নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সমৃদ্ধ আগামীর প্রত্যেয়

আনিসুর রহমান এরশাদ

আমি আমার দেশকে অত্যন্ত ভালবাসি ।

আনিসুর রহমান এরশাদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বেকারত্বের নিষ্ঠুরত্ব, সামাজিক ব্যবসা ও সমৃদ্ধ পৃথিবীর স্বপ্ন

১৭ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:৪৩

আমাদের অধিকাংশেরই মন মানসিকতা এমনভাবে গড়ে ওঠেছে যে, চাকরগিরী কিংবা কেরানিগিরী করা ছাড়া স্বাধীন উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তাও যেন আমরা করতে পারিনা। ফলে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখে যখন শুনি, তরুণরা চাকরিপ্রার্থী নন, তারা চাকরিদাতা। পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না, বিশ্বে একজন মানুষও বেকার থাকবে না। সুস্থ শরীরের একজন মানুষ বেকার থাকবে- এটা হতে পারে না। তখন অনেকে বিস্মিত হয়, অনেকে আবেগী হয়। চমৎকৃত হওয়া মানেইতো চ্যালেঞ্জকে গ্রহণের মতো সাহসী হওয়া নয়।ফলে লেখাপড়া শেষে অনেকে আশা ভরসা নিয়ে চাকরীর সন্ধানে নামে এবং বেকার হওয়ায় সমাজে অপমান আর অবহেলার শিকার হয়।



বেকারত্ব কি ?

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুসারে, বিগত চার সপ্তাহ ধরে কাজ খুঁজেছে তবে কাজ পায়নি কিন্তু আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কাজ পেতে পারে বা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিদ্যমান মজুরিতে কাজ শুরু করবে এমন কর্মক্ষম মানুষকে বেকার বলা হয়৷



অধ্যাপক পিগুর ভাষায়, 'ঐ অবস্থাকেই বেকারত্ব বলা হয় যখন কর্মক্ষম ব্যক্তিরা প্রচলিত মজুরীতে কাজ করতে ইচ্ছুক হওয়া সত্তেও যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পায় না।' এখানেও অনিচ্ছাকৃত বেকারত্বের কথাই বলা হয়েছে।



বিত্তবান লোকের সন্তান যাদেরকে আলালের ঘরের দুলাল বলা হয় তাদেরকে বেকারদের তালিকায় ফেলা ঠিক নয়। কারণ তারা কর্মক্ষম হওয়া সত্তেও কোন কাজ না করে বাপ দাদার সঞ্চিত সম্পত্তি ভোগ করে আলস্যে দিন কাটায়। এরূপ ইচ্ছাকৃত কর্মবিমুখদের ঠিক বেকার বলা না গেলেও, এরাও কিন্তু এ জাতির জন্য একটি অভিশাপ।



বেকারত্ব: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আইএলও) তথ্যমতে, পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি বছর কর্মবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ২৭ লাখ আর চাকরি পাচ্ছে ১ লাখ ৮৯ হাজার। অর্থাৎ মাত্র ৭ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারত্ব বাড়ার হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বেকারত্বের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে বেকারের সংখ্যা ছয় কোটিতে দাঁড়াবে। সংস্থাটির মতে, বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ বেকার, বর্তমান কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ২ শতাংশ। মোট বেকারের মধ্যে আংশিক বা পার্ট টাইম বেকারের সংখ্যাই বেশি।



দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানাচ্ছে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিও (ইউএনডিপি)। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০-৯৫ সালে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী বেকার জনগোষ্ঠী ছিল ২৯ লাখ। ২০০৫-১০ সালের মধ্যে তা প্রায় পাঁচ গুণ বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটি ৩২ লাখে।



২০১২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে কাজ পাচ্ছে মাত্র সাত লাখ। উচ্চশিক্ষিত অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও রয়েছেন এর মধ্যে।



বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একই ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ ও শ্রীলংকায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্তানে, ৬৫ শতাংশ। এর বাইরে ভারতে এর হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।



বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ মাত্র ২৬ লাখ মানুষ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে, পরিবারের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কোনো মজুরি পান না, এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এ ছাড়া আছে আরও এক কোটি ছয় লাখ দিনমজুর, যাঁদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। দেশে মোট কর্মজীবী মানুষের ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত, যেমন পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ডেকোরেশন ও বিভিন্ন সেবা খাতে নিয়োজিত। আর মাত্র ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত।



বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছেন। সুতরাং নতুন কর্মসংস্থান তৈরির চাপ রয়েছে অর্থনীতির ওপর। দৈনিক ২ মার্কিন ডলারের সমান অথবা কম আয়ের সীমাকে দারিদ্র্যসীমা বিবেচনা করলে দেশে মোট জনসংখ্যার ৭৬ দশমিক ৫ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে।



বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১২ সালের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই বছর দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তরসহ উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ। তাঁদের মধ্যে ৯২ হাজার ৭৪৭ জন স্নাতক পাস, এক লাখ ২৮ হাজার ৪৮১ জন স্নাতক সম্মান এবং ২১ হাজার ৩৮০ জন কারিগরি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া এক লাখ ১৯ হাজার ৮৯৪ জন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি, দুই হাজার ৩৮৫ জন স্নাতকোত্তর (কারিগরি) এবং এক হাজার ৭৬৩ জন এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। অন্যদিকে বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট অর্জন করেন দুই হাজার ৩৩৫ জন।



বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সূত্র মতে, গত ছয় মাসে শিল্প খাত থেকেই প্রায় ১০ লাখ লোক কাজ হারিয়েছেন। নির্মাণ খাত, কৃষি, পোলট্রি এবং সেবা খাতেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব।



পরিসংখ্যান ব্যুরোর সূত্র মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০০০ সালের তথ্য অনুযায়ী শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ লাখ এবং আন্ডার এমপ্লয়মেন্টের শিকার প্রায় ৫৫ লাখ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ শিক্ষিত বেকার শ্রমবাজারে আসছে। যার মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে প্রায় ৫০ হাজার। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশ চাকরি পেলেও প্রায় ৫৫ শতাংশ বেকার থাকছে কিংবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না।



‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর মাসিক ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা’র ২০১৪ সালের মে সংখ্যায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, গত এক দশক ধরে বেকারত্ব বৃদ্ধির যে প্রবণতা তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আগামী বছর (২০১৫) দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৩৩ লাখে। বেকারত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি আংশিক বেকারত্বও বাড়ছে। ১৯৯৫ সালে দেশে মোট চাকুরিজীবী ও বেকারের সংখ্যা যথাক্রমে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ও ১৪ লাখ যা ২০১০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে যথাক্রমে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ও ২৬ লাখে উপনীত হয়েছে।



