভিবাসনের সাথে ক্ষমতা সম্পর্কম, লিঙ্গীয় ও শ্রেণী বৈষম্যকে সম্পৃক্ত করে পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন মিডিয়া, টকশো কিংবা ইন্টারনেটে ব্যাপক লেখালেখি হয়নি। দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর-পেশার-ধর্মের-অঞ্চলের নি:স্ব মানুষদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, বিশ্বাস ও চর্চার ভিন্নতাগুলোর সংমিশ্রণ ঘটে মিশ্র সংস্কৃতি তৈরি হয়। সামাজিক বাস্তবতা ও তাদের বাস্তবতার সমন্বয়ে নতুন ধরনের বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে যা অভিবাসি এলাকায় বেড়ে ওঠা শিশুদের সামাজিকীকরণে প্রভাব ফেলছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় জ্ঞান বা লোকায়িত জ্ঞানগুলোর সংমিশ্রণ ঘটছে।
বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাস্তবতার বাইরে নয়।আর নগর প্রলেতারিয়দের অধিকাংশ যেহেতু চরম দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে তাই তাদের যাপিত জীবনে দারিদ্রতার প্রকোপ ও প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার আছে। Attacking Poverty শীর্ষক World development Repot, 2000- অর্থনীতিবিদ রবি কানবুর দেখান যে, দরিদ্র মানুষের ক্ষমতাহীনতার সমস্যার সমাধান না হলে দরিদ্র মানুষের ক্ষমতাহীনতার সমস্যার সমাধান না হলে দারিদ্র দূর করা সম্ভব নয়।তিনি দরিদ্রদের নিরাপত্তা, দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন,দরিদ্রদের জন্য সুযোগ সুবিধা- এতিনটি বিষয়কে প্রথমেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্থান দেন।তিনি প্রমাণ করেন যে, দরিদ্ররা শুধু ক্ষমতাহীনই নয়, তারা বাকহীন, বাণীহীন, মূক বা নিরব। দরিদ্ররা ভীত এবং তারা নাজুক ও অসহায়ও বটে।তিনি প্রশ্ন তোলেন, দারিদ্র বিমোচনের জন্য কোনটি আগে দরকার আয়, ভোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি-নাকি ক্ষমতা, মতপ্রকাশ বা কথা বলার অধিকার, ভয়ভীতিহীন পরিবেশ, অসহায় দশা থেকে মুক্তি লাভ। দারিদ্র দু’রকমের-আপেক্ষিক এবং চরম। একজনের কিছু আছে, কিন্তু অন্যের তা নেই। যার নেই সে না থাকবার কারণে অপরের তুলনায় দরিদ্র। একে বলে আপেক্ষিক দারিদ্র। আর চরম দারিদ্র হচ্ছে, আয়ের এমন স্বল্পতা যার ফলে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে কষ্ট হয়।মানুষের স্বাস্থ্য এবং স্বাভাবিক কর্মদক্ষতা অক্ষুণ্ন থাকেনা।
নগর নি:স্ব প্রলেতারিয় শ্রেণীর টিকে থাকার প্রচেষ্টা ও উপায়কে গভীরভাবে বুঝা তথা নগর প্রলেতারিদের জীবনের বিভিন্ন দিকের অনুসন্ধান, তাদের জীবনধারা, সমাজ সংস্কৃতি, আচার আচরণ, নারী ও শিশুর জীবনে বিশেষ প্রভাব, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আইনের সাথে তাদের যাপিত জীবনের সম্পর্ক, বিরাজমান নিয়ম নীতি ও বিধি বিধানকে সুস্পষ্টরুপে উন্মোচন করা তথা সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার কার্যকরণ তুলে ধরা মোটেই সহজ কাজ নয়।অভিবাসিদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক তথা সার্বিক দিক পর্যবেক্ষণের জন্যে যে সময় ও সুযোগ দরকার তা চাহিদানুযায়ী পাওয়াটাও কঠিন। তারপরও নগরের নি:স্ব মানুষদের জীবন-জীবিকা, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, বিভিন্ন সংকট, জীবনে পরিবর্তন ও জগত সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার এবং আর্থসামাজিক প্রভাবকে অনুধাবনের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
কেউ ভোটের রাজনীতি করে, কেউ পেটের রাজনীতি করে। রাজনৈতিক স্বার্থে দলীয় নীতি আদর্শকেও জলাঞ্জলি দেয়। স্বার্থটাই যেখানে মূখ্য দেশপ্রেম, মানবপ্রেম, সমাজসেবার কথা সেখানে কথার কথা। নগর নি:স্ব প্রলেতারিয় দরিদ্রদের অভাব অভিযোগ শুনলে মনে হয় তাদেরকে ব্যবহার করে অনেকেই ক্ষমতা ও বিত্ত হাসিল করে। শহরের খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন জীবিকাকে বুঝতে যেয়ে, তাদের দু:খ কষ্টকে উপলব্ধি করে মনে হয়েছে তারা আসলে স্বাধীন মুক্ত জীবন যাপন করতে পারে না। সত্যিকারের মানুষ হিসাবে টিকে থাকার জন্যে যে সুযোগ সুবিধা থাকা দরকার তার বিন্দুমাত্রও তাদের নেই। অত্যন্ত সংকীর্ণ কাঠামোর মধ্যে নিম্নশ্রেণীর মানুষ পরাধীন জীবন যাপন করে। তাদের শক্তির অক্ষমতা, অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের ব্যর্থতার দায়ভার যে শুধুমাত্র তাদের এমনটি নয়।
আধিপত্যশীল সিস্টেমের খপ্পর থেকে না তারা না বেরুতে পারে, না তারা সইতে পারে, না প্রতিবাদ করতে পারে। তাদের এই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়াটা যেন এক অলিখিত নিয়মছাড়া কিছু নয় । প্রলেতারিয়রা তাদের স্বার্থ উদ্ধারে বুর্জোয়াদের ব্যবহার করতে পারে না, নিজেরা বুঝে না বুঝে কিংবা ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বুর্জোয়াদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহারিত হয়।
বাইরের জগতটা যদি ক্রমাগত বৈরী আচরণ করতে থাকে আর ভেতরের জগতেরও যদি প্রশান্তিদায়ক কোন উৎসের সন্ধান পেতে ব্যর্থ হয় তখন জীবনটাকে বয়ে বেড়ানোটা বিরক্তিকর ও অস্বস্তিদায়ক হয়ে ওঠে। শরীরে ইন্দ্রিয়গুলো যখন মনের চাহিদা অনুযায়ী অনুভূতি উদ্রেককারী ঘটক-অনুঘটকের অভাববোধ করতে থাকে বিকাশ ও বৃদ্ধির প্রয়াসের চেয়ে তখন অস্তিত্বের প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দেয়। জগতের পরিবেশ বা বাহ্যিক অবস্থার সাথে অভিযোজিত হবার দৈহিক সক্ষমতা যেমন প্রাণের অস্তিত্বের স্বার্থেই অতিব প্রয়োজনীয় তেমনি জাগতিক পারিপাশ্বিকতা ও শারীরিক অবস্থার সমন্বয়ে সৃষ্ট বাস্তবতার ভুমিকাও মানসিক অবস্থা নির্ধারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রলেতারিয়দের অনেকের এমন অবস্থা যে, প্রভাবশালী বুর্জোয়াদের সুনজরে পরতে নিজের বউকেও দিতে রাজি হয়, ক্ষমতাধরদের সামান্যতম সান্নিধ্যে তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে, বড়লোকের সাথে সুসম্পর্কের সুবাধে নিজেও অন্যদের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠে। যেন সেই ব্যকটেরিয়ার মতো যে জীবের সংস্পর্শে জীব আর জড়ের সংস্পর্শে জড়।