বেকারত্ব: বৈশ্বিক প্রেক্ষিত

বিশ্বজুড়ে দ্রুত গতিতে ক্রমবর্ধমান আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে বেকারত্ব। বিশ্বের ২৩টি দেশের ১১ হাজার মানুষের ওপর এক জরিপ চালিয়ে এই তথ্য প্রকাশ করেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস। জরিপে বলা হয়, বেকারত্বের কারণে মানুষের মধ্যে দিন দিন ভীতি বাড়ছে। দ্য ওয়ার্ল্ড স্পিকস নামের প্রতিষ্ঠান ২৩টি দেশের সচেতন মানুষের উপরে এই জরিপ চালায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্পেনে তরুণ বেকারত্বের হার ৪০ শতাংশেরও বেশি। অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে পড়েছে যে, ইউরোপের বহু পরিবারের পক্ষে দু'বেলা দু'মুঠো অন্নের সংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী -এমনকি অনেক গৃহবধু সংসারের ভরণ- পোষণের জন্য দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন। লঙ্গরখানাগুলোতে দিন দিন মানুষের ভিড় বাড়ছে।



ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে বর্তমানে গড় বেকারত্বের হার ১০.৮ শতাংশ। ইউরোপে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ইউরোপীয় পরিসংখ্যান বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বরে ইউরো অঞ্চলের ১৭টি দেশে মৌসুমি বেকার মিলে মোট বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ। বেকারত্বের এই হার ১৯৯৮-৯৯ সালে ইউরো মুদ্রা প্রচলন হওয়ার পর সর্বোচ্চ। ।নতুন প্রজন্ম চাকরি না পেয়ে দাঙ্গায় নামতে বাধ্য হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে স্নাতকরা কফিশপ বা রেস্তোরায় খাবার সার্ভ করবে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট কর্মজীবীর সংখ্যা যদি ২৪ কোটি ধরা হয় তবে তাদের মধ্যে অনন্ত সাড়ে ৬ কোটি ওভায়কোয়ালিফায়েড৷ তারা যে কাজ করছেন তার থেকে অনেক বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন, এমনই এইসিডির পরিসংখ্যান৷ এছাড়াও য়ারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও পার্টটাইম চাকরিতে বাধ্য হচ্ছেন তাদের সংখ্যাও প্রায় ৯০ লক্ষ৷ আর ইচ্ছে অনিচ্ছে বাদ দিয়ে ইউরোপের মোট কর্মজীবীর এক-পঞ্চমাংশই পার্ট টাইম কাজ করেন৷



ইউরোপের প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ডেভিড স্ট্যাকলার বলেছেন, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার পর আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়ে গেছে। ইউরো নিউজ এক প্রতিবেদনে বলেছে, অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপে আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১০ সালে গ্রিসে আত্মহত্যার হার যেখানে ছিল শতকরা ১৮ ভাগ, সেখানে ২০১১ সালে তা ২৫ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। শিশুদের রক্ষা করুন' নামক একটি ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান বলেছে, দেশটির ১৭ লাখ শিশু মারাত্মক দারিদ্রের শিকার এবং তারা পরিমিত খাবার ও পোশাক থেকে বঞ্চিত।



বর্তমানে গ্রিসে ২০ ও স্পেনে ৩০ শতাংশ বেকার রয়েছে। স্পেনে শুধুমাত্র ২০১২ সালের প্রথম তিন মাসে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ ব্যক্তি চাকরি হারিয়েছেন। দেশটির ২৫ বছরের কম বয়সী মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ। বর্তমানে স্পেনের যুব সমাজের অর্ধেকেরও বেশি বেকার। স্পেন সরকার অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি খাতের কর্মজীবী মানুষের বেতন কমিয়েছে, অবসর গ্রহণের বয়স সীমা বাড়িয়েছে এবং শিক্ষা ও চিকিতসাসহ বিভিন্ন ধরনের সরকারি সেবা খাত তুলে দিয়েছে। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়েছেন এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার ফলে বহু কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মচারী চাকরি হারিয়েছেন।



এসব দেশে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। ঋণগ্রস্ত ইতালিতেও বেকারের সংখ্যা আট দশমিক নয় শতাংশ হয়েছে। ২০০৪ সালের পর এ হার সর্বোচ্চ। দুই বছরের গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ইউরোপে কর্মসংস্থানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বৃহত্ কোম্পানিগুলো ব্যয় হ্রাসে কর্মী ছাঁটাই করছে। সর্বশেষ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল সরঞ্জাম নির্মাতা নকিয়া সিমেন্স নেটওয়ার্ক জার্মানিতে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করছে। এর মাধ্যমে এক বিলিয়ন ইউরো সাশ্রয় করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।



চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর প্রবৃদ্ধির গতিতে মন্থরতা দেখা দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, ইউরো জোন মন্দার মধ্যে আছে। কারণ, তাদের ঋণ সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। জার্মানী ছাড়া ইউরো জোনের অপর ১৬টি দেশের অর্থনীতিই আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। স্ট্যান্ডার্ড এন্ড পুওর’স সমপ্রতি ফ্রান্সের ঋণমান এক ধাপ নামিয়ে দিয়েছে। সার্বভৌম ঋণ পরিশোধে দেশটির সামর্থ্য হ্রাস পেয়েছে।



মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় বিরাজমান রাজনৈতিক উত্তেজনা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপকরণ জ্বালানি সরবরাহকে হুমকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ইউরোপের দুরবস্থ, বেকারত্ব মোকাবেলায় উন্নত বিশ্বের নীতি-নির্ধারকদের ব্যর্থতা, সার্বভৌম ঋণ সঙ্কট ও আর্থিক খাতগুলোর ভঙ্গুরতা বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যত্ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছে।



আইএলওর বার্ষিক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, আগামী ২০১৮ সাল নাগাদ বিশ্বে বেকারের সংখ্যা হবে ২১ কোটি ৫০ লাখ। সংস্থার মহাপরিচালক গে রাইডার বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটলেও একই সঙ্গে বেকারত্বও বাড়ছে। আগামী বছরগুলোতেও বেকারত্ব বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তাঁর মতে, বর্তমানে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলছে, তা বেকার কমাতে ব্যর্থ। তাই প্রবৃদ্ধি আরো জোরালো না হলে বেকারত্ব পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা উচিত। সংস্থা জানায়, গত বছর উত্তর আফ্রিকায় বেকারত্ব সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এ অঞ্চলে বেকারত্ব বেড়ে হয়েছে ১২ দশমিক ২ শতাংশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এর পাশাপশি ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং অন্য উন্নত দেশগুলোতে বেকারত্বের হার ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে ৮ দশমিক ২ শতাংশ এবং সাব-সাহারা আফ্রিকায় ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হার লাতিন আমেরিকান ও ক্যারিবীয় দেশগুলোতে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে চীন নেতৃত্বাধীন পূর্ব এশিয়ায় বেকারত্ব ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বেকারত্ব ৪ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্বে গড়ে বেকারত্বের হার ৬ শতাংশ হলেও ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ১৩ শতাংশ ছিল গত বছর, যা উদ্বেগের কারণ হিসেবে মনে করছে আইএলও।



ইনফোসিসের সিইও এস ডি শিবুলালের মতে, ‘ভারতে লাখ লাখ চাকরির সংস্থান করা হয়েছে এবং আমার জীবনেই আমি দেখলাম এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা তিন কোটি থেকে বেড়ে ৩০ কোটিতে ঠেকেছে। ভারতের আইটি খাত প্রত্যক্ষভাবে ২২ লাখ ও পরোক্ষভাবে ৮০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ১২০ কোটি লোকের একটি দেশে যেখানে এক কোটি ১০ লাখ লোক সম্পূর্ণ বেকার, সেখানে এটা সাগরে এক ফোঁটা পানির সমতুল্য। দেশটি প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ গ্র্যাজুয়েট ও ১০ লাখ ইঞ্জিনিয়ার তৈরি করছে। অথচ এর মাত্র ২৫ শতাংশের কর্মসংস্থানের ক্ষমতা রাখে।



বেকারত্বের প্রভাব

বেকারের আত্মপরিচয় সংকট: একজন বেকারকে যখন কেউ প্রশ্ন করে, তুমি কী কর?- প্রশ্নের উত্তর দিতে তার বিব্রতবোধ হয়। কারণ সার্টিফিকেট ফাইলবন্দী করা, পে-অর্ডার আর ব্যাংক ড্রাফট করা, সার্টিফিকেট ও সিভি ফটোকপি করা, সাপ্তাহিক চাকরির পত্রিকা কেনা, মাসিক কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স কেনা, দৈনিক পত্রিকাগুলোতে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখা, প্রতিদিন বিডি জবস্ কিংবা প্রথম আলো জবস্ ওয়েবসাইট দেখা, প্রতিদিন নিজের ইমেইল আইডির ইনবক্স দেখা ও সিভি সেন্ড করা, কখনো সাইব্যার ক্যাফেতে বসে অনলাইনে ফরম পূরণ করা আর এডমিট কার্ড ও পাসপোর্ট সাইজের ছবি প্রিন্ট করা, ফেসবুকে বিভিন্ন জব সংক্রান্ত গ্রুপ গুলোর পোস্ট দেখা-এসব নানান কাজ। এর বাইরেও অনেকে খেয়ে না খেয়ে গ্রুপ স্টাডি করেন, পড়ার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরী পর্যন্ত যান, নীলক্ষেত থেকে বই কেনা ও লেকচারশীট ফটোকপি করতে করতে অনেক পুস্তক বিক্রেতা কিংবা ফটোকপির দোকানদারদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে, Fণ করে হলেও কোচিং সেন্টার গুলোতে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির আশায় ভিড় করেন- তারপরও চাকরি নামের সোনার হরিণ কপালে জুটেনা।



বেকারের অভাববোধ ও মানসিক চাপ: চাকরি নামের সোনার সাক্ষাৎ মিলবে কি করে? শুধু মেধা ও যোগ্যতা থাকলেইতো চাকরি হয়না। এজন্যে সুপারিশ লাগে, তদ্বির লাগে, ঘুষ লাগে।একটু নেক নজরের আশায় পকেটে রিক্সা ভাড়া না থাকা সত্ত্বেও পায়ে হেঁটে জুতার তলি ক্ষয় করে বড় সাহেবদের চেম্বারে যান। জীবনেও যার ব্যাপারে কারো মুখে প্রশংসা শুনেন নি এমন অপছন্দনীয় ব্যক্তিরও প্রশংসা করেন, নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী ব্যক্তি হয়েও কোন মূর্খ রাজনীতিবিদ নেতা কিংবা ম্যাট্রিক পড়ুয়া ব্যবসায়ীর কাছে নত শিরে চাকরির জন্যে আকুল আবেদন জানান। তিনবেলা পেটে ভাত না জুটলেও রীতিমতো প্যান্ট-শার্ট, কোর্ট-ট্যাই পরিধান করে স্মার্টনেস বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থেকেও অনেক সময় বড় সাহেবের ব্যস্ততায় সাক্ষাত লাভে অক্ষম হয়ে ব্যর্থ মনে ঘর্মাক্ত দেহে ফিরে আসেন।অনেকে নিদ্রায় অনিয়ম, দুশ্চিন্তা, পুষ্টিকর খাবারের অভাব এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের সুযোগ না পাওয়ায় রোগাক্রান্ত হন, দুর্বল হয়ে পড়েন। পরিবার থেকে টাকার চাহিদা জনিত কারণে বারবার চাকরি নেবার তাগাদা, বৃদ্ধ বাবা মা কিংবা দাদা দাদির শখ পূরণে কিংবা মৃত্যুর আগে নাতি নাতনি বা পুতি পুতনি দেখার প্রত্যাশা পূরণেবিয়ের জন্যে পীড়াপীড়ি- সাংঘাতিকভাবে অসহনীয় হয়ে ওঠে একজন বেকারের কাছে। বেকারত্ব হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়! যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ হাজারেরও বেশি লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে গবেষকরা দেখেছেন যারা কর্মহীন বা বেকারের মতো অলস সময় কাটান অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।



অভিভাবকের উদ্বিগ্নতায় বেকারের হতাশা বৃদ্ধি: মূর্খ ছেলেটা বেকার হলে একটা সান্ত্বনা থাকে। ওর পেছনে কোনো ইনভেস্ট নেই। কিন্তু লাখ লাখ টাকা খরচ করে উচ্চশিক্ষা দানের পর যদি ছেলেটা বেকার হয়ে পরিবারের পিঠে চেপে বসে তখন একমাত্র ‘মৃত্যু’ ছাড়া অভিভাবকদের এই ‘আপদ’ থেকে মুক্তির আর পথ থাকে কি? আয়ের উৎস না থাকা সত্ত্বেও দু:সহ বেকার যিন্দেগী যাপনেও অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। মেধাবী ছাত্র হিসাবে সন্তানের সামাজিক পরিচিতির কারণে যে বাবা মা গর্ববোধ করতো তারাও নিজের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ও হতাশ হয়ে পড়েন। দেশ ও সমাজের উচ্চ পর্যায়ের কোন কর্তা ব্যক্তির সামনে এসব বেকার গিয়ে হাজির হলে কেউ ‘দূর হও’ বলে তাড়িয়ে দেন আর কেউ বড়জোর ‘আহারে’ বলে একটি নি:শ্বাস ফেলেন মাত্র। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সোশ্যাল বিজনেস ধারণার উদ্ভাবক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘তরুণরা নতুন ব্যবসা ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তহবিলের সংকট হবে না। সামাজিক ব্যবসা দিয়ে সামাজিক সমস্যা দূর করা যাবে। তরুণদের স্বপ্ন ও উদ্যোগ নিয়ে বেকারত্ব দূর করতে হবে।’ কেউ কেউ বলেন দেশে জনসংখ্যা বেশি তাই দেশে বেকারত্ব বাড়তেছে। অথচ অর্থনীতির কোন তত্ত্বে বলা হয়নি জনসংখ্যা বাড়লে বেকারত্ব বাড়ে। যদি সরকার এই অধিক জনসংখ্যাকে সম্পদে রুপান্তর করতে পারতো, চাহিদানুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারতো তাহলে জনসংখ্যাকে সমস্যা মনে হতোনা, বেকারত্বও থাকত না।