অনেক প্রলেতারিয়রা তাদের খারাপ অবস্থার জন্যে নিজেদেরকেই দায়ী মনে করে বলে ‘অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়’, ‘না জানি কোন পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে হচ্ছে’। ‘ভাগ্যের লিখন যায়না খন্ডন’, ‘চার আঙ্গুল কপালের বেশি পাওয়া যায়না’, ‘হায়াত-মউত-রিযিক আল্লাহর হাতে’,-এসব বলে তারা নিজেদের দু:খ কষ্টের জন্যে অন্যকে দায়ি না করে নিজের ভাগ্যের ফল বলে মেনে নেন। নিজেদের অবস্থাকে মানসিকভাবে গ্রহণ করে নিতে বলেন-‘মুখ দিয়েছেন যিনি আহারও জোগাবেন তিনি’, ‘চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়-ত্বকদিরেতো থাকতে অইবো’-বলে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে দোষারোপ না করে তা পরিবর্তনের চেষ্টায় শরিক হওয়া থেকে বিরত থাকেন তারা। ‘দুনিয়াতে যার সম্পদ কম আখেরাতে তার হিসাব সহজ হবে’, ‘কষ্টে চলি তবে সাহেবগো মতো হারাম খাইনা-হালাল খাই’, ‘আজ মরলে কাল দুদিন’, ‘কষ্ট হলেও দু:খ নাই- বেহেশত পাইলেই অইবো’-বলে মনে তৃপ্তি পান তারা। অনেকের মুখে অবশ্য ক্ষোভের কথাও শুনা যায়-‘গরিবের কি আর ভগবান আছে’, ‘আমগো জন্মানোটাই পাপ অইছেরে ভাই’, ‘যদি ভাল মানুষই হইতাম সারাদিন জম্মের মতন খাইট্ট্যাও ভাত মিলবোনা ক্যানরে বাপ’, ‘যত বিপদ মুসিবত সব গরিব ম্যানসের লাইগ্যা’, ‘খোদার পরীক্ষা সব আমগো লাগি’।
আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন প্রলেতারিয়রা বুর্জোয়াদের সাথে এমনভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকে যে, তাদের হাসি কান্না, বোধ বিশ্বাস ও আচরণ সবই তাদের সাথে বুর্জোয়াদের করা ব্যবহারের ওপরই যেন নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রলেতারিয়দের অধিকাংশের জীবনটা নিজস্ব পরিকল্পনা দ্বারা সুপরিচালিত নয়, অধিকাংশক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়ারই নামান্তর মাত্র।তারা যতটা না প্রভাব ফেলে তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়, যতটা না নিয়ন্ত্রণ করে তার চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রিত হয়। এদর অনেকে বুর্জোয়াদের সাথে সামান্যতম সম্পর্কের সুবাধে নিজেদেরকে একটু আলাদা করে ভাবতে শিখে তারপরও তারা যতই পরিকল্পনায়,নীতি আদর্শে, জীবন যাপন পদ্ধতিকে নিজস্ব বলে ধরে নেয় না কেন বাস্তবে তারা আসলে আধিপত্যশীল মতাদর্শ ও সিস্টেম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-প্রভাবিত-পরিচালিত। ফলে প্রচলিত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় প্রলেতারিয়দের স্বপ্নের জগৎ, চিন্তাভাবনার জগৎ, বাস্তব জীবন ও কর্ম জগৎ কিংবা সুখময় ভবিষ্যতের কল্পিত জগতের আমূল পরিবর্তন ঘটবে না যদি না পদ্ধতিগত ত্রুটির সংশোধন, নতুনত্ব আনয়ন,সময়োপযুগী প্রায়োগিক সংস্কার ও শক্তিশালীভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন করা না যায়।
©somewhere in net ltd.