বেকারত্বের কারণ

সুযোগের অভাবে বেকারত্ব: বেকারত্ব থাকায় ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আজ আমাদের তরুণদের মাঝে হতাশা নামক এক কাল ছায়া ছেয়ে গেছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ ) দক্ষিন এশিয়া বিষয়ক হাই ইউনিভার্সিটি এনরোলমেন্টে, লো গ্রেজুয়েট এমপ্লয়মেন্ট শীর্ষক এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ ব্যাচেলর ডিগ্রিধারী বেকার। অনেক বেকার তরুণেরা কোন কর্মসংস্থান করতে না পেরে অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। মাদকাসক্ত হয়, নানান অপকর্ম করে, সমাজের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত হয়। অর্থসংকটের একদিক যেমন বেকারত্ব, তেমনই অপর দিকটা হল আধা বেকারত্ব৷ আধা বেকারত্ব অর্থাৎ যোগ্যতার চেয়ে নীচু ধরনের কাজ বা পার্টটাইম কাজ বা অল্প মাইনের কাজ৷ প্রধানত উচ্চ শিক্ষিতরাই এই ভিন্ন বেকারত্বের শিকার৷ দেশের সেরা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েট হয়েও মাসের পর মাস বেকার থাকা, হাজারো আপ্লিকেশন পাঠিয়ে মাত্র একটা কি দুটো ইন্টারভিউর ডাক এ সবই এখন সাধারন অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ পাবলিক ইউনিভার্সিটির পাঠ্য বিষয় ও বিভাগের ফিরিস্তি দেখলে মনে হয় তারা এখনও অন্য জগতে বাস করেন৷ কারণ নানা ধরনের বিষয়ে পাড়শোনার সুযোগ থাকলেও এগুলি নিয়ে ফিল্ডে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব৷ ড. ইউনুস এজন্যে আমাদের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার দোষারোপ করে বলেন, ‘পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই ভুল। আমরা চাকরিপ্রার্থী হিসেবে শিক্ষার্থীদের তৈরি করছি। মানবিক গুণাবলির অধিকারী হিসেবে এটি লজ্জার। চাকরি মানে মানুষকে ছোট করা। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যে যত উপরে উঠছে, সে তত চুষে খাচ্ছে। বেকার যুবকদের দিকে তাকালে আমার খুব কষ্ট হয়। অন্যের অধীনে কাজ করার চেয়ে নিজের কাজে সম্মান অনেক বেশি। তরুণরা লেখাপড়া শিখেও বেকারত্বের শিকার। এটি তাদের দোষ নয়। আমাদের অর্থ ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে এটি হয়েছে। বিদ্যমান অর্থকাঠামো তাদেরকে সে সুযোগ দিচ্ছে না। সমাজ বেকারকে পরিত্যক্ত হিসেবে বিবেচনা করে। সুযোগ না দিয়ে একজন যোগ্য মানুষকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।’



শ্রমবাজারের সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষা: শ্রমবাজারের সঙ্গে সঙ্গতিহীন শিক্ষা ব্যবস্থাকেই বেকারত্বের জন্য দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত মনে করেন, প্রতিবছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই শিক্ষার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক নীতি এবং অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় না করলে এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকবে। খাপছাড়া উচ্চশিক্ষা বেকারত্ব বাড়াচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সাহিত্যে স্নাতক হয়েও ব্যাংকে চাকরি করছেন অনেকে। সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনার পর প্রশিক্ষণ নিয়ে আইটি খাতে কাজ করছেন এমন সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আবার প্রকৌশলী হয়েও সরকারের প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োজিত আছেন অসংখ্য কর্মকর্তা। বাংলাদেশে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এ শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে চাকরির বাজারে বিরাজ করছে নাজুক পরিস্থিতি। বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট সেক্টর: অ্যান অ্যাসেসমেন্ট অব স্কিলস ইন দ্য ফরমাল সেক্টর লেবার মার্কেট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাকরির বাজারে চাহিদা না থাকলেও কলা ও মানবিক, প্রকৌশল ও কারিগরি, সমাজবিজ্ঞান, কৃষি শিক্ষার প্রতি ঝুঁকছে দেশের শিক্ষার্থীরা। আবার চাহিদা থাকলেও বিজ্ঞান, সাধারণ শিক্ষা, ব্যবসায় প্রশাসন, চিকিত্সা কিংবা লোকপ্রশাসন বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম। ফলে খাপছাড়া এ শিক্ষাব্যবস্থা বাড়াচ্ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বেশি ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছে কলা ও মানবিক শাখায়। অথচ চাকরি বাজারে এর চাহিদা মাত্র ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ এ দুই বিভাগে বাড়তি শিক্ষার্থী রয়েছে ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর চাহিদা থাকলেও অধ্যয়নরত মাত্র ৮ শতাংশ। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষায় এখনো ঘাটতি রয়েছে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর। এছাড়া প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষায় ২ দশমিক ৮ শতাংশ প্রয়োজন হলেও শিক্ষার্থী রয়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। ফলে এ খাতে বাড়তি শিক্ষার্থী ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আবার ব্যবসায় প্রশাসন শাখার জনবল প্রয়োজন ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এ বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে চাকরির বাজারে এ শাখায় শিক্ষার্থীর ঘাটতি রয়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সাধারণ শিক্ষায় ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এ শাখায় ঘাটতি রয়েছে ১৫ শতাংশ। তবে সমাজবিজ্ঞানে ১ দশমিক ৬ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে শিক্ষার্থী রয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞানে বাড়তি শিক্ষার্থী রয়েছে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া কৃষিতে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে শিক্ষা নিচ্ছে ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। এ হিসাবে কৃষিতে শিক্ষার্থীর হার চাহিদার চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ বেশি। ঘাটতি রয়েছে চিকিত্সা ও লোকপ্রশাসন বিভাগেও। ১ দশমিক ৫ শতাংশ চিকিত্সকের চাহিদা থাকলেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। ফলে ঘাটতি রয়েছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। আর লোকপ্রশাসনে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ চাহিদার বিপরীতে শিক্ষার্থী রয়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ।



পদ্ধতিগত ত্রুটির নিষ্ঠুর খেসারত : ড.ইউনূস বলেন, বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও পুঁজিবাদী কাঠামো গোটা দুনিয়াকে হতাশ করেছে। মানুষে মানুষে আয়ের বিরাট পার্থক্য। বিশ্বে ৮৫ ব্যক্তির যে ধন সম্পদ আছে, পৃথিবীর অর্ধেক জনসংখ্যার সব সম্পদ যোগ করলেও সেই পরিমাণ সম্পদ নেই। এ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে যিনি যত বেশি উপরে আছেন, নিচের জনকে তিনি তত বেশি চুষছেন। বিশ্ব জুড়েই দারিদ্র্য ও বেকারত্বের সমস্যা রয়েছে। বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঠামো থেকে বের হওয়া ছাড়া মুক্তি মিলবে না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছরই লাখো শিক্ষার্থী ডিগ্রি লাভ করলেও শ্রমবাজারে তাদের চাহিদা নেই। শিক্ষার গুণগত মানের অভাবের কারণেই শিক্ষা জীবন শেষে বেকার থাকছেন তারা। চাকরির বাজারে যে ধরনের জ্ঞান, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা প্রত্যাশা করা হয়, প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থীর সে ধরনের যোগ্যতা নেই। তবে কারিগরি ও বিশেষায়িত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের চাকরির বাজারে ভালো চাহিদা আছে। আবার অনেক স্নাতকের যোগ্যতা ও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। খোদ ইউজিসির ২০১২ সালের প্রতিবেদনেই এই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘যদিও সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত কারিকুলাম উন্নত মানের, কিন্তু কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিশেষ করে কতিপয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। অর্থাৎ যদিও উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, তবু শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।’



অদক্ষতা ও প্রযুক্তির পরিবর্তন: রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) যৌথ আয়োজনে 'ট্রেড লিবারেলাইজেশন ইন বাংলাদেশ: ইমপ্লিমেন্টেশন ফর অ্যামপ্লয়মেন্ট' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছিলেন,বাণিজ্য উদারীকরণ নয়, বরং অদক্ষতা ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের কারণে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে। সিপিডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা করা হয়, সাধারণভাবে বাণিজ্য উদারীকরণের কারণে দেশে বেকারত্ব বেড়েছে। বর্তমানে উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থানের হার খুবই কম। বাণিজ্যে উদার নীতির কারণে এই হার বাড়ছে না।



বিনিয়োগ হ্রাস ও কর্মসংস্থানের অভাব: রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। অবরোধের কারণে শিল্প-কলকারখানাসহ ছোটবড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ কমে। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রকটাবস্থায় নতুন কর্মসংস্থান হয়না, বরং চাকরিচ্যুত হয় বিপুলসংখ্যক শ্রমিক। অবরোধ আর হরতালে মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়ে দেশের শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ। নির্মাণ, পর্যটন, পোলট্রি, পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও তৈরি পোশাকশিল্প খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনীতির খাতগুলো বিপর্যস্ত হওয়ায় লোকসান এড়াতে অনেক শ্রমিক বিদায় করে দেন শিল্পোদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খোদ রাজধানীতে ছোটবড় ভ্রাম্যমাণ দোকান ও অস্থায়ী হকার্স এবং টং দোকানের সংখ্যা এক লাখ ৭৩ হাজার ৩০০টিরও বেশি। যেখানে সরাসরি আড়াই লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ বিপুল জনশক্তির অধিকাংশই পুঁজি ভেঙে খেয়ে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ বছরে দেশের দুই হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক পাটকল, চিনিকল, বস্ত্রকল এবং কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ আছে। কয়েক শ ঢালাই কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে লাখ লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। গত ২০ বছরে আড়াই লাখ তাঁতি বাধ্য হয়ে পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। বার্ড ফ্লু সংক্রমণের ফলে দেশের লক্ষাধিক পোলট্রিশিল্পে নিয়োজিত কয়েক লাখ মানুষ কর্মহীন এবং তাদের পুঁজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিডরকবলিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সংকট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি, উচ্ছেদ এবং দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের ফলে সারা দেশে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন প্রায় ছয় লাখ লোক। এদের মধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে হকারের সংখ্যাই প্রায় পাঁচ লাখ। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিল প্রায় এক লাখ জনশক্তি।



বেকারত্ব নিরসনে করণীয়

অন্যের কাছে চাকরি চাওয়ার প্রবণতা ত্যাগ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সব সমাজেই সমস্যা-সংকট রয়েছে। তবে কোন সমস্যা স্থায়ী হলে শান্তি ও উন্নয়ন অর্জনের পথ প্রবলভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আমাদের নিজেদের সমস্যাকে নিজেরাই চিহ্নিত করে তা সমাধানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সবচেয়ে বড় সাহস ও শক্তি আছে তারুণ্যের। আমাদের তরুণদের শক্তি ও সম্ভাবনা ব্যবহার করতে হবে। তরুণদের বড় সমস্যা বেকারত্ব। এ বেকারত্ব সব জায়গায় রয়েছে। একদিন পৃথিবীতে এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যখন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না। বাংলাদেশে চাইলেইতো চাকরি পাওয়া যায় না। চাকরি পাওয়া মানে, শুধু সময় দেয়া নয়। এর জন্য টাকাও লাগে। এক লাখ, দুই লাখ, পাঁচ লাখ, দশ লাখ টাকা দেয়া লাগে। এটি এখন সবাই জানে। টাকা দিয়ে চাকরি পেতে হলে টাকা দিয়ে ব্যবসা করাই ভালো। তখন তরুণ চাকরি পাওয়া নয়, চাকরি দিতে পারবে। সমাজে একটি মানুষও বেকার থাকবে না এমন একটি সংস্কৃতি চালু করতে পারলে দেশকে অনেক দ্রুত এগিয়ে নেয়া যায়। কেন মানুষ অন্যের কাছে চাকরি চাইবে। কেন মানুষ বেকার থাকবে। অন্যের কাছে চাকরি চাওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করতে পারলেই মানুষ তার নিজের শক্তি সম্পর্কে জানতে পারে। যেটা নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি না সেটা কখনো হয় না। যেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখি সেটাই বাস্তবায়িত হয়। আমরা প্রত্যেকে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন না দেখে চাকরি নেয়ার স্বপ্ন দেখি। এর মধ্য দিয়ে আমরা নিজের শক্তিকে খাটো করে দেই।



বেকারত্ব দূরিকরনে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন : রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত ‘কার্যকর উন্নয়নে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব: ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন কর্মসূচি’ শীর্ষক কর্মশালায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে দারিদ্র, অতি দারিদ্র এবং বেকারত্ব প্রধান বাধা। এসব বাধা মোকাবেলা করতে আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার পাশাপাশি আমাদের প্রশাসনিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে।’ ঝালকাঠি জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে সফল মৎস্য চাষিদের সম্মাননা অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেছেন, ‘এখন মাছ চাষ করার উপযুক্ত সময়। মাছ চাষ করে বেকারত্ব দূর করা সম্ভব।’ সমস্যাটা হলো শিক্ষিত কেউ গ্রামে থেকে কৃষি কাজ করবেন, খামার করবেন- এর মাধ্যমে যদিও ভাল ইনকাম করবেন তবু গ্রামের লোকজন তাকে অবজ্ঞা করবে।ঢাকায় চাকরি করে যে বেতন পাবে তাতে খরচ শেষে সঞ্চয় করতে পারবেনা তবু গ্রামে নয় ঢাকায় থাকতে হবে, খামার নয় চাকরি করতে হবে। অনেকে বিদেশে অনেক নিম্ন মানের কাজ করে কিন্তু দেশের ভিতরে তারাও কেউ নবাবজাদা, কেউ জমিদারপুত হয়ে সাহেবী যিন্দেগী যাপন করতে চান। কেউ যদি ঢাকায় থেকে পঁচিশ হাজার টাকার চাকরি করে আর আরেকজন যদি কৃষি খামার করে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করে তবে বিয়ের বাজারে ঠিকই চাহিদা বেশী হবে চাকরিজীবীর।



সামাজিক ব্যবসার সম্প্রসারণ: শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসার ঘটলে কলকারখানা গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। গ্রামে গঞ্জে কুটিরশিল্প স্থাপন করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যায়। তাছাড়া মাছের চাষ, হাঁস-মুরগির খামার, পশুপালন ও ফলের চাষ কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে দেশের অর্থনীতি। আমাদের দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতের অবদান ৯৫ শতাংশ আর সরকারি খাতে মাত্র ৫ শতাংশ। আমাদের দেশের বৃহত্তম কর্মসংস্থানশীল বেসরকারি খাতসমূহের মধ্যে রয়েছে পোশাকশিল্প, আবাসন, কৃষি, পরিবহন, পোলট্রি ও ডেইরিশিল্প ইত্যাদি। এ ছাড়াও আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থান খাতসমূহ বুটিকশিল্প, ফিশারিজ, পোলট্রি খামার, ডেইরি ফার্ম, কম্পিউটার ট্রেনিং অ্যান্ড সার্ভিসিং, মোবাইল সেন্টার, বিকাশ, ক্ষুদ্র ব্যবসা, সবজি ও ফল চাষ প্রভৃতি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দেশের মোট কর্মজীবী মানুষের ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যেমন : পরিবহন, হোটেল রেস্তোরাঁ, ডেকোরেশন ইত্যাদি। আর মাত্র ১২ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। আমাদের দেশে ইনফরমাল সেক্টরকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু এ সেক্টরই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, আয় বৈষম্য ও বেকারত্ব দূর করতেই সামাজিক ব্যবসা। প্রচলিত ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলো যার অর্থ নেই, তাকে ঋণ দেয় না। এলাকাভিত্তিক সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করতে হবে। সমাজের সমস্যা চিহ্নিত করে তরুণরা যে উদ্যোগ গ্রহণ করবে, এ তহবিল থেকে তাদেরকে সহায়তা করতে হবে।



সরকারী উদ্যোগ ও সচেতনতা বৃদ্ধি: বেকারত্ব নিরসনে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। আমরা বেকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই, না কি শিক্ষিত বেকারে ভারাক্রান্ত দেশ চাই-এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য এখন সময়ের দাবি। জনশক্তির উন্নয়নে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। হস্তশিল্প, কাঠের কাজ, বেতের কাজ, বাঁশের কাজ, মাছের চাষ, হাঁস-মুরগির খামার, পশুপালন সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ, লেদ মেশিন স্থাপন, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ, হোটেল সংক্রান্ত ট্রেনিং, চুলকাটার ট্রেনিং, দর্জি, কলকারখানার কাজ, সেলসম্যানশীপ ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের বিপুল বেকারদের শ্রমশক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। সর্বজনীন শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে হবে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার, আত্মকর্মসংস্থান সংক্রান্ত শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম। রাস্তা ঘাট, বৃক্ষরোপণ, হাট-বাজার উন্নয়ন, কুটিরশিল্প ও কৃষি খামার স্থাপন ইত্যাদি সংক্রান্ত কার্যক্রম হাতে নিলে আপনা থেকেই বেকারত্ব হ্রাস পাবে।



কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চাই বিনিয়োগ : দেশের রপ্তানি খাতে নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। সরকারি খাতে জনপ্রশাসনে ব্যয় এত বেড়ে গেছে যে সেখানে ব্যাপক পরিমাণে নতুন কর্মী নিয়োগ করা সরকারের জন্য কঠিন। আবার সরকারি চাকরির বয়স বাড়ানোয় নতুনদের ঢোকার সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানে কৃষির অংশীদারি কমছে। আর মজুরি বেড়ে যাওয়ায় কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বাড়ছে। ফলে সেখানেও নতুন করে বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার সুযোগ কমছে। বিনিয়োগ হলেই কর্মসংস্থান হয়। এ জন্য বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে কর্মসংস্থানের ওপর জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশে সম্ভাবনা থাকার পরও বিনিয়োগ আশানুরূপ না হওয়ার পেছনে অবকাঠামো সংকটকে দায়ী করে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) তৈরি করা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন এবং পরে ছয় লেন করা, গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিসহ শিল্প সহায়ক প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকতে হবে এবারের বাজেটে। বেসরকারি খাত যেভাবে এগিয়েছে, সেভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়নি। এটা হলে বিনিয়োগ বাড়ানোও সম্ভব হবে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়বে। দেশে বড় বিনিয়োগ হচ্ছে না। বড় বিনিয়োগ না হলে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না। বেকারের সংখ্যা কমাতে হলে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শূন্য পদে লোক নিয়োগ করতে হবে।



উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উদ্যোগ বৃদ্ধি: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বেকারত্ব নকল জিনিস। সৃজনশীল মানুষ কখনও বেকার হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষ একটা অনাবিষ্কৃত শক্তির আধার। বেকারত্ব বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট। বেকারত্বের মাধ্যমে সমাজের লোকদের বিকল করে রাখা হয়েছে। সমাজ তাকে কাজ করতে দেবে না। নিশ্চয়ই সমাজের কোথাও কোনো গোলযোগ আছে বলে সমাজের কোটি কোটি মানুষ বেকার। বেকারত্ব মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, সমাজ ব্যবস্থার সমস্যা। দুনিয়ার সব মানুষই উদ্যোক্তা গুণসম্পন্ন। উদ্যোক্তা হওয়ার গুণ নেই এমন মানুষ দুনিয়ায় নেই। কেউ কেউ নিজের জীবনে এ শক্তির সন্ধান পাওয়ার সুযোগ পায়, আর বেশিরভাগ মানুষকে এ ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে দেয়া হয় না। যেমন- গরিব মানুষদের। গরিব মেয়ে মানুষ হলে তো কথাই নেই। তাদের বোঝানো হয়, তোমাদের জন্ম হয়েছে অন্যের হুকুম তামিল করার জন্য। হুকুম দেয়ার ক্ষমতা তোমাদের নেই। হাজার হাজার বছর ধরে একথা শুনতে শুনতে তারাও বিশ্বাস করে এসেছে যে, কথাটা সত্যি। তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ, পুরুষ, নারী, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী, দরিদ্র যে কোনো মানুষ সফল উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রত্যেক মানুষের আছে মৌলিক সৃষ্টিশীলতা। এ সৃষ্টিশীলতাকে কেন্দ্র করেই বেকারত্ববিহীন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপান্তর হবে। বেকারত্বের চরম হতাশা, বিষণ্নতা এবং মানবতার অবমাননা থেকে মানুষ অবশেষে মুক্ত হবে। সেদিন 'বেকার' শব্দটির আর কোনো প্রয়োগ থাকবে না। তখন মানুষ বুঝতে অক্ষম হবে বেকারত্ব মানে কী, এটা কোন ধরনের পরিস্থিতি। কেন একজন মানুষ বাধ্য হবে নিজের সৃজনশীলতার বর্ণিল প্রকাশকে অবরুদ্ধ রাখতে? যেদিন বেকারত্ব বলে কিছু থাকবে না, সেদিন মানুষের নবজন্ম লাভ হবে। নতুন আশা, নতুন সীমাহীন সম্ভাবনার জগতে প্রবেশ করবে মানুষ। এ নতুন মানুষকে ঘিরে নতুন অর্থনীতির জন্ম হবে। প্রত্যেক মানুষের সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ দ্রুতলয়ে ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকবে। নিজের জীবন ধারণের জন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করে নিজের কৃতিত্বে নিজেকে গৌরবান্বিত বোধ করবে।’



পাওয়া নয় দেয়ার মানসিকতা বাড়ানো: ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের দেশে যেন চাকরি পাওয়াটাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আমরা এর পরিবর্তন চাই। ঘুষের অর্থে ব্যবসায়ের তহবিল সৃষ্টি করে তা দিয়ে অনায়াসেই বেকারত্ব ঘুচানো সম্ভব।বাংলাদেশে চাকরির জন্য যে টাকা ঘুষ দেয়া হয় তা একত্রিত করে বিনিয়োগ করা হলে বিশাল ব্যবসা ক্ষেত্র তৈরি হবে। আর তা করা হলে উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন যুবদের চাকরির পেছনে ছুটতে হবে না। বরং তখন প্রত্যেক যুবকই হবে চাকরিদাতা। মানসিকতার পরিবর্তনের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশকে পাল্টে দেয়া যাবে। বেকারত্ব সমাজের সৃষ্টি। আমাদের জীবনের একমাত্র চাওয়াই হলো শুধু পাওয়া। কিন্তু দেয়ার মানসিকতা আমরা ভুলে গেছি। তাইতো আমাদের এতো এতো সামাজিক সমস্যা। দেয়ার মানসিকতা থাকলে পাওয়া যায় বেশি। চাকরি পাওয়ার অর্থ হলো একজন মানুষকে অতি ক্ষুদ্র করে দেয়া। অথচ চাকরি না করে উদ্যোক্তা হলে যে কোনো যুবক সমাজকে অনেক কিছু দিতে পারতেন। মানুষ অনেক বেশি সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। চাকরি পেলে সে সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। তোমরা চাকরির পেছনে সময় নষ্ট করো না। ’



ব্যবসা-বাণিজ্যকে গুরুত্ব প্রদান: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)'র তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের ২ হাজার কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি ১শ' ৩৪টি পাটকলের মধ্যে এখন ৩৩টি বন্ধ। এ ছাড়া ১৬টি চিনিকল, ১৪টি বস্ত্রকল, ২২টি কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিসহ বন ও পরিবেশ, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইস্পাত খাতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ৩শ'টি ঢালাই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় এক লাখ মানুষ। গত ১৫ বছরে আড়াই লাখ তাঁতি বাধ্য হয়েছেন তাদের পেশা ছেড়ে দিতে। এধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে দেয়া যাবে না। ব্যবসা বাণিজ্যকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যা য়ে গুরুত্ব দিতে হবে। ড. মুহম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের সমাজের প্রবণতাই হল ব্যবসা-বাণিজ্যকে পরিবেশের শত্রু হিসেবে চিন্তা করা। ব্যবসাকে এভাবে দোষ দেওয়াটা অবশ্য অবাক করা কোন ব্যাপার নয়। বিশ্বের সমস্ত ভুলের দায় ব্যবসার ঘাড়ে তুলে দেওয়া বেশ সহজ। এমন ঘটে কারণ বেশিভাগ সময়ই ব্যবসায়ীরা পৃথিবী ও মানুষের কী ক্ষতি হতে পারে তা ভুলে গিয়ে, ব্যবসাকে যতবেশি সম্ভব টাকা রোজগারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। যাইহোক, মনে রাখা উচিত, ব্যবসা আসলে তাই, যা মানুষ ব্যবসাকে দিয়ে করাতে চায়। আপনি যদি মানুষের সমস্যা সমাধান করতে চান, তবে ব্যবসা আপনাকে তা করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু মানুষ ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবসাকে এমন পথে পরিচালিত করে যা মানুষের ক্ষতি করে।’



জনশক্তি রপ্তানি বাড়ানো: বাংলাদেশের সবচাইতে বড জনশক্তি রপ্তানিকারক অঞ্চল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। কিন্তু সেখানেও জনশক্তি রপ্তানীতে বড বিপর্যয়। ভিসা জটিলতার কারণেও অনেক প্রবাসী বাঙ্গলী দেশে ফেরত এসেছেন, কেউ অবৈধ হয়ে গেছেন। জনশক্তি রপ্তনিতে ব্যার্থতা হচ্ছে সরকারের চরম কুটুনৈতিক ব্যার্থতা। এই ব্যার্থতার ভার বহন করে চলছেন দেশের বেকার যুবকরা। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার অবকাঠামো আরো পরিবর্তন করা দরকার এবং দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীল ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের উৎপাদণশীল প্রতিষ্ঠানও খুবই কম। তাই উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান বাডাতে হবে, এই জন্য বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।



গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি: ডক্টর জাফর ইকবাল বলছেন, ‘শিক্ষা এবং গবেষণার জন্যে সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে সেটা একটা কৌতুকের মতো! এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পিএইচ-ডি করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসত তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত”। যুক্তরাজ্যের রয়েল সোসাইটির উপাত্ত অনুসারে ২০১১ সালের গবেষণা খাতে কতগুলো দেশের মোট খরচের পরিমান হলো এরকম (মার্কিন ডলারে)। ব্রাকেটে প্রতিটি দেশের গবেষণায় বরাদ্ধ জিডিপির শতকরা অংশও তুলে ধরা হলো। ইথিওপিয়া ১০ কোটি (০.১৭%), ভিয়েতনাম ৫০ কোটি (০.১৯%), মালোয়শিয়া ২৬০ কোটি (০.৬৩%), পাকিস্তান ৩৬৭ কোটি (০.৬৭%), সিঙ্গাপুর ৬৩০ কোটি (২.২%), তুরস্ক ৬৯০ কোটি (০.৭%), ভারত ৩৬১০ কোটি (০.৯%), দক্ষিন কোরিয়া ৫৫৮০ কোটি (৩.৭%), চীন ২৯৬৮০ কোটি (১.৯৭%) আর যুক্তরাষ্ট্র ৪০৫৩০ কোটি (২.৭%) মার্কিন ডলার খরচ করেছে। বেদনাদায়ক সত্য হলো আজ বাংলাদেশ জিডিপির ০.০২% চেয়েও কম খরচ করছে গবেষণায়। গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।



শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযুগী করা: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পিপিআরসি-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার নিশ্চয়তায় এখন কী ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন সেদিকে নজর দেয়ার সময় এসেছে। কর্মসংস্থানের চাহিদা ও শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে একটি জাতীয় সমন্বয় (ম্যাচিং) প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সমন্বিত একটি নীতিমালার আলোকে শিক্ষালয় স্থাপনের অনুমোদন ও তা সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখা জরুরি। সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থায় গুণগত মানও নিশ্চিত করতে হবে। এসিআই গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (অ্যাগ্রোবিজনেস) ফা হ আনসারী বলেন, সাধারণ কিছু পদের বিপরীতে কয়েক গুণ আবেদন জমা পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে আবার আবেদনকারীর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। দেশের ডিগ্রিগুলো বিষয়ভিত্তিক না হওয়ায় নিয়োগদাতা হিসেবে দক্ষ কর্মী বাছাই করতে হিমশিম খেতে হয়। আবার শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো ব্রড বেজড থাকায় শিক্ষার্থীরা পেশাগতভাবে শতভাগ দক্ষ হতে পারছে না। এ ধরনের অসামঞ্জস্যতা দূর করতে সিলেবাসে পরিবর্তন আনাসহ প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি।



সামাজিক ব্যবসা প্রসঙ্গ

ড. ইউনূস তার নতুন ধারণা Social Business এর তাত্ত্বিক রুপ দিয়েছেন, Building Social Business: The New Kind of Capitalism that Serves Humanity’s Most Pressing Needs’ বইটিতে। সামাজিক ব্যবসার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এক বা একাধিক সামাজিক সমস্যা সমাধানে ভুমিকা রাখা। সামাজিক ব্যবসার ৭টি মূলনীতি হচ্ছে, ১. সামাজিক সমস্যার উদ্দেশ্য সমস্যার সঠিক সমাধান, মানুষের উপকার করা, কোনো ব্যক্তিগত লাভ না নেয়া। ২. সামাজিক ব্যবসায় যথাযথ পুঁজি বিনিয়োগ ও আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক পর্যারয়ে রাখা। ৩.উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারী কোনো লাভ নেবেন না। বিনিয়োগকৃত অর্থ শুধু পর্যাষয়ক্রমে ফেরত নিতে পারবেন। ৪. বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরৎদানের পর কোম্পানির লাভ ঐ কোম্পানির সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্য খরচ হবে। ৫. পরিবেশকে দূষিত করে কোন ব্যবসা করা যাবে না। ৬. প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের বেতন ভাতা হবে ন্যায়সঙ্গত, বাজার চাহিদা অনুযায়ী। ৭. এ ব্যবসায় উদ্যোক্তারা আনন্দের সাথে প্রকল্প গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবেন।



উপসংহার:

বেকারত্বের এই সমস্যা-সংকট দেশে একদিনে তৈরি হয়নি। এই মূহূর্তে বেকারত্ব নিরসন যেমন অপরিহার্য, তেমনি ভবিষ্যতে বেকারত্ব কোন পর্যায়ে পৌছতে পারে, তার নিরিখে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণও সমভাবে প্রয়োজনীয়। বেকারত্বের হার বাড়ছে, এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই যুবা এবং তাদের মধ্যে ৪০ থেকে ৪২ ভাগই বেকার। পরিল্পনা কমিশন ও জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপির গবেষণা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দেশে কর্মক্ষম যুবক-যুবতীর সংখ্যাই দাঁড়াবে সাড়ে তিন কোটি। বেকারত্বের হার বর্তমান অবস্থায় রাখতে হলে এ সময়ের মধ্যে এক কোটির উপর যুবক-যুবতীকে চাকরি দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতি, বেকারত্ব এবং আই এমএফ ও দাতাদের দ্বারা আমাদের “মুরগী” বানানোর প্রক্রিয়া যদি আমরা বুঝি এবং আমরা যদি জেগে না ঘুমাই- তাহলে আমাদেরও উচিৎ কর্মসংস্থান ও সামাজিক খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়াগ নিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করা। এর জন্য প্রয়োজনে ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করা এবং উদার আমদান নীতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা। বেকারত্ব শুধু একটি সরকারকে নয়, একটি দেশকেও বিপদে ফেলতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ইন্ধনদাতার অভাব হবে না। তাই আসুন আমরা সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে গুরুত্ব দেই, সামাজিক ব্যবসায় উৎসাহী হই এবং বেকারত্বের অসহায়ত্বমুক্ত সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ে তুলি।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.